অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ পর্ব-২২

অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
পর্ব-২২
#লেখিক-মেহরুমা নূর

★দুপুরের কড়া রোদের তীব্রতা খানিকটা কমে এসেছে। বিকালের শীতলতা নেমে আসছে। জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে উদাসীন হয়ে বসে আছে খুশি।মলিন চোখের দৃষ্টি সামনের সীমাহীন সমুদ্রের মাঝে।একসময় প্রহরের সাথে এমনই একটা জায়গায় আসার স্বপ্ন দেখতো সে। দুজনে মিলে প্রকৃতির নিবিড়তায় নিজেদের হারাবে। প্রেমের মোহময় আলোড়নে জড়াবে দুজন। ভালোবাসাময় এক ছোট্ট পৃথিবী গড়ে তুলবে। তবে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েও অসম্পূর্ণ,বেদনাময়। আমাদের সাথে এমনটা না হলে খুব কি ক্ষতি হতো? জীবনের আরও কিছু টা দিন প্রহরের বক্ষে কাটাতে পারলে কি এমন হতো? আমাদের প্রেমকাব্যের পরিণতি এতো নির্মম হবে জানলে, আমি কখনোই প্রহরকে ভালোবাসার কথা বলতাম না। কখনও ওর মনে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করতাম না। কিন্তু এখন কি করবো? ওর মনে জায়গা তো করেছি। এখন সেটা মেটাবো কিভাবে?খুশির দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কিভাবে কি করবে? এখান থেকে কিভাবে বেড় হবে? প্রহরের মনে কিভাবে নিজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করবে? কিছুই বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না। প্রহরের পাগলামি তো দিনদিন শুধু বেড়েই চলেছে।

প্রহর সেই ঘন্টাখানিক পূর্বে বেড়িয়েছে এখনো ফেরেনি। কি করছে কে জানে? তখন থেকে খুশি ওভাবেই বসে আছে। খুশির ভাবনার মাঝেই প্রহর চলে এলো। রুমে এসেই মুখে হাসির রেখা টেনে বলে উঠলো।
–খুশি চলো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

খুশি পূর্বের ন্যায় বসে থেকেই বললো।
–আমি কোথাও যাবো না তোমার সাথে। তুমি আমাকে কবে রিসোর্টে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেটা বলো?

প্রহর এবার কোন কথা না বলে এগিয়ে এসে সোজা খুশিকে কোলে তুলে নিল। কোলে তুলে নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বললো।
–তুমিও না অনেক দুষ্টু। ইচ্ছে করেই এমন করো যাতে আমি কোলে করে নিয়ে যাই। নাও এখন খুশিতো?

খুশি কিছু বলতে গিয়েও আবার বললো না। জানে এই পাগলের সাথে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। এর যা করার তাই করবে। প্রহর খুশিকে কোলে নিয়ে সমুদ্রের হাঁটু পানির মাঝে এসে বললো।
–দুষ্টুপরি সামনে তাকাও।

প্রহরের কথামতো সামনে তাকালো খুশি। চোখের দৃষ্টি চকিত হয়ে উঠলো। সামনে সমুদ্রের নীল স্বচ্ছ জলরাশির ওপর ভাসছে বাঁশের অপূর্ব এক ভেলা। ভেলায় ছড়িয়ে আছে নানান বন্যফুলের সমাহার। খুশির চোখের পাতায় যেন চকচকে তাঁরারা ঝিলমিল করছে। মাধুর্যমন্ডিত হয়ে গেল সারা মুখমণ্ডল। প্রহর এতক্ষণ ধরে তাহলে এসব করছিল? অতিব মায়াপূর্ণ নজরে তাকালো প্রহরের পানে। প্রহর মুচকি হেসে খুশিকে আস্তে করে ভেলায় বসিয়ে দিল। তারপর সে নিজেও ভেলায় চড়ে একটা বাঁশের বানানো বৈঠা দিয়ে ভেলা ভাসালো সমুদ্রের বুকে।

মাথার উপর উন্মুক্ত নীল গগনতলে ভেলা ভাসছে সমুদ্রের নীল পানির ওপর।শীতল পবন বইছে আপন তালে। খুশি বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে পানির নিচে। স্বচ্ছ পানির নিচের সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে হরেক রকম পাথরের মাঝে বাহারি মাছেরা দল বেঁধে ছুটে বেড়াচ্ছে।খুশি প্লাজু একটু উপরে তুলে আস্তে করে পা জোড়া পানির মাঝে নামিয়ে দিল। মাছেরা এসে খুশির পায়ের উপর ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে খুশির। এ যেন অদম্য অবিস্মরণীয় অনূভুতি। যা কোন ভাষায় মিলিয়ে বলা সম্ভব না। খুশি আপাতত বাকি দুনিয়ার বাস্তবতা থেকে বিছিন্ন হয়ে গেছে। শুধু এই মুহূর্তের মুগ্ধতায় ডুবে আছে।

আর প্রহর ডুবে আছে তার প্রিয়তমার মুগ্ধতায়। চোখের দৃষ্টি স্থির। খুশির চেহারার এই মুগ্ধতা প্রহরকে এনে দিচ্ছে অনাবিল সুখানুভূতির প্রচ্ছায়া। প্রহর মুচকি হেঁসে বলে উঠলো।
–দেন ইটস ফাইনাল।

প্রহরের কথায় ঘোর কাটলো খুশির। ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রহরের পানে। প্রহর বৈঠা চালাতে চালাতে বলতে লাগলো।
–হ্যাঁ ফাইনাল। এখন থেকে আমরা এখানেই থাকবো। এখানেই হবে আমাদের নতুন পৃথিবী। গড়ে তুলবো আমাদের সংসার। এখানে বানাবো আমাদের আলাদা রাজ্য। যেখানকার মহারাণী হবে তুমি। আর তোমার মহারাজা, কম সেনাপতি কম সিপাহী, কম বাবুর্চি, কম সেবক, কম সবকিছুই শুধু আমি। আমি তোমার জন্য রোজ সমুদ্র থেকে মাছ মেরে এনে, রান্না করে তোমাকে খাওয়াবো। তুমি চিন্তা করোনা তোমার কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু মহারাণী হয়ে আরাম করবে। তোমার কোন কাজ নেই। তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসবে। আর আমাদের ভালোবাসার ফসল গুলো পৃথিবীতে আনবে। আমি কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা হতে চাই বুঝেছ? নো ফিগার মেইনটেইন এন অল। আমরা দুটো ফুটবল টিম করবো। একটা গার্লস টিম,আরেকটা বয়েস টিম। চিন্তা করোনা আমার স্টেমিনা প্রচুর। দুটো টিমতো আরামছে করে ফেলবো।

অন্য সময় হলে হয়তো প্রহরের এই আউট ক্যারেক্টর কথাবার্তা শুনলে খুশি অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেত। তবে আপাতত ও নিজের মনে অন্য কোন অনুভূতির প্রবেশ ঘটাতে অনিচ্ছুক। তাই সে প্রহরের কথার কোন প্রতিত্তর না দিয়ে আবারও পানির নিচে মনোনিবেশ করলো। এখন আপাতত সবকিছু ভুলে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চায় ও। কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন নাহয় এখন নাইবা হলো। খুশি দুই হাত দুই পাশে রেখে মাথাটা গগন মুখী করে আবেশে চোখ বন্ধ মুহূর্ত টা উপভোগ করতে লাগলো।

প্রহরের আর কি লাগে। সে গুনগুন করে গান ধরলো।
♬ একা আছি তো কি হয়েছে
♬ সবই তো আছে আমারই কাছে
♬ এই তুমি আছ, হৃদয়ে আছ
♬ আমারই জীবন তোমারাই এখন
♬ একা আছি তো কি হয়েছে
___

পরম আয়েশ করে বসে তখন থেকে খেয়ে যাচ্ছে ফাহিম। আর তিশা ওর পাশে দাড়িয়ে ওয়েটারের মতো সার্ভ করে যাচ্ছে। আর মনে মনে রাগে জ্বলছে। একেই বলে কু কর্মের ফল। চালাকি করে বাবা মাকে বোকা বানাতে গিয়ে এখন নিজেই ফ্যাসাদে ফেঁসে গেলাম। এখন না পারছে কিছু বলতে, না পারছে কিছু করতে। কপাল মন্দ হলে যা হয় আরকি। ফাহিম খাবার চিবুতে চিবুতে বলে উঠলো।
–তুমি চাইলে আমার সাথে বসে খেতে পারো। আমি এতটাও নির্দয় না।

তিশা দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে বললো।
–না না থাক আমার এতো মেহেরবানী লাগবে না। আপনিই খান পেট পুরে।

–হুমম মনে হচ্ছে রেগে আছ। যাক ব্যাপার না। এ্যাজ ইউর উইশ। আচ্ছা বাইদা ওয়ে তুমি বিয়ে করতে চাওনা কেন? আই মিন তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড আছে নাকি? ডোন্ট মাইন্ড অ্যাম জাস্ট আস্কিং।

তিশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–নাহ তেমন কিছুই না। আসলে বিয়ে করে আমি আমার স্বাধীনতার জলাঞ্জলি দিতে চাই না। বিয়ের পরে নিজের কোন স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না। অন্য কারোর হাতের কাঠের পুতুল হতে চাই না আমি।

–এটা কেমন কথা? বিয়ে হলেই স্বাধীনতা শেষ হয়ে যায় নাকি? বিয়ের পরেও মেয়েরা তাদের স্বাধীন মতো চলতে পারে।

তিশা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–এগুলো শুধুই কথার কথা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। আমি নিজের চোখের সামনে সব উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমি দেখেছি আমার মাকে, আমার বোনকে। আমার মাকে আজপর্যন্ত নিজের ইচ্ছেই নিজের জন্য একটা জামাও কিনতে দেখিনি। সবসময় দেখেছি বাবাই যা এনে দেয় তাই পড়তে হয় মাকে। বাবা কখনও মায়ের ইচ্ছে কিংবা পছন্দের কথা কখনো জানার চেষ্টাই করেনি। আর না কখনো তার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দিয়েছে। আমার বোনও বিয়ের পরে তার জীবনের সব ইচ্ছে আকাঙ্খার জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। আমার আপু অনেক ভালো পেইন্টিং করতে পারে। তার অনেক বড়ো আর্টিস্ট হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার স্বামী তার ইচ্ছেকে দলাই মোচড়াই করে ডাস্টবিনের কোনায় ফেলে দিয়েছে। আর আপুকে বানিয়ে বাড়ির পার্মানেন্ট কাজের বুয়া। কিন্তু আপু কিছু বলতে পারে না। কারণ মেয়েদের যে কিছু বলতে নেই। এটাই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম।

তিশার কথায় ফাহিম কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিশার দিকে। তারপর বলে উঠলো।
–হ্যাঁ হয়তো আপনার কথা কিছুটা ঠিক আছে। তবুও একটা কথা অবশ্যই বলবো। সব ছেলেরা কিন্তু এক হয়না। হ্যাঁ হতে পারে তাদের সংখ্যা কম। তবে আছেতো অবশ্যই। জানি আপনি যা এক্সপেরিয়েন্স করেছেন তাতে হয়তো বিশ্বাস করা কঠিন। তবে আমি বলবো সবাইকে এক মাপকাঠিতে দেখা কিন্তু ঠিক না। যেমন দেখুন আমাদের পরিবার। আমার মা একজন ডক্টর। বাবা সবসময় মাকে তার ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করেছে। তারপর আমার ভাবিও ওয়ার্কিং ওম্যান। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে। ভাইয়া কখনো ভাবিকে কোন কাজে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। বরং সবসময় প্রোৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এমনকি বাচ্চাদের দেখাশোনাও ভাইয়াই বেশিরভাগ সময় করে। আমাদের পরিবারে আমরা ছেলে মেয়ে সমান অধিকার ভাবি। এবং যথাযথ স্বাধীনতাও দিয়ে থাকি। আপনি এটা ভেবেন না যে, আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য আমি এসব বলছি। মোটেও না। আমি বলছি যা না যে আমাকে বিয়ে করুন। আমি শুধু বলতে চাইছি সবাই এক হয়না। তাই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনকে পায়ের শেকল ভেবেন না। যে আপনাকে যথাযথ সম্মান,স্বাধীনতা দিবে তাকে বিয়ে করতেই পারেন।

ফাহিমের কথায় কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তিশা। কেমন ভাবনায় পরে গেল ও। লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল ততটাও খারাপ না। ফাহিম এবার বাঁকা হেসে বললো।
–আর এমনিতেও বয়স তো আর কম হচ্ছে না। দুদিন পর আর তোমার ছেলেদের সামনে এক্টিং করতে হবে না। এমনিতে তোমার নরমাল চেহারা দেখেই সবাই মানা করে দিবে।

তিশা দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–ও হ্যালো, অ্যাম জাস্ট নাইন্টিন ওনলি। আপনি নিজের কথা ভাবুন। মেয়েরা তো দূরের কথা আন্টিরাও রাজি হবে কিনা সন্দেহ হুহ্। যে না চেহারা নাম দিয়েছে পেয়ারা।

ফাহিম কিছু না বলে শুধু হাসলো। মেয়েটাকে রাগাতে ভালোই লাগে। রাগলে অনেক কিউট লাগে ওকে। মনে হচ্ছে এবার বোধহয় কাম তামাম হয়েই যাবে।
____

দিবাভাগ গড়িয়ে নেমেছে ঘোর কালো যামিনী। ঘরের মধ্যভাগে টিমটিম করে জ্বলছে হারিকেনের আলো। ইলেক্ট্রিসিটি নেই এখানে। তাই এই অরগ্যানিক উপায় বের করেছে প্রহর। দিনটা কাটলেও রজনীর আঁধার খুশির মাঝে বয়ে আনছে অধীরতা। কিভাবে কাটবে এই নিশি? এই একটা মাত্র রুমের ভেতর দুজন কিভাবে থাকবে? হাজার ইচ্ছে থাকা সত্বেও প্রহরের সাথে একসাথে এক রুমে থাকা যে সম্ভব না। ওর মনে কোনভাবে নতুন করে কোন আশা জাগানো যাবে না। ওর কাছাকাছি থাকলে যে আমি নিজেও দূর্বল হয়ে পড়ি। যেটা মোটেও ভালো লক্ষণ না। ওকে যে আমার দূরে সরাতেই হবে।

বাহিরের সব ঠিক ঠাক করে রুমে এসে ঢুকলো প্রহর। রুমে এসে সোজা বেডের ওপর এসে সটান হয়ে আয়েস করে শুয়ে পড়লো। খুশির দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি ব্যাপার ঘুমাবে না? সারারাত দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান আছে নাকি?

খুশি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ তো কোথায় ঘুমাবো?

–ওমা তোমার চোখের পাওয়ার বেড়ে গেছে নাকি? এতবড় একটা বেড তোমার চোখে পড়ছে না? এসো এসো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। অ্যাম সো মাচ টায়ার্ড। আই ওয়ান্ট টু স্লিপ।

–এসব কি বলছ তুমি? আমি তোমার সাথে কিভাবে ঘুমাতে পারি? কখনোই না। আমরা এক বেডে শুতে পারবো না।

–কেন কি সমস্যা? আর তুমি কি এই প্রথম ঘুমাচ্ছ নাকি আমার সাথে?

–ত তখনকার কথা আলাদা। কিন্তু এখন আমি তোমার সাথে এক বেডে ঘুমাতে পারবোনা।

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–ঠিক আছে তাহলে আর কি করার? তোমার যেখানে খুশি ঘুমাতে পারো। আমার আবার বেড ছাড়া ঘুম হয়না। তাই আমিতো এখানেই ঘুমাবো। তুমি দেখে নাও কি করবে।

প্রহরের কথায় খুশির একটু রাগ হলো। প্রহর এমন নিশ্চিন্তে কিভাবে শুয়ে পড়লো। ওর কি আমার জন্য কোন চিন্তা হচ্ছে না? ঠিক আছে থাক ও ওখানে শুয়ে। খুশি বলে উঠলো।
–ঠিক আছে থাক তুমি এখানে। আমি বরং বাইরে গিয়ে ঘুমাবো।

প্রহর ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো।
–ওকে ফাইন যাও।

খুশি আবারও বিস্মিত হলো। ওতো ভেবেছিল প্রহর ওকে আটকাবে। আমাকে বেডে দিয়ে নিজে অন্য কোথাও বিছানা করে নিবে। খুশি এবার সত্যি সত্যিই বাইরে চলে যেতে লাগলো। হঠাৎ প্রহর পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললো।
–আচ্ছা শোন, যেতে যেতে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যেও। শুনেছি এখানে রাতে নাকি জঙ্গলের ভুত পেতনীর দল ঘোরাঘুরি করে। আর আমার মতো সুন্দর মানুষ দেখলে ঘাড় মটকে কচকচ করে খেয়ে ফেলে। আমার ভাই এতো তাড়াতাড়ি মরার শখ নেই। তাই দরজা ভালো করে আটকে দিয়ে যেও।

বেচারি খুশি আর এক পা ও এগুনোর সাহস পেল না। ভয়ে অন্তর আত্মা শুঁকিয়ে আসছে। ছোট বেলা থেকেই ভুতের কথায় অনেক ভয় পায় ও। কিন্তু এটাতো আর প্রহরের সামনে জাহির করা যাবে না। মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। তাই গলা ঝেড়ে আমতা আমতা করে বললো।
–উহুম,, বাইরে অনেক শীত। তাই ঘরেই মেঝেতে বিছানা পেরে শুবো।

প্রহর এবারও কোন ভাবাবেগ না দেখিয়ে বললো।
–ঠিক আছে জাহা তোমার ইচ্ছে। তবে হ্যাঁ মাটির ভেতর থেকে লম্বা লম্বা কেঁচো গুলো উঠে তোমার কানের মাঝে ঢুকে ডিসকো ডান্স করলে তখন যেন আমাকে বলোনা।

ব্যাস এবার বাকি অবশিষ্ট মনোবল টুকুও বিদায় নিয়ে পালালো খুশির কাছ থেকে। এখনতো মেঝেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও শরীর কাঁপছে। আর পেরে উঠলো না নিজের সাথে। দ্রুত পায়ে গিয়ে বেডের ওপর উঠে বসে বললো।
–ঠিক আছে আমি বেডেই শুবো। তবে মাঝখানে ডিস্টেন্স রেখে। ঘুমের মাঝে আমার এডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবে না একদম।

প্রহর দুষ্টু হেসে বললো।
–লুক হু ইজ টকিং। এডভান্টেজ এর কথা তুমি বলছ? ঘুমের মাঝে কে কার কেমন করে এডভান্টেজ নিয়ে থাকে সেটা কি আমার এখন মনে করিয়ে দিতে হবে?

খুশি অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে, এখন চুপচাপ শুয়ে পড়ো।

মাঝখানে ডিস্টেন্স রেখে খুশি বেডের একপাশে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রহরের সব কৌশলই কাজে লাগছে। এবার পরবর্তী স্টেপের পালা। আজতো দুষ্টুপরিকে তার বুকে নিয়েই ঘুমাবে প্রহর। আর সেটা কার্যকারী করার পদ্ধতিও জানা আছে তার। প্রহর খুশির দিকে কাত হয়ে শুয়ে ধীরে ধীরে নিজের শার্টের বোতাম গুলো খুলতে লাগলো। খুশিকে আকর্ষিত করার মূল মন্ত্রই এটা। খুশি একবার আরচোখে তাকিয়ে প্রহরের কার্যক্রম দেখে হকচকিয়ে উঠে বললো।
–এই এই কি করছ? শার্ট কেন খুলছ?

–এমনি আমার কেমন জানি হট হট লাগছে। তাই শার্ট খুলছি।

–এই হার কাঁপানো শীতে তোমার গরম লাগছে? আর ইউ কিডিং?

–আরে আমার শরীর আমার চেয়ে কি তুমি ভালো জানবে? আমাকে আমার কাজ করতে দাও।

প্রহর শার্টের সবগুলো বোতাম খুলে শার্ট টা দুই দিকে সরিয়ে দিয়ে নিজের বুকটা উন্মুক্ত করে দিল। প্রহর যে এসব ইচ্ছাকৃত ভাবে করছে তা ভালোই বুঝতে পারছে খুশি। তবে সে এতো সহজে গলবে না। প্রহরের মনকামনা সফল হতে দিবে না কোনমতেই। মনে মনে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলেও তাতে টিকে থাকা যথেষ্ট দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। বেহায়া চোখের দৃষ্টি খুশির সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিয়ে বারবার প্রহরের পানেই তীর নিক্ষেপ করছে।চোরা চোখে ঘুরেফিরে দেখার চেষ্টা করছে পাশের সু বলিষ্ঠ যুবকের সুঠাম বুকটাকে। আরচোখে তাকানো দৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনতে নিলেই কিছু একটাই ভ্রু কুঁচকে আসে খুশির। খুশি কাত হয়ে এবার সরাসরি তাকায় প্রহরের বুকের দিকে। বুকের বামপাশে যেখানে একবার খুশি কামড় দিয়েছিল সেখানে খুশি নামের ট্যাটু দেখে হৃদপিণ্ড থমকে গেল খুশির। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো সে। প্রহরের চোখের পানে চেয়ে ধরা গলায় বললো।
–এ এটা কবে করেছ?

প্রহর মায়াবী চোখে তাকিয়ে বললো।
–তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বে। আমি যখন বিজনেসের কাজে ক্যানাডা গিয়েছিলাম তখন ওখানে এটা করিয়েছিলাম।তোমার দেওয়া প্রথম চিহ্নটাকে জীবন্ত রাখার জন্য এটা করেছিলাম। তুমি শেষ যেদিন আমার সাথে দেখা করেছিলে সেদিন তোমাকে বলেছিলাম না, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে? এটাই সেই সারপ্রাইজ ছিল। তোমাকে সেদিন এটা দেখাতে চেয়েছিলাম। আর তোমাকে সেদিন বিয়ের জন্য প্রপোজ করার প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু পরদিন তোমার বাসার সামনে গিয়ে তোমাকে আর পেলাম না। তোমার ফোন বন্ধ। ফোন করেও পাচ্ছিলাম না। জানো সেদিন সারাদিন তোমার বাসার বসে ছিলাম তোমার অপেক্ষায়। শেষে পাইপ বেয়ে তোমার ব্যালকনিতে গিয়েও দেখলাম দরজা আটকানো। মেইন দরজায় এসে দেখলাম সেখানেও তালা মারা। দিয়া শাহিন সবার কাছে তোমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তোমার কোন খোঁজ নেই। সে দিনটা যে আমার কি অবস্থা হয়েছিল সেটা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আমার জীবনের সবচেয়ে দূর্বিষহ দিন ওটা। কিন্তু আমি কি জানতাম এরপরের দিনগুলো তারচেয়েও ভয়াবহ হতে চলেছে। কারণ আমার দুষ্টুপরি হারিয়ে গিয়েছিল ……..

প্রহর আরও কিছু বলতে লাগলো। কিন্তু খুশির কানে আর ঢুকছে না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।চেপে রাখা কষ্ট গুলো বাঁধ ভাঙা সমুদ্রের পানি হয়ে উপচে পড়তে চাচ্ছে ওর দুচোখ দিয়ে। আর যে নিজেকে আটকাতে পারছেনা ও। খুশি প্রহরের বুকে নিজের নামের ট্যাটুর ওপর আলতো করে বোলাতে লাগলো। মাথা টা এগিয়ে নিয়ে ট্যাটুর ওপর একটা চুমু একে দিল খুশি। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো প্রহর। প্রশান্তির বাতাস ছুঁয়ে গেল শরীর মন জুড়ে। খুশির চোখের বাধ ভেঙে গেল।প্রহরের বুকে হাত বোলাতে অঝোর ধারা বইতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে প্রহরকে জড়িয়ে ধরে নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন দিতে লাগলো।প্রহরও দুই হাতে জড়িয়ে নিল প্রিয়তমাকে।তবে খুশির শরীরের কাঁপুনি উপলব্ধি করে প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–খুশি? তুমি কি কাঁদছ?

নীরব কান্নার সাথে এবার আওয়াজের সংযোজন ঘটলো। সাথে শক্ত হলো হাতের বাঁধন।নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারছে না ও।আজ যেন সব কষ্টের প্রতিধ্বনিরা বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে আসছে। খুশির কান্নার শব্দ টের পেতেই প্রহর খুশিকে ছাড়িয়ে সামনে আনার চেষ্টা করলো। তবে খুশির শক্ত বাঁধন খুলতে পারলোনা প্রহর। ধীরে ধীরে খুশির কান্নার আওয়াজের গতি বাড়তেই লাগলো। আর বাড়ছে হাতের বাঁধন। প্রহর ভয় পেয়ে গেল। খুশিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। খুশি দুই হাতে প্রহরকে সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। সারা শরীর কাঁপিয়ে হৃদয়বিদারক কান্না করছে করছে খুশি। কাঁদার সময় খুশির দাঁত গুলো লেগে আছে প্রহরের বুকের সাথে। চোখের পানি আর লালায় ভিজে যাচ্ছে প্রহরের বুক জমিন।

আমি মরতে চাইনা প্রহর। আমি বাঁচতে চাই তোমার সাথে। তোমার সাথে বুড়ো হতে চাই। প্লিজ বাঁচাও আমাকে। আমাকে যেতে দিওনা। আগলে রাখো তোমার বুকে। প্লিজ আমাকে আটকে রাখো তোমার পিঞ্জরে।
মনে মনে চিৎকার করে এসব বললেও, মুখ দিয়ে শুধু কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারলোনা। চিৎকার করে কাঁদছে খুশি। প্রহরের কলিজা যেন ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। খুশির এই নিদারুণ কান্না সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। প্রহর ধরা গলায় বললো।
–প্লিজ সোনা আমার, থাম না। আর যে সহ্য হচ্ছে না। কি হয়েছে আমার লক্ষি সোনাটার? একবার শুধু বল না? আমি আছিতো। সব ঠিক করে দিবো। কান্না থামা। কি হয়েছে বল একবার?

খুশি চেয়েও নিজের কান্না থামাতে পারছে না। খুশি এবার কান্না থামানোর জন্য প্রহরের বুকে কামড়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর নিজের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ পেল সে। ধীরে ধীরে কান্নার গতি থেমে এলো। কান্না কমে এলে খুশি প্রহরের বুকের মাঝে থেকেই বলে উঠলো।
–প্লিজ এইমুহূর্তে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করোনা। আমাকে এভাবেই একটু থাকতে দাও।

খুশির কথা রেখে প্রহরও আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করলোনা। খুশিকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। খুশি ফোপাঁতে ফোঁপাতে একসময় প্রহরের বুকে ঘুমিয়ে পড়লো। প্রহর খুশির মাথার উপর চুমু খেয়ে মনে মনে বললো।
–আমি জানতাম আমার দুষ্টুপরি ভালো নেই। আমাকে ছাড়া ও কখনো ভালো থাকতেই পারে না। তবে আমি এখন এসে গেছিতো। আর কোন কষ্ট পেতে দেবোনা আমার খুশিকে। নতুন করে শুরু করবো আমাদের প্রেমকাব্য।

চলবে……

গল্পের লেটেস্ট আপডেট পেতে আর গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আমার গ্রুপে জয়েন হওয়ার আমন্ত্রণ রইল। নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো। জয়েন হতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন। 👇
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here