অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤পর্ব_১৩

অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤পর্ব_১৩
#কায়ানাত_আফরিন

ফারহানকে হঠাৎ সেই মেয়ের দিকে এতটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখজোড়া ক্রমশ যেন ছোট হয়ে আসলো সাব্বির আর শামসুর। কেননা ফারহানের এমন দৃষ্টির সাথে দুজনেই অপরিচিত। বলা বাহুল্য , ফারহান গম্ভীর ধাঁচের মানুষ। নিজের কাজে আত্ননিয়োগ করতেই ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মানুষদের প্রতি নজর দেওয়ার মতো ফুরসত যেন এই সুদর্শন যুবকটির নেই। শামসু সন্দিহান কন্ঠে সাব্বিরকে বললো,

-এই সাব্বির! ভাইয়ের কি হইলো আবার?

-কে জানে?আমি নিজেও তো বুঝতেসি না।

আফরা তখন এখানকার সব জনপ্রিয় খাবারগুলোর বিষয় নিয়ে ফাহিমের সাথে মশগুল ছিলো। হঠাৎ এক কোণে চোখ পড়তেই আফরার আলাপচারিতা বন্ধ হয়ে যায়।এত শোরগোল আর এত মানুষের ভীড়ে মানুষটার অবাকমিশ্রিত তীক্ষ্ণ চাহিনী সহজেই নজর কাড়ার মতো। মানুষটা ফারহান। শ্যামবর্ণের গায়ে কালো শার্টের আবরণ , উপরের দুটো বোতাম খুলে সানগ্লাস ঝুলিয়ে রেখেছে। হাতে মোটা বেল্টের খয়েরি ঘড়ি,আর বরাবরের মতোই কানে ব্লুটুথ ইয়ারফোন। ঠোঁটকোলের স্মিত হাসি আর এমন রূপ দেখে আফরা অনুভব করলো ওর বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ যেন ক্রমশই বেড়ে চলছে।ফাহিম আফরাকে এতটা অন্যমনষ্ক হতে দেখে বললো,

-এনি প্রবলেম আফরা?

ফাহিমের কথার দিকে আফরার ধ্যান নেই। সে বিস্ময় নিয়ে ফারহানের উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলে। এদিকে দুদিকে বসে থাকা শামসু আর সাব্বির তো খুশিতে আটখানা। দাঁত কেলিয়ে শামসু সাব্বিরকে বললো,

-ঐ সাব্বির দেখ ! মাইয়্যাটা আমায় ‘হ্যালো’ বলসে…….

-আরে না। আমারে হ্যালো বলছে সে। তোর যেই চেহারা……তোরে ভালোমতো দেখলে তো মাইয়্যা ডরে পালাইবো।

ঠোঁট টিপে হাসলো ফারহান। দুজনের কথাবার্তা শুনে চোখে-মুখে ব্যাঙ্গাত্নের ছাপ। এই গর্দেভ দুটো বুঝতে পারিনি যে অপরূপ সুন্দরী এই মেয়েটি ফারহানের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করেছে। তবুও ফারহান কিছু বললো না। সেও ঠোঁট চেপে হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানালো আফরাকে যা সাব্বির-শামসু খেয়াল করেনি আফরার দিকে তাকিয়ে থাকার কারনে।

আফরার হাত নাড়ানো দেখে পেছনে ফিরলো ফাহিম আগন্তুকটিকে দেখার জন্য। সেখানে ফারহানকে দেখে সেও স্মিত হাসলো। প্রফুল্লস্বরে বললো,

-আরে ফারহান ! তুমি এখানে হঠাৎ?

-লাঞ্চ করতে এসেছিলাম।

ফারহানের শীতল প্রতিউত্তর। এদিকে আফরা নামের অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটার সাথে ফারহানের ছয় মাসের ছোট কাজিন ফাহিমকে দেখে মুখ কালো হয়ে গেলো শামসু আর সাব্বিরের। সাব্বির হাহাকার করে বললো,

-ইয়া মাবুদ! এই ছোকরা এদিকে কি করে?

-ওই আস্তে বল…….ফারহান ভাই যদি শোনে , তুই ফাহিম ভাইকে ছোকরা কইছস , তোরে ধইরা পিটাইবো।

ফিসফিস করে বললো শামসু।ফাহিম কিছু বলার আগেই আফরা মৃদু স্বরে ফারহানকে বললো,

-যদিও আমাদের লাঞ্চ শেষ পর্যায়ে,,,,,,,,,আপনিও চাইলে জয়েন হতে পারেন ফারহান।

-ইটস ওকে। আমরা এখানেই ঠিক আছি।

হঠাৎ শামসু-সাব্বির ফিসফিসিয়ে বললো,
-ভাই না কইরেন না। এত সুন্দর মেয়ে আপনাকে লাঞ্চের জন্য ডাকছে আর আপনি?আমি থাকলে সাথে সাথেই রাজি হয়ে যেতাম।

ফারহানের মজা লাগছে ওদের এমন কান্ড দেখে। যদি এই দুই সাগরেদ জানে যে আফরা মেয়েটা আজ ওর বাসায় ডিনার করতে আসবে তবে তো পাগলই হয়ে যাবে। তবুও ফারহান মৌনতা কেটে বললো,

-ঠিক আছে। আপনার কথা রাখলাম আফরা।

-থ্যাংক ইউ। আর এইযে,,,,,,দুই সিপাহী!আপনারাও আসেন।

শামসু আর সাব্বিরের খুশি আর দেখে কে। তারপর কথামতো ওরা তিনজন বসে পড়লো ফাহিম আর আফরার সাথে। আফরা লাঞ্চ শেষ করে ডেজার্ট হিসেবে একটা চীজ কেক অর্ডার দিলো। ফারহান কথাবার্তা না চালিয়ে লাঞ্চ করছে শান্তভাবে। ফাহিম এবার ফারহানের উদ্দেশ্যে বললো,

-তো ফারহান! ইদানীং তো দেখাই যায় না তোমায়। দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

-এজ অলয়েজ যেমন যায়।

-স্ট্রাইক নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি?

কথাটি একটু আস্তে বললো ফাহিম যাতে আফরা নজর দিতে না পারে। ফারহান বুঝতে পারলো ফাহিমের চিন্তিত হওয়ার কারন। ব্যস্ততার জন্য খুবই কম কথা বলার সময় পায় ফাহিম আর ফারহান। বাড়িতেও পারিবারিক সংঘর্ষ আর মিসেস নাবিলার ক্রোধের শিকার হয়ে দুজন কথা বলতে পারে না। স্ট্রাইক বা অন্য কোনো ঝামেলা হলে ফারহান প্রায়ই আঘাতপ্রাপ্ত হয়…দিনের সময়ে ফারহান অনায়াসে ফাহিমের চেম্বারে গেলেও মধ্যরাতে ফারহানকে জানালা টপকে ফাহিমের ঘরে যেতে হয়। সেরাত স্ট্রাইকে পুলিশের আঘাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফারহান জানালা টপকে ফাহিমের কাছে আসতে চেয়েছিলো কিন্ত দেখা হয়ে যায় আফরার সাথে। ফাহিম হয়তো কোনোভাবে জেনে গিয়েছে যে সেরাতে ফারহান আঘাত পেয়েছিলো। তবে আফরার কথাটি এড়ানোর জন্য ফারহান শীতল কন্ঠে বলে,

-রিলেক্স ফাহিম। আমি সেরাত ডক্টরের কাছে চলে গিয়েছিলাম।

ফারহানের কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো ফাহিম।মাঝে মাঝে নিজের মায়ের অদ্ভুত সব কাজকর্মের জন্য এই মানুষটার সঙ্গে দুরত্ব হয়ে গিয়েছে ওর। এতটাই দুরত্ব…….যা কখনোই কাটিয়ে তোলা যাবে না।
.
.
লাঞ্চ সেড়ে সবাই বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে।দুপুরের কড়া প্রহর ঢলে বিকেল নেমেছে। তরতাজা বাতাসের সমন্বয়ে মোহময় পরিবেশ। ফারহান মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমি তাহলে এবার আসছি…..

-কোথায় যাচ্ছো ফারহান?
ফাহিম জিজ্ঞেস করলো।

ফারহান মৃদু প্রতিউত্তরে বললো,
-ব্যাংকে যাচ্ছি টাকা তুলতে।

ফাহিম এবার আর কিছু বললো না ফারহানকে। আফরার উদ্দেশ্যে বললো,

-তো চলুন এবার। আপনাকে বাসায় ড্রপ করে চেম্বারে চলে যাবো।

-ওকে। আপনি পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে আসুন। আমি এখানেই দাঁড়াই।

ফাহিম তাই চলে গেলো গাড়ি আনতে। সাব্বির আর শামসুও ইতিমধ্যে সেখানে গিয়েছে। রেস্টুরেন্টের এক কোণের এই ভিউ পয়েন্টটি এককথায় চমৎকার। দমকা বাতাসে আফরার খোলা চুলগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করছে ফারহানের মনে। তবুও প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। আনমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সাব্বির আর শামসুর আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। আফরা ঠোঁটে সুক্ষ্ণ হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। হাত জোড়া পেছনে আকড়ে বারবার দেখছে ফারহানকে। একপর্যায়ে ধৈর্যহীন হয়ে বললো,

-এইযে মিঃ কমরেড?

জনসমাগমে আফরার এভাবে কমরেড ডেকে ওঠাতে ফারহানের চোখজোড়া ক্রমশ সুক্ষ্ণ হয়ে এলো। তাই মোবাইল পকেটে গুজে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,

-এভাবে সবার সামনে কমরেড ডাকার মানে কি?

-তো কমরেড কে কমরেড বলবো না তো কি অন্যকিছু বলবো? যদিও আপনার আরেকটা আছে। রেইনকোর্টম্যান!

আফরার চোখেমুখে দুষ্টু হাসি। ফারহান হাল ছেড়ে দিলো। এই মেয়ের সাথে কথায় পেরে ওঠা বড়ই দুষ্কর । আফরা এবার কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এলো ফারহানের কাছাকাছি। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,

-রাতে কিছু আপনার হন্টেড হাউজে আসছি মিঃ কমরেড।

ফারহানের মেরুদন্ড দিয়ে যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো আবার। হৃদস্পন্দন ক্রমশই যেন বেড়ে যাচ্ছে। ফাহিম গাড়ি নিয়ে আসাতে আফরা মৌনভাবে চলে গেলো এবার। যাওয়ার আগে ফারহানের দিকে তাকিয়ে গেলো একপলক। ফারহান স্মিত হাসে আফরার এমন কাজে।

——–
চারিদিকে নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার। ওপাশের বাশঝাড় থেকে কেমন যেন ভুতুড়ে শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে। দরজাটা খোলা রেখেছে ফারহান। তাই পূব দিকের হাওয়া দরজা বরাবর বারি খেতে মগ্ন। পর্দা উড়ে চলছে হালকাভাবে। ফারহান নিজের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে দ্রুত বাড়ি ফিরে এলো আজ। একটা ঠান্ডা গোসল সেরে জলপাই রঙের টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার পড়ে নিলো। ফারহান যদিও গোছালো মানুষ তবুও অতিথি আসবে বসে দুই রুমের এই ছোট ঘরটি আবার গুছিয়ে নিলো।রাতের খাবারের জন্য রান্না করেছে অনেক ধরনের খাবার। ফারহান জানেনা যে আফরা বাঙালি খাবারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কি না তাই সে ইটালিয়ান ফুড রান্না করলো। টমইয়াম স্যুপ সাথে বেড ক্রাম্ব আর ইটালিয়াল রেড সস পাস্তা। আজ একা থাকে বলেই এত ধরনের রান্না জানে সে। হঠাৎ মিসেস নাবিলাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করলো এই প্রসঙ্গের জন্য।

-আসতে পারি মিঃ কমরেড?

মেয়েলি সুরে পিছনে ফিরে দরজার দিকে তাকালো ফারহান। আফরা দাঁড়িয়ে আছে। একটা হালকা গোলাপি রঙের কূর্তি পড়াতে সুন্দর লাগছে তাকে। ফারহান মৃদু হেসে বললো,

-অবশ্যই।

আফরা প্রবেশ করলো ছোট্ট কুটিরটিতে। ওর নিজের ভাষায় যেটাকে বলে হন্টেড হাউস।ফারহান টিশার্টের ওপর এপ্রোন পড়ে আছে। রোদে পোড়া সবল শ্যামবর্ণের চেহারা। শক্ত চোয়াল। ঘামের কারনে কপালে কালো নরম চুলগুলো দূর্বাঘাসের মতো লাগছে। আফরার মন উথাল-পাতাল করছে এমন অবর্ণণাতীত সৌন্দর্য দেখে। অজান্তেই মানুষটার চুলগুলোতে হাত ছোয়ার মতো ভয়ঙ্কর ইচ্ছে চলে আসছে বারবার। ফারহান আসলেই নিঃসন্দেহে ভীড়ের মাঝে এক নজর কাড়ার মতো ব্যাক্তিত্ব। ভাবতেই আফরার মনে এবার অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে থাকলো।

.
.
.
.
#চলবে……..ইনশাআল্লাহ

[ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here