#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★খুশি যথাসময়ে ভার্সিটি সেকশনে চলে এলো প্রহরের উদ্দেশ্যে। আজ দুদিন হলো প্রহরকে দেখেনা সে। মনটা বড়ো ব্যাকুল হচ্ছে তার দর্শনের আশায়। যদিও খুশির মতে সেদিন স্বপ্নে একটু দেখেছিল। কিন্তু তাতে কি আর মন ভরে? তাইতো আজ বেশ ভালো করে দেখবে। সেসব ভাবনার মায়াজাল বুনতে বুনতে প্রফুল্লচিত্তে ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় এলো সে। রোজ এই সময়ে প্রহর এখানেই থাকে। তবে আজ প্রহর নেই। শুধু ফাহিমকে বসে থাকতে দেখলো। খুশি হাসিমুখে ফাহিমের কাছে এসে বললো।
–আরে দেবরজী, আপনি একা বসে আছেন কেন? আপনার সারগেদ কই?
ফাহিম মুচকি হেঁসে বললো।
–কিজানি ভাবিজী,আপনার হবু সোয়ামী আজ এখানে বসলো না। দেখলাম হনহন করে ক্লাসরুমের দিকে গেল। মুড অফ বোধহয়।
খুশি তার আপন ভঙ্গিতে বললো।
–বেচারা আমাকে দুদিন ধরে দেখেনা। মুড তো অফ হবারই কথা। আহারে আমার কুচ্চু পুচ্চু বয়ফ্রেন্ড টা।
–জ্বি জ্বি ভাবিজী এক্কেরে হাচা কথা কইছেন। এখন আপনিই গিয়ে তার মুড ঠিক করে দিন।
–ওকে ওকে আমি দেখছি। আপনি টেনশন নিয়েন না। চিল ধরে খান।
খুশি হেলেদুলে হেঁটে এগিয়ে ক্লাসরুমের দিকে। বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা ফাকা ক্লাসে প্রহরকে দেখতে পেল সে।মাথা নিচু করে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। প্রহরকে দেখে খুশি নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। প্রহরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো।
–উহুম উহুম, কি অবস্থা জনাবের? শুনেছি আমাকে না দেখে নাকি অন্ন বস্ত্র ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যাচ্ছো? আমার বিরহে কাতর হয়ে গেছ নাকি? তা অবস্থা যখন এতটাই নির্মম তাহলে একবার বললেই তো পারো। দেখলে তো শুধু দুদিন না দেখেই এই অবস্থা হয়েছে। এই হলো খুশির জালওয়া। খুশির জালওয়া থেকে বাচা মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হে।
সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বশবর্তী হেতু প্রহরের মন মেজাজ এমনিতেই প্রচন্ড পরিমাণ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এইমুহূর্তে খুশির আগমন যেন প্রহরের তপ্ত আগুনে ঘিয়ের কাজ করলো। মাথায় জ্বলতে থাকা লাভা যেন এবার ভলকে পড়তে শুরু করলো। যে আগুন একমুহূর্তে সবকিছু পুড়ে দিতে সক্ষম। রাগ আর কষ্টের সংমিশ্রণে প্রহর এক ভয়ংকর রুপ ধারণ করলো। চোয়াল শক্ত করে ঠাস করে উঠে দাঁড়াল সে। খুশির হাত শক্ত ধরে নিজের কাছে টান দিয়ে, অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–সে আর বলতে। তোমার মায়াজাল আর ধূর্ততা থেকে বাঁচা সত্যিই খুব কঠিন।সত্যিই মানতে হবে তোমাকে। যেখানে আমার মতো লোককে ফাঁসিয়ে নিলে, সেখানে বাকিরা তো অতি তুচ্ছ। তা এযাবত কতজনকে তোমার এই জালওয়া দেখিয়ে ফাঁসিয়েছ শুনি? আরও কতজন তোমার ধূর্ততার শিকার হয়েছে শুনি?
প্রহরের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না খুশি। খুশি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কতজন মানে? কি বলছ এসব তুমি?
প্রহর এবার আরও ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো।
–ও জাস্ট শাট আপ। ডোন্ট এ্যাক্ট স্মার্ট। তোমার এইসব চালবাজি আর আমার সামনে চলবে না।তোমার এই মাছুম চেহারার পেছনে লুকিয়ে থাকা আসল রুপটা সামনে এসে গেছে। আসলে ভুলটা আমারই। তাইতো ভেবেছিলাম হয়তো তুমি অন্যদের থেকে আলাদা। কিন্তু না তুমি আবারও আমাকে ভুল প্রমান করে দিলে। তুমি প্রমাণ করে দিলে যে আমার আগের ধারণাই ঠিক ছিল। সব মেয়েরাই চালবাজ,ছলনাময়ী। তুমিও তেমনই।
প্রহরের তিক্ত কথাগুলো খুশিকে বিস্মিত করে দিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না হয়েছে টা কি? প্রহর হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? খুশি এবার শক্ত গলায় বললো।
–যা বলতে চাও ক্লিয়ার করে বলো। আমি কি এমন করলাম যার জন্য তোমার এই মহান ধারণার উদয় ঘটলো?
প্রহর আবারও তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–ভাবতো এমন করছ যেন কিছুই বোঝনা। তুমি কি ভেবেছ আমি কিছু জানিনা? একটু আগেই যে কলেজে অন্য একটা ছেলের হাতে হাত রেখে মনের সুখে প্রেম বিনিময় করছিলে সেটা এত জলদিই ভুলে গেলে? বাহ্ ইউ আর গ্রেট। মানে এখানে আমি আর ওখানে ও। তা আরও কয়টা আছে শুনি? সত্যিই তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস মেয়ে আমি….
আর বলতে পারলোনা প্রহর। তার আগেই সজোরে একটা থাপ্পড় এসে লাগলো ওর গালে। থাপ্পড় টা খুশিই মেরেছে। প্রহরের ঝলসানো কথাগুলোয় খুশি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে নি। সারা শরীর রি রি করছে ওর। রাগে দুঃখে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর। থাপ্পড় দেওয়ায় প্রহর আরও বেশি ক্রোধান্বিত হয়ে গেল।চোখ দিয়ে যেন অগ্নিগিরির লাভা ঝলকে পড়ছে।আজ পর্যন্ত কেউ প্রহরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি। আর এই মেয়েটা… প্রহর কপালের রগ ফুলিয়ে খুশির দিকে আঙুল তুলে আবারও কিছু বলতে যাবে তার আগেই খুশি হাত উঠিয়ে কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো।
–বাচ, মিঃ প্রহর বাচ। অনেক বলেছেন আপনি, আর অনেক শুনেছি আমি। নাউ ইটস মাই টার্ন। এখন আমি বলবো আর আপনি শুনবেন। একটা কথা মনে রাখবেন আমি সবকিছু সহ্য করতে রাজি কিন্তু কেউ আমার চরিত্র আর প্রতিপালনের ওপর কটুক্তি করলে সেটা আমি কখনোই সহ্য করবোনা। সে যেই হোকনা কেন? আপনার সাহস কি করে হলো আমার চরিত্রের ওপর লাঞ্ছনা লাগানোর? এক্সুলি ভুলটা আমারই। ভেবেছিলাম আপনি উপরে উপরে যেমনই হোন না কেন, আপনার মনটা সুন্দর। কিন্তু আমি বুঝতেই পারিনি আপনার মনটা কয়লার থেকেও কালো। আপনি যদি আমাকে ভালোভাবে জিজ্ঞেস করতেন তাহলে আমি নির্দ্বিধায় বলে দিতাম ছেলেটা কে ছিল, আর আমরা কি করছিলাম। কিন্তু না, আমি তো আর জানিনা যে আপনি চোখ থাকতেও অন্ধ। আপনি তো সরাসরি আমার চরিত্রে আক্রমণ করেছেন। ইউ নো হোয়াট? আপনার ওপর আজ রাগের থেকে বেশি দয়া হচ্ছে। আমি দুনিয়াতে আপনার মতো বদনসিব লোক আর একটাও দেখিনি। আপনি সারাজীবন একা থেকে যাবেন। কারণ কি জানেন? কারণ আপনি অতীতে বসবাস করছেন। আপনি আজ পর্যন্ত অতীত থেকেই বের হতে পারেননি। আপনি কখনো সুখী হতে পারবেন না। কারণ আপনি সুখ কি তা জানেনই না।আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স ভরপুর থাকতে পারে। তবে আপনি মনের দিক দিয়ে নিতান্তই দরিদ্র। আসলে আপনার কোন মনই নেই। ইউ আর এ হার্টলেস পারসন। আর আমি কোন পাথরের উপর নিজের মাথা ঠোকাতে চাইনা। কংগ্রাচুলেশন মিঃ প্রহর। আজ থেকে এই খুশি নামক মুসিবত টা আপনার জীবন থেকে বিদায় নিলো।আই প্রমিজ আর কখনো আপনাকে জ্বালাতে আসবোনা। গুডবাই।
নিজের বক্তব্য প্রদান শেষে খুশি আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেল। আর প্রহর হতবিহ্বল হয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। খুশির বলা কথাগুলো ওর মাথায় ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আর শেষের কথাটা যেন বুকের ভেতর কেমন কাঁটার মতো বিঁধল। চিনচিন ব্যাথার আবির্ভাব হচ্ছে। ও কি সত্যিই কোন ভুল করলো?
___
ভার্সিটি শেষে প্রহর বেড়িয়ে এসে নিজের গাড়ির দিকে এগুলো। সবকিছু কেমন অসহনীয় লাগছে। খুশির বলা কথাগুলো বারবার ওকে অস্থির করে তুলছে। কেমন দিশাহীন বোধ করছে ও। এই প্রথম নিজের চিন্তাধারার ওপর আত্মবল পাচ্ছে না। প্রহর গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুদূর আসতেই হঠাৎ ওর নজর পড়লো রাস্তার পাশে ফুচকার দোকানে। সেখানে তখনকার সেই ছেলেটা দিয়ার সাথে বসে ফুচকা খাচ্ছে। দিয়ার সাথে খুব হাসাহাসি করছে, আবার দিয়াকে নিজের হাতে ফুচকা খাইয়ে দিচ্ছে। ছেলেটাকে দেখে প্রহরের চেপে থাকা রাগটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। গাড়ি সাইড করে হনহন করে নেমে ছেলেটার দিকে এগুলো প্রহর। ছেলেটার সামনে এসে এক হাতে কলার টেনে ধরে দাঁড় করালো ওকে। ঘটনার আকস্মিকতায় দিয়া আর ছেলেটা হতভম্ব হয়ে গেল। ভয়ে আত্মা উড়ে গেল বেচারার। প্রহর চোয়াল শক্ত করে বললো।
–এখানে কি করছিস তুই হ্যাঁ? খুব রোমিওগিরি দেখানো হচ্ছে তাইনা? সকালে একজন কে আই লাভ ইউ বলছিস, আর এখন আরেকজনের সাথে আড্ডা মারছিস। আজতো তোর রোমিওগিরি ছুটিয়ে দিবো আমি ।
দিয়া এবার ছেলেটার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো।
–এই শাহিন জিজু কি বলছে রে? তুই আরও কাউকে আই লাভ ইউ বলেছিস?
শাহিন ভীতু স্বরে বললো।
–ভাইয়া আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি তো শুধু দিয়াকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না। সত্যিই বলছি।
–আচ্ছা? তাহলে সকালে খুশির সামনে বসে যে আই লাভ ইউ বলছিলো ওটা কি তোর ভুত ছিল?
–ওও আপনি ওটার কথা বলছেন? আরে ওটাতো আমি প্রাকটিস করছিলাম। আসলে আজ দিয়াকে প্রপোজ করার ছিলোতো সেটা নিয়ে অনেক নার্ভাস ছিলাম।তাই খুশির সাথে একটু প্রাকটিস করছিলাম। ওতো আমার ফ্রেন্ড তাই আমার হেল্প করছিল। দ্যাটস ইট। সত্যিই বলছি মা কসম।
শাহিনের কথায় অবাক হয়ে গেল প্রহর। আস্তে করে শাহিনের কলার ছেড়ে দিল ও। নিজের ওপর চরম রাগ লাগছে ওর।এক পাহাড় সমান অপরাধ বোধ যেন মাথার উপর চেপে বসলো। এটা কি করে বসলো ও? না জেনে শুনে খুশির সাথে কতটা খারাপ আচরণ করে ফেলেছে। এখন কি করবে ও? খুশি কি কখনো ওকে মাফ করবে?
প্রহরের চিন্তিত মুখ দেখে দিয়া বলে উঠলো।
–জিজু আপনাদের ভেতর কি কিছু হয়েছে? খুশিকেও অনেক আপসেট দেখালো। সেইজন্যই তখন প্রচুর ঝাল দিয়ে ফুচকা খাচ্ছিল।
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো
–মানে??
–আসলে খুশি কোনকিছু নিয়ে বেশি আপসেট হলে তখন প্রচুর ঝাল দিয়ে ফুচকা খায়। আজকেতো আরও বেশি করে খেয়েছে। ঝাল খেতে খেতে ওর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছিলো। ঠোঁট নাক সব রক্তের মতো লাল হয়ে গিয়েছিল। আমরা দুজন মিলে অনেক কষ্টে ওর খাওয়া থামিয়েছি। নাহলে তো আজ ও ঝাল খেয়ে মরেই যেতো।
প্রহরের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। প্রহর ঢোক গিলে বললো।
–কোথায় ও?
–ওতো তখনই বাসায় চলে গেছে। আজ কলেজও করেনি।
প্রহর চলে এলো ওদের কাছ থেকে। বুকের যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করছে। কি করবে এখন ও? কিভাবে সব ঠিক করবে? খুশি ঠিকই বলেছে। আমি সত্যিই একটা ইডিয়ট। আই অ্যাম এ ব্লাডি ফুল। তাই তো ওর মতো মাছুম ফুলটাকে ভুল ভেবে জীবনের চরম অন্যায় করে ফেললাম। এখন কি পারবো নিজের ভুল শুধরাতে? পারবো কি তার মান ভাঙতে? তাকে যে অনেক বড়ো আঘাত দিয়ে ফেলেছি আমি। সেকি ক্ষমা করবে আমাকে?
__
দুইদিন পার হয়ে গেছে। খুশি তার কথা সত্য প্রমাণ করেছে। এই দুদিনে খুশি একবারও আসেনি প্রহরের সামনে। খুশি বিহীন প্রহরের পাগল প্রায় অবস্থা। প্রহর খুশিকে অনেক বার ফোন করার চেষ্টা করেছে কিন্তু বারবারই বন্ধ পেয়েছে ফোন। খুশির কলেজেও খোঁজ নিয়েছে, সেখানেও পায়নি তাকে। দিয়ার কাছ থেকে জানতে পেরেছে খুশি নাকি সেদিনের পর কলেজেই আসেনি। খুশির বাসার সামনেও অনেক বার গাড়ি নিয়ে বসে থেকেছে খুশিকে একবার দেখার আশায়। কিন্তু তাতেও ব্যার্থ হয়েছে প্রহর। খুশি যেন ওর জীবন থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আর খুশির এই রুষ্টতা প্রহরের ভেতরে অসহনীয় যন্ত্রণায় পাহাড় গড়ে দিচ্ছে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে ওর। নিজের চরম বোকামির জন্য আজ সে কঠিন শাস্তি পাচ্ছে। নিঃশ্বাস কেমন আটকে আসছে ওর। এই যন্ত্রণা থেকে যে একমাত্র খুশিই ওকে বাঁচাতে পারবে। খুশি ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু কিভাবে পাবে সে খুশিকে? খুশি কি আর ধরা দিবে ওর কাছে? খুশিকে ফিরে পাবার একটা সুযোগ কি সে পাবে?
খুশির কলেজের সামনে এসে গাড়ি থামালো প্রহর। দিয়া ফোনে বলেছে আজ নাকি খুশি কলেজে এসেছে। তাইতো সে তড়িঘড়ি সেখানেই চলে এসেছে। খুশিকে পাবার এই একটা সুযোগ পেয়েছে সে। আজ যে কিছুতেই এই সুযোগ হাত ছাড়া করবে না সে। আজ যে করেই হোক খুশির মান ভাঙিয়েই ছাড়বে সে। প্রহর গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যেতেই দেখলো খুশি আর দিয়া গেট দিয়ে বেড়িয়ে আসছে। প্রহরকে দেখেই খুশির রাগ উঠে গেল। খুশি রাগ দেখিয়ে দ্রুত অন্য দিকে হাঁটা ধরলো। তবে প্রহরও হার মানার পাত্র নয়। সে অতি দ্রুত গিয়ে খপ করে খুশির হাত টেনে ধরলো। তারপর কোনকিছু না বলে সোজা ওকে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো। খুশি রাগী ফেস করে নিজেকে ছাড়ানোর যথাযথ চেষ্টা করে বললো।
–এই কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে। ছাড়ুন বলছি।
কিন্তু প্রহরের শক্তির কাছে খুশি বেচারি কি আর পেরে ওঠে। প্রহর খুশিকে নিয়ে এসে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে দিল। খুশি বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে আবার গাড়ি লক করে দিল সে। তারপর নিজেও দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। আর পাশে খুশি ক্রোধে ফেটে যাচ্ছে। আর রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে প্রহরের ওপর। বন্য বিড়ালের মতো দুই হাত দিয়ে প্রহরের বাম বাহুতে ইচ্ছে মতো কিল ঘুষি মারতে মারতে বলতে লাগলো।
–ছাড় আমাকে, ছাড় বলছি। কেন এসেছ তুমি? কেন? আমিতো তোমাকে শান্তি দিয়ে চলে এসেছি তাহলে কি চাও এখন? নাকি আরও কিছু শোনানো বাকি আছে আমাকে? কিন্তু আমি আর কোন কিছু শুনবো না। ছাড় বলছি আমাকে,ছাড়।
প্রহর কিছুই বলছে না খুশিকে। এটাতো ওর প্রাপ্য। অন্যায় যখন করেছে তখন শাস্তি তো পেতেই হবে। খুশি নিজেই একসময় ক্লান্ত হয়ে প্রহরকে ছেড়ে দিয়ে জানালার দিকে ঘুরে বসলো। এখন যে ওর কান্না পাচ্ছে। আর প্রহরকে নিজের কান্না দেখাতে চায়না সে।
প্রহরের গাড়ি এসে ঢুকলো ওদের ফার্মহাউসে। গাড়ি থামিয়ে নামার জন্য লক খুলতেই খুশি সুযোগ বুঝে গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে চলে যেতে লাগলো।প্রহর দ্রুত নেমে গেল দৌড়ে গেল খুশির কাছে। খুশির সামনে এসে ওর হাত ধরে খুশিকে সোজা কাঁধে তুলে নিল। খুশি নামার জন্য হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো। তবে প্রহর ওভাবেই ওকে নিয়ে বাসার ভেতর গেল। ফার্মহাউসের সব কর্মচারীরা এসব দেখে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। যেন ওরা পৃথিবীর কোন অষ্টম আশ্চর্য দেখছে।
প্রহর খুশিকে বাসার ভেতর নিজের রুমে নিয়ে এলো।দরজা লক করে এসে বেডের ওপর খুশিক বসিয়ে দিল। খুশি আবারও উঠে চলে যেতে উদ্যত হলো। তখনই প্রহর খুশির সামনে নিচে হাঁটু গেড়ে বসলো। খুশির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খুশির দিকে আবেগ ভরা চোখে তাকিয়ে বললো।
–প্লিজ খুশি শুধু পাঁচ মিনিট একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি জানি আমি তোমাকে অনেক হার্ট করেছি। তবে আমার কথাটা তো একটু শোন। একবার আমাকে বোঝাতে দাও। শুধু পাঁচটা মিনিট দাও। তারপর তুমি যা বলবে তাই হবে। আই প্রমিজ।
প্রহরের অনুরোধ ফেলতে পারলোনা খুশি। অন্য দিকে তাকিয়ে বললো।
–ঠিক আছে বলুন কি বলবেন? তবে পাঁচ মিনিটের বেশি না।
প্রহর বলতে লাগলো।
–আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাবো। গল্পটা একটা ছেলের।যার পৃথিবী ছিল তার মা। মা ছাড়া সে কিছুই বুঝতো না। মা দিন বললে দিন, মা রাত বললে রাত। মা তার সবকিছু ছিল। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যা কিছু হয়ে যাক না কেন তার মা তাকে কখনো কোন কষ্ট দিবে না। কখনো তাকে একা ছেড়ে যাবে না। কিন্তু ছেলেটার সেই বিশ্বাস একদিন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মাত্র পাঁচ বছরের ছেলেটাকে ফেলে সে চলে যায় অন্য এক পুরুষের সাথে। ছেলেটা কত কান্নাকাটি করে তবুও তার মায়ের মনে দয়া হয় না। সে চলে যায় সব ছেড়ে। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছ ছেলেটা কে?
খুশির কথা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে।তবে নিজের জন্য না।প্রহরের কষ্ট অনুভব করে। প্রহর আবার বলতে লাগলো।
–তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে আমি আসলেই এখনো অতীতে ডুবে আছি। সেদিনের পর থেকে আমি কারোর ওপর বিশ্বাস পাইনা। সবাইকে আমার ওই মহিলার মতোই মনে হয়।
খুশি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো।
–তো এগুলো আমাকে কেন শোনাচ্ছেন? আমার জানার কি দরকার?
–দরকার আছে। সেদিন তোমার কাছে আসার আগে ওই মহিলাকে দেখতে পাই। যার কারণে আমার মন মেজাজ বিগড়ে যায়। আর পরে ওই ছেলেটাকে তোমার সাথে দেখে আমার রাগ৷ আরও বেড়ে যায়। তাই রাগের মাথায় ওসব কথা বলে ফেলেছি। প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে। আমি অতীতে থাকতে চাই না খুশি। আমাকে অতীত থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করো। আই নিড ইউ খুশি। প্লিজ হেল্প মি?
খুশি একটু ভাব নিয়ে বললো।
–কেন? আমি কেন সাহায্য করবো? আমি আপনার কি হই? হাম আপকে হে কন?
–এভরিথিং। ইউ বিকম মাই এভরিথিং খুশি।তুমি জিতে গেছ।আমার চারপাশের শক্ত দেয়ালটা ভেঙে তুমি আমার সবটা জুড়ে দখল করে নিয়েছ। এখন যে নিঃশ্বাসও তোমাকে ছাড়া চলতে চায়না। আমি জানি না এটাকে কি বলে? যদি এই অনুভূতির নামই ভালোবাসা হয়ে থাকে। তাহলে হ্যাঁ ভালোবাসি আমি তোমাকে।”” আই লাভ ইউ খুশি””।
নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না খুশির। ও কি ঠিক শুনলো? প্রহর ওকে ভালোবাসি বলেছে? অতিমাত্রায় আনন্দে খুশি পুরো স্ট্যাচু হয়ে গেল।কোন রিয়্যাকশন দিতে পারছে না ও। নিজেকে শক্ত রেখে কোনরকমে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো।
–এক মিনিট, আমি এখুনি একটু আসছি।
কথাটা বলে খুশি উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। প্রহর কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই ওভাবেই চুপ করে বসে রইলো।
খুশি ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তারপর হঠাৎ উড়াথুড়া এলোপাতাড়ি ডান্স শুরু করে দিল। ক্লাশিকাল,ডিসকো,ব্রেক ডান্স, হিপ হপ, কংগম স্টাইল যতরকমের ডান্স ফম আছে সব করতে লাগলো। নাচতে নাচতে বলতে লাগলো।
–ইয়েস, ইয়েস,ইয়েস হি লাভস মি,হি লাভস মি। ও মাই গড আমি পাগল না হয়ে যাই।
কতক্ষণ নাচার পর নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণে এনে খুশি আবার নরমাল হলো। চেহারায় গম্ভীর্য ধারণ করে বাইরে বেড়িয়ে এলো খুশি। খুশিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল প্রহর। খুশি তখন এটিটিউট দেখিয়ে বললো।
–দেখ এসব বলে আর কোন লাভ নেই।অনেক দেরি করে ফেলেছ তুমি। এখন যতোই কান্না কাটি করো কোন কাজ হবে না। ট্রেন প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে গেছে। এখন আর তোমার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। আমার জন্য হাজার টা ছেলে লাইন ধরে আছে। আমি এখন তাদেরকে সুযোগ দেব। ইনফ্যাক্ট একটু পরেই একজনের সাথে মিটিং আছে আমার। আমি এখন সেখানেই যাবো। সো টাটা।
কথাটা বলে খুশি উল্টো ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু পারলো না সে। প্রহর ঝট করে খুশির হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের সাথে আটকে নিল।কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই খুশির অধরে নিজের অধর চেপে ধরলো প্রহর। খুশির মুখে অন্য ছেলের কথা শুনে অতিমাত্রায় রাগ উঠে গিয়েছিল প্রহরের। তাইতো এভাবেই সে খুশির মুখ বন্ধ করে দিল। প্রহরের আচমকা এ্যাকশনে হাজার ভোল্টের শক খেল খুশি। এমনটা সে মোটেও এক্সপেক্ট করেনি। চোখ দুটো ফুটবল আকার ধারণ করলো। কিছুক্ষণ পর প্রহর খুশির অধর ছেড়ে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কন্ঠে বললো।
–এখন থেকে তোমার জীবনে শুধু একটাই অপশন থাকবে। দ্যাটস অনলি মি। প্রহর মেহরাব, বুঝতে পেরেছ। মাথায় এটা ভালোভাবে গেঁথে নাও। তুমি চাও বা না চাও সারাজীবন তোমার সাথে শুধু এই নামটাই থাকবে। আর কখনো যদি তোমার মুখে অন্য কারোও নাম শুনেছি তাহলে পরিণাম এর থেকেও ভয়াবহ হবে।
খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–তারমানে যতবার অন্য কারোর নাম নেবো ততবার এভাবে কিচ্ছি দিবে? তাহলে তো দিনে চারপাঁচ বার অবশ্যই নিবো।
খুশির কথায় হেঁসে দিল প্রহর। হাসতে হাসতে বললো।
–তুমি সত্যিই একটা পাগলী।
খুশিও নির্দ্বিধায় বলে দিল।
–জানি।
–পুরো পাগলী।
–তাও জানি।
প্রহর বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো খুশিকে। খুশিও পরম আবেশে প্রহরের বুকে নিজের স্থান করে নিল। শুরু হলো এক নতুন প্রেমকাব্য।
চলবে…..
গল্পের লেটেস্ট আপডেট পেতে আর গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আমার গ্রুপে জয়েন হওয়ার আমন্ত্রণ রইল। নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো। জয়েন হতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন। 👇
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/