গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৭
প্রিয়তী এবং অর্ণবকে বিয়ের জন্য হলুদ-চন্দন এবং দুধ দিয়ে গোসল করানো হচ্ছে। নীলাসহ দুইপরিবারের সবাই মোটামোটি এখানে উপস্থিত। এক এক করে কনে এবং বরকে হলুদ মাখাচ্ছে সবাই। মৌলভীবাজার জেলার গিয়াসনগরে দুসাই রিসোর্ট এন্ড স্পা অবস্থিত। নীলারা শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত ট্রেনে এসে বাকি রাস্তাটা রিসোর্টের কার বুক করে চলে এসেছে। কেননা অর্ণব আর প্রিয়তীর ওয়েডিং প্রিপারেশন এখানেই করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথের দুরত্বে এই রিসোর্টের অবস্থান। সুদৃশ্য লেক এবং পাহাড়ের ওপর সবুজ বনানী পরিবেষ্টিত এই রিসোর্টটি অবকাশ যাপনের জন্য একটি আদর্শ স্থান।
প্রিয়তীর ভীষণ পছন্দের জায়গাতে এই সিলেট অবস্থিত। সিলেটের প্রকৃতিক সৌন্দর্য বরাবরই তাকে খুব টানে। তাই নিজের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটা সে এখানেই কাটাবে বলে মনোবাসনা করেছে। নরমালি বিয়েতে কনেরা একটু লাজুক, একটু চুপচাপ থাকে। কিন্তু প্রিয়তীর ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই উল্টো হচ্ছে। সবার থেকে হাসিখুশি সে নিজেই। কনের এমন চঞ্চলতা দেখে সবাই মুখটিপে হাসছে। প্রিয়তীর মা-বাবাও হাসছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মেয়েটাকে দূরে চলে যেতে হবে ভাবলেই অশ্রুসিক্ত চোখগুলো মুছিয়ে নিচ্ছে।
সবার এমন হাসি-আনন্দের মধ্যে নীলাকে বেশ অস্থির দেখা যাচ্ছে।
নীলা আশেপাশে তাকিয়ে বারবার তাকেই খোঁজে চলেছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কোনো হদিস নেই।
একটু দূরে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকা তানবীরকে দেখা যাচ্ছে। নীলা ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো। এই ছেলের আবার কি হয়েছে? মুখটা এমন বাংলার পাঁচ কেন?
কিন্তু আপাতত এসবদিকে সে তাকাতে চাচ্ছে না। তাই সোজা গিয়ে তানবীরের সামনে দাঁড়াল। কোনো বণিতা ছাড়া বলে উঠল,
— ‘ ভাইয়া উনাকে দেখেছেন? অনেকক্ষণ যাবত দেখছি না। ‘
তানবীর কপাল কুঁচকে নিলো। তার বিরক্তিমাখা মনে আবারও যেন শব্দটার প্রতিধ্বনিত হলো। সে কিছুটা বিরক্তিভরা চেহারা নিয়েই বলল,
— ‘ উনাকে মানে কাকে? ‘
— ‘ আরে আপনার বন্ধুর কথা বলছি। দেখেছেন উনাকে? ‘
তানবীরের বিরক্তি যেন এবার আকাশ ছুঁয়েছে। মেয়েমানুষ কত কিছুই না করতে পারে। এই যেমন সামান্য একটা সম্বোধন নিয়েও তাদের যেন অতিরঞ্জিতা। এককথায় অপরজনকে কনফিউশান করতে তারা এক্সপার্ট। সে আড়চোখে ডানদিকে তাকিয়ে আবারও কপাল কুঁচকে নিলো। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বলল,
— ‘ ঘণ্টাখানেক আগে রুমে দেখেছিলাম। এরপর আর নজরে পড়েনি। ‘
বলেই সে নীলার থেকে দুরত্ব আরও বাড়িয়ে আনলো। নীলা একপলক সেদিকে তাকিয়ে সাদিদ যেই রুমে উঠেছে সেই রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
তামবীর এতক্ষণ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালেও এখন একবারে শান্তর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তানবীরের হঠাৎ এমন আগমনে রিয়াদ নিজের হাতটা শান্তর কাঁধ থেকে নামিয়ে আনলো। যেটা হাস্যরত শান্ত বেচারি এতক্ষণ খেয়াল-ই করেনি। কিন্তু তানবীর তীক্ষ্ণ চোখে সবটা খেয়াল করেছে। আর বলাবাহুল্য লুচির মতো ফোলেছে।
— ‘ এত হাসাহাসির কি হয়েছে? মনে তো হচ্ছে হাসতে হাসতে এখন-ই অক্কা পাবার অবস্থা। ‘
— ‘ আর বলবেন না। রিয়াদ ভাইয়া কি যে হাসির কৌতুক জানে। আপনি শুনলে আপনারও হাসি পাবে। ‘
শান্ত হাসতে হাসতেই কথাটা বলল। রাগীস্বরের তানবীরের ঠোঁটের কোণেও এক চিলতে হাসির রেখা দৃশ্যমান হলো। শান্তর রিয়াদের জন্য ভাইয়া ডাকটাই মূলত তার এই খুশির কারণ। কিন্তু রিয়াদ বেচারা তাদের মতো খুশি হতে পাড়ল না। সে দুঃখভরা কন্ঠে বলল,
— ‘ শান্ত তুই আমাকে ভাইয়া বললি কেন? আমরা না সেইম ইয়ার, তারউপর একি এলাকার? ‘
— ‘ কিন্তু বয়সে তো আমার থেকে বড়। ‘
— ‘ ক্লাস তো সেইম। ‘
— ‘ আচ্ছা যা আর বলব না। এবার খুশি? ‘
বলেই শান্ত হাসল। আর তার সাথে তাল মিলিয়ে এবার রিয়াদও মৃদু হাসছে। কিন্তু স্থানান্তর রূপে তানবীরের হাসিটা যেন রিয়াদের কাছে চলে গেল। নতুবা তার মুখ আবারও এমন গম্ভীর কেন?
সে আর একমুহূর্ত এখানে দাঁড়াল না। হাতের মুঠি শক্ত করে সামনে হাঁটা ধরল। শান্ত একপলক সেদিকে তাকালেও মাথা খুব একটা ঘামাল না। তানবীরকে সে বুঝতে পারে না। এই নরম তো এই গরম। অদ্ভুত লোক!
তানবীর তাদের থেকে বেশ অনেকটা দূরে এসে বেঞ্চে বসল। কিন্তু দৃষ্টি তার এখনও সেই দক্ষিণ দিকের মেয়ে-ছেলের উপর।
সে আবারও একটা রাগ মিশ্রিত বিরক্তির শ্বাস ফেলল।
বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠার পর থেকেই তানবীরের এই বিরক্তি শুরু হয়েছে। শান্ত আগে গিয়েই মধ্যম সারির জানালার পাশের সিটে বসেছিল। তানবীরও তারপাশের সিটটা দখল করতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পথিমধ্যেই তাকে থেমে যেতে হয়েছিল। কেননা ততক্ষণে তার-ই সিটটা অপরজন বেশ হাসিমুখে দখল করে নিয়েছে।
শান্তর পাশে কেউ বসাতে সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছিল। মুহূর্তেই তার মুখটা অবাকের চূড়ান্ত পযার্য়ে এসে ঠেকেছিল। গোল গোল চোখজোড়া নিয়ে সে প্রায় চেঁচিয়ে ডেকে উঠেছিল,
— ‘ রিয়াদ! ‘
ব্যস তারপর থেকেই দুইজনের এই কথোপকথন শুরু। পুরোটা রাস্তা তারা একেবারে বিরামহীনভাবে কথার সাগরে ডুবে ছিল। তানবীরও রাগমিশ্রিত চেহারা নিয়ে শান্তর বরাবর পিছনের সিটে বসেছিল। সেই অজুহাতে আড়িপেতে সে সবটা শুনে নিয়েছে।
এই বিরক্তির চিহ্নিত প্রধান আসামি রিয়াদ হলো শান্তর ক্লাসমেইট। ক্লাস এইট পর্যন্ত নাকি তারা একসাথেই পড়াশোনা করেছে। এবং ভাগ্য নতুবা তানবীরের জন্য দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের গ্রামের বাড়ি একি জায়গায় অবস্থিত। তাই দুইজনের মধ্যে ভাবও অনেক। এতো বছর পরে আবারও প্রিয়তীর বিয়ে উপলক্ষে তাদের দেখা হয়েছে। কেননা পড়াশোনার এক পর্যায়ে রিয়াদের বাবার চাকরির ট্রার্ন্সফার হয়ে যায়। এবং তারা সপরিবারে রংপুর চলে যায়।
কিন্তু আজ রিয়াদের সপরিবার এখানে হাজির হয়েছে। প্রিয়তীর বাবা পঙ্কজ সেনের খুব ভালো বন্ধু হচ্ছেন রিয়াদের বাবা। সেই কারণেই তারা এখানে উপস্থিত।
একজন ওয়েটার কোল্ড ড্রিংক্স সার্ভ করছিল। তানবীরকে দেখে সে তার দিকে এগিয়ে আসলো।
— স্যার ড্রিংক্স দিব? ‘
— ‘ সম্ভব হলে বরফ দাও। মাথা প্রচন্ড গরম। সামান্য ড্রিংক্সে কাজ হবে না। ‘
ওয়েটার ছেলেটা থতমত খেল। অবিশ্বাস্য চক্ষুজোড়া নিয়ে চমকিত কন্ঠেই বলল,
— ‘ স্যার সত্যিই বরফ দিব? ‘
তানবীর এবার রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকালো। অর্থটা এমন যে আর একটা কথা বলে মাথা খেলে তোকেই কাঁচা খেয়ে ফেলব। ছেলেটা দ্রুত নিজের জান বাঁচিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল।
তানবীর আবারও বিরক্তিভরা চাহনি নিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। এই মেয়েটার হাসি তার বরাবরই ভীষণ পছন্দের। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন যেন সেটা তানবীরের কাছে বিষাক্ত পদার্থের ন্যায় মনে হচ্ছে। বড্ড বিদঘুটে!
_____________________
নীলা বেশ কিছুক্ষণ যাবত সাদিদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পায়চারী করছে। কিন্তু ভিতরে যেতে দ্বিধা কাজ করছে। কেননা তাদের বিয়ের বিষয়টা সবার মতো এখানেরও কেউ জানে না। তাই দুইজনে আলাদা রুমেই উঠেছে। সাদিদ-তানবীরের জন্য এই রুম বরাদ্দ। তাই নীলার এতো দ্বিধাদ্বন্দ্ব। যদিও তানবীরকে নীলা এইমাত্র বাহিরে দেখে এসেছে। তবুও কেউ যদি তাকে এমনকরে সাদিদের রুমে যেতে দেখে তাহলে হয়তো মন্দ ভাবতে পারে। কিন্তু এতভেবেও সে নিজেকে স্থির করতে পাড়ল না। অবশেষে মনের কাছে হার মেনে দরজায় নক করল।
কিন্তু না ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না৷ নীলা খানিকবাদে আবারও নক করল। কিন্তু এবারও ভিতর শব্দহীন।
সাদিদ-ই তো। সম্পর্কে নীলা তার বউ হয়। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে নীলা দরজার লকে হাত দিলো। ভিতর থেকে লক করা নেই। তাই লক ঘুরাতেই দরজাটা খোলে গেল।
কিন্তু ভিতরের দৃশ্য দেখে নীলার চোখ প্রায় কপালে। সে কয়েক মুহূর্ত বড়বড় চোখ করে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। পরমুহূর্তেই পেট চেপে শব্দ করে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। সাদিদের মুগ্ধ হবার কথা থাকলেও আপাতত সে পাড়ছে না। নীলার দিকে সে চোখ গরম করে তাকালো। নীলা তার তাকানো দেখে মুখ চেপে ধরেছে। কিন্তু হাসি তার কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। সে বিছানায় বসে সাদিদের দিকে তাকিয়ে অনবরত হেসেই যাচ্ছে।
কেননা সাদিদ বেচারা কাজের চক্করে থ্রি কোয়ার্টারের উপর পুরোপুরি কোট-টাই পরে মিটিং এটেন্ড করছে। বেচারার ব্যস্ততা দেখে নীলা খানিকটা দুঃখবোধ করল।
এই কাজের জন্যই সাদিদ নীলাকে ঠিকমতো সময় দিতে পাড়ছে না। আর না পাড়ছে বন্ধুর বিয়েটা ঠিকঠাক এনজয় করতে। অপরদিকে তাদের বিয়েটাও পিছিয়ে গেল কেবলমাত্র এই কাজ নামক ব্যস্ততার জন্যই।
হাসিবুর রহমানকে এমারজেন্সিতে এভরোড যেতে হয়েছে। সেখানে মিনিমাম মাস খানেক তার থাকতে হবে। অফিস সামলানোর জন্য শাহেদ-সাদিদকের উপর পুরোপুরি দায়িত্ব পড়েছে। এতদিন নিজের ল্যাব সামলিয়ে সাথে অফিসে সময় দিয়ে সাদিদের হাতে বাড়তি কোনো সময়-ই থাকত না। তাই নীলার থেকে এই দুরত্ব।
এখন হাসিবুর রহমান ফিরে আসা অব্দি এভাবেই চলবে৷ বয়স হলেও অফিসের পুরো দিকটা এখনও তিনি-ই দেখে চলেছেন৷ ছেলেদেরকে এত দ্রুত অফিসের বেড়াজালে ফেলে ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ থেকে তিনি বঞ্চিত করতে চান না৷ তাই ধীরেসুস্থে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু তার হঠাৎ এমন অনুপস্থিতিতে শাহেদ-সাদিদকে বড্ড বেগ পেতে হচ্ছে। শাহেদ-নিধি এইজন্যই অর্ণবের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেনি। কেননা সাদিদকে এখানে অবশ্যই আসতেই হবে। সেখানে শাহেদও যদি চলে আসে অফিস কে দেখবে?
ঢাকাতে অর্ণব-প্রিয়তীর রিসিপশনের আয়োজন করা হবে। তাই শাহেদ কথা দিয়েছে তখন তারা উপস্থিত থাকবে। শেষ পর্যায়ে অর্ণবও পরিস্থিতি বুঝে মেনে নিয়েছে।
সাদিদ এখন সেই কাজেই ব্যস্ত। মিটিংয়ে তো আর এমন ক্যাজুয়াল লোকে এটেন্ড করা যায় না। তাই বাহির দিয়ে সব ঠিকঠাক দেখিয়ে তার এমন অদ্ভুত লুক।
নীলাও সেটা বুঝতে পাড়ছে। কিন্তু হাসি আসলে তার কি দোষ?
সাদিদ নীলার এমন হাসিতে বড্ড বিরক্ত। সে বারবার চোখগরম করে ইশারায় তাকে শাসিয়ে যাচ্ছে। ক্লাইন্ট ভিডিও কলে আছে বিধায় মুখে কিছু বলাও যাচ্ছে না। আর এই পরিস্থিতিটার-ই চূড়ান্ত ফায়দা নীলা উঠিয়ে নিচ্ছে।
— ‘ মিস্টার হেনরি, দ্যান ইমেইল মি রেস্ট অফ দ্য ডিটেইলস। আই উইল চেক এন্ড ইনফর্ম দ্য ফাইনাল ডিসিশন। ‘
— _____________ ‘
— ‘ গুড বাই। সিউ ইউ সুন। ‘
সাদিদ ক্লাইন্টের সাথে মিটিং শেষ করে লেপটপটা বন্ধ করল। নীলাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়ে সে সোফা থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা লক করল। সাদিদকে দরজা লক করতে দেখে নীলার এবার হাসি থেমে থেমে আসছে।
সাদিদ পরনের কোটটা খোলে সোফায় ছুঁড়ে ফেলল। গলার টাইটা লুজ করে শার্টের হাতাটা গুটিয়ে নিতে নিতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— খুব হাসি পাচ্ছিল? তাই না, খুব হাসি? ‘
নীলা ভয়ার্ত চোখে দ্রুত ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। কিন্তু সাদিদ থামল না। কটমট চাহনি নিয়ে নীলার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই সে এবার বিছানা ছেড়ে দৌড়ে অপর পাশে গেল। সাদিদও কি হার মানবার পাত্র নাকি?
পাখিকে কিভাবে খাঁচায় বন্দি করতে হয় সেটা তার খুব ভালো করেই জানা আছে।
— ‘ আরে তুমি এমন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছ কেন? আমরা কি এখানে দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি নাকি? ‘
— ‘ এতসব বুঝি না। আপনার ভাব-ভঙ্গি আমার কাছে ঠিক ঠেকছে না। দূরে থাকুন আমার থেকে৷ ‘
— ‘ ওহ্ তাই? এতক্ষণে তোমার মাথা কাজ করতে শুরু করেছে? বাট সরি বেবি ইট’স টু লেইট। ‘
বলেই সাদিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। তার এই বাঁকা হাসিতে নীলার বুকে মুচড় দেবার অবস্থা। ভয়ে তার হাত-পা ইতিমধ্যে কাঁপাকাপি শুরু করেছে। সাদিদ এবার একপা একপা করে নীলার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। নীলা ভয়ে পিছিয়ে আসছে। আর মনে মনে বলতে লাগল কোন কুলক্ষণে যে সেই এই রাক্ষসের রুমে আসতে গেল। এবং অন্যায়জনকভাবে হেসেও ফেলল।
সাদিদ এবার পায়ের গতি বাড়িয়ে পুরো বিছানার চারপাশে নীলাকে দৌড়ানি দিচ্ছে। নীলাও শেষপর্যন্ত বাঁচার তীব্র লড়াই করছে।
কিন্তু অবশেষে তাকে হার মানতে হলো। সাদিদ চোখের পলকে পিছিয়ে গিয়ে নীলার কোমড় জড়িয়ে তাকে উপরে তোলে নিলো। সে ক্রমাগত ছুটবার জন্য দাপাদাপি শুরু করেছে।
সাদিদ তার এসব পাত্তা না দিয়ে সোজা এনে তাকো বিছানায় ফেলল৷ তারপর নিজের ভরটুকু নীলার উপর দিতেই সে মৃদু আওয়াজ করল,
— ‘ আহ্। ‘
— ‘ এতটুকুতেই কাহিল? ‘
— ‘ এতটুকু! হাতির মতন শরীর নিয়ে পিঁপড়ার উপর উঠেছেন। তারউপর আবার বলছেন এতটুকু? ‘
— ‘ কি আমি হাতি? তোমার সাহস দিনদিন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ‘
কথাটা বলেই সাদিদ নীলার হাতদুটো নিজের হাত দিয়ে বিছানায় শক্ত করে চেপে ধরল। হালকা ব্যাথায় নীলা আবারও ব্যাথাজনক শব্দ করল। তবুও হার মানল না। তেজ দেখিয়ে বলল,
— ‘ সত্যি কথা-ই বলেছি। ‘
— ‘ওহ্ তাই বুঝি? তাহলে সত্যবাদী নীলাঞ্জনা, এবার সত্যি সত্যি শাস্তিটুকুও ভোগ করেন। ‘
— ‘ মানে! কিসের শাস্তি? ‘
— ‘ যুগ পাল্টেছে। এতদিন পিঁপড়া হাতিকে কামড় দিয়ে আসলেও আজ হাতি পিঁপড়াকে কামড় দিবে। ‘
— ‘ মা..নে? ‘
— ‘ মানে হচ্ছে এই যে…
সাদিদ বাক্যটুকু শেষ না করেই নিজের মুখটা একেবারে নীলার মুখের কাছে এগিয়ে আনলো। নীলার চোখ-মুখ অনবরত কাঁপছে। সাদিদ নীলার গালে আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতেই নীলা চোখ খিঁচে বন্ধ করল। সাদিদ সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। পরমুহূর্তেই করে ফেলল ভয়ংকর এক কাজ। নীলা ধরফরিয়ে চোখ খোলে চমকিত দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। গালটা রীতিমতো জ্বলছে তার। সে চোখ-মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠল,
— ‘ অসভ্য একটা। ‘
— ‘ এখনও শিক্ষা হয়নি? তোমাকে তো আজ সোজা করে তবেই আমি দম নিব। ‘
সাদিদ এবার নীলার অপরগালেও ভালোবাসার কামড় বসালো। কিন্তু তাকে শায়েস্তা করার জন্য অন্য সময়ের তুলনায় অনেকটা জোরে কামড় দিলো। নীলা ব্যাথা পেলেও এবার আর মুখে প্রকাশ করল না। তীক্ষ্ণ স্বরে আবারও সাদিদদের দিকে অপবাদের তীর ছুড়ল।
— ‘ অসভ্য। ‘
সাদিদ এবার নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছে। জামাই যেমন জেদি বউও জেদি। কিন্তু বলে না স্বামীদের পাঁজরের হাড় দিয়ে স্ত্রীগণ তৈরি। সেহেতু স্বামী অবশ্যই একদাপ এগিয়ে থাকবে। এবং এইটাই স্বাভাবিক। তাই সাদিদের কাছেও যে নীলাকে হার মানতেই হবে। সাদিদ তাকে হার মানতে বাধ্য করবে।
সে এবার নীলার ডানগালে হাত দিতেই নীলা নড়েচড়ে উঠল। উঠে গিয়ে বাধা দিতে চাইল। কিন্তু সাদিদের সঙ্গে পাড়লে তো?
সাদিদ তাকে বিছানার সাথে আরও শক্ত করে চেপে ধরল। অতঃপর নীলার গালে হাতে রেখে নিজেদের উষ্ঠদ্বয় এক করল। সামান্য একটু ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে পরমুহূর্তেই ভালোবাসার-ই বিষ ঢাললো। নরম ঠোঁটে সাদিদের শক্ত কামড়ে নীলার আত্মা বেড়িয়ে আসার অবস্থা। কিন্তু তারপরও জেদ যে চেপেছে। তাই হার মানতে নারাজ।
সাদিদ উল্টো হাতে ঠোঁট মুছিয়ে নিতে নিতে বলল,
— ‘ এখনও বলবে? ‘
— ‘ অসভ্য, চরম অসভ্য। ‘
নীলা সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়ে দিলো। সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। সাদিদ দুষ্টু হেসে নীলার গলায় মুখ গোঁজল। সেখানেও কামড় বসাল। কিন্তু নীলার জেদ কমাতে পারেনি। নিজের অপবাদ সে কোনোভাবেই ফিরিয়ে নিবে না।
সাদিদও উঠেপড়ে লেগেছে। সেও দেখবে তার প্রাণপাখি কতক্ষণ নিজের জেদে বহাল থাকে।
সাদিদ নীলার জামার হাতাটা টেনে কাঁধ থেকে কিছুটা নিচে নামিয়ে আনলো। কাঁধের এমন বাহুর নরম অংশেও ধারালো দাঁতের কামড় বসাল।
নীলার কন্ঠ এবার ধীরে ধীরে লেগে আসছে। সে দ্রুত শ্বাস ফেলে আটকে যাওয়া গলায় আবারও বলল,
— ‘ অ…সভ্য। ‘
— ‘ এখনও এতো জেদ? আ’ম ইমপ্রেসড বউ। সাদিদ ইবনে শাহরিয়ারের ওয়াইফকে এমন এটিটিউডেই মানায়। অন্য ক্ষেত্রে হলে বাহবা দিতাম। কিন্তু বিষয়টা আমি রিলেটেড তাই এখন বাহবা নয়, অনলি পানিশমেন্ট হবে। আমার ভালোবাসার পানিশমেন্টে তুমি হার মানতে বাধ্য সুইটহার্ট। ‘
কথাটা বলেই সাদিদ উপর থেকে নিচ নীলাকে একবার পরখ করল। বিয়ের আমেজে সবাই শাড়ি পরলেও নীলা হলুদ আর সবুজের মিশ্রণের একটা চুড়িদার পরেছে। শাড়ি-টাড়ি সে খুব একটা সামলাতে পারে না। তাই এই বিকল্প ব্যবস্থা।
সাদিদ নীলার বন্ধ আখিঁ পল্লবের দিকে তাকিয়ে আচমকা তাকে নিজের বুকের উপর উঠিয়ে নিলো।
এমন আকষ্মিক কান্ডে নীলা দ্রুত চোখ খোলে তাকালো। নিজেকে সাদিদের উপর দেখতেই প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তার বিরক্তিকর স্বামীর দিকে তাকালো। নীলাকে পুরোপুরি জ্বালিয়ে মারছে এই ছেলে। নীলার কুঁচকানো ভ্রুজোড়া দেখে সাদিদ ডেবিল হাসি দিলো। অতঃপর নীলার চুড়িদারের পিঠের ফিতাটা একটানে খোলে দিলো। নীলা এবার বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকাতেই সাদিদের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি চোখে পড়ল। সাদিদের ভাবসাব কিছুটা এমন যে এখনও কিছুই হয়নি। হার না মানলে সামনে তার জন্য আরও বিপদ অপেক্ষা করছে।
নীলা নিজের শেষ চেষ্টাটুকু করল। কিন্তু সাদিদ তাকে ছাড়ল না। নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল। নীলার পরিহিত জামাটা কাঁধ থেকে কিছুটা নিচে নামিয়ে সাদিদ-ই বলে উঠল,
— ‘ এখনও অসভ্য বলবে? ‘
নীলার কন্ঠ মিইয়ে গেল। এই ছেলের সাথে পেরে উঠা তার সাধ্যের বাহিরে৷ নীরবতায় সম্মতির লক্ষণ প্রকাশ করে। নীলার ক্ষেত্রেও আপাতত সেইটাই বিবেচনা করা হচ্ছে। সাদিদ তাকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল,
— ‘ মনে থাকে যেন৷ এইবার মাফ করলাম। কিন্তু নেক্সট টাইম কখনও এমন দেখলে পুরোপুরি শেষ করে দিব। মাইন্ড ইট। ‘
সাদিদ বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। নীলার চোখের দিকে তাকাতেই খানিকটা অশ্রুর সমাগম দেখল। সাথে নীলার অভিমানী চেহারাটাও পরিলক্ষিত হলো।
সে গালে হাত দিতেই নীলা সেটা ঝটকা মেরে ফেলে দিলো। আবারও হাত দিলে আবারও এমন করল। তৃতীয়বারের মতো সাদিদ আর তাকে সেই সুযোগটা দিলো না। নিজের তৈরি করা ব্যাথাযুক্ত সব জায়গাতে ঠেসে চুমু খেল। অতঃপর অধরকোণে আদর দিয়ে সাদিদ তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বয়ছে তার। নীলাও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত হাঁপিয়ে যাচ্ছে। সাদিদ লম্বা কয়েকটা শ্বাস টেনে বলল,
— ‘ এমন রাগী লঙ্কাদেবী কবে হলে? এমনিতেই কি কম জ্বালাও, যে এখন আবার নতুন করে শুরু করেছ? ‘
— ‘ রাবণের রাজ্যে বসবাস করছি তো তাই সঙ্গ দোষে হয়ে যাচ্ছি। ‘
— ‘ তবে রে পাঁজি মেয়ে…
নীলাকে এবার আর পায় কে? সাদিদের বুক থেকে উঠে এক দৌড়ে সে দরজায়। বাহিরে গিয়েও সে আবার ভিতরে মুখ এনে দ্রুত গতিতে বলল,
— ‘ অসভ্যের উপরের যদি কিছু থাকে তবে সেটা আপনি। ইউ সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার, ইউ। ‘
— ‘ ফাজিল মেয়ে দাঁড়া…
সাদিদ বিছানা ছেড়ে নীলাকে ধরতে গেলেই সে হাওয়া। নীলা সমানে দৌড়াচ্ছে আর সাদিদকে মুখ দিয়ে ভেংচি কাটছে। প্রাণপাখির দুষ্টুমিভরা চেহারা দেখে সাদিদ এবার হেসে ফেলল।
— ‘ দুষ্টু পাখি। ‘
__________________
রাতের শেষ পহরে বিয়ের লগ্ন পড়েছে। তাই এখন অর্ণব-প্রিয়তীর উপোসভোগ চলছে। তারা বিবাহ সম্পূর্ণ হওয়া অব্দি অন্ন গ্রহণ করতে পারবে না। তাই হবু দম্পতি এখনই শেষ আহার করবে। দুইপরিবারের মেয়েগুলো শঙ্খ বাজাচ্ছে আর মুখ দিয়ে ক্রমাগত ওলু দিচ্ছে। অর্ণব প্রিয়তীর হাস্যউজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সবার সামনেই নিজের প্লেটের থেকে মুরগীর পিসটা পোলাওয়ের সাথে মেখে তার দিকে ধরল। সমবয়সীরা জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে। প্রিয়তী সবার সামনে এমন কান্ডে লজ্জা পেল। কিন্তু মুখ এগিয়ে খাবারের লোকমাটা নিজের মুখে নিলো। অর্ণব তার ঠোঁটের আশেপাশে হালকা ছড়িয়ে যাওয়া ভাতের কণাগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে। সেটা দেখে আবারও একবার হাসির ঝিলিক পড়ল।
নীলা-শান্ত সেদিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসছে। অল্প কয়েকদিন হলেও প্রিয়তীর সাথে তাদের বন্ডিংটা বেশ জোরালো। শান্ত-ই প্রথমে বলল,
— ‘ একে অপরকে খুব ভালোবাসে। তাই না? ‘
— ‘ হুম সেটা আর বলতে। ‘
— ‘ আমি কি কম বাসি শালিকা? নিজের বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ভালোবাসায় কমতি আছে নাকি নেই? ‘
সাদিদ নীলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে উঠল। নীলাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আবারও নিজের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করল,
— ‘ কি শালিকা, জিজ্ঞেস করো নিজের বান্ধবীকে৷ কিগো বউ, আদর-সোহাগে কমতি আছে? ‘
নীলা নিজের নির্লজ্জ বরটাকে পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো। শান্ত পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। তাদের এই অবস্থার মধ্যেই রিয়াদ এসে শান্তর পাশে দাঁড়াল।
— ‘ তুই এমন মাথামোটা কেন? জিজু এখন নীলকে নিয়ে ব্যস্ত। আর তুই কি-না কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হয়ে বসেছিস? ‘
— ‘ মাইর খাবি না রিয়াদ। দুইদিনে জিজু জিজু শুরু করেছিস? ‘
— ‘ তোকে দেখে বিরক্ত। তাই এখন জিজুকে দেখার পালা। তাই না জিজু? ‘
সাদিদ মৃদু হাসল। রিয়াদ শান্তকে একপ্রকার টানতে টানতে নিজের সাথে নিয়ে গেল। নীলা-সাদিদ বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখেছিল। যতক্ষণ না পর্যন্ত তানবীরকে রাগী দৃষ্টিতে তাদের পিছনে যেতে দেখে। নীলা-সাদিদ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
.
রিয়াদ শান্তকে নিয়ে সোজা রিসোর্টের খালি জায়গায় এসে দাঁড়াল। অর্ণব-প্রিয়তীর বিয়ের কার্যক্রমের জন্য এখানে ছাঁদনাতলা সাজানো হচ্ছে। দুইজন-ই বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে নিজেদের ধর্মের বাহিরে আলাদা এই সাজসজ্জা দেখছে। আচমকা শান্তর চোখে কিছু পড়তেই সে চোখ কচলাতে লাগল। পাশ থেকে রিয়াদের অস্থির কন্ঠ,
— ‘ এই ঠিক আছিস তুই? চোখে কি হয়েছে? ‘
— ‘ কি জানি একটা পড়েছে। বড্ড জ্বালা করছে। ‘
রিয়াদ আর দেরী করল না। শান্তর হাতটা সরিয়ে দিয়ে তার চোখ পরখ করতে লাগল।
তানবীর মাত্রই সেখানে এসেছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সে শান্তকে খোঁজার চেষ্টায় রয়েছে। তৎক্ষনাৎ সামান্য একটু দূরে চোখ যেতেই রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এসেছে তার। রক্তলাল চোখে সে সামনের দিকে তেড়ে গেল।
— ‘ কিরে এখন ঠিক আছিস? ‘
— ‘ হ্যাঁ এখন ঠিক আছে। পোকাটুকা কিছু পড়েছিল হয়তো। ‘
— ‘ আচ্ছা ভিতরে গিয়ে চোখে পানি দে। দেখবি ভালো লাগবে। ‘
শান্ত বেঞ্চ ছেড়ে কেবল উঠে দাঁড়াতেই নিচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগটুকু আর পাওয়া গেল না। তানবীর তার বাহুতে শক্ত করে চেপে ধরে তাকে দাঁড় করাল। এত জোরে ধরেছে যে শান্তর মাংস প্রায় হাড়ের সাথে লেগে যাবার অবস্থা। সে বিরক্তিমাখা কন্ঠে কিছু বলবে তাই আগেই তার দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটল।
তানবীর কষিয়ে তার গালে নিজের হাতের পাঁচ আঙ্গুল বসিয়েছে।
— ‘ নির্লজ্জ মেয়ে! তোকে আমি আলাদা মনে করতাম। কিন্তু তুইও এক৷ সব তোরা একই গোয়ালের গরু। নির্লজ্জ তুই, নির্লজ্জ তোদের এই নারীসমাজ। ‘
তানবীরের এমন অপমানসূচক বাক্য শান্তর শরীরে বিষাক্ত সুচের মতো ফুটছে৷ চোখজোড়া তার গালের ব্যাথা ভুলে এখন কষ্টে জর্জরিত। তার অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে তানবীর আরও ক্ষেপে গেল। ক্রমশ রাগীস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
— ‘ একদম মায়া কান্না কাঁদবি না৷ তোরা এই রূপ আর কান্না দিয়েই ছেলেদের বশ করিস। এই মেয়ে, এই লজ্জা করে না তোদের? একটা পুরুষে হয় না তােদের? নিজের তৃপ্তি মেটানোর জন্য কয়টা পুরুষকে তোদের প্রয়োজন? বল, কয়টাকে পেলে তোদের পুষাবে? ‘
অপমান-ঘৃণায় শান্তর এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সে আকষ্মিক এমন কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। কন্ঠস্বরও হয়েছে বাকরুদ্ধ। রিয়াদ অবাক দৃষ্টিতে এতোক্ষণ সবটা দেখলেও এবার সে রাগীস্বরে বলল,
— ‘ আপনার সাহস কি করে হয় আমার ফ্রেন্ডকে এসব বলার? কে দিয়েছে আপনাকে এতো অধিকার? ‘
— ‘ অধিকার! তাহলে তুই কোন অধিকারে ওর ঠোঁটযুগলে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিস? বল কোন অধিকারে? ‘
তাকে আর উত্তর বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। তানবীর বাক্যটুকু সমাপ্ত করেই নিজের রাগের ঝাঁঝ তার উপর প্রয়োগ করতে লাগল। সাদিদ এবার আর সবটা দাঁড়িয়ে দেখতে পাড়ল না। দৌড়ে এসে তানবীরকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল। নতুবা এই ছেলে নির্ঘাত এখন রিয়াদকে মেরে ফেলবে।
— ‘ সাদি ছাড় আমাকে। এই কুত্তাটাকে আমি মেরেই ফেলব। তারপর দেখব মরে গিয়ে কিভাবে মেয়েদের ঠোঁটের স্বাদ নিতে পারে। ‘
— ‘ দোস্ত চুপ কর। পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? ‘
— ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। পুরোপুরি পাগল হয়ে গিয়েছি। তুই কি ঠিক থাকতি? যদি নিজ ব্যতিত অন্য কাউকে নীলার ওষ্ঠযুগলে আবদ্ধ দেখতি? ‘
— ‘ তানবীর…
সাদিদের হাতটা কাঁপছে। কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান তৈরি করতে না পাড়লে এখন সেটা তানবীরের গালে অবস্থান করত। সাদিদের লাল চোখজোড়া আর কাঁপা হাত দেখে তানবীর মলিন হাসল।
— ‘ পাড়বি না। আর সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু দেখ, আমি পাড়ছি। একবার নয় একাধিক বার এমন ঘটনার সম্মুখীন আমি হয়েছি। দেখ আজকেও আবার হলাম। আই হেইট দোস গার্লস। আই হেইট দেম। ‘
শেষোক্ত কথাটা তানবীর ঘৃণাভরা চাহনি নিয়ে শান্তর দিকে তাকিয়েই বলল। তারপর গটগট পায়ে জায়গা থেকে প্রস্থান করল। শান্ত নীলার বুকে মুখ লুকিয়ে হেঁচকি তুলে কান্না করছে৷ জীবনে এত অপমানিত সে কখনও হয়নি। সাদিদ নিচে থেকে রিয়াদকে তুলল। বেচারার অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। সাদিদ অপরাধী কন্ঠে বলল,
— ‘ আ’ম এক্সটেমলি সরি রিয়াদ। তানবীরটা না..
— ‘ হি ইজ ক্রেজি। সার্চ এ মেন্টাল পার্সন। ‘
সাদিদ হাতের মুঠি শক্ত করে নিজের রাগ সংবরণ করল। বিয়ের মতো জমজমাট একটা পরিবেশকে এই ঘটনায় বিষিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই নীলাকে ইশারায় শান্তকে ভিতরে নিয়ে যেতে বলল।
আর তাকে এখন অন্যকাউকে সামলাতে হবে। যেমনটা বিগত দিনগুলোতে সামলিয়ে এসেছে। আজও আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে এই পাগল রূপের ভাইটাকে সামলাতে হবে।
#চলবে…