অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ পর্ব-৪

অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
পর্ব-৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★বহমান কালাতিক্রমের পালাবদলে অতিবাহিত দিনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই সপ্তাহ। দুই সপ্তাহে চৌদ্দ দিন, তিনশত ছত্রিশ ঘন্টা, বিশ হাজার একশত ষাট মিনিট, এক কোটি বিশ লক্ষ নয় হাজার ছয়শত সেকেন্ড থাকে। তবে এর থেকে হাজার গুণ বেশি অতিষ্টতায় ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রহরের মন মেজাজ। তার কারণ শুধু একটাই। খুশি, হ্যাঁ তার মতে এই খুশি নামক আপদটা তার সুশৃঙ্খল জীবনী টাকে অশৃঙ্খলতায় পরিপূর্ণ করে দিচ্ছে। সে এই মেয়েটাকে নিয়ে মহা বিড়ম্বনায় পড়ে গেছে। কোনক্রমেই তাকে দূরে সরাতে পারছে না। নিজের এই ব্যার্থতার ওপর নিজেরই চরম রাগ লাগছে। শেষমেশ কিনা এমন পুঁচকে মেয়ের সাথে পেরে উঠছে না সে? দিস ইস রিডিউক্লুয়াস।

তবে এতে খুশির কি যায় আসে। সেতো তারমতো প্রফুল্লচিত্তে রোজই প্রহরের সামনে এসে হাজির হয়। প্রহর বিরক্ত হয়ে কতবার বকা দেয় তবুও তাতে খুশির কোন হেলদোল নেই। তার মতো সে মাস্ত। রোজ আসে, আর প্রহরকে নানান ভাবে হরেক রকম দলিলপত্র পেশ করে নিজের ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে। প্রহরকে ইমপ্রেস করার নানান পরিকল্পনায় লেগে থাকে। যদিও তার প্রচেষ্টার খুব একটা প্রভাব পড়ে না প্রহরের ওপর। উল্টো প্রহর রেগে গিয়ে আরও বকা দেয়।মাঝে মধ্যে তো অনেক কঠিন বাক্যও বলে দেয়। তবুও খুশির দৃঢ় সংকল্পের খুটি নাড়াতে পারে না। তাই প্রহর যখন অতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে যায়, তখন নিজেই সেখান থেকে চলে যায়। সামনে এক্সাম নাহলে প্রহর হয়তো ভার্সিটিতেই আসতো না। তাহলে এই জঞ্জাল থেকে একটু রেহাই পেত। তবে এক্সামের জন্য সেটাও পারছে না।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে এইসব ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে প্রহরের মস্তিষ্কে। সামনে থেকে ফাহিম দুষ্টু হেসে বলে উঠলো।
–ভাবিজী কে মিস করছিস বুঝি?

প্রহর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির তীর নিক্ষেপ করে, দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–তোর মনে হচ্ছে না তুই একটু বেশি বেশি করছিস? তুই কি হসপিটালের বেড মিস করছিস খুব? তাহলে তোকে ওখানেই পাঠিয়ে দেই কি বলিস?

–আরে রাগছিস কেন? আচ্ছা জোক্স অ্যা পার্ট, বাট মেয়েটা কিন্তু সত্যিই কিউট। ওর মাঝে কোন ভেজাল নেই।মনে যা আছে সেটাই মুখে বলে। একেবারে সরল মনের। তুই একবার ওকে একটা চাঞ্চ দিয়ে দেখতে পারিস। আই থিংক সি রিয়েলি লাভস ইউ।

–আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? আমি আর ওই মেয়ে? নট ইভেন থিংক।

–কেন কি সমস্যা আমার মাঝে?

ওদের কথার মাঝেই খুশি এসে কথাটি বলে উঠলো। খুশির কন্ঠ কর্ণপাত হতেই মেজাজ বিগড়ে গেল প্রহরের। চোখ বন্ধ করে রাগ হজম করার চেষ্টা করছে। খুশি তার মতো করে আবারও বলে উঠলো।
–কি হলো বলো, কি সমস্যা আমার মাঝে? কিসের কমতি আছে? টেল মি? না আজকে তো তোমাকে বলতেই হবে হোয়াট ইজ দ্যা সমস্যা?

ব্যাস আর নিতে পারলোনা প্রহর। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে খুশির পানে দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো।
–এনাফ নাউ।হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?

খুশি অতিশয় নির্বিঘ্নে বলে উঠলো।
–তোমাকে। আমার তো ধ্যান, জ্ঞান,মনে, প্রাণে কলিজা, ফোঁপরায় একটাই চাওয়া, শুধু তুমি।
♬ তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই
♬ আর কিছু জীবনে পাবনা পাই।

পাশ থেকে দিয়া বলে উঠলো।
–আরে ইয়ার পাবনা না,পাই বা না পাই হবে।

–কস কি? ঠিক আছে আবার প্রথম থেকে গাই।
খুশি আবারও গান গাইতে নিলে প্রহর ধমক দিয়ে বলে উঠলো।
–দেখ আমি জানি এসব তুমি টাকার জন্য করছ। তো বলো কত টাকা চাই তোমার? কত টাকা হলে আমার পিছু ছাড়বে তুমি? জাস্ট টেল মি ইউর অ্যামাউন্ট।

প্রহরের কথায় খুশি হঠাৎ চোখ মুখ বিকৃত করে বলে উঠলো।
–ইউউউ,ইয়াকক, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ভেরি ব্যাড।লাইক সিরিয়াসলি? এতো পুরাণ ডায়লগ? আমার বয়ফ্রেন্ড হয়ে এতো পুরাণ ডায়লগ বলছ? আরে এই ডায়লগ তো বাটন ওয়ালা মোবাইলের থেকেও পুরাণ। তোমার থেকে এটা আশা করিনি। ইউ আর ভেরি ডিসিপয়েন্ট মি।

প্রহর যেন তাজ্জব বনে গেল। সাথে ফ্রীতে ফাহিমও। প্রহর ভেবেছিল টাকার কথা বললে মেয়েটা হয়তো অপমানিত বোধ করে চলে যাবে। নাহলে টাকার অফারে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে এর কাহিনিই উল্টো। সে কিনা ডায়লগ বাজি নিয়ে পড়ে আছে?
ওদের আশ্চর্য আরও বাড়িয়ে দিয়ে খুশি বলতে লাগলো।
–আর এটা কোন অফার হলো? অফারই দিতে হলে কোন লোভনীয়, আকর্ষণীয় অফার দাওনা? যা শোনার সাথে সাথে হ্যাঁ বলে দেই। যেমন, তুমি কয়টা চুম্মা চাও? কয়টা চুম্মা নিলে তুমি খুশি হবে? এমন কিছু।

ফাহিম হাতে তালি বাজাতে বাজাতে প্রভাবিত কন্ঠে বলে উঠলো।
–বাহ্ ভাবিজী জিও জিও। কি অফার দিলেন। হায় কেউ আমাদেরও যদি এমন অফার দিতো।

খুশিও গদগদ হয়ে বললো।
–থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।

প্রহর এবার অতিষ্টতার শিখরে। কপালের রগ ফুলিয়ে খুশির দিকে আঙুল তুলে বললো।
–জাস্ট শাট আপ ইউ চিপ গার্ল।

ব্যাস এবার খুশির মনোদেবি হাজির হলো এতক্ষণে। উপর থেকে বলতে লাগলো।
–এই খুশি কি বললো শুনছস? চিপ। সস্তা বলছে তোকে।

খুশি উপর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে বললো।
–এই তুই সবসময় আগুনে ঘি ঢালতে কেন চলে আছিস রে? আমার কানপুরে কোন হরতাল নেই। আমি ঠিকঠাক শুনতে পাই। তুই যাতো এখান থেকে।
খুশি এবার প্রহরের দিকে তাকিয়ে তেজী কন্ঠে।
–চিপ? ইউ মিন সস্তা? তুমি আমার ভালোবাসা কে সস্তা বলছ? মোটেও না। আমার ভালোবাসা কোন সস্তা মূলা না। আমার হলো দামি সোয়াবিন তেল। যার দাম দিনদিন শুধু বাড়তেই থাকে। একদম নাম্বার ওয়ান শাকিব খান ওয়ালা ভালোবাসা আমার। ওইযে গান আছে না?
♬যে প্রেম হাঁচি থেকে এসে ফুসফুসে করোনা হয়ে যায়
♬ সেই প্রেম আমাকে দিও
♬জেনে নিও তুমি আমার অক্সিজেনের চেয়েও প্রিয়
♬ তুমি আমার অক্সিজেনের চেয়েও প্রিয়

খুশির সুরেলা ফাটা বাঁশের মতো গান শুনে প্রহরের কান থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। প্রহর টেবিলে বাড়ি মেরে বলে উঠলো।
–স্টপ দিস ননসেন্স। এন্ড লিসেন্ট টু মি। আমি ভালো করেই জানি তুমি এসব টাকার জন্য করছ। তাই হেয়ালি না করে সোজাসুজি বলো কতো টাকা চাই তোমার? আমি তোমাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিচ্ছি। নিজের খুশিমতো এমাউন্ট বসিয়ে নাও। আর আমার পিছা ছাড়ো।

খুশি কৌতুহলী কন্ঠে বলে উঠলো।
–আপনার অনেক টাকা আছে বুঝি?

প্রহর একটা তিরস্কার স্বরূপ হাসি দিয়ে বললো।
–ভাবতো এমন করছ যেন কিছুই জানো না। এসব ট্রিকস আমার ওপর কার্যকর হবে না। তোমাদের মতো মেয়েদের ভালো করেই চেনা আছে আমার। যেই কোন রিচ ছেলেকে দেখেছ ওমনি চলে এসেছ তাদের ফাঁসাতে। নিজের মাসুম আর ভোলাভালা রুপ দেখিয়ে তাদের মন জয় করতে চাও। তবে আমার সাথে এসব চলবে না। তাই টাকা নাও আর আমাকে জ্বালানো বন্ধ করো।

খুশি একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো।
–হুমম তারমানে আপনার অনেক টাকা আছে। আর আমি যা চাইবো তাই আপনি দিবেন তাইতে?

–অপকর্স।

–ওকে ফাইন। তাহলে চলুন আমার সাথে।

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কোথায়?

–কেন আপনিই তো বললেন আমি যা চাইবো তাই দিবেন। তাহলে চলুন। আমি যেখানে নিয়ে যাবো আমার সাথে যেতে হবে।

প্রহর মনে মনে এক তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। সেইতো আসল রুপটা বেড়িয়েই পড়লো। দুনিয়াতে প্রেম ভালোবাসা বলতে কিছুই নেই। সবই হলো প্রতারণা।সবাই এক।সবাই শুধু স্বার্থের পেছনে ঘুরে।আজ তুমিও সেটা আরও একবার প্রমাণ করে দিলে। এতদিন কতো ভালোবাসা ভালোবাসা করছিল। আর আজ টাকার কথা বলতেই সব ভালোবাসা উড়ে গেল। যাক তাতে আমার কি? টাকা নিয়েও আপদ টা বিদায় হলেই বাঁচি। তাই না চাইতেও এই মেয়ের কথা মেনে নিতে হবে। একবার মেয়েটা পিছু ছাড়লে বাঁচি। সেই মনোভাব নিয়ে প্রহর বলে উঠলো।
–ঠিক আছে চলো।

খুশি উৎসাহ নিয়ে প্রহরের সাথে রওয়ানা হলো। সাথে ফাহিম আর দিয়াও চললো। খুশি যেতে যেতে কাওকে ফোন করে অতি উৎসাহী কন্ঠে বললো।
–এই লাবু শোন,সব বিচ্ছু বাহিনী নিয়ে দ্রুত ***গার্ডেনে চলে আয়। আজকে জমিয়ে পার্টি করবো। ধরে নে আমার লটারি লেগে গেছে বুঝেছিস।

প্রহর ফাহিমের দিকে ঝুঁকে বললো।
–খুব তো বলছিলি মেয়েটা খুব ভালো, ব্লা ব্লা ব্লা। একদম প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে যাচ্ছিলি। এখন দেখলিতো আসল রুপ। টাকা পেয়েই কেমন বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করার প্ল্যান করছে। এই হলো তোর সরল মনের মেয়ে।

–যতই বলিস ইয়ার। আমার এখনো মনে হচ্ছে খুশি এমন না।মেয়েটা একটু অন্যরকম। ওর মাঝে একটা ইউনেক নেস আছে। মেবি তুই দেখতে পাচ্ছিস না।

–আমি সঠিক টাই দেখতে পেয়েছি। এবং সেটা ধরে ফেলে তার সমাধানও করে ফেলেছি। এখন শুধু আর কিছু সময়ই একে সহ্য করতে হবে।
___

টিচার ক্লাস শেষ করে বেড়িয়ে যেতেই সব বাচ্চা কাচ্চারা হৈহৈ করতে করতে বাইরে চলে এলো। এখন টিফিন টাইম। তাই বাচ্চারা বাইরে এসে হৈচৈ করতে লাগলো। তবে নিভান এসব থেকে আলাদা। ও নিজের মতো বটগাছের নিচে বসে ওর স্কেচ খাতাটা বের করে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ করা শুরু করলো। সামনের গোলাপ ফুল গাছে একটা ফুটন্ত গোলাপ আর একটা কলি গোলাপ আছে। নিভান সেটারই আর্ট করছে।ক্লাস সেভেনে পড়ে সে। নিভান তেমন কারোর সাথে সহজে মিশতে পারে না। তাই একা নিজের মতোই থাকে। চুপচাপ শায় প্রকৃতির সে। তবে অনেক বুদ্ধিমান । নিজের বয়সের তুলনায় অনেক বেশি মেচিউর সে।

স্কেচ প্রায় শেষের দিকে। তখনই পাশ থেকে কোমল কন্ঠে কেউ বলে উঠলো।
–ওয়াও,, কত্তো সুন্দর হয়েছে।

নিভান পাশে তাকিয়ে দেখলো সেই মেয়েটা। যার কথা ও সেদিন ওর আপুকে বলেছিল। মেয়েটাকে ওর ভালোই লাগে। একদম বারবি ডলের মতো দেখতে। ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো স্কিন। হাসলে গালে টোল পড়ে। মাঝে মধ্যে আরচোখে দেখে ও। ওর আপুর পড়ে এই প্রথম কোন মেয়েকে ওর কাছে ভালো লেগেছে। তবে নিজের শায় স্বভাবের জন্য নিজে থেকে কখনো কথা বলতে যায় নি। এখন হঠাৎ করে সামনে আসায় একটু নার্ভাস হয়ে গেল নিভান। মেয়েটি আবারও বলে উঠলো।
–তুমি সত্যিই খুব সুন্দর আর্ট করতে পারো।

নিভান সৌজন্যেমূলক হাসি দিয়ে বললো।
–ধন্যবাদ।

মেয়েটি বলে উঠলো।
–হায়, আমার নাম স্পৃহা। তোমার নাম কি?

–আমার নাম নিভান।

–আচ্ছা নিভান তুমি কিছু মনে না করলে আমাকে একটু তোমার স্কেচ খাতার বাকি আর্ট গুলো দেখাবে? আসলে আমার না এগুলো দেখতে অনেক ভালো লাগে।

নিভান হাসিমুখে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ দেখনা।
নিভান খাতার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে স্পৃহাকে দেখাতে লাগলো। স্পৃহাও মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে স্পৃহা কৌতুহলী কন্ঠে বলে উঠলো।
–আচ্ছা এগুলো কি? প্রতি পেজের কোথাও চুলের ছবি,কোথাও হাতের, কোথাও শুধু চোখ। এমন একটু একটু বডিপার্টের আর্ট কেন?

নিভান মুচকি হেসে বললো।
–আসলে এগুলো সব আমার আপুর বডিপার্ট। আমি এখনো পুরো মানুষের স্কেচ করা ভালো করে পারিনা। তাই একেক সময় আপুর একেক অংশের ছবি আঁকি।
নিভান খাতার পৃষ্ঠায় দেখিয়ে বললো।
–যেমন এইযে এটা আমার আপুর চুল। এই চুলের ক্লিপটা আমি আমার পকেট মানি থেকে বাঁচিয়ে আপুর জন্য কিনেছিলাম। আপু অনেক খুশি হয়ে মাথায় লাগিয়েছিল। অনেক সুন্দর লাগছিল আপুকে। তখনই আমি আপুর এই স্কেচ টা করি।
তারপর আরেক টা পেজ দেখিয়ে বললো।
–এইযে হাতের ছবিটা দেখছ। এটাও সেদিন আমি আপুর জন্য কাচের চুড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর আপু সেটা হাতে দিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছিল। আমি তখনই এটা আঁকায়। এভাবে একটা একটা আঁকতে আঁকতে যখন আপুর সব অংশ আঁকতে শিখে যাবো। সেদিন আপুর বড়ো একটা ফুল স্কেচ বানাবো।তবে আপুকে দেখাবোনা। একটা স্পেশাল দিনে আপুকে গিফট করবো। আপু সেদিন অনেক খুশি হয়ে যাবে।

এতক্ষণ নিভানের কথাগুলো শুনে স্পৃহা গালে হাত ঠেকিয়ে বললো।
–অওওওও…হাউ সুইট। তুমি তোমার আপুকে এতো ভালোবাসো? তোমার আপু সত্যিই অনেক লাকী।

নিভান হালকা হেঁসে বললো।
–উহুম। আপু না। বরং আপুকে পেয়ে আমি লাকী। আপু আমার সবকিছু। আমি মা বাবার চেয়েও বেশি আপুকে ভালোবসি। আমার আপুটা মানুষই এমন। তাকে কেউ না ভালোবেসে থাকতেই পারে না। জানো আমার আপু যখন হাসে তখন আমার সবচেয়ে খুশি লাগে। আপুর হাসিতে ম্যাজিক আছে। সবকিছু আলোকিত করে দেয়।

নিভানের ওর বোনের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে স্পৃহা মুগ্ধ হয়ে গেল। হাসিমুখে বলে উঠলো।
–তুমি আসলে অনেক কিউট।

নিভান হালকা লজ্জা পেলেও সেটা চেহারায় আসতে না দিয়ে বললো।
–জানি। আপু বলেছে আমাকে।

–আচ্ছা নিভান,আমাকে আর্ট শেখাবে প্লিজ? আমার না আর্ট করার খুব শখ। কিন্তু আমি তোমার মতো এতো সুন্দর করে পারি না। তাই আমাকে একটু হেল্প করোনা প্লিজ? তুমি চাইলে আমি তোমাকে এরজন্য ফি দেবো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

নিভান মনে মনে ভাবলো।
–ব্যাপার টা মন্দ না। ফিস এর টাকা জমিয়ে আপুর বার্থডে তে ভালো একটা গিফট দিতে পারবো।
সেই মনস্তাপ করে নিভান স্পৃহার কথায় রাজি হয়ে গেল। স্পৃহা খুশি হয়ে বললো।
–থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ।
তারপর নিভানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
–ওকে দেন তাহলে আজ থেকে আমরা বন্ধু।

নিভান মুচকি হেসে হাত মিলিয়ে বললো।
–ওকে।
__

শপিং মলের ক্যাশ কাউন্টারের কাছে বিরক্তি ভরা মেজাজে দাঁড়িয়ে আছে প্রহর। পাশেই ফাহিমও দাঁড়িয়ে আছে। খুশি দিয়াকে নিয়ে সেই দুই ঘন্টা যাবৎ শপিং করছে। শেষ হওয়ার কোন নাম নেই। প্রহরের মেজাজ হায় হয়ে যাচ্ছে। প্রহর ভেবে পাচ্ছে এখানে ওকে নিয়ে আসার কি মানে হলো? টাকা নিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো শপিং করলেই তো পারতো। এখানে ওকে নিয়ে আসার কোন প্রয়োজনই উপলব্ধি করছে না সে।মেয়েটা জাস্ট হেডেক। কাম ডাউন প্রহর। শুধু আর কিছু সময়। তারপরই এই মেয়েটার থেকে ছাড় পেয়ে যাবে।

প্রহর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এই তুই একটু গিয়ে দেখতো হলো নাকি ওদের?

ফাহিম দ্বায় সারা ভাবে বললো।
–হোয়াই শুড আই গো ম্যান? ভেজাল তোর তুই যা।

প্রহর দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো ফাহিমের দিকে। ফাহিম সেটার ভ্রূক্ষেপ না করে বলে উঠলো।
–আচ্ছা ভাবিজী, আই মিন খুশি কিডস সেকশনে কি করছে?

প্রহর বিরক্তি ভরা কন্ঠে বললো।
–হাউ উড আই নো?হবে হয়তো নিজের ভাই বোনের জন্য কাপড়চোপড় কিনছে। এতো বড় লটারি হাত লেগেছে। পুরো চৌদ্দ গুষ্ঠির জন্য কেনাকাটা করছে হয়তো।

ওদের কথার মাঝেই খুশিরা চলে এলো। খুশির দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগের পাহাড় জমেছে। বেচারি ব্যাগের ভীড়ে ডুবে যাচ্ছে। ওরা প্রহরদের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কিছুর সাথে পা বেজে পড়ে যেতে লাগলো। পড়তে পড়তে বেচারি একেবারে প্রহরের ওপর এসে পড়লো। আচমকা এমন হওয়ায় প্রহর নিজেও পড়ে যেতে লাগলো। নিজেকে বাঁচাতে পেছনের ক্যাশ কাউন্টারে হাত ঠেকালো প্রহর। খুশি যেয়ে পড়লো প্রহরের বুকের ওপর। হাতের ব্যাগগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। খুশি নিজের ব্যালেন্স রাখতে প্রহরের দুই কাঁধে ওপর দিয়ে নিজের হাত রাখলো। নাক যেয়ে লাগলো প্রহরের বুকের সাথে।

এক মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ এসে লাগলো খুশির নাকে। কেমন নেশালো একটা ঘ্রাণ। খুশি আবেশে চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ টা টেনে নিল নিজের মাঝে। তারপর মাথা তুলে তাকালো প্রহরের দিকে। প্রহরের চোখে চোখ পড়ে গেল। খুশির চোখের দিকে এই প্রথম সরাসরি তাকালো প্রহর। স্বচ্ছ ওই চোখের ভাষায় কিছু একটা আছে। সে চোখের গভীরতায় কেমন হারিয়ে যাচ্ছে প্রহর। প্রহরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুশি দুষ্টু হেসে ফট করে বলে উঠলো।
–ইরাদা কেয়া হে? কিস করতে চাচ্ছো নাকি? চাইলে করতে পারো। আই ওন্ট মাইন্ড।

খুশির এমন খাপছাড়া কথা শুনে প্রহরের সব ঘোর মুহূর্তেই ছু মন্তর হয়ে গেল। দুই হাতে খুশিকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–জাস্ট শাট আপ ইডিয়ট। এন্ড স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি। তোমার এসব কারসাজি শেষ হলে কি আমি যেতে পারি?

খুশি হাসিমুখে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ এখানকার কাজ শেষ। এখন আমরা আরেক জায়গায় যাবো চলুন।

–হোয়াট? দেখ আমি আর কোথাও যেতে পারবোনা। তোমার টাকা লাগে নিয়ে যাও।

–দেখুন আপনি বলেছেন আমি যা বলবো তাই শুনবেন। এখন না করতে পারবেন না। যেতে তো আপনাকে হবেই।
কথাটা বলে খুশি প্রহরের হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। প্রহরের রাগ লাগলেও আপাতত এই মেয়ের কথা মানা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই অগত্যা ওর কথায় মেনে চললো।
___

খুশি প্রহরদের একটা উন্মুক্ত পার্কে নিয়ে এলো। পার্কে এসে দেখলো অনেক গুলো বাচ্চা এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছে। তাদের পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা সব পথশিশু। খুশি সেদিকে এগিয়ে যেতেই সবগুলো বাচ্চারা হাসিমুখে উচ্ছসিত হয়ে খুশির দিকে দৌড়ে এলো। খুশিও হাসিমুখে তাদের দুইহাতে জড়িয়ে নিল। খুশির সেই শপিং মল থেকে কিনে আনা প্যাকেট গুলো ওদের সবার হাতে একটা একটা করে দিচ্ছে। বাচ্চারা সেগুলো পেয়ে খুবই খুশি। তাদের মাছুম হাসিগুলোতে যেন এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ খেলছে। যেটা হয়তো এই সামান্য টাকার চেয়ে অনেক বহুমূল্যবান।

এসব দেখে প্রহর খুবই অবাক হয়ে গেল। খুশি যে এদের জন্য তখন শপিং করছিল তা ভাবতেই পারেনি সে। এমন ইমম্যাচিওর উড়নচণ্ডী মেয়ের যে এমন চিন্তাধারাও থাকতে পারে সেটা অকল্পনীয় ছিল প্রহরের কাছে। ব্যাপার টা ভাবিয়ে তুললো ওকে। খুশির বৈচিত্র্যময় এই চরিত্রটা কেন যেন না চাইতেও মুগ্ধ করলো প্রহরকে। অবাক বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো সে। খুশি কেমন অমায়িক ভাবে এই বাচ্চাগুলোর সাথে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। যেন কত আপন কেউ।

প্রহরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাহিম হাসিমুখে বলে উঠলো।
–দেখেছিস আমি বলেছিলাম না, মেয়েটা ইউনিক। নট লাইক এভরিওয়ান।

খুশি এবার প্রহরের গাড়ির ভেতর থেকে বাচ্চাদের জন্য আনা খাবারের বক্সগুলো বের করছে। অনেক গুলো বক্স হওয়ায় খুশি একা পারছে না। তাই খুশি প্রহরদের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্টাইল মারছো। একটু হেল্প করলেও তো পারো। আজকাল স্বহৃদয়বান মানুষ পৃথিবী থেকে উঠেই গেছে মনে হচ্ছে।

খুশির কথায় এবার আর রাগ হলো না প্রহরের। ওরা এগিয়ে গিয়ে বাকি খাবারের বক্সগুলো বের করে আনলো। সব বাচ্চাদের গোল করে বসিয়ে সবার হাতে একটা করে বক্স দিল। বাচ্চারা খুবই আনন্দচিত্তে খাবার খাচ্ছে। এই দৃশ্যটা সত্যিই অসামান্য এক সন্তুষ্টি এনে দিচ্ছে প্রহরের মনে। খুশি একটা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে বললো।
–কিরে লাবু তোর পড়ালেখা কেমন চলছে?

লাবু খেতে খেতে বললো।
–ভালা চলতাছে আফা। আপনে যে টেহা দিছিলেন ওইডা দিয়া ইশকুলের সব ফিস দিয়া দিছি। এহন আর কোন সমস্যা নাই।

–গুড। ভালো করে পড়াশোনা করবি। আর কোন কিছু লাগলে আমাকে বলবি কেমন?

–আইচ্ছা।

ফাহিম বলে উঠলো।
–ভাবিজী, আপনি কি ওদের আগে থেকেই চিনেন।

–হ্যাঁ চিনি। এদের সবাইকে চিনি আমি। এদের সাথে সময় কাটাতে অনেক ভালো লাগে আমার।

–বাহ্ ভাবিজী আপনি কিন্তু অনেক ভালো কাজ করছেন।

–ধন্যবাদ দেবরজী। আসলে আমি এটাই মানি নেকি করো ফলের আশা করো না। কারণ ফল তো বাজারেও পাওয়া যায়।
কথাটা বলেই খুশি খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।সাথে ফাহিমও। হাসতে হাসতে ফাহিমের হাতের সাথে হাই ফাই দিল।

খাওয়া শেষে বাচ্চারা বললো।
–অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু। এতো সুন্দর খাওন আর কাপড়চোপড়ের লাইগ্যা।

খুশি বললো।
–উহুম। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে লাভ নেই। আজকের সবকিছু তোমাদের এই ভাইয়ার তরফ থেকে। উনার টাকাতেই এসব আনা হয়েছে। তাই তাকেই ধন্যবাদ দাও।

বাচ্চারা এবার প্রহরকে ধন্যবাদ জানালো। প্রহর সৌজন্যমূলক হাসি দিল। খুশির কাজে আজকে প্রচুর অবাক হচ্ছে প্রহর।
খাওয়া দাওয়া শেষে বাচ্চারা কানামাছি খেলার জেদ ধরলো। সবাই মিলে খুশির চোখে কাপড় বেঁধে দিল।তারপর খুশি হাতড়িয়ে সবাইকে ধরার চেষ্টা করছে। খুশি চালাকি করে কাপড়ের ফাঁকে প্রহরকে দেখে নিল। তারপরে ফট করে গিয়ে প্রহরকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–ইয়েএএএ ধরে ফেলেছি, ধরে ফেলেছি।

খুশি চোখের কাপড় খুলে প্রহরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে একটা চোখ মেরে দিল । প্রহর যথারীতি রেগে গিয়ে খুশিকে ছাড়িয়ে ওখান থেকে চলে যেতে নিলে,খুশি পেছন থেকে হাত ধরে ফেললো। প্রহরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ ইস দিওয়ানে ল্যাড়কে কো কোয়ি সামঝায়ে
♬পিয়ার মোহাব্বাত সে না জানে কিউ এ ঘাবড়ায়ে
♬ দাড়দে দিল জানে না
♬পাস মে জিতনা আয়ু উতনি হি দূর এ যায়ে হা যায়ে
(প্রহর খুশির হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগলে বাচ্চারা এসে ঘিরে ধরে। খুশি প্রহরের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নানান অঙ্গভঙ্গি করতে করতে গাইতে লাগলো)
♬ রাঙ না দেখে রুপ না দেখে
♬ এ জওয়ানি কে ধুপ না দেখে
♬ ইস্ক মে ইস কি বাবরি হু মে
♬ এ ভালা হে তো কেয়া বুরি হু মে
♬ এ ল্যাড়কা হে ফিরবি জানে কিউ শারমায়ে
♬ হা শারমায়ে

♬ ইস দিওয়ানে ল্যাড়কে কো কোয়ি সামঝায়ে
♬ পিয়ার মোহাব্বাত সে না জানে কিউ এ ঘাবড়ায়ে

প্রহর ওখান থেকে সরে এসে একটা ব্রেঞ্চে এসে বসে। খুশিও যথাযথ ওখানে এসে বসে পড়ে। প্রহর এবার একটু শান্ত সুরে বলে উঠলো।
–দেখ তুমি মেয়ে খারাপ না। তবে আমার পিছে ঘুরে নিজের জীবন নষ্ট করোনা। তোমার চাওয়া কখনোই পুরন হবে না। আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসবতে পারবোনা। ইনফ্যাক্ট আমি কোন মেয়েকেই কখনো ভালোবাসতে পারবোনা। তাই আমার পিছু ছেড়ে দাও প্লিজ।

কথাটা বলেই প্রহর উঠে চলে গেল। আর তখনই জনাবা মনোদেবি এসে হাজির হলেন। উপর থেকে খুশিকে বলে উঠলো।
–কি বললো শুনেছিস? কোন মেয়েকেই নাকি ভালোবাসতে পারবে না। এর অর্থ কি বুঝতে পারছিস?

খুশি ভীতু স্বরে বললো।
–তুইও কি তাই ভাবছিস যা আমি ভাবছি? তারমানে কি প্রহর একটা “গে”?
খুশি দুই কানে হাত রেখে চিৎকার দিয়ে বললো।
–নেহিইইইইইইইই🙉

চলবে…….

গল্পের লেটেস্ট আপডেট পেতে আর গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আমার গ্রুপে জয়েন হওয়ার আমন্ত্রণ রইল। নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো। জয়েন হতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন। 👇
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here