গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৩ 💙🍫💖
নীলা কিচেনে হাত পুড়িয়ে রান্না শিখছে। নার্গিস খাতুন বিস্ময়ে প্রায় হতবাক। এতদিন যেই মেয়েকে টেনে রান্নার ধারেকাছেও আনা যেত না, সে আজ স্বইচ্ছায় রান্নাঘরের দরজায় হাজির হয়েছে। নার্গিস খাতুনের জন্য এটা এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার-স্যাপার। তারপরও তিনি নিজের চমকিত ভাবটা মেয়ের সামনে প্রকাশ করছেন না। মেয়ের সামনে তার এমন একটা ভাব, যেন ইহা অতি সাধারণ একটা কাজ। মেয়েকে আরও আগেই এখানে হাজির হওয়া প্রয়োজন ছিল।
অপরদিকে জীবনে প্রথমবার যেহেতু নীলা এখন প্রায় ঘেমে নেয়ে অস্থির। এই বিকেলবেলাতেও সে কাঠখোট্টা দুপুরের গরমের ন্যায় ঘেমে একাকার। নার্গিস খাতুনের মায়া হচ্ছে প্রচুর। তাই আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,
— ‘ বাকিটুকু আমি করে নিব। তুই গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে। ‘
— ‘ না আম্মু। কিছুই তো করলাম না। সবটা এখনও বাকি। প্রথমবার তো, তাই একটু ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। ‘
বলে নীলা নিজেই মৃদু হাসল। কপালের ঘামটা কিচেন ক্লথ দিয়ে মুছে নিয়ে সে আবারও সব উপকরণগুলো একবার দেখে নিচ্ছে। বারবার খেয়াল করছে কোনো কিছু বাদ পড়েছে কি-না?
সব উপকরণগুলো ঠিকঠাক দেখে নীলা হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে নিজের মনেই হাসছে। সে মিষ্টি খুব একটা পছন্দ করে না। শুধু ছানার কালোজাম বা গোলাপজামুন বাদে। এটা তার পছন্দের তালিকায়। কিন্তু নিজের জন্য এটা সে হাতে তৈরি করার কথা, কখনও চিন্তা করতে পারে না। কিন্তু আজ সে তৈরি করছে। কেবলমাত্র সাদিদের জন্য।
নীলা দার্জিলিং ট্রুর থেকে বুঝে গিয়েছে যে বর তার বড্ড ভোজনরসিক। তাই নীলা আজ সাদিদের জন্যই গোলাপজামুন তৈরি করছে। সাদিদও ডেজার্ট আইটেমের মধ্যে গোলাপজামুনটা খুব পছন্দ করে। নীলা দেখেছে কেমন তৃপ্তি নিয়ে সাদিদ এই মিষ্টান্নটা খায়। তাই সে এইটাই তৈরি করার কথা ভেবেছে।
আর মিষ্টি আইটেম করার আরেকটা উদ্দেশ্য হচ্ছে ডেজার্ট ফ্রিজে রেখে দেওয়া যায়। যেহেতু সাদিদকে আজ এটা খাওয়ানো সম্ভব হবে না, সেহেতু নীলা বানানোর জন্য ডেজার্টটাই চুজ করেছে। সাথে অবশ্য আরেকটা ডেজার্টও রয়েছে। নাটি ফ্রুটি চকলেট। নিজের বোনপোর জন্য।
নীলা জীবনে প্রথম কিছু তৈরি করছে। তাই এইদুইটো স্পেশাল মানুষকে খুশি করতে পাড়লে নীলার আর কি চাওয়ার থাকবে?
— ‘ কি রে, এমন হাসছিস কেন? ‘
— ‘ কি আম্মু? ও আসলে দেখছিলাম সব ঠিক আছে কি-না। ‘
নার্গিস খাতুনের আওয়াজে নীলা ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে। সে এবার দ্রুত হাত চালাতে লাগল। মোবাইলের ভিডিও রেসিপিটা অন করে সে স্টুভ জ্বালালো।
সে প্রথমেই করবে গোলাপজামুন। তাই সে সর্ব প্রথমে মিষ্টির জন্য সব উপকরনগুলো একটা মিক্সিং বোলে নিলো। তাতে রয়েছে ছানা ১ কাপ, ঘি ২ টেবিল চাম, গুঁড়াদুধ ১/২ কাপ, ময়দা ৩ টেবিল চামচ, চিনি ১ টেবিল চামচ, বেকিং পাউডার ১ চিমটি এবং ফুড কালার সামান্য পরিমাণে নিলো।
পাশাপাশি সিরার জন্য চিনি ২ কাপ, পানি ৪ কাপ, দারচিনি ১ টুকরা এবং বড় এলাচ ১ টি নিলো। যতক্ষণে মিষ্টি তৈরি হবে ততক্ষণে সিরাও প্রস্তুত হয়ে যাবে। তাই প্রথমেই পাত্রে সিরার সব উপকরন নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলো।
এদিকে ছানার সাথে গুঁড়াদুধ, ময়দা, চিনি, বেকিং পাউডার, ঘি, এবং ফুড কালার মিশিয়ে সব একসাথে ভালো করে মেখে নিলো। এরপর মিশ্রণটি কয়েকভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগ লম্বা মিষ্টির আকারে গড়ে নিলো।
এখন চুলায় মিডিয়াম লো আঁচে পরিমানমত তেল মিষ্টি ভাজার জন্য গরমে দিলো। তেল মাঝারী থেকে একটু কম গরম হলে সে মিষ্টিগুলো আস্তে করে গরম তেলে ছেড়ে দিলো। মিষ্টিগুলো অল্প আঁচে অনেক সময় নিয়ে ভাজতে থাকল। মিষ্টিগুলোর রং গাড় বাদামি হলে সে তেল থেকে তুলে সেগুলো আলাদা প্লেটে রাখল।
মিষ্টি ভেজে সাথে সাথে গরম সিরায় দেওয়া ঠিক না। তাই নীলা মিষ্টিগুলো রুম টেম্পারেচারে রেখে কিছুটা ঠাণ্ডা করল। তারপর এই ভেজে রাখা মিষ্টিগুলো সব একসাথে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ফুটন্ত গরম সিরার মধ্যে দিয়ে চুলায় ৪-৫ মিনিট বেশি আঁচে জ্বাল দিতে থাকল। এরপর চুলার আঁচ লো করে আরো ১০ মিনিট জ্বাল দিয়ে চুলা বন্ধ করে মিষ্টিগুলো ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত ঢেকে রেখে দিলো।
মিষ্টি ঠাণ্ডা হতে কিছুটা সময় লাগবে। ততক্ষণে নীলা নাটি ফ্রুটি চকলেট প্রিপারেশনে এগিয়ে গেল।
নীলা চকলেট তৈরির সব উপকরনগুলো সামনে এনে রাখল। তাতে রয়েছে সেমি সুইট চকোলেট চিপস ১ কাপ (২৩৬ গ্রাম), কাঠ বাদাম ৩ টেবিল চামচ, কাজু বাদাম ৩ টেবিল চামচ, কিশমিশ ৩ টেবিল চামচ এবং কনডেন্সড মিল্ক ১ টেবিল চামচ।
নীলা প্রথমেই বাদাম এবং কিশমিশগুলো কুঁচি করে কেটে রেখেছিল। তাই এবার সবগুলো একসাথে মিশিয়ে নিলো।
তারপর মিক্সিং বোলে চকলেট নিয়ে, মাইক্রোওয়েভে ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড দিয়ে সেটা গলিয়ে নিলো। এই পুরো সময়টাতে প্রতি ৩০ সেকেন্ড পরপর চকলেটটা চেক করতে থাকল। কেননা চকলেট পুড়ে যাবার চান্স রয়েছে। চকলেট পুরোপুরি গলে গেলে সেটা মাইক্রোওয়েভ থেকে বের করে নিলো।
নীলা চকলেটের জন্য আলাদা পাউডার সুগার ব্যবহার করেনি। তাই চকলেট গলানোর পর সে সামান্য কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে সেটা ভালোভাবে মিশিয়ে নিলো।
তারপর সিলিকন মোল্ডে চামচের সাহায্যে গলানো চকলেট অল্প করে নিয়ে এর উপর বাদাম এবং কিশমিশ দিয়ে দিলো। তারপর এর উপর আবারও চকলেট দিয়ে বাদাম-কিশমিশ ঢেকে দিলো। অর্থাৎ ডাবল পার্টের চকলেট হবে। এবার নীলা চকলেটগুলো সেট হবার জন্য ফ্রিজে সেগুলো ১ ঘণ্টার মত রেখে দিলো।
এখন ১ ঘণ্টা পর চকলেটগুলো মোল্ড আউট করে নিতে হবে। তাহলেই রেডি নাটি ফ্রুটি চকলেট।
অপরদিকে এতক্ষণে মিষ্টি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তাই নীলা সিরা থেকে সেগুলো ছেঁকে তুলে নিলো। তারপর ডেকোরেশনের জন্য মাওয়ায় গড়িয়ে নিয়ে পরিবেশন করল। অবশেষে তৈরি সাদিদের জন্য নীলার হাতের গোলাপজামুন।
নীলা মিষ্টি হাসল। নিজেকে কেমন তার গিন্নি গিন্নি মনে হচ্ছে। যে নিজের স্বামীর জন্য যত্ন সহকারে রান্না করেছে। নীলা টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে তৈরি করা জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পাশে নার্গিস খাতুনও নিঃশব্দে সবটা দেখছেন। প্রথমে নীলাকে একটু নার্ভাস দেখা গেলেও জিনিসগুলো সে তৈরি করেছে খুব যত্নে এবং সুন্দরভাবে। তিনি এগিয়ে গিয়ে মেয়ের গালে হাত রেখে কপালে চুমু দিলেন। নীলার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফোটে উঠল। তিনি গালে হাত রেখেই আদুরে গলায় বললেন,
— ‘ আমার পিচ্চি মেয়েটা দেখি বড় হয়ে গিয়েছে। কত সুন্দরভাবে এগুলো করে ফেলল। ‘
— ‘ শুধু দেখতে ভালো হলে হবে আম্মু? টেস্টেও তো ভালো হতে হবে। ‘
— ‘ তুই যে যত্নে এগুলো তৈরি করেছিস, আমি নিশ্চিত খেতেও দারুণ হবে। ‘
নীলা আবারও হাসল। কিন্তু নার্গিস খাতুন এবার তাকে তাড়া দিলেন,
— ‘ এখন যা তো। পুরো ঘেমে গিয়েছিস। গিয়ে আগে ফ্রেস হয়ে নিবি, তারপর একটু রেস্ট নে। আমি তোর জন্য ততক্ষণে কফি করছি। ‘
নীলাও আর কথা বাড়ালো না। কিচেন এপ্রোনটা খোলে সে রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরল। কিন্তু বসার ঘর পেরুতে গেলেই কলিংবেলের আওয়াজটা কানে আসলো৷
নীলা একবার নিজের দিকে তাকালো। অবস্থা বড্ড সোচনীয়। কিন্তু এই মুহূর্তে আবার কে আসবে? আরিফ মাহমুদ বাসাতে নেই। তাই নীলা ভাবল উনি হয়তো এসেছেন। তাই সে নিজের এলেমেলো অবস্থা নিয়েই দরজা খোলতে এগিয়ে গেল।
কিন্তু দরজা খোলেই তার চক্ষু চরাকগাছ!
কেননা পুরো পদ্মলয়ার সদস্যরা নীলার সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাদমান নীলাকে দেখেই শাহেদের কোল থেকে চেঁচিয়ে উঠল,
— ‘ খালামণি যাব, খালামণি যাব। ‘
শাদমানের আওয়াজে নীলা নিজের দিকে তাকিয়ে খানিকটা বিড়ম্বনায় পড়ল। এতক্ষণ কিচেনে থেকে তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাই সে তাকে কোলে না নিয়ে সবাইকে ভিতরে আসতে বলল। শায়লা রহমান নীলার ইতস্ততবোধ দেখে তার ডানগালে হাত রেখে বলল,
— ‘ মামনি, তুইতো পুরো ঘেমে গিয়েছিস দেখি। কাজ করছিলি বুঝি? ‘
নীলা কপালের ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো হালকা হাতে সরাতে সরাতে আড়চোখে একবার সাদিদের দিকে তাকালো। তার সাদিদের সামনে বলতে খুব লজ্জা লাগছে৷ নীলা মাথা নিচু করে বলল,
— ‘ আসলে একটু কিচেনে ছিলাম। ‘
শায়লা রহমান নিঃশব্দে হাসল। তাদের সাড়াশব্দ পেয়ে নার্গিস খাতুনও ইতিমধ্যে কিচেন থেকে বেড়িয়ে এলো। সবাইকে একসাথে দেখে তিনি ভীষণ আনন্দিত। নাতিকে কোলে নিয়ে সবাইকে বসতে বলে তিনি আপ্যয়নে লেগে গেলেন৷ নিধিও তার পিছু পিছু গেল৷ যাওয়ার আগে অবশ্য জলদি নীলাকে ফ্রেস হতে বলে গেল।
নীলা একপলক সাদিদের দিকে তাকালো। সে এখনও নীলাতেই মত্ত। সবার সামনে এমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বলে নীলার বড্ড লজ্জা লাগল। ইশশ সবাই দেখলে কি ভাববে?
নীলা মাথা নিচু করে রুমের দিকে চলে গেল। অপরদিকে নীলাকে পিছন থেকে যতক্ষণ দেখা গিয়েছে সাদিদ তার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। নীলা চোখের আড়াল হতেই সাদিদের হুঁশ ফিরল। সে পাশে তাকালো। তার বাবা-ভাই আপাতত তার দিকেই তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। তারা যে এতক্ষণ বিষয়টা খেয়াল করেছে সাদিদ খুব সহজেই সেটা বুঝে গেল।
সে মাথা চুলকিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগল। তার চোখে এখনও নীলার ঘর্মাক্ত মুখটা ভাসছে। ইশশ কি মুগ্ধতা!
মেয়েরা যদি বুঝতে পারত তাদেরকে উইথআউট মেকাপেই বেশি সুন্দর লাগে, তাহলে হয়তো এত কষ্ট আর মেকাপ করতে চাইত না৷ এই যে কিছুক্ষণ আগের নীলাকে দেখে সাদিদের চোখজোড়া প্রায় থমকে গিয়েছিল। সাথে থমকে গিয়েছিল সাদিদের চারপাশের সবকিছু। সে কেবল পলকহীনভাবে নীলাকেই পরখ করেছে। এলেমেলো চুল, সাদা মুক্তের দানার ন্যায় ঘর্মাক্ত মুখের সৌন্দর্য। কিচেনের গরমে লালাভ বর্ণের মুখ। ইশশ বউটা তার প্রাণঘাতী।
সাদিদ মাথা খানিকটা এদিক-ওদিক ঝাঁকালো। এই নীলাঞ্জনা নামক মেয়েটা তাকে পুরো পাগল বানিয়ে ছেড়েছে৷
এখন নীলা বিহীন সাদিদের কাছে সবকিছুই শূন্য শূন্য লাগে। সব থেকেও যেন নীলা ব্যতিত সাদিদ অচল। পুরোপুরি অচল।
____________________
নীলা একেবারে শাওয়ার নিয়ে ওয়াসরুমে থেকে বেড়িয়েছে। ক্লোজেট খোলে সে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। লিভিংরুমে সাদিদ রয়েছে। নীলার স্ত্রীর মনটা নিজেকে স্বামীর সামনে না চাইতেও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করানোর চিন্তা আঁকছে। সে লাজুক হেসে সাদিদের পছন্দের রঙের একটা চুড়িদার হাতে নিলো। ড্রেসটা পরে সে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল।
নীল রঙের হাঁটুর নিচ অব্দি জামা। সাথে সাদা আর নীল রঙের মিশ্রণ কালারের সেলোয়ার-ওড়না। ভিজা চুলগুলো নীলা খোলা-ই রেখে দিলো। চুল ছাড়া বিধায় নীলা মাথায় ওড়নাটা টেনে দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। লিভিংরুমের কাছে আসতেই জমজমাট অবস্থা লক্ষ্য করা গেল। আরিফ মাহমুদও ইতিমধ্যে চলে এসেছেন। তাই সবাই মিলে কফি খাচ্ছে। নার্গিস খাতুন ইতিমধ্যে কফির সাথে পাকোড়া পর্যন্ত তৈরি করে নিয়েছে। সবাই গরম-গরম পাকোড়া খাচ্ছে আর খোশমেজাজে গল্প করছে।
নীলাকে আসতে দেখে পদ্মালয়া ম্যানশনের সবাই তার দিকে তাকালো। আজ এমন করে সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীলা ইতস্ততবোধ করতে লাগল। শায়লা রহমান উঠে গিয়ে নীলাকে তার পাশে এনে বসালেন। মিষ্টি হেসে হাসিবুর রহমানের উদ্দেশ্য বললেন,
— ‘ তুমি কিছু বলবে? আমার যে আর তর সইছে না। ‘
সাদিদ মায়ের অস্থিরতা দেখে নিঃশব্দে হাসল। হাসিবুর রহমানও হাসছেন। অপরদিকে নীলাসহ তার মা-বাবা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। নার্গিস খাতুন নিধির দিকে তাকালেন। নিধির মুখেও হাসি লেগে আছে৷ সে ইশারায় জানতে চাইলে নিধি কিছু বলল না৷ শুধুমাত্র হাসির রেখা দ্বিগুণ করল।
হাসিবুর রহমান ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়েই বলে উঠলেন,
— ‘ ভাই, আজ কিন্তু আমরা শুধু গল্প করতে এখানে আসিনি৷ আপনাদের থেকে আবারও কিছু চাইতে আসলাম৷ ‘
— ‘ আরে, আরে কি বলেন বিয়াইসাব! বলেন না কি প্রয়োজন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব৷ ‘
— ‘ কি বলুনতো বিয়াই, আমাদের না আপনার একটা মেয়ে দিয়ে হচ্ছে না। ঘরটা পরিপূর্ণ করতে আরেকটা সোনার টুকরো মেয়ে প্রয়োজন। ‘
— ‘ বাবা এইরকমটা আপনি বলতে পাড়লেন? এখন আমার সব মূল্য শেষ? নতুনকে আনার জন্য পুরাতন বাদ? ‘
— ‘ আরে আরে কি বলিস মা? তুইতো আমার বড় মেয়ে। তোকে নিয়ে এমনটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারব না। ‘
নিধি মাথা নিচু করে হাসল। পরমুহূর্তেই হাসি মুখে বলল,
— ‘ আমি মজা করছিলাম বাবা। এতদিনে আপনাদেরকে পুরোপুরি চিন্তে আমার একটুও সমস্যা হয়নি। আমি শুধু একটু দুষ্টুমি করছিলাম। ‘
— ‘ পাজি মেয়ে একটা। তুই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। ‘
বলেই উনি হাসলেন। তৃপ্তিজনক হাসি। অপরপক্ষে আরিফ রহমানসহ মা-মেয়ের সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এসব কি হচ্ছে এখানে?
তাদেরকে এই পরিস্থিতি থেকে বাহির করতে হাসিবুর রহমান নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— ‘ আপনার এই মেয়েটাকেও আমার চাই বিয়াইসাব। আমার সাদির জন্য নীলা মামনির হাত চাইতে এসেছি। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না। ‘
নীলার কর্ণকোহরে কথাটা পৌঁছাতেই সে সর্বপ্রথম সামনের সোফায় বসা সাদিদের দিকে তাকালো। এত বড় সারপ্রাইজ!
নীলাকে এই সম্পর্কে ছেলেটা কিছু বলেনি। নীলার এখন রাগ করা উচিত। সে করতেও চাইল।
কিন্তু পরমুহূর্তেই সাদিদের ঐরকম নিষ্পলক চাহনি আর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসতে দেখে লজ্জারা এসে তাকে চেপে ধরল। নীলা দ্রুত মাথা নিচু করল।
আরিফ মাহমুদ-নার্গিস খাতুন পুরোপুরি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তারা শুধু একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সাদিদের মতো ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। ছেলে হিসেবে সে লাখে একজন। কিন্তু এতবড় সিদ্ধান্ত তারা মেয়ের মতামত ব্যতিত কিভাবে নিবেন?
অপরদিকে তাদেরকেও মুখের উপর না করা যাচ্ছে না। তাদের এইরকম সংকোচ দেখে সাদিদের পরিবারের সবাই বিষয়টা বুঝতে পাড়ল। তারা রাগ করল না। বরং শায়লা রহমান হাসিমুখেই বলল,
— ‘ ভাই আপনাদের এমন দেখাচ্ছে কেন? আমার সাদি কি ছেলে হিসেবে খারাপ? ‘
— ‘ আরে বিয়াইন, এমনটা বলবেন না। সাদিদ বাবাকে আমাদের থেকে ভালো আর কে জানে? ছোট মেয়েকে ওর হাতে তোলে দিতে পাড়লে আমি নিশ্চিতে থাকতে পারব। মাশাল্লাহ আপনার শাহেদ-সাদিদের প্রশংসা করে আমি শেষ করতে পারব না। ‘
— ‘ তাহলে আপনাদের এত ইতস্ততবোধ কেন? ‘
— ‘ আসলে মেয়ের জীবনের এতবড় সিদ্ধান্ত মেয়ের মতামত ব্যতিত…
আরিফ মাহমুদের কথা বুঝতে পেরে পদ্মালয়ার সবাই এবার মৃদু হাসলেন। শায়লা রহমান নীলার থুতনিতে ধরে আদরমাখা কন্ঠে বললেন,
— ‘ কিরে মামনি, আমার ছেলেকে বর হিসেবে পছন্দ নয়? ‘
ইশশ যেমন মা তার তেমন ছেলে! এমন করে কেউ বলে? নীলা লজ্জায় আরও নতজানু হলো। তাকে চুপসে যেতে দেখে শাহেদ মায়ের কথার উত্তরে বলল,
— ‘ মা ওদেরকে বরং একটু আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। তারপর না হয় বাকি কথা বলা যাবে। ‘
শাহেদের প্রস্তাবটা সবার কাছে পছন্দ হলো। তাই সাদিদ-নীলাকে একা কথা বলার জন্য নীলার রুমে যেতে বলল। নীলা পা টিপে টিপে এই লজ্জাকর পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসলো। সাদিদও তার পিছু আসছে।
সাদিদ নীলার রুমে প্রবেশ করেই দরজার ছিটকিনিটা দিয়ে দিলো। দরজা লাগানোর শব্দে নীলা এবার পিছন ফিরে তাকালো। সে কিছু বলবে তার আগেই সাদিদ তাকে হেঁচকা টানে নিজের কাছে আনল। নীলা কিছু বুঝার আগেই সে দরজার সাথে তাকে ঠেসে চেপে ধরল। তারপর বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় না করে নীলার হালকা গোলাপি বর্ণের ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁটজোড়া মিলিত করল। সাদিদ নীলার কানের পিছনে একহাত আর কোমড়ে একহাত রেখে তাকে একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। তারপর ভালোবাসাময় উষ্ণ আদর দিতে লাগল।
সাদিদ এতদ্রুত সবকিছু করেছে যে নীলা পুরোপুরি শকে চলে গিয়েছিল। এখন সাদিদের এমন উষ্ণ স্পর্শে সেখান থেকে সে বেড়িয়ে আসছে। নীলা সাদিদের দিকে একপলক তাকালো।
সাদিদ নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে নীলার কোমল অধরগুলো সমানে নিজের মধ্যে নিচ্ছে। নীলার চোখজোড়া আবেশে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। সে কাঁপা হাতে সাদিদের পিছনের চুলগুলো আঁকড়ে ধরল।
নিজেদের মধ্যকার দীর্ঘ উষ্ণ মুহূর্ত অতিবাহিত করে সাদিদ থামল। সে এবার চোখ খোলে নীলাকে দেখল। নীলার গোলাপি ঠোঁটযুগল এতক্ষণের ভালোবাসাময় অত্যাচারে খানিকটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সাদিদ নীলার বন্ধ চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও তার অধরে নিজের অধর মিলাল। ছোট একটা চুমু দিয়ে নিজেকে সরিয়ে আনলো। তারপর নীলার গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে মিহিস্বরে বলল,
— ‘ আই মিসড ইউ পাখি। ‘
নীলা কাঁপা চোখজোড়া নিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। তার ইচ্ছা করছে সাদিদের পাল্টা উত্তরটা তাকে দেওয়ার। সে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ আমিও। ‘
বলেই আবারও সে লজ্জায় নতজানু হলো। সাদিদ নীলাকে লজ্জায় লাল হতে দেখে নিজের ভিজে যাওয়া অধরগুলো জিহ্বা দ্বারা আবারও ভিজিয়ে নিলো। তারপর ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু কন্ঠে নীলার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ‘ সো মিসেস, বর হিসেবে সাদিদ ইবনে শাহরিয়ারকে পছন্দ তো? ‘
নীলা এমন প্রশ্নে নিঃশব্দে লাজুক হাসল। সত্যিই তো বিষয়টা হাস্যকর-ই। ফ্যামিলির সবাই তাদের বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। নিজেদের মতামত জানানোর জন্য আলাদাভাবে তাদেরকে কথা বলতে পাঠিয়েছে। অথচ তারা জানেই না এই যুবক-যুবতী ইতিমধ্যে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ।
নীলার আবারও এসব খেয়াল হতে অনুতপ্ততাবোধ হতে লাগল। তার মুখে এমন বিচলিত ভাব দেখে সাদিদ তার গালে হাত রাখল। দুষ্টুমি ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
— ‘ পাখি, কি হয়েছে? মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? ‘
— ‘ আমার খুব খারাপ লাগছে। সেদিন ভয়ের জন্য আপনাকে বারণ করলেও এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে৷ এতবড় সত্য তাদের থেকে লুকিয়ে রাখতে আমার বড্ড খারাপ লাগছে৷ ‘
সাদিদ নীলার কপালে চুমু দিলো। তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলাল। অতঃপর স্বান্তনার স্বরে বলল,
— ‘ আমিতো তখন-ই তোমাকে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি অযথা ভয় পাচ্ছিলে। আর তাদের কষ্ট হবে বলে ভাবছিলে। কিন্তু দেখ, তারা আজ কতটা খুশি। আমি জানতাম তারা জানলে ঠিক এমনটাই হবে। ‘
নীলা মাথা তুলে সাদিদের দিকে তাকালো। অপরাধী মনোভাবে বলল,
— ‘ আ’ম সরি। ঐরকম পরিস্থিতিতে ভালো-খারাপ বুঝতে পারিনি। ‘
সাদিদ তার কথায় মৃদু হাসল। নিজের নাকটা নীলার নাকে ঘষা দিয়ে বলল,
— ‘ আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি আছি না? সবকিছু ঠিক করে দিব৷ ‘
— ‘ কিভাবে? ‘
— ‘ যেটা তখন বলতে পারিনি সেটা এখন বলে দিব। ‘
— ‘ কি? ‘
— ‘ জ্বি মহারাণী। ফ্যামিলির সবাইকে আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের কথাটা বলে দিব। ‘
— ‘ যদি এতে হিতে বিপরীত হয়? সবাই যদি কষ্ট পায়? যদি রাগ করে? ‘
নীলার ভয়াতুর কন্ঠে এমন বিচলিত ভাব দেখে সাদিদ তাকে শান্ত করতে চাইল। তাই নীলার গালে স্লাইড করে তার ডানগালে চুমু খেল। অতঃপর একে একে তার বামগাল, কপাল নাকসহ পুরো মুখে নিজের উষ্ণ আদর দিলো।
নীলাকে এবার শান্ত দেখে সাদিদ তাকে বুকে টেনে আনল।
শক্ত করে নিজের সাথে আঁকড়ে ধরল। নীলার ঘাড়ে মুখ রেখে আত্মবিশ্বাসের সাথে তাকে বলল,
— ‘ পাখি, এমন কিছু হবে না। আমার উপর বিশ্বাস আছে তো? আমি সবটা সামলে নিব। তাই তোমার মুখে এখন হাসি দেখতে চাই। আমার প্রাণপাখির এমন বিচলিত চেহারা আমার সহ্য হচ্ছে না। ‘
নীলা নিঃশব্দে হাসল। তারপর সাদিদের বলিষ্ঠ শরীরটাকে নিজের নরম হাতগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইল।
অপরদিকে তাকে না দেখতে পাড়লেও সাদিদের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না নীলার ঠোঁটের কোণের নিঃশব্দের হাসির রেখা। সে নীলার ঘাড়ে চুমু খেয়ে তাকে আরও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো৷ এই বন্ধন যেন জন্মজন্মান্তরের। এই বন্ধন যেন আলাদা হবার নয়। সেটা এই প্রেমিকযুগল যেন নিজেদের সবটুকু শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখবে।
#চলবে…
[ অনেকক্ষণ যাবত পরবর্তী অংশ দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের এড়িয়াতে নেটওয়ার্কের এমন সমস্যা হচ্ছিল যে, আমি ফেইসবুক লগ-ইন পর্যন্ত করতে পাড়ছিলাম না। তাই লেইট হয়ে গেল প্রিয়পাঠক। 💙🐦 ]