অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব-১৬

0
941

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★রাতের ঘন বর্ষণের ইতি টেনে ভোরের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। আলোর আভাস লাগতেই প্রহরের ঘুম ভেঙে এলো। চোখ খুলে তাকিয়ে প্রথমে প্রিয়তমার মুখদর্শন করলো। যে এখন পরম শান্তিতে তার বুক জমিনে ঘুমিয়ে আছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে খুশির এই মায়াবী মুখখানা দেখে হাজারো প্রশান্তির বাতাস ছুঁয়ে গেল প্রহরের মন মস্তিষ্ক জুড়ে। আজকের সকাল টা সবচেয়ে স্পেশাল প্রহরের কাছে। জীবন এতো সুখের হতে পারে এটা হয়তো খুশিকে না পেলে জানতোই না। প্রহর খুশির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে, আস্তে করে খুশিকে কোলে তুলে নিল। রুমে এসে খুশিকে বেডের ওপর শুইয়ে দিল। গায়ের ওপর চাদর টেনে দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল প্রহর।

বেলা আট টা,
ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে এলো খুশির। চোখ খুলে নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো। টেবিলের ওপর ফোন দেখে আলসেমি ভরা শরীরে উঠে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো বাসার নাম্বার। খুশি বুঝতে পারছে এটা কার নাম্বার। ও দ্রুত ফোন রিসিভ করে অপরাধী সুরে বললো।
–সরি সরি বাবু। অ্যাম সো সরি।ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দে প্লিজ? আর কখনো এমন হবে না।

তবে ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ প্রতিত্তর এলোনা। খুশি করুন সুরে বললো।
–এখনো রাগ করে থাকবি? সরি না বাবু। আমার বাবু টা কতো ভালো। প্লিজ কথা বলনা ?দেখ তুই কথা না বললে কিন্তু আমি কেঁদে দিবো বলে দিলাম। দিবো কেঁদে?

এতক্ষণে ওপাশ থেকে নিভান মৌনতা ভেঙে বলে উঠলো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে কাঁদতে হবে না। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কাঁদতে দেখতে পারি না। কিন্তু তুমি এটা ঠিক করোনি। আমাকে না বলে তুমি চলে গেলে? আবার রাতেও থাকলে। একবার ফোনও করলে না। তুমি জানো না তুমি ঘুম না পারিয়ে দিলে আমার ঘুম আসেনা? তোমার ওই ড্রিম ম্যান কে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছ তুমি।

–কে বলেছে বাবু। আমার কাছে তোরচেয়ে গুরুত্ব আর কারোরই নেই। তুই আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি। আসলে কাল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাচ্ছিলো না। তাই তোকে ফোন করতে পারিনি। এখন আর রাগ করে থাকিস না প্লিজ?

–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে যাও মাফ করে দিলাম।

–থ্যাংক ইউ বাবু। আই লাভ ইউ সোওওওওওও মাচ। আমার কিউটি, কলিজা সোনা উম্মাহহ্

প্রহর খুশির জন্য ট্রে তে করে নাস্তা নিয়ে এসেছিল। তবে দরজার কাছে আসতেই খুশির ফোনালাপ শুনতে পেল ও। খুশির এভাবে কথা বলাই ভ্রু কুঁচকে এলো প্রহরের। হাসি মুখটা গায়েব হয়ে গেল ওর। হঠাৎ রাগ এসে মাথায় ভর করলো। তবে এবার আর গতবারের ভুল করবে না প্রহর। না জেনে শুনে আগেই কোনরকম ওভার রিয়্যাক্ট করা যাবে না। তাই আপাতত নিজের রাগ দমিয়ে নিয়ে ভেতরে এলো ও। এতক্ষণে খুশির কথা শেষ হয়ে গেছে। প্রহর নাস্তার ট্রে টেবিলের ওপর রেখে খুশির কাছে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–কার সাথে কথা বলছিলে?

খুশি বুঝতে পারছে প্রহর নিশ্চয় ওর কথা শুনে অন্যকিছু ভাবছে। তাই প্রহরকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য খুশি এটিটিউট দেখিয়ে বললো।
–আছে কেউ। আমার লাইফের সবচেয়ে স্পেশাল ম্যান। যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। সে আমার জীবনে তোমার আগে থেকেই আছে।

প্রহর এবার রাগ সামাল দিতে পারলোনা। খুশির হাত শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–কে সে? নাম বলো।

খুশি বাঁকা হেসে বললো।
–এতো তাড়াহুড়োর কি আছে ডার্লিং? শুধু নাম কেন, সরাসরি দেখাই করিয়ে দিবো। আজ বিকাল ৪ টায় ****রেস্টুরেন্টে চলে এসো। দেখা করিয়ে দিবো। আর হ্যাঁ একটা কথা মনে রেখ, আমার সেই স্পেশাল ব্যাক্তি যদি তোমাকে মেনে নেয় তবেই তুমি আমাকে পাবে। নাহলে আমার কথা ভুলে যাও। বুঝতে পেরেছ? এখন সরো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

খুশি প্রহরকে পাশ কেটে মুখ টিপে হেঁসে ওয়াশরুমে চলে গেল। আর প্রহর পেছন থেকে রাগে ফেটে যাচ্ছে। স্পেশাল ম্যান হাঁ? স্পেশাল মাই ফুট। আবার সে নাকি আমাকে খুশির জন্য চুজ করবে। তারমানে কি? কোথাকার কোন ইডিয়ট এখন আমার আর খুশির ভবিষ্যৎ ডিসাইড করবে? এই স্পেশাল ম্যানকে যদি আমি স্পেশাল রুগী না বানিয়ে দিয়েছি আমার নামও প্রহর মেহরাব না। কুল ডাউন প্রহর। কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ। এখন রাগলে চলবে না। একবার ওই স্পেশাল ম্যান কে সামনে পাই তারপর দেখাবো মজা। আমার দুষ্টুপরির স্পেশাল ম্যান হওয়া তাইনা? আজ বুঝতে পারবে ও কার সাথে পাঙ্গা নিয়েছে।
___

খুশির কথামতো প্রহর টাইম অনুযায়ী রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে। রাগে শুধু হাত পা নাড়াচ্ছে। আর কিভাবে ওই ব্যাক্তির হাড্ডি গুড্ডি গুড়িয়ে ফেলবে সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পরেই খুশি এলো। আরামে হেলেদুলে এসে প্রহরের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। প্রহর আশেপাশে তাকিয়ে বললো।
–কোথায় তোমার সেই স্পেশাল ম্যান? নাকি ভয় পেয়ে পালিয়েছে।

খুশি এটিটিউট নিয়ে বললো।
–ও হ্যালো, আমার বাবু কখনো কাওকে ভয় পায়না বুঝেছ? হি ইজ ভেরি ব্রেভ। হ্যাভ সাম পেশেন্স। এখুনি আসবে আমার বাবু।

খুশির মুখে বারবার বাবু শুনে প্রহরের শরীর জ্বলে যাচ্ছে।চোখ বন্ধ করে অনেক কষ্টে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখছে। বাচ একবার শুধু আসুক ওই নমুনাটা তারপর ওর বাবুগিরি বার করছি। তখনই খুশি বলে উঠলো।
–এইতো এসে গেছে আমার বাবু।

প্রহর চোখ খুলে রাগী মুডে তাকালো সামনে। তবে সামনে নিভানকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রহর। খুশির বাবু যে এই ছেলে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি প্রহর। প্রহর অবাক সুরে বললো। –এ তোমার বাবু??

খুশি হাসিমুখে বললো।
–হ্যাঁ এই হলো আমার বাবু। মাই ফার্স্ট লাভ। আমার একমাত্র কলিজার টুকরা ভাই। ওর নাম নিভান।

প্রহর বেচারা থতমত খেয়ে গেল। তারমানে খুশি ওর ভাইয়ের কথা বলছিল? আর আমি কিনা কিসব ভেবে বসে আছি। থ্যাংক গড। প্রহর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিল। তারপর মুচকি হেসে নিভানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–হেলো নিভান। হাউ আর ইউ?

নিভান দুই হাত ভাজ করে গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–অ্যাম গুড।

এতো অল্পবয়সেও এমন ম্যাচিউরিটি দেখে প্রহর একটু অবাকই হলো। খুশি এবার বলে উঠলো।
–হ্যাঁ তো যেমন টা বলেছিলাম। আমার বাবু যদি তোমাকে মেনে নেয় তবেই আমাদের সম্পর্ক সামনে এগুবে। নাহলে এখানেই দি এন্ড। আর এটা মোটেও মজা না বুঝেছ? এখন তোমরা ম্যান টু ম্যান কথা বলো। আমি একটু ঘুরে আসছি।
কথাটা বলেই খুশি উঠে চলে গেল। যেতে যেতে প্রহরকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বেস্ট অফ লাক ইশারা করে গেল।

প্রহরের একটু চিন্তা হচ্ছে। নিভান ওকে পছন্দ করবে তো? আরে এতো চিন্তার কি আছে? ছোট বাচ্চা ছেলেই তো। এক মিনিটেই ইমপ্রেস করে ফেলবো। প্রহর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ তো নিভান কি খাবে তুমি? চকলেট আইসক্রিম অর্ডার করবো তোমার জন্য?

নিভান আবারও গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–আই ডোন্ট লাইক চকলেট। আর আমার কিছু লাগলে আমি নিজেই অর্ডার করে নিবো। ইউ ডোন্ট বদার।

–ওকে ফাইন। এ্যাজ ইউ সে। বাইদা ওয়ে ইভান তুমি কিন্তু অনেক কিউট।

–আই নো। আপু বলেছে। টেল মি সামথিং আই ডোন্ট নো।

বাপরে এই ছেলে তো দেখছি আমার চেয়েও বেশি গম্ভীর। একে কিভাবে বসে আনবো?নিভান যদি আমাকে মেনে না নেয় তাহলে কি হবে? কি দিন এসে গেল তোর প্রহর? এক বাচ্চা ছেলের সামনে তোর হাওয়া টাইট হয়ে যাচ্ছে।এতো সহজে হার মেনে নিতে পারিস না তুই। শো সাম স্কিল। প্রহর আবারও জোরপূর্বক হেসে বললো।
–নিভান ইউ লাইক ভিডিও গেম? আমার কাছে লেটেস্ট ভিডিও গেম আছে। তুমি চাইলে আমি দিতে পারি।

নিভান এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলে উঠলো।
–দেখুন আমাকে এসবের লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। এতে করে কিছুই হবে না। তাই বাচ্চা ভেবে মন ভোলানোর চেষ্টা করার দরকার নেই। তাই আসল কথায় আসি। দেখুন আমি দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি আমার আপুকে ভালোবাসি। আপুর চেয়ে বেশি জরুরি আর কিছুই না। আপুর খুশিই আমার খুশি। আর আপুর খুশি আপনাতে। আমি শুধু এতটুকু শিওর হতে চাই যে আপনি আমার আপুকে কখনো কষ্ট দিবেন না। আপুর মুখের হাসি কখনো বিলীন হতে দিবেন না। ব্যাচ এটারই শিওরিটি চাই আমার। নাথিং ইলস।

প্রহর মুচকি হেসে স্বাভাবিক সুরে বললো।
–নিভান বলতো মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি কি?

নিভান বলে উঠলো।
–নিঃশ্বাস।

–ঠিক বলেছ। তাহলে তুমি কি চাইবে জেনে শুনে তোমার নিজের নিঃশ্বাস কে বন্ধ করতে?

–একদমই না। এমন বোকামি আমি কেন করবো?

–এক্সাক্টলি। তো তোমার আপুও আমার জীবনে নিঃশ্বাসের কাজ করে। তো নিজের নিঃশ্বাস কে কোন কষ্ট দেওয়ার মতো বোকা নিশ্চয় আমি না। আমি হয়তো ওয়াদা করতে পারবোনা যে আমার দ্বারা কখনো কোন তোমার আপু দুঃখ পাবে না। আমি রক্ত মাংসের গড়া মানুষ। তাই স্বাভাবিক মানুষের মতো আমারও কখনো কখনো ভুল ত্রুটি হতে পারে। তবে আমার কোন ভুলের কারণে যতটা না তোমার আপু কষ্ট পাবে। তারচেয়ে হাজার গুন বেশি আমার কষ্ট হবে। তাই আমি অবশ্যই ইচ্ছে করে নিজেকে কোনরকম কষ্ট দিতে চাইবোনা। কারণ মানুষ সবার আগে নিজের ভালোটাই চায়।

প্রহরের জবাবে এবার নিভানের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। নিভান মুচকি হেসে বললো।
–আমি জানতাম আমার আপুর চয়েস কখনো ভুল হতে পারে না। কারণ আমার আপু বেস্ট টাই ডিসার্ভ করে। এন্ড ইউ আর বেস্ট ফর হার।

প্রহর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো।
–থ্যাংক ইউ নিভান। এন্ড আই মাস্ট সে,খুশি ইস রিয়েলি লাকি টু হ্যাভ এ ব্রাদার লাইক ইউ।

–উহুম। আই অ্যাম লাকি টু হ্যাভ এ সিসটার লাইক হার। আর আপুর কারণে আপনার মতো ভাইয়াও পেয়ে গেলাম। তো আমিতো ডাবল লাকি।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার মাধ্যমে প্রহর আর নিভান একজন আরেকজনের সাথে মোটামুটি ভালোই মিশে গেল। খুশি আড়াল দেখে ওদের দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। ওর জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার দুজনকে একসাথে মিশতে দেখে খুশির মন ভরে উঠছে।
___

যথারীতি রোজকার মতো খুশিকে কলেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রহর খুশির বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে এসে বসে আছে। একটু পরেই খুশি বেড়িয়ে এলো গেট দিয়ে। গাড়িতে বসে বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার আজ সিভিল ড্রেসে আসতে বললে যে? আমরা অন্য কোথাও যাচ্ছি নাকি?

প্রহর ড্রাইভ করতে করতে বললো।
–হ্যাঁ আমরা আজ অন্য কোথাও যাচ্ছি।

খুশি সবসময়ের মতো দুষ্টু হেসে বললো।
–কোথায়? রুমডেটে যাচ্ছি বুঝি?

আর যথারীতি প্রহর রাম ধমক দিয়ে বললো।
–শাট আপ ইডিয়ট। মুখে মাঝে মধ্যে একটু ব্রেকও দিতে হয় তাকি জানো তুমি?

খুশি ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। প্রহর মুচকি হেসে বললো।
–হয়েছে আর গাল ফুলাতে হবে না। তুমি কাল তোমার ফ্যামিলির সাথে দেখা করিয়েছিলে তাই আজ আমি আমার পরিবারের সাথে তোমার দেখা করিয়ে দিবো। আমার পরিবার বলতে শুধুই আমার বাবা। আর আজ বাবার জন্মদিন।

খুশি উৎসাহী কন্ঠে বললো।
–ওয়াও, তাহলে তো আঙ্কেলের জন্য গিফট নেওয়া উচিত।

–হুম, গিফট নিয়েছি তো। বাবার সারপ্রাইজ গিফট হলো তুমি। বাবার জন্য তোমার চেয়ে বড়ো গিফট আর কিছুই হবে না। যখন সে দেখবে তার ছেলে ফাইনালি তার জন্য ছেলের বউ এনেছে। তখন সে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।

খুশি একটু মলিন সুরে।
–আঙ্কেল আমাকে পছন্দ করবে তো?

–আরে পছন্দ করবে না কেন? আমার কিউট দুষ্টুপরি টাকে কেউ না পছন্দ করে থাকতে পারে? আর তুমি আমার বাবাকে চেন না। তারজন্য তো এটাই যথেষ্ট যে আমি কোন মেয়েকে পছন্দ করেছি। তুমি জানো না সে এই দিনটার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে।দেখবে সে তোমাকে দেখেই খুশি হয়ে যাবে।

মিনিট ত্রিশ পর ওদের গাড়ি প্রহরদের বাসার গেট দিয়ে ঢুকলো। গাড়ি থামিয়ে ওরা নেমে এসে বাসার দরজায় এসে প্রহর খুশিকে একটু দরজার আড়ালে দাড় করিয়ে দিয়ে কলিং বেলে টিপ দিল। একটু পরে জিদান সাহেব এসে দরজা খুলে দিল ।প্রহরকে দেখে বললো।
–কিরে তুই এই সময় বাসায়?

প্রহর এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো। –হ্যাপি বার্থডে বাবা। মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে।

জিদান সাহেব মুচকি হেসে বললো।
–হয়েছে হয়েছে বুড়োকালে আর বার্থডে বার্থডে খেলতে হবে না।

প্রহর ওর বাবাকে ছেড়ে দিয়ে বললো।
–বাবা তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

–সারপ্রাইজ? কি সারপ্রাইজ?

প্রহর এবার খুশিকে ডাক দিল। খুশি আস্তে করে ভেতরে এসে প্রহরের পাশে দাঁড়াল। প্রহর খুশিকে দেখিয়ে বললো।
–বাবা ও খুশি। লাভ অফ মাই লাইফ। তোমার হবু বউমা।

খুশি জিদান সাহেব কে সালাম দিল। তবে প্রহরের কথায় জিদান সাহেবের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি কতক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ বলে উঠলো।
–কত টাকা দিয়েছিস?

জিদান সাহেবের এমন উদ্ভট প্রশ্নে প্রহর থতমত খেয়ে বললো।
–টাকা? কিসের টাকা? কি বলছ বাবা?

–হ্যাঁ টাকা। কত টাকা দিয়ে মেয়েটাকে তোর গার্লফ্রেন্ড হওয়ার এক্টিং করানোর জন্য নিয়ে এসেছিস? দেখ আমাকে খুশি করার জন্য অযথা এসব করার দরকার নেই। আমি এটা মেনে নিয়েছি যে আমার ছেলে একটা অপদার্থ। তার দ্বারা এসব সম্ভব না।আর হ্যাঁ ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আমার সব সম্পত্তি তোকেই দিবো। তাই এসব নাটক করার দরকার নেই।

জিদান সাহেবের কথায় খুশি মুখ টিপে অনেক কষ্টে নিজের হাসি আটকে রাখছে। প্রহর করুন সুরে বললো।
–বাবা কি বলছ এসব? এসব কোন নাটক না। আমি সত্যিই বলছি।

–হতেই পারে না। এতো মিষ্টি একটা মেয়ে তোকে ভালোবাসবে? নো চাঞ্চ।

বেচারা প্রহরের করুন অবস্থা দেখে এবার খুশি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–আসলে আঙ্কেল এটা সত্যি। আমি জানি এটা বিশ্বাস করাটা একটু কঠিন। আপনার এই হাঁদারাম ছেলের জন্য আমার মতো কাওকে পাওয়া অনেক টা পাথরে ফুল ফোটার মতো ব্যাপার। তবে ওইযে কথায় আছে না, লাক বাই চাঞ্চ। তেমন এটাও তাই। আমরা সত্যিই একজন আরেকজনকে ভালবাসি।

নিজেকে এভাবে পঁচাতে দেখে প্রহর চোখ গরম করে তাকালো খুশির দিকে। এতক্ষণে জিদান সাহেবের মুখে হাসি ফুটলো। তিনি প্রফুল্ল কন্ঠে বললেন।
–তারমানে প্রহর সত্যিই বলছে? আলহামদুলিল্লাহ, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। এবারের জন্মদিনে এতো ভালো উপহার পাবো ভাবতেই পারিনি।হাঁদারাম টা এতদিনে একটা সত্যিকারের খুশির সংবাদ দিয়েছে।

প্রহর করুন সুরে বললো।
–বাবা তুমিও?

–এই তুই চুপ করতো। এসো মা এসো ভেতরে এসো। তোমার হবু শশুর বাড়িতে তোমার স্বাগতম।

জিদান সাহেব খুশিকে নিয়ে এসে সোফায় বসালো। প্রহর বলে উঠলো।
–তোমরা বসে কথা বলো আমি খাবার কিছু নিয়ে আসছি।
কথাটা বলে প্রহর কিচেনের দিকে চলে গেল।

প্রহর চলে যেতেই খুশি জিদান সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–নেন এখন শুরু করেন।

জিদান সাহেব খুশির কথা বুঝতে না পেরে বলে উঠলেন।
–শুরু করবো? কি শুরু করবো?

–আরে নিজের ডায়লগ বলেন।

–ডায়লগ? কি বলছ এসব?

–দেখুন আমি জানি এমন সিচুয়েশনে কি হয়। বাবা মা ছেলেমেয়েদের সামনে হাসিমুখে তাদের প্রেমিক/প্রেমিকা কে মেনে নেয়।তারপর তাদের অগোচরে আসল মনের কথা গুলো জাহির করে। বলে তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলেকে নিজের ফাঁদে ফেলার? কোথায় তুমি আর কোথায় আমার ছেলে? এক্সক্ট্রা এক্সক্ট্রা,,।তো আপনারও নিশ্চয় এখন ওসব বলতে ইচ্ছে করছে তাইনা? তাহলে শুরু করেন।

জিদান সাহেব হেসে উঠে বললেন।
–আরে না। আমি কেন এমন বলতে যাবো? আমিতো সত্যিই খুশি তোমাদের জন্য।

খুশি এবার মলিন সুরে বললো।
–দেখুন এমন করবেন না প্লিজ। আমার কতদিনের শখ আমি ওই চৌধুরী সাহেব ওয়ালা ডায়লগ বলবো। আপনাদের সারনেমও চৌধুরী। আর আপনি বলছেন আপনি বলবেন না ওসব? তাহলে কিন্তু আমি খেলবোনা বলে দিলাম। একটু খানি বলুন প্লিজ। মজা করে হলেও বলুন।

জিদান সাহেব বুঝতে পারছেন মেয়েটা খুবই চঞ্চল আর ফিল্মি। তাই ওর মন রক্ষার্থে তিনি বলে উঠলেন।
–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলছি।
জিদান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ফিল্মি কায়দায় বললেন।
–এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলের দিকে হাত বাড়ানোর? কোথায় তুমি আর কোথায় আমার বাঁদর মার্কা থুক্কু হিরার টুকরা ছেলে। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাও। বলো কত টাকা চাই তোমার? কত টাকা হলে আমার ছেলের পিছু ছাড়বে।

খুশি এবার তার মেলোড্রামা চালু করে দিল। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো।
–চৌধুরী সা…হে….ব!! আমার ভালোবাসা এতো সস্তা না যে,আপনার সামান্য কিছু টাকার সামনে বিক্রি হয়ে যাবে। সুপার গ্লু ওয়ালা ভালোবাসা আমার। এতো সহজে ছাড়াতে পারবেন না।

–ঠিক আছে। আমার কাছে একবক্স ভরা বিদেশি চকলেট আছে। যা আমার কাছে মহামূল্যবান সম্পদ। তাও তোমাকে দিয়ে দিবো। এখন বলো ডিল পাক্কা?

খুশি এবার আরও দৃঢ় কন্ঠে বললো।
–আপনি যদি ভেবে থাকেন চকলেটের লোভ দেখিয়ে আমার মন বদলাতে পারবেন তাহলে আপনি……………………একদম ঠিক ভাবছেন। আরে এতো আকর্ষণীয় অফার কি ছাড়তে পারি নাকি? চকলেটের জন্য শুধু একটা কেন, হাজার টা বয়ফ্রেন্ড কুরবান৷ ওকে ওকে ডিলা ডান। এক হাত চকলেট দিন,অন্য হাতে ছেলে নিন।

খুশির কথায় জিদান সাহেব হো হো করে হেঁসে উঠলো। তার সাথে খুশিও খিলখিল করে হেঁসে দিল। খুশি হাত উঠিয়ে জিদান সাহেব কে হাইফাই এর জন্য ইশারা করলো।জিদান সাহেবও খুশির হাতের সাথে হাইফাই দিয়ে বললো।
–এটা সত্যিই অনেক মজার ছিল।

বাইরে ওদের শোরগোল শুনে প্রহর একটু বাইরে এসে দেখলো ওর বাবা আর খুশি অট্রহাসিতে মেতে আছে। প্রহর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর বাবার দিকে। আজ প্রথম ওর বাবাকে এমন মন খুলে হাসতে দেখছে প্রহর। প্রহরের সামনে যতই নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক। তবে প্রহর জানে ওর বাবাও ভেতরে ভেতরে খুব একটা ভালো থাকে না। এই একাকিত্ব তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর আজ ওর বাবাকে এভাবে মন খুলে হাসতে দেখে প্রহরের মন ভরে উঠলো।সব খুশির জন্য হয়েছে। মেয়েটা ওর নামের মতোই। যেখানে যায় শুধু খুশিই ছড়িয়ে দেয়। আমার খুশি সত্যিই এক খুশির গুপ্তধন। প্রহর তৃপ্তির হাসি দিয়ে আবারও কিচেনে চলে গেল। আপাতত ওদের একটু একসাথে থাকাই ভালো হবে।

জিদান সাহেব খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–তুমি সত্যিই অনেক মিষ্টি খুশি মা।তোমার আমার ভালোই জমবে। আমার ছেলেটা যে এমন হিরা খুঁজে বের করবে ভাবতেই পারিনি।

খুশি মুচকি হেসে বললো।
–থ্যাংক ইউ আঙ্কেল।

–উহুম আঙ্কেল ডাকা যাবে না। শশুর কে কেউ আঙ্কেল ডাকে?

–তাহলে কি শশুর ডাকবো?

–বাবা ডাকো।

–আমার কাছে আরেকটা ভালো কুল আইডিয়া আছে। শশুরের এস, আর বাবার বি =এসবি। এখন থেকে আমি আপনাকে এসবি ডাকবো ওকে?

–ওয়াও আই লাইক ইট। এসবি, হোয়াট এ কুল নেম। আমার বাকি ফ্রেন্ডরা শুনলে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। তোমার মতো কুল ছেলের বউ কারোরই হবেনা ।
__

খুশি এসেছে প্রহরের রুমে। ঘুরেঘুরে দেখছে সবকিছু।তখনই প্রহর এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো।
–থ্যাংক ইউ সো মাচ খুশি। আজ তোমার জন্য বাবাকে এতো খুশি দেখলাম। ইউ আর অ্যা এঞ্জেল অফ মাই লাইফ। তুমি আমার জীবনে সত্যিকারের সুখপাখি।

–আরে হয়েছে হয়েছে এতো তারিফ করলে আমার আবার বদহজম হয়ে যাবে।

প্রহর হালকা হেঁসে বললো।
–আচ্ছা আমার রুম কেমন লাগলো তোমার?

খুশি ঠোঁট উল্টিয়ে বললো।
–একদমই ভালো না।

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কেন? কি সমস্যা?

–আরে অনেক সমস্যা। প্রথমত রুমটা মাত্রাতিরিক্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আরে এতো পরিস্কার কখনো রুম হয় নাকি? মনে হচ্ছে ল্যাবে দাঁড়িয়ে আছে।আরে রুমে একটু আধটু নোংরা না থাকলে রুমকে কি রুম মনে হয়? আর এটা কেমন রঙ সাদা? সবকিছু শুধু সাদা রঙের। কেনরে ভাই? এখানে কি কারোর শোক দিবস পালন করা হচ্ছে? আরে রুম হবে রঙবেরঙের মেলা।

খুশির কথায় খুব একটা অবাক হলো না প্রহর। কারণ এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শুধু খুশির পক্ষেই সম্ভব। ওর তো ভেবেই ভয় লাগছে। নাজানি বিয়ের পর এই রুমটাকে কি বানিয়ে ফেলবে?

খুশি দেয়ালে টানানো গিটার দেখিয়ে বললো।
–এটা কি তুমি বাজাও? নাকি এমনই ফ্যাশনের জন্য ঝুলিয়ে রেখেছ?

–এই একটু আধটু বাজাই আরকি।

–তুমি গানও গাও বুঝি?

–হ্যাঁ ওই আরকি। তোমার মতো অতো সুরেলা কণ্ঠে তো আর গাইতে পারিনা। একটু আধটু চেষ্টা করি আরকি।

–জানি জানি আমার মতো সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া অতো সহজ না। আচ্ছা যেমনই গাও আমাকে একটু শুনাও। আমি কাজ চালিয়ে নিবো।

প্রহর হালকা হেঁসে বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে।যা আমার মহারাণীর ইচ্ছা।

প্রহর গিটার টা নিয়ে বাজাতে শুরু করবে তখনই খুশি বললো।
–এই এই এখানে না। চলনা নিচে যাই। এসবির সামনে গাইবে। আজ এসবির জন্মদিন না?

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এসবি? হু ইজ এসবি?

–আরে এসবি মিনস শশুর বাবা। উনার কথা বলছি।

প্রহর মাথা নেড়ে হাসলো। এই মেয়েটা পারেও বটে। বাবাকে এসবি বানিয়ে দিল। খুশি প্রহরের হাত ধরে নিচে নিয়ে এলো। এতক্ষণে ফাহিমও চলে এসেছে। প্রহরের কথামতো ওর বাবার জন্য কেক নিয়ে এসেছে। নিচে এসে খুশি সবার উদ্দেশ্যে বললো।
–এটেনশান গাইস। তো এখন প্রহর আমাদের সবাইকে গান গেয়ে শোনাবে তালিয়া।

সবাই একসাথে তালি বাজালো। প্রহর গিটারে টুংটাং ধ্বনি তুলে খুশির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ ও খুশি ও খুশি তুমি কিযে রুপসী
♬ মন চায় ময়না পাখির মতো বুকের পিঞ্জরে পুষি।
♬ ও খুশি ও খুশি তুমি কিযে রুপসী
♬ মন চায় ময়না পাখির মতো বুকের পিঞ্জরে পুষি।

প্রহরের গানের সুরে খুশির মন নেচে উঠলো। খুশি নাচতে নাচতে জিদান সাহেবের হাত ধরে তার সাথে নাচতে লাগলো। ফাহিম মুখে দুই আঙুল ঢুকিয়ে শিস বাজাতে লাগলো। প্রহরের মনে হচ্ছে খুশির আগমনে এই বাড়ি নতুন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। খুশি ওর জীবনের সর্বত্র রঙিন আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। খুশি ছাড়া ওর জীবন টা শূন্য মরুভূমি হয়ে যাবে। খুশিকে ছাড়া বাচার কল্পনাও যে এখন মৃত্যু সমান।

চলবে………

গল্পের লেটেস্ট আপডেট পেতে আর গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আমার গ্রুপে জয়েন হওয়ার আমন্ত্রণ রইল। নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো। জয়েন হতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন। 👇
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here