গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪২
মিরপুরের এই সাত তলা বিল্ডিংয়ের সুখনিড় বাসাতে আজ পিনপতন নীরবতা। সুখের রাজ্যে যেন এক আকাশ অন্ধকারের মেলা। যেখানে একবিন্দু সুখ দেখা দুষ্কর। কে বলবে এটা একটি বিয়ে বাড়ি? এই ঘরের ছোট মেয়ের আজ বিয়ে? এক কান দুই কান হতে ইতিমধ্যে সবার কাছেই কনে নিখোঁজের সংবাদটা পৌঁছে গিয়েছে। কেউ কেউ পরিবারের বদনামের কথা ভেবে আপসোস করছে আবার কেউ বা মেয়ের অনর্গল নিন্দা করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় স্তরের লোকের সংখ্যাই যেন অধিক।
— ‘ মাফ করবেন বিয়াইসাব, কিন্তু আপনার ছোট মেয়ের প্রশংসা না করে পারছি না। নিজের কথা পরিবারের কথা নাই বা ভাবলো, কিন্তু তার যে আরেকটা বোন রয়েছে এবং সেই পরিবারে এইসবের কি প্রভাব পরবে এটা কিভাবে ভুলে গেল? নির্লজ্জ মেয়ে তার বোনের সংসারের কথা একবারও চিন্তা করলো না? ‘
— ‘ মা, বাদ দাও এসব। ‘
— ‘ তুই চুপ থাক। নেহাত আমরা ভদ্র পরিবারের সদস্য। নতুবা উনার এই গুণধর মেয়ের কুকীর্তি সবার সামনে মেলে ধরতাম। ‘
— ‘ আহা শায়লা চুপ করো তো। এমনিতেই দেখছ পরিস্থিতি ঘোলাটে। তারউপর তোমার এসব কথাবার্তা তাদের উপর কি প্রভাব পরবে একবার চিন্তা করো। ‘
— ‘ আমি কারো চিন্তা করতে পারব না। এতসবের পর তোমরা কিভাবে আমাকেই চুপ থাকতে বলো? আমি কি ভুল বলছি? যা করার সেটা তো ঐ চরিত্রহীন মেয়ে করেছে। ‘
শায়লা রহমানের শেষোক্ত বাক্যটা যেন আরিফ মাহমুদের আর সহ্য হলো না। তিনি এতো এতো চাপ নিতে পারছিলো না। তাই এবার বুকে হাত চেপে সেখানেই মেঝেতে পরে গেলেন।
উপস্থিত সবাই আকষ্মিক এমন কান্ডে হতবাক। কয়েক পলক পার হতেই নিধি শাহেদ দৌড়ে তার কাছে গেল।
— ‘ আব্বু, এই আব্বু কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? বুকে কষ্ট হচ্ছে তোমার? আব্বু। ‘
নিধি বাবার বুকে মালিশ করতে করতে ক্রমাগত হিচকি তুলে কান্না করছে৷ ছোট্ট শাদমান এতসব বুঝতে পারছে না। কিন্তু মায়ের কান্না দেখে সেও গুনগুন করে কাঁদছে। নার্গিস খাতুন ইতিমধ্যে আহাজারি শুরু করেছে।
— ‘ হে আল্লাহ, তুমি এসব কি দেখাচ্ছ আমাদের? তার থেকে বরং আমাকেও তুলে নিয়ে যাও। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না৷ তুলে নাও আল্লাহ। তুলে নাও। ‘
শাহেদ ছেলেকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চুপ করতে বলছে। আর নার্গিস খাতুনকে স্বান্তনা দিতে বলল,
— ‘ মা প্লিজ এসব বলবেন না। আপাতত বাবাকে হসপিটাল নিতে হবে৷ আপনি প্লিজ নিজেকে সামলান। ‘
সে কথাটা শেষ করেই পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। আরিফ মাহমুদের অবস্থা খুব একটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে শাহেদ সবাইকে এসব বলে আর বিচলিত করতে চাইল না। সে দ্রুত অর্ণবকে ফোন দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ণবসহ তানবীর সেখানে এসে হাজির হলো। তারা বাসার সামনেই ছিল৷ আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে তিনজনে ধরাধরি করে তাকে নিচে নামিয়ে আনলো। শাহেদ নিজেই ডাইভিং সিটে বসে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিলো। রাগ অভিমান ঠেলে দিয়ে শায়লা রহমানও হাসিবুর রহামানকে নিয়ে তাদের পিছন পিছন অপর গাড়িতে হসপিটালের উদ্দেশ্য ছুটল।
খারাপ পরিস্থিতিতে নিজের রাগকে সংযত করতে পারেনি। আর না পেরেছে নিজেকে সামলাতে। তাই কয়েকটা কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এখন যেন নিজের কাছেই তিনি ছোট হয়ে গিয়েছেন। বারবার কিছু মুহূর্ত আগের কথাগুলো ভেবে তিনি বড্ড অনুতপ্তবোধ করছেন।
— ‘ আমিনুল, আরেকটু দ্রুত চালা। এতো ধীরে ধীরে চালাচ্ছিস কেন? ‘
— ‘ খালাম্মা এর থেকে বেশি স্পিড দিলে এক্সিডেন্ট করতে হইবো। ‘
— ‘ চুপ থাক বেয়াদব। খালি মুখে মুখে কথা। তোকে যেটা বলছি সেটা কর। ‘
— ‘ এখন আমিনুলের উপর কেন রাগ দেখাচ্ছ? তখনতো কারো কথা শুনছিলে না৷ যা নয় তা বলেছ। এখানে তাদের কি দোষ বলতে পারো? তাদের কেন এইসব বলে আঘাত করলে? ‘
শায়লা রহমান স্বামীর কথার পরিবর্তে কিছু বলতে পারল না। শুধু মলিন মুখে গাড়ির জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলো। তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন কাজটা বড্ড অন্যায় হয়ে গিয়েছে। তিনিতো এমন স্বভাবের নন। তাহলে কেন আজ এই অবনতি?
সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। নতুবা সন্তানের দোষে কখনও পিতা-মাতাকে দোষারূপ করতো না৷
কিন্তু বিয়ের কনে নিখোঁজ থেকে এতকিছু ঘটে গেল তারপরও একজনের কোনো হেলদোল পরিলক্ষিত করা গেল না। তার মুখ দিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ একটা টু শব্দ বের হতে দেখেনি। বসার ঘরে এখনও নীলার নানু বাড়ির দাদু বাড়ির অনেকেই রয়ে গিয়েছে। আর এখন বারবার আড়চোখে সবাই সাদিদকেই দেখছে। শান্ত তাদের এমন আচরণ দেখে ভয়ার্ত পায়ে সাদিদের দিকে এগিয়ে আসলো। কান্না মিশ্রিত ভাঙা গলায় ডাকল,
— ‘ জিজু। ‘
ডাকটা যেন সাদিদের পুরো শরীর নাড়িয়ে দিলো৷ আধো কি সে এই সম্বোধনের যোগ্য?
সে এবার চোখ তুলে তাকালো। শান্ত সাদিদের এই অবস্থা দেখে ভয়ে দুইপা পিছিয়ে গেল। রক্তবর্ণ চোখজোড়াতে স্পষ্ট লোকায়িত জলের আনাগোনা৷ কয়েক ঘণ্টা আগে একেবারে পরিপাটি ছেলেটা এখন একবারেই অগোছালো। এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক, মলিন মুখমণ্ডল। ঘন স্লিকি চুলগুলো যেন একেবারে রুক্ষ। শান্তর যেন সহ্য হলো না। সে সাদিদের এই অবস্থা দেখে মুখে হাত চেপে কান্না শুরু করল। সাদিদ কয়েক মুহূর্ত নির্বিকার তার কান্না দেখলো। তারপর শেরওয়ানির উপরের বোতামগুলো খুলতে খুলতে এলোমেলো পায়ে হাঁটা ধরল। কোন দিকে যাচ্ছে এই মুহূর্তে তার খেয়াল নেই। দিক-বেদিক হয়ে সে হাঁটতে লাগল। ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই হঠাৎ দক্ষিণ পাশের রুমটাতে তার নজর পড়ল। দরজায় আকাশি সাদা বর্ণের পর্দাটা বাতাশের তুপে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। সাদিদ পা টিপে টিপে রুমটার দিকে এগিয়ে গেল।
এই ছোট্ট রুমটা সাদিদের ভীষণ পছন্দের।
হয়তো বা তার নিজের আলিশান বিশাল রুমটার থেকেও। কেননা এখানে যে তার প্রাণপাখি দিনের বেশিরভাগ সময়টা অতিবাহিত করে। সে ঘুমায় এই ছোট্ট খাটে। অহ্ দুঃখিত সে ঘুমাতো এই খাটে। এখনতো ঘুমায় না। কোথায় সাদিদের প্রাণপাখি?
সাদিদ ঝাপসা চোখে পুরোটা রুমে নজর বুলালো। নীলা খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে। এলোমেলো দেখলেই সে খুঁতখুঁত করে। কিন্তু বিয়ের আমেজে রুমটা এখন অনেকটাই অগোছালো। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিয়ের কনের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস। সাদিদের নজর বারান্দায়ও পড়ল। সেখানেই নীলার গায়ে হলুদের পরিহিত শাড়িটা দড়িতে টাঙানো রয়েছে।
সাদিদের যেন এবার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বার কয়েক টেনে টেনে শ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে বসলো। কপাল, গলা বেয়ে তার চুয়ে চুয়ে ঘাম ঝরছে। সে এলোমেলো ভাবে মুখের ঘাম মুছে জড়সড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই মুহূর্তে কেউ তাকে দেখলে নির্ঘাত ভাববে সে শীতে কপোকাত। বর্তমান পরিস্থিতি তাকে বাচ্চাদের মতো আচরণ করতে বাধ্য করছে। বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাদিদের নিজের হাতে কেনা নীলার জন্য বিয়ের পোশাকসহ গয়নাগাটি। যা হয়তো এই মুহূর্তে নীলার পরিধেয় থাকতো৷ লাল টুকটুকে বউ সেজে সে সাদিদের অপেক্ষায় অধৈর্য্য পহর কাটাতো৷
কিন্তু দুর্ভাগ্য এমন কিছুই হয়নি৷ আর না আর কখনও হবে। সে লাল টুকটুকে বউ সাজবে কিন্তু সেটা সাদিদের জন্য নয়। বরং সে তার ভালোবাসার মানুষের জন্য সাজবে। তাহলে সাদিদ কি তার ভালোবাসার মানুষ না? কিন্তু সাদিদ এটা কিভাবে মানবে? সে যে তার চোখে নিজের জন্য উপচে পড়া ভালোবাসা দেখেছে। তাহলে ঐ চোখজোড়ার ভাষা কি সাদিদ এতদিন বুঝতে পারেনি? এতটা ব্যর্থ প্রেমিক সে?
সে কাঁপা হাতে নিজের ডান হাতের মুঠিটা সামনে আনলো৷ তার বুক ধক ধক আওয়াজ করে ক্রমাগত বেজে চলেছে। সে ধীরে ধীরে চিঠিটা আবারও মেলে ধরল,
— ‘ আব্বু-আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দিও। কিন্তু এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। তাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। কেবলমাত্র তোমাদের সম্মানের কথা চিন্তা করে এই বিয়েতে মত দিয়েছি। কিন্তু আমি এটা পারব না। আমার পক্ষে তাকে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ঘরবাঁধা সম্ভব নয়। তার থেকে আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। তাই শেষ সময়ে সহ্য করতে না পেরে চলে যাচ্ছি। আমার খোঁজ করার চেষ্টা করো না। তোমাদের জামাইকে নিয়ে আমি সুখি থাকব। আর ঐ পরিবারকেও বলে দিও আমাকে ক্ষমা করে দিতে। এই বিয়ে হলে না তাদের ঘরের ছেলে সুখি থাকতো আর না আমি৷ তাই আমার এই সিদ্ধান্ত। আশাকরি রাগ কমলে তোমরা সবাই আমার অবস্থাটা বুঝতে সক্ষম হবে।
ইতি,
নীলা
এতো নিখুঁত অভিনয়! কবিরা ঠিক-ই বলে৷ নারীজাতি বড্ড রহস্যময়। তার সঙ্গে ছলনাময়। তাদের মতো রঙ বোধহয় গিরগিটিরাও পাল্টাতে পারে না। সাদিদের কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ছেলেদের কান্না এই সমাজের চোখে ঘৃণিত বস্তু। নাহয় সাদিদ বোধহয় এখন ডুকরে ডুকরে মেয়েদের মতো কান্না করতো। সে চিঠিটা মুঠিতে পিষে নিয়ে বুকে হাত চেপে ধরল। আবারও তার নিঃশ্বাসের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। রক্তিম বর্ণের চোখজোড়া হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিয়ে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রুম থেকে চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে যেন দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিজের অস্থিরতা মিশ্রিত নজর চারদিকে বুলিয়ে নিলো৷ অতঃপর পাগলের মতো বিয়ের শাড়ি, মালা, গহনা সবকিছু নিজের হাতে নিতে লাগল। দ্রুততার সহিত সবগুলো জিনিস গুছিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। সবাই তীক্ষ্ণ চোখে সাদিদের এই পাগলামি দেখছে। কিন্তু কিছু বলা বা বাঁধা দেবার সাধ্য কারো নেই। সাদিদ জিনিসপত্রগুলো নিয়ে নিচে নেমে গাড়ির পিছনে রেখে এসে আবারও নীলার রুমে আসলো। তারপর বাকি জিনিসগুলো হাতে নিয়ে আবারও বেড়িয়ে গেল। ডাইভ করার শক্তি বোধহয় তার শরীরে নেই। তাই ধরা গলায় শুধু বলল,
— ‘ বাসায় চলো। ‘
কারো আর কিছু জানার বাকি নেই। তাই ডাইভার বিনা বাক্য গাড়ি স্টার্ট দিলো। আর সাদিদ পা গুটিয়ে সিটে হেলান দিলো। হাতে তার নীলার বিয়ের শাড়িটা পেচানো।
পদ্মালয়ার সামনে গাড়ি এসে থামতেই ডাইভার নিচুস্বরে বলল,
— ‘ ছোট ভাই চলে আসছি৷ ‘
— ‘ হ্যাঁ? ‘
সাদিদ থতমত খেয়ে চোখ খুলল। সামান্য কথাটাতেই তার যেন ভয় পাওয়ার অবস্থা। ডাইভার শফিকের বড্ড মায়া লাগলো তার ছোট ভাইয়ের জন্য। সর্বদা হাসিখুশিতে থাকা ছেলেটার আজ একি অবস্থা হয়েছে। তার মুখের দিকে তাকালো যাচ্ছে না। ঐ একটা মেয়ে-ই যেন ছেলেটার জীবনটা আটকিয়ে রেখে দিলো। এই সাদিদের সাথে আগের সাদিদের যেন কোনো মিল নেই। দুইজন যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। এই সাদিদ ছন্নছাড়া, নির্জীব। আর আগের সাদিদ হাস্যউজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল।
সাদিদ এলোমেলো ঝাপসা পায়ে গাড়ি থেকে নামলো। পদ্মলয়ার বাহারি আলোকসজ্জার দিকে নজর পরতেই তার বুকে যেন আবারও রক্তক্ষরণ হতে লাগল। সবকিছু আগের জায়গায় রয়েছে। সব আয়োজনও সমানতালে করা হয়েছে। এককথায় সাদিদের বউকে বরণ করার জন্য পদ্মলয়া সহ সবকিছু তৈরি। কিন্তু সাদিদের বউটাই নেই। কোথায় সে?
কোথায় তার প্রাণপাখি? সাদিদ লোকায়িত জলে চিকচিক করা চোখগুলো এদিক-সেদিক তাকিয়ে আড়াল করতে চাইল। তারপর পিছন থেকে একএক করে সবগুলো জিনিস উঠাতে নিতেই শফিক এগিয়ে আসলো,
— ‘ ভাই, আপনি যান। আমি নিয়া আসতাছি। ‘
— ‘ না। একদম না। এগুলো আমার পাখির। তুমি ছুঁবে না। আমার পাখি রাগ করবে। ‘
সাদিদকে এমন মানসিক রোগীদের মতন আচরণ করতে দেখে শফিকের কান্না পেয়ে গেল। তার গলা ভেঙে আসছে। সে মাথা নিচু করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো৷ সাদিদ নিজের মতো করে আগলে ভীষণ যত্ন সহকারে সবগুলো জিনিস উপরে নিজের রুমে নিয়ে গেল। রুমে ডুকতেই সাদিদের ক্ষতস্থানে যেন আবারও কেউ আঘাত করলো। বিশাল বড় রুমটা ইতিমধ্যে ফুলে ফুলে সজ্জিত করে ফেলা হয়েছে। ডেকোরেশনের লোকরা সাদিদের বলা অনুসারে বেলি, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধার সাথে টকটকে লাল গোলাপের সাহায্য পুরো রুমটা সাজিয়েছে। এতো এতো ফুল মনে হচ্ছে এটা কোনো রুম নয় বরং ফুলের একটা বাগান। ফুলের তীব্র সুভাস আর জেসমিনের সুভাসের অসংখ্য লাভ সেইপ ক্যান্ডেল মিলে রুমটাকে যেন এক স্বপ্নের রাজ্যে পরিণত করেছে।
এতো আয়োজন না করে উপায় আছে?
আজ যে সাদিদ-নীলার বাসর রাত। একে-অপরের উষ্ণতায় ভালোবাসায় ডুবে থাকার রাত। তাই এই আয়োজন তো অনিবার্য। কিন্তু এখন কেবল এই রজনী স্বপ্নের রাজ্যের ন্যায় কল্পনা। যার বাস্তবের স্মৃতির পাতা অসম্ভব। সাদিদ ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। ঝাপসা চোখে পুরো রুমটাতে একবার নজর বুলালো। তারপর বিয়ের সবগুলো জিনিস বাচ্চাদের মতন একটা একটা করে সাজিয়ে বিছানার উপর রাখল। কাজ শেষ হলে তার ঠোঁটের কোণে নিষ্পাপ এক হাসির রেখা ফুটে উঠল।
সে নিজের জন্য একটু জায়গা করে গুটিশুটি মেরে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। বিয়ের জিনিসগুলো দেখে আবারও মৃদু হাসলো। হাসিমুখেই কাঁপা হাতে বিয়ের শাড়িটা নিজের কাছে টেনে আনলো। কাঁথার মতন করে শাড়িটা নিজের বুকের উপর জড়িয়ে নিলো। অতঃপর আলতো করে হাত বুলাতে শুরু করল। যেন সে নীলার শাড়িকে নয় স্বয়ং নীলাকেই আদর করছে। সাদিদ চোখ বন্ধ করতেই তাদের একে-অপরের সঙ্গে অতিবাহিত করা ভালোবাসাময় সেই সুখস্মৃতিগুলো চোখের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল। ভেসে উঠতে লাগল সেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো যেগুলো তারা একে-অপরের সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেছে। একে-অপরের উষ্ণতায় মত্ত হয়েছে।
সাদিদ চোখ বন্ধ করেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। আর গুনতে লাগলো তার প্রিয়তমার আকর্ষণিয় তিলকসহ দেহের অগণিত গৌড় বর্ণের নীলচে শিরা-উপশিরাগুলো। প্রিয়তমার কোমল শরীরের সবকটা ভাঁজ যেন সাদিদের মুখস্থ। সাদিদ মনের আঙিনায় সাজাতে লাগল তাদের প্রথম ভালোবাসার প্রকাশ। প্রথম উষ্ণ চুম্বন। প্রথমবারের অনুভব করা ওষ্ঠদ্বয়ের মিষ্টি স্বাদ। প্রথমবার একে-অপরের কাছে আসা। সম্পূর্ণভাবে একে-অপরের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। আর সেইসব মুহূর্তে নমনীয়তার আড়ালে নীলার লজ্জা রাঙা রক্তিম মুখখানাও যেন তার চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছে। সব যেন বাস্তব।
সাদিদের ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি। কিন্তু হঠাৎই ধীরে ধীরে সেটা মিলিয়ে যেতে লাগল। সাদিদ দ্রুত নিজের চোখ খুলে হুড়মুড়িয়ে বসল। এসি চলাকালীনও ইতিমধ্যে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে আচমকা চোখে হাত চেপে বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল,
— ‘ এই পাখি না৷ একদম না৷ আমি সহ্য করতে পারব না। পাখি, এই এই….
সাদিদের কন্ঠ লেগে লেগে আসছে সে চোখ ছেড়ে গলাতে হাত রাখল। কথা কেন বের হচ্ছে না? সে কাশতে শুরু করলো। ঝাপসা চোখগুলো দিয়ে সামনের কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। সে বিছানা থেকে শাড়িটা নিয়ে পাগলের চোখ মুছতে শুরু করলো। তারপরও যেন জলকণা এসে বারবার চোখ ঝাপসা করে দিচ্ছে। ভাঙা স্বরে সে নীলার শাড়িটা বুকে চেপে ধরল,
— ‘ লক্ষ্মিটি এমন করিস না৷ আমি মরে যাব পাখি৷ তোর দেহে-মনে অন্য কারো বিচরণ আমি সহ্য করতে পারব না৷ প্লিজ দোহায় লাগে এমন করিস না আমার সাথে। প্লিজ পাখি, দয়া কর আমাকে৷ একটু রহম কর। সত্যিই বাঁচতে পারব না। আমি যে আমাদের সুখের ছোট্ট সংসার সাজাতে চেয়েছি। কিন্তু তুই কেন চাসনি? কেন পাখি? কেন এমন করলি? কিসের জন্য? কে…
আচমকাই এতক্ষণের আর্তনাদে নিস্তব্ধতা ভেসে আসতে লাগল। বুক চিঁড়ে আসা কথাগুলো থেমে থেমে যেতে লাগল। অবশেষে প্রিয়তমার সিঁদুর রাঙা বেনারসি শাড়িটা বুকে জড়িয়েই পাগল প্রেমিক বিছানায় ঢলে পড়ল।
#চলবে…