অনুভবে তুমি পর্ব-৩

0
4180

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_০৩
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

আমি ভয়ে পার্সেল টা আর খুললাম না।কে জানে কি আছে এতে?যদি আবার বোম হয়?

বাসার কাউকে কি বলবো?না,না আগেই বলা যাবে না।
এমনও তো হতে পারে ভুল করে এসেছে।থাক রেখে দেই।এই ভেবে পার্সেল টা আলমারির মধ্যে রেখে দিলাম।

কিন্তু সারাদিন এই টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।
রাতে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না।কি আছে এই বক্সে?কে পাঠিয়েছে?

রাতে অনেক কষ্টে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
কিন্তু ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেলো।আমি এক লাফে বিছানা থেকে উঠলাম।গলা শুকে একদম কাঠ হয়ে গেছে।সেজন্য পানি খাওয়ার জন্য বিছানা থেকে নামলাম।কিন্তু আমার আর কিচেনে যাওয়ার সাহস হলো না।কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছে।
সেজন্য দৌঁড়ে আবার বিছানায় চলে এলাম।আর কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।সেদিনের ঘটনার পর থেকে একটুতেই ভয় পাই।আগের চেয়ে অনেক দূর্বল হয়ে গেছি।

পরের দিন আম্মুর সাথে ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম।কারন ভাইয়া আজ ভীষণ ব্যস্ত আছে।বাসা থেকে বের হতেই পাশের বাসার আন্টি এগিয়ে আসলো।তার হাতে ছিলো সেই পার্সেল টা।যেটা আমি ভয় পেয়ে কাল ফেলে দিয়েছিলায়াম।

আন্টির হাতে পার্সেল টা দেখামাত্র জিহবায় একটা কামড় দিলাম।কি করে ভুলটা করলাম?পার্সেলের গায়ে লেখা “অতশী” নামটা তুলে ফেলতে ভুলে গেছি।

আন্টি আমাকে দেখামাত্র বললো, অতশী মা এটা তোমার না?

আমি আন্টিকে কিছু বলার সুযোগই দিলাম না।
তাড়াতাড়ি করে ওনার হাত থেকে পার্সেল টা নিয়ে ব্যাগে রাখলাম।আর আম্মুকে বললাম,তাড়াতাড়ি চলো।দেরী হয়ে যাচ্ছে।

আন্টি হা করে তাকিয়ে রইলো। হয় তো ভেবেছে পার্সেল টা কুড়িয়ে এনে দিলাম,একটা ধন্যবাদ ও দিলো না।আমি তখন পিছন ফিরে বললাম,আন্টি আজ একটু তাড়া আছে।পরে কথা বলছি।

এদিকে আম্মু ভেবেছে আমি আজও অর্ডার দিয়েছি।
সেজন্য আম্মু আমাকে বকা শুরু করে দিয়েছে।তুই আজও অর্ডার দিয়েছিস?কালকেই না দিয়েছিলি?
দুই এক দিন পর পর কি এতো অর্ডার দেস?

এখন আম্মুরে আমি কি করে বোঝায় এটা সেই কালকের পার্সেলই।বুদ্ধি করে বললাম,আম্মু আমার কিছু পার্সোনাল জিনিস কেনার ছিলো।
মার্কেটে যেতে ইচ্ছে করছিলো না।
সেজন্য অনলাইনে অর্ডার করেছিলাম।

–সবকিছু কি অনলাইনেই কিনতে হবে?
যেসব জিনিস বাজারেই পাওয়া যায় সেগুলো কেনো অর্ডার করতে গিয়েছিস?

–না মানে খুব এমারজেন্সি ছিলো আম্মু।
আমার বাহিরে যেরে ইচ্ছে করছিলো না তাই,,,,,,,,,

–তোর ভাইয়াকে বললেই তো হতো!

আমি তখন বললাম,বললাম তো পার্সোনাল জিনিস।
সব কিছু কি ভাইয়ার দ্বারা আনা সম্ভব?

আম্মু সেই কথা শুনে বললো, আমাকে বললেও তো পারতিস?আমি তো কোন না কোন প্রয়োজনে মার্কেট এ সবসময় যাই।

আমি এবার আর কোনো উত্তর দিলাম না।
কারন কথা বললেই আম্মু আরো বেশি প্রশ্ন করবে।
সেজন্য চুপ করে থাকলাম।এদিকে আম্মু একা একা বকর বকর করেই যাচ্ছে।আমি শুধু অপেক্ষা করছি কখন কলেজ বের হয়?

কলেজের কাছাকাছি যেতেই দেখি পুরো কলেজ জুড়ে শুধু ভাইয়ার বন্ধু তমালের ছবি।কিছু কিছু ছবি ভালো থাকলেও বেশিরভাগই ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলছে।
তমাল হত্যার বিচার চেয়ে এই কয়েকদিন অনেক মানববন্ধনও হয়েছে।সেজন্য ভাইয়া কলেজে আসতে দেয় নি আমাকে।এখন মোটামুটি পরিবেশ টা শান্ত হয়েছে।ভাইয়ার বন্ধুকে আগে কখনোই দেখি নি।
এই প্রথমবার দেখলাম পোস্টারে।

আম্মু আমাকে গেটে রেখেই চলে গেলো।
যাওয়ার সময় বলে গেলো তোর ভাইয়া না আসা পর্যন্ত বের হবি না।খবরদার একা একা আসবি না বাসায়।
আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি সাবধানে যেও।

অনেকদিন পর আমি কলেজে আসলাম।আমাকে দেখামাত্র সবাই এগিয়ে আসলো।আমার কোনো ছেলে ফ্রেন্ড ছিলো না।কারন ভাইয়ার ভয়ে আমি কোনো ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলি না।আমরা ছিলাম চারবান্ধুবী।নেহা,লিশা আর সুইটি।

ক্লাস শেষে সবাই কলেজের ক্যান্টিনে গেলাম।
আর সবার জন্য এক প্লেট করে ফুঁচকা অর্ডার করলাম।
সবাই অনেক হাসিঠাট্টা করছে।নানা ধরনের গল্পও করছে।বাট আমার মুখে কোনো হাসি ছিলো না।
আমি পার্সেল টার কথা ভাবছিলাম।আর ভাবছিলাম সেদিনের ঘটনা।কি হচ্ছে এসব আমার সাথে?কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

খাবারের বিল দিতে গিয়ে লিশা বক্স টা দেখে ফেলে।
আর জিজ্ঞেস করে দোস্ত এটা কিসের বক্স?

আমি তা শুনে চমকে উঠলাম।
আর লিশার হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু লিশা সেটা কিছুতেই দিলো না।

এদিকে লিশার হাত থেকে বক্সটা নেহা আবার নিলো।
সে হাসতে হাসতে বললো তলে তলে এতোদূর?
কে গিফট দিয়েছে সত্যি করে বল?এই বলে নেহা গিফটা খুলতে ধরলো।

আমার ভীষণ ভয় হতে লাগলো।ভিতরে যদি আবার খারাপ কিছু থাকে! এদের কে তো বোঝানোও যাচ্ছে না।আর এরা আমার কথা শুনলে তো?

আমি তখন বললাম, এই প্লিজ তোরা বাড়াবাড়ি করিস না।আমি নিজেও জানি না কে দিয়েছে এটা?আর ভিতরে কি আছে?

সুইটি সেই কথা শুনে বললো, ধরা পড়ে এখন বাহানা করছিস?তাহলে তোর কাছে এই বক্স আসলো কিভাবে?আমরা দেখবোই কি আছে এতে?এই বলে ওরা সবাই মিলে ক্যান্টিনের মধ্যেই বক্স টা ওপেন করলো।

ওদের এমন দুষ্টামি দেখে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিলো।
আমি রাগ করে উঠে যেতে ধরলাম।
হঠাৎ নেহা তার মিষ্টি কন্ঠে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো।

❝মনের নীল খামে
এই চিরকুট দিলাম তোমার নামে
তুমি পড়ে নিও গোপনে
একদিন তোমায় নিজের করে পাবো আমার এই জীবনে❞

❝ওহে প্রিয়তমা!
তোমার রুপের নেই যে তুলনা!
তুমি যে অপরুপা!
সেজন্যই যায় না ভোলা!
মায়াবি তোমার আঁখি!
আর পাগল করা মুখের হাসি!
সেজন্যই বোধ হয় রোজ রোজ নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি!

কবিতাটি শুনে ওরা সবাই হাসাহাসি করছে।আমি সেজন্য আবার এগিয়ে এলাম।আর চিরকুট টা নেহার হাত থেকে কেড়ে নিলাম।আমি নিজেও পড়লাম।
একবার নয় দুইবার নয় বার বার পড়লাম।আর ভাবতে লাগলাম কে পাঠিয়েছে এই চিরকুট?এমন আবেগ দিয়ে কে লিখেছে আমার জন্য?

নেহা হঠাৎ একটা চকলেট আমার মুখে পুরে দিলো আর একটা গোলাপ ফুল কানে নিয়ে বললো,এতোদূর গিয়েছিস?আর আমরা কিছুই জানি না?যা তোর সাথে কোনো কথা নাই আমাদের।এই বলে একটা চকলেট বক্স আর কিছু ফুল হাতে দিলো যেগুলো এই বক্সের মধ্যে ছিলো।ফুলগুলো কিছুটা শুকিয়ে গেছে।
তবে খুব সুন্দর ছিলো।একদম গাঢ় খয়েরী কালারের গোলাপ।

আমি তখন চিরকুট টা ভাজ করে নেহার হাতে দিলাম।
চকলেট বক্স দিলাম লিশার হাতে।আর ফুলগুলো দিলাম সুইটিকে।তারপর বললাম,সব তোদের কাছেই রাখ।এসবের কোনো প্রয়োজন নেই আমার।
যেখানে আমি নিজেই জানি না কে পাঠিয়েছে এগুলো, সেখানে তোরা যা নয় তাই ভাবছিস?তোরা এটা ভাবলি কি করে?আমার ভাইকে তোরা চিনিস না?

সুইটি তখন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। রাগ করিস না।তোর কথা বাদ দে।ধরলাম তুই কিছু জানিস না।
কিন্তু যে এগুলো পাঠিয়েছে সে তো তোকে পছন্দ করে।
তোকে অনেক ভালোবাসে।কি করবি এখন?

–জানি না।

লিশা তখন বললো, ছেলেটি যদি তোর সামনে এসে দাঁড়ায়?সবার সামনে প্রপোজ করে তখন কি করবি?

আমি এবার চুপচাপ থাকলাম।কারন আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।শুধু মনে মনে প্রার্থনা করলাম এমন ঘটনা যেনো না ঘটে।তাহলে সেই ছেলের অবস্থা তো খারাপ হবে হবেই সাথে আমারও খবর আছে।

আমার বান্ধুবীরা এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে ভীষণ আনন্দ করছিলো।আর জোরে জোরে হাসিঠাট্টা করছিলো।

হঠাৎ পাশের বেঞ্চ থেকে একদল ছেলে জোরে করে বললো,
স্টপ।এতো জোরে কথা বলছো কেনো তোমরা?
ভদ্রতা শেখো নি?এটা ক্যান্টিন কোনো মাছের বাজার না।

আমরা তা শুনে সবাই পিছন ফিরে তাকালাম।
ওনারা সবাই ভার্সিটির বড় ভাই ছিলেন।আর সাথে আছেন আমাদের ভার্সিটির ছাত্রনেতা আহসান।
আমরা ওনাদের খেয়ালই করি নি।আমি শুধু একবার তাকিয়েছি তাতেই কেমন যেনো বুকটা ধক করে উঠলো।আর দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস হলো না।
কারন চার পাঁচজন ছেলেকে একসাথে দেখলেই আমার এখন ভীষণ ভয় করে।সেদিনের ওই সন্ত্রাসী গুলোর কথা মনে পড়ে।

আমাদের ভার্সিটিতে ছাত্রদলের নেতা হলো আহসান।
আর আহসানের সাথে সবসময় এক ঝাঁক ছেলেকে দেখা যায়।

ভাইয়ার বন্ধু তমাল ছিলো বিপক্ষ দলের।ভাইয়া আমাদের ভার্সিটিতে না পড়লেও তমালের সাথে তার অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিলো।তমাল মারা যাওয়ার পর অনেকেই আহসান কে দায়ী করছে।কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আহসান কে কেউ কিছু বলছে না।
এদিকে আমার মনেও প্রচন্ড ভয়।সাহস করে ভাইয়াকে এখন পর্যন্ত কিছুই বলি নি।তাছাড়া আমি নিজেও তো জানি না সেদিনের ছেলেগুলো আসলে কে ছিলো?
হঠাৎ মনে হলো যদি আবার এরাই সেই সন্ত্রাস হয়, এরা তো আমাকে দেখেছে সেদিন।যদি চিনতে পারে?
না,না আর এখানে থাকা যাবে না।এই ভেবে আমি তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে উঠে গেলাম।
আমার দেখাদেখি আমার ফ্রেন্ডরাও উঠে এলো।
আমরা সবাই সোজা ক্লাস রুমের দিকে চলে গেলাম।

কিন্তু হঠাৎ নেহা বললো,এই একটা তো ভুল হয়ে গেলো?

–কি ভুল?

–চিরকুট টা তো ক্যান্টিনেই রেখে এসেছি।

আমি তখন বললাম কি করেছিস এটা?
ঐ ভাইগুলোর হাতে গেলে কি হবে?

নেহা তখন বললো চিরকুটে তো তোর নাম লেখা নাই।
কিছুই হবে না।

সুইটি তখন নেহার মাথায় একটা চড় দিয়ে বললো,চিরকুটে নাম লেখা নাই তো কি হয়েছে?
বক্সটাও তো ওখানেই রেখে এসেছি।বক্সটাতে তো বড় করে লেখা “অতশী”

আমি সেই কথা শুনে আর কারো অপেক্ষায় না থেকে দৌঁড়ে চলে গেলাম ক্যান্টিনে।

#চলবে,,,
কেমন হচ্ছে গল্পটা অবশ্যই জানাবে।
রেসপন্স কম হলে গল্প লিখতে ইচ্ছে করে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here