অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৫০

0
5319

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫০

এতদিন পর বাবাকে কাছে পেয়ে ছোট্ট শাদমান শাহেদের কাঁধ থেকে মাথা তুলছে না৷ ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সামনে দাঁড়ানো নিধির চোখজোড়াও জলে চিকচিক করছে। শাহেদ ছেলের পিঠে যত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে নিধির গালেও হাত রাখল। আদরে গলায় ডেকে উঠল,

— ‘ কেমন আছো নিধি? ‘

নিধি উত্তরে কিছু বলতে পারল না। ছেলেকে ঝাপটে ধরে নিজেও শাহেদের বুকে হেলে পড়ল। শাহেদ নিঃশব্দে হেসে আরেকহাতে তাকেও নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে রসিকতার স্বরে বলে উঠল,

— ‘ বাহ্বা, দূরে থাকলে এতো মহব্বত! তাহলে তো এখন থেকে দূরেই থাকতে হয়। ‘

নিধি মাথা তুলে আস্তে করে শাহেদের বুকে একটা কিল বসাল। শাহেদ হাসতে হাসতেই ভিতরে প্রবেশ করল। এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল,

— ‘ আম্মু-আব্বু কোথায়? ‘
— ‘ মা নামাজ পড়ছে। আর বাবা একটু বেড়িয়েছে। ঘরে থাকতে থাকতে নাকি শরীরে অসুখের আরো বাসা বাঁধছে। ‘
— ‘ সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু বাবার শরীর এখন কেমন? দুইদিন আগেও তো বলছিলে ঠান্ডা লেগেছে। ‘
— ‘ আর বলবেন না। বাবার একটার পর একটা লেগেই থাকছে। ‘

বাবার কথা তুলতেই নিধির মনটা আবারও খারাপ হলো। নীলার ঐ ঘটনার পর থেকে আরিফ মাহমুদের শরীরটা যেন নেতিয়ে পরেছে। শাহেদ সেটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠল,

— ‘ জলদি ব্যাগ গুছিয়ে নাও। বাড়ি যাবে। ‘
— ‘ কি? ‘
— ‘ যা শুনেছো তাই। অযথা দেরী না করে দ্রুত রেডি হয়ে নাও৷ আমি তোমাদেরকে নিয়েই বাড়ি ফিরব। ‘
— ‘ কিন্তু মা..
— ‘ মায়ের চিন্তা করতে হবে না। সেদিকটা আমি দেখে নিবো। এমনিতেই এতোদিন একা থেকেছি। দিনগুলো যে কিভাবে পার করেছি সেটা কেবলমাত্র আমি;ই জানি৷ ‘

নিধি তার অভিমানভরা কথা শুনে ঠোঁট টিপে মৃদু হাসল। মাসখানেক হবে তারা আবারও মিরপুরে চলে এসেছে। বলতে গেলে ইচ্ছে করেই। সাদিদের সেদিনের রেগে কথা বলার পর শায়লা রহমান আর কিছু বলেনি। কিন্তু কথা বলাও একপ্রকার বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু হুটহাট নিজের মনকে সামলাতে না পেরে রেগে যেত৷ সেটা সবার সাথেই৷ নিধির মন এমনিতেই বাবা-বোনের জন্য অস্থির। সেসময়ে শায়লা রহমানের এমন আচরণ মেনে নিতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। তাই শাহেদকে বলে সে তখন নিজেই কয়েকটাদিন বাপের বাড়িতে থাকার জন্য চলে আসে। কেননা সে চায়নি শায়লা রহমান যখন পরে বুঝতে পারবে, তখন তার কাছে অপরাধী হয়ে থাকুক। মানুষটা পরিস্থিতিতে পরে এমন করলেও নিধিকে সবসময় মেয়ে হিসেবে যত্ন করে রেখেছে। আর সেই কয়েকটা দিন আজ মাসে এসে ঠেকেছে। নিধি নিঃশব্দে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুমের দিকে এগিয়ে যেতে ধরলে শাহেদ আবারও পিছন থেকে বলে উঠল,

— ‘ বাবা কখন আসবে কিছু বলেছে? ‘
— ‘ না। তেমন কিছু বলে যায়নি৷ কি জন্য, কোনো প্রয়োজন? ‘
— ‘ আসলে আজ অনেকদিন পর সাদির সাথে কথা হয়েছে। বাবু এবং তোমার কথাও জিজ্ঞেস করছিলো। আর যখন বললাম তোমরা বাড়িতে নেই এবং আমি তোমাদেরকে নিতে মিরপুর আসবো, তখন বললো মা-বাবাকেও যেন তোমাদের সাথে পদ্মলয়ায় নিয়ে যাই। ‘
— ‘ হঠাৎ আম্মু-আব্বু কেন? ‘
— ‘ আমিও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু বলেনি৷ ‘
— ‘ বাবা, পাপু কই? ‘
— ‘ চাচ্চু আসবে বাবা। ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই আসবে। ‘

আরিফ মাহমুদ এবং নার্গিস খাতুন পদ্মলয়ায় যেতে কিছুটা সংকোচবোধ করলেও শাহেদের জোরাজুরির সাথে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না। সাদিদ তাকে বারবার বলেছে তাদেরকে সাথে করেই যেন নিয়ে আসে৷ তাই ছোট ভাইয়ের এতদিন পরের একটা আবদার শাহেদ অপূর্ণ রাখেনি।
সবার মুখে হাসির রেখা না থাকলেও ছোট্ট শাদমানের মুখে উপচে পড়া হাসি। বাবার কোলে থেকেই সে হাসিমুখে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। কতদিন পর নিজ বাড়িতে পদার্পণ। মিনু এসে দরজা খোলে দিতেই সে চেঁচিয়ে উঠল,

— ‘ মিনু আন্টি। শাদমান এসেছে, শাদমান এসেছে৷ ‘

মিনু তার উত্তেজনায় হেসে ফেলল। সেও চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকতে লাগল,

— ‘ খালাম্মা-খালুজান, দেহান কেডা আইসে। শাদ বাবা আইসে। জলদি আহেন৷ ‘

শায়লা রহমান তার এমন হাঁক ডাক শুনে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন৷ দরজায় দাঁড়ানো সবাইকে হঠাৎ এভাবে দেখে একটু অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলেন না। সামনে এগিয়ে এসে শাহেদের দিকে হাত বাড়িয়ে শাদমানকে কোলে তুলে নিলেন। সম্পর্কগুলোতে কেমন যেন জড়তা এসে গিয়েছে। এখন চাইলেও আগের মতো হাসিখুশি হওয়া যায় না। তিনি বেশ ইতস্ততবোধ নিয়েই বললেন,

— ‘ কেমন আছেন বেয়াই-বেয়াইন? ‘
— ‘ জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আপা৷ আপনি কেমন আছেন? ‘
— ‘ এইতো। কেটে যাচ্ছে দিন৷ ‘

তার এই উত্তরে আবারও নীরবতা ছাপিয়ে গেল। শাহেদ তাদেরকে ফ্রি করতে প্রসঙ্গ পাল্টালো,

— ‘ নিধি, মা-বাবাকে এভাবেই বাহিরে দাঁড়া করিয়ে রাখবে না-কি? ‘
— ‘ এমা না। আম্মু আসো৷ আব্বু তুমিও আসো৷ ‘

উনারা সোফায় বসতেই নিধি শায়লা রহমানের পাশে এসে নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ মা, আপনার শরীরটা এখন কেমন? ‘
— ‘ আছি ভালো৷ ‘

আর কোনো কথা হলো না৷ সব সম্পর্কগুলোর মধ্যেই যেন জং ধরে গিয়েছে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও পালিশের ন্যায় জকজকা করা সম্ভব হচ্ছে না। সবাই নিজেদের জড়তা নিয়েই স্বাভাবিকভাবে টুকটাক কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল।
নিধি বউয়ের দায়িত্ব হাতে নিয়ে সবার জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করতে লাগল। ট্রে হাতে গরম গরম কফি আর নিমকি নিয়ে বসার ঘরে আসতেই কলিং বেল বেজে উঠল। নিধি সামনে ছিলো বিধায় সেন্টার টেবিলের উপর কফির
ট্রে রেখে সে নিজেই দরজা খুলতে এগিয়ে গেল। কিন্তু দরজা খোলতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। আনন্দ নাকি অন্য কিছুতে, কিন্তু সে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাকে স্বাভাবিক করতে নীলাই এগিয়ে আসলো৷ বোনকে ঝাপটে ধরে অশ্রুসিক্ত আটকে যাওয়া গলায় ডেকে উঠল,

— ‘ আপুনি৷ ‘

এতদিন পর আদরের বোনের কন্ঠস্বরে সেই আবেগমাখা আপুনি ডাকটা শুনে নিধি শব্দ করে কেঁদে উঠল। নিজেও নীলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। তাদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে লিভিংরুমে বসা সবাই উত্তেজিত হয়ে কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য এগিয়ে এলো। অতঃপর নিধির মতোন তাদেরও একি অবস্থা। নীলাকে স্বচোখে দেখতে পেয়ে তারাও ভীষণ অবাক হলো। এতগুলো দিন পর প্রিয় মুখগুলো দেখে নীলা ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল৷ কাঁদতে কাঁদতে মা-বাবার বুকে হেলে পড়ল। অপরদিকে তারাও আপাতত পূর্বেকার সবকিছু ভুলে গিয়ে মেয়েকে স্বযত্নে বুকে আগলে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেল।

— ‘ মা, এতদিন কোথায় ছিলে? ‘
— ‘ বাবা ক্ষমা করে দাও। তোমাদের সবাইকে আমি খুব কষ্ট দিয়েছি। প্লিজ ক্ষমা করে দাও। ‘
— ‘ কাঁদে না মা। এভাবে কাঁদলে বাবা কিন্তু রাগ করবে৷ ‘

নীলা বাবার কথায় এবার হাসল। উপস্থিত সবার মাথায় যেন একঝাঁক প্রশ্নের পাহাড়৷ সাদিদ সবটা পরখ করে নীলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তার বাহুতে ধরে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ বাড়িতে এসেই লাফালাফি শুরু? মাইর কিন্তু একটাও মাটিতে পরবে না৷ ‘

নীলা রেগে গেল। সবার সামনেও এই ছেলেটা এমন করবে? সাদিদ সেদিকে খেয়াল না করে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মিনুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— ‘ যা তো মিনু, তোর ছোট ভাবীর জন্য একগ্লাস নরমাল পানি নিয়ে আয়। সাথে অরেঞ্জ জুস। ‘

মিনু বিনাবাক্য সাদিদের কথায় কিচেন রুমের দিকে এগিয়ে গেল৷ আর বাকিরা সবাই তো প্রথম থেকেই অবাক, তাহলে আবার কি অবাক হবে। শুধু তাদের চোখে-মুখে অজস্র প্রশ্নেরা খেলা করছে। সাদিদ একপলক সবার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল,

— ‘ তোমরা সবাই এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সবাই বসো৷ তারপর বাকি কথা বলছি৷ ‘

নিজেদের উত্তেজনা আপাতত চেপে রেখে তারা সবাই সাদিদের কথায় সোফায় বসল। সাদিদ একপলক নীলার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,

— ‘ নীলাঞ্জনাকে আমরা রাঙামাটি থেকে খোঁজে পেয়েছি। সে সেখানে কিভাবে গেল এবং কেন গেল সবটাই তোমাদের বলবো৷ কিন্তু আপাতত আম্মু-আব্বুর উদ্দেশ্য আমার কিছু কথা রয়েছে। ‘

সাদিদ এতটুকু বলে থামল। আরিফ মাহমুদ এবং শায়লা রহমানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তারাও প্রশ্নবোধক চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অতঃপর সাদিদ বলল,

— ‘ সামাজিকভাবে আমাদের বিয়ের কথাটা সবার কাছে গোপন থাকলেও পরিবারের সবার কিন্তু অজানা নয়। তাই আজ এমনকি এই মুহূর্ত থেকে নীলাঞ্জনাকে আমি এই বাড়িতে আমার সাথে রাখতে চাই৷ আপনাদের উত্তর বলার আগেই বলে রাখছি, এতে আপনাদের অমত থাকলেও আমি নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবো না। আমার বউ এবার থেকে আমার সাথেই থাকবে৷ ‘

নীলার বাবা-মা চমকিত ভাব নিয়েই একে-অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটা কি তাদের কাছে অনুমতি চাইছে নাকি শান্ত গলায় নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে তারা সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না৷ এরিমধ্য মিনু সাদিদের বলা কথা অনুযায়ী নীলার জন্য জুস আর পানি নিয়ে আসলো৷ নির্লজ্জ সাদিদ সবার সামনেই নীলার মুখের সামনে পানির গ্লাস ধরে বলল,

— ‘ নাও। ‘

নীলা সাথেসাথেই মাথা নিচু করে নিয়েছে। আর সবাইকে বাদ দিলেও আম্মু-আব্বু এমনকি সাদিদের মা-বাবা এখানে উপস্থিত। তাদের সামনেও কি এই ছেলেটা একটুখানি লজ্জা বজায় রাখবে না?
নীলার মন মস্তিষ্ককে চলা কথাগুলো মনেই রইল৷ আর অপরদিকে সাদিদ তাড়া দিচ্ছে,

— ‘ কি হলো, খাও পানিটা৷ ‘
— ‘ আমার হাতে দিন। ‘

সাদিদের হয়তো কিছু একটু মায়া হলো। তাই নিজের নির্লজ্জতাটাকে একটু সাইডে রেখে পানির গ্লাসটা নীলার হাতে তুলে দিলো। উপস্থিত সবাই অবাক চাহনিতেই তাদের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কি যে জিজ্ঞেস করবে সেটাও তাদের বুঝে আসছে না৷ শুধু কিছু যে একটা অস্বাভাবিক এটা তাদের চোখেও বেশ লাগছে৷ কিন্তু সেটা কি? এটাই তারা বুঝে উঠতে পারছে না৷

— ‘ এখন জুসটা শেষ করো৷ ‘

নীলা আড়চোখে সবার দিকে একবার তাকালো। অর্ণব তানবীর ব্যতিত সবার চোখে-মুখেই প্রশ্ন। সে নিজের অস্থিরতা চাপাতে নিঃশব্দে জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো৷ সেটা দেখে সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। শায়লা রহমান আর নিজের অস্থিরতা চাপিয়ে রাখতে পারলো না৷ তাই বলেই ফেললেন,

— ‘ এসব কি হচ্ছে, একটু বলবি সাদি? আমার তো সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এতদিন পর তুই বাড়ি ফিরলি সাথে আবার নীলাকে নিয়ে। কিন্তু তোদের আচরণ যেটা হওয়া উচিত হচ্ছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ‘
— ‘ আহা শায়লা উত্তেজিত হচ্ছো কেন? বাচ্চাগুলো কতদিন পর নিজ বাড়িতে ফিরেছে। ওদেরকে একটু সময় দাও। ‘

সাদিদ পাশে বসা নীলার দিকে তাকালো। নীলার মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে একে সব বলতে শুরু করলো৷ সাদিদ যত বলছে তাদের বিস্ময়ের পর্যায় যেন আরও বেড়ে উঠছে। নিধি মুখে হাত চেপে ধরেছে। ইমরান যে জেদের বশে এমনটা করতে পারে সেটা তার ধারণার বাহিরে৷ নীলার থেকে তাকে কখনও কম মনে করেনি। তাদের ভাই নেই বিধায় ইমরানকেই সে সবসময় ভাইয়ের আদর দিয়ে এসেছে। আর সেই কি-না আজ তার পিচ্চুর এতো বড় ক্ষতি করতে পারলো!
হামিদুর রহমান রাগে উত্তেজিত হয়ে বসা থেকেই হুংকার ছাড়লেন,

— ‘ শাহেদ, তানহার বাবাকে ফোন লাগা। বল তার বেয়াদব মেয়েকে নিয়ে এখানে হাজির হতে। এতোটা অমানুষ কিভাবে আমার বোনের ঘরে তৈরি হলো আমি সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। ‘
— ‘ আর এই মেয়েটাকেই কিনা আমি নিজের সাদির জন্য বউ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলাম! ‘

শায়লা রহমানের কথা শুনে নীলা এবার মাথা উঁচিয়ে তার দিকে তাকালো। শায়লা রহমানের কথাটা নীলার বুঝতে অসুবিধা হলেও উপস্থিত সবার কাছে সেটা পরিষ্কার। সাদিদ নিজের রাগ চেপে গম্ভীর মুখে মাথা নিচু করে রয়েছে। তার ভাবতেও অবাক লাগে সবকিছু জানার পরও তার মা কিসব পাগলামি করেছিল।
নীলাকে এই ভাবনা-চিন্তা থেকে বের করতে শায়লা রহমানই এগিয়ে আসলেন। নীলার পাশে বসে তার হাতদুটো নিজের মুঠিতে নিয়ে অপরাধী কন্ঠে বলতে শুরু করলেন,

— ‘ আমাকে মাফ করে দিস মা। কিন্তু কি করবো বল? সন্তানের কষ্টের সামনে মায়েরা বড্ড স্বার্থপর। তাইতো নিজের ছেলের এই কষ্টভরা মুখটা সহ্য করতে না পেরে তানহাকে ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর, সেটা আমি নিজে প্রথমে সামনে আনেনি। হেনা বলল তানহা নাকি সাদিকে ভীষণ পছন্দ করে। এখন যদি তার সাথে সাদির বিয়েটা দিয়ে দেয় তাহলে আমার ছেলেটা তোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে। আমিও ছেলের শোকে দিশেহারা হয়ে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। ক্ষমা করে দিস। ‘

শায়লা রহমানের গলা ধরে এসেছে। তিনি শাড়ির আচল মুখে চেপে ধরেছে। নীলা তাকে স্বান্তনা দিতে পারছে না। সে সাদিদের সাথে তানহার বিয়ের কথাবার্তা শুনে একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজের কানকেই তার বিশ্বাস হচ্ছে না। আল্লাহ না করুক মায়ের পাগলামিতে বাধ্য হয়ে যদি সাদিদ বিয়েতে রাজি হয়ে যেত! তাহলে? তাহলে নীলা কি করতো?
সেটা ভাবতেই নীলার বুকে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। সাদিদ সেটা মুহূর্তেই টের পেয়ে খানিকটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

— ‘ প্লিজ মা, এখন এইসব বন্ধ করো। পাখির অবস্থা ভালো না। ‘

সাদিদ তাকে থামিয়ে সামনে থেকে পানির গ্লাস নিয়ে নীলাকে কয়েক চুমুক পানি খাইয়ে দিলো। নীলা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সাদিদ আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ বেশি খারাপ লাগছে? ডক্টর ডাকবো? ‘

নীলা কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে নিচুস্বরে মাথা নাড়িয়ে না করল। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে সাদিদ বলল,

— ‘ যা কিছু ব্যবস্থা নেবার সব আমি করবো। আমার পাখির একেকটা কষ্টের ভাগ তাদেরকে ডাবল আকারে ফিরিয়ে দিবো। তাই এই নিয়ে তোমাদের কারও উত্তেজিত হতে হবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর রেস্টের প্রয়োজন। এই অবস্থায় এতটা পথ জার্নি করে এসেছে। তাই আমি ওকে নিয়ে রুমে যাচ্ছি। ‘

সাদিদ কথাটুকু বলে আবারও আরিফ মাহমুদের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ বাবা, যদিও আমি নিজের মতামত জানিয়েছি। কিন্তু আপনাদের কি এই নিয়ে কোনো আপত্তি রয়েছে? ‘
— ‘ আমরা আর কি বলবো? এখনও সবকিছু বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। আমার মেয়েটা কি অবস্থায় ছিলো, আর আমরা তাকে কতটা ভুল বুঝে দিনগুলো পার করেছি। আমাদেরতো এখানে বলার মতো কোনো মুখ পর্যন্ত নেই বাবা। যখন নীলাঞ্জনার আমাদের সবাইকে ভীষণভাবে প্রয়োজন ছিলো, তখন সামান্য একটা চিঠির উপর ভিত্তি করে আমরা মেয়েটাকে ভুল বুঝেছি। এতবছর যাবত মেয়েটাকে দেখে এসেও খারাপ পরিস্থিতিতে পরে তার উপর বিশ্বাস রাখতে পারিনি। আমরা যে তোমার কাছে ঋণী। বাবা-মা হয়েও আমরা তাকে ভুল বুঝে গিয়েছি। অথচ তুমি তাকে সবার ঊর্ধ্বে গিয়ে বিশ্বাস করেছো। তার প্রতি তোমার ভালোবাসা-বিশ্বাস অসীম। তাই নিজের অধিকার হোক আর অন্যকিছু, নীলাঞ্জনার সব দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে। আমি এতটুকু আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারবো আমার মেয়েটা তোমার সাথে সবচেয়ে বেশি ভালো থাকবে৷ কেউ তাকে তোমার থেকে বেশি যত্নে রাখতে পারবে না। ‘

বাবার মুখে এমন আবেগপ্রবণ কথা শুনে নীলা উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে বাবার পাশে বসে তার বুকে মাথা রাখল। আরিফ মাহমুদও মেয়েকে পরম যত্নে বুকে আগলে ধরল। সাদিদ ঘাড় ঘুরিয়ে মহিলা সমিতিকে লক্ষ্য করলো। প্রথমে হঠাৎ করে নীলাকে দেখে তারা বিষয়টা এতোটা খুঁটিয়ে না দেখলেও এখন যে লক্ষ্য করবে সেটা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে। তার ধারণা ঠিক। শায়লা রহমান, নার্গিস খাতুন, নিধিসহ তার বাবা পর্যন্ত চিন্তিত মুখে নীলার হালকা উঁচু পেটটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদ গলা কেশে নীলার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ নীলাঞ্জনা, আর কান্নাকাটি নয়। পরে মাথা ব্যাথা শুরু হবে৷ ‘

সাদিদের কথায় নীলা চোখ মুছে বাবার বুক থেকে মাথা তুললো। সাদিদ সেটা দেখে বলল,

— ‘ কষ্ট করে একটু উঠে দাঁড়াতে পারবে? ‘

নীলা সাথে সাথেই সাদিদের মুখের দিকে তাকালো। তখন বাবার কথায় আবেগের বশে প্রায় দৌড়ে আসলেও এখন সাদিদের কথার মানেটা তার বোধগম্য হচ্ছে। সে ভয়ার্ত চেহারায় একবার আড়চোখে সবার দিকে তাকিয়ে সাদিদের মুখের দিকে তাকালো। আর নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে না করল। সাদিদ নিজের কথায় অনড়। তাই আবারও বলল। কিন্তু এবার বেশ গম্ভীরস্বরে। তাই নীলার আর অবাধ্য হবার সাহস হলো না। সে আস্তেধীরে উঠে দাঁড়াতেই সাদিদ এসে তার পাশে দাঁড়ালো। নীলার বাহুতে ধরে একহাতে তাকে নিজের সাথে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,

— ‘ এই সন্তানের বাবা আমি৷ তাই নীলাঞ্জনার কাছে কেউ যেন এই বাচ্চার পিতৃ পরিচয় জানতে না চায়। তাকে এসব বলে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে না ফেলার জন্য সকলের নিকট অনুরোধ। ‘

সাদিদের কথা সকলের কর্ণকোহরে পৌঁছাতেই তাদের মুখগুলো দেখার মতোন অবস্থা হলো। নীলাতো সেই প্রথম থেকেই মাথা নিচু করে রয়েছে। এখন যেন থুতনি একেবারে বুকের সাথে লেগে যাওয়ার অবস্থা। লজ্জা-অস্বস্তি সবকিছু মিলিয়ে তার অবস্থা নাজেহাল। কিন্তু সাদিদ বরাবরের মতোই ভীষণ শান্ত।
উপস্থিত সবাই কিছুটা মুহূর্ত নীরবতায় কাটিয়ে ধীরে ধীরে নিজেদেরকে সামলিয়ে নিতে লাগল। সমাজের চোখে না হলেও তাদের কাছে সাদিদ-নীলার মধ্যকার সম্পর্ক পরিষ্কার। তাই এই নিয়ে কিছু বলে নিজেরা আর লজ্জায় পরতে চাইলো না। সম্পর্ক যেহেতু বৈধ তাহলে এখানে তারা আর কি বলতে পারে? আর বিষয়টা যথেষ্ট সেনসেটিভ। তাই তারা এই নিয়ে আর বেশি ঘাটলো না। সবার মুখেই এতক্ষণ পর হাসির রেখা ফুটে উঠল। দুই মা এসে নীলার কপালে চুমু খেয়ে আদর দিলো। শাহেদ এসে ভাইকে কংগ্রাচুলেশন জানালো। একে সবাই-ই নীলাকে আদর দিলো। এতদিনের নিস্তেজ হয়ে যাওয়া পরিবারে আজ হঠাৎ করেই যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল। তারা সকলেই এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত যে, নীলা কেবল সাদিদের প্রাণ নয়। তাদেরও প্রাণ। তাইতো তার পায়ের কদম ঘরে পরতেই তাদের দুঃখভরা জীবনে এতো আনন্দ এসে উপচে পড়ল।
সবার সাথে আরও কিছু আনন্দঘন মুহূর্ত কাটিয়ে সাদিদ সাবধানে নীলাকে উপরে নিয়ে উঠল। রুমের সামনে যেতে যেতেই বলল,

— ‘ খুব কষ্ট হয়েছে জান? আমি কালকেই আমাদের রুম নিচে সিফট করে ফেলব। ‘

নীলা নিশ্চুপ রইল। কেননা তার সত্যিই উপরে উঠতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। তাই সাদিদের সিদ্ধান্তে আর অমত পোষণ করলো না।
সাদিদ তাকে নিয়ে নিজের রুমে পৌঁছাতেই নীলার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে গেল। দেয়ালগুলো কেবলমাত্র নীলার ছবিতে পরিপূর্ণ। এ যেন নীলাঞ্জনা নামক আরেকটা গ্রহ। নীলা ঘাড় উঁচিয়ে সাদিদের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল,

— ‘ কি? ‘
— ‘ এতোটা কেন ভালোবাসেন? ‘

সাদিদ ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে নীলার কপালের একপাশে চুমু খেল। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। উঁচু পেটটাতেও ভালোবাসার উষ্ণ চুম্বন একে দিয়ে বলল,

— ‘ বাঁচার জন্য। নিজের প্রাণকে যে ভালোবাসতে হয়। আর আমার প্রাণ নামক সুখপাখিটা যে এই নীলাঞ্জনা নামক রমণীর খাঁচায় বন্দি। তাই ভালো না বেসে উপায় আছে? ‘

নীলার চোখে অশ্রুকণারা এসে ভিড় জমালো। সে অশ্রুমাখা চোখেই হাসল। সাদিদও মৃদু হেসে তার গালে হাত রাখল। আদুরে স্বরে বলল,

— ‘ সত্যি করে বলো তো, খুব বেশি ক্লান্ত লাগছে? ‘
— ‘ না। খুব বেশি নয়। একটু একটু। ‘
— ‘ ফ্রেস হতে চাও? ‘
— ‘ হ্যাঁ। একেবারে গোসল করে নিবো। শরীরটা কেমন যেন করছে। শাওয়ার না নিলে ভালো লাগবে না। ‘
— ‘ আচ্ছা। তোমার যেভাবে ভালো লাগে। তুমি একটু বসো। আমি যাব আর আসবো। ‘

নীলা চুপচাপ বিছানায় বসে রইল। আর সাদিদ আলমারি থেকে টাওয়েল নিতে নিতেই পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে উদ্দেশ্য করে কল লাগালো,

— ‘ কতদূর? ‘
— ‘ স্যার অলমোস্ট চলে এসেছি। বিশ মিনিটে চলে আসবো। ‘
— ‘ ওকে রাখছি তাহলে। ‘

সাদিদ ফোন রেখে নীলার দিকে এগিয়ে আসলো৷ তাকে সাবধানে ওয়াসরুমের সামনে নিয়ে যেতেই নীলা বলে উঠল,

— ‘ চলবে৷ বাকিটা আমি যেতে পারব। ‘

সাদিদ তার কথাটা শুনেও একেবারে না শোনার মতো করে নিজেও ওয়াসরুমের ভিতরে প্রবেশ করলো। ভালোভাবে ফ্লোরটা দেখে নিয়ে নীলার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ বাথটাবে পারবে? ‘
— ‘ হ্যাঁ, এখনও তো বাবুর বেশিদিন হয়নি। এখন পারা যাবে। ‘
— আচ্ছা তাহলে চলো। ‘

সাদিদের ওয়াসরুমের বাথটাবটা ডাবল সাইজের। তাই নীলার আরাম করে বসতে কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু সাদিদকে এখনও যেতে না দেখে নীলা বলল,

— ‘ আপনি যাওয়ার সময় দরজাটা চাপিয়ে যেয়েন। ‘

সাদিদ এবারও তার কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। শুধু নিঃশব্দে নিজের শার্টের বোতামগুলো খুলতে লাগল। নীলা চোখ বাঁকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদের ভাবসাব সে ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। সাদিদ নীলাকে ওয়াসরুমে রেখেই আবারও রুমে গেল। এবং মিনিট খানেকের মধ্যেই ড্রেস পাল্টে অফ হোয়াইট একটা থ্রি কোয়ার্টার পরে আবারও ওয়াসরুমে আসলো। নীলাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়ে সাদিদ নিজেও বাথটাবে আসলো। নীলা চোখজোড়া মুহূর্তেই বড় বড় করে তার দিকে তাকালো,

— ‘ একি! আপনি এখানে কি করছেন? যান বলছি। ‘

সাদিদ এবার নীলার ঠোঁটে আঙুল চেপে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। অধিকারে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

— ‘ চুপ। আর একটা কথাও নয়। শুধু আজ নয়। বাবু যতদিন না আসছে, আর তুমিও যতদিন না পর্যন্ত পরিপূর্ণ সুস্থ হবে ততদিন একা একা গোসল করার চিন্তা ভুলেও করবে না। আমি নিজ হাতে তোমাকে গোসল করিয়ে দিবো। ‘
— ‘ কি! ‘

নীলার চোখজোড়া পূর্বের থেকে যেন আরও বড় আকার ধারণ করলো। সাদিদ তার চাহনি দেখে এবার মৃদু স্বরে হেসে উঠল।

— ‘ তুমি জানো কি? এমনকরে চোখ বড় করে তাকালে তোমাকে যে একদম কার্টুনের মতো লাগে? ‘
— ‘ মোটেই না। আর একদমই হবে না। আমি এটা মানবো না। চুপচাপ বাহিরে যান। নতুবা আমি গোসলই করবো না। ‘
— ‘ পাখি, মাইর চলবে কিন্তু। যা বলছি সেটাই। ‘
— ‘ ইশশ না। যান প্লিজ। আমার কোনো সমস্যা হবে না। ‘
— ‘ আমি কি একবারও তোমার সমস্যা জানতে চেয়েছি? ‘
— ‘ এমন করছেন কেন? আমি…

সাদিদ তাকে বলতে না দিয়ে আবারও ঠোঁট জোড়া আঙুল দিয়ে চেপে ধরল। নীলা বুঝে গিয়েছে এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলের সাথে সে কথা বলে পারবে না। কিন্তু এভাবে গোসলও যে সম্ভব নয়।
সাদিদ তার কামিজে হাত দিতেই নীলা সাদিদের হাতের উপর নিজের হাত রাখল। মাথা নিচু করে অনুরোধের কন্ঠে বলল,

— ‘ প্লিজ আপনি যান। আমার কোনো সমস্যা হবে না। ‘
— ‘ কিন্তু আমার হবে। তোমাকে এখানে একা রেখে আমি একদন্ড শান্তি পাব না। তার থেকে এটাই কি উত্তম নয়? ‘

সাদিদ নীলার উত্তরের আর অপেক্ষা করলো না। আস্তে ধীরে কামিজটা খুলে দিলো। সাদিদ পুরোপুরি স্বাভাবিক আচরণ করলেও নীলার অবস্থা কাটিল৷ এতদিন পর সাদিদের স্পর্শ শরীরে পরতেই সে যেন আরও চুপসে গিয়েছে। লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে।

— ‘ আরে কি হলো? হাত এভাবে শক্ত করে রাখলে কিভাবে হবে? হাত সরাও। ‘
— ‘ আপনি বাহিরে যান প্লিজ। আমার কেমন কেমন যেন লাগছে। ‘

সাদিদের মাথায় এবার দুষ্টুমি চেপে বসল। সে নীলার উন্মুক্ত ঘাড় থেকে কাঁধে আঙুল দিয়ে স্লাইড করলো। নীলা চোখ বন্ধ করে একপাশে ঘাড় কাত করে নিলো। সাদিদ নীলার দিকে খানিকটা চেপে এসে উন্মুক্ত কাঁধে ঠোঁট ছুঁয়ালো। অতঃপর গলার আশেপাশে এবং উন্মুক্ত বাহুতে। নীলা শিহরণ সহ্য করতে না পেরে সাদিদের উন্মুক্ত পিঠে নখের আঁচড় বসালো। সাদিদ ব্যাথা পেলেও সহ্য করে নিলো। অসংখ্য উষ্ণ পরশ দিয়ে নীলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ কেমন কেমন লাগে? আদর আদর পায়? ‘

নীলা প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। তার কি কথার পরিবর্তে এই দুষ্ট ছেলেটা কি অর্থ বের করলো!
নীলার এমন অবস্থা দেখে সাদিদ আর কিছু বলল না। চুপচাপ সরে এসে আবারও নিজের কাজে মনোযোগী হলো। নীলার আর কিছু বলার সাহস হলো না। নতুবা আবার না জানি এই ছেলে কি করে বসে!
তাকে এসব ক্ষেত্রে একবিন্দু পরিমাণ ভরসা করা যায় না। ভীষণ জড়তা নিয়ে নীলা চুপচাপ বসে রয়েছে। আর সাদিদ একধ্যানে তার চুলে শ্যাম্পু লাগাচ্ছে। সাদিদ নিজেও নীলার অবস্থা বুঝতে পারছে। কিন্তু তারপরও নীলাকে এই অবস্থায় একা ফেলে যাবার সাহস সাদিদের হচ্ছে না। মনের ভেতর কেমন যেন একটা ভয় ঢুকে গিয়েছে। নীলাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। যা আর কখনও দূর হবে কি-না সেটা নিয়ে সাদিদ ভীষণ সন্দিহান।
সাদিদ বেশ যত্ন নিয়ে নীলার মাথায় শ্যাম্পু ঘষসে। আরাম পেয়ে নীলার ঘুম চলে আসছে। সাদিদ নীলার অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। দুষ্টুমি করে বলল,

— ‘ বাবাইয়ের আম্মু, আর একটু অপেক্ষা করেন। রুমে গিয়ে কম্বলের নিচে আরাম করে ঘুমাবেন৷ ‘

নীলা নিজেও চোখ খুলে মুচকি হাসল৷ এতক্ষণতো ঠিক ছিলো। কিন্তু এখন সাদিদের হাতে লুফা দেখেই নীলা মিনমিনিয়ে বলল,

— ‘ বাকিটা আমি করি? ‘
— ‘ চুপচাপ বসে থাকো। তোমাকে সর্দারি করতে বলেছি? ‘
— ‘ দেন না। ‘
— ‘ কেন? আমি করলে সমস্যা কি? না-কি আমি লুফার ব্যবহার জানি না। কোনটা? ‘
— ‘ আমি কিন্তু এবার চলে যাব। ‘
— ‘ আর আমি কি বসে বসে দেখবো নাকি? পাখি, বিরক্ত করো না তো। এতক্ষণ পানিতে থাকলে তোমার আবার ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘
— ‘ বিরক্ত আমি করছি? বিরক্ততো আপনি আমাকে করছেন। ‘
— ‘ তাই? হলেও আমার কিছু করার নেই। সহ্য করতে হবে। ‘

নীলা মুখ ফুলিয়ে বসেছে। এই ফাজিল ছেলেটা তার কোনো কথা শুনে না। সাদিদ নীলার গোমড়ামুখো চেহারা দেখে নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসল। কিন্তু উন্মুক্ত বুকে-পেটে সাদিদের হাতের স্পর্শ পরতেই নীলা আর রাগ ধরে রাখতে পারল না। লজ্জায় তার মুখ রক্তিম বর্ণে পরিণত হলো। কিন্তু সাদিদের আজ সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। প্রাণপাখির লজ্জায় রক্তিম মুখশ্রীতে যে সাদিদ এতোদিন মুগ্ধ হতো সেদিকে তার আজ মন নেই। আর না আছে নীলাকে এই অবস্থায় দেখেও চোখে কোনো নেশালো ঘোর। ঘোরের পরিবর্তে সাদিদের চোখজোড়া যে আজ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কামিজের উপর দিয়েই নীলার শুকিয়ে কাঠ হওয়া শরীরটা সাদিদ বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু এখন এই উন্মুক্ত অবস্থাতে ভেসে উঠা হাড়গুলোতে যখন নিজের হাত দিয়ে স্পর্শ করছে সাদিদ নিজেকে আর সামলাতে পারছে না। সে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে৷ কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। আচমকাই সে নীলাকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো। উন্মুক্ত পিঠে আদুরেভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে মাথায় গুটিকয়েক চুমু দিলো। নীলা প্রথম থেকেই অবাক। তাই এখনও একই অবস্থায় রয়েছে। সাদিদ কিছু বলল না। শুধু নিঃশব্দে নীলার ভেজা ঘাড়ে নিজের ভেজা চোখগুলো খুবই গোপনে মুছে নিলো। অতঃপর আবারও নিজের কাজে মনোযোগী হলো। সম্পূর্ণ গোসল শেষ করিয়ে সাদিদ নিজে প্রথমে বাথটাব থেকে নেমে নীলাকে সাবধানে নামিয়ে আনলো। নিজের সাদা বাথরাবটা নীলার শরীরে পেঁচিয়ে দিয়ে মাথায় আরেকটা শুকনো টাওয়েল পেঁচিয়ে দিলো। সাদিদের বাথরাবটা নীলার গোড়ালি পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। পুরোই কিউটের ডিব্বা লাগছে নীলাকে।

— ‘ কিউটিপায়। ‘

নীলা হাসতেই সাদিদ তার গালগুলো টেনে দিলো। নীলা কপাল কুঁচকে তাকাতেই সাদিদ ঝুঁকে এসে তার দুইগালে চুমু খেলো। নীলা এবার লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো।
নিজের শরীর ভেজা থাকায় সাদিদ আর রুমে আসলো না। শুধু নীলার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসবে। আমি দুই মিনিটের মধ্যে বেড়িয়ে আসছি। ‘

সাদিদ ঠিক দুই মিনিটের মাথায় ওয়াসরুম থেকে গোসল সেরে বেড়িয়ে আসলো। নীলার জন্য সে খুবই দ্রুত সবকিছু করে নিলো। ওয়াসরুমের দরজা খোলার আওয়াজে নীলা সেদিকে তাকালো। সাদিদকে শুধু টাওয়েল পরে বেড়িয়ে আসতে দেখে বরাবরের মতোই বেশ লজ্জা পেল। নীলার লাল টমেটো ওয়ালা মুখটা দেখে সাদিদ হাসতে হাসতে এগিয়ে আসলো। নীলার চুলে পেঁচিয়ে রাখা টাওয়েলটা খুলে নিয়ে বলল,

— ‘ বউটা এখনও এতো লজ্জা কিভাবে পায়? বাচ্চার মা হয়ে যাচ্ছে অথচ এখনও তার লজ্জা শেষ হয় না! এই লজ্জার সমাপ্তি কোথায়? ‘

নীলা মাথাটা আরও নিচু করলো। লজ্জায় সাদিদের কথার বিপরীতে আর কিছু বলতে পারল না। সাদিদের ফোনে কল আসাতে সে একহাতে নীলার চুল মুছিয়ে দিতে দিতেই কল রিসিভ করলো,

— ‘ হ্যাঁ বলো। ‘
— ‘ স্যার আপনাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ‘
— ‘ করিম চাচার কাছে ব্যাগগুলো দিয়ে দাও। আর তাকে বলে দিও আমার রুমে কাউকে দিয়ে সেগুলো পাঠিয়ে দিতে। ‘

সাদিদ ফোন রাখার কিছু সময়ের মধ্যেই দরজায় মিনুর ডাক পরলো। তাই সাদিদ উঠে দাঁড়িয়ে কাভার্ড থেকে টাওজার আর ট্রি-শার্ট নিয়ে পরে নিলো। অতঃপর দরজা খুলে তার হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে দরজা লাগিয়ে আবারও নীলার কাছে এগিয়ে আসলো।

— ‘ বেবি, দেখো তো সাইজগুলো তোমার ঠিক আছে কি-না? ‘
— ‘ এসব কি? ‘
— ‘ তোমার প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়। ‘
— ‘ আপনি আবার এসবের ব্যবস্থা কখন করলেন? ‘
— ‘ আমার পাখির যে এসবের প্রয়োজন হবে সেটা কি আমাকে বলে দিতে হবে? ‘

নীলা নিজের বোকামিতে হাসলো। এই মানুষটা যে নীলার থেকেও তার প্রয়োজনগুলো বেশি চিন্তা করে সে কিভাবে এটা ভুলতে পারে!

— ‘ আমি নিজে যাওয়ার সময় পাইনি। আপাতত এগুলো থেকে একটা পরে নাও। আমি গিয়ে দেখেশুনে আবার নিয়ে আসবো। ‘
— ‘ এমা না, এখানেই এতগুলো। আর লাগবে না। ‘

সাদিদ নীলার জন্য অনেকগুলো লং জামা নিয়ে এসেছে। নীলা তার মধ্যে থেকে সাদা আর হালকা পিংকের একটা সুতি জামা পরে নিলো। নীলার সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে সাদিদ এতদিকে কিভাবে খেয়াল রাখতে পারে! প্রেগন্যান্সিতে যেন নীলার কোনো সমস্যা না হয় সেটা ভেবেই সাদিদ ড্রেস বাছায় করেছে। সবগুলোর সাইজ নীলার বর্তমান শরীরের মাপ অনুযায়ী একেবারে সঠিক৷ আগের ড্রেসটা পরে যেমন অস্বস্তি হচ্ছিল এখন আর তেমনটা একবারেই হচ্ছে না। লুজ হওয়াতে পরে ভীষণ আরাম পাচ্ছে।
নীলা একপলক মুগ্ধ দৃষ্টি সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তাই চোখাচোখি হয়ে গেল। এতক্ষণে যেন সাদিদের একটু শান্তি লাগছে। প্রাণপাখিটাকে দেখতে এখন ফ্রেস-ঝলমলে লাগছে। শুকনো ভাবটাতো এতো দ্রুত কেটে উঠার নয়। কিন্তু নির্জীব ভাবটা যেন আর নেই। সাদিদ এগিয়ে এসে হাত দিয়ে নিজেই নীলার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিলো। ভেজা বিধায় আর চিরুনি ব্যবহার করলো না। মাথায় ওড়নাটা দিয়ে নীলার মুখটা আঁজলাভরে ধরলো। কপালে দীর্ঘ উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিয়ে মোহাচ্ছন্ন কন্ঠে বলল,

— ‘ জীবনটাকে আবারও সতেজ করে তোলার জন্য সাদিদ তার প্রাণপাখির কাছে কৃতজ্ঞ। ‘

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here