অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤ পর্ব____৩৩

অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
পর্ব____৩৩
#কায়ানাত_আফরিন
-‘তোমার নাম রৌশিন না হয়ে বুকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া রৌদ্রময়ী রাখলে ভালো হতো৷ এই মেয়ে! তোমায় দুদিন ধরে কল দিচ্ছি, আর তুমি কিভাবে পারো পাষাণের মতো আমার, এই ফাহিম এর আড়ালে থাকার চেষ্টা করতে?’

রৌশিন নিজের স্বাভাবিক বাকবুদ্ধি হারিয়ে স্তম্ভিত হয়ে ছিলো কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছে ও কোনো ঘোরে আছে। এতক্ষণ সে বাস্তব জগতে থাকলেও মোবাইলে ধরার পর সেই বহুদিনের প্রিয় মানুষটার তোলপাড় করা কন্ঠ শুনে সে অন্য এক জগতে হারিয়ে গিয়েছে। কাল্পনিক উপন্যাসে আয়নার অপর প্রান্তে যেমন একটা দুনিয়ার উপস্থিতি অনুভব করা যয় ঠিক তেমন। রৌশিনের মনে হচ্ছে ও ভুল শুনছে। এটা হয়তো ওর ভুল শোনা নয়তো অপর প্রান্তের মানুষটি ফাহিম নয়। তাই সে দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কি আসলেই ফাহিম ভাই জনাব?’

অপর পাশে ফাহিম যেন অবাক হয়ে গেলো। প্রশ্ন ছুড়লো,

-কার এতো সাহস আছে আমারই ফোনে সে তোমার সাথে কথা বলার দুঃসাহস করবে?

-তাও ঠিক।

রৌশিন কথাটি বলে ওঠলো মিনিনিয়ে। তবুও ফাহিমের হঠাৎ এমন আচরণ ওর শরীরে অদ্ভুত অনুভূতির জানান দিচ্ছে। জ্বরও যেন বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। ফাহিমের এ কথাবার্তার সাথে রৌশিন অনভিজ্ঞ। মূলত স্কুল লাইফ থেকেই ফাহিমের প্রেমে নিমজ্জিত ছিলো রৌশিন , তবে তা সবার অগোচরে। কথায় আছেনা কিশোরী মন বড় ভয়ঙ্কর, রৌশিনের ক্ষেত্রেও কিশোরী মনে ফাহিমের প্রতি প্রথম প্রেমানুরাগ ওকে পাগলপ্রায় করে দিয়েছিলো। কথা নেই কারন নেই হুট করে মারুফকে নিয়ে সে স্কুলের পর ছুটে চলতো ইলার বাসায় শুধুমাত্র ফাহিমের সাথে দেখা করার জন্য। তবে ফাহিম বরাবরের মতোই ছিলো খুব মিশুক, হাসিখুশি ধরনের ছেলে। দাম্ভিকতা বা গম্ভীরতার লেশটুকু ওর মধ্যে নেই। নিজের কথা আর উন্নত ব্যাক্তিত্বের মাধ্যমে অনেককেই নিজের ধ্যানে টেনে নিতে পারার মতো অসীম ক্ষমতা ফাহিমের থাকলেও রৌশিন ওর প্রতি আকর্ষিত হয়নি, মনের অন্তরালে জেগে ওঠেছিলো ফাহিম ভাইকে পাওয়ার মতো এক তীব্র আকাঙ্খা। তবে সেগুলো শুধুই এখন অন্তরের কথা। ফাহিম মৌনতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-জ্বর কমেছে তোমার?

রৌশিন আরও একধাপ অবাক হলো। ফাহিমের ছোট ছোট কথাগুলো ওকে বারবার চুপসে দিয়েছে। অনুভব করছে জ্বর বেড়ে যাচ্ছে শরীরে। তবুও সেদিকে পরোয়া না করে রৌশিন পাল্টা জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কি করে জানলেন আমার জ্বর?

-তোমার গুণোধর ভাই সাদ্দাফের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি।

রৌশিন এবার কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ফাহিম ভাই তবে সত্যিই ওর জন্য সাদ্দাফের কাছে খোঁজ খবর নিয়েছে? ফাহিম এবার বললো,

-মারুফের জন্মদিনের জন্য কত কি প্ল্যান করলে তোমরা। তারপর কি হলো? তুমি উধাও। ইলা-মারুফ কত ফোন দিলো তোমায় তুমি তো একবার বলতে পারতে যে তোমার জ্বর হয়েছিলো? ওদের কথাবার্তা শুনে আমি নিজেও তোমার জন্য একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম । তাই কিছু না ভেবেই সাদ্দাফকে কল দিয়ে জানতে পারলাম আমাদের রৌশিন ভাবুক রাণীর জ্বর।

ফাহিম কথাটা বেশ স্বাভাবিকভাবে বললেও রৌশিনের বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ ক্রমাগত যেন বেড়েই চলছে। এ মাত্র কি বললো ফাহিম?ওকে সত্যিই তাহলে ভাবুক রাণী বলেছে? আসলেই তো সে ভাবুক। ফাহিমের রূপে-গুণে-কথার মোহে ভাবুক। ফাহিম নির্বিকারে বলে ওঠলো,

-শোনো বেশি চাপ নিতে হবে না। মোবাইল রেখে একটা প্যারাসিট্যামল খেয়ে শান্তির ঘুম দিবে। সকালেই আমি তোমার চেক আপ করতে আসবো। ডাক্তার হয়ে কি লাভ যদি নিজের মানুষদেরই যত্নাদি না করতে পারি?

রৌশিনের ফাহিমের সাথে কথা বলার আর সাহস হলো না। দ্রুত কল কেটে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বইলো ঠায় হয়ে। ওর পা দুটো অবশ হয়ে আসছে, হৃদয় উত্তেজনায় রীতিমতো ধুকপুক করছে, নিঃশ্বাস হয়ে আসছে রুদ্ধ।আজ কোন ফাহিমকে দেখলো সে? যে মানুষটার সাথে রীতিমতো দায়বদ্ধতা নিয়ে কথা বলত হতো আজ তার মধ্যে এতটা নিজস্বয়তা? রৌশিন ঢুলুঢুলু হয়ে ফিরে গেলো ওর বইয়ের রাজত্বের ছিমছাম ঘরটিতে। ওপাশের ঘরে মা বাবা ঘুমে বিভোর। বাবার নাক ডাকার শব্দওশোনা যাচ্ছে তবে রৌশিন পরোয়া করলো না। খাটে দুর্বলচিত্তে শরীর এলিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে নিলো কম্বল। ওর শরীর প্রচন্ড গরম। চোখ মুখ লাল হয়ে আসলেও কাজ করছে ভালোলাগা। রৌশিন বিড়বিড়িয়ে বললো,

-এই জ্বরে কোনো অনিশ্চয়তা নেই, আনন্দটাকে উপভোগ করার জন্য হুটহাট করেই এমন জ্বর আসা উচিত।

____________

সকালে আফরা সবার নজর এড়িয়ে ধীরপায়ে চলে গেলো ফারহানের কুটিরটির কাছে। এখন ভোর সকাল। আলো আশপাশে সর্বত্র ফুটেছে মাত্র। বাইরে ফুরফুরে হাওয়ার সাথে অদূরেই বনের কাছে পাখির কিচিরমিচির শান্ত নীরব সকালকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আফরা চুলগুলো কাটা ব্যান্ড দিয়ে আটকে নিলো। পরনে নাইট ড্রেসে পাল্টে হাটুর নিচ পর্যন্ত সাইজের একটা লম্বা স্কার্ট আর লেডিস শার্ট পড়লৌ। এত সকালে এসব পড়ার কোনো মানেই হয়না। তবুও পড়ে নিলো ফারহানের জন্য। ফারহান স্বভাবতই সকালে ওঠার মানুষ। আর আফরা চায়না ওর সামনে বিচ্ছিরি ভাবে যেতে। ফারহানের কুটিরটির কাছে যেতেই দৃঢ় হয়ে এলো গিটারের টুং টাং শব্দ। ক্রমেই সেটা আরও মোহনীয় হচ্ছে। ফারহান যে গিটার বাজাতে পারে এটা সম্পর্কে অবগত আফরা। তবে ফারহান তখনই গিটার বাজায় যখন ওর মন হয়তো খুব ভালো থাকে , নয়তো খুব খারাপ। তবে এখন গিটার বাজানোর কারন কি? আফরা হাজার ভেবেও খুঁজে পেলো না এর প্রতিউত্তর। অতঃপর দু’কদম এগিয়ে যেতেই দেখলো বারান্দায় বসে আছে ফারহান। শরীর এলিয়ে দিয়েছে ছোট চৌকিটিতে। ওর পরনে সাদা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। টিশার্টটি হাফ হাতা থাকায় হাতের নীল রগ গুলো দৃশ্যমান আফরার কাছে। ফারহান আফরার উপস্থিতি টের পেয়ে থমকে গেলো। আঙুল চালানো বন্ধ করে দিলো । গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠলো,

-কেনো এসেছেন আপনি?

আফরা এর উত্তর দিতে পারলো না। সে তো এসেছে এত ভোরে শুধুমাত্র তার কমরেড সাহেবকে দেখার জন্য। কিন্ত এটা কি আদৌ মুখ ফুটে বলা সম্ভব? সেই সাথে ওর অভিমানও হলো এই দাম্ভিক মানুষটার প্রতি? কিভাবে পারে ‘কেনো এসেছেন’ এই প্রশ্নটি করতে? সে কি জানে না তার এ কথাগুলো ক্ষতবিক্ষত করে দেয় আফরাকে? তাই সে রূঢ় স্বরে বললো,

-মর্নিং ওয়াক করতে এসেছি।

-এভাবে স্কার্ট পড়ে? ব্যাপারটা স্ট্রেইন্জ না?

বলেই ভ্রু কুচকে তাকালো ফারহান। আফরা স্তম্ভিত। বোঝা গেলো , ভালোই ফ্যাসাদে পড়েছে। তবুও সে হাল ছাড়লো না। বলে ওঠলো,

-আমি অনায়াসেই এভাবে স্কার্ট পড়ে মর্নিং ওয়াক করতে পারি । বুঝেছেন?

-হুম বুঝেছি। আপনি তো আবার ইন্টারন্যাশনাল উইয়ার্ড গার্ল।আপনাকে দ্বারা সবই সম্ভব।

অপমানে থমথমে হয়েওঠলো আফরার মুখখানা। তবে ফারহান পাত্তা দিলো না। এটাই ওর প্রাপ্য ছিলো। বিগত দু’দিন নিজেকে ঘরবন্দী করে ফারহানের তীব্র নজর থেকে দূরে রেখে অনেক বড় ভুল করেছে আফরা। ওর সর্বপ্রথম ভুল ছিলো ফারহানের পাষাণ মনে একটা মেয়ের জন্য দুর্বলতা তৈরি করা। তারপর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো ফারহানকে দৃষ্টিনেশায় কাঙাল করে রাখা। যেটার হেস্তনেস্ত ফারহান করেই ছাড়বে। এদিকে আফরার কান্না পাচ্ছে। যেই মানুষটার জন্য এত সকালে সুন্দর পোশাক পড়ে এলো সেই মানুষটাই ওকে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইয়ার্ড গার্ল’ এর উপাধি দিয়ে দিলো? আফরা হঠাৎ এগিয়ে ফারহানের টিশাল্ট টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। রুক্ষমেজাজে বললো,

-আই অ্যাম নট অ্যা উইয়ার্ড গার্ল। উইয়ার্ড ম্যান ইজ ইউ। ইউ আর মাই ফিলিংস ম্যান! হোয়াই ইউ ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড? আই,,,,,,,আই উইল কিল ইউ। ইফ ইউ অ্যাগেইন সে ইট , আই উইল কিল ইউ মিঃ ফারহান জুবায়ের।

আফরা যেন নিজের মধ্যে নেই। সে এতটাই রেগে আছে যে বাংলা বলতে ভুলে গিয়েছে। মুখ দিয়ে ফারহানকে অজস্র গালাগাল দলেও ফারহান হো হো করে হেসে ওঠে বসে পড়লো চেয়ারে। আফরা হতভম্ব। অগোছালো চুলের এই মায়াবীনির যেন এই পাগল বাঙালি ছেলেটার আচরণ ভাবুক করে তুলেছে। ফারহান নিজের চুলগুলো পেছনে ঠেলে বলে ওঠলো,

-আপনাকে রাগাতে আমার যেমন ভালোলাগে, আপনাকে রাগলে আমার আরও বেশি ভালোলাগে। এখন থেকে আরও বেশি রাগাবো কেমন?

আফরা দাঁড় কিড়মিড় করে বলে ওঠলো,

-আপনি একটা খারাপ।

-খারাপটা হয়েছি শুধুমাত্র আপনার জন্যই।

ফারহানের নির্বিকার প্রতিউত্তরে আফরা কিছু বললো না আর । যেভাবে এসেছিলো,সেভাবেই চলে গেলো । তবে মুখোমুখি হলো ইলার সাথে। ইলা, ফাহিম সবাই রৌশিনদের বাড়িতে যাচ্ছে। এত সকালে কেনো ওদের বাড়িতে যাচ্ছে সেটা আফরাকে ভাবিয়ে তুললেও সে প্রশ্ন করলো না। রাজি হলো ওদের সাথে যেতে। ফাহিম এবার ইলাকে জিজ্ঞেস করলো,

-ফারহানকে ডাক দে তো! জিজ্ঞেস কর , ও যাবে কি-না।

আফরা ফারহানের নাম শুনে তেলেবগুনে জ্বলে উঠলেও কিছু বললো না। বিড়বিড়িয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো , ‘মরে গেছে ওই গোমরামুখোটা!’
.
.
.
~চলবে……..ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here