অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
পর্ব___২৭
#কায়ানাত_আফরিন
‘শ্রীমঙ্গল গভর্নমেন্ট কলেজ’ এর সদর কোঠাটি দৃষ্টি নান্দনিক। কলেজের টাইম শেষ হওয়ার পর হরদমে ছাত্র-ছাত্রীরা কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আজকে টানা এতক্ষণ ক্লাস করার পর বেশ ক্লান্ত ইলা-রৌশিন আর মারুফ। গরমের সময় এতক্ষণ কলেজের পোশাক পরে থাকাতে বিরক্তিও ভর করেছে ওদের মধ্যে। ইলা ক্লান্তস্বরে বললো,
-‘আল্লাহ ! গরমে সেদ্ধ হয়ে গেলাম রে আমি। এত গরম তো কখনোই পড়েনা ! আজ এত অস্থির লাগছে কেনো?’
মারুফ তা শুনে ভ্রু কুচকালো । ইলার চুল টান মেরে বলে ওঠলো,
-‘ভাব তো তুই এমন করতাসোস যে এই দুনিয়াতে তোরই শুধু গরম। আমারে দেখ্, মনে হইতাসে যে খালের থেইক্যা ঝাপ দিয়া আসলাম।’
ইলা আর মারুফের এধরনের হাতাহাতি নতুন কিছু না। রৌশিন তাই সেসব দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠলো। ইলা কাদো কাদো স্বরে বললো,
-‘তুইও এই দেওভূতটার মতো হাসোস কেন্ পেত্নী? এখন এই চেহারা নিয়ে কিভাবে দেখা করবো আমি সাব্বিরের সাথে?’
মারুফ হাসি চাপিয়ে সিরিয়াস হওয়ার ভান করলো। তারপর রৌশিনের কাধে হেলান দিয়ে কাব্যের ন্যায় বললো,
-‘শোন ইলা ! কথায় আছেনা,,,’প্রেম রূপ দিয়ে হয়না,আর রূপ হয়না প্রেম দিয়ে। রূপ হলো উপভোগ্য বিষয়। আর প্রেম ! সেটা হলো মনের বিষয়।’
-‘এমন আজাইরা কথা কই থেইকা পাস তুই?’
ক্ষীপ্ত হয়ে বললো ইলা। মারুফ কলার ঠিক করতে করতে বললো ,
-‘কোথা থেকে আবার? আমার আইনস্টাইন ব্রেইন থেকে। তাছাড়া একটা কথা , সেই তোর আসল প্রেমিক যে তোর এই কামের বেডি রূপ দেইখাও ভালোবাসবো। তাহলে সাব্বির ভাইয়ের কাছে যাবি এত লজ্জা পাস কেন্? ভয় হয় যে ভাই তোর রূপ দেইখা পালাইবো?’
বিদ্রুপ করে বলে ওঠলো মারুফ। ইলা না পারছে সইতে না পারছে কিছু করতে। একপর্যায়ে ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠলো,
-‘তোর বা** মুখ থেইকা আর একটা কথা বাইর করবি,, কসম আমি খুন কইরা ফেলমু তোরে।’
মারুফ বুঝছে ভালো ক্ষেপেছে এই মহিলা। রৌশিন মারুফের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
-‘আর রাগাইস না বেচারিরে। নাহলে সত্যিই তোরে খুন কইরা ফেলবো।’
মারুফ তাই ক্ষেপালো না আর। ওরা তিনজন হাটতে হাটতে এবার কলেজের অনতিদূরে খালের কাছটাতে এসেছে। এখানে ওদের মতো বহু বন্ধুবান্ধরাই এসে পড়ে হৈ হুল্লোড় করে আড্ডা দিতে। দক্ষিণ পাশে অবস্থানরত এই খালটিতে প্রচন্ড বাতাসের সমারোহ। পাশের রাস্তা দিয়ে সা সা করে যানগুলো মৌলভিবাজার আর সাতগাঁও এর পথ ধরে ছুটে চলছে। রৌশিন এবার বলে ওঠলো,
-‘কি রে ইলা, তুই না বললি সাব্বির ভাই আসবে এখানে? কোথায় উনি?’
-‘আশেপাশেই আছে মেবি। চল খুঁজে দেখি।’
অল্পসময়ের মধ্যেই তিনজন পেয়ে গেলো সাব্বিরকে।ইলার তো খুশিতে চকচক করছে মুখশ্রী। তবে সাব্বিরের ভাবখানা বুঝা যাচ্ছেনা মাস্ক পরিহিত বলে। সাবধানতার জন্য সাব্বিরকে সবসময়ই মাস্ক পরে থাকতে হয়। এমনিতেও ছাত্ররাজনীতি করে তার ওপর এখানকার এক বড় রাজনীতিবিদ ‘ফারহান জুবায়ের’ এর ব্যাক্তিগত মানুষ। ওর মতো মানুষকে যদি রাস্তাঘাটে এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ের সাথে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় যে কি-না ফারহানের আপন চাচাতো বোন, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কেউ ভালো চোখে দেখবে না।
রৌশিন এবার ইলার কাধে স্পর্শ করে টিটকারি সুরে বললো,
-‘আমি আর মারুফ ফুচকা খেয়ে আসি। তুই নাহয় ভাইয়ের সাথে একটু টাইম স্পেন্ড কর্।’
ইলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই মারুফ আর রৌশিন চলে গেলো ওদেরকে একা রেখে। এখানে কলেজের পর স্টুডেন্টরা অনেকেই আড্ডা দিতে চলে আসে। সবাই তাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। কে কি করছে সেদিকে কারও কোনো খেয়াল নেই। ইলা বড্ড খুশি আজকে। কেননা অনেকদিন পর সাব্বিরকে সামনা-সামনি দেখতে পেলো সে। ওদের শেষ সাক্ষাত হয়েছিলো আফরার অ্যামেরিকা থেকে আসার পর দ্বিতীয় দিনে যেদিন ফারহান ওদের বাইরে নিয়ে গেলো। আফরাকে সে মিথ্যে বলেছিলো যে সাব্বিরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।
আজ সাব্বির আর ইলা দুজনেই বেশ প্রাণোচ্ছল। এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে ওদের মধ্যে। মারুফের সাথে ফুচকা খাওয়ার ফাক-ফোকরে রৌশিন আড়চোখে দেখছিলো এই প্রেমময় জোড়াটিকে। সাব্বির একটু বেখেয়ালি ধরনের হলেও ইলার প্রতি ছেলেটার অনুভূতি অনেক গভীর। রৌশিন অগোচরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর শূণ্য হৃদয় অজান্তেই ফাহিম নামক মানুষটির জন্য হাহাকার করে বেড়াচ্ছে।
_____________________________________
আফরা গাড়ির থেকে মাথা বাহিরে নিয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো। কি সুন্দর ; তরতাজা হাওয়া। চা বাগানের মাঝ দিয়ে বিভিন্ন উপজাতিদের কর্মরত দেখে ওর মনে উত্তেজনায় ছেয়ে গিয়ছে। সাদা রঙের গাড়িটি সবুজ টিলার মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাওয়াতে দূর থেকে দেখতে অনন্য লাগছে। আফরা আড়নজরে পরখ করে নিলো ফারহানকে। ফারহান একধ্যানে গাড়ি চালাতে মগ্ন। চোখে কালো সানগ্লাস লাগানো থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সেই গম্ভীর মায়াবী চাহিনী সে পিচঢালাই পথের দিকে নিক্ষেপ করে রেখেছো। ঠোঁটজোড়া চেপে একটা আড়ষ্ট ভাব বিদ্যমান ওর মধ্যে। আফরা যে কি করছে সেদিকে মানুষটার যেন কোনো ধ্যানই নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। বলে ওঠলো,
-‘আপনি কত টাকা দিয়ে আপনার হাসি বিক্রি করেছেন?’
ফারহান কপাল ভাজ করলো এমন কথায়। আফরার দিকে না তাকিয়েই বললো,
-‘এ আবার কেমন প্রশ্ন? হাসি কি বিক্রি করা যায়?’
-‘তো কি বলবো আর? আপনার মুখে হাসি দেখতে পাওয়া ঈদের চাঁদের মতো একটা ব্যাপার।’
আফরা ব্যঙ্গাত্নক ভাবে বললো। ফারহান ওর কথা শুনে বললো,
-‘ঈদের চাঁদ অনেক প্রিসিয়াস হয় ম্যাম ! আমাকেও ঠিক সেরকমটাই মনে করতে পারেন।’
আফরা প্রতিউত্তরে বললো না কিছু। ফারহান গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে অন্যপথে গাড়িটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
-‘আপনার শখ কি আফরা?’
-‘ক্যাম্পিং এন্ড হাইকিং।’
আফরার মুখে উৎফুল্লতা। তাই আবার বলে ওঠলো,
-‘এ পর্যন্ত বহুবার হাইকিং আর ক্যাম্পিং করেছি ফ্রেন্ডসদের সাথে। আমি প্রচুর ট্রাভেল এডিক্টেড বলতে পারেন। সানি ওয়েদার পেলেই বিচে, পার্কে, লেকে ; কখনও দূর কোনো গন্তব্যে চলে যাই। তবে অ্যামেরিকার বাইরে বলতে শুধু ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছিলাম ২ বছর আগে। নাহলে অ্যামেরিকাতেই বেশি ঘোরাঘুরি হতো।একমাত্র সিয়াটল ছাড়া আমার মোটামুটি সবগুলো স্টেট ঘোরা শেষ।’
-‘ঘোরাঘুরিটা আমারও বড্ড পছন্দ। তবে সবসময় ঘুরতাম না। আমার কাছে ঘোরার জন্য বেস্ট এই আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। লাস্টবার বান্দরবান ঘুরে এসেছিলাম।’
আফরা ‘বান্দরবান’ নামটি উচ্চারণ করতে পারলো না ভালোমতো।বাংলাদেশে এই নামের যে কোনো জায়গা আছে এটাও ওর অজানা। তাই ও স্থির করে নইলো বাংলোতে ফেরার পরই নেটে আগে সে কাঙ্খিত জায়গাটি সার্চ দেবে। হঠাৎ একটা জায়গা দেখার পর গাড়ি থামাতে বললো আফরা। ফারহান তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামালো। জিজ্ঞেস করলো,
-‘এনি প্রবলেম আফরা?’
-আমি গাড়ি থেকে নামবো?’
-‘কিন্তু কেনো?’
ফারহান কৌতুহলী জিঙ্গেস করতেই আফরা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো পাশের স্চ্যাচুটি। শুভ্র রঙের কারুকার্য একটি মানবমূতি রৌদ্দুরের প্রতিফলনে অপরূপ লাগছে। সেখানে নিলো বাংলা গোটা গোটা অঙ্ক্ষরে লিখা,
‘মৌলভীবাজারে স্বাগতম।’
নিচে সুন্দর ইংরেজী কার্সিভ লেটারে লিখা,
‘Welcome to Moulovibazar’
জায়গাটি এককথায় মনোমুগ্ধকর। স্চ্যাচুর চারদিকে গোলত্র করে ঘাসের নরম আস্তরণ পড়া। আফরা জায়গাটিকে দেখিয়ে বললো,
-‘এখানে ছবি তুলবো আমি।’
ফারহান আর আফরা নামলো এবার। আফরা গলার মধ্যে আসার সময়েই একটা ক্যামেরা ঝুলিয়ে এনেছিলো। তারপর ক্যামেরাটা ফারহানকে দিয়ে বললো,
-‘আমার ছবি তুলে দিন।’
ফারহান কথামতো ছবি তুলে দিলো অনেকগুলো। ফারহানের সাথে মোবাইল বের করে আফরা আচমকা একটা সেলফি তুলাতে হতভম্ব হয়ে গেলো ফারহান। বললো,
-‘এভাবে সেলফি তুললেন কেনো?’
আফরা খানিকটা ফারহানের কাছে এগিয়ে এলো। গম্ভীর স্বরে বললো,
-‘কেনো যেন মনে হলো আপনার সাথে একটি হলেও আমার ছবি থাকা উচিত।কেননা একসময় এগুলোই শুধু স্মৃতি হয়ে বেড়াবে আমাদের!!’
আফরার ছোট্ট কথা দুটোর পরিসর অল্প হলেও গভীরতা অনেক।আফরা মৌনতা কাটিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো এবার। ফারহানও সেখান থেকে গাড়ি স্টার্ট করে এগিয়ে গেলো সাতগাঁওয়ের সেই বিলের উদ্দেশ্যে।
.
.
.
.
~চলবে…….ইনশাআল্লাহ