অনুভূতিতে তুমি 💖পর্ব-২৩

0
2536

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২২

ভোরের আলো পর্দা ভেদ করে ঘরে উঁকি দিয়েছে। অন্ধকার ঘরটা আলোর ছোঁয়া পেয়ে আলোকিত হয়ে গেছে। নির্ঝর আলতো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল অর্ণব ঘুমাচ্ছে। মুচরাতে মুচরাতে ওপাশে গেল। না আর ঘুম আসছে না। বিছানার থেকে পা নামিয়ে উঠে বসল। হামি ছেড়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। তার ঘুমের রেশ এখনো চোখে। বিছানা ছেড়ে উঠল তবে। বাথরুমের দরজার দিকে এগিয়ে এলো। দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে গেল। মিন মিন চোখে সামনে তাকাল সে। অগোছালো মেহেরিন কে ঝাপসা ঝাপসা লাগছে দেখতে। যখন’ই স্পষ্ট ভাবে দেখার চেষ্টা করল ওমনি নির্ঝরের আক্কেল গুড়ুম। চিৎকার দিয়ে উঠলো, মেহেরিনও চেঁচাচ্ছে তার সাথে। দ্রুত দরজা আটকে দিয়ে পেছনে যেতেই ধপাস করে পড়ে গেল সে। মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে রইল। বিছানার কাছ থেকে অর্ণবের গলার স্বর পাওয়া গেল। ঘুম ঘুম চোখে ড্যাডি বলে ডাকছে সে।

নির্ঝরের ঘুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দ্রুত নিচ থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। নিজের ঘর এসে বিছানায় বসে পড়ল। এতো টুকু দৌড়াতেই হাঁফিয়ে উঠেছে সে। শরীরের অন্য রকম এক অস্থিরতা! অন্যরকম অনুভূতি! চোখ বন্ধ করতেই মেহুর সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে। লাফিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। এটা কি? কি হলো এসব? এমন ভুল কি করে করল সে? আসলেই কি এমন মানায় তাকে? বিছানায় বসে দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগল কি হয়ে গেল এটা!

মেহেরিন এখনো আতঙ্কিত অবস্থায় বসে আছে মেঝেতে। ঘোর ফেরার সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে উঠল। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। কি রকম বোকামি এটা! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মন চাচ্ছে নিজের মাথা ফাটিয়ে দিতে। দরজা বন্ধ না করে বাথরুমে কিভাবে চলে এলো সে! দু হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। এই চিৎকার কান ভেদ করল নির্ঝরের। চট করে উঠে দাড়িয়ে গেল সে! মাথা ঘুরিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে লাগাল। এদিকে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে বিধায় বালিশের নিচে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল অর্ণব!

খাবার টেবিলে তিন জন বসে থাকলেও একজন’ই শুধু খেয়ে যাচ্ছে আর সে হলো অর্ণব। চামচ দিয়ে খাবার উঠিয়ে মুখে দিচ্ছে বার বার। নির্ঝরের ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। মেহেরিন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে চামচ দিয়ে খাবার নেড়েই যাচ্ছে কিন্তু খাচ্ছে না। সাহস নেই আর মেহুর দিকে তাকানোর।‌হঠা্ৎ করেই অদ্ভুত আওয়াজ আসতে লাগাল। সামনে তাকাতেই দেখল মেহু শব্দ করে খাবার তুলছে। নির্ঝরের মনে হলো মেহু একটু পর এসব খাবার তার উপরেই না ঢেলে দেয়। সত্যি’ই কি এমনটা করবে সে। চোখের দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছে আস্ত গিলে খাবে। গরম পানিতে সিদ্ধ করবে নাকি। করবে নাই বা কেন? ছোট কোন ভুল করে নি সে। মাথায় রাখা দরকার ছিল এটা মেহুর ঘর। নিজের ঘর ভেবে সোজা এভাবে বাথরুমে ঢুকে পড়া মোটেও উচিত হয় নি।

নির্ঝর খাবার ছেড়েই উঠে যেতে নিল মেহেরিন শান্ত গলায় বলে উঠে,

“আচ্ছা!

নির্ঝরের কাছে এই “আচ্ছা” কথাটা হজম হলো না। তবে কি এটা ঝড়ের পূর্বাভাস! মেহু কি এতো সহজে ছেড়ে দিবে তাকে।

ঘরে পায়চারি করে যাচ্ছে নির্ঝর। মনে স্বস্তি নেই তার। হুট করেই ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। নির্ঝর চমকে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে দরজার কাছে এলো। এপাশ থেকে কে জিজ্ঞেস করতেই ওপাশ থেকে মিস মারিয়া বলে উঠে,

“স্যার আমি কফি নিয়ে এসেছি!

নির্ঝর দরজা খুলল। কফি হাতে মেহু কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিষম খেলো সে। তার পাশে দাঁড়ানো মিস মারিয়া। মেহেরিন হেসে মিস মারিয়া কে চলে যেতে বলে ঘরে ঢুকল। নির্ঝর পিছনে যেতে লাগল। কফি মগ টা টেবিলে রেখে নির্ঝরের দিকে পা বাড়াল সে। নির্ঝর মেহেরিন কে দেখে কাশতে শুরু করল। মেহেরিন হেসে পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিল তার হাতে। নির্ঝর পানি খেয়ে কাশি থামাল। মেহেরিন হেসে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে বলে উঠল,

“তুমি আমাকে এই ভাবে ভয় দেখাচ্ছ কেন?

মেহেরিন হাসি থামিয়ে কঠিন মুখে বলে উঠল,
“আমি ভয় দেখাচ্ছি, ( নির্ঝরের কলার ধরে ) সকালে আমাকে কে ভয় দেখাচ্ছিল!

“আমি মোটেও ভয় দেখাইনি।

“তাই! ( নির্ঝরের মাথায় বাড়ি মেরে ) ম্যানারস জানেন না!

নির্ঝর মাথায় হাত দিয়ে,
“মারছো কেন? আমি কি জানতাম নাকি!

“কি জানতেন হুম কি জানতেন!

“আমি কি জানতাম যে তুমি ( মেহেরিন রেগে তাকিয়ে আছে, নির্ঝর তোতলাতে তোতলাতে বলে ) ততুততমি..

মেহেরিন রেগে নির্ঝরের পায়ে দিল পারা। নির্ঝর পা ধরে ধপাস করে বসে পড়ল। মেহেরিন নিচু হয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“অসভ্য লোক একটা আপনি!

নির্ঝর রেগে বলে উঠল,
“আমার দোষ একা কেন দিচ্ছ! তোমার দোষ ছিল না। দরজা লক না করে কেন গিয়েছিলে তুমি হুমম!

মেহেরিন দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল। চেঁচিয়ে বলে উঠে,

“আআআআ! কেন জানতো আপনি এভাবে চলে আসবেন।

“তাহলে আমি কি জানবো তুমি থাকবে। আমি প্রতিদিন যেভাবে নিজের ঘরে ঘুম থেকে উঠে যাই করি এবারও তাই করেছি!

“প্রতিদিন যা করতো তাই করেছি হুহ! মনে ছিল না এটা কার ঘর!

নির্ঝর চুপ হয়ে গেল। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
“না!

“এখন না বাহ না!

“আমার উপর সব দোষ দেওয়া বন্ধ কর, তোমারও মনে রাখা উচিত ছিল তোমার ঘরে আমি ছিলাম।

মেহেরিন চোখ ছোট ছোট করে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর মুখ ভেংচি কেটে উঠে দাঁড়াল। নির্ঝর নিচেই পা ধরে বসে রইল। মেহেরিন’র হাই হিল তার পায়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। হুট করেই নির্ঝরের চোখ পড়ল খাটের নিচে। একটা তেলাপোকা সেখানে ঘুর ঘুর করছে। নির্ঝর তাকে দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠল। দ্রুত খাটের উপর এসে বসে রইল।

মেহেরিন নির্ঝরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। নির্ঝর বালিশে মাথা গুঁজে বসে রইল। মেহেরিন জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“কি করছেন কি?

নির্ঝর বালিশের নিচ থেকে বলল,
“নিচে তেলাপোকা.. ( যা মেহেরিন বুঝতে পারল না। )

“কিহহ?

“নিচে তেলাপোকা!

মেহেরিন এবারও বুঝতে না পেরে চেঁচিয়ে বলল,
“কি বলছেন কি এসব? ঠিক করে বলুন!

নির্ঝর বালিশের থেকে মুখ সরালো। মেহেরিন’র দিকে তাকিয়ে বলল,

“নিচে তাকাও?

“ককেন?

“তাকাও!

মেহেরিন নিচে তাকাল। দেখল একটা তেলাপোকা তার পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে। মেহেরিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। চারদিক নিস্তব্ধ দেখে নির্ঝর অবাক হলো। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে ফিরল। নির্ঝর সাথে সাথে কানে হাত দিল। মেহেরিন জোরে চেঁচিয়ে উঠল!

“আআআআআআআআআ!

নির্ঝর কান থেকে হাত সরিয়ে মেহেরিন’র দিকে তাকাল। সে চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে! চোখ বন্ধ করে দু হাত মুঠ করে আছে। নির্ঝর ডাক দিল,

“মেহু বেঁচে আছো!

মেহেরিন চোখ মেলে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এটা সরান এখান থেকে!

“আমি পারবো না।

“নির্ঝর!

বলেই নিচে তাকাল, দেখল তেলাপোকা এক জায়গায় চুপ হয়ে আছে। মেহেরিন সাথে সাথে হাত দিয়ে মুখ দিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর কোলে বালিশ নিয়ে বলে উঠল,

“পারবো না। তেলাপোকা গিলে ফেলুক তোমাকে!

মেহেরিন রেগে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মুখ ভেংচি কেটে সরিয়ে নিল। মেহেরিন সেখানেই চোখ বন্ধ করে হাত মুঠ করে তাকিয়ে রইল। নির্ঝর আবারো মেহেরিন’র দিকে তাকাল। তার মুখটা কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কি জানি বিরবির করছে সে। নির্ঝর মুখ টিপে হেসে উঠল। হালকা কেশে বলে উঠল,

“হাম মেহু..

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বেঁচে আছি!

“আলহামদুলিল্লাহ! তা ওখানেই কি দাঁড়িয়ে থাকবে।

“এটা এখানেই আছে!

“তাই!

বলেই নির্ঝর নিচে উঁকি মারল। তেলাপোকা দেখে নিজেই একটা ঢোক গিলল। হেসে বলে উঠল,

“মনে হচ্ছে না এটা এখান থেকে চলে যাবে।

“তাড়িয়ে দিন না এটা!

“সরি বলো!

“কককিহ?

“সরি বলো আর বলো সকালে যা হয়েছে সব দোষ তোমার?

“কিহহ? কি বললেন আপনি।

“যা শুনেছ তাই! এখন জলদি জলদি বলে ফেলো।

“নাহ বলবো না।

“তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো!

বলেই নির্ঝর ওপাশ ফিরে শুয়ে রইল। মেহেরিন রেগে দাঁতে দাঁত চেপে নির্ঝরের থেকে মুখ সরিয়ে নিল। তেলাপোকার দিকে তাকাল‌। এটা এখন তার পায়ের কাছে। মেহেরিন শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“হুশ হুশ! হুশ..

নির্ঝর জোরে জোরে হাসতে লাগল। মেহেরিন জোরে বলে উঠল,

“হাসবেন না একদম!

তখনই তেলাপোকা ঘুরাঘুরি করতে লাগলো। মেহেরিন কাঁদো কাঁদো মুখ করে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। নির্ঝর হেসে তার দিকে ফিরল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,

“তাহলে.. সরি বলছো!

মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকাল। বলে উঠল,
“সরি!

“আর..

মেহেরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“সব দোষ আমার ছিল!

নির্ঝর এবার দাঁত বের করে হাসল। চুল গুলো এলোমেলো করে বলল,
“আহ তাহলে মানছো!

“এখন আসুন!

নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আসছি!

অতঃপর সে নিচে নামার জন্য পা বাড়াল। ওমনি তেলাপোকা আবারো নড়াচড়া শুরু করল। নির্ঝর লাফিয়ে বিছানার এক কোনে বসে পড়ল। মেহেরিন রেগে বলল,

“নির্ঝর!

“দেখছ না এটা কেমন নড়ছে!

“তো আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন।

“যদি আমাকে খেয়ে ফেলে তখন!

“হুহ তেলাপোকা খাবে হাতি, আসছে..!

“কিছু বললে..

“হ্যাঁ বললাম, আমি আমার কথা রেখেছি। এবার আপনার পালা!

নির্ঝর কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
“ঠিক বলেছ!

অতঃপর টেবিলের কাছ থেকে একটা বই উঠাল। বিছানা থেকে নেমে মেহেরিন’র কাছে গেল। মেহেরিন শুকনো ঢোক গিলে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর ফিসফিসিয়ে বলল,

“নড়বে না একদম!

মেহেরিন ভয়ে কাঁপতে লাগলো। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। নির্ঝর খুব সাবধানে বই টা তার উপর ফেললো। অতঃপর হেসে বলল,

“আহ মরে গেছে!

“সত্যি তো!

“হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি, দেখো!

মেহেরিন চোখ মেলে তাকিয়ে নিচে দেখতে লাগল। কিছু দেখতে না পেয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর বাঁকা হেসে বলল,

“তাড়িয়ে ফেলছি!

মেহেরিন নির্ঝরের হাত চেপে ধরে লাফিয়ে চেঁচাতে লাগলো! নির্ঝর থমতম খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মেহেরিন থেমে শ্বাস নিতে লাগল। নির্ঝর বলে উঠল,

“এখন কেন চেঁচাচ্ছো?

মেহেরিন দম নিয়ে বলল,
“তখন চেঁচাতে পারি নি তাই..

“কিহহ?

“হুম হুম!

নির্ঝর মুখ টিপে হেসে বলল,
“ভুল করেছ, দেখো তোমার চেঁচামেচি’তে তেলাপোকা আবারো চলে এসেছে!

“কককোথায়?

নির্ঝর মেহেরিন’র কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোমার পায়ের কাছে!

মেহেরিন চোখ বড় বড় করে নির্ঝরের দিকে তাকাল। হুট করেই জরিয়ে ধরল তাকে। শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলল,

“তাড়িয়ে দিন তাড়িয়ে দিন! প্লিজ প্লিজ তাড়িয়ে দিন!

নির্ঝর মিট মিট করে হাসতে লাগলো!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here