#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤পর্ব__৩১ [দ্বিতীয়াংশ]
#কায়ানাত_আফরিন
রৌশিন আর ইলা মার্কেটের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো। একপাশে বিশার ভীড়। জণগণের ঠেলাঠেলিতে রীতিমতো উপচে পড়ছে সবাই সেদিকে। ভিড়ভাট্টা রৌশিনের কখনোই পছন্দ না। অগত্যাই সে চেয়েছিলো জায়গাটি কোনোভাবে অতিক্রম করে গিফট শপের কাছাকাছি যেতে। কিন্ত বাধঁ সাধলো ইলা। মেয়েটা বরাবরই কৌতুহলপ্রবণ। ওদিকটায় কি হয়েছে না জেনে ও যাবে না। রৌশিন এবার ইলাকে বুঝিয়ে বললো,
-দেখ্ ইলা , আমাদের এভাবে ভিড়ভাট্টায় যাওয়াটা উচিত হবে না। এমনিতেও এসব জায়গাতেই কিছু লোভী পুরুষ স্পর্শ করার পৈশাচিক আনন্দ খুঁজে। তুই কি ভুলে গিয়েছিলি যে কলেজে সেবার কি হয়েছিলো?
ইলার মনে পড়ে গেলো সেদিন কলেজের কথা। নির্বাচনের আগ মুহুর্তে কলেজের পরিবেশ কিছুটা উত্যপ্ত ছিলো আর সেসময় আফরা আর ও কৌতুহলবশত প্রধান ভবনের কাছাকাছি যাওয়াতে একদল লোক ওদের বাজেভাবে স্পর্শ করেছিলো। বিষয়টা ফারহানের কানে যাওয়াতে যেই ভয়ঙ্কর আঘাত দিয়েছিলো ওদের, এই কারনে সারা কলেজে বিষয়টা দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়। রৌশিন আর মারুফও সেখান থেকে বাদ পরেনি। ইলা এবার শান্ত হলো। মনক্ষুন্ন হয়ে মার্কেটের দিকে এগোতেই ওর কানে গেলো যে শুটিং চলছে এখানে। তাও আবার কোনো এক ওয়েব সিরিজের।
ব্যস ইলাকে আর পায় কে। পারলে রৌশিনকে ছেড়েই হতদন্ত হয়ে সেদিকটায় ছুটে চলে যায়। রৌশিন বহুবার থামানোর চেষ্টা করেও পারলো না। তাই বাধ্য হয়ে ওকেও যেতে হলো সেদিকটায়।
দেশের বিখ্যাত দুই অভিনেতা অভিনেত্রীর ওয়েব সিরিজের শুটিং এখানে হওয়াতে ভীড়ভাট্টা নেহাত কম নয়। রৌশিন আর ইলা অপার পানে সেদিকটায় তাকিয়ে ছিলো। এতদিন ওরা টিভি স্ক্রীনের সামনের পর্দা দেখেছে। তবে পেছনের পর্দায় এধরনের দৃশ্য ওদের কাছে অদেখা। লাইটিং, মেকআপ, অ্যাকশন , কাট সবকিছুই নতুন লাগছে ওদের কাছে। হঠাৎ ওরা খেয়াল করলো এক মধ্যবয়স্ক লোক একজনের সাথে প্রচন্ড রাগারাগি কযছে। সম্ভবত উনি এই সিরিজের ডিরেক্টর। অনেকটা ক্রুব্ধ গলায়ই উনি সামনের ব্যাক্তিকে বলছেন,
-‘এতটা ইরিসপন্সিবল কিভাবে হতে পারো তোমরা? জানো পাবলিক স্পটে শুটিং করাটা কত চ্যালেন্জিং? এর মধ্যে একজন কো আর্টিস্ট হুট করে বললো আসবে না। মানে ,,,,, আমি কি সিরিয়াসলি কোনো শুটিং করাচ্ছি?’
লোকটির কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই চোখ গেলো রৌশিনের দিকে। রৌশিন স্তব্ধ। কেননা লোকটা বেশ অদ্ভুতভাবেই তাকিয়ে আছেন। অতঃপর উনি হাত বাড়িয়ে বললেন,
-তুমি একটু এখানে আসো তো মা?
রৌশিন কিছু বুঝলো না। তবে জ্ঞানবোধের দরুন সে গার্ডদের পাড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো উনার দিকে। লোকটা আড়ষ্ট কন্ঠে বললেন,
-তুমি এক্টিং করতে পারো?
-জ্বী,,,,,,,,,,মানে , কলেজের থিয়েটারেই যা একটু আধটু করেছি।
অপ্রস্তুতভাবে কথাটি রৌশিন বললেও লোকটি যেন অমাবস্যায় পূর্ণিমা পেয়ে গেলো। খুশিতে আপ্লুত হয়ে সে বলে ওঠলেন,
-আসলে, আমাদের ওয়েব সিরিজের এক কো আর্টিস্ট হঠাৎ করেই আজ আসেননি। তোমায় শুধু ওর জায়গায় ছোটট একটা রোল প্লে করতে হবে। বেশি কিছু না , তুমি নায়কের কাছে যাবে আর চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলবে যে অমি চিঠিটা দিয়েছে আপনাকে। অমি হলো নায়িকার ক্যারেক্টারের নাম।
সিনটা ছোট। তবে নেহাত গুরুত্বহীন নয়। এই সিনটার ওপর ভিত্তি করেই হয়তো পুরো ওয়েব সিরিজটা সাজানো হয়েছে। তাই বিচলিত ডিরেক্টর সাহেব।এদিকে রৌশিন কিছুটা চিন্তিত। একেতো মারুফের গিফট কেনা এখনও হয়নি তার ওপর এই লোকের অনুরোধ অগ্রাহ্য করাটাও ওর শরীর সায় দিচ্ছে না। তাছাড়া এত বড় দুই অভিনেতার সাথে ছোট একটা সুযোগ মিস করার কোনো মানেই হয়না। তবুও মারুফের কথা ভেবে রৌশিন না বলতে চাইলেও বাঁধ সাধলো ইলা। বললো, গিফট আর ওর সারপ্রাইজ হিসেবে টাঙ্গুয়ার হাওরের ট্যুর ফাহিমের সাথে ও ম্যানেজ করবে। তবুও রৌশিনকে ও এই চান্সটা মিস করতে দেবে না।রৌশিন তাই পরিশেষে রাজি হয়ে গেলো চরিত্রটিতে অভিনয় করতে।
_________________________
লাউয়াছড়া বনের সীমানাপ্রাচীর পেরিয়ে উত্তরধার দিয়ে চলে গিয়েছে একটা সুন্দর পিচঢালাই রাস্তা। ফারহান আফরাকে নিজের কথার মোহে ফাসিয়ে শেষমেষ নিয়েই এলো ওর পছন্দের জায়গাটিতে। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সেই সাথে প্রবাহমান একধরনের শীতল ঠান্ডা বাতাস।দুধারে অবস্থিত দেবদারু গাছের উচ্চতার মোহে আফরা পাগল হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়সমান পাইনগাছের সৌন্দর্যগুলো তো দুর্বিষহ। আফরা বৃষ্টির পানিতে ভিজতে থাকলো একটু একটু করে। তাকালো ফারহানের দিকে। ছেলেটাকে আচ্ছন্নময়ী লাগছে। ওর সিক্ত জুবুথুবু সুঠাম দেহের গঠনে যে কেউ নেশাময় হতে বাধ্য। কি আছে এই ছেলেটার মধ্যে? যা ওদের প্রথম সাক্ষাত থেকেই আফরাকে ভাবুক করে তুলেছে। ফারহান নির্বিকার। চোখের মায়াময় শীতল দৃষ্টি যেন আরও বেশি ঘোরযুক্ত। ঠোঁটজৈড়া সে হালকা নাড়িয়ে বলে ওঠলো,
-‘জায়গাটা ভালোলেগেছে?’
-আপনাকে তার থেকেও বেশি।
চমকপ্রদ হয়ে ওর দিকে তাকালো ফারহান। আফরা যেন নিজের মধ্যে নেই। ওর পুরো দৃষ্টিই কাঙাল হয়ে আছে ফারহানকে দেখার জন্য। ফারহান মাথা নত করে আশপাশ তাকালো। ভঙ্গিমায় নির্বিকারত্বের ছাপ। সে জানে আফরার মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো। জানে কতটা দুর্বল সে ফারহানের প্রতি। তবুও ফারহান পরোয়া করতে চায় না। ওর ধারনা, বিদেশিনী তো ! হয়তো ফিরে গেলেই সে মোহ কটে যাবে।তবে এখন ও নিজেও এই বিদেশিনীর প্রতি দিন দিন বৈরাগী হয়ে ওঠছে। কিন্ত সেদিন ফাহিম যে বলেছিলো ওর আফরাকে পছন্দ? হ্যাঁ,আফরা সেদিন রাগ করে চলে যাওয়ার পর ফাহিম এসেছিলো ফারহানের কাছে। বলেছিলো নিজের সুপ্তমনের কথা। তাহলে ভাই হয়ে কিভাবে প্রতারণা করতে পারবে সে?তবুও ফারহান নিজেকে আশ্বস্ত করলো, এটা কোনো ফ্যান্টাসী নয় যে সে ফাহিমের জন্য নিজের অনুভূতি ধামাচাপা দিয়ে ফেলবে। এটা একটা গল্প। এক বিদেশিনী আর তার থেকে অনুতিদূরে শ্রীমঙ্গলের এক মিঃ রেইনকোর্টম্যানের গল্প। তাকে যদি স্বার্থপর হতে হয় তবে হবে সে স্বার্থপর। কিন্ত স্যাক্রিফাইজ করতে পাবে না।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে তুমুল গতিতে। দুজন এবার দৌড়ে পথের একেবারে অন্তিম প্রান্তে চলে গেলো। এ যেন এক নিদারুন অনুভূতি। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে পুরো পথপ্রাঙ্গন নতুনত্ব ধারন করেছে। আফরা ভিজে টুইটুম্বুর। সেই সাথে ফারহানও। উন্মাদনা দুজনকে পাগলপ্রায় করে দিচ্ছে। ফারহান এবার জিজ্ঞেস করলো,
-‘কদন ফুল লাগবে?’
-‘হ্যাঁ।’
ফারহান পথের একপাশ থেকে গাছ থেকে ফুল ছিড়ে পড়িয়ে দিলো আফরার কালচে বাদামী চুলে। ভেজা চুলের সাথে তা লেপ্টে অপাররূপ ধারন করেছে। ফারহান বিমূঢ়। মেয়েটাকে এই রূপে ভয়ংকর আবেদনময়ী লাগছে। নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে ফারহান। তবুও বেড়াজাল পাড়ি দিয়ে সে হঠাৎ আফরার হাত টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। ওর দৃষ্টি প্রখর। আফরা তাই অবাক হলো এই ফারহানকে দেখে। ফারহান এবার বলে ওঠলো,
-‘আপনি রূপ তেজস্বী আফরা, আপনার সবকিছু আমায় ঘোরে ফেলে দিচ্ছে। আজ আমাদের সম্পর্ক আরও একধাপ উপরে উঠলো এই বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে। আপনি খুশি তো রূপ তেজস্বী?’
‘রূপ তেজস্বী’ এর মানে কি আফরা জানে না। তবে ফারহানের শীতল কন্ঠে এই কথাটি ঐর সর্বাঙ্গে প্রেমের স্রোত বয়ে দিয়েছে। নিজেকে মনে হয়েছে কিশোরী যার মনে সবসময় উৎফুল্লতা। ফারহান মানুষটা হয়তো গম্ভীর। তবে নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য সে ততটাই উন্মাদ হতে পারে যতটা আজ তার দৃষ্টি আফরার জন্য হচ্ছে। আফরা বুঝতে পেরেছে ওর এসব পাগলামির মানে। হ্যাঁ এটাই প্রেম। অতঃপর এটাই ওর প্রেমের গল্প❤…..
.
.
.
~চলবে,,ইনশাআল্লাহ!
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।