অনুভবের প্রহর পর্ব-৩৪

0
2127

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____৩৪ (বোনাস পার্ট)

শরৎকাল চলছে। আকাশ মুক্তদানার মতো ঝকঝকে। সেই ঝকঝকে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে অজস্র মেঘের টুকরো। এমনই এক শরতের দিনে সামান্য সর্দি থেকে প্রহর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল সুড়সুড় করে। বুকে ব্যথাসহ শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। তাকে ভর্তি করা হলো মেডিকেলে। ইরতাজ উদ্দিন দেশের সবচেয়ে বড় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। জলের মতো টাকা খরচ করতে লাগলেন। কি হবে এই টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ দিয়ে? যদি তার কলিজার টুকরো বেঁচে না থাকে?

রোজকার দিনের মতো আজকের দিনও! আকাশ পরিষ্কার। চনমনে রোদ। সবাই ব্যস্ততা নিয়ে ছুটছে। সবকিছু চলছে আগের মতো। শহর কখনো নিরব নেই। আগের মতোই ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। অথচ এই শহরে কতকিছু ঘটে যাচ্ছে। কত দুঃখ নিয়ে কেউ কেউ দিনাতিপাত করছে। কারো বুক জুড়ে প্রিয় মানুষকে পাওয়ার আনন্দ। কারো বুক জুড়ে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর যন্ত্রণা। কেউ ছুটছে তো ছুটছেই! কেউ আবার স্থির হয়ে এসেছে।

অনুভব দ্বিতীয় দলে। সে স্থির হয়ে এসেছে। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে বিষাদের গাঢ় ছায়া। আর পারছে না সে! গন্তব্য ছাড়া ক্লান্ত পথিক লাগছে। বুকের ভেতর ভয় জমে জমে পাহাড়সম হয়ে গেছে। এখন শুধু ধ্বসে পড়ার অপেক্ষা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছে। বার বার মনে হচ্ছে, চিৎকার করে পুরো পৃথিবী জানিয়ে দিক। পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিক!

‘অনুভব।’

নাজমুল এসে দাঁড়িয়েছে। অনুভব মাথা তুলে তাকালো। সে বসে আছে হাসপাতালের বারান্দায়। চোখে মুখে দিশাহারা ভাব। নাজমুলের ডাকে সাড়া দিল না৷ পূর্বের মতো মাথা নত করে রইলো। বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। তার উত্তাপে হৃদয় পুড়ে ছারখার। সে কি জীবনে বড় কোনো ভুল করেছিল? যার জন্য এত কষ্ট পেতে হচ্ছে?

নাজমুল এসে অনুভবের পাশে বসলো। কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘শক্ত কর নিজেকে। ভিসা, পাসপোর্ট সব রেডি। পরশুদিন রাতে তোদের ফ্লাইট। একবার বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দিলে প্রহর ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু আগের মতো হবে।’

অনুভবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সবকিছু কি এত সহজ? আগের মতো হবে সব? সে জানে না। শুধু জানে, প্রহরের কিছু হলে সে বাঁচবে না। এই মেয়েটা তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। তার মরু উদ্যানের একমাত্র ফুল। তার তৃষ্ণার্ত জীবনের একফোঁটা জল। মেয়েটার হৃদয় নিংরানো ভালোবাসা-ই তো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ক্ষয়ে যাওয়া অচল বৃক্ক নিয়ে সে বেঁচে আছে৷ সবটা শুধু প্রহরের জন্য। প্রহরের কিছু হলে তার কি হবে?

অনুভবের দম বন্ধ হয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে পড়লো সে। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল দক্ষিণ দিকে। ওখানে ওয়াশরুম আছে।

______

প্রহর শুয়ে আছে। শীর্ণকায় দেহটা বিছানার সাথে মিশে গেছে। মুখে মাস্ক নেই। শ্বাস নিচ্ছে টেনে টেনে। প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের ভেতর উঠানামা করছে। অনুভব নিঃশব্দে কেবিনে প্রবেশ করলো। প্রহরের কাছে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। তার অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ খুলল প্রহর। ঘোলাটে চোখ! তবুও অনুভবকে দেখে শুষ্ক ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।

‘এখন কেমন লাগছে প্রহর? কষ্ট হচ্ছে?’

আদুরে গলায় জিগ্যেস করলো অনুভব। প্রহর মাথা রাখলো অনুভবের কোলে। ক্ষীণ স্বরে বললো,

‘কষ্ট হচ্ছে না। আমার কি হয়েছে অনুভব? বড় কোনো অসুখ?’

‘না। কিচ্ছু হয়নি। সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি। খুব দ্রুত। আমি বলছি সব আগের মতো হবে।’

‘আপনি খেয়েছেন দুপুরে?’

‘হুঁ!’

‘কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না। দেখি আমার চোখের দিকে তাকান তো।’

অনুভব তাকালো। কিন্তু প্রহরের ঘোলাটে দৃষ্টি সহ্য হলো না। বুক পুড়ছে তার। চোখ সরিয়ে নিল। প্রহরের দেহের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। মনে হচ্ছে ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। প্রচন্ড বমি বমি পাচ্ছে। অনুভবকে কিছুই বুঝতে দিল না। নিজের সহ্য ক্ষমতা দেখে নিজে অবাক হলো। এই অমানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার মতো শক্ত সে অনুভবের জন্য হয়েছে।

স্মিত হাসলো সে। অনুভবের হাতটা গালে ছুঁয়ে বললো,

‘জানেন অনুভব? এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে আমাদের পুরনো দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম। প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে প্রথম দিকের দিনগুলো। দিনগুলো হুট করে ভীষণ মিস করছি। প্রথম প্রেমে পড়ার মতো ভয়ংকর অনুভূতি পৃথিবীতে দ্বিতীয় কিছু নেই। তখন যা দেখি তাই ভালো লাগে। যা করি তাই ভালো লাগে। তখন আপনাকে জ্বালাতে ভালো লাগতো, আপনাকে চিঠি লিখতে ভালো লাগতো। রাতে জেগে আপনাকে নিয়ে কল্পনা করতে ভালো লাগতো। আপনার ধমক শুনেও মন খুশিতে নেচে উঠতো। লুকিয়ে ঝুঁকিয়ে আপনার ছবি তুলে সেগুলো প্রিন্ট আউট করা আর রাতভর দেখা। দিনগুলো কেমন স্বপ্নের মতো ছিল।

ছোটবেলা থেকে আমার বন্ধু কম ছিল। গাড়িতে করে নিয়মমাফিক যেতাম-আসতাম বলে কারো সাথে বন্ধুত্ব হয়ে উঠেনি। একাকী নিজের মতো বড় হয়েছি। মিশুক ছিলাম না কোনোকালে। আচমকা আপনার সাথে দেখা। আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর গুরুগম্ভীর, কথা কম বলা এই আমি কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠলাম। নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা অস্থির এক সত্তার বিকাশ ঘটতে থাকলো। আমি প্রাণখুলে হাসতে শিখলাম। বেঁচে থাকার আলাদা কারণ খুঁজে পেলাম। আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে স্বপ্নের মতো। এই যে আপনি আমার এত কাছে এই মুহূর্ত গুলোও স্বপ্নতুল্য। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার স্বপ্নকে এত আশকারা দেওয়ার জন্য। আমার বেঁচে থাকার কারণ হওয়ার জন্য। আমাকে ভালোবেসে আগলে রাখার জন্য। আমার……’

প্রহরের মুখে হাত রেখে থামিয়ে দিল অনুভব। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মেয়েটার। শ্বাস দ্রুততর হচ্ছে। সে নরম গলায় বললো,

‘এসব বলে না! ঘুমিয়ে পড়ো৷’

‘আপনাকে আমার মতো করে কেউ কেনোদিন ভালোবাসতে পারেনি অনুভব। আর ভবিষ্যতেও পারবে না!’

বলে হাসলো প্রহর। অনুভবের গলা ধরে আসছে। না বলা অনেক কিছু দলা পাকিয়ে গলার কাছে জড়ো হয়ে আছে। সে কিছুই বলতে সক্ষম হলো না। শুধু প্রহরকে নিজের সাথে জড়িয়ে বললো,

‘আমি তোমায় ভালোবাসি প্রহর। ভীষণ ভালোবাসি। আমায় নিয়ে কল্পনা করা তোমার সমুদ্রের যত ফোঁটা জল তার দ্বিগুণ পরিমাণ।’

_______

নিস্তব্ধ সকাল! আস্তে ধীরে দু চারটে শহুরে পাখির আনাগোনা শুরু হচ্ছে। ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। হাসপাতালের জানালার ওপাশে ব্যস্ততম একটা দিন শুরুর প্রস্তুতি চলছে। মধুর একটা স্বপ্নে অনুভব নড়ে উঠলো। কখন যে চোখ দুটো ভার হয়ে এসেছিল টের পায়নি। নড়েচড়ে প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহরের মাথাটা তার কোলে রাখা। সারারাত এভাবেই ছিল। ডান হাতটা এখনো তার হাতের মুঠোয়।

(চলবে)

একদম ছোট হয়ে গেছে। শুভরাত্রি। 🤍🧡

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here