অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ২১

0
6349

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২১ 💑❤💑

সাদিদরা ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত অনেক। তাই তারা সকলেই ক্যাব বুক করে বাসার পথে রউনা দিলো। প্রিয়তীকে অর্ণব পৌঁছে দিবে আর নীলাকে সাদিদ। আর শান্তকে তার বাসায় পৌঁছে দিবে তানবীর। সে আছে বিধায় সাদিদ ইচ্ছে করে নিজেকে এর মধ্যে জড়ালো না। তানবীরও বোধহয় তার এই সিদ্ধান্তে খুশি। কেননা তার চোখে-মুখে নামহীন হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।
সবাই সবার থেকে বিধায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। বলাবাহুল্য এই কয়েকটা দিন একত্রে কাটিয়ে এখন সবার-ই যাবার সময় খারাপ লাগছে। কিন্তু তারপরও যেতে তো হবেই।
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে নীলার মিরপুরের বাসার উদ্দেশ্য। সে জানালার বাহিরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদ তাকে এমন চুপচাপ দেখে বলল,

— ‘ কি ম্যাম, এমন চুপচাপ কেন? ‘
— ‘ এমনি। ‘

নীলাকে আবারও চুপ করে থাকতে দেখে সাদিদ একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল। সাদিদের অল্প উষ্ণতায় যেন নীলার চেপে রাখা কান্নাগুলো উপচে পরে বেড়িয়ে আসতে লাগল। সে সাদিদের বুকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগল। কান্নাটা নিঃশব্দের হলেও সাদিদ তার শরীরে বহমান কাঁপুনি অনুভব করতে পাড়ছে। তাই সাদিদ তার গালে হাত রেখে মুখটা উঁচু করল। ইশারায় বলল চোখের জল না ফেলতে। কিন্তু নীলার চোখের অশ্রুরা যে বাঁধনহারা। তারা কোনো বাধা-নিষেধ মানতে নারাজ। সাদিদ সামনে ডাইভিয়ে ব্যস্ত চালককে একপলক দেখে নিয়ে নীলার কপালে নিঃশব্দে আদর দিলো। তারপর ভীষণ মায়ায় জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আর না পাখি। তোমার চোখের অশ্রুজল আমি সহ্য করতে পারি না। ‘
— ‘ সরি, কিন্তু আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট হচ্ছে কেন? ‘

সাদিদ এবার মৃদু হাসল। তার কাছে উত্তরটা বিশুদ্ধ জলের ন্যায় পরিষ্কার। কিন্তু সে মুখ ফুটে কিছু বলল না। কেননা সে এই মধুর শব্দটা নীলার মুখ থেকেই শুনতে আগ্রহী। তাই তাকে বুকে আগলে নিয়ে বলল,

— ‘ আমি সকালেই বাবা-মার সাথে আমাদের বিষয়ে কথা বলব। নিজের প্রাণপ্রিয় বউকে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও দূরে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। খুব শীঘ্রই নিজের ব্যক্তিগত পাখিকে নিজের ভালোবাসায় বাঁধানো খাঁচায় নিয়ে আসব। কোথাও যেতে দিব না। ‘

শেষোক্ত কথাটা বলতে নিয়ে সাদিদ নীলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। এমন একটা ভাব যেন ছেড়ে দিলেই সে চলে যাবে। যা সাদিদ হতে দিবে না।
গাড়ি নীলাদের বাসার সামনে পৌঁছাতেই সাদিদের হুঁশ আসলো। এতক্ষণ যে নীলাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল সেদিকে তার খবর ছিল না৷ না ছিল নীলার। গাড়ির ডাইভারের হর্ণের আওয়াজ শুনেই তার হুঁশ ফিরেছিল। চালক সাদিদের সমবয়সী হবে। এতক্ষণ পিছনে খেয়াল না করলেও শেষের দিকে ডাক দিতে গিয়ে সে লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। সে দ্রুত সামনে মুখ করে বসে গাড়ির হর্ন দিলো। তাতেই সাদিদ নীলাকে ছাড়ল। নীলাও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে লজ্জিত। সে মাথা নিচু করে রয়েছে। সাদিদ হালকা গলা কেশে গাড়ির দরজা খোলে বাহিরে আসলো। অপরপাশে গিয়ে নীলার পাশের দরজাটা খোলে দিলো। রাত অনেক হওয়া সত্ত্বেও সাদিদ ক্যাব ভাড়া মিটিয়ে তাকে বিদায় করে দিলো।
নীলার হাঁটার গতি ধীর। সাদিদ পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরল। নীলা মাথা নিচু করে রয়েছে। চোখ তোলে তাকালে যে সাদিদের কাছে ধরা খাবে। যেটা নীলা এইমুহূর্তে চায় না।
কিন্তু সাদিদ তো নিজের প্রাণপাখির অবস্থা বুঝতে সক্ষম। তাই গালে হাত দিয়ে নীলার মুখটা উঁচু করল। একধ্যানে তাকিয়ে থাকল নির্নিমেষ। নীলার ছোট ছোট করে রাখা চোখগুলোতে অশ্রুকণারা এসে ভিড় জমিয়েছে। সাদিদ বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে তার দুই চোখ মুছিয়ে দিলো।

নিস্তব্ধতা তাদের ঘিরে রয়েছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোলাহলযুক্ত যায়গাটাও এখন নীরব পল্লিতে রূপান্তর হয়েছে। সাদিদ একপা এগিয়ে নীলার শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল। তার গাল থেকে একটা হাত এনে তার কোমড়ে রাখল। সাদিদের এহেন ছোঁয়ায় নীলার শরীর কম্পিত হলো। কিন্তু সাদিদ তাতে থামল না। বরং তার কোমড়ে নিজের একহাতে জড়িয়ে মাটি থেকে তাকে সামান্য উপরে তোলে নিলো। নিজেকে এমন ভাসমান দেখে নীলা এবার খানিকটা চমকিত দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদের চোখ-মুখ পুরোপুরি নরমাল। সে একদৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের নড়চড় একবারে সামান্য। সাদিদ নীলাকে এনে নিজের সাথে মিশাল। তার একহাত এখনও নীলার গালে। সাদিদ এবার নীলার গালে আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতে লাগল। ধীরে ধীরে সাদিদের চোখগুলো লাল হতে লাগল। নীলা এবার রীতিমতো কাঁপছে। কেননা সাদিদের এই দৃষ্টি তার এতদিনে বড্ড চেনা হয়ে গিয়েছে। সে এলেমেলো দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। সাদিদ নীলার একগালে হাত রেখে অপরগালে চুমু খেল। সাদিদের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে নীলা তার ঘাড় খামচে ধরল।
সাদিদ আড়চোখে নিজের ঘাড়ে রাখা নীলার হাতের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মৃদু হাসছে। জায়গাটা রীতিমতো জ্বলছে। এই মেয়ের জন্য ভবিষ্যতে তার হয়তো স্পট রিমোভার অয়েন্টমেন্ট নিয়ে ঘুরতে হবে। তার পুরো শরীরে ইতিমধ্যে সে অগণিত খামচির দাগ বসিয়ে দিয়েছে। সাদিদ নীলার মুখের দিকে তাকাতেই তার বন্ধ আখিঁদ্বয় দেখতে পেল। সাদিদ আবারও মুখ এগিয়ে নীলার বন্ধ চোখে চুমু খেল। একে একে তার গাল, কপাল, নাকসহ পুরো মুখে অগণিত উষ্ণ আদর দিলো।
সাদিদ এবার একটু থেমে নিজের মুখটা নীলার ঠোঁটের একেবারে সন্নিকটে নিয়ে আসলো। দুই জোড়া অধর ছুঁই ছুঁই। সাদিদের তপ্ত নিঃশ্বাস নীলার মুখভাগে পরতেই তার কাঁপুনি দ্বিগুণ হলো। চোখ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সে বুঝতে পাড়ছে সাদিদ তার কতটা কাছে রয়েছে। তাদের মধ্যকার দূরত্বটা একেবারে নেই বললেই চলে। নীলা সেটা উপলব্ধি করে তার বন্ধ চোখজোড়া আরও খিঁচে বন্ধ করল। নীলার চোখ-মুখ, ঠোঁট অনবরত কাঁপছে। সাদিদের এই স্পর্শগুলো নীলাকে এখনও বেসামাল করে তোলে। সে কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারে না৷ সাদিদ বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নীলার অধর ছুঁয়ে দিলো। হালকা স্লাইড করে সাদিদ নেশাভরা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আই লাভ ইউ বেবি। লাভ ইউ লট। ‘

নীলা এবার চোখ খোলে সাদিদের চোখে চোখ রাখল। তার এই কথার পরিপেক্ষিতে বিপরীত উত্তরটা দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে। সে বলতে চাইল। কিন্তু সাদিদের এমন নেশাক্ত চাহনি দেখে লজ্জায় চোখজোড়া নিচু করল।
এমন চাহনি কেন ছেলেটার? সে বুঝে না নীলা এই দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না? সাদিদ নীলার মুখটা আবারও উঁচু করল। এগিয়ে আসলো নিজেদের মধ্যকার দূরত্বটা মিটিয়ে নিতে। নীলা কাঁপছে। তার কাঁপুনির পরিমাণ আরও বেড়ে গেল যখন নিজের অধরে সাদিদের অধর মিলিত হলো। সে নিজেকে সামলাতে একহাতে সাদিদের ঘাড় শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। সাদিদ একহাতে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে অপর হাত তার গালে রেখে ক্রমাগত উষ্ণ স্পর্শ বিলিয়ে দিতে লাগল।
অনেক সময় অতিবাহিত হবার পরও যখন সাদিদের ছাড়ার নামগন্ধ রইল না তখন নীলার অবস্থা দিশেহারা। তার দম আটকে আসছে৷ সে সাদিদের বুকে মৃদু ধাক্কা দিলো। কিন্তু সাদিদ তাকে উষ্ণতা দিতে ব্যস্ত। নীলা না পেরে এবার একটু জোরেই ধাক্কা দিয়ে সাদিদের থেকে সরে আসলো। তার ধাক্কায় সাদিদের হাত ঢিলে হয়ে যায় এবং নীলার পা দীর্ঘসময় পর নিচে অবতরণ করল। সে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে জোরে জোরে শ্বাস টানছে। সাদিদের শ্বাসও দ্রুত গতিতে চলছে। নিজেকে স্থির করে নীলার এতক্ষণে নিজের করা বেয়াদবির খেয়াল আসলো। এত সময়েও সাদিদের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে নীলা এবার তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সাদিদের লাল লাল চোখগুলো দেখে নীলার অনুতপ্ততাবোধ হতে লাগল। সে এগিয়ে গিয়ে অপরাধী মনোভাবে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ সরি আসলে তখন শ্বাস…

নীলাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে সাদিদ তার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরল। মাথা খানিকটা নিচু করে নীলার সমানে এসে বলল,

— ‘ ভালোবাসিতো। নিজের প্রাণপাখির এইটুকু কারণবশত সমস্যা বুঝব না? বর হিসেবে কি এতটাই খারাপ? ‘

নীলা আশ্বস্ত হলো। কিন্তু সাথে লজ্জাও পেল। সাদিদ তাকে লজ্জায় লাল হতে দেখে আচমকাই তার ঠোঁটে আবারও শব্দ করে একটা দীর্ঘ চুমু খেয়ে নিলো। নীলা হঠাৎ এমন করাতে থতমত খেয়ে গিয়েছে। সাদিদ তার ভাবভঙ্গি বুঝতে পেরে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ এনার্জি সঞ্চয় করছি। দূরে থাকার এনার্জি। আমাকে এত কষ্টে পুড়ানোর জন্য তোমাকেও কিন্তু সমানতালে পুড়াবো বউ। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করব। ‘

কথা সমাপ্তিতে সাদিদ নীলার কানের লতিতে আলতো কামড় বসাল। এবং শেষাক্ত কথাগুলো যেন সাদিদ তার কন্ঠে নেশার বিষ ঢেলে বলেছে। যা নীলার কর্ণকোহরে পৌঁছাতেই নীলার দম আটকে আসতে লাগল। শরীর তার অনবরত শিরশির করতে লাগল। তার থেমে থেমে শ্বাস নেওয়া দেখে সাদিদ এবার কামড় দেওয়া অংশে আদর দিলো।

রাত অনেক হয়েছে। নীলাকে এখন বাসায় যেতে হবে৷ সাদিদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকা সত্বেও নীলাকে তার রেখে যেতে হচ্ছে। ভাবতেই তার কাছে বিষয়টা বিষাক্ত মনে হচ্ছে।
সাদিদ সবকিছুকে ছাপিয়ে নীলার কপালে ভালোবাসার উষ্ণ চুম্বনে এঁকে দিলো।
গালে হাত রেখে আদরমাখা কন্ঠে বলল,

— ‘ গুড নাইট পাখি, এন্ড সি ইউ ইন মাই ড্রিমস্। ‘

সাদিদ একটু থেমে নীলাার কানে আবারও চুমু খেল। এবার খানিকটা নিচু স্বরে বলল,

— ‘ আর অনেক আদর করব। ‘

ইশশ কি নির্লজ্জ এই ছেলে। নীলা লজ্জায় লাল-নীল-সবুজ সব হয়ে মাথা নিচু করল। সাদিদ তার অবস্থা দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগল।
নীলাকে বিদায় জানিয়ে সাদিদ তাকে বাসায় যেতে বলল। সাদিদ গেল না। নীলাকে যতক্ষণ পিছন থেকে দেখা সম্ভব সাদিদ ততক্ষণই সেই সুযোগটা চায়। এত দেখেও যেন সাদিদের তৃপ্তি মেটে না। এত ভালোবেসেও যেন দিনশেষে সাদিদের কাছে ভালোবাসায় কমতি মনে হয়। এতো কাছে থেকেও যেন সাদিদ তাকে নিজের আরও সন্নিকটে চায়। এটা কি তার কোনো সমস্যা? নাকি তার নীলার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা?
নাকি তার অনুরাগ? হৃদয়ের অন্তরালের অনুরাগের ফলাফল কি তার এই ভালোবাসাময় পাগলামি?
সাদিদ এর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে অবগত নয়। কিন্তু সে নীলাকে চায়। অসম্ভব হারে চায়। যেই চাওয়ার কোনো শেষ নেই। দিনশেষে যেই চাওয়া-পাওয়ার পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে কেবল বাড়তেই থাকে।
নীলা ধীর পায়ে গেইটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটাকে ছেড়ে যেতে তারও কষ্টে বুক ফাটছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে বুকের বাম পাশে অসহ্যকর ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। দূরত্বটাকে একেবারে পিষে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সাদিদের ভালোবাসাময় পাগলামিতে নীলাও আজ পুরোপুরি আসক্ত। তাইতো দিনশেষে এত লজ্জাবাণের পরও তার শুধু সাদিদকেই চায়। ঘুমাতে-জাগতে সবসময়। সেও যে অন্তরালের অনুরাগের রোগে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। যেখান থেকে এখন নিস্তার পাওয়া দুঃসাধ্য। নীলা হাঁটা থামিয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। সাদিদ নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। যেটা দেখে নীলার এতক্ষণের চেপে রাখা কষ্টটা আরও বেড়ে গেল। সাদিদ ঠোঁটের কোণায় জোরপূর্বক হাসি টেনে নীলাকে ইশারায় ভিতরে যেতে বলল।
নীলাও বুকে পাথর চেপে সাদিদের মুখটা শেষবারের মতো দেখে ভিতরে পা রাখল।
নীলা চোখের আড়াল হতেই সাদিদ অনুভব করল তার চোখজোড়া অসহ্যকর যন্ত্রণায় জ্বলছে। সে মৃদু হাসল। মেয়েটা তাকে পুরোপুরি ডুবিয়ে মেরেছে। মানুষ হিসেবেও একদন্ড রহম করেনি। সাদিদ আবারও একপলক নীলা বিহীন গেইটের দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে আসলো। রিক্সা নিতে মন চায়ছে না। সবকিছুতেই কেমন যেন শূন্যতা বিরাজমান। সাদিদ চুলগুলোকে কপাল থেকে ঠেলে পিছনে ফেলল। সামনের মোড়ে গিয়ে গাড়ি নিবে। আপাতত সে প্রিয়তমাবিহীন ভারাক্রান্ত হৃদয়ের প্রেমিক হয়ে রাস্তাটুকু শেষ করতে চায়।

চাঁদের আলোয় নীরব রাস্তাটা ঝলমল করছে। রাতের ঠান্ডা শিরশিরানি বাতাশ সাদিদের শরীর-মন ছুঁয়ে দিচ্ছে। সে অনেকটা পথ হেঁটে পেরিয়ে আসতেই পিছনের দিক থেকে কারও দৌড়ানির আওয়াজ পেল। শব্দটা প্রকট থেকে প্রকটতর হতেই সাদিদ কৌতূহলবশত পিছনে ফিরল।
একি! সে এটা কি দেখছে?

নীলার সাদা-সবুজটা ওড়নাটা বাতাশের সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত দুলছে। সবুজ রঙটাকে চাঁদের আলোয় সাদিদের কাছে কালো মনে হচ্ছে। নীলার হালকা করে বেঁধে রাখা চুলগুলো ইতিমধ্যে নিজেদের স্বাধীনতা লাভ করে নিয়েছে। নীলাকে এমন এলোকেশী কন্যার ন্যায় পাগলের মতো ছুটে আসতে দেখে সাদিদ প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখনই বিষয়টা তার মাথায় আসলো সে একপা সামনে আগালো। দুইকদম সামনে হেঁটে সে নিজের পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো। সাদিদের গতির সামনে নীলার জন্য পথের দৈর্ঘ্যটা নিমিষেই কমে গেল।
সাদিদ নিজেদের সবটুকু দূরত্ব মিটিয়ে নীলাকে শূন্য তোলে নিলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষের স্পর্শে এসে নীলাও সাদিদের গলা জড়িয়ে ধরল। ক্রমাগত লম্বা শ্বাস টেনে সে একদমে বলে উঠল,

— ‘ ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। ‘

জীবনের অতি মধুর কাঙ্ক্ষিত এই শব্দটা আচমকা শুনে সাদিদ চমকিত হলো। কতদিন, কতবছর, কত নির্ঘুম রাত সাদিদ হয়তো এই শব্দটা শুনার জন্য অপেক্ষা করেছে। যার হিসাব করতে গেলে কষ্টকর হয়ে যাবে। সাদিদ নীলার কোমড় জড়িয়ে তাকে নিজের বরাবর করল। তাকে শূন্য ভাসিয়েই বলে উঠল,

— ‘ আবার বলো প্লিজ। ‘
— ‘ ভালোবাসি। ‘
— ‘ ওয়ান্স মোর বেবি। আই ওয়ান্ট টু হেয়ার দিস ওর্য়াড এগেইন এন্ড এগেইন। ইট’স লাইক এ ম্যাজিক। টোটালি আনডিক্সক্রাইবল। ‘

নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। সাদিদের কথায় তার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে আবারও বলতে লাগল,

— ‘ ভীষণ ভালোবাসি। বলতে দ্বিধা নেই এই মানুষটাকে আমি ভালোবাসি। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আপনি। আর ইনশাআল্লাহ শেষ। আমি সাদিদ নামের এই ছেলেটাকে সীমাহীন ভালোবাসি। এই নির্লজ্জ-অসভ্য পুরুষটাকেও ভালোবাসি। ভালোবাসি আমি, নিজের একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটাকে। আমি ভালোবাসি সাদিদ নামক আমার জীবনসঙ্গীকে। আমি ভালোবাসি পুরো এই মানুষটাকেই। ভীষণ ভালোবাসি। ‘

সাদিদ পুরোটা সময় নীলার মুখের দিকে একধ্যনে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে-মুখে তৃপ্তি। মুগ্ধতায় ছেয়ে আছে পুরো মুখমন্ডল। চাঁদের আলোয় যা অতি স্নিগ্ধকর। নীলা প্রাণভরে সাদিদের এই মুগ্ধতায়ভরা খুশি মুখটা দেখছে। সে স্বার্থক। সাদিদের মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল দেখে নীলার মুখেও তৃপ্তিকর হাসি ফুটে উঠল।
সাদিদ নিজের অব্যক্ত খুশিগুলোকে নিজের মধ্যে বন্দি করে নীলাকে কাছে টানল। নীলার উন্মুক্ত চুলের পিছনে হাত দিয়ে সাদিদ তার নরম অধরযুগল নিজের অধরের মধ্যে পুরে নিলো। তাকে এতটা তৃপ্তি দেবার জন্য বিনিময়ে ভালোবাসাময় উপহার দিতে লাগল। নীলা আচমকা সাদিদের এমন স্পর্শে থমকে গিয়েছিল। চোখগুলো তার মুহূর্তেই বড় বড় হলো। কিন্তু সাদিদের অতিরিক্ত মধুময় ভালোবাসার সামনে নীলার চোখগুলো ধীরে ধীরে নিভে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই আবেশে নীলার আখিঁদ্বয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আসলো। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাদিদের ভালোবাসার শিহরণ বয়ছে। সে কাঁপা হাতগুলো দিয়ে সাদিদের পিঠ আঁকড়ে ধরল। নিজেকে সামলাতে সাদিদের পিঠের জামা খামচে ধরল।
দীর্ঘ ভালোবাসাময় মুহূর্ত কাটিয়ে সাদিদ নীলাকে ছাড়ল। নীলা চোখ বন্ধ করে ক্রমাগত কাঁপছে। সাদিদ নীলার গালে এক হাত রেখে নিজের ভেজা ঠোঁটে তার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ আঁকল। নীলা শিহরিত হয়ে সাদিদের হাতের উপর নিজের হাত রাখল। সাদিদ নীলার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে মুগ্ধতাভরা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আমার জীবনটা রাঙিয়ে তোলার জন্য সাদিদ তার প্রাণপাখির কাছে কৃতজ্ঞ। ভালোবাসি প্রিয়তমা। খুব বেশি ভালোবাসি। ‘

________________

তানবীর শান্তকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে আরও আগেই৷ কিন্তু সে এখনও তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেন দাঁড়িয়ে সেটা সে নিজেও বুঝতে পাড়ছে না৷ কয়েকবার যেতে চায়লেও তার পা একজায়গাতে স্থির। নিজের এমন পাগলামিতে তানবীর এবার মহা বিরক্ত। সে ভ্রুজোড়া বাঁকা করে কপাল কুঁচকে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করছে।
তার মন বলছে উত্তরটা তার জানা। কিন্তু মস্তিষ্ক উত্তরের বিপরীতে হাজারও নাবোধক উত্তর এনে দাঁড় করাচ্ছে। এককথায় তানবীর নিজের মনকে সাইডে রেখে নিজের তৈরি করা কথা দিয়ে নিজেকেই স্বান্তনা দিচ্ছে।

সে রাস্তার একটা ইটের টুকরোকে পায়ে আঘাত করে দৌড়ে সরাল।
শান্ত এতক্ষণ মা-বাবার নানারকম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। পায়ের ব্যাথায় জন্য বকাও খেয়েছে। এতসব বকাবকি-আদরের পর তার রুমে আসার অনুমতি মিলল। রুমে এসেই সে ওয়াসরুমে ঢুকল। পা না ভিজিয়ে ফ্রেস হয়ে নিলো।
চুলগুলোও হালকা ভিজিয়ে বেড়িয়ে আসলো। রাত অনেক হয়েছে। এবার ঘুমানো দরকার। কিন্তু কি মনে করে সে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাতের পরিবেশ দেখতে ভালো লাগছে। শান্ত দৃষ্টি এদিক-ওদিক করে মুগ্ধতা নিয়ে চারপাশ অবলোকন করছে।
কিন্তু আচমকা নিচে চোখ পরতেই শান্তর ভ্রুজোড়া অটোমেটিকলি কুঁচকে এলো। সে চোখগুলো হাত দিয়ে ঢলে আবারও তাকালো। না সে চোখে ঠিকই দেখছে। কিন্তু সে এখানে কেন?

তানবীরকে ফাঁকা রাস্তায় বাচ্চাদের মতো ইটের টুকরোর সাথে ফুটবল খেলতে দেখে শান্তর চোখগুলো প্রায় বেড়িয়ে আসার উপক্রম। তাদের দুইতলার ছাঁদ থেকে সোডিয়ামের আলোতে রাস্তায় তানবীরকে শান্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তাকে ঢেকে কিছু বলতে পাড়ছে না৷ কেননা পাশের রুমে মা-বাবা। তারউপর রাতের নিস্তব্ধতায় হালকা শব্দও ভয়ংকর শোনা যায়। শান্ত এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাত কচলাতে লাগল। সে না পেরে মৃদু স্বরে আওয়াজ করল,

— ‘ শুনছেন? ‘

এত আস্তে বলেছে যে বোধহয় শান্তর কানেই কথারা যায়নি। সেখানে তানবীর কিভাবে শুনবে?
শান্ত পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে উপায় খোঁজতে লাগল। মাথায় কিছু আসতেই সে দ্রুত রুমে এসে লোশনের বোতলটা হাতে নিলো। আবার দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে সেটা ছুঁড়ে মারল রাস্তায়। এমনভাবে মেরেছে যেন তানবীরের উপর না পরে। কিন্তু তারপরও এত দূর থেকে ব্যালেন্স রাখতে পারেনি। ঢিলটা এত জায়গা রেখে সোজা গিয়ে তানবীরের পিঠে পড়ল।
দূর থেকে আসায় গতি বেশি ছিল। এবং লোশন বোতলের একতৃতীয়াংশ থাকাতে সেটা বেশ জোরেই লাগল। তানবীর চোখ বাঁকিয়ে মুখ দিয়ে বিশ্রি শব্দ উচ্চারণ করল,

— ‘ কোন হালা*** রে? শালা…

তানবীর পিঠ ঢলতে ঢলতে পিছনে ফিরতেই দূরে দাঁড়ানো একটি মেয়ের হাত নাড়ানো দেখে থেমে গেল।
শান্ত কানে হাত দিয়ে সরি সরি বলছে।
তানবীর মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসল। এই মেয়ের অপর নাম সংঘর্ষ হলেও মন্দ হবে না। সবসময় যেন তানবীরের সাথে সংঘর্ষের বাহানায় থাকে।
কথা বলা যাচ্ছে না। তারপরও শান্ত হাত নাড়িয়ে ইশারায় বুঝাতে চাইল এখানে এখনও কেন? বাসায় যায়নি কেন?

তানবীর খুব সহজেই শান্তর ইশারা বুঝে গেল। কিন্তু তারপরও সে কোনোরূপ প্রতিউত্তর জানালো না। শান্তকে ধোয়াশায় রেখে সে সামনে পা বাড়াল।
শান্ত পুরোপুরি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কি হলো এটা?
অপরদিকে তানবীরের এবার অস্থিরতাটুকু কেটে গিয়েছে। তার মন বলছে শান্তকে একপলক দেখার জন্যই ছিল তার এই অস্থিরতা। এতক্ষণের এই পাগলামো। কিন্তু মস্তিষ্ক সেটা মানতে নারাজ।
সে নিজের মনকে কয়েকটা বিশ্রিজনক গালি দিলো। তারপরও নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাল।

— ‘ মাইয়া মানুষ মানেই ভেজাল। হেইগুলো নিজেরা যেমন ভেজাল, তেমনি আমাগো মতো ভালা পুলাগোর কাছে আইসা হেইগুলোর ভেজালের বিজ বপন কইয়া যায়। শালার ভেজালময় লাইফ। ‘

তানবীর নিজের মনে মেয়েদের খারাপ গুণকীর্তন করে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। মেয়েদের এত বকাঝকা করে মন হালকা করলেও সে যে মেয়েদের ব্যবহার্য জিনিস-ই নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে সেটা সে মানতে নারাজ। লোশনের বোতলটা হাতে নিয়ে সে একপলক দেখল।

— ‘ ভেসলিন বডি লোশন। ভালোই, দামি কোম্পানি। তাই সাথে নিয়া নিলাম। অযথা টাকা নষ্ট কইয়া লাভ কি? বাসার কাজের বুয়ারে দিলে বরং খুশি হইব।
আমি দয়ালু, মহৎ দয়ালু। তাই জন্য এটা আমার হাতে। অন্য কোনোরকম কারণ দাঁড় করাতে আসবি না। শুনছিস কি বললাম?
হারামি মনের বাচ্চা মন, তোকেই বলছি৷ কান খোলে শুনে রাখ। আমি এমনটাই ভেবে এটা নিয়েছি। আর কিছু বলতে আসলে চিবিয়ে তোকে খেয়ে ফেলব। ‘

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here