অনুতাপ (পর্ব১) লেখিকা_নাঈমা_হোসেন_রোদসী

অনুতাপ (পর্ব১)
লেখিকা_নাঈমা_হোসেন_রোদসী

‘বাবা, তুমি নিরার জন্য যে কাল একটা জামা এনেছিলে। আমাকেও তেমন একটা জামা এনে দিও।’

বিরক্ত চোখে একবার মেয়েটার মুখের দিকে তাকালাম। মাত্র অফিস থেকে এসে ফ্যানের নিচে বসেছি। তাঁর মধ্যেই এসে ঢং শুরু করেছে। আমি ধমক দিয়ে বললাম,

‘ওকে এনে দিয়েছি বলে তোকেও দিতে হবে! হিংসুটে তো ভালোই হয়েছিস। ‘

মেয়েটার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। মুখটা নিচু করে বলল,

‘না মানে বাবা, আমার জামা যে দুটো আছে সেগুলো ছিঁড়ে গেছে। আর পড়া যাচ্ছে না। কালকে নিরার জামাটা বেশ ভালো লেগেছিল। তাই আরকি..’

‘আচ্ছা, যা এখন। কালকে আসার সময় ফুটপাত থেকে একটা নিয়ে আসবোনে। কানের কাছে আর ঘ্যানঘ্যান করিস না। ‘

চলে গেলো মেয়েটা। আমি আবারও বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। আমার প্রথম ঘরের মেয়ে আঁচল। আঁচলের মায়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিলো পারিবারিকভাবেই। দেখতে সাধারণ একটা মেয়ে ছিলো চারুলতা। তবে, মায়াবী ছিলো খুব। সবদিকে সমান খেয়াল রাখতো। বিয়ের দুই বছর পর আঁচল জন্ম নিলো। আমার আর চারুলতার খুব আদরের মেয়ে। কিন্তু, আঁচলের কপাল মন্দ। ওর জন্মের তিন বছর পরই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলো চারুলতা। আমি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেলাম পুরোপুরি। সংসারের কিছুতেই মন ছিলো না। গ্রাম থেকে মা এসে পড়লো।
আসার পর থেকেই আরেকটা বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো। প্রথম প্রথম আমি নাকচ করলেও পরবর্তীতে মনে হলো সত্যিই সংসারে একজন নারীর প্রয়োজন। নারী ছাড়া ঘর হয়না। আবার ছোট মেয়েটাকে একা রেখে অফিসেই বা কীভাবে যাই! অতঃপর ছয় মাস পর আমি পুনরায় বিয়ে করি ৷

নিশিতা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের প্রথম দিকে নিশিতা আঁচলকে আদর করলেও আস্তে আস্তে অবহেলা করা শুরু করে। আমি তখন প্রতিবাদ করলেও, নিশিতা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর আর কিছুই বলিনি। নিরা হওয়ার পর প্রায় ভুলেই গেছি আঁচল নামের আরেকটা মেয়েও আমার আছে।

আমি জানি, নিশিতা আঁচলকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করায়, কখনোবা একবেলা খাবার দেয়না। আমি এ নিয়ে এখন তেমন কিছু বলিনা। বললে নিশিতা ক্ষেপে যায়। কী দরকার অযথা ওই মেয়েটার জন্য নিজের বউদের সঙ্গে ঝামেলা করার! খেয়েদেয়ে ব্যাগ নিয়ে অফিসের পথে যাত্রা করাই আমার দৈনন্দিন রুটিন। অনেক অন্যায় অবিচার চোখের সামনে ঘটতে দেখলেও আমি এড়িয়ে যাই সুন্দর করে। এই যেমন,
সেদিন আমি টিভি দেখতে ড্রইং রুমে বসেছি এমন সময় হঠাৎ দেখি নিরা একটা কাচের প্লেট ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু নিশিতা আসতেই নিরা আঁচলের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়। নিশিতা আঁচলের চুলের মুঠি ধরে চার পাঁচটা থাপ্পড় দেয়। আমি একবার আগ বাড়িয়ে বললাম, আহা মেরো না! ভুল হতেই পারে। কিন্তু আসল সত্যিটা নিয়ে আর ঘাটলাম না। কথায় কথা বাড়ে। দেখতে দেখতে আঁচল আর নিরা দুজনেই বিয়ের বয়সী হলো। আঁচল যেহেতু বড় তাই স্বাভাবিক ভাবেই ওর জন্য একটা উচ্চ পরিবার থেকে সম্বন্ধ এলো। কিন্তু, নিশিতার মা আঁচলের পরিবর্তে নিরার জন্য বিয়ের কথা উঠালো। লোকেরা প্রথমে দোনামোনা করলেও পরে নিরাকেই নিলো। ধুমধামে বিয়ে হলো। লাখ লাখ টাকার আয়োজন। সঙ্গে মেয়েকে ভারি স্বর্ণের হাড় দিয়ে ভরে ফার্নিচার সহ পাঠিয়েছি। মেয়ে সুখেই আছে রাজরানীর মতোন।
আঁচলের বিয়ে নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই না। একবার কথা তুলেছিলাম অবশ্য, নিশিতা ধমকে বলল-

–দেখো, আজকাল কাজের বুয়া পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। মেয়েটা আছে যতদিন আমি একটু আরামে থাকতে পারবো!

হয়তো আমার বলা উচিত ছিলো, সারাজীবন তো আয়েশই করে গেলে। আর কত চলবে! কিন্তু নাহ, এবারও আমি নিঃশব্দে প্রস্থান করলাম। আমার কী বলার! মাসশেষে আঁচলের হাতে হাজের দুয়েক টাকা ধরিয়ে দিয়েই আমার দায়িত্ব শেষ। পড়াশোনা তো করছেই। আমার আবার কীসের এতো চিন্তা! নিজেরটা নিজেই করতে পারবে।

একদিন অফিস থেকে এসে শুনি, আঁচল নাকি হোস্টেলে উঠেছে। সেখানেই নাকি খেয়ে পড়ে নিজের মতো থাকবে। নিশিতা যদিও দিন কয়েক হা হুতাশ করে গালিগালাজ করে মেয়েটাকে। তবে, আমি কিছু বলিনা। কেটে যায় বছরের পর বছর। উইকেন্ডের দিনে, আমি চশমা চোখে দিয়ে আমার একটা বই খুঁজতে খুঁজতে আঁচলের জন্য বরাদ্দ করা চিলেকোঠার মতো ঘরটায় এসে গেলাম। হুট করেই আমার মনে হলো, এই ছোট কুঠুরি ঘরটায় কীভাবে দিনরাত্রি থাকতো আঁচল! দুই মিনিট থাকতেই দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যাকগে, আমি বই খোঁজার জন্য ছোট টেবিলটায় হাত দিলাম। কোথা থেকে যেনো ধুলোমাখা মলিন একটা পোঁকায় খাওয়া ডায়েরি বেরিয়ে এলো। ভ্রু কুচকে ডায়েরিটা হাতের মাঝে নিলাম।

ডায়েরিটা খুলেই আমি যা দেখি, আমার হৃদপিণ্ডটা কেঁপে ওঠে!

অনুতাপ
লেখিকা_নাঈমা_হোসেন_রোদসী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here