অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤ পর্ব___৩৫

অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
পর্ব___৩৫
#কায়ানাত_আফরিন

রৌদ্দুরের কড়া উত্তাপে তপ্ত আশপাশ। কাঠফাটা রোদে চা বাগানটা দেখতেও কেমন যেন মলিন মনে হচ্ছে। আফরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে কিচেনে কথা বলতে ব্যস্ত মিসেস নাবিলার সাথে। উনি সবেমাত্রই টেবিল গুছিয়ে গাছিয়ে সব রান্নাঘরে রেখেছেন। বাসায় আর কেউ নেই। মিঃ ইফাজ গিয়েছেন দোকানে আর ফাহিম বরাবরের মতোই হসপিটালে। এসময় ওর ডিউটি না থাকলেও কিছু কাজের দেখভাল করার জন্য থাকতে হয়। ইলা তখনও মারুফের সাথে রৌশিনের বাসায়। ফাহিম আফরাকে নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে। যদিও ওর অবচেতন মন বারবার বলছিলো যে ফারহান আসলে হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা অনেক গম্ভীর, নিজ থেকে হয়তো একটিও কথা বলবে না। তবুও ওর সঙ্গই আফরার ভালোলাগে। ফাহিম যে ওর বিরক্তির কারন তা-না। ফাহিম নিঃসন্দেহে চমৎকার মানুষ। তবে মানুষের ক্ষেত্রে একটি চরম প্রবাদ আছে, মানুষ মাত্রই নিজের পছন্দের জিনিসটাতে আকর্ষিত হয়। ফাহিম চমৎকার, তবে সে আফরার হৃদয়ে ক্ষুদ্র আলোড়ন তৈরি করতে পারেনি যেটা ফারহান পেরেছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে হঠাৎ মিসেস নাবিলা বলে ওঠলো,

-আমার ছেলেটাকে কেমন লাগে তোমার আফরা?

আফরা হকচকিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কি ফাহিমের কথা বলছেন?

-হ্যাঁ।

আফরার মনে হঠাৎ খটকা লাগে। সেদিন রাতে আফরার বাবাও জিজ্ঞেস করেছিলো ফাহিমের কথা। তাছাড়া শুরু থেকেই মিসেস নািলার আচরণ কেমন জানি অদ্ভুত। বাঙালিদের ট্রেডিশন মতে এখানে কখনোই যুবকের সাথে এক যুবতীর অবাধে ঘোরাফেরা হয়না যেটা আফরা করতে পারছে। তাছাড়া মিসেস নাবিলার বারবার ফাহিমকে রিপ্রেজেন্ট করা, ওর সাথে একান্তে সময় কাটানোর ক্ষেত্রে খুব সচেতন। কিন্ত কেনো?

-এত কি ভাবছো আফরা?

মিসেস নাবিলার ডাকে ওর ধ্যান ফিরলো। অবাক প্রসন্ন হয়ে বললো,

-আপনি হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছেন যে?

-একজন ছেলের মা কেন একটি মেয়েকে এ ধরনের কথা জিজ্ঞেস করে তা তোমার ধারনা আছে?

রহস্যের হাসির আদলে কথাটি বলেন মিসেস নাবিলা। আফরার মনের গভীর সন্দেহ এবার গভীর থেকেও আরও গভীরতর হলো। নিশ্চিত উনার কোনো একটা পরিকল্পনা আছে এসব নিয়ে। তই আফরা খুবই সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলো মিসেস নাবিলাকে। বললো,

-আমি একটু বাইরে টি এস্টেটটা ঘুরে আসি। ঘরে ভালোলাগছে না।

টি এস্টেটের নাম করে গেলেও আফরার উদ্দেশ্য ছিলো একবার ফারহানের সাথে দেখা করার। তবে সে বাড়িতে নাই। ঘরে তালা ঝুলে আছে। আফরা এতে অবাক না হয়ে পারলো না। ছেলেটা সেই যে সকালে উত্তর গাঁও থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলো , আর খবর নেই। অবশ্য ইলা বলেছিলো , যে ফারহান আগে নাকি ঘরেই থাকতো না। ফজরের আযানের পর বেরোতো আর ফিরতো রাত সাড়ে বারোটার পর।

সিলেটের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে রাত ১২ টায় বাহিরে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রায়শই সেনাবাহিনীর চার্জ পড়ে আশপাশে। তবুও ফারহানের হুঁশ হলো না। এই মিটিং-ওই মিটিং, এই নেতা-ওই নেতা’র সাথে সাক্ষাতের জন্য ছুটে যেতো যখন তখন। যদি হরতাল বা কারফিউ হয় তবে তো কথাই নেই। এ সময় হয়তো জেলে মামলা খাটা আসামি হয়েছে, নতুবা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থেকেছে।

এমন একটা পাষাণ মানুষের তবুও মানুষের জন্য রয়েছে গভীর চিন্তা। এখনও তাই এখানকার মানুষদের প্রয়োজনে ছুটে যেতে দ্বিধা করেনা। কলেজ লাইফে ও শুধু ছাত্রদের অধিকারের জন্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেও পরে নিশে গেলো সাধারন মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ে। ছেলেটা ছোট থেকে কষ্ট নিয়ে বড়ো হয়েছে, তাই একটু হলেও বুঝে মানুষের সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারটি।

আফরার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। তারপর পুরো দুপুর নিজ মনেই সবুজে সমারোহ চা বাগানের মাঝে বিচরণ করতে লাগলো। অদূরেই দেখা যাচ্ছে ভারতের মেঘালয়ের উচুঁ উচুঁ পাহাড়। সেই সাথে মনে পড়ছে এখানে এতদিনের থাকা সমস্ত ঘটনাগুলো। শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি কোণায় বিচরনের মধুর স্মৃতিগুলো। হঠাৎই ওর পেছন থেকে শোনা গেলো এক শক্ত পুরুষালি কন্ঠ,

-মেঘালয়ের মতো আপনারও কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আছে আফরা, আপনার এই ক্ষমতা মানুষকে এতটাই মুগ্ধ করবে যে আপনার কথাই নিউরনে আলোড়িত হতে বাধ্য।

আফরা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। কথাটা বুঝতে ওর পাক্কা দুই মিনিট লেগেছে কেননা ফারহানের এই কথাগুলো ছিলো খুবই কঠিন। তবে যেই না কথাগুলো ও ধারন করতে পারলো সারা শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি ছেয়ে গেলো। চোখে মুখে উৎফুল্লতার রেশ। ফারহান দাঁড়িয়ে আছে গাছে হেলান দিয়ে, হাত জোড়া ভাঁজ থাকলেও ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি। শ্যামবর্ণের এই লোকটি মুহূর্তেই যে কাউকে পাগল করার মতো তীব্র ক্ষমতা নিয়ে এসেছে বোধহয়। আফরা এবার খানিকটা এগিয়ে এলো ফারহানের কাছে। ফিসফিসালো কন্ঠে বলে ওঠলো,

-কাউকে মুগ্ধ করতে পারবো কিনা জানিনা , তবে আপনাকে মুগ্ধ করলেই চলবে।

নিঃসংকোচ কথা ওর। ফারহান ভেবে পায়না এই মেয়ে এতটা খোলামেলা সহজসরল কেনো, বাঙালি মেয়ে মানেই তো লজ্জার আবরণ আর অস্বস্তি ঘিরে থাকবে। তবে এসব কিছুই ওর মধ্যে নেই। ফারহান ভ্রু উচিয়ে বললো,

-আমার সাথে ফ্লার্ট করার ট্রাই করছেন?

-আগে প্রচুর ফ্লার্ট করতাম ছেলেদের সাথে। তবে আপনাকে দেখে ওসব ভুলে গিয়েছি। এমনকি ভবিষ্যতেও করবো না।

আরও একবার বিষয় খেলো ফারহান আফরার কথায়। এই মেয়ের রূপের তেমন তেজ কথাবার্তার তেজ যেন সীমা অতিক্রম করেছে। ভ্যাপসা দুপুর। তবুও বহমান ফুরফুরে হাওয়া। দুপুরের রোদ্দুর পশ্চিম দিকে খানিকটা হেলে যাওয়াতে জানান দিচ্ছে যে কিছুক্ষণ পরই বিকেল ঘনিয়ে আসবে। বর্ষাকালের বিকেলটা অনেক সুন্দর। অন্য এলাকাগুলোর কথা ফারহান তেমন জানে না তবে এই চায়ের রাজ্যের শেষ বিকেল ওর কাছে দুর্দান্ত লাগে। মাঝে মাঝে ক্লান্তি নিনির্মেষে এভাবেই সিক্ত পথের এক কোণে বসে নিবিড়ভাবে অনুভব করতো বিকেলটা। তবে ফারহানের সেই বিকেলগুলোতে কাজ করতো একধরনের শূণ্যতা। মনে হতো , কিছু একটা নেই ওর সাথে। ওর মধ্যে কিছু একটার কমতি আছে যার জন্য এই প্রকৃতি ওকে আপন করে নিচ্ছে না। ফারহান এসব ভাবনা বন্ধ করে গাছে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই আফরাকে জিজ্ঞেস করলো,

-এই অসময়ে বাংলোর বাহিরে এখানে ঘুরছেন কেনো?

-এভাবেই ঘুরছিলাম। বাড়িতে মিসেস নাবিলা ছাড়া কেউই নেই তো। তাই ভালো লাগছিলো না।

ফারহান কিছু বললোনা। আফরা এবার চোখজোড়া ছোট ছোট করে বলে ওঠলো,

-আচ্ছা, আপনি তখন উত্তর গাঁও থেকে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন বলেন তো?

ফারহান এবার কি বলবে ভেবে পেলো না। কেননা সবার অগোচরে সে গিয়েছিলো নিজাম সাহেবের সাথে দেখা করতে। ইলেকশনের জন্য ওমর খুব ঝামেলা করছে। আর ফারহানের হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কেউই ভালো চোখে দেখছে না। আবার তখন ফারহান এই চক্রান্তের মূল কালপ্রট এর বিপক্ষে থাকার কারনে উপর মহল থেকে আগোচরে নির্দেশ এসেছে ফারহানকে মেরে ফেলার জন্য। নিজাম সাহেব তাই ওকে সাবধান করে বলে দিয়েছেন কিছুদিনের জন্য এলাকিটি ত্যাগ করতে। ওমরের হাত অনেক দূর পর্যন্ত। তাই ওকে মেরে ফেলতেও দু’বার ভাববে না।
ফারহান সুক্ষ্ম চালে এড়িয়ে খানিকটা সন্দিহান হওয়ার ভান করলো আফরার মুখপানে চেয়ে। জিজ্ঞেস করলো,

-আপনাকে কেনো বলবো? আমার লাইফ,,আমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে লিড করতে পারি। এট এনি চান্স আপনি কি আড়ালে আবডালে আমার ওপর নজর রাখছেন? ইন্টেরেস্টিং,,,,,,,,,!

শেষ কথাটি ফারহান বললো রম্য কন্ঠে, চোখে মুখে চরম কৌতুহলতার ছাপ। আফরা আমতা আমতা করে বললো,

-আমি…….আমি কেনো আপনার ওপর নজর রাখবো?

-সেটা তো আপনিই জানেন। কেনো নজর রাখেন আমার ওপর?

বলেই ফারহানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে পড়লো। আফরাকে এভাবে উত্যক্ত করে ভালো লাগছে বেশ। ফারহান জানে আফরা ওর প্রতি দুর্বল, আর এর সুযোগটা নিতে ফারহান কখনোই বিলম্ব করে না। আফরা মুখ ফুলিয়ে বললো,

-এমন কিছুই না। আমি,,,,,আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম।

-আমায় নিয়ে আপনার একটু বেশিই চিন্তা আফরা। শুনুন, আপনি এখানে আমার জন্য চিন্তা করতে আসেননি , এসেছেন ঘুরাফিরা করতে। আর আপনি সেরকম কিছু না করে আমার পেছনে পড়ে আছেন । উফফফ! ইউ আর টু মাচ সিলি গার্ল আফরা।

আফরার রাগে অপমানে মুখ কালো হয়ে গেলো। একই সাথে নিজেকেও অবাধে গালি দিতে মন চাইছে। আগে তো ও এমন ছিলো না। তাহলে এখন এমন টিন এজারদের মতো আচরণ করছে কেনো ফারহানের সামনে। যতবারই ও চেষ্টা করে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করতে অমনেই সব ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। মানুষের কাছে এতটা প্রশংসা পেয়ে কি লাভ যদি পছন্দের মানুষটার সামনেই হাসির পাত্র হতে হয়?

আফরা এবার রাগে দুঃখে বাংলোর দিতে ফিরে যেতেই ফারহান ওর হাতের কব্জি চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। মিহি কন্ঠে বললো,

-এত রাগ কোথায় রাখেন আপনি? খালি কথায় কথায় ভুতের মতো এদিক ওদিক চলে যান?

আবারও। আফরার এবার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। ফারহান ভ্রু উচিয়ে বললো,

-রাগ হচ্ছে আমার ওপর?

-অনেক।

-ইচ্ছে করছে আমায় একেবারের চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে?

-হুম।

-তাহলে তো আপনার রাগ ঠান্ডা করতে হয় দেখছি। তো! যাবেন আমার সাথে?

আফরা চুপসে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

-কোথায় যাবো?

-গেলেই নাহয় দেখতে পারবেন…………ইটস সারপ্রাইস মিস উইয়ার্ড গার্ল!

শেষ কথাটি ফারহান বললো আফরার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে, একেবারে হৃদয় বিদীর্ন কন্ঠে। আফরার সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো এতে। আকাশ জানান দিয়েছে এখন বিকেলের প্রহর। রোদের হালকা মিষ্টি আলো ফারহানের মুখটা সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। কি ঘোরতর সেই দৃষ্টি। আফরার মনে হলো , এই লোক নিজের চাহিনী দিয়ে একেবারেই মেরেই ফেলবে ওকে। মাথার ওপরের গাছ থেকে ঝরে পড়ছে ছোট ছোট শিউলি ফুল। আফরা মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ ফারহান ওকে যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যেতেই ও রাজি। শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি পথ-প্রান্তরে সে নাম লিখাবে ফারহানের সাথে।❤
.
.
~চলবে……..ইনশাআল্লাহ!

এই উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে আমি নিজেই কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছি ‘আফরাহান’ জোড়ার প্রতি। এই চা বাগান, নেলসন টি এস্টেট, লাউয়াছড়া উদ্যান সবকিছুতেই ওরা যেন স্মৃতিবিজড়িত হয়ে আছে। নেক্সট টাইম আমি যদি শ্রীমঙ্গলে যাই , নির্ঘাত ওদের স্মৃতিচারনে ডুবে যাবো। যাই হোক, ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন। মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here