গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২২
কলিংবেল বাজিয়ে সাদিদ মাথা খানিকটা নিচু করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠোঁটের কোণে তার মিষ্টি হাসি ঝুলছে। নিজেদের মধ্যকার দূরত্বটা বুকের বামপাশে সুচের মতো ফুটলেও, কিছুক্ষণ আগের তাদের দু’জনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো সেগুলোতে ভারি পড়ছে। তারউপর সাদিদের দীর্ঘ প্রত্যশিত সেই মধুর শব্দ। ইশশ এখনও কানে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সাদিদ এসব মনে করেই নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছে।
দরজা খোলার আওয়াজে সে এবার মাথা তোলে তাকালো। পরমুহূর্তেই তার মুখের মিষ্টি হাসিটা বিলীন হতে লাগল। হয়তো বা তার হাসি আরেকজনের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে। কেননা তানহা দরজার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একেবারে সম্ভব হলে বত্রিশটা দাঁত দেখিয়ে দিত।
— ‘ সাদি, তোর এতক্ষণে আসার সময় হলো? আমার সেই কখন থেকে বসে থাকতে থাকতে অবস্থা খারাপ। আবার চোখটাও এতক্ষণে লেগে গিয়েছিল। ‘
— ‘ তোকে বসে থাকতে কে বলেছে? অন্ততপক্ষে আমিতো বলিনি। ‘
— ‘ সেটাই তো সমস্যা, তুই কিছুই বলিস না। তােকে এতবার ফোন করে দিয়েছি, একটাবারও রিসিভ করিসনি। কলব্রেক তো দূরের কথা। তুই যে আজকে আসবি মামি না বললে তো আমি জানতেই পাড়তাম না। ‘
সাদিদের ভালো মনটা এখন বিরক্তিতে প্রায় বিষিয়ে যাচ্ছে। সে তানহার কথার আর কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে চাইল। কিন্তু তানহা সেটাও হতে দিলো না। সে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে সাদিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সাদিদ সাথে সাথেই তাকে ঝটকা মেরে নিজের থেকে দূরে সরাল। চোখজোড়া তার মুহূর্তেই লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সে প্রচন্ড রাগীস্বরে বলে উঠল,
— ‘ থাপ্পড় মেরে তোর সব-কয়টা দাঁত ফেলে দিব বেয়াদব মেয়ে। তোকে বলেছি না? আমার সাথে এমনভাবে শরীর ঘেঁষাঘেঁষি করবি না। তারপরও নির্লজ্জের মতো এমন করিস কেন? ‘
— ‘ ভালোবাসিতো। আর ভালোবাসলে নির্লজ্জ হওয়া যায়। ‘
সাদিদের রাগ এবার সপ্তম আসমানে। সে রীতিমতো এই পাগল মেয়েকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছে। তারপরও এই ঘিলুহীন মেয়ের মাথায় এই সোজা কথাটা ঢুকে না। সাদিদ আঙ্গুল তোলে তাকে রাগীস্বরে শাসাল,
— ‘ লাস্টবার বলছি এইসব ফালতু কথা নিয়ে আমার সামনে আসবি না। তুই আমার বোন। এরথেকে বেশি একবিন্দুও কিছু না। তাই নিজের সীমার মধ্যে থাকবি। ‘
— ‘ বোন? আমি তোর কোন মায়ের পেটের বোন? তোর ফুফুর মেয়ে। তাই এখানে সমস্যা কি? আমিতো এখানে খারাপ কিছু দেখছি না। ‘
— ‘ তুই দেখবিও না৷ কেননা তুই পুরোপুরি অন্ধ এবং বয়রা হয়ে গিয়েছিস। নতুবা এককথা এতবার বলতে হয় না। ‘
— ‘ প্লিজ সাদি যা ইচ্ছে বল। তারপরও একটু ভালোবাস। আমি তোর ভালোবাসার কাঙ্গাল। এবার একটু কাছে টান। দেখ আমি মরে যাচ্ছি। তোকে ছাড়া আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ‘
তানহার জলে টইটম্বুর চোখ দেখে সাদিদের রাগটা এবার উড়ে গেল। সে তো কখনও এমনটা চায়নি। ছোট থেকেই তারা দুইজনে একসাথে বড় হয়েছে। তাদের একসাথে কত দুষ্টুমি-মজার স্মৃতি রয়েছে। ভাইবোন সম্পর্ক ব্যতিতও তারা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু ছিল। সমবয়সী হওয়াতে একে অপরের সাথে সবকিছু শেয়ারও করত। দিনগুলো তাদের ভালোই যাচ্ছিল, যতদিন না প্রিয়তী এমন অদ্ভুত ব্যবহার সাদিদের সাথে করতে শুরু করেছিল। প্রথম প্রথম সাদিদের একটু অস্বস্তি লাগলেও ভেবেছিল হয়তো বয়সের প্রভাব। কিন্তু বারবার সাদিদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা, তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা আর একদিন মুখ ফোটে বলার পরতো সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সাদিদ তাকে কোনো আশায় রাখেনি। সাথে সাথেই নিজের উত্তর তাকে জানিয়ে দিয়েছে। তানহা বারবার বলে গিয়েছে একটু সময় নিতে। কিন্তু সাদিদ সেটা শুনেনি। একজন বোন এবং বন্ধু ব্যতিত আর কোনোরকম অনুভূতি তানহার জন্য তার নেই। কিন্তু তারপরও তানহা তার পিছনে পড়ে রয়েছে। সাদিদ এত বলেও মেয়েটাকে নিজের পিছু ছাড়াতে পারেনি। পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত বলে মুখ বুজে তার এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে।
সাদিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানহার দিকে এগিয়ে গেল। তার মাথায় হাত রেখে আদূরে গলায় বলল,
— ‘ এমন করিস কেন? নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস আর আমাকেও দিচ্ছিস। ভালোবাসা জোর করে হয় না রে। এটা অনুভূতির বিষয়। আর তোর প্রতি আমার সেইরকম কোনো অনুভূতি কখনও কাজ করেনি আর না করবে। প্লিজ এবার এই পাগলামিটা বন্ধ কর। ‘
সাদিদের নরম কন্ঠস্বরে তানহা বুঝার পরিবর্তে উল্টো আরও বিগড়ে গেল। সে সাদিদের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কান্না করতে লাগল। সাদিদের পিঠ আঁকড়ে ধরে ভাঙা গলায় বলল,
— ‘ প্লিজ আমাকেও একটু দয়া কর। তোকে ছাড়া শ্বাস নিতে কষ্ট হয় সাদি। মরে যাব তোকে ছাড়া। একটু ভালোবাস আমাকে, একটুখানি। ‘
সাদিদের এখন নিজেকে জ্ঞানহীন মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে কি করা উচিত তার মাথায় আসছে না। সে প্রথমে নিজেকে তানহার থেকে সরিয়ে কয়েককদম পিছিয়ে আসলো।
তানহার মুখে সাথে সাথেই আহতরূপ ফোটে উঠল। সাদিদ বারকয়েক অস্থিরতা মিশ্রিত লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
— ‘ নিজেকে সামলা তানহা। আমি তোকে ভালোবাসতে পারব না। ‘
— ‘ কেন? কি সমস্যা তোর? আমার মধ্যে কিসের কমতি, যে আমাকে ভালোবাসতে তোর এতটা ভাবতে হচ্ছে? ‘
— ‘ সবসময় আজেবাজে কথা টানবি না। বললাম তো আমি তোকে ভালোবাসতে পারব না। মানে পারব না। ‘
তানহা আবারও সাদিদের কাছে এগিয়ে আসলো। সাদিদের দুইগালে নিজের হাত দিয়ে আবেগময় কন্ঠে বলল,
— ‘ কি সমস্যা বল না? আমি তোর পছন্দের মতো হবার চেষ্টা করব। নিজেকে কোনো দিক থেকে তোর জন্য কমতি রাখব না। ‘
সাদিদের এবার রাগে মাথা ফেটে যাবার অবস্থা। এই মেয়েটাকে বুঝিয়ে বললেও কোনো লাভ হয় না। সে ঐ একজায়গায় আটকে পড়ে রয়েছে। সাদিদ এতদিন যেই কথাটা বলতে চায়নি এখন বোধহয় সেটা বলতেই হবে। সে তানহার হাত সরিয়ে দিলো। খুব স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল,
— ‘ আবারও বলছি সেটার প্রয়োজন নেই। কেননা তোকে আমি কখনও ভালোবাসতে পারব না। কেননা, আমার জীবনে সে রয়েছে। যাকে আমি ভালোবাসি। এতটা গভীরভাবে যে তোকে বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার ভালোবাসার অনুভূতি কেবলমাত্র তার জন্যই বরাদ্দ থাকবে। ‘
এতটুকু বলে সাদিদ থামল। প্রিয়তীর গালে একহাত রেখে আদুরে গলায় বলল,
— ‘ এবার তো বুঝতে পাড়ছিস। তাই আর পাগলামি করিস না। আমি তোকে কখনও ভালোবাসতে পারব না। সেটা আমার হাতে নেই। ‘
বলেই সাদিদ মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এতক্ষণের ভালো মনটা এখন খারাপের চূড়ান্ত পযার্য়ে। সাদিদ মাথার চুল টানতে টানতে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। মাথাটা এরিমধ্য ধরে গিয়েছে।
অপরদিকে সাদিদের কথাটা কর্ণকোহরে পৌঁছাতেই তানহা স্থির হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে তাী লাল হয়ে যাওয়া চোখগুলো থেকে টুপটুপ করে জল গড়িয়ে গালগুলো ভিজে যেতে লাগল। সে অশ্রুকণাগুলো মুছল না। তাদের স্বাধীনতা দিয়ে এলেমেলো পায়ে সামনে হাঁটা ধরল। পা-গুলো যেন তার অসার হয়ে পড়েছে। জীবিত থেকেও সে যেন নিজেকে মৃত্যু ব্যক্তির ন্যায় অনুভব করছে। সে যেন প্রাণহীন এক জড়বস্তু।
________________________
নার্গিস খাতুনের অনবরত দরজায় করাঘাত করাতে নীলা পিটপিট করে চোখ খোলল। লম্বা জার্নির পর ঘুমটা বেশ ভালো চেপেছিল। সে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
— ‘ আম্মু উঠেছি তো। এবার আওয়াজটা বন্ধ করো। ‘
— ‘ আমি কি স্বাদে আওয়াজ করি? কয়টা ভাজে দেখেছিস? জলদি উঠে নাস্তা কর। ‘
নার্গিস খাতুন নিজের মনে আরও কিছু বকাঝকা করে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। নীলা বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলল। মা তো আর জানে না, নীলা কোথায় থেকে এসেছে। নতুবা সারাদিনও উঠার জন্য বলতো না।
নীলা ঘুম ঘুম চোখে ড্রয়ার হাতিয়ে ফোনটা নিলো। ফোনের স্ক্রিনে চোখ যেতেই সে বারকয়েক চোখের পাতা বুঁজে আবার খোলল। না সে ঠিকই দেখছে। সে শুকনো একটা ঢুক গিলল। সাদিদ এতবার কল দিয়েছে অথচ সে ঘুমে বিভোর ছিল। নীলা ভয় মিশ্রিত চোখে দ্রুত ভিডিও কল ব্রেক করল। কিছুসময়ের মধ্যেই সাদিদের ঘুমে এলেমেলো মুখটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল।
— ‘ সরি সরি, আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ‘
সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হাসল। উবু হয়ে শুয়ে ফোনটা বেডে হেলান দিয়ে রাখল। তারপর একদৃষ্টিতে অপরপাশের নীলার মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। নীলা ভেবেছিল এত কল এবং মেসেজের জন্য নির্ঘাত সে একটা লম্বা জারি খাবে। কিন্তু সাদিদকে এমন নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ভ্রুজোড়া নাচালো।
— ‘ কি হয়েছে? এমন করে কি দেখেন? ‘
— ‘ আমার বউকে। আমার প্রাণপাখিকে। কেন, তোমার কোনো সমস্যা? ‘
এবার নীলাও হাসল। ডান কাত হয়ে শুয়ে নিজেও সাদিদকে দেখতে লাগল। কিন্তু বেশিক্ষণ পাড়ল না। কেননা সাদিদের ঐ চোখে নীলা তাকিয়ে থাকতে পাড়তে না। লজ্জারা এসে আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরে।
— ‘ পাখি? ‘
— ‘ জ্বি? ‘
— ‘ মিস ইউ। ‘
নীলা মাথা নিচু করে আবারও লাজুক হাসল। তাকে এমন করে হাসতে দেখে দুষ্টু সাদিদের দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেল,
— ‘ বউ, এমন করে হাসলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে তো। ‘
লজ্জাজনক কথাটা কর্ণকোহরে যেতেই নীলার গালের বর্ণ যেন আরও লালাভ হলো। সে অন্যদিকে তাকিয়ে দ্রুতগতিতে শ্বাস টেনে বলল,
— ‘ ছিঃ যতসব বাজে কথা। ‘
— ‘ সত্যি বললেই বাজে! তাই না? এই, তাকাও আমার দিকে। ‘
— ‘ না। ‘
— ‘ আরে তাকাও না। ‘
— ‘ না। তাকালেই আপনি লজ্জা দেন৷ ‘
— ‘ আচ্ছা আর লজ্জা দিব না। এবার তাকাও। ‘
নীলা এবার বিশ্বাস করে তাকালো। কিন্তু বারবার তার চোখজোড়া নিচু হয়ে যাচ্ছে। সাদিদ সেটা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। দুষ্টু কন্ঠে বলল,
— ‘ এখনও এতো লজ্জা কেন? দার্জিলিং কি লজ্জা ভাঙতে কম পড়েছে? পড়লে বলো, সুইজারল্যান্ড ট্রুরের ব্যবস্থা করছি। ‘
নীলা সাদিদের ঠোঁট কামড়ে হাসা আর এমন কথায় লজ্জায় পুরোপুরি কুঁকড়ে গেল।
ছিঃ এই ছেলে কি পরিমাণ অসভ্য, নীলা হয়তো সেটা আন্দাজও করতে পারবে কি-না সন্দেহ। সে বিছানার চাদর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে চোখ বুজল। নিজেকে স্থির করতে মাথা নিচু করে ঘনঘন শ্বাস টানতে লাগল। এই ছেলেটা না জানি কোনো একদিন তার শ্বাস একেবারে আঁটকে দেয়। এমন করে কেউ বলে? এতটা ঠোঁটকাটা মানুষ হয় না-কি?
নীলা মিনমিনে স্বরে বলল,
— ‘ অসভ্য একটা। ‘
কিন্তু সাদিদের জিরাফের ন্যায় কান সেটা শুনে নিলো। তাই সাদিদ এবার আওয়াজ করে হাসল। নীলা লজ্জা ভুলে গিয়ে ফোনের স্ক্রিনে নিষ্পলক তাকালো।
সাদিদ খুব কমই শব্দ করে হাসে। কিন্তু যখন হাসে নীলার জন্য চোখ ফেরানো রীতিমতো দায় হয়ে পড়ে। যেমনটা এখনও হচ্ছে। তার ভাবতেই অবাক লাগে এই মিষ্টি ছেলেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত।
— ‘ কিন্তু এই অসভ্য ছেলেটার সাথেই সারাজীবন তোমাকে এক ছাদের নিচে থাকতে হবে। আর কোনো জায়গায় যাওয়ার অপশন নেই বেব। ‘
সাদিদের দুষ্টুমিস্বরে নীলার ভাবনায় টনক নড়ে। সে মাথা নিচু করে হাসল। সাদিদ বালিশের উপর দু-হাত দিয়ে একটু উঠে বসে বলল,
— ‘ নিজের বিয়ে করা বউকে আনতে যাব। ইশশ ব্যাপারটা কেমন ইউনিক না বউ? সবাই বলে বিয়ে করে বউ আনতে যাব৷ কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বলতে হবে বিবাহিত স্ত্রীকে আবারও বিয়ে করে আনতে যাব। ‘
সাদিদের কথা আর কথা বলার ভঙ্গি দেখে নীলা এবার ফিক করে হেসে দিলো। সাদিদ আচমকা ফোন উঠিয়ে নীলার ছবিতে চুমু খেয়ে নিলো। চুমু দিয়ে সেও ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে লাগল। তার এমন কুটিল হাসি দেখে নীলার দূর থেকেই শ্বাস আটকে যাবার অবস্থা। সাদিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হেসে বলল,
— ‘ পাখি, নিজের কাছে এনে তোমার অবস্থা একেবারে খারাপ করে দিব। এই যে নিজের আজাইরা চিন্তা-ভাবনার জন্য আমাকে এতটা কষ্ট ভোগ করাচ্ছ, এই সবগুলোর হিসাব তোমার থেকে পইপই করে তুলব। আমি যতটা পুড়ছি তোমাকেও ততটা পুড়াব। আমার ভালোবাসার আগুনে পুড়িয়ে তোমাকে কয়লা বানাব। একবিন্দুও ছাড় পাবে না সুন্দরী। তোমার লাল মুখখানা আরও রক্তিম আভাতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে শীঘ্রই সব ব্যবস্থা করছি। জাস্ট ওয়েট বেব, ইট’স টাইম টু পানিশ। সো গেট রেডি ফর ইট। দিস টাইম সাদিদ ওন্ট স্পেয়ার ইউ। ‘
নীলা ফোনটা দ্রুত কেটে দিলো। নতুবা এই ছেলের অসভ্যবাণে নীলা এখনই বোধহয় হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে।
অপরদিকে বুকে ফোন নিয়ে সাদিদ চোখ বন্ধ করেছে। মুখে তার হাসির রেখা। অনুপস্থিত থেকেও তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে অপরপাশে নীলার এখন কি অবস্থা হচ্ছে। সে নীলার লজ্জায় রাঙা মুখটা কল্পনা করে আবারও নিঃশব্দে হাসল।
________________
ডাইনিং টেবিলে নিধি সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করছে। ছোট্ট শাদের মন খারাপ। সে গাল ফুলিয়ে অনবরত পাউরুটি ছিড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে ছেলের মলিন মুখের সাথে রাগী চেহারা দেখে শাহেদ পাড়ছে না নিধিকে এখনই বড়সড় একটা শাস্তি দিয়ে দিতে। সে বারবার চোখ গরম করে ছেলের মায়ের দিকে তাকাচ্ছে, আর ছেলেকে কোলে নিয়ে নানা রকমভাবে আদর দিচ্ছে।
নিধির অবশ্য সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। এসব তার প্রতিদিনকার রুটিন।
হয়েছে বাপের এক আদরের ছেলে। দোষ করলেও তাকে কিছু বলা যাবে না। আর মার দেওয়া তো কল্পনায়। ছেলের আগে বাপের মুখ ফোলে যায়। যেমনটা এখনও চলছে। নিধি বাপ-ছেলের এসব কর্মকান্ড সম্পূর্ণ অদেখা করে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে।
শাদমান এবার পাউরুটি সব প্লেটে ফেলে বাবার দিকে মুখ করল। ছেলের রাগ মিশ্রিত চেহারায় জলে টইটম্বুর চোখ দেখে শাহেদ বেচারা পারলে নিজেও কেঁদে দিবে। রাগে শাহেদ আবারও নিধিকে ধমকে উঠল,
— ‘ নিধি, তোমার জন্য আবারও আমার ছেলের চোখে পানি এসেছে। ‘
— ‘ চোখে পানি আসা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। এটাতে এতো হট্টগোলের কি হয়েছে? ‘
— ‘ এটা স্বাভাবিক? আমার বাবার মন খারাপ হয়েছে। আর এটা তোমার কাছে স্বাভাবিক। ‘
— ‘ চুপ করেন তো। খালি বেশি বেশি। ছেলেটা আপনার জন্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ করলেও কিছু বলা যায় না। ‘
শাদমান মায়ের রাগ দেখে এবার চোখ টিপে টিপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। শাহেদ খাওয়া রেখে ছেলেকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। পিঠে-মাথায় অনবরত হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— ‘ আমার লক্ষ্মি বাবা, কান্না করে না। বাবা আজকে তোমাকে নিয়ে খুব ঘুরব। মা পঁচা। তাই মাকে নিব না। তারপর মা ঘরে বসে বসে আমাদের জন্য কান্না করবে। ‘
শাহেদ এটা সেটা বলে ছেলের মন ভালো করার সর্বোচ্চ চেষ্টায় আছে।
তারমধ্যেই সাদিদ কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে টেবিলে এসে বসল। বাপ-ছেলের দৈনন্দিন কর্মকান্ড দেখে সে নিঃশব্দে হাসল। নিধির দিকে একপলক তাকিয়ে শাদমানের উদ্দেশ্য বলে উঠল,
— ‘ কে বকেছে আমার চাচ্চুকে? শুধু নামটা বলো। তাকে জেলে পাঠানো হবে। ‘
— ‘ পা.পু মা বকেছে। ‘
শাদমানের আধোআধো বুলিতে নালিশ শুনে উপস্থিত সবাই হেসে ফেলল। নিধিও হাসল। কিন্তু বাপ-ছেলের অগোচরে।
— ‘ হুম। সেটা ছাড়া তোমার মা আর পারে টা-কি? সবসময় আমার ছেলেটাকে বকাঝকা করতেই থাকে। এক বোতল শ্যাম্পুর জন্য কেউ ছেলেকে বকে? ছেলের বাবার কি টাকার অভাব? যে এক বোতল শেষ করলে আর আনতে পারবে না? আমার কি এতটাই দুর্ভিক্ষ চলছে? ‘
শাদমান শুধু নাম বলেছিল। কিন্তু শাহেদকেও ছোট্ট শাদমানের সাথে তাল মিলিয়ে বিচারসভা বসাতে দেখে হাসির আওয়াজ এবার আরও দ্বিগুণ হলো। বাপ-ছেলে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। তাদের ভাবটা এমন যে, এই পাগলগুলো নিধিকে না বকে উল্টো হাসছে কেন?
— ‘ শেষ হয়েছে আপনাদের নালিশ? হলে এবার নাস্তাটা শেষ করুন। ‘
— ‘ হ্যাঁ দাদুভাই এবার খেয়ে ফেল। মাকে দাদাও বকে দিব৷ ‘
শাদমান দাদার আশা পেয়ে বাবার দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলল মিষ্টি হাসি। ছেলের মুখে এতক্ষণ পর হাসি দেখে শাহেদের মুখেও হাসি ফুটল। বাপ-ছেলের কান্ড দেখে নিঃশব্দে নিধিও হাসল।
শাহেদ আবারও চোখ গরম করে নিধিকে ইশারায় শাসাল। যার অর্থ পরে তোমাকে দেখে নিচ্ছি। নিধি সকলের অগোচরে তাকে ভেঙ্গচি কাটল।
হয়েছে একজোট। প্রতিটা দিন নিধিকে জ্বালিয়ে মারে। অথচ উপর থেকে তার নামে নালিশের সভা বসিয়ে গুমটি মেরে বসে।
সাদিদ কফি মগ হাতে নিয়ে এক চুমুক দিলো। হাসিবুর রহমান নাস্তা শেষ করে তাড়াহুড়ো করছে। এখনই তাকে অফিসে বের হতে হবে। তিনি শাহেদকেও তাড়া দিলো। শাহেদ এবার নিজেও খাচ্ছে, আর ছেলেকেও খাইয়ে দিচ্ছে।
সাদিদ সবাইকে হাসিখুশি দেখে সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইল। তার পক্ষে আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই সে হাসিবুর রহমানের উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ বাবা, একটা কথা ছিল। ‘
— ‘ হ্যাঁ বল। ‘
— ‘ ছেলের তো বিয়ের বয়স হয়েছে। সেই বিষয়ে খেয়াল আছে? ‘
ছেলেকে এমন নির্লজ্জ হতে দেখে শায়লা রহমান বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি হেসে উঠলেন। তার সাথে সাথে উপস্থিত সবাইও ঠোঁট টিপে হাসছে। তারা তো ভুলেই গিয়েছিল, সাদিদের বরাবরই লোক সম্মুখে লাজ-লজ্জা কম।
— ‘ ভুলব কেন? তোকে এই পর্যন্ত কম বলেছি নাকি? তুই ইতো রাজি হস না। আমি বলে বলে হয়রান। তোর তো বিয়ের কথা শুনলেই জ্বর উঠে যায়। ‘
— ‘ এখনতো রাজি আছি। এবার ব্যবস্থা করো। ‘
— ‘ সেটা তুই না বললেও করব। আজকেই তোর ঘটক চাচাকে বলে মেয়েদের লাইন লাগাচ্ছি। ‘
— ‘ মা, মেয়ে খোঁজে তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না। ‘
— ‘ মানে? ‘
শায়লা রহমানসহ সবাই চমকিত দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। মেয়ে ছাড়া বিয়ে কিভাবে হবে? অপরদিকে শাহেদ ঠোঁট টিপে হাসছে। বিষয়টা সম্পর্কে সে পুরোপুরি অবগত। এবার শুধু সকলের রিয়েকশন দেখার পালা।
সাদিদ সবার দিকে একপলক তাকালো। সবাইকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মাথা নিচু করে খানিক হেসে মাথা চুলকানো। তারপর বলে উঠল,
— ‘ মানে হচ্ছে তোমার ছেলের বউ খোঁজার পর্ব শেষ। এখন শুধু বরণ করে তোলার বাকি। ‘
এবার আর কারও বিষয়টা বুঝতে সমস্যা হলো না। শায়লা রহমানের মুখে তারপরও হাসি। নিজের ছেলেদের পছন্দ সম্পর্কে তার কোনো দ্বিধা নেই৷ তারা যে লাখে খোঁজে মেয়ে পছন্দ করবে এটা তাকে কেউ না বললেও সে বুঝতে সক্ষম। তাই তিনি হাসিমুখেই বলে উঠলেন,
— ‘ জলদি মেয়ের ছবি দেখা। ছেলের বউকে দেখার জন্য আমার আর তর সইছে না। ‘
— ‘ হ্যাঁ সাদিদ, আমিও দেখব। ইশশ এবার একজন সাথী আসবে। ‘
— ‘ বউমা, নতুনকে পাওয়ার আগেই পুরাতনকে ভুলে যাচ্ছ? ‘
নিধি হাসল। শায়লা রহমানকে পিছন থেকে হালকা হাতে জড়িয়ে বলল,
— ‘ না মা। এমনটা কখনও সম্ভব? আমরা তো বান্ধবী। ‘
এবার শায়লা রহমানও হাসলেন। নিধি না বললেও সে জানে বউ রূপে সে একটা মেয়ে পেয়েছে। আজকালের ছেলের বউদের মতো নিধি একদমই নয়। তাদেরকে সবসময় নিজের পরিবারের মতোই সামলে রাখার চেষ্টা করে। সবার ছোট থেকে ছোট্ট প্রয়োজনও সে খেয়াল রাখতে ভুলে না।
শাশুড়ী-বউয়ের অবস্থা দেখে সাদিদও হাসল। তারপর কফিতে আরেক চুমুক দিয়ে বলল,
— ‘ তোমরা সবাই তাকে দেখেছ। ইনফ্যাক্ট খুব কাছে থেকে। ‘
— ‘ তাই নাকি? শুনি কে সে, আমিও দেখি আমার অল ইন ওয়ান দেবরের মনটা কে চুরি করেছে। ‘
— ‘ তোমার বোন-ই তো। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ তোমার গুণধর বোনটাই তো মনটা চুরি করে নিয়েছে। শাস্তি দেওয়া উচিত। তাই তো বিয়েটা করে শাস্তিটা দিয়ে দিব। ‘
— ‘ কি বলিস সাদি? ‘
— ‘ মা, বাড়ির ছোট বউ হিসেবে নীলাঞ্জনাকে তোমার কোনোদিক দিয়ে অপছন্দ? কেননা তোমার ছেলে বউ হিসেবে তাকে-ই চায়। ‘
— ‘ বিয়ে আর পিচ্চু? ‘
নিধির মৃদু কন্ঠের চিৎকারে সাদিদসহ উপস্থিত সবাই তার দিকে তাকালো। নিধির চোখ প্রায় অক্ষিকোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সাদিদ এসব কি বলছে? বিয়ে-শাস্তি! তার তো রীতিমতো মাথা ঘুরাচ্ছে।
#চলবে…
[ পাঠকগণ আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো জানতে আগ্রহী। ]