গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৫ ♥🌹♥ (বর্ধিতাংশ)
সাদিদের সকল বন্ধু-বান্ধবসহ সমবয়সী সকলে তারা এখন একসাথে ডিনারের জন্য বসেছে। কিন্তু মাঝদিয়ে পিচ্চি শাদমানও নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। সবার দেখাদেখি সেও চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খাবার খাওয়ার অনবরত চেষ্টা করে চলেছে। নিধি পাশে বসে ঠোঁট টিপে হাসছে। সে ইতিমধ্যে অনেকবার তাকে বলেছে। কিন্তু ছেলে তার নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। সে নিজে খাবে মানে নিজেই খাবে।
— ‘ আব্বু মাকে দিয়ে দাও। মা খাইয়ে দিচ্ছি। ‘
— ‘ নো মাম্মা। আমি নিজে খাব। ‘
— ‘ ছেড়ে দাও চাচ্চু। তোমার খালামণিই-তো এখনও ঠিকঠাকভাবে খেতে পারে না। তার তুলনায় তুমি অনেক উপরে আছ। ‘
নীলা সাদিদের দিকে চোখ বাঁকিয়ে তাকালো। অতঃপর থমথমে গলায় বলল,
— ‘ আপনাকে কে বলল আমি ঠিকভাবে খেতে পারি না? এগুলো কি আপনার পেটে যাচ্ছে? ‘
— ‘ তুমিতো…
— ‘ এই সাদি খা-তো। সবসময় আমার নম্র-ভদ্র শালিকাটার পিছনে লেগে থাকিস। ‘
— ‘ ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন তোমার এই নম্র-ভদ্র শালিকাটা এখন সাদিদ ইবনে শাহরিয়ারের বউ। আমি কি তার পিছনে না পড়ে তোমার এক্সের পিছনে পড়ব? ‘
সাদিদের কথা শেষ হতেই শাহেদ খাবার মুখে বিষম খেল। সে সম্ভব হলে সাদিদকে এখন-ই তোলে একটা আছাড় দিবে।
সে ভয়াতুর দৃষ্টিতে আড়চোখে নিধির দিকে তাকালো। নিধি কাঁটাচামচ হাতে কটমটে দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। শাহেদ জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল। কিন্তু তাতেও নিধির দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন না দেখে সে শুকনো ঢুক গিলল। তার পিছনে যে শনি রয়েছে এটা সে পুরোপুরি নিশ্চিত।
তাদের সবার দৃষ্টির ব্যাঘাত ঘটে তানহার তীক্ষ্ণ স্বরে।
— ‘ বউ? ভুলে যাচ্ছিস কেন? এখনও অব্দি বিয়েটা হয়নি। বিয়ে পর্যন্ত অনেক দূর। তাই এতো বউ বউ করার কোনো মানে হয় না। ‘
সাদিদের রাগ উঠলেও আপাতত নিজেকে সে দমন করল। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি?
সাদিদ নিজের রাগ চেপে রাখলেও নীলার চোখে সেটা নজর এড়ালো না। সে টেবিলের নিচে সাদিদের হাতটার উপর নিজের হাত রেখে তার দিকে মিষ্টি হেসে তাকালো। নীলার স্পর্শ পেয়ে সাদিদও তাকালো। নীলাকে বড় মানুষের ন্যায় সান্ত্বনা দিতে দেখে সাদিদ নিঃশব্দে হাসল। তারপর দুষ্টুমি করে নীলার হাতটা জোরে চেপে ধরল। নীলা আর্তনাদ দিতে গিয়েও কোনোভাবে মানসম্মানের কথা ভেবে শব্দ নিজের ভিতরে রাখল। নীলা চোখ বাঁকিয়ে রাগী চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। অপরদিকে সে ঠোঁট টিপে হাসছে।
এইজন্যই লোকে বলে কারও উপকার বা ভালো করতে নেই৷
এই যেমন নীলা এখন ভালো করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গিয়েছে। কেননা তার বজ্জাত বরটা এখন নীলার হাতটাই ছাড়ছে না। নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখে, সাদিদ বেশ আরামশে ডিনার করছে। ভাবটা এমন যে খাবার ব্যতিত তার আর কোনো কিছুর উপর এইমুহূর্তে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।
নীলা নিজের মনেই আওড়াল,
— ‘ বজ্জাত একটা। ‘
সাদিদের কানে কথাটা না পৌঁছালেও নীলার জন্য শাস্তি মিস হলো না। হাতে আবারও সাদিদের শক্ত হাতের চাপ পড়ল। নীলা চমকিত চোখে সাদিদের পানে তাকালো। এখন কি এই ছেলে তার মনের উপরও দখলদারি করে নাকি?
নতুবা টের পেল কিভাবে?
নীলাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। নীলাকে একপলক দেখে নিয়ে বিনিময়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। যার অর্থ কাটাগায়ে নোনের ছিটা দিয়ে দিলাম।
.
সবার দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির মধ্যেই তাদের ডিনারের পর্বটা শেষ হলো। রাত বেশ হয়েছে। শাদমান বেচারা আর জেগে থাকতে পাড়ল না৷ বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। আপাতত ছেলেকে নিয়েই নিধি-শাহেদ আড্ডায় রয়েছে। শাহেদের কোলে শাদমান, আর নিধি ঘুমন্ত ছেলের একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। মা-বাবা দুইজনের-ই যেন এই ছোট্ট প্রাণটার মধ্যে নিজেদের প্রাণটা লুকিয়ে থাকে। সাদিদকে এখনও নীলার পাশে দেখে তানবীর এবার বাঁকা হেসে তার দিকে এগিয়ে গেল৷ সাথে করে অর্ণবকেও প্রিয়তীর বাহুবন্ধন থেকে আলাদা করল। অর্থটা এমন যে, ভাই তোদের এত ভালোবাসা আমার মতো সিঙ্গেল মানুষের আর সহ্য হচ্ছে না।
— ‘ আরে কোথায় নিয়ে চললি? ‘
— ‘ সারাদিন ঐ মেকাপের গোডাউনের পাশে থাকতে তোর বমির টেন্ডেন্সি হয় না? ‘
— ‘ ফালতু কথা ছাড়। ‘
— ‘ সত্য কইলেই ফালতু? তোর ঐ প্রিয়ু কোনো অংশ গোডাউনের থেকে কম? পাড়লে আরও বেশি৷ ‘
— ‘ হইলে হইছে। তোর টাকায় তো আর গোডাউন তৈরি করেনি৷ ‘
— ‘ এই হইলো পুরুষজাতি। বিয়ের পর-ই বউয়ের আঁচলের নিচে জায়গা করে। কিন্তু তুইতো বিয়ের আগেই বউয়ের আঁচল জড়িয়ে বসে আছিস।
অবশেষে সব পুরুষকে পিছনে ফেলে এওয়ার্ড বিজয়ী হলো আমাদের অর্ণব ওরফে মেকাপওয়ালির বাবু। ‘
— ‘ তানবীর, উষ্টা খাইস না। ‘
— ‘ ইচ্ছাও নাই। ‘
তানবীর মিনমিন করতে করতে এগিয়ে চলল। কিন্তু মুখেমুখে দুই বন্ধু এতো তর্ক করলেও তানবীর তাকে ছাড়ল না। তাকে নিয়ে সোজা গিয়ে সাদিদের সামনে দাঁড়াল।
দুই বান্দরকে একসাথে দেখে সাদিদ ভ্রুজোড়া নাচিয়ে জানতে চাইল,
— ‘ কি চায়? ‘
তানবীর ঠোঁট বাঁকিয়ে দুষ্টু হাসল। তারপর বেশ রসিয়ে বলল,
— ‘ বিবাহিত ব্যাচেলর আপনাকেই চাইছি। আপনার দর্শন পাওয়া তো রীতিমতো দুষ্কর। এখন কেউ জানতে চাইলে বলতে হবে নীলা যেখানে সাদিদ সেখানে। ‘
বলেই সে আবারও নিজেই হাসল। এবার পাশে দাঁড়ানো অর্ণবও হাসছে। এই নির্লজ্জ ঠোঁটকাটা ছেলেদের সামনে নীলার থাকা আর সম্ভব নয়। তাই সে দ্রুত অযুহাত দেখিয়ে জায়গা ত্যাগ করল।
— ‘ সমস্যা কি তোর? ‘
— ‘ মাই প্রবলেম ইস আ’ম এ সিঙ্গেল পার্সন। দেটস্ হোয়াই লোকসম্মুখে তোদের এতো ভালোবাসা-টালোবাসা দেখলে আমার ঘা জ্বলে। ‘
— ‘ সত্যি-ই সিঙ্গেল? ‘
— ‘ তা নয়তো আর কি?
তানবীর দ্রুত কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিলো। সাদিদ অর্ণবের দিকে তাকাতেই সেও তার দিকে দৃষ্টি দিলো। ইশারায় কথা আদান-প্রদান করে তারা দুইজনই হাসল।
_______________
নীলা বারবার না করছে। তার এককথা গান-টান তার দ্বারা হবে না। পাশে বসা সাদিদ নিঃশব্দে হাসছে। অবশেষে যখন নীলা কোনোভাবেই রাজি হতে নারাজ তখন সাদিদ নীলার বামহাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। নীলা সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে তাকালো। সাদিদ ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করছে।
এবার নীলার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফোটে উঠল। সে মাথা নিচু করে লাজুক হেসে সকলের উদ্দেশ্য নিজের হ্যাঁবোধক মতামত জানালো। সবাই আরেকদফা নীলা-সাদিদকে একত্রে পিন্চ করতে লাগল। নীলা লজ্জায় আরও নতজানু হলো।
কিন্তু এতক্ষণের গান নিয়ে যে ভয়টা নীলার মধ্যে ছিল আপাতত তার বিন্দু পরিমাণও নেই। কেননা সাদিদের চোখের জাদু নীলার সকল ভয় দূর করে দিয়েছে। নীলা পুরোপুরি নিশ্চিত সাদিদ সবটাই সামলে নিবে৷ নীলাকে কেবলমাত্র তার সহযোগী হতে হবে।
সাদিদ নীলার হাসিমুখটা দেখে নিজেও হাসল। অতঃপর গিটার হাতে তোলে নিয়ে নীলার দিকে তাকিয়েই সুর তুলল,
Tere bin jeena hai aise
Dil dhadka naa ho jaise
Yeh ishq hai kya duniya ko
Hum samjhaaye kaise
Ab dilon ki raahon mein
Hum kuch aisa kar jayein
Ik dooje se bichhde toh
Saans liye bin marr jayein
O Khuda.
Bata de kya lakreeron mein likha
Humne toh.
Humne toh bas ishq hai kiya (2x)
Pyaar ki inn raahon mein
Milte hain kitne dariya
Laakh toofaano mein bhi dil ko
Mil jaata hai zariya
নীলা এতক্ষণ সাদিদের দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল। তার চক্ষুগুলো প্রিয়মানুষটার চোখে নিজের জন্য এতটা ভালোবাসা দেখে ম্লান হয়ে গিয়েছে। সাদিদ মিষ্টি হেসে ভ্রুজোড়া নাচাতেই নীলাও অশ্রুমাখা সিক্ত চোখে হাসল। ম্লান চক্ষু নিয়েই গলায় সুর তুলল,
Iss dil ke irraadon mein hai itna asar
Lehron se kinaaron pe karta hai safar
O Khuda.
Bata de kya lakreeron mein likha.
Humne toh.
Humne toh bas ishq hai kiya (2x)
Aaj apne rangon se bichhdi hain yeh tasveerein
Haathon mein kahin toot rahin hain
Mil kar do taqdeerein
Duniya yeh jeet gayi dil haar gaya.
Nahi socha tha mil kar kabhi honge judaa.
O Khuda.
Bata de kya lakreeron mein likha
Humne toh.
Humne toh bas ishq hai kiya(×2)
গান শেষ হতেই একসাথে করতালির আওয়াজ ভাসতে লাগল। ফ্রেন্ডগুলো জোরে জোরে সিটি বাজিয়ে কাপলযুগলকে উৎসাহ দিচ্ছে। নীলা বেশ লজ্জা পাচ্ছে। তার লজ্জার পরিমাণটা আরও বাড়িয়ে দিতে সাদিদ এগিয়ে আসলো। হাতের গিটারটা পাশে থেকে একহাতে নীলাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রিয়তমার মাথায় দীর্ঘ ভালোবাসার চুমু খেল।
নীলা লজ্জায় এবার পুরোপুরি মিইয়ে গেল। সাদিদের কান্ডে দুষ্টুগুলো এবার আরও ফাজলামি শুরু করেছে। নানারকম দুষ্টুকথা বলে মুহূর্তেই পরিবেশটাকে উৎসবমুখর অবস্থানে নিয়ে আসলো।
নীলা লজ্জামিশ্রিত চোখে মাথা উঠিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদের চোখে-মুখে উপচে পড়া হাসি। এমন একটা ভাব যেন নীলা-ই পুরো গানটা গেয়েছে। অথচ নীলা হাতেগোনা গানের কয়েকটা কলিতে সুর মিলিয়েছে। কিন্তু সাদিদ এতেই মারাত্মক খুশি এবং সাথে মুগ্ধও। নীলাও হাসল। একমাত্র সাদিদের জন্য হলেও নীলা পুরোপুরি গানের রেওয়াজ তুলতেই রাজি। যে এতটা ভালোবাসতে পারে তারজন্য একটু কষ্ট করলে সমস্যা কোথায়?
উপস্থিত সবার মুখে হাসির রেখা থাকলেও একজনের মুখে সেটা অনুপস্থিত। তানহা নিজের ভিজে যাওয়া গালগুলো হাতের তালুর সাহায্য মুছিয়ে নিলো। সবার মতো সেও এখন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ঝুলিয়ে নিলো। কিন্তু সেটাতে মুগ্ধতা বিরাজমান নয়। নয় কোনো খুশিও। বরং তার ঠোঁটের কোণে ঝুলছে তাচ্ছিল্য হাসি।
সবার হাসিহাসির মধ্যে-ই নিধির চোখ পড়ল তানহার উপর। সে একেবারে সবার থেকে বিছিন্ন হয়ে এককোণায় বসে রয়েছে। দূর থেকে হলেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে তার মুখটা বেশ মলিন।
নিধি শাদমানের হাতটা ছেড়ে তানহার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
— ‘ কি হয়েছে তানহা, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আর সবার থেকে কেমন যেন বিছিন্ন হয়েও আছ। ‘
— ‘ না ভাবী তেমন কিছু না। আমি ঠিক আছি। এমনিতেই এখানে বসে রয়েছি। ‘
— ‘ তাহলে আমার সাথে চলো। সবার সাথে একসাথে বসবে। ‘
— ‘ না ভাবী আমি…
— ‘ কোনো কথা নয়। চলো তো। ‘
নিধি একপ্রকার জোরপূর্বক টেনেই তানহাকে সবার মাঝে নিয়ে গেল। তাকে নিজের পাশে বসাতেই শাহেদ বলে উঠল,
— ‘ কিরে, কোথায় থাকিস তুই? তোকে তো দেখা-ই যায় না। ‘
তানহা কোনো উত্তর দিলো। মলিন মুখে মৃদু হাসি দিয়ে নিজের উত্তর জানালো। শাহেদ-ই আবার বলল,
— ‘ আমাদের তানহাও কিন্তু মারাত্মক গান করে। সে তো আলাদাভাবে গান শিখেছে পর্যন্ত। ‘
— ‘ তাই নাকি আপু? তাহলে তুমিও একটা গান শোনাও। ‘
তানহা শান্তর কৌতূহলমূলক চাহনি দেখে সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদের অবশ্য সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই। সে নীলার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে তার নরম আঙ্গুলগুলো অনবরত নাড়াচাড়া করছে।
তানহা আবারও তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিলো।
সাদিদের গান বরাবরই পছন্দের তালিকায়। সে নিজেও বেশ ভালো গান গাইতে পারে। কন্ঠও সুমধুর। কেবল সেই জন্যই তানহা গানের অনুশীলন করেছে। এককথায় সাদিদের ভালোবাসা পাবার জন্য নিজের থেকে কোনো কমতি রাখেনি। নিজেকে যতটা শিক্ষিত-গুণের অধিকারীনি তৈরি করা যায় সবসময় সেটার-ই চেষ্টায় লেগে থাকত। কিন্তু তারপরও সাদিদের মনে নিজের জন্য জায়গা করতে পারেনি। সাদিদ নিজের হৃদয়ের মণিকোঠায় নীলার নামটাই খোঁদায় করেছে। তানহার দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে শাহেদ এনাউন্সমেন্ট করে দিলো,
— ‘ বাহ্ শালিকা বেশ বলেছ। তাহলে এই কথায় রইল। তানহা শুরু কর। ‘
— ‘ না ভাই। তোমরা করো আমার ভালো লাগছে না৷ ‘
— ‘ ভাইয়ের হাতের মাইর না খেতে চাইলে শীঘ্রই শুরু কর। ‘
নিধি-শাহেদসহ সবার আবদারে তানহা অবশেষে রাজি হলো। হৃদয়টা ভেতর থেকে তার টুকরো টুকরো হচ্ছে, অথচ সে সেটা প্রকাশ করতে পাড়ছে না।
তানহা নিজের ক্ষেত্রে মারাত্মক জেদি। বাড়ির ছোট্ট মেয়ে বিধায় আদরে আটখানা। নিজেরটা আদায় করতে সে সদা মরিয়া।
কিন্তু এইক্ষেত্রে সে নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় মনে করছে। কেননা বিষয়টা সাদিদকে ঘিরে জড়িত। তানহার মতো সেও ভীষণ জেদি। আর রাগলে তো মাশাল্লাহ সামনের জনকে পাড়লে তুলে আছাড় দেবার অবস্থা। এসব তানহার থেকে ভালো আর কে জানে? সে সাদিদের ছোট্টবেলার খেলার সাথী। তাই সাদিদের আচরণ সম্পর্কে সে ভালো-ই অবগত। এইজন্য এতদিন যাবত সাদিদের উপর জোর খাটাতে পারেনি। শুধু নিজের রূপ-গুণ দিয়ে সাদিদকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছে। সবসময় পাশে থাকার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু জোর করে নিজের ভালোবাসাটা আদায় করতে পারেনি। ইনফেক্ট সাদিদ তাকে সেই সুযোগটা দেয়নি। নিজের প্রতি তানহার অনুভূতি জানার পর থেকেই সবক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। তানহা হাজার চেষ্টা করলেও সে নিজের জায়গায় অনড় ছিল।
তানহা সবার থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবারও সেই নির্দয় ব্যক্তির পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নীলা-সাদিদকে আবারও একসাথে হাসিখুশি দেখে তার কলিজাটায় বোধহয় কেউ ক্রমাগত ছুরিকাঘাত করছে। নতুবা এত অসহ্যনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে কেন?
তানবীর গিটার হাতে নিতে গেলেই তানহা বলে উঠল,
— ‘ লাগবেনা। তুই বস। ‘
তানবীর তার কথায় গিটারটা রেখে দিলো। তানহা চোখ বন্ধ করে খালি গলায়-ই সুর তুলল,
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়।
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়।
তোমার কথার শব্দদূষণ, তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি, আমার দারুণ জ্বর।
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই।
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে, একটা চালের ভুল
কোথায় দাঁড়াই?
কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়।
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়।
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান
বুকের ভেতর ফুটছে যেন মাছের কানকোর লাল
এত নরম।
শাড়ির সুতো বুনছে যেন সেই লালের কঙ্কাল
বিপদ বড়।
তানহা নিজের বন্ধ আখিঁদ্বয় খোলল। আর সাথে সাথেই টপটপ করে অশ্রুকণাগুলো গাল বেয়ে পড়ে আবারও গালগুলো ভিজিয়ে দিলো। তার দৃষ্টি সাদিদের দিকে স্থির। হাসিখুশি পরিবেশটা মুহূর্তেই নিস্তব্ধতায় রূপান্তর হলো।
তানহার গলায় সুর আটকে যাচ্ছে। তারপরও সে নিষ্পলক সাদিদের মুখপানে তাকিয়েই গাইতে লাগল,
কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়।
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়।
তোমার কথার শব্দদূষণ, তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি, আমার দারুণ জ্বর।
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তানহার দুইচোখ জ্বলে টইটম্বুর। ফর্সা মুখটা অশ্রুজলে পুরো লাল হয়ে রয়েছে।
সাদিদ এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখশ্রীতে স্পষ্টত অসহায়ত্বের ছাপ। কেননা এখানে তার কিছু করার নেই। তার পাগলামিতে সাদিদ বিরক্ত অনুভব করলেও ছোট্ট বেলার খেলার সাথী, ভালো বন্ধু আর বোন হিসেবে সাদিদের বরাবরই তার জন্য খারাপ লাগত। কিন্তু তার করার কিছু ছিল না৷
কিছু জিনিস থাকে যেখানে জোর খাটানো যায় না। না গায়ের জোরে পাওয়া যায়, না গায়ের জোরে দেওয়া যায়।
ভালোবাসাও নিঃসন্দেহে তার মধ্যেই পড়ে। ভালোবাসা হৃদয়ের অনুভূতির মিশ্রণে তৈরি। এখানে নেই কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম।
সাদিদের মতো উপস্থিত সবার মুখও গম্ভীর। এখানে সবাই-ই প্রাপ্তবয়স্ক। তাই তানহার এমন করে চোখের জল আর অপলক দৃষ্টিতে সাদিদের দিকেই তাকানো দেখে কারও আর বুঝার বাকি নেই বিষয়টা আসলে কি?
তারাও নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করছে। কি করার আছে এখানে? সাদিদ-নীলা একে অপরকে ভালোবাসে। আর অপরদিকে তানহা যে সাদিদকে ভীষণ ভালোবাসে এটাও তাদের চোখের সামনে। বিষয়টা বড্ড জটিল হয়ে পড়েছে।
তানহা অশ্রুসিক্ত চোখ আর গালগুলো হাতে মুছিয়ে নিয়ে সাদিদের দিকে তাকিয়েই জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল। তারপর বিনাবাক্য নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কাউকে আর কিছু না বলে এলোমলো পায়ে বাড়ির ভিতরে চলতে লাগল। এই অসহ্যকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে তার এখন নিন্দ্রা প্রয়োজন। কিন্তু আজকাল সেও তানহার সঙ্গ দিচ্ছে না। সাদিদের মতো ঘুমও তাকে এড়িয়ে চলছে। তানহার জীবনটা পুরো মূল্যহীন লাগছে তার কাছে।
কি মূল্য আর এই জীবনের? যে জীবনে তার ভালোবাসা সাদিদ তার পাশে নেই?
তানহার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থেকে শাহেদ এবার সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ মাথা খানিকটা নিচু করে রয়েছে। শাহেদ একটা হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেলল।
তানহার সাদিদকে নিয়ে অতিরিক্ত পাগলামি বরাবরই তার চোখে পড়েছে। কিন্তু শাহেদ এটা নেগেটিভভাবে নেয়নি। ভেবেছে দু’জনই সমবয়সী। আর তাদের মধ্যেকার বন্ডিংটাও সবার জানা ছিল। কিন্তু যত বড় হচ্ছিল ততই যেন তাদের দুরত্বটা বেড়ে গিয়েছিল। শাহেদ তখনও ভেবেছিল হয়তো বয়সের গতিটা তারাও বুঝতে শিখেছে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে যে দুইজনের মধ্যে এসব চলছে শাহেদ সেটা চিন্তা পর্যন্ত করেনি। তার চোখে-মুখেও অসহায়ত্ব। কেননা সাদিদ, নীলা, এবং তানহা এই তিনজনই তার হৃদয়ের খুব কাছের। এই ছোট্ট প্রাণগুলোর জন্য তার স্নেহের সীমা নেয়।
সাদিদ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠকে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে বলল,
— ‘ সরি টু ছে গাইস, কিন্তু আমি আর এখানে থাকতে পাড়ছি না। মাথাটা বড্ড ধরেছে। গুড নাইট এভরিওয়ান। ‘
তাকে আর কেউ বাধা দিলো না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা এখনও বাকরুদ্ধ। সাদিদ কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আচমকা থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই চোখে পড়ল নীলার মলিন মুখখানা। সাদিদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নীলার কাছে এগিয়ে আসলো। তাকে কাছে আসতে দেখে নীলা দ্রুত চোখ নিচে নামিয়ে নিলো৷ সাদিদকে নিজের চোখের জল নীলা দেখাতে চায় না। সেই জন্যই এত লুকাচুরি।
সাদিদ নীলার সামনে এসে হাঁটু ভাজ করে নিচে বসল। নীলার কোলের উপর রাখা দুইটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। হালকা চেপে ধরে মিহি কন্ঠে বলল,
— ‘ বাসায় পৌঁছে আমাকে টেক্স করে দিবে। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। তাই রাতে আর কল দিব না। তাই রাত জাগবে না। লক্ষ্মি মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়বে। ‘
নীলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁবোধক উত্তর জানাল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পাড়ল না। সাদিদও আর তাকে ঘাটলো না। সে নিজেও এখন ভীষণ ক্লান্ত। শারীরিক নয় বরং সেটা মানসিক। তাই নিঃশব্দে মৃদু হেসে নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো। নীলা মাথা উঠিয়ে সাদিদের গমনপথে তাকালো। তাকে যতক্ষণ পিছন থেকে দেখা গিয়েছে নীলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অশ্রুসিক্ত চোখগুলো থেকে এতক্ষণের চেপে রাখা নোনাজলটা এবার নিজ স্বাধীনে গড়িয়ে পড়ল।
___________________
রুমের টেম্পারেচারটা একেবারে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। লাইটগুলোও আপাতত নিবিয়ে রাখা আছে। পুরো বাড়িতে এতএত লাইটিং করা হয়েছে যে সেগুলোর উজ্জ্বল আলো ব্যক্তির চাওয়াটাকে পূর্ণ করল না। অন্ধকার রুমটাতে জানালার থাই গ্লাস ভেদ করে কিছুটা হলেও আলো চলে এসেছে। সেই আলোতে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে থাকা সাদিদের অবয়ব আবছা। বালিশ ছাড়া মেঝেতে হাটু দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ আগের গুছানো ছেলেটাকে এখন বড্ড এলোমলো লাগছে। এনগেজমেন্টের পরনের কাপড়গুলো এখনও তার শরীরে-ই রয়ে গিয়েছে। শুধু গলার টাইটা লুজ করে রাখা। সাথে সুটের বোতামগুলো খোলে দেওয়া।
হঠাৎ পায়ে কারও স্পর্শ পেতেই সাদিদ চোখ খোলে মাথা উঁচিয়ে তাকালো। আবছা অন্ধকার হলেও তার বুঝতে অসুবিধা হলো না সেই মানুষটি কে। সাদিদ জলদি শোয়া থেকে উঠে বসল,
— ‘ এই পাখি, পায়ে হাত দিচ্ছ কেন? ‘
নীলা সাদিদের প্রতিউত্তর দিলো না। আবারও জুতায় হাত দিতে গেলেই সাদিদ দ্রুত পা সরাল।
— ‘ এই মেয়ে সমস্যা কি? এসব করছ কেন? ‘
— ‘ কেন? করলে সমস্যা কোথায়? ‘
— ‘ একদম চুপ। আর কখনও যেন এসব না দেখি। ‘
— ‘ আপনার জুতায় হাত দিলে বুঝি আমি ছোট হয়ে যাব? ‘
— ‘ তেমনটা নয়। কিন্তু আমি চাই না তুমি আমার এসব কাজ করো। অন্ততপক্ষে যতদিন আমি সুস্থসবল রয়েছি৷ অসুস্থ থাকলে না হয়…
নীলা সাদিদকে কথা শেষ করতে দিলো না। তার মুখের উপর নিজের হাত রেখে বাধা দিলো। সাদিদের কথাতে মুহূর্তেই তার চোখজোড়া আবারও অশ্রুসিক্ত হলো। তার অবস্থা দেখে সাদিদ মৃদু হাসল। নীলার হাতে চুমু দিয়ে তাকে নিজের পাশে বসাল।
তার মন ভালো করতে প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল,
— ‘ এখনও এখানে যে? বাসায় যাওনি কেন? ‘
— ‘ আব্বু আঙ্কেলের সাথে কথা বলছে। ‘
সাদিদের অগোচরে এই ছোট্ট মিথ্যা কথাটা বলে নীলা হাসল। নতুবা কি করে বলবে সে ইচ্ছে করে যেতে চায়নি। আম্মু-আব্বুকে বলেছে তার কাজ আছে। উনারা যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। আর উনাদেরকে ব্যস্ত করে সে এখন সাদিদের কাছে। তার অবাধ্য মনটা সাদিদকে এই অবস্থায় একা ফেলে যেতে চায়নি। কিছু করতে পারুক আর নাই-বা পারুক সঙ্গী হিসেবে তার পাশে থাকতে চায়।
সাদিদও নীলার কথায় হাসল। মুখে স্বীকার না করলেও সাদিদের মনটাও যে এখন নীলার সান্নিধ্যে চায়। শারীরিক-মানসিক উভয়ক্ষেত্রকে স্বাভাবিক আনতে প্রাণপাখিকে একটু একান্তভাবে তার এখন প্রয়োজন।
সাদিদ কিছু না বলে নীলাকে বুকে টেনে আনল। নিজের বুকের সাথে নীলাকে জড়িয়েই বালিশে মাথা রাখল।
নীলাও চুপচাপ রয়েছে। সাদিদকে কোনো প্রশ্ন করছে না। সাদিদ নীলাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করল।
নীলার মনটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বড্ড খচখচ করছে। কিন্তু মুখে বলতে সংকোচ। সে লেগে যাওয়া কন্ঠে বলল,
— ‘ আসলে না মানে…
— ‘ তুমি যেটা ভাবছ বিষয়টা তেমন-ই। ‘
নীলাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে সাদিদের বলা কথাটা নীলার কর্ণকোহরে যেতেই সে মাথা উঁচু করে তাকালো। সাদিদও বন্ধ আখিঁদ্বয় খোলে নীলার দিকে তাকালো। নিষ্পলক চেয়ে থেকে সে নীলার গালে নিজের ডানহাত রাখল।
— ‘ হ্যাঁ সত্য এইটাই যে তানহা আমাকে পছন্দ করে। ইনফেক্ট ভালোবাসে বলতে পারো। ‘
নীলা দ্রুত চোখ নামালো। সাদিদের এভাবে অকপটে এই কথাটা বলা নীলার বুকে গিয়ে বিঁধছে। সাদিদ নীলার মুখটা দুইহাতে উঁচু করে ধরল। তার অবস্থা পরিলক্ষিত হতেই সে মাথা নিচু করে প্রিয়তমার মাথায় চুমু খেল। সাদিদের একটু ভালোবাসার সোহাগেই যেন নীলার অবুঝ মনটা আরও নেতিয়ে গেল৷ সে সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগল।
নিঃশব্দের হলেও সাদিদ সেটা অনুভব করতে পারল। তাই নীলাকে মুহূর্তের মধ্যে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তার উপর নিজে আধশোয়া হয়ে বলল,
— ‘ এইটুকুতেই চোখে জল? ‘
নীলা উত্তর দিলো না। সাদিদ নিঃশব্দে হেসে নিজেই বলল,
— ‘ কিন্তু আমি কখনও তাকে অন্য রকম কিছু ভাবতে পারিনি। বন্ধু-বোন ব্যতিত আর কোনো অনুভূতি তার জন্য আমার কাজ করেনি। ‘
— ‘ আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন। আমি আপনার উপর সন্দেহ করছি না। ‘
— ‘ সেটা তুমি না বললেও আমি জানি। যেহেতু বিষয়টা সামনে চলেই এসেছে তাই আমি সবটা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। তোমারতো জানার অধিকার রয়েছে। আমার উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার এখন তোমার-ই। ‘
সাদিদের এমন আদরমাখা কন্ঠে নীলা এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল। আচমকা নীলার এমন কান্নায় সাদিদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। অস্থির কন্ঠে বলল,
— ‘ এই পাখি, আবার কাঁদছ কেন? ‘
— ‘ আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। নিজেকে বড্ড স্বার্থপর মনে হচ্ছে। ‘
নীলা কান্নামিশ্রিত গলায় কথাটা বলেই আবারও নিজেই বলতে লাগল,
— ‘ আমি তানহা আপুর চোখে আপনার জন্য গভীর ভালোবাসা দেখেছি৷ উনি আপনাকে খুব খুব ভালোবাসে। আমি কি কোনোভাবে আপনাদের মধ্যে চলে এসেছি? আমি কি…
সাদিদ ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে দিয়ে তাকে আঁটকে দিলো। নীলার গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সাদিদ সেগুলো আলতো হাতে মুছিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
— ‘ আজকেই শেষ। আর কখনও যেন এমনটা না শুনি। আর নিজেকে ছোট মনে করারও কিছু নেই। এখানে তোমার বিন্দুমাত্র দোষ নেই। তাই নিজেকে কখনও এর জন্য দোষারোপ করবে না। ‘
— ‘ কিন্তু আমার এমনটা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সবটা…
সাদিদ এবার আর আঙ্গুল চেপে তাকে বাধা দিলো না। নীলা অনবরত কাঁদছে। তাকে এইমুহূর্তে শান্ত করা প্রয়োজন৷ তাই সাদিদ সরাসরি তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল।
নীলার কান্না ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগল। সাদিদ তার একহাত নীলার গলায় আর অপরহাত কানের পিছনে রেখে নিজের উষ্ণতায় তাকে বেঁধে ফেলল।
কয়েক মুহূর্ত পর নিজের ভেজা ঠোঁট দিয়ে নীলার কপালেও চুমু খেল। অতঃপর দুইগালেসহ প্রিয়তমা স্ত্রীর পুরো মুখে ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসাময় আদর দিলো। অবশেষে ভ্রুযুগলের মাঝখানে দীর্ঘ চুমু দিয়ে সাদিদ তাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। নীলার কাঁপা হাতগুলো নিজেদের মতো সাদিদের পিঠে জায়গা করল। নিজেও তাকে নিজের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
কতসময় এভাবেই কেটে গেল তার হিসাব রাখা গেল না। দুইজন কেবল একে অপরকে অনুভব করেছে। আর করেছে একে অপরের জন্য সীমাহীন ভালোবাসাও। নীরবতার চাদর ভেদ করে অবশেষে সাদিদ আবেগমাখা কন্ঠে বলল,
— ‘ পাখি, ভালোবাসা অনুভূতিতে জন্ম হয়। অনুভূতি ব্যতিত ভালোবাসা তৈরি করা অসম্ভব। তানহার প্রতি আমার কখনও ভালোবাসাময় অনুভূতি কাজ করেনি৷ আর না ভবিষ্যতে কোনোদিন করবে।
আমার অনুভূতিগুলো কেবলমাত্র তোমার জন্য বউ। তুমিহীনা অন্য কারও জন্য এই অনুভূতি বরাদ্দ নয়। আমি ভালোবাসি তোমাকে। নিজের সবটা দিয়ে কেবলমাত্র তোমাকেই ভালোবেসেছি, আর এখনও তোমাতেই আমার ভালোবাসা স্থির। তাই নিজেকে কখনও এর জন্য দায়ি মনে করবে না। ‘
— ‘ এতটা ভালোবাসতে আপনাকে কে বলেছে? এখন যে আমার ভয় হয়। আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়গুলো আমাকে অনবরত তাড়া করে বেড়ায়। নিজের সাথে এতটা কেন জড়ালেন? ‘
নীলার কান্নামিশ্রিত কন্ঠে নিজের জন্য মিষ্টি অভিযোগ শুনে সাদিদ নিঃশব্দে হাসল। পাখিটাকে পাড়লে সে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে। যেহেতু সেটা সম্ভব নয় তাই আরও শক্ত করে তাকে আঁকড়ে ধরল। ভালোবাসার অধিকার নিয়ে তার নির্লিপ্ত উত্তর,
— ‘ সব প্রশ্নের এক উত্তর, ভালোবাসা। তোমার সব অভিযোগের এক সমাধান, ভালোবাসা। পাখি, বড্ড বেশি ভালোবাসি। ‘
নীলার কানগুলো যেন নিজেদের স্বার্থক মনে করছে। এই মধুর শব্দটা এতটা মধুরভাবে শুনতে পাড়ছে বলে সে কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ সে নিজের অস্তিত্বের উপর। কৃতজ্ঞ সে, সেই মহান সৃষ্টিকর্তার উপর। যিনি নীলার ভাগ্যে এই জীবনসঙ্গীর নামটা লিখেছেন। যার পাঁজরের হাড়ে নীলাকে তিনি তৈরি করেছেন। সাদিদের অস্তিত্বে নিজেকে জড়াতে পেয়ে নীলা সত্যিই কৃতজ্ঞ।
#চলবে…
[ প্রিয়পাঠক আজকের পর্বের জন্য ব্যবহৃত গানগুলো হচ্ছে,
Song Name: “O Khuda”
Movie: Hero
Singers: Amaal Mallik & Palak Muchchal
Song Name: Tumi Jake Bhalobaso
Movie: Praktan (প্রাক্তন)
Singer: Iman Chakraborty-Female version ]