গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪১
রিক্সা ছুটে চলেছে তার আপন গন্তব্যের উদ্দেশ্য। ঘড়ির কাটার হিসাব করলে রাত বেশ গভীর। দিনের আলোয় ঢাকার এই ব্যস্ততা যেন এখন পুরোপুরি অনুপস্থিত। ঠিক যেন শান্ত-শিষ্ট একটা ভদ্র বাচ্চা। নীলা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে বসা সাদিদের দিকে তাকালো। সে এতক্ষণ নীলার দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে। নীলা বুঝতে পারে না তার মধ্যে এমন আহামরি কি রয়েছে যার দরুন এই ছেলেটার দৃষ্টির কখনও পরিবর্তন হয় না? সবসময় যেন চোখে-মুখে তার উপচে পরা মুগ্ধতা।
নীলা নতজানু হয়ে পায়ে পা দিয়ে আলতোভাবে ঘর্ষণ করতে লাগল। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আড়চোখে আবারও সাদিদের দিকে তাকাতেই তার ঝাপসা চোখগুলোর সম্মুখীন হলো৷ যা নীলার ভেতরটা পুরোপুরি এলোমেলো করে দিতে সক্ষম। নীলা দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে রিক্সার অপরপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বলাবাহুল্য সেটা রমণীর এলোমেলো অস্থিরতা মিশ্রিত এক দৃষ্টি। সাদিদ নিজের তীক্ষ্ণ চোখের গভীরতায় সবটাই পরখ করলো। তাই ঠোঁট কামড়ে ধরে স্লিকি চুলগুলোকে আঙ্গুল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করলো। তারপর নীলার দিকে আরেকটু মিশে বসে শাড়ি ভেদ করে পিছন থেকে উন্মুক্ত কোমড়ে নিজের হাত রাখল।
প্রকৃতিতে যতটুকু না শীতলতা বহমান সাদিদের উষ্ণ হাতের স্পর্শটা যেন নীলার শরীরে আরও এঁটে বসেছে। নতুবা এমন শিহরণ বয়বে কেন? আর কেন-ই বা দেহ এমন হিমশীতল বরফে পরিণত হবে?
নীলার শরীর মৃদুভাবে কাঁপছে। কিন্তু তারপরও সেটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে। কিন্তু দুষ্টু সাদিদ যখন কোমড়ে রাখা নিজের হাতটা নীলার কোমড়সহ পেটের আশেপাশে বুলাতে লাগত তখন আর নীলা স্থির থাকতে পারল না৷ কাঁপা চোখে-মুখে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। পরমুহূর্তেই আবার তাকালো সামনের রিক্সা চালকের দিকে। চালক একধ্যনে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে। নীলা একবার সাদিদকে দেখছে তো আরেকবার রিক্সা চালককে। আর ইশারায় সাদিদকে অনুরোধ করছে এমনটা না করতে।
কিন্তু সাদিদ কি এত সহজে কথা শুনার মানুষ? সে দিব্বি নিজের দুষ্টুমিতে মত্ত।
নীলা পরেছে বেকায়দায়। হাতের মেহেদী এখনও পুরোপুরি শুকায়নি। তাই হাত দিয়ে সাদিদের হাত ছাড়াতে পারছে না। নতুবা এতক্ষণের সব কষ্ট বিফলে যাবে। তার থেকে বড় কথা হলো এটা সে সাদিদের নামে পরেছে। তাহলে এতো সহজে ভালোবাসার মানুষের নাম কিভাবে নষ্ট হতে দিবে? আর এই সুযোগটুকুই সাদিদ যেন পুরোপুরি উশুল করে যাচ্ছে।
নীলার দিক থেকে সব দিকেই যেন বিপদ। কেননা নীলা খুব একটা নড়াচড়া করেও সাদিদকে ছাড়াতে পারছে না। নতুবা আওয়াজের শব্দে চালক তাদের দিকে অবশ্যই ফিরে তাকাবে। আর নির্লজ্জতা সাদিদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত থাকলেও তার তো এমন পরিস্থিতিতে পড়লে লজ্জায় মরে যাবার অবস্থা হবে৷ তাই নিজেকে যথাসম্ভব সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন আর সহ্য করতে না পেরে নীলা মুখে হাত চেপে আপত্তিকর শব্দ বের করা থেকে নিজেকে সংযত করতে চাইল, তখন সাদিদ আস্তেধীরে নিজের হাতটা হালকা করে দিলো। কিন্তু পুরোপুরি ছাড়ল না। নীলার বাহুচেপে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখল।
নীলা যেন এতক্ষণে হাফ ছেড়েছে। কিছুক্ষণ আগের পরিস্থিতি চিন্তা করলেই তার গায়ে রীতিমতো কাটা দিয়ে উঠছে।
বাসার থেকে খানিকটা সামনে এসে সাদিদ চালককে রিক্সা থামাতে বলল। নীলাকে এবারও সাদিদ নামতে সহায়তা করলো। আজকে একে তো নীলা শাড়ি পরা, তারউপর আবার হাতে মেহেদী ভরা। সাদিদ তার বাহুতে চেপে ধীরস্থির ভাবে রিক্সা থেকে তাকে নামালো৷ সাদিদ রিক্সা চালককে বিদায় করে দিয়ে নীলাকে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে লাগল। নীলা কয়েককদম যাওয়ার পর-ই নিচুস্বরে বলে উঠল,
— ‘ এতো রাতে রিক্সা বিদায় করেছেন কেন? আপনার যেতে তো সমস্যা হবে। ‘
সাদিদ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। কিন্তু প্রতিউত্তর জানালো না। শুধু আপনমনে বিড়বিড় করলো,
— ‘ বউটা এত বোকা কেন? ‘
সাদিদকে উত্তর না দিতে দেখে নীলা-ই আবার বলতে শুরু করল। এবার যেন তার কন্ঠস্বরে ভীষণ আপসোস।
— ‘ লোকে বলে বিয়ের আগের রাতে না-কি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে হয়। নতুবা বিয়ের দিন চোখের নিচে কালি পরে ভূতের মতো দেখা যায়। নিঃসন্দেহে কালকে আমাকে ভূতের রাণী লাগবে। কেননা ঘুমাবো আর কি? রাত যে প্রায় শেষের দিকে। ‘
সাদিদ তার কথায় নিঃশব্দে মৃদু হাসল। ততক্ষণে তারা বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাদিদ নীলাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার গালে নিজের বলিষ্ঠ হাতজোড়া স্থির করলো। সাদিদের ভাবভঙ্গি দেখে নীলা ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল,
— ‘ কি? ‘
সাদিদ তার এই প্রশ্নের উত্তরে কপালে গাঢ় চুমু খেল। অতঃপর একে একে বোকা মেয়ের সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগল,
— ‘ এইজন্য চালক ভাইকে পাঠিয়ে দিলাম। নতুবা আমার আর আমার বউয়ের মাঝের ভালোবাসাটা সে দেখে নিতো। যা আমি কখনোই চাই না৷ তুমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। তাই সবার সম্মুখে কিভাবে ভালোবাসাটা বিলিয়ে দিব? ‘
নীলা লাজুক হেসে মাথা নিচু করল। সাদিদও হাসল। পরমুহূর্তেই ঠোঁট কামড়ে ধরে নীলার কানের পিছনে ঠোঁট লাগিয়ে ফিচেল কন্ঠে বলল,
— ‘ আর কি যেন বললে? বিয়ের আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হয়। কথাটা অবশ্য ভুল নয়। কিন্তু তুমি এটা জানো কি? কনের মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়াও এর পিছনে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যে রয়েছে? ‘
নীলা সাদিদের চোখে চোখ রাখল। উত্তরটা তার জানা নেই৷ তাই সাদিদ বাঁকা হেসে নীলার ঘাড়ে ঠোঁট ঘষে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— ‘ যেন বাসর রাত নির্ঘুম কাটাতে গিয়ে সমস্যা না হয়। ‘
ইশশ! বড্ড নির্লজ্জ এই ছেলে। নীলা তাকে মৃদুভাবে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে চলে যেতে চাইল। আর অপরদিকে সাদিদ তার টমেটোর ন্যায় গাল দেখে হেসে ফেলল। পিছন থেকে পেট জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে আবারও তাকে লজ্জায় ফেলতে বলে উঠল,
— ‘ আমাদের অবশ্য প্রথম নয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিয়ের বাসর হিসেবে কিন্তু প্রথমবার-ই। তাই আমি তো দ্বিগুণ এক্সাইটেড। ডাবল হলে তো এক্সাইটেড লেবেলও ডাবল হবার কথা। তাই নয় কি? ‘
— ‘ অসভ্য একটা৷ ‘
নীলা লজ্জায় জড়সড় হয়ে ছুটার জন্য আবারও নড়াচড়া শুরু করলো। সাদিদ এবার হাসতে হাসতে তাকে ছেড়ে দিলো। মুখে হাসি নিয়েই বলল,
— ‘ বউ যে এতো লজ্জা কেন পায় আমিতো সেটাই বুঝি না৷ এত প্রেম করলাম, এতো আদর-ভালোবাসা দিলাম তারপরও বউয়ের লজ্জা ভাঙতে পারলাম না। বরং তার লজ্জা যেন আগাছার মতো ডালপালা মেলে বাড়তেই থাকে। ‘
— ‘ আমি যাচ্ছি। ‘
নীলা আর একমুহূর্তে দাঁড়ালো না৷ এই ছেলের কথার মধ্যেই যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেবার বিষ মিশ্রিত থাকে। নীলার শ্বাসটা কোন দিন না তার কথার জালেই বেড়িয়ে আসে!
কিন্তু যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়? সাদিদ কি এতো সহজে বাঁধন ছিন্ন করে?
সে পিছন থেকে নীলার শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে নীলার একেবারে কাছে চলে আসলো। শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে নিজের গালের সাথে তার গাল লাগিয়ে বলল,
— ‘ যাচ্ছি নয়। বলতে হয় আসি। আর আমিও আসব। কাল একেবারে বর সেজে আমার বউটাকে উঠিয়ে নিয়ে যাব। মধ্যকার দুরত্বটা বড্ড পীড়া দিচ্ছে পাখি। এতদিন যন্ত্রণা ভোগ করেছি। তাই কাল থেকে যন্ত্রণা নিরসনের দায়িত্ব তোমার। আমার সবটুকু যন্ত্রণা ভালোবাসা দিয়ে মুছিয়ে দিতে পারবে না? ‘
নীলা আর সহ্য করতে পারল না। সামনে ফিরে সাদিদের বুকে মুখ লুকালো। আর টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগল। সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। অতঃপর নীলার মাথায় ভালোবাসাময় চুমু খেয়ে তাকে বাহুবন্ধনে শক্ত করে আবদ্ধ করলো।
কিছু মুহূর্ত এই প্রেমিকযুগল একিভাবেই একে-অপরের উষ্ণতাটুকু অনুভব করল। তারপর নীলা-ই মাথা উঁচিয়ে নিচুস্বরে অনুমতি চাইল,
— ‘ এবার তাহলে আসি? ‘
সাদিদ নিজের মনকে বুঝতে পারছে না। কিন্তু নীলাকে তার ছাড়তে একেবারেই ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই আবারও নীলাকে বুক পাঁজরে টেনে আনলো। মাথাটা বুকের বামপাশে শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠল,
— ‘ আর একটু প্লিজ। ‘
নীলাও মৃদু হাসল। নিজের হাতদুটো দিয়ে সাদিদ পিঠ আঁকড়ে ধরল। আর সাদিদকে বুঝতে না দিয়ে লুকিয়ে বুকে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে নিলো।
সাদিদ মৃদু হেসে ফেলল। তার প্রাণপাখিটা বরাবরই এসব দিক দিয়ে পিছিয়ে। থাক সমস্যা নেই। তার ভাগের টুকু সাদিদ হাসিমুখেই পুষিয়ে দিবে।
সে নীলাকে ছাড়ল। কিন্তু পুরোপুরি নয়। মুখটা আঁজলাভরে ধরে চোখের পাতায়, গাল, কপালে চুমু দিয়ে আদর করলো। অতঃপর নীলার কম্পিত মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে আলতো করে প্রিয়তমার পাতলা অধরযুগলেও ছুঁয়ে দিলো। ভালোবাসাময় কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত করে বহু কষ্টে যেন শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ যাও৷ ‘
কন্ঠটাতে এতটা বিষাদ মিশ্রিত ছিল যে নীলার চোখজোড়া মুহূর্তেই ছলছল করে উঠল। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে? বা সাদিদ-ই হঠাৎ করে এমন কেন করছে?
নীলা উত্তর পেল না। কিন্তু প্রিয়তমকে কষ্টের পরিবর্তে একটুখানি সুখ দিতে সব বাঁধাগুলোকে পিছিয়ে ফেলল। সে পা উঁচিয়ে সাদিদের বুকের পাঞ্জাবিতে হাত মুঠি করে ধরল। সাদিদ নীলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ করে নীলা কি করতে চাইছে এটাই বুঝার চেষ্টায় নিয়োজিত। নীলা হাতদুটো ধীরে ধীরে সাদিদের গলায় নিয়ে ঠেকালো এবং তার মাথাটা খানিকটা নিচে নামাতে চেষ্টা করলো৷ কেননা সাদিদের উচ্চতা তার থেকে বেশি। পা উঁচিয়েও নাগাল পাওয়া কষ্টকর৷
সাদিদের কাছে যেন এতক্ষণে সবটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল। অধরকোণে ফুটে উঠল ঈষৎ হাসির রেখা। সে এবার নিজেই মাথাটা নিচু করলো এবং নিজের একহাতে নীলাকেও তার সাথে জড়িয়ে নিলো৷
নীলার চোখ-মুখ সমানে কেঁপে যাচ্ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁপছে তার সমস্ত শরীর। সে বারকয়েক লম্বা শ্বাস টেনে চোখজোড়া বন্ধ করে প্রিয়তমের ওষ্ঠযুগল চেপে ধরল। সাদিদ যেন এই মুহূর্তটার-ই অপেক্ষায় ছিল। এবার সেও নীলার কোমল পেলাভ ঠোঁটজোড়া নিজের মধ্যে পুরে নিলো। আর প্রিয়তমাকে সমানে আদর বিলিয়ে দিতে লাগল। যতক্ষণ না নীলা অস্থির হয়ে পড়ল ততক্ষণ একটানা প্রিয়তমা স্ত্রীকে ভালোবাসা মুড়ানো সোহাগ দিতে সে কৃপণতা করলো না।
সাদিদ তার থেকে নিজেকে আলাদা করতেই নীলা একমুহূর্ত ব্যয় না করে দৌড়ে গেইটের ভিতর ডুকে গেল। নতুবা এই মুহূর্তে সাদিদের চোখে চোখ রাখার তার একেবারেই সামর্থ্য নেই। লজ্জায় মরেই যাবে সে।
সাদিদ নীলার গমনপথের দিকে তাকিয়ে হাসল। পিছন থেকে নীলার মুখশ্রী নজরে না আসলেও সাদিদ বেশ বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে নীলার মুখটা কোন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক যেন পাকা লাল টমেটো। সে হাসি আটকে আপনমনে বলে উঠল,
— ‘ আমার লজ্জাবতী। ‘
_______________
গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত বিয়ে বাড়ির হইহট্টগোল আমেজটা যেন এখন আর নেই। ক্রমশই সবকিছু যেন বিষাদে পরিপূর্ণ। বড়দের সবার মাথায় হাত। তাদের এই গভীর ভাবনায় মগ্ন দেখে ছোট্টরাও যেন টের পাচ্ছে পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। তাই তারা নিজেদের দুষ্টুমিগুলোকে আপাতত নিজেদের মধ্যে বন্দি করেছে।
— ‘ নিধির বাবা, আর কতক্ষণ? এবার তো কিছু একটা করতে হবে। আর ছেলের পরিবারকেও কথাটা জানাতে হবে। ‘
এতক্ষণের সবার নীরবতা পাল্লা ছাপিয়ে বড় ফুফা হঠাৎই আরিফ মাহমুদের উদ্দেশ্য কথাটি বলে উঠলেন। তার কথাটা কানে পৌঁছাতেই আরিফ মাহমুদ আবারও চুপসে গেল। চোখে মুখে তার অসহায়ত্বের ছাপ। তিনি মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললেন,
— ‘ ভাই আর একটু দেখি। এখনওতো সময় আছে। যদি তার মধ্যে ভালো একটা খবর পাই? ‘
বড় ফুফা রাগি মানুষ। এতক্ষণ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হুংকার ছুড়লেন,
— ‘ সময় আছে! এখনও কোন মুখে এই কথা বলছো? কই আমাদের মেয়ে ছেলেও তো শহরে থেকে পড়াশোনা করছে। কিন্তু তারা তো তোমার মেয়ের মতো পরিবারের এমন নাক কেটে বসেনি। এইজন্যই বুঝি মেয়েকে এত আদর-যত্নে বড় করেছো? আমার মেয়ে হলে তৎক্ষনাৎ এমন মেয়েকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলতাম। ‘
আরিফ মাহমুদের দেহের লোমকূপগুলো যেন এমন কথার পরিবর্তে শিউরে উঠল। কলিজার টুকরো মেয়ের গায়ে যদি কেউ এমন কথা ছুড়ে দেয় তাহলে কলিজা যে পুড়ে কয়লা হতে চায়। তারও এমন অবস্থা। কিন্তু বড়দের সাথে এই মুহূর্তে বেয়াদবি করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটের দিকে যাবে। তাই তিনি মাথা নিচু করে চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে ধরলেন। আর নার্গিস খাতুনের উদ্দেশ্য ধরা গলায় বলে উঠলেন,
— ‘ নিধির মা, একগ্লাস ঠান্ডা পানি দিও। আমার ভিতরটা বোধহয় জ্বলে যাবে। ‘
_______________
পদ্মালয়ায় চলছে বউ আনার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। শায়লা রহমান চিল্লিয়ে সবাইকে তাড়াতাড়ি করতে বলছে। অন্যসব দিনে এইসব কাজ তিনি একা করলেও আজ ছোট্ট শাদমানও তার সঙ্গ দিয়েছে। সাদিদের মতো সেও বরের স্টাইলে শেরওয়ানি-পাগড়ী পরেছে। ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে দাদির পিছন পিছন সবাইকে তাগাদা দিচ্ছে।
— ‘ মা, পাপা আসো। বড় আপু আসো। দাদাভাই তাড়াতাড়ি আসো। পাপু আসো। দাদুমণি কেউ আসে না কেন? ‘
শায়লা রহমান এতক্ষণ সবার উপর বিরক্তিতে রেগে গেলেও এখন যেন এই পুঁচকের কথা শুনে বিরক্তি চলে গেল। শাদমানের বরাবর বসে মাথার পাগড়ীটা ঠিক করে দিয়ে বললেন,
— ‘ সবাইতো তোমার মতো ভালো না দাদাভাই৷ তাই আসে না৷ আমরা আজ সবাইকে বকে দিব। ‘
— ‘ নতুব বউকেও? ‘
— ‘ না। তোমার নতুন বউকে বকবো না। সে হচ্ছে লক্ষ্মি মেয়ে। ‘
— ‘ লল্ক্ষ…
— ‘ থাক দাদাভাই তুমি এটা বলতে পারবে না। নতুন বউ হচ্ছে ভালো মেয়ে। আমার মিষ্টি আরেকটা মেয়ে। ‘
শাদমান যেন এবার বেশ খুশি হলো। বিয়ে সম্পর্কে পুরোপুরি না বুঝলেও এটা বুঝে বিয়ে মানে বর-বউ। টিভি-মোবাইলের কৃপায় এই ছোট্ট বয়সে বিয়ে সম্পর্কে এতোটুকু ধারণা তার বেশ জন্মেছে। তাইতো সাদিদ-নীলার বিয়ে হবে জেনে ছোট্ট শাদমান নতুন বউ নতুন বউ করে বাড়ির সবাইকে অস্থির করে ফেলছে। নীলা যে তার খালামণি এটা সে মানাতে নারাজ। তার এককথা নীলা যেহেতু পাপুর বউ হবে সেহেতু তার নতুন বউ।
নীলা এমনিতেই লজ্জায় কাচুমাচু। আর যখন ছোট্ট শাদমান এই নতুন বউ বলে বুলি আওড়িয়ে মাথা খায় তখনতো আরও করুণ দশা।
সে এখনও দাদির পিছন পিছন নতুন বউয়ের বুলি ছেড়ে এগিয়ে আসছে৷ শায়লা রহমান সাদিদের রুমের সামনে এসেই আবারও বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,
— ‘ তোদের এখনও শেষ হয়নি? তোরা দেখি মেয়েদের মতো শুরু করেছিস। ‘
— ‘ হ্যাঁ মা এবার আমি একমত। কি শুরু করেছে এগুলো একটু দেখ৷ বলছি তাড়াতাড়ি কর কিন্তু কে শুনে কার কথা! বিরক্তিকর। ‘
— ‘ হা হা। মামা তুমি দেখি আর ধৈর্য্য কুলাইতে পারতাছো না। একটু সবুর করো। বিয়া কি বারবার করবা না-কি? ‘
— ‘ তাই বলে তোরা এসব করবি? আমি কি মেয়ে? এতো ঠিকঠাক আমার হয়ে কি কাজ? ‘
— ‘ দেখলি অর্ণব, শালাই পুরোই বউ পাগল। আধা ঘণ্টায় তার অবস্থা পাগল প্রায়। ‘
— ‘ এই চুপ। মুখ সামলা। ‘
সাদিদের রাগীচোখের ইশারায় তানবীর একপলক দরজায় দাঁড়ানো শায়লা রহমানের দিকে তাকিয়ে কেবলা হাসলো৷ শায়লা রহমান সবকটাকে আবারও তাড়াতাড়ি করতে বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আর রুম থেকে বেড়িয়েই এতক্ষণের চেপে রাখা হাসিটুকু দিয়ে দিলো। শাদমান হঠাৎ দাদিকে হাসতে দেখে বলে উঠল,
— ‘ দাদুমণি হাসো কেন? ‘
— ‘ তোমার নতুন বউ যে আসবে, তাই আসছি। খুশির বিষয়ে হাসতে হয়। ‘
— ‘ ওহ্। ‘
শাদমান কপাল কুঁচকে খানিকটা চিন্তা করলো। তারপর নিজেও এবার হাসল। সত্যিই তো তার নতুন বউ আসছে। এটাতো খুশির খবরই।
শাদমানরা চলে যেতেই তানবীর আবারও তার দুষ্টুমি বহাল রাখল,
— ‘ মামা, তোমার-ই জীবন। আহা! কি সুখ। বিয়ে করা বউরে আর কতবার বিয়া করবি মিয়া? ‘
সাদিদ আয়নার দিকে তাকিয়ে শেরওয়ানীর ব্রজটা ঠিক করতে করতে হাসল। বর সাজাটা কেমন যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। সেটা বোধহয় কেবল যারা এই মুহূর্তটার সাথে সাক্ষাৎ করেছে তারাই বুঝতে পারবে। সাদিদেরও আজ অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করেছে। পাঞ্জাবি আগেও পরা হয়েছে। কিন্তু আজকেরটা যেন অন্যসব দিনের তুলনায় একেবারে ভিন্ন। সে নিজের বেশভূষায় মৃদু হাসলো৷ অতঃপর আয়নার মধ্যেই তানবীরের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
— ‘ প্রয়োজন পড়লে হাজারবার। এরও অধিক হলে সমস্যা নেই। আমি সর্বদাই তাকে গ্রহণ করতে একপায়ে দাঁড়ানো৷ ‘
তানবীর-অর্ণব দুইজনই হাসিমুখে সাদিদের পিঠে চাপড় দিলো। দুইটা মিলে এতো জোরে দিয়েছে যে সাদিদ মৃদু ব্যাথা পেয়ে গেল। আর এটা নিয়েই আবারও তিন বন্ধু একদফা দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া করে ফেলল।
অবশেষে সাদিদ তাদেরকে থামাতে থামাতে অস্থির গলায় বলে উঠল,
— ‘ ভাই থাম। এবারের মতো আর না। সত্যিই এখন লেইট হচ্ছে। আমার বউটা অপেক্ষা করছে। ‘
— ‘ শালা বিয়া কইরা হানিমুন পর্যন্ত শেষ তারপরও আর কিসের অপেক্ষা? ‘
— ‘ হারামী, একবার না করছি। আর মাত্রই না তোকে বললাম হাজার বার করতে ইচ্ছুক। তাই সংখ্যা বাড়াতে তো দিবি? ‘
— ‘ তুই আর শুধরাইলি না। নীলা মানে আমাদের ভাবী জানে, তোমার এই নির্লজ্জ রূপ? ‘
— ‘ মামা, তোমার ভাবীর জন্যই তো সব নির্লজ্জতা। সে জানবে না তো কে জানবে? ‘
বলেই সাদিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখ টিপল। তার কথার ধরণে তানবীর-অর্ণব হেসে ফেলল। আবারও নিচ থেকে তাগদা আসতেই সাদিদ নিজেকে একপলক আয়নায় ঠিকঠাক দেখে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।
সাদিদরা নিচে নামতেই সবাই একএক করে বাসা থেকে বের হলো। বাসার সামনেই সব কটা প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়ানো। সাদিদের নিজস্ব চারটা গাড়িসহও আরও বেশ কয়েকটা গাড়ি বর যাত্রীর জন্য ভাড়ায় বরাদ্দ করা হয়েছে। বরের গাড়িতে সাদিদের সাথে শাদমান, নিধি এবং শাহেদ বসেছে। সাদিদ গাড়িতে বসেও বারবার ফোনে তাকাতেই সামনে থেকে শাহেদ টিটকারি দিয়ে বলে উঠল,
— ‘ শালিকার আমার বিরাট কপাল। জামাই তার বউ বলতে পাগল। ‘
নিধি পিছন থেকে তার বাহুতে থাপ্পড় দিতেই সে হাসতে হাসতে বলল,
— ‘ সমস্যা কি? তুমি আমায় আঘাত করো কেন? ঠিক-ই তো বললাম। ‘
— ‘ তোমার ঠিক তোমার কাছেই রাখো৷ বেশি ঠিক-বেঠিক বলতে হবে না৷ ‘
— ‘ তোমার দেখছি আমার সবকিছুতেই সমস্যা। বুঝলি সাদিদ, পুরোনো সবকিছুতেই যেমন জং ধরে তেমনিভাবে সম্পর্কেও জং ধরে। নতুন নতুন সবকিছুতেই ভালোলাগা ছিল। আর এখন দেখ, সবকিছুতেই তার খারাপ লাগে। তুই-ই ভালো। নতুন সবকিছু শুরু করবি৷ ভাবছি আমাকেও একটা নতুনত্বের ব্যবস্থা করতে হবে৷ ‘
শাহেদের এমন কথায় নিধি মুহূর্তেই রণমুর্তিতে পরিণত হলো। ছোট শাদমান ড্যাবড্যাব চোখে মা-বাবার খুনসুটিময় ঝগড়া দেখছে। আর সাদিদ শুধু শুনে যাচ্ছে। আর মুখে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।
কিন্তু কিছুতেই সে স্বস্তি খোঁজে পাচ্ছে না। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বললেও একমাত্র সে জানে নিজের মধ্যে কি চলছে৷ বুকে যেন তার তোড়পার হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নীলার উপর তার ভীষণ রাগও জমা হচ্ছে।
নীলাকে বলা হয়েছিল বিয়ের সাজ কমপ্লিট করেই যেন সাদিদকে সে ভিডিও কল করে। সর্বপ্রথম বধু রূপে নীলাকে সাদিদ-ই দেখতে চায়। কিন্তু সেই মহারাণী কল করবে কি, তার কোনো খবর-ই নেই৷ রাতের পর থেকে আর অনলাইনেও দেখা যাচ্ছে না। ফোনটা বন্ধ। সাদিদ জানে সে ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু তাই বলে কয়েকমিনিট নিয়ে কল করলে কি হয়? সে কি জানে না, সাদিদ তার অনুপস্থিততে অস্থির হয়ে যাবে?
সাদিদের মাথা কাজ করছে না৷ বারবার ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে আর অনবরত কল করে যাচ্ছে। আর বারবার অপরপাশ থেকে সুমধুর কিন্তু সাদিদের কাছে এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্তিকর এক কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। অর্থাৎ প্রিয়তমার ফোনটা সুইচঅফ।
মন মস্তিষ্কে চরম অস্থিরতা নিয়েই সাদিদদের গাড়ি এসে কনভেনশন সেন্টারের সামনে থামল। একে একে সবকটা গাড়ি এসে দাঁড়াতেই শাহেদ দরজা খোলে নিজে বেড়িয়ে নিধির পাশের দরজাটা খোলল। সাদিদ বের হতে গেলেই শাহেদ বলে উঠল,
— ‘একটু বস। কনে পক্ষের লোক এসে তোকে নামাবে। ‘
বাধ্য হয়ে সাদিদকে গাড়িতেই বসতে হলো। অপরদিকে নিধি-শাহেদ দুইজনই একে অপরের দিকে কিছুটা আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে তাকালো। কেননা কনে পক্ষ আসবে কি? ঐ বাড়ির কাউকেই এখানে দেখা যাচ্ছে না। অথচ হিসেব মতে তাদেরকে এই মুহূর্তে গেইটের সামনে উপস্থিত থাকার কথা। মনে মনে দুইজন অবাক হলেও মুখে সেটা কেউ-ই প্রকাশ করলো না। নিজেরাই কনভেনশন সেন্টারের ভিতরে চলে গেল। তাদের দেখাদেখি অনেকেই ভিতরে গেল। আবার কেউ কেউ কনে পক্ষের জন্য গাড়ির সামনেই অপেক্ষা করতে লাগল।
কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যে আর কাটে না। সাদিদ না পেরে নিজের গাড়ির সামনে দাঁড়ানো তানবীরকে ডাক দিলো।
— ‘ কিরে, কি হয়েছে? ‘
— ‘ বুঝতাসি না মামা৷ ভাই আর ভাবীতো গেল। কিন্তু কেউরে তো আসতে দেহি না। ‘
— ‘ আরে তুই অস্থির হচ্ছিস কেন? এই তানবীর, যা তো এখান থেকে। তোর এসব ভাবভঙ্গি দেখলে যে কেউ আতংকে উঠবে৷ ‘
— ‘ লাথি দিমু হারামি। আমি আবার কি কইলাম! ‘
— ‘ এই চুপ করবি তোরা? আমার বিরক্ত লাগছে এখন৷ ‘
সাদিদের মৃদু ধমকে দুইজনই চুপ হয়ে গেল। আরও কিছু মুহূর্ত পার হতেই শাহেদ হন্তদন্ত হয়ে কনভেনশন সেন্টার থেকে বেড়িয়ে আসলো। আর তার পিছু পিছু নিধিও। তার ফর্সা মুখটা যেন আঁধারে ছেয়ে গিয়েছে। তাদের এই অবস্থা দেখে সাদিদ আর বসে থাকতে পারল না। গাড়ি থেকে বের হয়ে নিজেই কয়েককদম এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
— ‘ কি হয়েছে ভাইয়া? ইজ এভরিথিং ওকে? ‘
— ‘ না ভাই, কিছু ঠিক নেই৷ সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে সাদি। সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। ‘
— ‘ মা..নে? ‘
সাদিদের কন্ঠস্বর যেন লেগে আসছে। এতক্ষণের বুকের তীক্ষ্ণ ব্যাথাটা এখন বোধহয় কাটা হয়ে হৃদপিন্ডে বিঁধছে। সাথে না চাইতেও মন-মস্তিষ্কে এসে ভিড় জমাচ্ছে হাজারো ঘন কালো মেঘের ছায়া।
#চলবে…