অনুতাপ (পর্ব ২)
লেখিকা_নাঈমা_হোসেন_রোদসী
চোখ দুটো আমার ঝাপসা হয়ে গেছে। এক অন্তর্দহনে আমার বুকের বা পাশটা ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। ডায়েরিটা
আঁচলের। প্রথম পৃষ্ঠাটা খুলতেই দেখি, কাঁচা কাঁচা হাতের লেখা -‘আমার বাবা সুপারম্যান ‘। বোঝাই যাচ্ছে, লেখাটা লেখার সময় ওর বয়স খুব কম। নতুন নতুন লেখা শিখেছিলো তখনকার। আমার ভেতর থেকে চট করে একটা প্রশ্ন জেগে উঠলো। আচ্ছা, আঁচল কার কাছে লেখা শিখলো! একটা ভালো টিচার আমি তো রাখিনি। প্লে তে ভর্তি হয়ে স্কুল থেকেই বোধ হয় শিখেছিলো। আমার কী উচিত ছিলো না, মা ছাড়া মেয়েটাকে নিজের হাতে অক্ষরবুনন শেখানো?
প্রথম পৃষ্ঠার পরে আরও এমন কতশত চিন্তা ভাবনার কথা লেখা! কখনো রাগ, অভিমান, ভালোবেসেও অনেক কিছু লেখা। হঠাৎ একটা পৃষ্ঠায় আমার চোখ আঁটকে গেলো। আমি বিরামহীন পড়তে শুরু করলাম,
~
তুমি খুব পঁচা বাবা, আমাকে একটুও আদর করো না। একটুও ভালোবাসো না। কী হয় আমাকে আদর করলে!
~
বাবা, নতুন মা আজ আমাকে খুব মেরেছে। আমার হাত পুড়ে গেছে ভাতের পাতিল উঠাতে গিয়ে। তাঁকে তুমি বলে দিও একটু কম করে মারতে। বলবে তুমি? তুমি তো আমার সঙ্গে কথা বলো না বাবা। আমি কীভাবে বলবো তোমাকে? তুমি না ছোটবেলায় আমাকে ম্যাজিক দৈত্যর গল্প শুনিয়েছিলে! আজ ঐ দৈত্যটা আমার খুব দরকার বাবা। দৈত্যটাকে বলবো, যেনো ম্যাজিক করে তোমাকে আগের মতো বানিয়ে দেয়!
~
মা, আজ তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। এখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার জিএসসি এর রেজাল্ট দিয়েছে। আমি এ+ পেয়েছি। জানো মা, সবার বাবা মায়েরা সন্তানের রেজাল্টে খুশি হয়ে এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করছে। আমি বাসায় এসে বাবাকে রেজাল্ট দেখিয়ে আনতে গেছিলাম, নতুন মা আমাকে খুব মেরেছে। নিরার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। তারপরও রাতে বাবার কাছে রেজাল্ট দেখাতে যখন গেলাম, তখন বাবা বোধ হয় ক্লান্ত ছিলো তাই আমার কথা না শুনেই ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।
~
নিরার জামাটা দেখে আজ আমার ইচ্ছে করছিলো, একটা ভালো জামা পড়তে। কাল বাবা অফিস থেকে এসে নিরাকে কী সুন্দর একটা জামা দিয়েছে! আমার জামা দু’টোই প্রায় ছেঁড়া। আর পড়তে পারছিনা৷ ছেঁড়া জামাটা পড়ে যখন নিচে গেলাম, পাশের বাড়ির এলিনা কেমন করে হাসছিলো! আমার খুব লজ্জা লেগেছে। বাবাকে নতুন জামার কথা বলার পর বাবা খুব রাগ হয়েছে। হয়তো, মাসের শেষ দিক তাই টাকা পয়সা হাতে কম। দোষটা আমারই।
~
পড়ার বইটা বোধ হয় আর কেনা হবেনা। হাতে মাত্র তিনশো টাকা বাকী। বইয়ের দাম দুইশো ছাপ্পান্ন টাকা।
মাসের দশ দিন বাকী আছে এখনো। এটা দিয়ে বই কিনলে, সকালে না খেয়ে মরতে হবে। ক্যান্টিনের বাশি সিঙ্গারা খেয়ে পেটে অসহ্য রকমের ব্যাথা করে! কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় জোড় করে খেতে হয়। বাড়িতে তো আমার জন্য খাবারের বড্ড অভাব।
~
এলাকার কয়েকটা মাস্তান ছেলে রোজ ডিস্টার্ব করছে। আজ আমার গায়েও হাত দিয়েছে। চিৎকার করে মানুষ জড়ো করেছিলাম বলে, আমাকে হুমকি দিয়েছে। আমাকে কয়েক দিন পরই মেরে ফেলবে! হয়তো ওরাও টের পেয়েছে, আমার বাবা থাকলেও, মাথার উপর বাবার ছায়া নেই।
আমাকে বাঁচাও বাবা, বাঁচাও প্লিজ! ওরা আমাকে শেষ করে দেবে বাবা!
~
খুব সাহস করে বাবাকে মাস্তান গুলোর কথা বলেছিলাম। প্রতি বারের মতো এবারও বাবা বিরক্ত হয়ে বলেছে, রাস্তা দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলে আসতে। নতুন মা তো, বলেই ফেলেছে আমার আর পড়াশোনা করার দরকার নেই।
~
হাহ! আজ খুব করে একবার বলতে ইচ্ছে করে বাবা,
তুমি আমার জন্মদাতা ঠিকই, তবে আদর্শ বাবা হতে পারোনি। জন্ম দিলেই হয়তো বাবা হওয়া যায় না।
ভালো থেকো বাবা। দোয়া করি, আমার হাহাকারের প্রতিধ্বনি গুলো তোমার কানে কখনো না লাগুক। তোমার বিবেকও না জাগুক। কারণ বিবেকের দংশনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাবে তুমি। বুকে ছুরিকাঘাতের মতো লাগবে, বেঁচে থাকবে শুধু একমুঠো অনুতাপ!
–
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে আমি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম। সারাজীবন ব্যাংকের হিসাব নিকাশ মিলিয়ে জীবনের খাতাটায় জিরো রয়ে গেছে। আসলেই তো, মেয়েটার কোনো দায়িত্বই আমি পালন করিনি। দূরছাই করে মেয়েটাকে বহু দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। বুকের ভিতর এক অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে ছিড়েখুঁড়ে খেতে লাগলো। বুকে হাত চেপে ডায়েরিটা নিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
সেদিনের পর থেকে বিছানায় শয্যাশায়ী আমি। ডায়েরিটার দিকে যখন তাকাই তখন মনে হয় কেউ চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে আমার অপরাধ গুলো দেখিয়ে দিচ্ছে। সত্যিই, এই বিবেকের দংশন আমাকে শেষ করছে ধীরে ধীরে! কিন্তু আমি যে আমার কত দায়িত্ব অবহেলা করেছি, কত কষ্ট দিয়েছি! এসব আমাকে ভালো থাকতে দেয়না। মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনি আমি, প্রতিটা প্রহর কাটে আমার ওই মেয়েটার আর্তচিৎকার অনুভব করে। খুব ইচ্ছে করে একটাবার মেয়েটাকে দেখতে। বুকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করে, পরীমা তোমার বাবা সত্যিই আগের মতো হয়ে গেছে। এখন আর সে তোমাকে বকবে না, বিরক্ত হবে না, খুব আদর করবে! পাপিষ্ঠের দোয়া পূরণ হয়না হয়তো! রাতের পর রাত কাটে, তবু মেয়েটা যে আসেনা! কেনইবা আসবে? মেয়েটা যাওয়ার সময় আমি কী একটিবার আঁটকে ছিলাম! হায়! অনুতাপ হয় আমার, এক আকাশ সমান অনুতাপ!
চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। নিশিতা আহাজারি করে কাঁদছে। নিরাকে শশুর বাড়ির লোকেরা অত্যাচার করে নাকি রোজ। আহ! পাপের বিনাশ বুঝি এভাবেই হয়!
সময় খুব বেশি নেই আমার হাতে। মৃত্যুর স্বাদ আমাকে ভোগ করতে হবে শীঘ্রই। আমি নিভু নিভু চোখে তাকালাম, চমকে উঠলাম। ইশ! আঁচল এসেছে। আমার শেষ ইচ্ছে ছিলো, মেয়েটাকে একবার দেখার। শুনেছি, আঁচল নাকি এখন ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে।
আমার ঘোলা চোখদুটো বুঁজে আসছে। চোখ বন্ধ করতেই দেখি, একি! চারুলতা। কী সুন্দর লাগছে! আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে নিলাম। চারুলতা ঘৃণার দৃষ্টিতে বলছে, ‘আমাকে তুমি কথা দিয়েছিলে,ওর খেয়াল রাখবে। তুমি রাখোনি, তুমি বেইমান। ‘
আমার নিষ্প্রাণ দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছে। অনুতাপের দহনে আমি শেষ হচ্ছি। কানের কাছে কে যেনো তখন কেঁদে কেঁদে বলছে,
‘বাবা, বাবা আমাকে আদর করবে না? ‘
(সমাপ্ত)