অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ২৬

0
5574

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৬

ব্যস্ততায় আমরা হাঁপিয়ে উঠি। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বিষিয়ে উঠে আমাদের শরীর-মন। সেই সময় সম্পর্কগুলোও বড্ড নড়বড়ে হয়ে উঠে। অপর মানুষটির ব্যস্ততা আমরা মেনে নিতে পাড়লেও ব্যস্ততার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সহজে গ্রহণ করতে পারি না। দিনশেষে ব্যস্ততার বেড়াজালে পড়ে প্রিয়জনের সামান্য খেয়ালের অভাবকে নিজের অজান্তেই তিলতিল করে তাল বানিয়ে ফেলি। অভিমান-রাগ পুষিয়ে তারউপর অভিযোগের এক পাহাড় তৈরি করি৷ যেটা ঠিক না হলেও গুটিকয়েক ব্যতিত সবাই আমরা ঠিক এই কাজটাই করি।
কিন্তু প্রিয়জনকে যে শুধু ভালোবাসলেই হয় না। তাকে বুঝতেও হয়। তার সময় না দেওয়ার কারণটা নিয়ে কথা শুনানো উচিত নয়। বরং তার সাথে থেকে হোক বা দূরে থেকে, তাকে নিজের জায়গায় সময় দেওয়া উচিত। তার পরিস্থিতিটা বুঝা উচিত। এই যেমন আজ সপ্তাহেরও উর্ধ্বে সাদিদ-নীলার দেখাসাক্ষাৎ নেই৷ প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও খুবই কম৷ ক্লান্ত সাদিদ রাতে ফিরে আর এনার্জি খোঁজে পায় না৷ তাই রাত জেগে আর কথাও হয় না। কিন্তু তারপরও যেন এই মানুষটার প্রতি নীলা বিন্দু পরিমাণ অভিযোগ জমাতে পারেনি। বলতে পারেনি এত কিসের ব্যস্ততা আপনার?
নীলার কেবল এই উশকুখুশকো ছেলেটাকে দেখে বুকের বামপাশে তীক্ষ্ণ একটা কষ্ট হচ্ছে। কি ধকলটাই না যাচ্ছে এই ছেলেটার উপর দিয়ে। ভালোবাসার ব্যাথা ব্যতিত দরজায় দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে নীলার আর কোনো অভিযোগমূলক অনুভূতি হচ্ছে না। নীলা সিক্ত চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল কাঙ্ক্ষিত সেই মুখের দিকে। সাদিদ নীলার গালে নিজের হাতের স্পর্শ দিলো। আদরমাখা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ কেমন আছ পাখি? ‘

ইশশ কি মধুর ডাক। দূরত্বে নাকি সম্পর্কের গভীরতা কমে যায়। কিন্তু নীলার ক্ষেত্রে বোধহয় উল্টো হচ্ছে। এই খানিকের দূরত্ব যেন নীলাকে সাদিদের প্রতি আরও দুর্বল করে দিয়েছে। আরও যেন নিজের ভালোবাসায় সাদিদ তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। নীলা নিষ্পলক সাদিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

— ‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি? ‘
— ‘ এতদিন ভালো ছিলাম না। কিন্তু এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ‘

বলেই সাদিদ নিজেও নিঃশব্দে মৃদু হাসল। তারপর নীলার গাল থেকে হাত নামিয়ে শার্টের হাতাগুলো ঠিক করতে লাগল। সে অফিস থেকে সোজা বেড়িয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে পর্যন্ত পারেনি। অতঃপর চুলে হাত বুলিয়ে সে বলল,

— ‘ আঙ্কেল বাসায় আছে? ‘
— ‘ এই যা এতক্ষণ আপনাকে আমি বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখলাম! প্লিজ ভিতরে আসুন। ‘
— ‘ অস্থির হবার কিছু নেই। আমি-ই তো। ‘

নীলা শুনল না। সাদিদকে ভিতরে নিয়ে এসে তারপর শান্তি হলো। সাদিদ সোফায় বসতেই বলল,

— ‘ আব্বু বাসায় আছে। আমি ডেকে আনছি। ‘

নীলা কয়েককদম এগিয়ে থেমে গেল। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখা মিলল ক্লান্ত সাদিদকে। সে ইতিমধ্যে চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়েছে। নীলা এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। নরম আঙ্গুলগুলো দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই সাদিদ দ্রুত চোখ খোলে তাকালো। সে কিছু বলবে তার আগেই নীলা বলে উঠল,

— ‘ আপনার জন্য লেমন জুস নিয়ে আসি? ‘
— ‘ তুমি নিজে বানাবে? ‘

নীলা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁবোধক উত্তর দিলো। সাদিদ ক্লান্তিময় হেসে বলল,

— ‘ আচ্ছা নিয়ে আস তাহলে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ‘

নীলা সাদিদের চুলগুলো হালকা এলেমেলো করে দিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে আসলো। ব্লেন্ডারে ৪টা পুদিনাপাতা, দুই চা চামচ লেবুর রস, দুই চা চামচ চিনি আর অল্প বিটলবন মিশিয়ে ব্লেন্ড করে ছেকে নিলো।
তারপর গ্লাসে ৩টা বরফ কিউব দিয়ে দিলো। শেষে ব্লেন্ডারে তৈরি করা রসের মিশ্রণটি দিয়ে তারউপর ঠান্ডা পানি দিয়ে গ্লাস পূর্ণ করল। ট্রেতে নিয়ে সাদিদের জন্য বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

— ‘ নিন আপনার জন্য মিন্ট লেমোনেড। ‘

নীলার কথার ভঙ্গিমা দেখে সাদিদ নিঃশব্দে হাসল। গ্লাস হাতে নিয়ে সে একচুমুকে সবটা শেষ করল। ঠোঁট টিস্যুতে মুছিয়ে নিতে নিতে বলল,

— ‘ পাখি তোমার হাতটা দাওতো। একটা চুমু খাই। ‘

নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। তাকে আর আরিফ রহমানকে ডাকতে যেতে হয়নি। তিনি নিজেই এশার নামাজ পরে চলে এসেছেন। শরীরটা তেমন ভালো লাগছিল না উনার। তাই নামাজটা বাসাতেই পরে নিয়েছেন। তার পিছু পিছু নার্গিস খাতুনও আসলেন। সাদিদকে সোফায় বসা দেখেই তিনি আনন্দিত কন্ঠে বললেন,

— ‘ কতদিন পর দেখলাম। কেমন আছো বাবা? ‘
— ‘ জ্বি আন্টি ভালো আছি৷ আপনি কেমন আছেন? ‘
— ‘ আমিও ভালো-ই আছি। ছেলেটা কখন এসেছে আর তুই আমাদের কিছু বলিসনি কেন? ‘
— ‘ আন্টি অস্থির হবেন না। আমি মাত্র-ই আসলাম। ‘
— ‘ তুমি এই মেয়ের সাফাই গাইতে এসো না। একে আমার ঠিক চেনা আছে। নিশ্চয়ই তোমাকে খালি মুখে বসিয়ে রেখেছে? ‘

নার্গিস খাতুন আর কারো কথা শুনে সময় নষ্ট করতে চাইল না। মেয়ে জামাইয়ের জন্য দ্রুত খাবার তৈরি করতে কিচেনের দিকে ছুটলেন। নীলা সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আরিফ রহমান এসেও সাদিদের সাথে কথা জমিয়ে দিলো। সবার খোঁজ-খবর নিতে লাগল।

— ‘ বাবা, তুমি আসাতে কিন্তু আমরা ভিষণ খুশি হয়েছি। ‘

সাদিদ ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলল,

— ‘ আঙ্কেল আমি কিন্তু মূলত আপনার আর আন্টির কাছেই এসেছিলাম। ‘
— ‘ বাপরে বউ ছেড়ে এখন শশুর-শাশুড়ির দরকার পড়ল? ‘

আরিফ রহমান কথাটা বলে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলেন। মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে এমনটা তিনি মোটেও বলতে চাননি। কিন্তু হঠাৎই ভুলটা হয়ে গেল। নীলাতো বাবার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। কি বললেন উনি?
পরিস্থিতি সামলাতে তিনি গলা পরিষ্কার করে সোজা-সাপ্টা বললেন,

— হ্যাঁ বলো কি দরকারে এসেছিলে? ‘
— ‘ আঙ্কেল আমার ফ্রেন্ড অর্ণব মুখার্জিকে তো আপনি ইতিমধ্যে চিনেন। ওর বিয়ে সামনের সোমবারে। কিন্তু পাত্রী ডেসটিনেশন ওয়েডিং চায়। তাই বিয়ের সমস্ত কার্যক্রম সিলেটের শ্রীমঙ্গলে করা হবে। এমতাবস্থায় তারা নীলাঞ্জনাকেও বিয়েতে চাচ্ছে। এখন যদি আপনারা পারমিশন দিতেন…

সাদিদের কথাটুকুর সারমর্ম বুঝতে আরিফ মাহমুদের অসুবিধা হলো না। তিনি মৃদু হেসে বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললেন,

— ‘ বেশ তো, নিয়ে যাও। সবাই না জানলেও আমাদের কাছে তো তোমাদের সম্পর্কের নামটা স্পষ্টত। তাই নীলাঞ্জনার উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার এখন তোমার এবং তোমাদের পরিবারের-ই। তোমরা ওকে এখনও আমাদের সাথে থাকতে দিচ্ছ এটাই আমাদের জন্য অনেক। ‘

নীলা বাবার সম্মতিতে খুশি হলেও তার চোখ মুহূর্তেই ভরে উঠল। বিয়ে হলেই কি মেয়েরা এতটা পর হয়ে যায়? ছোট্ট থেকে বড় করে তোলা সেই মা-বাবার অধিকার কি সন্তানের উপর থেকে এতটা কমে যায়?
সাদিদ একপলক নীলার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর এগিয়ে গিয়ে আরিফ রহমানের হাতটা মুঠোয় নিয়ে সাবলীল কন্ঠে বলল,

— ‘ ভুল আঙ্কেল। নিজেদের জায়গা সম্পর্কে কখনও এমনটা চিন্তা করবেন না। নীলাঞ্জনা এখন আমার ওয়াইফ। সত্য যে তার উপর আমার অধিকার অনেক। কিন্তু তাই বলে যে আপনাদের অধিকার সেখানে কমে যাবে এমনটা নয়। একজনের জন্য আরেকজনের অধিকার কেন কমবে? অধিকারতো আর ব্যস্তানুপাতিক নয়। আপনার মেয়ের উপর আগেও যেমন আপনাদের অধিকার ছিল এখনও আছে আর ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবে। সেটা সে এখানে থাকুক বা আমার সাথে। কিন্তু অধিকার কিন্তু আপনার কাছেই থাকবে। ‘

আরিফ রহমানের ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে শক্ত করে বুকে আগলে ধরতে। সে এতটা ভালো কেন? এমন চিন্তা-ভাবনার জন্য বৃহৎ মন সে কোথায় থেকে পেয়েছে? নিজের মেয়ের জন্য আল্লাহ নিঃসন্দেহে রাজকপাল মিলিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই তিনি খুশিতে পুলকিত হলেন। আর নিজের ইচ্ছেটাকেও প্রাধান্য দিলেন।
সাদিদকে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে তার পিঠ চাপড়ে বললেন,

— ‘ বিয়াইসাব আর বিয়াইন নিশ্চয়ই কোনো মহৎ পূর্ণ করেছে। যার জন্য সৃষ্টিকর্তা তোমাকে তাদের জন্য উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছেন। খুব সুখি হও বাবা। আল্লাহ তোমাদের দুইজনকে খুব হাসি-খুশিতে রাখুক। ‘

.

ভালো কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে সাদিদ যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। নার্গিস খাতুন তাকে ডিনার না করিয়ে ছাড়লেন না। অবশেষে ডিনার এবং নীলাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার পারমিশন সাথে নিয়ে সাদিদ বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো। নীলার ইতস্ততবোধ দেখে নার্গিস খাতুন নিঃশব্দে হাসলেন। কিন্তু কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললেন,

— ‘ ছেলেটাকে এগিয়ে পর্যন্ত দিতে গেলি না! এমনটাই কি তোকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে? ‘

নীলা মায়ের দিকে তাকালো। তার ইচ্ছে করছে খুশিতে মাকে এখন ঝাপটে ধরতে। কিন্তু লজ্জা আর সাদিদ চলে যাবে সেই শঙ্কায় দ্রুত সে নিচে ছুটল।
সাদিদ গাড়ির দরজা লাগিয়ে কার স্টার্ট দিতেই সাইড আয়নায় নীলাকে দেখতে পেল। সে মৃদু হাসল৷ তারপর গাড়ির দরজা খোলে বাহিরে এসে নীলার দিকে দুইহাত প্রসারিত করল।
নীলাও দ্রুত এসে নিজের শান্তির জায়গাটাতে নিজের মাথা এলিয়ে দিলো। সাদিদ তাকে নিজের উষ্ণ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মাথায় দীর্ঘ চুমু খেল। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

— ‘ ভালোবাসি পাখি। নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি। ‘
— ‘ আমিও ভালোবাসি। ভীষণ রকমভাবে ভালোবাসি। ‘

__________________

বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে শান্ত অনবরত বাদামের খোসা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি এদিক-ওদিক। এক্সাইটমেন্টের চকরে সে ট্রেনের রেগুলার টাইমের একঘণ্টা আগেই এসে হাজির হয়েছে। এখন বারবার গেইটের দিকে নজর দিয়ে দেখছে তারা এসেছি না-কি না?
নীলাকে ইতিমধ্যে কল দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তারা সবেমাত্র মিরপুর থেকে রউনা হয়েছে। সাদিদ নিজে-ই নীলাকে পিক করেছে।
শান্তর এমন চঞ্চল দৃষ্টির মধ্যেই সে তারপাশে কারো উপস্থিতি বুঝতে পাড়ল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই এটিটিউড নিয়ে দাঁড়ানো তানবীরকে চোখে পড়ল। সাদা রঙের ট্রি-শার্টের উপরে কালো রঙের জ্যাকেট। সাথে জিন্স এবং ব্ল্যাক লোফার। শান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আড় চোখে তানবীরকে উপর থেকে নিচ পরখ করল। দেখতে মাশাল্লাহ ভালো-ই। শান্তর দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটল তানবীরের খোঁচাযুক্ত কথায়,

— ‘ দেখতে হলে ভালোভাবে দেখ। এরকম আড়-টাড় চোখে দেখার মানে কি? ‘

শান্ত থতমত খেয়ে গেল। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

— ‘ নিজেকে কোন ছবির হিরো মনে করেন? আমি মোটেই আপনাকে দেখছিলাম না। ‘
— ‘ তারমানে বলতে চাইছ তোমার চোখে সমস্যা আছে? আই মিন তুমি ট্যারা? ‘
— ‘ একদম বাজে বকবেন না। ‘
— ‘ তুমি বাজে কাজ করতে পারো আর আমি বললেই দোষ? ‘
— ‘ আপনি… আপনি একটা অসহ্য। ‘

শান্ত চোখ-মুখ শক্ত করে তানবীরের থেকে কয়েককদম পিছিয়ে আসলো। একা থেকে এতক্ষণ বোর হচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই রকম সহযাত্রীর থেকে একা থাকা বেশ ভালো। শান্তর এমন বিরক্তিপূর্ণ মনোভাব দেখে তানবীর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। কিন্তু তার হাসিটা দীর্ঘায়িত হতে পাড়ল না। মুহূর্তেই তার চোখ-মুখ লালচে বর্ণে পরিণত হলো। সাথে শক্ত হলো হাতের মুঠি। সে রাগ মিশ্রিত চোখে শান্তর দিকে এগিয়ে গেল। বিনাবাক্য তার গায়ের জ্যাকেটটা শান্তর শরীরের উপর দিয়ে দিলো। তারপর রাগী চোখে শান্তর থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ছেলেগুলোর দিকে তাকালো। সম্ভব হলে সবগুলোকে সে এখনই কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।
সে বারকয়েক লম্বা শ্বাস টেনে শান্তর বামহাতটা নিজের ডানহাতে নিয়ে নিলো। শক্ত করে চেপে ধরে সামনে হাঁটা দিলো।
শান্ত বেচারি আকষ্মিক এমন কান্ডে পুরোপুরি থতমত খেয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই সে দ্রুত বলল,

— ‘ কি হচ্ছে টা-কি? এমন করার কি অর্থ? ছাড়ুন আমার হাত, ব্যাথা পাচ্ছি আমি। ‘

তানবীর ছাড়ল না। এমনকি সামান্য টু শব্দটা অব্দি করল না। শুধু লাল চোখগুলো নিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। ব্যস এতেই কাজ হলো। শান্ত আর কথা বাড়িয়ে ধমক খাওয়ার চিন্তা বাদ দিলো।
বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন জমজমাট পূর্ণ এলাকা। আর এখন যেহেতু ট্রেনের সময় তাই লোকসমাগম আরও বেশি। তানবীর এদিক-ওদিক তাকিয়ে খালি জায়গা খোঁজতে লাগল। কিন্তু না, তেমন কোনো কিছু চোখে পড়ছে না। সে শান্তর হাত ধরেই ফ্রুটঅভার ব্রিজ দিয়ে দুই নাম্বার প্লাটফর্মে গেল। এদিকটা বেশ নীরব। পরিবেশের সাথে শান্তও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তানবীর তাকে লোকচক্ষুর থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়ে থামল।
এতক্ষণ পর এমন একটা কথা শান্তর উপর রীতিমতো বাজ পড়ার মতো করে পড়ল। সে গোল গোল চোখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তানবীরের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। তানবীর এবার পিঠ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। তারপর নিচুস্বরে আবারও বলল,

— ‘ ইনারওয়ার ঠিক করো। সম্ভব হলে আমার জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে রাখ। পরনের জামাটা বেশ পাতলা। ‘

শান্ত এতক্ষণ অবাক হলেও এবার সে লজ্জায় নতজানু হলো। তানবীরের থেকে এমন একটা কথা সে স্বপ্নেও আশা করেনি। এখন লজ্জায় প্রায় মাটির ভিতরে চলে যাবার অবস্থা।
সে তানবীরের থেকে আরও কয়েককদম পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করল। এখনতো তানবীরের চোখের দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগবে। তাই সে মাথা নিচু করে রাখল৷ তানবীর অতটাও অবুঝ নয়। তাই শান্তর ইতস্ততবোধটা সহজেই ধরতে পাড়ল। সে আর এই প্রসঙ্গে কথা বলল না। কিছুক্ষণ আগের সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দিয়ে বলল,

— ‘ কফি খাবে? সাদিরা বোধহয় এখনও এসে পৌঁছাতে পারেনি। এলে আমাদের ফোন দিবে। ‘

শান্ত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁবোধক সম্মতি জানালো। তানবীর শান্তকে প্লাটফর্মের চেয়ারে বসিয়ে রেখে তাদের জন্য কফি আনতে গেল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তাদের জন্য ওয়ানটাইম গ্লাসে ফিল্টার কফি নিয়ে হাজির হলো। শান্তর দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে সেও শান্তর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তার পাশে বসল। তানবীরের জ্যাকেকটা অবশ্যই শান্তর সাইজের চেয়ে বড়। তাই সে খানিকটা টানাটানিতে রয়েছে। শান্তকে এমন করতে দেখে তানবীর বলে উঠল,

— ‘ ভালোভাবে পরে নাও। তাহলে এমন লাগবে না। ‘
— ‘ আপনি পরবেন না? ‘

তানবীর উত্তর দিলো না। সামনে তাকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিলো। শান্ত কফি খেতে খেতে এবার জ্যাকেটটাও পরে নিলো। এবার শান্তর শান্তি লাগছে। তার চেহারায় হাসি হাসি ভাব ফোটে উঠল। তানবীর আড়চোখে সবটাই খেয়াল করেছে। তার চোখে-মুখে মুগ্ধতারা এসে ভিড় জমাতেই সে নিজের উপর-ই বিরক্ত হলো। বারবার সে নিজের অজান্তেই এই মেয়েটার নিকট চলে আসে। আর সে তার মায়াজাল তানবীরের শক্ত খোলস ভাঙতে উঠে পড়ে লাগে। তানবীর বিরক্ত। নিজের উপর-ই সে এখন চরম বিরক্ত।
ফোনের ভায়োব্রেশনের আওয়াজে তানবীর বিরক্তিভরা চাহনি নিয়েই পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিলো। অপরদিকে শান্তর ফোনেও কল এসেছে। তারা দুইজন-ই একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। আর একসঙ্গেই বলে উঠল,

— ‘ তারা চলে এসেছে। ‘

.

অর্ণব-প্রিয়তীর সপরিবারসহ তাদের বন্ধু বান্ধবদের জন্য ট্রেনের পুরো একটা বগি রিজার্ভ করা হয়েছে। এটাও কনের-ই ইচ্ছার বদলে। সে ট্রেনের জার্নি করে শ্রীমঙ্গল অব্দি হইহট্টগোল করে যেতে চায়। পরিবারের কেউই এতে অমত পোষণ করেনি। অর্ণব তার কান্ডে ঠোঁট টিপে হাসছে। এই মেয়ের যে দুইদিন পর বিয়ে এটা কে বলবে? প্রিয়তী অর্ণবকে হাসতে দেখলেই লজ্জা পেয়ে তাকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে। আর অর্ণবের তাতে হাসির পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
অবশেষে কিছুটা লেইট করেই ঢাকা-সিলেট অভিমুখী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে হাজির হলো। তারা সবাই একএক করে তাদের বগিতে উঠল।
সাদিদ নীলাকে জানালার পাশে বসিয়ে নিজেও তার পাশেই বসল। নীলার দৃষ্টি অর্ণব আর প্রিয়তীর ফ্যামিলির বিবাহিত মেয়েমানুষদের উপরে। সাদিদ প্রথম থেকেই তাকে খেয়াল করেছে। এবার কিছুটা উৎসাহের জোরে প্রশ্ন করে বসল,

— ‘ পাখি তখন থেকে একদৃষ্টিতে কি দেখছ? কিছু লাগবে তোমার? ‘
— ‘ না, না কিছু লাগবে না। ‘
— ‘ তাহলে কি দেখ? ‘
— ‘ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়মগুলো দেখছিলাম। দেখেন সব বিবাহিত আপুরা শাঁখাসিঁদুর পরে রয়েছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনারা বিবাহিত। ‘
— ‘ হ্যাঁ এটাতো তাদের ক্ষেত্রে কমন বিষয়। ‘
— ‘ হ্যাঁ সেটা ঠিক। কিন্তু আমাদের ইসলাম ধর্মের মেয়েদেরকে এমনভাবে চিহ্নিত করা যায় না। এই যে দেখুন আমিও বিবাহিত। কিন্তু আমাকে দেখে কি এমনটা বুঝার উপায় আছে? ‘

সাদিদ এতক্ষণে নীলার উৎসুক দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পাড়ল। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে সে বাঁকা হাসল। আশেপাশে মানুষজনের অভাব নেই। সাদিদ একপলক ব্যস্ত জনগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে নীলার প্রায় শরীর ঘেঁষে বসল। নীলা তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কি করতে চাইছে এই ছেলে?
সাদিদ নীলার জামার উপর দিয়ে নিজের একটাহাত হালকা করে চেপে ধরল। তারপর নীলার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ এখানে কেউ আসলে বুঝতে সুবিধা হবে। কি বলো, আসার ব্যবস্থা করব? ‘

নীলার পুরো মুখ লালাভ আভায় ছেয়ে গেল। কি বলল এই দুষ্টু ছেলেটা? নীলা সাদিদকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরাল। তারপর দ্রুত জানালার বাহিরে মুখ দিয়ে নিজের অতিরিক্ত লজ্জা লুকাতে চাইল। সেটা সম্ভব না হলেও সাদিদের ধমক খাওয়া মিস হলো না।

— ‘ এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? মাথা ভিতরে আনো। এখনি হকারদের জিনিসপত্রের সাথে লেগে মাথায় ব্যাথা লাগত। ‘

নীলা নিঃশব্দে মাথা ভিতরে এনে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে পড়ে রইল। আসলে এখন সাদিদের মুখোমুখি হওয়া তার জন্য ভীষণ লজ্জাকর। কিন্তু কথায় আছে না? যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়৷ সাদিদের থেকে এত লুকাচুরি খেলেও অবশেষে তার হাতেই ধরা দিতে হলো।
রাগী সাদিদ রকেটের গতিতে আবারও দুষ্টু সাদিদে পরিণত হলো।
সে নীলার পিছন দিক দিয়ে একটাহাত নিয়ে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। নীলা টের পেয়েও চোখ খোলল না। সাদিদের চোখে তাকালেই সে এখন লজ্জায় আহত হবে।
সাদিদ বোধহয় সবটাই বুঝতে পাড়ল। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর নীলার মুখের উপর চলে আসা ছোট চুলগুলোকে যত্নের সাথে নিজের বামহাতে কানের পিছনে গোঁজে দিলো। সাদিদের তপ্ত নিঃশ্বাসের স্পর্শ মুখে লাগতেই নীলা এবার কাঁপা চোখজোড়া ধীরে ধীরে খোলল। সাদিদ তাকে চোখ খোলতে দেখে মৃদু হাসল। তারপর নীলার চোখের দিকে তাকিয়ে-ই আদরমাখা কন্ঠে বলল,

— ‘ তুমি চাওনা এখানে কেউ আসুক?
আমিতো চাই। আমাদের ভালোবাসার রাজ্যে আরেকটা মিষ্টি রাজকন্যার আগমন হোক সেটা আমি খুব করে চাই। ‘

নীলা আর পাড়ল না। লজ্জা পেয়ে অবশেষে নিজের লজ্জার উৎপত্তিস্থলকেই লজ্জা নিবারণের জন্য বরাদ্দ করল। সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে সে কাঁপা কন্ঠে বলল,

— ‘ নির্লজ্জ একটা। ‘

সাদিদ আবারও হাসল। নীলার লজ্জারাঙা মুখটা তার বরাবরই ভীষণ পছন্দের। যখন লজ্জায় লালাভ বর্ণে তার মুখ ছেয়ে যায় তখন সাদিদের জাস্ট চোখ ধাঁধিয়ে আসে। একি সাথে নিজেকে প্রাণপাখির মুগ্ধতার চাদরে আবরণযুক্ত পায়, আর অপরদিকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এক কঠিন যুদ্ধে নামতে হয়। প্রকৃতপ্রেমিক বা প্রকৃত স্বামীরা-ই হয়তো বুঝতে সক্ষম এই যুদ্ধে বিজয় লাভ করা কতটা ভয়াবহ। কতটা কঠিনসাধ্য।

#চলবে…

[ পাঠকগণ আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো জানতে আগ্রহী। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here