অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৩৪

0
4952

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৪

নিধি কপালে হাত দিয়ে বিরক্তমুখে বসেছে। বারবার একই কথা বলতে বলতে সে এখন বেশ ক্লান্ত। কিন্তু যে এর ক্লান্ততার মোক্ষম কারণ সে পুরোপুরি ভাবলেশহীন। কন্ঠে তার একই অভিযোগ,

— ‘ পবাই পঁচা। ‘

মা-ছেলের এমন মান-অভিমানের পর্বের মধ্যেই কলিংবেল বেজে উঠল। নিধি শাদমানের দিকে একপলক তাকিয়ে দরজা খোলতে এগিয়ে গেল। দরজায় ভিজে জবজবে সাদিদকে দেখতেই তার ভ্রুযুগল আপনশক্তিতে কুঁচকে এলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে চিন্তিত কন্ঠে বলল,

— ‘ এমন ভিজেছ কিভাবে? তাড়াতাড়ি উপরে গিয়ে চেইঞ্জ করে নাও। নয়তো অসময়ের বৃষ্টিতে ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

সাদিদ কাঁধের ব্যাকপ্যাকটা নিচে নামিয়ে মৃদু হাসল। অতঃপর ভিতরে ডুকতে ডুকতে নিধির উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ ভাবীমণি, একটা কড়া করে কফি। ‘

নিধি তার কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসল। সাদিদও হাসিমুখেই উপরে যাবার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু সোফায় মুখ ফুলিয়ে শাদমানকে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। তার হাবভাব পরখ করে নিধির দিকে তাকালো। নিধি প্রতিউত্তরে মৃদু হাসি উপহার দিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বিষয়টা এমন যে নিজের ভাতিজাকে এখন তুমি সামলাও৷ আমার সময় শেষ।
সাদিদও নিঃশব্দে শাদমানের পাশে গিয়ে বসল। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে ছোট শাদ আড়চোখে একবার তাকালো। পরমুহূর্তেই সোফার একেবারে কিনারায় গিয়ে চেপে বসল। সাদিদ ভ্রুজোড়া কুঁচকে তার মতিগতি খেয়াল করছে। এই পাঁজির আবার কি হয়েছে?

— ‘ বাবা, কি হয়েছে তোমার? ‘
— ‘ পা.পু পঁচা। পবাই পঁচা। ‘

সাদিদ তার কথায় হাসল। শরীর পুরোপুরি ভিজে আছে। তারপরও তাকে টেনে নিজের কাছে আনলো। সে নিজের ছোট্ট শরীরটাকে সাদিদ থেকে প্রাণপণে ছুটাতে চায়ছে। কিন্তু না পেরে অভিযোগের স্বরে বলল,

— ‘ পা.পু ব্যাড বয়। আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। দাদুন, দাদাভাই পা.পু ব্যাড বয়৷ ‘
— ‘ আরেহ এতরাগ আমার বাবাটার? কি হয়েছে? ‘

শাদমান আবারও মুখ ফুলিয়ে বসতেই তানহা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই উত্তর দিলো,

— ‘ তাকে নিয়ে যাসনি। তাই সে রাগ করেছে। সকাল থেকেই মুখ ফুলিয়ে বসা। ‘

সাদিদ তানহার আওয়াজ পেয়ে কিছুটা চমকিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরল। কিন্তু যাকে দেখে এমন বিস্ময়ভাব সে একেবারে স্বাভাবিক। সাদিদ কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর কন্ঠে স্বাভাবিকতা এনে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

— ‘ তুই! কখন আসলি? ‘
— ‘ আজকে সকালেই এসেছি। মামির থেকে শুনলাম তোর শ্রীমঙ্গল যাওয়ার খবর। ‘
— ‘ অর্ণব তোকে অনেকবার কল করেছিল। কিন্তু বরাবরই তোর ফোন বন্ধ ছিল। বেচারা অনেকবার কল করেছে। ‘
— ‘ তুই একবারও করেছিস? ‘

সাদিদ নিজের দৃষ্টি সরাল। তানহা তার নীরবতা দেখে নিঃশব্দে হাসল। উত্তর যা পাওয়ার সেটা পেয়ে গিয়েছে। সে এবার সম্পূর্ণ বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়ে বলল,

— ‘ উপরে গিয়ে জলদি চেইঞ্জ করে নে। নতুবা অসময়ের বৃষ্টিতে জ্বর এসে যাবে। ‘

সাদিদও আর কথা বাড়াতে চাইল না। ছোট্ট শাদমানের দিকে একপলক তাকিয়ে সে উপরে চলে গেল। আপাতত সে তানহার সম্মুখীন হতে চায় না৷ এইজন্যই দ্রুত এখান থেকে চলে যাওয়া।
সাদিদ উপরে যাবার কিছু মুহূর্ত পরই নিধি কফি হাতে কিচেন থেকে বেড়িয়ে আসলো। তানহা তার হাতে কফির মগ দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

— ‘ ভাবী, কফি কার জন্য? ‘
— ‘ সাদিদ চেয়েছিল। ‘
— ‘ ওহ আচ্ছা। আমাকে দাও। আমি দিয়ে দিব। ‘

নিধি কিছু মুহূর্ত একটু ইতস্ততবোধ করলেও পরমুহূর্তেই তানহার হাতে ট্রে-সহ কফির মগটা দিয়ে দিলো। তানহাও সুন্দর মতন উপরের দিকে চলে গেল। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিধি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। এনগেজমেন্ট পার্টি থেকেই নিধি তানহার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত। কিন্তু হাতে করার মতো কিছু ছিল না। কেননা আর যায় হোক জোর জবরদস্তিতে ভালোবাসা হয় না। কিন্তু তানহার একপাক্ষিক ভালোবাসায় খারাপ লেগেছিল। তার উদাসীনতা দেখে ভীষণ কষ্টও লেগেছিল।
কিন্তু হুট করেই এনগেজমেন্টের পরদিনই তানহার এভাবে বান্দরবন চলে যাওয়ায় সে একটু অবাক-ই হয়েছিল। সে একা নয় বরং তার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত যারা ছিল তারা সকলেই না চাইতেও একটু অবাক অবশ্যই হয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেদেরকে বুঝ দিয়েছে তানহার একা একটু স্পেস দরকার। নিজেকে সামলিয়ে নেবার জন্য। সুন্দরভাবে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য। এবং হয়েছেও তেমনটাই। ফিরে আসার পর থেকেই নিধির ব্যহিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তানহা বেশ স্বাভাবিক। এমনকি হিসেবের থেকে একটু বেশি-ই নরমাল তার চালচলন। যেমনটা দেখতে মানাসই হলেও বড্ড সন্দেহজনক। কেমন যেন নিভৃতে রহস্য চেপে রাখা৷
নিধি আপনমনে মৃদু হাসল। সেও না কি থেকে কি ভাবছে! হঠাৎ করে তানহার এতটা স্বাভাবিক দেখেই তার হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তাই মাথায় এমন উলটপালট চিন্তা এসে ভর করছে। সে দ্রুত সেগুলোকে অদেখা করে মাথা ঘুরিয়ে শাদমানের দিকে তাকালো। সে এখনও মুখটা ফুলিয়ে বসে রয়েছে। নিধি হেসে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো নিজের মুঠিতে নিয়ে বলল,

— ‘ আব্বাটা এখনও রেগে আছে? ‘
— ‘ হুম। ‘
— ‘ মাম্মা কি করলে রাগ কমবে? ‘
— ‘ রাগ কমবে না। রাগ শুধু বাড়বে। ‘
— ‘ আরেহ্ বাপরে। আমার ছোট্ট বাচ্চাট এত বড় কিভাবে হয়ে গেল? বড়দের মতো রাগ করছে। ‘

শাদমান একপলক নিধির দিকে তাকালো। চোখ-মুখ তার খানিকটা কুঁচকে রয়েছে। সে নিধির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো চালিয়ে রুমের দিকে চলে গেল। নিধি আর তার পিছনে ছুটল না। বরং ফোনটা হাতে নিলো। কেননা এখন তার পিছনে ছুটলে ক্ষতি বৈকি লাভ হবে না। তাই সে পুত্রের অভিমান ভাঙানোর মাধ্যম খুঁজল। বারকয়েক রিং হতেই অপরপাশ থেকে শাহেদের রসিকতা মিশ্রিত কন্ঠ কানে আসলো,

— ‘ আরেহ আজ সূর্য কোন দিক দিয়ে উঠেছে? ‘

নিধি ভ্রুযুগল কুঁচকে শাহেদের কথাটা শ্রবণ করল। অতঃপর মর্ম বুঝতে না পেরে বলল,

— ‘ মানে? ‘
— ‘ নরমালি তো আমার বউয়ের তার জামাইয়ের জন্য সময়-ই থাকে না। আজ হঠাৎ মনে পড়াতে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। ‘
— ‘ ধ্যাত। আপনার যত আজাইরা কথা। ‘

তার কথাতে অপরপাশে শাহেদ মৃদু হাসল। নিধিও মিষ্টি হেসে বলে উঠল,

— ‘ শুনুন না। ‘
— ‘ জ্বি বউ বলুন না। ‘
— ‘ আমি কিন্তু ফোন রেখে দিব। ‘
— ‘ মাসে একবার ফোন দিয়ে আবার রেখে দিবার ধমকি দিচ্ছ? বিয়ের বয়স যত বাড়ে ভালোবাসাটা তত কমে। কথাটা আসলেই চিরন্তন সত্য। ‘
— ‘ আচ্ছা হার মানলাম আপনার কাছে। কথাতে পারা যায় না। কিন্তু এবার যেই কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম সেটা কি বলতে পারব? ‘
— ‘ বলুন মহারাণী। আপনার সেবায় এই পুরুষ সবসময় নিয়োজিত। ‘
— ‘ আপাতত আমার সেবা লাগবে না। নিজের প্রাণপ্রিয় পুত্রকে দেখুন। সকাল থেকে ভালোভাবে কিছুই খায়নি। রেগে মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছে। এই মুহূর্তে ছেলের তার বাপকে প্রয়োজন। আপনি সম্ভব হলে আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে আসবেন প্লিজ? ‘
— ‘ অবশ্যই। তুমি বললে আর বাপ তার ছেলের কাছে হাজির। আমি জলদি ফিরছি। ‘

নিধি মাথা নুইয়ে মৃদু হাসল। অতঃপর ফোন রেখে নিজের অবশিষ্ট হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে চলে গেল।

__________________

সাদিদ একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিয়েছে। নতুবা অসময়ের বৃষ্টি বড্ড খারাপ। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতেই রুমে তানহার আগমন ঘটল। শার্টলেস থাকাতে তানহার সামনে সে বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। দ্রুত তোয়ালে গায়ে দিয়ে ওয়ারড্রব খোলে ট্রি-শার্ট বের করে পরে নিলো। তানহা পুরোটা সময় চুপচাপ থাকল। একেবারে শান্ত। যেন বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
সাদিদ নিজেকে ঠিক করে তানহার উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়ল,

— ‘ কফি তুই নিয়ে আসলি যে? আমিতো ভাবীমণিকে বলেছিলাম। ‘
— ‘ আমি নিয়ে আসাতে সমস্যা কি? না-কি এখন আমার নিয়ে আসা কফি খেতেও তোর আপত্তি! ‘

সাদিদ আর হা বা না-বোধক কিছু বলল না। তানহার হাত থেকে কফিটা নিয়ে বিছানায় বসে তাতে চুমুক বসাল। তানহা তার নীরবতা দেখে টেবিলের উপর রাখা একটা বক্স তার দিকে এগিয়ে দিলো।
সাদিদ ভ্রুজোড়া কুঁচকে তার হাতের দিকে তাকাতেই তানহা হালকা হেসে বলে উঠল,

— ‘ তোর আর নীলার জন্য। বান্দরবনের আদিবাসীদের বিক্রিত কিছু সামগ্রী। সবার জন্যই টুকটাক কিছু এনেছি। এটা তোর আর নীলার। সুবিধার জন্য দুইজনেরটা একসাথেই দিলাম। ‘

সাদিদ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইছে৷ কিন্তু বারবার তানহার ব্যবহারে তার দৃষ্টি চমকে পরিণত হচ্ছে। বিষয়টাকে সে স্বাভাবিক ভাবতে চাইলেও মাথার ভিতর অনবরত অন্য কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা তানহা বরাবরই সাদিদের সাথে উল্টো পাল্টা আচরণ করে এসেছে।
কিন্তু কয়েকদিন আগে হুট করে চলে যাওয়া৷ আর তারপর ফিরে এসে সবকিছু এতটা হালকাভাবে নেওয়া। না চাইতেও বিষয়টা নিয়ে তাকে ভাবতে হচ্ছে।
তাকে অন্যমনস্ক দেখে তানহা এবার কিছুটা অভিযোগের স্বরে বলল,

— ‘ এতটা পর করে দিলি? তুই জানিস আমাকে। আর আমার অনুভূতি সম্পর্কেও। নিজেকে সামলাতে না পেরে না-হয় একটু-আধটু পাগলামি করেছিলাম। তাই বলে এখনও সবকিছু ধরে বসে থাকবি? বন্ধু হিসেবে কি মানতে এতটা কষ্ট হবে? ‘

সাদিদ এবার ঠোঁটের কোণে সরু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। সে প্রকাশ না করলেও তানহার থেকে এমনটাই সে বরাবর আশা করে গিয়েছে। তাই তানহার এইরূপে সাদিদ তাকে সাধরে গ্রহণ করতে রাজি। সে হাসিমুখেই বলল,

— ‘ থেক্স ইয়ার। তুই নিজেও জানিস না আমি কতটা খুশি হয়েছি। থেক্স এ লট দোস্ত। ‘

তানহা বিস্তৃত হাসল। আজ কতটা বছর পর সাদিদ তাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছে। এমন হাসিমুখ নিয়ে দুটো কথা বলেছে। সে অপলক এই হাস্যউজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। সময়ের গতি বাড়তে গেলেই আচমকা সে থমকে গেল। নিজেকে ধাতস্থ করে আর কিছু না বলে সাদিদের রুম থেকে হাসিমুখে বেড়িয়ে আসলো।
সাদিদ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মৃদু হাসল। সে বেশ খুশি। নিজেকে কিছুটা একান্ত সময় দিয়ে তানহাকে বেশ রিফ্রেশ লাগছে। সে কফিটুকু শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। পাশ থেকে লেপটপটা নিয়ে প্রিয়তমার স্মরণে মননিবেশ করল।
.

ফোনের আওয়াজে নীলা চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বেডসাইড টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলো। সাদিদ কল করছে দেখে সে মিষ্টি হাসল। অতঃপর ফোনটা রিসিভ করতেই অপরপাশে প্রিয় মানুষটার মুখ ভেসে উঠল।
নিঃশব্দে কেটে গেল ক্ষীণ মুহূর্ত। নীরবতার চাদর সরিয়ে নীলা নতজানু হয়ে বলল,

— ‘ এভাবে কি দেখেন? ‘
— ‘ আমার পাখিকে। বউকে। অর্ধাঙ্গিনীকে। ‘

নীলা লজ্জায় মাথাটুকু আরও নামিয়ে নিলো। সারা মুখ ছেয়ে গেল রক্তিম আভায়। এই ছেলেটা কথায় কথায় বেশ লজ্জা দিতে পারে। নীলাকে লজ্জায় নতজানু হতে দেখে সাদিদও ঠোঁট কামড়ে হাসল। অতঃপর বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,

— ‘ বউ, গালগুলো আর আপেল করতে হবে না৷ নতুবা টাপুস করে এসে টুপুস করে খেয়ে নিব। ‘

নীলা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকালো। পরমুহূর্তেই সাদিদের কথা বুঝতে পেরে বরাবরের মতোই চুপসে গেল। বিড়বিড় করে আওড়াল,

— ‘ অসভ্য পুরুষ। ‘
— ‘ ওরফে তোমার বর। ‘

বলেই সে ঠোঁট এলিয়ে হাসল। যেন এটা খুবই গৌরবের বিষয়। সে লেপটপটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে ক্লোজেট থেকে ফর্মাল কিছু ড্রেস বের করতে লাগল। নীলা তা দেখে কিছুটা কপাল কুঁচকে তাকালো৷ সাদিদকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই সে বলল,

— ‘ দেখ তো পাখি, কোনটা পরব? ‘
— ‘ কোথাও যাবেন আপনি? ‘
— ‘ একটু অফিসে যেতে হবে। ‘
— ‘ এই সময়? ‘
— ‘ হুম। বাবা তো এখনও ফিরেনি। ভাইয়া ফোন করেছিল। শাওয়ার নিচ্ছিলাম তাই শুনিনি। তাই টেক্স করেছে। ফ্রি থাকলে একটু যেতে বলল। তার নবাবপুত্র রাগের সাথে অভিমানের পাল্লা ভারী করেছে। তাই তার উপর রাগ ভাঙানোর জোরালো তলব পড়েছে। ‘

নীলা হেসে কুটিকুটি। এটা মোটামোটি বেশ পরিচিত তাদের নিকট। শাদমান রাগ-অভিমান নিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসবে। আর তখন শাহেদ এসে ছেলেকে হ্যান-ত্যান করে রাগ কমাবে। সত্যিই বাপের ছেলে। বাপ ছাড়া কিছুই বুঝে না এই পিচ্চি।
নীলাকে এমনকরে হাসতে দেখে সাদিদও হাসল। অতঃপর তাড়া দিয়ে বলল,

— ‘ আরে হাসাহাসি পরে করো। আগে বলো কোনটা পরব? ‘
— ‘ যেইটা ইচ্ছা পরেন৷ আপনাকে সবকিছুতেই ভালো লাগে। ‘

সাদিদের দুষ্টু মাথায় এবার দুষ্টুমি চাপল। প্রাণপাখির রাগী মুখটা দেখার আশায় সে বলল,

— ‘ তারপরও। আমাদের অফিসে কতশত মেয়ে কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের সামনে যেমন-তেমন ভাবে কি যাওয়া যায়? ‘

নীলা কিছু মুহূর্ত থম মেরে সাদিদের বাক্যটুকু শুনল৷ অতঃপর কপট রাগীস্বরে বলল,

— ‘ তাহলে ছেলেদের পার্লারে চলে যান৷ একেবারে সেজেগুজে বর সেজে চলে যাবেন৷ ‘

সাদিদের হাসি পাচ্ছি। তারপরও সে হাসিটুকু আটকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

— ‘ আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু সময় সল্পতার কারণে আপাতত সম্ভব হয়ে উঠছে না। কিন্তু নেক্সট টাইম মিস হবে না। ‘

বলেই সে ফ্রুল ব্ল্যাকের একটা সুট তোলে নিলো। তা দেখে নীলা ফোনের অপরপাশ থেকে হুড়মুড়িয়ে বলে উঠল,

— ‘ একদম না। একদম না৷ এইটা ভুলেও পরা যাবে না। অন্যকিছু। ‘

সাদিদ একপলক লেপটের স্ক্রিনে নীলার ভাসমান মুখশ্রীতে তীক্ষ চোখে তাকালো। কিন্তু বিনাবাক্য অপর একটা ড্রেস তুলে নিলো। এবারও নীলার একি বারণ। এসব করে করে সাদিদ বেশ কয়েকটা ড্রেস বের করল। আর নীলা বরাবরই সেগুলো নাকচ করল।
সাদিদ এবার সবগুলো ড্রেস বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বুকে হাত বেঁধে নীলার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিষ্পলক চেয়ে রইল। নীলা তার চাহনি দেখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তারপরও সাদিদকে নড়তে চড়তে না দেখে অভিযোগের কন্ঠে বলল,

— ‘ এমন করে তাকিয়ে কি দেখেন? ‘
— ‘ আমি দ্রুত যাওয়ার জন্য তোমার সহযোগিতা চাইলাম৷ তুমি উল্টো আমার লেইট করছ। ‘

নীলা মাথা নিচু করে ক্রমাগত নখ খুটতে লাগল। সে মুখ ফোটে কিভাবে বলবে যে, সবগুলোতেই সাদিদকে বড্ড আকর্ষণীয় লাগে। আর নীলা চায় না তার সৌন্দর্য নীলা ব্যতিত অপর কেউ উপভোগ করুক। শত হলেও বাঙালি মেয়ে। আর যাই হোক স্বামীর ভাগ কোনোমতেই স্ত্রী ছাড়তে পারে না৷ সেটা নীলা হোক বা অন্য যে কেউ। না চাইতেও মনের খচখচানিটা আপনাআপনি শুরু হয়ে যায়। সেটা ইনসিকিউরিট বা বিশ্বাসের জন্য নয়। সেটা হচ্ছে এক প্রিয়তমার তার প্রিয়তমকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে। যেমনটা একজন মা সন্তানের সৌন্দর্যে নজরটিকা পরিয়ে দেন। তেমনিভাবে স্ত্রীগণ স্বামীকে খারাপ নজরের থেকে লুকিয়ে রাখতে খানিকটা হিংসুটে রূপ ধারণ করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কিন্তু তাদেরকে সবক্ষেত্রে ভুল বুঝা উচিত নয়। সীমালঙ্ঘনের আগমুহূর্ত অব্দি তাদেরকে ভালোবেসে আগলে রাখতে হয়। হোক না সে কিছুটা হিংসুক। কিন্তু দিনশেষে এই অপবাদটা কিন্তু সে আপনার জন্যই হাসিমুখে গ্রহণ করছে। তাহলে আপনি কেন স্বামী হয়ে তার মনোভাব বুঝতে পারবেন না? ভালোবাসে বলেই তো হারিয়ে ফেলতে ভয় পায়।
নীলাকে আবারও নীরবতার চাদর গায়ে দিতে দেখে সাদিদক কিছুটা অস্থিরতা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

— ‘ পাখি, আমার লেইট হচ্ছে। ‘
— ‘ আচ্ছা, সবসময় এত ভালো ভালো ড্রেস কিনতে আপনাকে কে বলেছে? কিছু খারাপ কালেকশন থাকলে সমস্যা কি? ‘
— ‘ মাথা খারাপ তোমার? টাকা নষ্ট করে কেউ খারাপ জিনিস কিনে? ‘
— ‘ তাহলে এখন আমি কি করব? এই ছেলেটাকে সবকিছুতেই ভালো লাগে। ধ্যাত। এত সুন্দর হতে কে তাকে বলেছে? এখন যতসব আমার ঝামেলা। ‘

নীলার বিড়বিড়িয়ে কথাটা অপরপাশ থেকে সাদিদ শুনতে না পারলেও তার মনোভাব বুঝতে বেগ পেতে হয়নি৷ সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। অতঃপর সামনে থাকা নীল-সাদা মিশেলে একটা সুট নিয়ে লেপটপের দিকে ঝুঁকে এলো। আবেগপূর্ণ কন্ঠে আওড়াল,

— ‘ যার নাম হৃদয়ে লেখা। যার অস্তিত্ব আমার অস্তিত্বে মেশা। যার তরে তে আমার বসবাস, সে বিনা কে আসবে এই হৃদমাঝারে? কার এতো দুঃসাহস?
তাই তাকে বলে দিও, আমি তার ছিলাম। রয়েছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব। এই হৃদয়ে সে ব্যতিত অন্য কারও জায়গা হবে না। সেটা এই সাদিদ কখনও হতে দিবে না। ‘

নীলা মুগ্ধ চোখে সাদিদের চোখে চোখ রাখতেই সে ঠোঁট বাঁকিয়ে চুমু দেখাল। অতঃপর ঠোঁটের কোণে সরু হাসির রেখা টেনে রেডি হতে ওয়াসরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
নীলা একদৃষ্টিতে যতটুকু সেদিকে সাদিদকে দেখা যায় তাকিয়ে রইল। সে দৃষ্টির বাহিরে যেতেই নীলা মাথা নুইয়ে নিজের মাথায় থাপ্পড় দিলো।

— ‘ গর্দভ। তুই চিনিস না তাকে? একেবারে দুষ্টুর শিরোমণি। তারপরও এমন মুর্খতা করার কোনো মানে হয়? ‘

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here