#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৩
নির্ঝর ঘুম থেকে উঠেছে অনেকক্ষণ আগে। ফ্রেশও হয়েছে তবে বসে আছে ঘরের কোনে। কিছুই করার নেই এভাবে বসে থাকা ছাড়া । হঠাৎ করেই গাড়ির আওয়াজ পেলো সে। কে এলো এতো সকালে! নির্ঝর উঠে বেলকনির দিকে গেল। আজকের আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। বেশ সুন্দর চারদিক। বেলকনিতে আসতেই নির্ঝরের মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল।
চোখ দুটো গেল বাড়ির গেটের কাছে। মেহুর গাড়ি এটা, মেহু নামছে গাড়ি থেকে। গাড়ির পিছনের সিটের দরজা খুলে নামাল অর্ণব কে। তারা কি তাহলে তাকে দেখতে এসেছে। নির্ঝর প্রথমে ভাবল ডাক দিবে কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভাবনা বদলে দিল। ইচ্ছে করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইল। একটু অসুস্থতার ভাব! দেখাই যাক না মেহু কি তার সেবা করবে কি না! চিন্তা করবে কি না তার জন্য!
.
নীলিমা নির্ঝরের জন্য খাবার বানাতে ব্যস্ত। ছেলেটার অসুস্থতা তার মা কেও অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে এ ক’দিনে। ছেলের চিন্তায় ঠিক মতো ঘুমাতেও পারছে না। এর মাঝেই নাকি আবার বিয়ে। মশকরা হচ্ছে নাকি। বিয়ে বললেই কি হয়ে যায়। কতো কাজকর্ম থাকে বিয়েতে। কে দেখবে এসব? দুদিন পরেই মেহমান এসে হাজির হবে বাড়িজুড়ে। ছেলেটা কি তখন একটু শান্তিমতো বিশ্রাম নিতে পারবে। কিভাবে নিবে, এই বাড়িতে তো তখন আর শান্তি থাকবে না। নির্ঝরের ড্যাড কে বলে যে অন্য কোথায় থাকার ব্যবস্থা করবে তাও হবে না। আত্নীয়রা ভাববে তাদের অপমান করছি। উফ সব জ্বালা যন্ত্রণা যেন একা নিয়েই বসে আছে নীলিমা!
রিদুয়ান চৌধুরী বসার ঘরে সোফায় বসে চা খাচ্ছে। নীলিমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বার বার নিক্ষেপ করছে তার দিকে। কিন্তু উনার কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে পারছেন না। এসব যেন তার রাগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে!
কলিং বেল বেজে উঠল। একজন এসে দরজা খুলে দিল। নীলিমা রান্না ঘর থেকেই উঁকি দিয়ে সামনে তাকাল। একটা ছোট বাচ্চার পা দেখা যাচ্ছে। নীলিমা একটু ভালো করে উঁকি দিয়ে তাকাল। রিদুয়ান চৌধুরী ততোক্ষণে উঠে দাঁড়ালো। হাসি মুখে বলে উঠে,
“মেহেরিন যে!
নীলিমার কানে কথাটা যেতে দেরি হলো না। এর মানে মেহেরিন আর অর্ণব এসেছে। সে আর না উঁকি দিয়ে খাবার বানানোতে মনোযোগ দিলো।
মেহেরিন হেসে বলে উঠে,
“অর্ণব নির্ঝর কে দেখতে চেয়েছে, তাই এসেছি!
“বেশ ভালো তো। ড্যাডি অসুস্থ অর্ণব কি না দেখে থাকবে নাকি!
মেহেরিন হেসে পাশে তাকাল। নীলিমা রান্না ঘরে কাজ করছে।রিদুয়ান চৌধুরী হাত বাড়িয়ে দিল অর্ণবের কাছে। অর্ণব চট করে পিছু হটে গেল। মেহেরিন অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তুমি যাও ড্যাডির ড্যাডি সাথে যাও,আমি আসছি ঠিক আছে!
অর্ণব মাথা নাড়ল। এসে হাত ধরল রিদুয়ানের। রিদুয়ান তাকে নিয়ে সিঁড়িতে দিকে পা বাড়াল। মেহেরিন এসে দাঁড়াল রান্না ঘরে। নীলিমা নিজেকে কাজেই ব্যস্ত রাখছে। মেহেরিন পাশে দাঁড়িয়ে নীলিমা’র দিকে তাকিয়ে বলে,
“রেগে আছেন আমার উপর!
নীলিমা অবাক হয়ে কাজ থামাল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল মেহেরিন’র দিকে। মেহেরিন হেসে বলল,
“আমি আপনার রাগ টা আজ আরেকটু বাড়াতে এসেছি। আমার মনে হয় এখনকার কথাটা এই রাগের কারণে আপনি বুঝতে পারবেন।
নীলিমার অবাক এবার চরম শিখরে উঠলো। তার দৃষ্টি এখনো মেহেরিন’র মাঝে। মেয়েটার মুখটা হাসিমাখা। সে এখন এসেছে তাকে রাগাতে। হেসে হেসে কথা বলবে মনে হচ্ছে। এভাবে তাকে রাগানোর ধরণ টা কিছুটা আহ্লাদী আহ্লাদী মনে হচ্ছে তার। মেহেরিন নীলিমা’র হাত থেকে ছুড়িটা নিল। নীলিমা ক্যাপসিকাম কাটছিল। মেহেরিন সেটা কাটতে কাটতে বলল,
“আপনার রেগে থাকা টা স্বাভাবিক! ছেলের এমন অসুস্থতা অথচ আমি চাইছি এই অবস্থায় বিয়ে হোক। এতে আপনার ছেলে সুস্থতার বদলে আরো অসুস্থ হবার সম্ভাবনা বেশি আমি জানি কিন্তু কথা এটা না। কথা হলো… ( বলেই ছুরি চালানো থামিয়ে দিল। নীলিমা’র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ) বিয়ের পর নির্ঝর অর্ণব আর আমি এই বাড়িতে থাকবো না।
নীলিমা’র রাগ এবার মাথায় চড়লো। তার মুখেও রাগের আভাস দেখা যাচ্ছে। কি বলছে এই মেয়ে! বিয়ের পর এখানে থাকবে না মানে! ছেলে বিয়ের পর ছেলের বউ এখানে থাকবে না তো কোথায় থাকবে? মেহেরিন ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি দেখা গেল। সে বলে উঠে,
“আপনি রেগে যাচ্ছেন, আমি জানি সেটা। কিছু বলতে পারছেন না বলে আপনার হাত কাঁপছে। অতিরিক্ত রাগের কারনেই এমনটা হয়। আমি মনে করি এখন আপনি আমায় পুরোটা বলার সুযোগ দিবেন। দিবেন না!
নীলিমা’র মুখ এবার ফুটল, শান্ত গলায় বলে উঠে,
“কি বলতে চাও!
“বেশি কিছু বলবো না, আপনি তো জানেন অর্ণবের অবস্থা। মূলত অর্ণবের কারণেই আমরা এখানে থাকবো না। এতো তাড়াতাড়ি অর্ণব এই বাড়িতে মানিয়ে নিতে পারবে না। ওর কষ্ট হবে, এতো বছর ধরে আমি চিকিৎসা করে ওর যা উন্নতি করেছি তা হয়তো নিমিষেই চলে যাবে। এখন আপনি বলুন এখানে আমার কি করা উচিত.
নীলিমা মেহেরিন’র চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেহেরিন হেসে বলল,
“দ্বিধায় পড়ে গেলেন তো। না কথাটা এভাবে নিবেন না। সহজ ভাবে নিন। আপনিও একজন মা, আমিও একজন মা। কিন্তু মা’র মমতা আমার চেয়ে আপনি বেশি বুঝেন। ছেলের অসুস্থতার কারণে চাইছেন না এখন বিয়েটা হোক, এতে আপনার ছেলে অসুস্থ হয়ে যাবে তাহলে আপনিই বলুন আমি কিভাবে চাইবো আমার ছেলে অসুস্থ হোক। আমি কি তার ভালো চাইবো না!
নীলিমা চোখ সরিয়ে ফেলেন। চুলোয় থাকা নির্ঝরের জন্য স্যুপ টা প্রায় হয়ে এসেছে। নীলিমা তা নেড়ে একটা বাটিতে উঠাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেহেরিন সবজি কাটায় ব্যস্ত।
নীলিমা স্যুপের বাটি আর এক গ্লাপ পানি একটা ট্রে তে করে এনে মেহেরিন’র সামনে ধরে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এসব উপরে নিয়ে যাও, আমি তোমাদের জন্য নাস্তা বানাবো।
মেহেরিন নীলিমার হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে বের হতে নিবে নীলিমা তখন বলে উঠে,
“একজন মা আমি, মায়ের মন অনেক ভালো মতো বুঝি। তাই চাই না আমার জন্য অন্য কারো সন্তানের কোন ক্ষতি হোক। তোমার যেটা ভালো মনে হয় তুমি সেটাই করো!
মেহেরিন পিছনে ঘুরে নীলিমা’র দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
“একজন ভালো মা আপনি!
অতঃপর সামনে ঘুরে নির্ঝরের ঘরের দিকে পা বাড়ায়!
.
নির্ঝর কে দেখে ড্যাডি বলে চট করে বিছানায় চড়ে বসে অর্ণব। নির্ঝর উঠে বসে অর্ণবের মাথায় হাত নাড়ে। অর্ণব নির্ঝরের ব্যান্ডেজ করা হাত টা ধরে বলে,
“ড্যাডি!
“কিছু না ড্যাডি একটু চোট পেয়েছে, ডাক্তার বলেছে তোমার ড্যাডি অনেক তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তখন আবার অর্ণব কে কোলে নিতে পারবে!
নির্ঝরের কথাটা মনে হয় পছন্দ হলো না অর্ণবের। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিদুয়ান হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। নির্ঝর অর্ণবের মলিন মুখ খানা দেখে বলে উঠে,
“আমার অর্ণবের হাসি মাখা মুখটা কোথায় দেখি, কোথায় আছে!
বলেই অর্ণবের পেটের দিকে হাত বাড়ায়। অর্ণব দূরে সরে হেসে দেয়। নির্ঝর হাত ধরে অর্ণব কে কাছে কেনে তার পেটে শুড়শুড়ি দিতে থাকে। খিলখিলিয়ে হাসি অর্ণব।
.
অর্ণবের হাসির আওয়াজ ঘরের বাইরে থেকেই মেহেরিন পেলো। বুঝতে পারে না এই লোকটার সাথে কেন অর্ণব বেশ হাসিখুশি থাকে। ঘরের মধ্যে প্রবেশ ঘটল তার। প্রথম চোখাচোখি টা নির্ঝরের সাথেই হলো। নির্ঝর কে দেখে আচমকা মুচকি হাসল সে। নির্ঝর ও হাসল তার হাসি দেখে। অর্ণব বিছানায় বসে জোরে বলে উঠে,
“মাম্মি!
“অর্ণব, ড্যাডি অসুস্থ। তাকে জ্বালাতন করো না।
নির্ঝর বলে উঠে,
“কে বললো অর্ণব জ্বালাতন করে। অর্ণব তো গুড বয় তাই না অর্ণব!
অর্ণব জোরে জোরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। মেহেরিন স্যুপের বাটি টা টেবিলের কাছে রেখে বলল,
“আন্টি পাঠিয়েছে, বলেছে খেয়ে নিতে!
বলেই অর্ণব কে সড়ালো বিছানা থেকে। বলে উঠে,
“ড্যাডি এখন খাবে, অর্ণব! উনাকে বিরক্ত করো না!
নির্ঝর চোট টা পেয়েছিল বা হাতে। মেহেরিন নির্ঝরের খাটের উপর একটা ছোট সাইজের টুল রেখে তাতে খাবার রেখে দিল। নির্ঝর চামচ দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। অর্ণব পাশে বসা ছিল। কি মনে করে নিজের কাঁধের ব্যাগ টা খুলল সে। ব্যাগ থেকে বিভিন্ন রুঙের কলম বের করল। সেই আঁকা ছবি টাও বের করে দেখাল নির্ঝর কে। অর্ণব কিছু বলার আগেই নির্ঝর বলে উঠে,
“মাঝখানে অর্ণব, এটা মাম্মি আর এটা ড্যাডি!
বলেই তাকাল অর্ণবের দিকে। অর্ণব একগাল হেসে মাথা নাড়ল। নির্ঝরের ব্যান্ডেজ করা হাতে কলম দিয়ে আঁকাআঁকি শুরু করেছে অর্ণব। কি আঁকছে এসব। মেহেরিন একবার বারণ করল কিন্তু নির্ঝর না করল, করছে করুক না। যা করছে ড্যাডির জন্য’ই তো করছে।
ইচ্ছে করেই বিষম খেলো নির্ঝর। মেহেরিন কি করবে তার জন্য দেখার জন্য। সে যা ভাবল মেহু তার চেয়েও বেশি কিছু করল। পানির গ্লাস টা তার মুখের কাছে এসে ধরল। অর্ণব উঠে তার পিঠের মাঝে হাত বোলাতে লাগল। এই ছোট্ট ছোট্ট হাতে খানিকটা শুড়শুড়ি লাগতে লাগলো নির্ঝরের। সে মুখ টিপে হেসে দিল। মেহেরিন উষ্ণ গলায় বলল,
“ঠিক আছেন!
নির্ঝর মাথা রেখে কিঞ্চিত হাসল। এই আদর নিতে ভালোলাগছে তার! ইশ কোথায় ছিল এই ভালোবাসা।
.
রাতে একা ঘরে বসে আছে নির্ঝর। তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। নির্ঝর কি কি জানি একেছে। ইংরেজি শব্দে Daddy ও লিখেছে। বাহ ! বেশ ভালো লাগছে। অসুস্থ হলে সবাই যত্ন করলে সে যত্ন নিতে ভালো লাগে। কিন্তু এর মাঝে এই ছোট্ট হৃদয়ের ভালোবাসা নির্ঝর কে অভিভূত করল।
বাইরে থেকে শীতল হাওয়া বয়ে আসছে। এটা বৃষ্টির পূর্বাভাস। ইদানিং বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। এই বাতাসে কিছু একটা উড়ছে। তার কানে আওয়াজ আসছে। নির্ঝর পাশে তাকিয়ে দেখে বিছানার পাশে থাকা টেবিল একটা কাগজ উড়ছে। কাগজের উপর কিছু একটা রেখে আটকে দেওয়া হয়েছে। নির্ঝর কাগজ টা হাতে নিয়ে দেখে এটা অর্ণবের আঁকা ছবি। ছবি টা দেখে অজান্তেই হেসে দিল সে। ভেবে নিল এই ছবিটা ফ্রেম বানিয়ে রেখে দিবে!
.
আজ ২৬শে বৈশাখ! কথামতো মেহেরিন আর নির্ঝরের গায়ে হলুদ! মেহেরিন’র পরিবার থেকে শুধু সে আর অর্ণব। আর সঙ্গে এসেছেন মিস মারিয়া এবং ডঃ রাহেলা! এছাড়া আর কেউ নেই। নির্ঝর আর মেহেরিন’র গায়ে হলুদ পাঁচতারা হোটেলে আয়োজন করা হয়েছে। দু’জনের গায়ে হলুদ একসাথেই হবে। মেহেরিন একটা হলুদ রঙের লেহেঙ্গা পড়ে অনুষ্ঠানে সব প্রবেশ করল। নির্ঝরের হাত ছেড়ে মাম্মি ডেকে দৌড়ে মেহেরিন’র কাছে এলো অর্ণব। তার হাতে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল। নির্ঝর মেহেরিন’কে দেখে ভড়কে গেল। অনেকটা মিষ্টি লাগছে তাকে দেখতে। তার মুখের এই স্নিগ্ধতা এই প্রথমবার চোখে পড়ল নির্ঝরের!
প্রেস মিডিয়া সবাই উপস্থিত ছিল এই গায়ে হলুদে। খুব ধুমধাম করেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। অনুষ্ঠান শেষে মেহরিন আর অর্ণব বাড়ি আসার জন্য রওনা হলো। মেহেরিন খান বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল। পুরো বাড়ি আজ আলোতে রঙ্গিন। অনেকদিন পর বাড়ি কে রঙিন সাজে দেখল সে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিরু দি’র বিয়ের কথা। খুব ধুমধাম করেই হয়েছিল সেই বিয়ে। টানা সাত দিন অনুষ্ঠান লেগেছিল খান বাড়িতে। বাড়ির প্রথম মেয়ের মেয়ে উপলক্ষে কোন কমতি রাখেন নি শুভ্র খান। কিন্তু ছোট মেয়ের বিয়েতে নিজের জায়গার ঠাঁই টুকু পেলো না সে। তার আগেই মাথা রাখার হাত টা চলে গেল মেহেরিন’র!
মেহেরিন আজ সারারাত ঘুমালো না, কোন ঘুমের ঔষধ ও খেলো না। মাঝরাত অবদি পুরো ঘর শুধু ঘুরে ঘুরে দেখেছে অর্ণব। মেহেরিন দেখছে অর্ণব কিছুটা হলেও গ্রোথ করছে। এসব বিষয়ে তার সবসময় অনিহা থাকলেও আজ তা নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহেরিন। অনুষ্ঠানে আজ অনেকেই ছেলেকে নিয়ে অনেক কটুক্তি করেছে। কিছুটা হলেও সে খবর মেহেরিন পেয়েছে। বুঝে না মানুষের সমস্যা টা কি কোথায়? কেন এতো আগ্রহ তাদের!
নির্ঝরের এক্স গার্লফ্রেন্ড’র কিছু কথা কানে এসেছে মেহেরিন! হ্যাঁ কথার কথাই ভাবছে, শুনলো সে নাকি সুইসাইড অ্যাডেন্ট করতে গিয়েছিল। কি জানি হায়, এতোটাই ভালোবাসতো নির্ঝর কে। কিন্তু নির্ঝর বোধহয় কথা কে ভালোবাসে নি। ভালোবাসলে কি আর তাকে বিয়ে করার কথা ভাবতো। ছেলেদের ভালোবাসাও অনেক আজব। তারা যখন কাউকে ভালোবাসে তখন সবটা উজাড় করে দেবে কিন্তু তাকেই যখন ভুলে যাবে তখন এমনভাবে ভুলে যাবে যেন গাছ থেকে পরগাছা তুলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আজ পর্যন্ত যত পুরুষ মানুষ দেখলো তারা বেশির ভাগই তেমন আবার কিছু আলাদাও আছে। এই এক তার বাবা। মা মারা যাবার পরও দ্বিতীয় বিয়ে করে নি। কেন করেনি, মেয়েদের কথা ভেবে। হুম তবে আরেকটা কারন ও ছিল। তার হলো নিজের স্ত্রীর মতো গভীর ভালোবাসা।
“আমার বাবা তার অতীত নিয়েই কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বলে আর বিয়ে করে নি। মাঝে মাঝে মাঝরাতে বাবা’র রুমে এলেই দেখতাম মায়ের ছবি হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কতোটা ভালোবাসলে একটা লোক এমন করতে পারে। এমনকি মরবার আগেও বলে গেল অধরার পাশে যেন করবটা দেওয়া হয়। নিজের স্ত্রীর শেষ স্মৃতি মানে আমাকে আরর নিরু দি কে কতোটা আগলে রেখেছে তা কি এমনে এমনে। আবার কিছু পুরুষ মানুষ ও আছে যারা নিজের স্ত্রীর ঝুলন্ত লাশ দেখেও তার পাশ থেকে নিজের বাচ্চা টাকে সরিয়ে আনেন না। কতোটা অমানুষ হলে মানুষ এমনটা করে। এটা কি অন্য কারোর সন্তান। তার’ই তো সন্তান।
হ্যাঁ মেহেরিন মনে করে তার দি’র মৃত্যুর পিছনে তার জিজুর হাত আছে। কারণ সেদিন দরজা খোলা ছিল, মেহেরিন খোলা দরজা’ই পেয়েছিল। এর মানে তার আগে নিশ্চিত কেউ এসেছিল বাড়িতে। আর এটা জিজু ছাড়া কেউ না। কিন্তু যথাযথ প্রমাণ না থাকায় কিছুই করতে পারে নি সে।
এসব ভেবে তার মন বিষণ্ন হয়ে গেল। ক্লান্ত লাগতে শুরু করল তার। আগামীকাল অনেক কাজ আছে। বিয়ের কাজ, যদিও তার বাড়িতে মেহমান কেউ নেই। পুরো বাড়িতে সে একা আর অর্ণব। আর বলতে মিস মারিয়া! অর্ণবের জন্য বেশি অপরিচিত মানুষ বাড়িতে রাখে না সে।
মেহেরিন ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখে অর্ণব মেঝেতে পরে ঘুমাচ্ছে। কখন ঘুমাল ও! ইশ খেয়াল করে নি তো।
চট করে উঠে অর্ণব কে কোলে তুলল। অর্ণব ঘুমের ঘোরেই ডেকে যাচ্ছে,
“ড্যাডি, ড্যাডি!
মেহেরিন অর্ণবের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“এই তো কাল এসে পড়বে তোমার ড্যাডি!
.
সারারাত না ঘুমিয়েই কাটাল মেহেরিন। ভোরের দিকেও দু চোখের পাতা এক করল না সে। ইজি চেয়ারে বসে অর্ণব কে দেখছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অর্ণব। মেহেরিন উঠে দাঁড়াতে গেল। হুট করেই পরে গেল। মাথা ঘুরছে তার, ক্লান্ত লাগছে খুব। মেঝেতে বসে খাটে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে তবুও কারো ডাকে। মেহেরিন তাকিয়ে দেখল মিস মারিয়া! মিস মারিয়া মেহেরিন কে জিজ্ঞেস করল,
“ঠিক আছেন ম্যাম!
মেহেরিন’র চোখ মিনিমিনি করতে লাগল। পাশ থেকে অর্ণব গালে হাত রেখে বলল,
“মাম্মি!
মেহেরিন’র ঘুমের রেশ তখনো কাটে নি। তবুও বলে উঠে,
“মাম্মি ঠিক আছে অর্ণব!
অর্ণব হেসে মেহেরিন’র মাথায় হাত বোলাল। মেহেরিন’র ঘুম এখন কিছুটা হলেও কেটেছে। মেহেরিন ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে যাবার সময় হয়ে গেছে। মিস মারিয়া কে বলল অর্ণব কে যেন তৈরি করে নিয়ে আসে। অতঃপর মেহেরিন উঠে দাঁড়ায়। এখন কিছুটা হলেও ভালো লাগছে তার। ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এলো মেহেরিন। সময় হয়ে গেছে, এখনি বেরুতে হবে।
অর্ণব কালো রঙের একটা স্যুট পড়ে মেহেরিন’র সামনে এসে দাঁড়াল। মেহেরিন হেসে বলে উঠে,
“বাহ বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে তো আমার অর্ণব সোনা কে!
“মাম্মি!
মেহেরিন হেসে চোখের কাজল অর্ণবের কানের পাশে লাগিয়ে দিল। অতঃপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। মেহেরিন হোটেলে গিয়েই সাজবে তাই আর তৈরি হয় নি!
গাড়িতে থাকা অবস্থায় একবার নির্ঝরের কল এসেছিল। মেহেরিন কল রিসিভ করে বলেছিল সে আসছে। হোটেলে এসে পৌছাবার পর মিস মারিয়া’র কাছে অর্ণব কে দিয়ে মেহেরিন তৈরি হতে চলে গেল। কিন্তু এর আগে একবার নির্ঝরের সাথে দেখা করার দরকার ছিল। মেহেরিন নির্ঝরের ঘরের দিকে আগাল সেখানে সে তৈরি হচ্ছে। এসময় তার ফোনে একটা মেসেজ এলো। মেহেরিন ফোন বের করে তা চেক করতে করতে নির্ঝরের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা খোলাই ছিল। মেহেরিন দরজায় একবার টোকা দিয়ে দরজা খুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেল। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কথা নির্ঝরের অনেক কাছে তার কলার হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর নির্ঝরের হাত কথার হাতে। মেহেরিন কে দেখে নির্ঝর হতবাক হয়ে গেল। কি হতে চলেছে এখন। মেহু কি করবে? ভুল বুঝবে না তো তাকে। নির্ঝর কিছু বলতে নিলো কিন্তু তার আগেই মেহেরিন চলে গেল। অতঃপর…
#চলবে….