গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫২
জানালার থাইগ্লাস বেধ করে সূর্যের কিরণরশ্মি রুমের ভিতর তীর্যকভাবে প্রবেশ করতেই নীলার ঘুমটা ছুটে গেল। পিটপিট করে চোখ খুলতেই সে অনুভব করলো আজকের সকালটা অন্যরকম। একেবারে অন্যরকম একটা ভালোলাগায় সকালটা ছেঁয়ে আছে। তার কারণ জানতে নীলা নিজের মনকেই প্রশ্ন করলো। এবং চঞ্চল মন উত্তর জানাতে সময় নিলো না। নিঃশব্দে যেন বলে দিলো,
— ‘ উপরে তাকা, নিজের উত্তর পেয়ে যাবি। ‘
নীলা আধঘুমো চোখজোড়া নিয়ে উপরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে একজোড়া সম্মোহনী চোখের সাথে তার দৃষ্টির মিলন হলো।
সাদিদ একদৃষ্টিতে নীলার মুখোপাণেই তাকিয়ে রয়েছে। নীলা ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুললো। এটাই তো সেই কারণ। নীলার অন্যরকম ভালোলাগার কারণ হিসেবে এই সুপুরুষটি পরিপূর্ণভাবে দায়ী। সকালটা এতো স্নিগ্ধ সুন্দর করার জন্য এই সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার নামক পুরুষটির ভয়ংকর এক শাস্তি পাওয়া উচিত। তাই শাস্তি স্বরূপ নীলা সাদিদের গালে হাত রাখলো। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেল। সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তার হাসি দেখে নীলাও হাসলো। অতঃপর বলে উঠল
— ‘ কখন জেগেছেন? ‘
— ‘ ঘুমিয়েছিলাম কখন? ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ মানে কিছু না। এইতো তুমি জাগ্রত হবার কিছু সময় পূর্বে। ‘
নীলা মৃদু হাসল। আজ তার কাছে সবকিছু একটু বেশিই ভালো লাগছে। কত দীর্ঘ রজনী পেরিয়ে নীলা এই সকালটা উপভোগ করতে পারলো। এতো প্রশান্তিময় ঘুম নীলা কবে ঘুমিয়েছিল? সেটা বোধহয় প্রায় ভুলেই গিয়েছে। নীলা এবার নিচে এসে সাদিদের উন্মুক্ত বুকে নাক ডুবিয়ে দিলো। শুধু মেয়েদের শরীরেরই যে মিষ্টি ঘ্রাণ বিরাজ করে তেমনটা কিন্তু নয়। ছেলেদের শরীরেরও যে এক মনমাতানো মাতাল করা নেশালো ঘ্রাণ মিশে থাকে। আর এই নেশালো ঘ্রাণই নীলার ঘুমটাকে গভীর তন্দ্রায় নিয়ে গিয়েছে।
নীলাকে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো বুকে নাক ঘষতে দেখে সাদিদ মৃদু হাসল। কাত হয়ে তার মাথাটা নিজের বাহুর উপর রেখে হালকা ঝুকে আসলো। নীলা তার ঘন কালো চোখের পাপড়ির আড়ালের মায়াবী চোখজোড়া দিয়ে সাদিদকে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। সাদিদ তার কোমল গালে হাত রেখে কপালে উষ্ণ চুম্বন আঁকলো,
— ‘ শীতের সকালের উষ্ণ শুভেচ্ছা মিসেস৷ ‘
— ‘ আপনাকেও। ‘
— ‘ আমারটা? ‘
— ‘ কি আপনারটা? ‘
সাদিদ নিজের কপাল এগিয়ে দিলো। নীলা বুঝতে পেরে হাসলো। অতঃপর যখনই তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবে দুষ্টু সাদিদ তার কপাল সরিয়ে নীলার দিকে মুখোমুখি হলো। তাই কপালের পরিবর্তে তার ঠোঁটে নীলার কোমল ঠোঁটের চুম্বন পড়লো। নীলা চোখ বড় করে সাদিদের দিকে তাকিয়েছে। আর অপরদিকে সাদিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি।
— ‘ এটা কি হলো? আপনি চিটিং করেছেন। ‘
— ‘ তাই না-কি? আমারতো এমনটা মনে হচ্ছে না৷ ‘
— ‘ সেটা হবে কেন? সবসময় মাথায় যে দুষ্টুরা কিলবিল করে। ‘
— ‘ তুমি আমাকে ইনসাল্ট করছো? ‘
— ‘ না সম্মান করছি৷ সরুন পাঁজি লোক কোথাকার। ‘
সাদিদ সরলো না৷ এমনকি নীলাকেও উঠতে দিলো না। ঠেসে ধরে তার ঠোঁটে চুমু খেলো।
বিনা মেঘের এমন বজ্রপাতে নীলা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। সাদিদ তাকে চেপে ধরে নিজের ইচ্ছে মতো ঠোঁট আদর খেলো। অতঃপর ছেড়ে দেওয়ার সময় ইচ্ছে করেই একটা কামড় বসালো।
— ‘ আউচ। ‘
নীলার এদিকে জান বেড়িয়ে আসে। আর অপরদিকে সাদিদ হাসছে। নীলা কটমট চাহনিতে তার দিকে তাকাতেই সাদিদ নীলার নাকে নাক ঘষে দিলো। অতঃপর ফিচেল কন্ঠে বলল,
— ‘ সুদবোধ করে দিলাম। ‘
নীলা আশ্চর্য। এতো দুষ্টু ছেলেটাকে সে কিনা পাগলের মতো ভালোবাসে! সে নিজেও তো আরেক পাগল। নতুবা এতোটা বুঝি ভালোবাসতো?
সাদিদ দুষ্টুমি ছেড়ে এবার নীলাকে ধরে উঠিয়ে বসালো। অতঃপর ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে তাকে ওয়াসরুম পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।
নিধির সার্ভেন্টদের সাথে মিলে সকালের নাস্তার প্রিপারেশনে ব্যস্ত। নীলা ফিরে আসাতে সবার মাঝেই যেন উৎফুল্লতা ছড়িয়ে আছে। এতদিনের বিষাদটা কেটে গিয়ে সবাই হাসিমুখে নিজস্ব কার্য সম্পাদনে লেগে রয়েছে। নাস্তার এখনও দেরী বিধায় সাদিদ নীলার জন্য দুটো সেদ্ধ ডিম, এক গ্লাস কুসুম গরম দুধ আর হোমমেইড একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে আসলো। সাদিদের হাতে এসব জঘন্য জিনিসগুলো দেখেই নীলার চোখ-মুখ কুঁচকে এলো। সে আগেভাগেই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। সাদিদ এসবে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলো না। নীলার সামনে বসে একটা সেদ্ধ ডিম হাতে নিয়ে বলল,
— ‘ চুপচাপ হা করবে আর ঝটপট খেয়ে নিবে৷ ‘
— ‘ একদম না। এসব আমি খাব না। ‘
— ‘ মাইর চিনো? তাহলে মাইর খাবে। ‘
নীলা হেসে ফেলল। সাদিদ কথায় কথায় তাকে মাইরের ধমক দেয়৷ কিন্তু নীলা ভালোই জানে এটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। নীলা যতটুকু না আঘাতে ব্যাথা পাবে সাদিদ তার দ্বিগুণ নিজেকে ব্যাথায় জর্জরিত করবে। ছেলেটা একেবারে পাগল। নীলাকে হাসতে দেখে সাদিদের ভ্রুজোড়া কুঁচকিয়ে গেল। সে চোখ বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো,
— ‘ সমস্যা কি? এভাবে হাসছো কেন? আমি হাসির মতো কি বললাম? ‘
— ‘ হাসার মতো কথাই তো। আপনি আমাকে আঘাত করতে পারবেন? ‘
বলে নীলা আবারও মিটমিটিয়ে হাসতে শুরু করলো। সাদিদ এবার সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝে উঠতে পারলো। সে নিজেও মনে মনে দুষ্টুমির ফন্দি আটলো,
— ‘ ওহ্ তাও ঠিক। কিন্তু মেরিজান, আপনি ভুলে যাবেন না আমিও আপনার বর। আঘাত কি শুধু একভাবেই করা যায়? আমার কাছে তো আঘাতের ভিন্ন ভিন্ন সুত্র রয়েছে। ‘
বলেই সাদিদ ঠোঁট এলিয়ে বাঁকা হাসলো। নীলার ঠোঁটের হাসি এবং ফুড়ুৎ করে উবে গেল। সে দুষ্টু সাদিদের মতিগতি অনুমান করে আপনমনেই বিড়বিড় করলো,
— ‘ বজ্জাত একটা। ‘
সাদিদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তার পাখিটা এতোটা অবুঝ যে বিড়বিড়িয়ে কথাটা পর্যন্ত ঠিকঠাক বলতে পারে না। এতোটা জোরে কেউ বিড়বিড়িয়ে বলে? সাদিদ হাসি চেপে গম্ভীরগলায় বলে উঠল,
— ‘ কি বললে? ‘
— ‘ না.. মানে আমি আবার কি বলবো? ‘
— ‘ হুম গুড। কিছু না বলাই উত্তম। নাও এবার শুরু করো। একটা কিছু যেন বাদ না থাকে। ‘
— ‘ এমন করছেন কেন? মাত্র সকাল হয়েছে। এখন এতগুলো কিভাবে খাবো! ‘
— ‘ শুধু মুখ খুলবে আর খেয়ে নিবে৷ ভেরি সিম্পল। ‘
সাদিদের হ্যাঁ এবং নীলার না এর মাঝে তর্ক বির্তক চলছে। এরিমধ্য দরজা ধিরিম করে খোলে কেউ একজন হুড়মুড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। আচমকা এমন হওয়াতে সাদিদ-নীলা দুইজনই দরজার দিকে তাকালো।
শান্ত ছলছল চোখে নীলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। অন্যদিন হলে সে সাদিদের সামনে ইতস্ততবোধ করে৷ কিন্তু আজকে সাদিদের সামনেই নীলাকে গিয়ে ঝাপটে ধরলো। নীলার চোখজোড়াও ভিজে গিয়েছে৷
— ‘ বান্দরনী, তুই.. তুই সত্যিই একটা বান্দরনী। ভুল করে আমার এতো সুদর্শন জিজুটা তোর জালে ফেসে গিয়েছে। তোর জন্যতো জঙ্গলের বানররাজ প্রয়োজন ছিলো। ‘
শান্ত কান্না গলায় নীলার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। নীলা অন্যসময়ের মতো আজ তার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করলো না। বরং মন দিয়ে তার এই অহেতুক কথাবার্তাগুলো শ্রবণ করলো। এই আজাইয়া প্যাচালগুলোতে যে কতটা যত্ন এবং ভালোবাসা লুকায়িত সেটা নীলাকে কেউ বলে দিতে হবে না৷ শান্তর পিছন পিছন তানবীরও রুমে প্রবেশ করলো। মুখে তার চাপা হাসি। তানবীরকে লক্ষ্য করে শান্ত এবার ক্ষেপে উঠল,
— ‘ জিজু, জলদি এই ছেলেটাকে এই রুম থেকে বের করুন। ‘
— ‘ কেন? আমি কেন বের হবো? তোর সমস্যা হলে তুই বের হো। ‘
— ‘ আমি আমার বেস্টুর কাছে এসেছি। তাই আপনি বের হোন। ‘
— ‘ তাহলে আমি আমার বোন প্লাস ভাবীর কাছে এসেছি। ‘
— ‘ দেখুন, আমার মেজাজ খারাপের আগে ভালোই ভালোই বের হয়ে যান। নতুবা কি করবো আমি নিজেও জানি না৷ ‘
— ‘ তোর মেজাজ কোন কালে ভালো থাকে? ‘
— ‘ আপনি.. আপনি একটা অসহ্যকর লোক৷ ‘
— ‘ আরে থাম। দুইটা এমন করে লেগেছিস কেন? ‘
— ‘ জিজু আমি লাগিনি। আপনার এই অসহ্যকর বন্ধুটা যতসব লাগিয়েছে। ‘
— ‘ তোর মুখের চটাং চটাংই বলে দিচ্ছে কে কতোটা লাগাচ্ছে। ‘
শান্ত গাল ফুলালো। নীলা নিঃশব্দে মিটমিটিয়ে হাসছে। বলা চলে ফ্রিতে একটা বিনোদন উপভোগ করছে। অনেকদিন পর প্রিয় মানুষগুলোর এমন খুনসুটি দেখতে নীলার মন্দ লাগছে না। বরং সে বেশ মজাই পাচ্ছে। শান্তকে সিরিয়াসভাবে রাগ করতে দেখে তানবীর এবার কিছুটা নিবলো। সে রাগ ভাঙানোর স্বরে বলল,
— ‘ এমন করে মুখ লটকাস ক্যান? তোরে সারপ্রাইজ দিবার চাইছিলাম৷ তাইতো বলি নাই৷ ‘
— ‘ এমন সারপ্রাইজ আমার দরকার নাই। ‘
— ‘ তোর লাইগ্গা কিতা নীলা আবারও নিখোঁজ হইবো? আর আমি আবারও তোরে না কইয়া সারপ্রাইজ দিমো? তুই কি এইডাই চাস? হুনসত সাদি, এই ডেঞ্জারাস মাইয়া কি কই! তোর বউরে আবারও হারাইয়া যাইবার লাইগ্গা কইতাসে। ‘
— ‘ আমি কিন্তু এবার আপনার মাথা ফাটিয়ে দিবো। ‘
— ‘ সর্বনাশ। মাইয়া দেহি বিয়ার আগেই জামাই খুন করবার লাগছে। ‘
— ‘ চুপ। ‘
সাদিদের জোরালো ধমকে দুই টম এন্ড জেরি নিজেদের তর্ক বির্তক বন্ধ করলো। সাদিদ রাগীস্বরেই অশান্ত গলায় বলল,
— ‘ কি হয়েছে, আমাকে ঠিক বলবি? ‘
— ‘ জিজু এই অসহ্য..
— ‘ আবারও ঝগড়া? ‘
— ‘ ওকে সরি। এই তানবীর নামক ছেলেটার সাথে গতরাতেও আমার কথা হয়েছে। ইনফ্যাক্ট যেদিন আপনারা নীলকে খোঁজে পেয়েছেন সেদিনও। কিন্তু এই অস.. না মানে এই ছেলেটা আমাকে কিছু বলেনি৷ আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর বলে কিনা বাহিরে আসো। আমিও বিনাবাক্য বাসার নিচে আসলাম। এবং আমাকে নিয়ে সোজা আপনাদের এখানে চলে আসলো। রাস্তায় আমি কতবার জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাচ্ছি? কিন্তু সে আমাকে একবারও বলেনি৷ এখানে এসে জানতে পারলাম নীলকে আপনারা নিয়ে এসেছেন। ‘
কথাটুকু বলেই শান্তর চোখজোড়া আবারও ঝাপসা হয়ে গেল। সে নীলাকে জড়িয়ে ধরে অভিমানভরা কন্ঠে আবারও বলল,
— ‘ আপনিই বলুন, এমনটা কি আপনার বন্ধুর করা ঠিক হয়েছে? ‘
সাদিদ কিছু বললো না। শুধু মুচকি হাসলো।।তানবীরই রসিকতার স্বরে বলে উঠল,
— ‘ একেবারে ঠিক হয়েছে। আমার কাছে আবারও সুযোগ আসলে আমি এমনটাই করবো। ‘
শান্ত তার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া রাঙিয়ে তাকাতেই সে ঠোঁট বাঁকিয়ে চুমু দেখালো। এবার শান্ত লজ্জায় রক্তিম হলো। আড়চোখে একবার সাদিদের দিকে তাকাতেই দেখলো সে ফোনে ব্যস্ত। বিষয়টা ইচ্ছে করে হোক আর অন্যকিছু, সাদিদকে না তাকাতে দেখে যেন শান্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল৷ নতুবা লজ্জায় জড়সড় হয়ে যেত। অপরদিকে সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। কিন্তু উপরদিয়ে সে পুরোপুরি নির্বিকার।
তানবীর শান্তর হাসিমুখখানা দেখে নিজেও নিঃশব্দে হাসলো। অতঃপর তার কাছে এসে খাটে বসলো। তার কাঁধে থুতনি রাখতেই শান্ত নিচুস্বরে বলে উঠল,
— ‘ এসব কি হচ্ছে? ‘
— ‘ চুপ থাক অভদ্র মহিলা। সবসময় ঝামেলা করস। ‘
শান্তর কর্ণকোহরে কথাটা পৌঁছাতেই সে তানবীরের পেটে খুঁচা দিলো।
— ‘ আহ্। এই তোর হাত কি লোহা নাকি? মাইয়াগো হাত তো শুনছি নরম থাকে৷ তোরটা এমন শক্ত ক্যান? ‘
— ‘ যেমন মানুষ তেমন হাত। ‘
— ‘ কি! তুই আমারে ইনসাল্ট কইরা কথা কস? ‘
— ‘ বেশ করেছি৷ আরও বলবো। ‘
তানবীর রাগতে গিয়েও কি মনে করে আর রেগে গেল না। বরং ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললো,
— ‘ আচ্ছা যা বেশ করেছিস। এখনকার মতো রেহাই পেয়ে গেলি৷ কারণটা জানবি না? ‘
— ‘ কি কারণ? ‘
তানবীর নীলার দিকে একপলক তাকিয়ে ঘাড় বাকিয়ে সাদিদের দিকেও তাকালো। অতঃপর নিচুস্বরে শান্তর কানে কানে বলে উঠল,
— ‘ খালামণি যে হচ্ছিস। তাই মাফ করে দিলাম। ‘
— ‘ কি? ‘
শান্ত প্রশ্নবোধক চাহনিতে তানবীরের দিকে তাকাতেই সে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। শান্ত এবার নীলার আপাদমস্তক ভালোভাবে লক্ষ্য করলো৷ এবং পেটের ভাগটা দেখেই সে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। নীলাকে আবারও ঝাপটে ধরল। কিন্তু এবার বেশ সর্তকতার সাথে। এতক্ষণতো জানা ছিলো না এই কথা। তানবীর গলার কলার টেনে ঠিক করতে করতে বলল,
— ‘ তাহলে এখন? ‘
— ‘ কি? ‘
— ‘ এতক্ষণের বকবকানির জন্য আমার পা ধইরা মাফ চা। ‘
শান্ত ক্ষেপে পাশ থেকে পানির জগটা নিয়েই তানবীরের পিছনে দৌড় লাগালো। আজকে সে নির্ঘাত এই ছেলের মাথা ফাটাবে। নীলা শব্দ করে খিলখিল হাসছে। সাদিদ বুকে হাত বেঁধে তার প্রিয়তমার মুখের হাসি পর্যবেক্ষণ করছে। আর তাতেই যেন সাদিদের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে।
____________
তানহা রাগে অস্থির হয়ে ফোনটা সজোরে মেঝেতে আঘাত করলো। সে মাথা চেপে ধরেছে। শরীরের রক্ত যেন টগবগ করছে।
একে তো তারা কেউ ফোন রিসিভ করছে না। দ্বিতীয়ত সাদিদ আবারও বিয়ের জন্য নাকচ করেছে। সে ভেবেছিলো সাদিদের চোখে নীলাকে খারাপ প্রমাণিত করতে পারলেই সাদিদ তার হবে৷ আর সেই অনুযায়ী সব প্ল্যানও করেছে। কিন্তু দিনশেষে ফলাফল শূন্য। সাদিদ এখনও সেই নীলাতেই মত্ত। সে বুঝে পায় না ঐ একটুখানি মেয়ে সাদিদের চোখে কি এমন পট্টি পরিয়েছে যে, সে অন্য কোনো দিকে তাকাতেই চায় না।
— ‘ ড্যাম ইট। সবগুলো কি মরেছে নাকি? ফোন তুলে না কি জন্য? ‘
তানহা রাগে আবারও রুমে একটা তান্ডব চালালো। মেয়ের কান্ডে হেনা চৌধুরী মাথায় হাত চেপে ধরেছে। কিন্তু করার কিছু নেই। সাদিদের থেকে বরাবরের মতো না উত্তর পেয়ে ঘরেই এই মেয়ে যতসব কান্ড ঘটায়। কিন্তু তিনি কি করবেন? কোনো ছেলেকে কি জোর করে বিয়ের জন্য রাজি করানো যায়? তাও যদি আবার সাদিদের মতো ঘাড়ত্যাড়া ছেলে হয় তাহলে তো কথায় নেই৷ তার না কে হ্যাঁ তে রূপান্তর করা চারটিখানি কথা নয়। হঠাৎই উনার ফোনে শায়লা রহমানের কল এলো। সাদিদ এতদিন পর বাড়িতে ফিরেছে সেটা জানতে পেরেই খুশির ঠেলায় তিনি শায়লা রহমানকে আর কিছু বলতে দিলেন না৷ মেয়ের মেজাজ ঠান্ডা করতে কল কেটে দ্রুত গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলেন,
— ‘ মা তানহা, দরজা খোল মা। ‘
— ‘ আম্মু যাও তো এখান থেকে৷ বিরক্ত করবে না৷ আমার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। ‘
— ‘ একবার দরজাটা খোল মা। তোর মেজাজ একেবারে ফুরফুরে হয়ে যাবে। ‘
মেয়েকে এবারও দরজা খুলতে না দেখে তিনি হাসিমুখে বলে উঠলেন,
— ‘ তোর মামি ফোন দিয়েছিল, জানিস কি বলেছে? সাদি এসেছে মা। তোর সাদি এসেছে। ‘
তানহার কানে কথাটা পৌঁছাতেই সে ঝড়ের বেগে দরজা খুলে দিলো।
— ‘ কি বললে মা? আবার বলো। ‘
— ‘ হ্যাঁ রে মা। সাদি এসেছে। এতোদিন তো এতো বলে-কয়েও বাড়িতে আনা যায়নি। আজ যখন এসেই পড়েছে তুই কি রাগের মাথায় সুযোগটা হাতছাড়া করবি? ‘
তানহা হেনা চৌধুরীর গালে চুমু দিয়ে হাসিমুখে বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলে উঠল,
— ‘ না মা। একবারেই না। এই সুযোগ আমি কিছুতেই হাতছাড়া করবো না। প্রয়োজন পরলে সাদির সাথে আঠার মতো লেগে থাকবো। তারপরও তাকে এবার ছাড়ছি না৷ ‘
মেয়ের হাসি মুখখানা দেখে হেনা চৌধুরীর মুখেও হাসি ফুটলো৷ বড্ড আদরের মেয়ে তার। মেজাজটা চওড়া হলেও সন্তানকে তো ফেলে দিতে পারবেন না৷ তাই আদরেই সবসময় তাকে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে।
_______________
পদ্মলয়ার ডাইনিং রুমে সবাই ব্রেকফাস্টের জন্য বসেছে। তাদের সাথে শান্ত-তানবীরও জয়েন করেছে। বড়দের নজরে সেটি আড়াল হলো না। তারা সবাই কিছু বললো না। বরং হাসিমুখেই তাদের সাথে কথা বলছে। তারা যেন সকলেই নীলার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার আসার পর থেকে শুধু একটার পর একটা খুশি লেগেই রয়েছে। হাসিবুর রহমান তানবীরের সাথে বরাবরই বন্ধুর মতোন। তাই এবারও খানিকটা রসিকতার স্বরে বলে উঠল,
— ‘ তাহলে দুষ্টু পুত্র, বিয়ে-শাদি এবার বোধহয় ভাগ্যে জুটবে? ‘
— ‘ হ্যাঁ বাবা৷ তুমি বললে এখনই বিয়ে, এখনই নাতি-নাতনি হাজির। ‘
বলেই সে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। হাসিবুর রহমান অন্যসময় দুইতিন কথা বললেও এবার পুরোপুরি চুপসে গেলেন। বেয়াই-বেয়াইনসহ তার ছেলের বউরা এখানে উপস্থিত। তার মধ্যে এই দুষ্টু ছেলেটার কি এসব না বললেই নয়?
তিনি সবার অগোচরে তানবীরকে চোখ রাঙিয়ে শাসালো। তানবীর যেন তাতে আরো মজা পেল। সে শান্তর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— ‘ দেখো, দেখো তোমার শশুরমশাই কি বলে। ‘
শান্ত আড়চোখে একবার হাসিবুর রহমানকে দেখে তানবীরের পায়ে টেবিলের নিচে দিয়ে জুতো পিষলো। ছেলেটার তো লজ্জা নেই। সে এবার তাকেও সবার সামনে নির্লজ্জ বানিয়ে ফেলছে। তানবীর ভ্রুজোড়া কুঁচকে ঘাড় বাকিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত করে শান্তর সকল চিন্তা চেতনাকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে এই ছেলে তাকেও জুতো দিয়ে পিষে দিলো। শান্তর মুখ থেকে চিৎকার বেড়িয়ে এসেছে। সে ড্যাবড্যাব করে পাশে বসা ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ তার মৃদু চিৎকারে টেবিলে উপস্থিত সবাই তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিন্তু এসবের মধ্যে তানবীর একেবারে শান্ত। সে নিজের মনে খেয়ে যাচ্ছে।
— ‘ কি হয়েছে মা? এভাবে চিৎকার দিয়েছিস কেন? ‘
— ‘ না আসলে না মানে এমনি। ‘
শান্ত তানবীরের দিকে রাগী কটমট চাহনি নিক্ষেপ করে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। সবাইকে এইরকমভাবে একসাথে পেয়ে নীলার মনটাও আজ ভীষণ হাসিখুশি। সাদিদ সবটাই পরখ করছে৷ এবং তার ঠোঁটের কোণেও হাসি ঝুলছে। তখনই কলিংবেল বাজতেই একজন সার্ভেন্ট গিয়ে দরজা খুলে দিলো। এবং তানহা হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। সাদিদ ঘাড় বাকিয়ে তানহাকে দেখে হাসলো। খুব সুক্ষ্মভাবে পরখ করলে দেখা যাবে সেটা ভীষণ রহস্যঘেরা তীর্যক হাসির রেখা। সাদিদ টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তানহার এতদিন পর সাদিদকে দেখে আর হুঁশ নেই৷ সে দৌড়ে এসে তাকে ঝাপটে ধরতেই শেষ মুহূর্তে সাদিদ সরে দাঁড়ালো। যার ধরুন তানহা আশাহত হলো। কিন্তু সাদিদ বেশ হাসিমুখেই বলে উঠল,
— ‘ কিরে তুই? যাকগে ভীষণ ভালো হয়েছে। নতুবা আমি নিজেই তোর দর্শনে হাজির হতাম। ভীষণ দরকারী কাজ যে। ‘
— ‘ সত্যি বলছিস সাদি? তুই সত্যিই আমার সাথে দেখা করতে যেতি? ‘
— ‘ মিথ্যা হবে কেন? আর তোর সাথে কি আমার রসিকতার সম্পর্ক নাকি? ‘
সাদিদের এমন হাসিখুশি ভাব দেখে তানহা বড্ড খুশি হলো৷ যাক দেরী হলেও যে অবশেষে নীলার ভূত তার মাথা থেকে নেমেছে এটাই অনেক। সাদিদ এবার গলা উঁচিয়ে সার্ভেন্ট মারুফাকে ডাকলো,
— ‘ জ্বি স্যার? ‘
— ‘ দ্রুত সেনিটাইজার আর গ্লাভস নিয়ে আসো। ‘
— ‘ ওকে সার। ‘
মিনিটখানেকের মধ্যেই সার্ভেন্ট এসে সাদিদকে সেগুলো দিয়ে দিলো। সে প্রথমে হ্যান্ড সেনিটাইজেশন শেষে গ্লাভস পরে নিলো। তানহার আগমনে আর সাদিদের গলা শুনে সবাই এবার অর্ধেক খাওয়া রেখেই লিভিংরুমে উপস্থিত হলো। সবার মাঝে নীলাকে দেখে তানহার কলিজার পানি শুকিয়ে যাবার উপক্রম। তবে কি তার সব আশা এবারও বিফলে যাবে? তার উত্তর পেতে খুব বেশি দেরী হলো না। তানহার ধারণাকে সম্পূর্ণ সঠিক প্রমাণ করে সাদিদ তার গালে সজোরে থাপ্পড় বসালো। থাপ্পড়ের আওয়াজ এতটাই বেশি ছিলো যে নীলাসহ উপস্থিত সবাই কেঁপে উঠল। সাদিদের রাগ শুধুমাত্র একটাতেই ক্ষান্ত হলো সে। সে তানহাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরপর দুইগালে সমানে সমানে চারটা থাপ্পড় বসালো। পুরুষদিপ্ত এমন বলিষ্ঠ শরীরের হাতের থাপ্পড়ে তানহার ঠোঁটের কোণ কেটে গিয়েছে। দুই গালে লালচে হয়ে আঙুলের দাগ ফুটে উঠেছে। ফর্সা মুখে এমন লালচে দাগ দেখলে যে কোনো মানুষের হয়তো মায়া হবে। কিন্তু সাদিদের বিন্দুমাত্র মায়া হলো না। কোনো পূর্ব সম্পর্কের জের ধরে সে এই অপরাধীকে মাফ করলো না। সাদিদ এমন অবস্থাতেই তানহার গাল চেপে ধরল। এতটাই জোরে যে আঙুল বোধহয় গাল বেধ করে ভিতরে প্রবেশ করবে। এতক্ষণ সবাই দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও শাহেদ এবার এগিয়ে আসলো। সাদিদের হাত থেকে তানহাকে ছুটানোর চেষ্টা করে বলল,
— ‘ সাদি, অনেক হয়েছে। ছাড় এবার। ‘
— ‘ না ভাইয়া। আজ তুমি আমাকে বাধা দিও না। এই অসভ্য মেয়েকে আজ শায়েস্তা করার সুযোগ দাও আমাকে। আর তুই, তোর কলিজা কত বড় সেটাই আমি দেখবো। কতবড় কলিজা হলে তুই আমার জানের উপরে নজর দিস। ‘
— ‘ আ..মি তোকে ভালোবাসি সাদি। ভী..ষণ ভালোবাসি। ‘
তানহার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কেননা সাদিদ এতটাই জোরে চেপে ধরেছে যে মুখ নাড়ানোও কষ্টকর। কিন্তু সাদিদ তারপরও তাকে ছাড়লো না। রাগ যে তার কোনোভাবেই কমার নয়।
— ‘ ভালোবাসিস? ভালোবাসা মাই ফুট। ভালোবাসার মধ্যে বুঝি এতটাই স্বার্থপরতা থাকে? নিজের স্বার্থের জন্য তুই আমার প্রাণপাখিটাকে এতটা কষ্ট দিয়েছিস। এমনকি শুধু তাকে নয়, আমার অনাগত সন্তাকেও তুই তোর স্বার্থের জন্য ছেড়ে দিসনি৷ ‘
সাদিদ ধাক্কা মেরে তানহাকে নিচে ফেললো। সে রাগে ফোঁসফোঁস করছে। উপস্থিত সবার মধ্যেই আতংক বিরাজ করছে। সাদিদ যেই পরিমাণ রেগে আছে না জানি কি থেকে কি করে ফেলে।
নীলারও ভয় লাগছে। কিন্তু সে চায় না রাগের মাথায় সাদিদ কোনো ভুল করে ফেলুক। তাই সে ধীরে পায়ে সাদিদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। সাদিদ অসতর্কতাবশত রেগে পিছনে তেড়ে আসতে নিলেই নীলার তাতে পরে যাবার উপক্রম হলো। সাদিদ মুহূর্তেই তাকে ঝাপটে নিজের সাথে আগলে নিলো৷ গালে হাত রেখে অস্থির কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ পাখি, এই ঠিক আছো তুমি? পাগল হলে না-কি! এখানে এসেছো কেন? ‘
— ‘ আমি পুরোপুরি ঠিক আছি। কিন্তু আপনি এইরকম পাগলামি শুরু করেছেন কেন? ‘
নীলা ঠিক আছে জেনে সাদিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সবার সামনেই বুকে আগলে নিয়ে কপালে আলতো করে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিলো। অতঃপর গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,
— ‘ এখানে আর আসবে না। ভাবীমণি, ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও প্লিজ। ‘
নিধি সাদিদের কথায় এগিয়ে আসতেই নীলা বাধা দিলো,
— ‘ না আপুনি, আমি যাব না। দেখো, উনি কেমন পাগলামি শুরু করেছে। উনাকে থামতে বলো। ‘
— ‘ পাখি। ‘
সাদিদ জোরে ধমকে উঠল। নীলা ছলছল চোখে তার দিকে তাকাতেই সে মাথা নুইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না এই মেয়েটা তাকে কোনো কিছুই শান্তিমতে করতে দিবে না। সে এগিয়ে এসে নীলাকে আগলে নিলো। তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েই তানহার উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ আমি এখানে সেখানে আমার পাখিটাকে তন্নতন্ন করে খোঁজেছি৷ কোথায় গেলে তার একটু সন্ধান পাওয়া যাবে সেই আশায় আমি চাতকের মতো গলির অলিতে-গলিতে ঘুরেছি৷ অথচ আমার পাখি কি-না তোর আস্তানায় বন্দি ছিলো? শত্রু নিজের এতটা কাছে থেকেও ভালো মানুষের রূপ ধরেছে আর আমি কি-না তাকে চিনতেই পারলাম না! এজন্যই বলা হয় যুগে যুগে ছলনার আশ্রয়ে যারা পিঠে ছুড়ি আঘাত করেছে তার মধ্যে আপন মানুষের হাতই বেশি। তুই আবারও আমার সামনে ইতিহাস রচনা করলি তাহনা। আবারও। ‘
সাদিদের গলা ধরে এসেছে। সে নিচু হয়ে নীলার মুখপানে তাকিয়ে তাকে দুইহাতের বাঁধনে আবদ্ধ করে মাথায় চুমু দিয়ে আবারও তানহার দিকে তাকালো। রক্ত লাল চোখে আবারও বলে উঠল,
— ‘ তুই যদি ওর পরিবর্তে আমাকে মারাত্মকভাবে জখম করতি তাহলেও বোধহয় সম্পর্কের দোহায়ে আমি তোকে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু তুই যার শরীরে আঘাত করেছিস তার শরীরের একটা আঘাত আমার শরীরে সেটা শতগুণ বাড়িয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে। তার একফোটা চোখের জল আমার কাছে বিষাক্ত জলের থেকে বেশি তীব্র কষ্ট অনুভব করায়। আর তাকেই তুই এতটা মাস ধরে কষ্ট দিয়ে এসেছিস! তাহলে তোকে আমি কিভাবে ক্ষমা করবো? তুই ক্ষমা পাবি না। এমনকি তোর সাথে জড়িত প্রত্যেকটা সদস্যকে এই সাদিদ গুণে গুণে তার প্রাণপাখির কষ্টের ভাগ ফিরিয়ে দিবে। ‘
সাদিদ কোনোকালেই মেয়েদের গায়ে হাত তোলার পক্ষপাত করে না। সে নিজেও এটা মেনে চলে এসেছে। কিন্তু আজ তানহা তার ধৈর্য্যের বাহিরে অবস্থান করছে। তাই সে বাধ্য হয়ে তার গায়ে হাত তুলেছে। কিন্তু নীলার জন্য শরীরের রাগটা পুরোপুরি দমাতে পারেনি।
অবশেষে তানহাকে নীলার অপহরণের দায়ে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। নিজের লোক বলে সবার কিছুটা মন খারাপ হলেও সেটা চাপা পড়লেদ। কেননা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সবাই সমান। সেখানে কোনো আপন-পর নেই। যে অন্যায় করেছে শাস্তি তাকে পেতেই হবে৷ তাই তানহার পরিবারের লোকজন ঝামেলা করলেও সাদিদ সেসবে পাত্তা দেয়নি। সাফ সাফ বলে দিয়েছে সম্পর্কের দোহায় দিয়ে তাকে আটকানো যাবে না। যার গায়ে উনাদের মেয়ে আঁচড় কেটেছে তার ক্ষেত্রে সাদিদ কোনোভাবেই অপরাধীকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে পারবে না। তাই উনাদের মেয়ের উপযুক্ত শাস্তি হবেই।
সাদিদ নিজের রাগ নিয়েই উপরে উঠে গেল। সে এই মুহূর্তে নিজের রাগ কারো উপর খাটাতে চায় না৷ আর নিচে থাকলে রাগের বশে কারো সাথে খারাপ আচরণ করেই ফেলবে।
দিনের বেলাতেই রুম অন্ধকার করে সাদিদ মেঝেতে বসে বিছানায় হেলান দিয়েছে৷ পূর্ববর্তী দিনগুলোর কথা ভাবতেই সাদিদের রাগে রক্ত টগবগিয়ে উঠে। তার প্রাণপাখিটা কতটা কষ্টে সেইসকল দিনগুলো পার করেছে৷ অথচ সাদিদ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। নিজের উপরই সাদিদের সবচেয়ে বেশি রাগ হয়।
দরজা খুলে বাহিরের আলো ভিতরে প্রবেশ করতেই সাদিদ মাথা উঁচিয়ে তাকালো। আধো আলো-অন্ধকার রুমে নীলার অস্তিত্বটা বুঝতে সাদিদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না। এতক্ষণের রাগ নিভে গিয়ে মুহূর্তেই সাদিদের মাথায় চিন্তারা এসে ভর করলো। সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে নীলাকে দরজার সামনে থেকে এনে ব্যস্ত গলায় বলে উঠল,
— ‘ তুমি আবার উপরে কি জন্য এসেছো? তোমাকে বারণ করেছিলাম না, উপরে আর না আসতে? তারপরও কেন এলে? আমাকে জ্বালিয়ে না খেলে বুঝি তোমার শান্তি হয় না? ‘
নীলা যদিও জানে সাদিদ এই মুহূর্তে নিজের মধ্যে নেই৷ অতিরিক্ত রাগে এমন ঝাঁঝালো স্বরে বলছে। তারপরও কথাটা নীলার মনে কষ্ট দিয়েছে। সে মাথা নিচু করে ছলছল চোখজোড়া লোকায়িত করার চেষ্টা চালালো। অতঃপর হাতের কফি মগটা পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে বলে উঠল,
— ‘ আপুনি উপরে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে। মনে হয়েছে আপনার মাথা ব্যাথা করছে তাই কফি নিয়ে এলাম। আচ্ছা আমি যাই। ‘
নীলার আর দেরী করলো না। কফি মগটা রেগে দ্রুত বেড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু সাদিদ দিলো না। চোখের পলকেই দরজা লক করে নীলার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। অভিমানিনীর যে বড্ড অভিমান জমেছে সাদিদ সেটা বুঝতে পারলো। সাদিদ এগিয়ে এসে নীলার মুখোমুখি দাঁড়ালো। নীলার নিচু করা মুখটা উপরে তুলতে থুতনিতে হাত রাখলো। সাদিদ থুতনিতে ধরতেই নীলা চোখ বন্ধ করে নিয়েছে৷ আর বন্ধ চোখের অশ্রুকণাগুলো মুহূর্তেই গড়িয়ে পড়ে শুকনো গালগুলো ভিজিয়ে দিলো।
সাদিদের রাগ পরে গেল। সে নিঃশব্দে হেসে নীলার বন্ধ আঁখিতে ঠোঁটযুগল চেপে ধরলো। ভীষণ আদরে শুষে নিলো প্রিয়তমার অভিমানে জড়ে পড়া নোনাজল। অতঃপর মুখটা আঁজলাভরে ধরে ডেকে উঠল,
— ‘ প্রাণপাখি। ‘
নীলা তাকালো না। সাদিদ আবারও ডাকলো,
— ‘ জান? চোখ খুলে তাকাবে না? ‘
নীলা চোখ বন্ধ রেখেই মাথা নাড়িয়ে না করলো। সেটা দেখে সাদিদ আবারও মৃদু হাসলো। প্রিয়তমার রাগ ভাঙাতে সাদিদ উঠেপড়ে লাগলো। গালে চুমু দিয়ে আদর করলো৷ কপালেও উষ্ণ পরশ দিলো। নাকের ডগাও বাদ রাখলো না। নীলা আর অভিমান ধরে রাখতে পারলো না। চোখ খুলে নিচুস্বরে বলল,
— ‘ হয়েছে। আর আদর দেখাতে হবে না৷ অপরাধ করেন অথচ রাগ দেখাতে দেন না। এটা কেমন কথা? ‘
সাদিদ শব্দ করে হাসলো। একহাতে নীলাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। আর অপরহাতে টেবিলের উপর থেকে একহাতে কফির মগটা নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে চললো। নীলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে সাদিদ তার কাঁধে থুতনি রাখলো। তারপর নীলার দিকে কফি মগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
— ‘ যদিও প্রেগন্যান্সিতে ক্যাফেইন খাওয়া ঠিক নয়। তবুও আমার সাথে একটুখানি খেয়ে নাও। ‘
নীলা তার কথায় হাসলো। অতঃপর মগটা সামনে থেকে সরিয়ে বলে উঠল,
— ‘ এটা আপনার জন্য এনেছি৷ আমি এখন খাবো না। ‘
— ‘ একটু? ‘
— ‘ একটুও না৷ কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ‘
— ‘ তবুও আমার সাথে একটুখানি। তোমার মিষ্টি ঠোঁটের স্পর্শ না পরলে এই কফির পানসে ভাব যাবে না৷ ‘
নীলা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। কি খারাপ লোক। নিজের জন্য এতক্ষণ বলছিলো। আর নীলা ভেবেছে তার জন্য বলছে৷ নীলা একটা ভেংচি কাটলো৷ অতঃপর ঠেস দিয়ে বলল,
— ‘ মগে আপনার পরিমাণ একচামচ চিনি রয়েছে। আর সাথে পাউডার মিল্ক। পানসে হবার নো চান্স। ‘
— ‘ বললাম তো পানসে হয়েছে। নতুবা টেস্ট করে দেখো৷ ‘
নিরীহ নীলা এবার সত্যিই মগে চুমুক দিলো। না সবকিছু ঠিকই আছে৷ সাদিদের দিকে তাকাতেই সে চোখ টিপ দিলো। অতঃপর মগে চুমুক দিয়ে রাশভারি স্বরে বলে উঠল,
— ‘ ইশশ কি মিষ্টি! পাখি তোমার ঠোঁটের কি পারমানেন্ট কোনো টেস্টিং কিট আছে? না মানে যখন ইচ্ছে তখন এই মিষ্টি স্বাদের টেস্ট নিতাম৷ ‘
— ‘ অসভ্য একটা। ‘
নীলা সাদিদের বাহুতে কিল বসালো। সাদিদের তাতে হেলদোল নেই৷ সে আবারও কফি মগে চুমুক দিয়ে নীলার উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ আর এই অসভ্যটাই তোমার বর। এমনকি তোমার গর্ভের সন্তানের বাবা। ‘
নীলা এমন কথায় ভীষণ লজ্জা পেল। এই সাদিদটা বড্ড ঠোঁটকাটা। মুখে কিচ্ছুটি আটকায় না।
____________
সকালের নাস্তার পরপরই সাদিদ নীলার সুবিধার জন্য নিচে তাদের রুম শিফট করেছে। নীলাকে রুমে রেখে সেই যে হাওয়া হয়েছে এখন অব্দি তার খোঁজ নেই। নীলা বারকয়েক তার ফোনে কল দিয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতোই ফোন সুইচ অফ আসছে। সে এসব নিয়ে চিন্তা করেছে জানলে সাদিদ ভীষণ বকা দিবে৷ কিন্তু তাতে কি সে চিন্তা বাদ দিতে পারছে? ওহ্ একবারেই পারছে না৷
অপরদিকে সাদিদের কপাল বেয়ে ঘাম পরছে৷ এই শীতের আবহাওয়ায়ও সে তরতর করে ঘামছে৷ তার শরীর থেকে যেমন করে ঘাম ঝরছে সামনের মেঝেতে পরে থাকা ব্যক্তিটির শরীর থেকে তেমনিভাবে রক্ত গড়িয়ে পরছে৷ সাধারণ কোনো ব্যক্তির এই রক্তের স্রোত দেখলে অজ্ঞান হবার কথা৷ কিন্তু সাদিদ যেন তার রক্তের নেশায় রয়েছে। তার শরীর থেকে যতটা রক্তের বিন্দু গড়িয়ে পরছে সাদিদের মনে ততো প্রশান্তি হচ্ছে। অর্ণব এবার এগিয়ে গেল। সাদিদকে পিছন থেকে শক্ত করে ধরে বলল,
— ‘ সাদি, আর না৷ এতক্ষণ তোর পাগলামি দেখলেও আর সহ্য করবো না। ছাড় ওকে নতুবা মরে যাবে৷ ‘
— ‘ মরে যাক। এমন কুলাঙ্গারের বেঁচে থেকে লাভ নেই৷ তাই মরে কিছুটা উপকার করুক৷ ‘
— ‘ চুপ। আর একটা আঘাত করবি না। ‘
অর্ণব তানবীরকে ইশারা করতেই সে পাশ থেকে এগিয়ে আসলো। দুইজনে মিলে জোর পূর্বক সাদিদকে ইমরানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। সাদিদের গায়ের শার্টে রক্তের ছুপছুপ দাগ পরে রয়েছে। শরীরের বিভিন্ন অংশেও ইমরানের শরীর থেকে নিঃসৃত রক্তের বিন্দু। সাদিদ হাতের তালুতে কপাল মুছে ঝটকা মেরে তানবীর-অর্ণবকে পিছনে ফেলে আবারও ইমরানের দিকে এগিয়ে গেল। ধারালো ছুরিটা দিয়ে আবারও কয়েকদফা দাগ দিলো। ইমরান করুণ আর্তনাদ করে উঠল। সাদিদ তার হাতের তালুর উপর জুতো পিষে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,
— ‘ ঠিক একইভাবে আমার পাখিও হয়তো আর্তনাদ করেছে। কিন্তু তোরা তাকে দয়া করিসনি৷ তাই আমিও করবো না। ‘
বলেই সাদিদ রক্তাক্ত হাতের উপর সজোরে হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলো। ইমরানের চিৎকারে অর্ণব তানবীর কানচেপে ধরেছে। বন্ধ রুমে শব্দটা ভীষণ বিদঘুটে শুনাচ্ছে। তারা সাদিদকে আর পাগলামি করতে দিলো না। নতুবা সাদিদের হাতে আজ নির্ঘাত ইমরানের মৃত্যু হবে। দুইজনে এবার সর্ব শক্তি দিয়ে সাদিদকে ধরে রেখেছে। কোনোভাবেই তাকে ছাড়লে চলবে না। সাদিদ আবারও ছুটে আসার চেষ্টা করতে করতে বলল,
— ‘ ছাড় আমাকে। ইচ্ছে তো করছে এই হারা* সবগুলো অঙ্গ শরীর থেকে আলাদা করে দিতে। কুত্তা* সাহস কতোটুকু হলে সে আমার পাখির গায়ে স্পর্শ করে! জানিস? এই হারামি, এই হারামি ঐ অসভ্য তানহার কথায় আমার পাখিকে বাসা থেকে বের করে এনেছিলো। ঘুম থেকে জেগে যেন চিৎকার না করতে পারে সেইজন্য তাকে বেহুঁশ পর্যন্ত করেছে৷ ভাবতে পারিস তোরা? আমি ব্যতিত ও আমার প্রাণপাখির শরীর স্পর্শ করেছে! আমি এটা কিভাবে মানবো? ছাড় আমাকে। এই বেজন্মার শরীরের সবকটা অংশ আমি নিজ হাতে কেটে টুকরো টুকরো করবো৷ ‘
— ‘ আল্লাহরওয়াস্তে মাফ কর দোস্ত। আমার নিজের শরীরই কাটা দিচ্ছে। আর দেখতে পারছি না এসব। প্লিজ বন্ধ কর। তার অপরাধের থেকে অনেক বেশি শাস্তি দিয়েছিস। ‘
— ‘ না। কোনো শাস্তিই দিতে পারলাম না। এটাকে মাটির নিচে জ্যান্ত পুঁতে দিতে পারলে তবে আমার কিছুটা শান্তি লাগতো। ‘
অনেকটা সময় তারা সাদিদকে শক্ত করে ধরে রাখলো৷ যখন দেখলো সে নিজের হুঁশে আছে তখন তারা তাকে ছাড়ল। তানবীর গিয়ে টুকটাক ব্যান্ডেজ করে দিয়ে রক্ত পরা বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সাদিদ পানির বোতল নিয়ে মাথা-মুখ ভিজিয়ে নিলো। টিস্যু পেপার দিয়ে চোখে-মুখের পানি মুছতে মুছতে ইমরানের উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ আমার বড্ড ইচ্ছা ছিলো তোর এই করুন পরিণতি আমার পাখিটাকে স্বচোখে দেখাবো। কিন্তু সেটা আর হবার নয়। বুঝলি? আমার বউটা না বড্ড অবুঝ আর বড্ড নরমও। তাইতো তোর সহযোগীর সামান্য দুইটা চর-থাপ্পড়েই তার চোখে পানি এসে গিয়েছে। আর সেই জায়গায় তোর এমন অবস্থা সে কোনো কালেই হজম করতে পারবে না। তারউপর অজ্ঞান হয়ে যাবার শতভাগ নিশ্চিয়তা রয়েছে। সে তো এখন একা নয়। আমার অংশও তার গর্ভে বেড়ে উঠছে৷ তাই এতসব ভেবে নিজের ইচ্ছেটা অপূর্ণ-ই রেখে দিলাম৷ ‘
সাদিদ গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে বের হতে হতে অর্ণব আর তানবীরের উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ শত হলেও সম্পর্কে আমার সম্বন্ধি। তাই সপ্তাহখানেক এই অমানুষটার ভালোভাবে যত্নআত্তি কর। তারপর না হয় পুলিশের হাতে তুলে দিস। আর ততদিনে যদি মরে যায় সেটাও খারাপ হবে না। পৃথিবী থেকে একটা অমানুষিক কমলে একটা ভালো মানুষের বেশি জায়গা হবে৷ ‘
বলেই সাদিদ বেড়িয়ে গেল। তানবীর অর্ণব এখনও সাদিদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ইউকে থাকাকালীন সময়েও তারা নীলার জন্য সাদিদের এসব পাগলামি দেখে এসেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এখনও এমন রক্তারক্তির প্রয়োজন হয়নি বিধায় সাদিদের এই রূপটা তাদের কাছেও অজানা ছিলো। এই ছেলেটা একাধারে ভীষণ যত্নে ভালোবাসা মানুষ। একইভাবে প্রয়োজনে পাগলাটে মানুষ। যার পাগলামির চূড়ান্ত পর্যায়ে কেবল ধ্বংসলিলা অবশিষ্ট।
সাদিদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় অনেক রাত। সে এতো রাতে কলিং বেল চাপেনি। সার্ভেন্টকে কল করিয়ে দরজা খোলেছে। সে নিঃশব্দে তাদের রুমের সামনে এসে দরজা খুললো। বিছানায় তার ঘুমন্ত পরীটাকে দেখেই সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। সে এগিয়ে এসে কপালে চুমু দিতে চাইলো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগপর্যন্ত পরিবেশের কথা চিন্তা করে নিজেকে সংযত রাখলো। কাভার্ড খুলে টাওজার আর ট্রি-শার্ট নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল। লম্বা একটা হট শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে আসলো৷ কিন্তু বিছানায় নীলাকে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেল,
— ‘ জান, কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? ডক্টর ডাকবো আমি? ‘
সাদিদ মুহূর্তেই অস্থির হয়ে উঠল। নীলা ঘুমন্ত মুখে মৃদু হাসলো। অতঃপর চোখ ঢলে বলল,
— ‘ আরে আমি ঠিক আছি। এমনিতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছে। ‘
— ‘ ওহ্ তাহলে চলো মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দ্রুত ঘুম চলে আসবে। ‘
— ‘ একটু চুপ করে বসুন তো। সবসময় কেবলমাত্র আমাকেই নিয়ে পড়ে থাকেন। ‘
সাদিদ তার কথায় হাসল। বুকে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে আদর করলো। নীলা এবার মিনমিনিয়ে বলে উঠল,
— ‘ এতো রাতে যে গোসল করেছেন? ‘
— ‘ এমনি। একটু গরম লাগছিলো তাই আর কি। ‘
নীলা নিজেও মৃদু নাসলো। এই শীতের রাতেও এই ছেলেটার এতো গরম কোথায় থেকে আসে? সে আবারও প্রশ্ন করলো,
— ‘ সারাদিন কোথায় ছিলেন? না লাঞ্চ না ডিনার? ‘
— ‘ একটু কাজ ছিলো জান। ‘
— ‘ তাই বলে ফোনটাও অফ করে রাখবেন? জানেন আমি কতবার কল দিয়েছি? ‘
— ‘ তাই? বউটা বুঝি এতটাই মিস করছিলো? ‘
বলেই সাদিদ তাকে বাহুডোরে শক্ত করে চেপে ধরলো। কানের পিছনে মুখ ঘষতেই নীলা হাসতে হাসতে সরে আসলো।
— ‘ সরুন তো। সবসময় শুধু দুষ্টুমি৷ ‘
— ‘ দুষ্টুমি আর করতে পারলাম কই? বউ যে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার ন্যায় তার কাটা জালের ব্যবস্থা করে রেখেছে৷ ‘
— ‘ ইশচ আপনি এতো অসভ্য কেন? সবসময় শুধু পঁচা কথাবার্তা! ‘
— ‘ এমা বুঝে গিয়েছো? বাহ্ বউ দেখি মারাত্মক বুদ্ধিমান হয়ে যাচ্ছে। বুঝে যখন গিয়েছো ভালোই হলো৷ তাহলে পরবর্তীতে আর হিসাবে ঝামেলা হবে না। ‘
— ‘ হিসাব? কি হিসাব? ‘
— ‘ না৷ যতটা আশা করেছিলাম ততটা এখনও হয়ে উঠতে পারোনি৷ ‘
নীলা চোখ বাকিয়ে তাকাতেই সাদিদ তার গালে আলতো করে কামড় বসালো। নীলা চোখ-মুখ কুঁচকে গাল ঘষতেই সাদিদ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— ‘ হিসাব মানে হচ্ছে সবগুলো দুষ্টুমির হিসাব। যেগুলো এখন বাদ যাচ্ছে সবগুলো উশুল করতে হবে না? বউটাকে একেবারে দুষ্টুমির রাজ্যে নিয়ে চলে যাবো। ‘
লজ্জায় নীলার ফর্সা গাল টকটকে টমেটোর ন্যায় লাল হয়ে গেল। সাদিদ সেইদিকে তাকিয়ে শব্দ করেই হাসলো। অতঃপর গালের কামড় দেওয়া যায়গাতে ভেজা ঠোঁটের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিলো। নীলা মাথা নিচু করে হাসলো। অতঃপর ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়েই নিচুস্বরে বলল,
— ‘ আপনি কি ডিনার করে এসেছেন? ‘
— ‘ না বউ৷ একজনকে এতো খাইয়ে নিজে খাওয়ার সময় পাইনি৷ লাঞ্চ-ডিনার সবই বাকি৷ ‘
— ‘ কিছু বললেন আপনি? ‘
— ‘ আজ্ঞে না। বলেছি ডিনার করা হয়নি৷ ‘
— ‘ আপনি তাহলে বসুন। আমি খাবারগুলো গরম করে টেবিলে রাখছি। ‘
— ‘ একদম পাকনামি করার চেষ্টা করবেন না। আমি সার্ভেন্ট ডেকে করিয়ে নিবো। ‘
— ‘ এতো রাতে সার্ভেন্টদের ডেকে তুলবেন? তার চেয়ে বরং আমি যাই? প্রয়োজন হলে আপনি সাথে সাথে থাকুন। আমিতো এখন জেগেই রয়েছি৷ ‘
সাদিদ কয়েক মুহূর্ত কি ভেবে যেন রাজি হলো। অতঃপর নীলার সাথে দাঁড়িয়ে থেকেই সবগুলো খাবার গরম করে নিলো। কিন্তু নীলাকে টেবিলে কিছু রাখতে দিলো না। সাদিদ নিজে সবগুলো টেবিলে রাখলো। নীলা খেয়েছে শুনে আর জোর করলো না। বেশি রাত হয়ে গিয়েছে। নতুবা আবারও একটু জোর করে খাইয়ে দিতো। কিন্তু নীলার অসুবিধা হবে বিধায় জোর খাটালো না৷
খাওয়ার পর নীলাকে টেবিলে বসিয়ে সাদিদই পূর্ণরায় সবগুলো ফ্রিজে রেখে নীলাকে নিয়ে রুমে আসলো।
বিছানায় শুয়ে নীলাকে আস্তে করে বাহুর উপর শুইয়ে দিলো। এখন যে নীলার বুকে শুতে সমস্যা হয় সেটা সাদিদ গতকাল রাতেই বুঝে গিয়েছে৷ তাইতো নীলার ঘুমানোর পরপরই হাতের উপর শুইয়ে দিয়েছিল। আবার সকালের দিকে নীলা নিজেই এসে বুকের উপর শুয়ে পরেছিল৷ ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে সাদিদও আর সরিয়ে দেয়নি। নীলা এতক্ষণ সাদিদের কান্ড দেখছিল। এখন সে নিঃশব্দে হাসলো। মানুষটাকে আগবাড়িয়ে কিছু বলতে হয় না। নীলার মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই কেমন করে যেন বুঝে যায়।
নীলার হঠাৎ সাদিদের দাঁড়ির উপর নজর পড়ল। সে আস্তে করে টেনে ধরলো,
— ‘ আউচ, এই মেয়ে এভাবে কেউ ধরে? ‘
— ‘ এগুলো কি? ‘
— ‘ এগুলো কি মানে? তুমি চেনো না কি এগুলো? ‘
— ‘ আমি মানুষই। তাই না চিনবার কারণ নেই। কিন্তু আপনার দাঁড়ির এই অবস্থা কেন? চুলগুলোও কেমন বড় বড় হয়ে গিয়েছে। কাটেন না নাকি? আমি এগুলো রাঙামাটিতেই খেয়াল করেছিলাম। কিন্তু আর বলা হয়নি৷ ‘
সাদিদ এবার বুঝলো নীলা কি বলতে চায়ছে। তাই সে নীলাকে যত্ন করে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। কম্বলটা নিজেদের উপর ভালোভাবে দিয়ে বলে উঠল,
— ‘ তুমি ছিলে নাতো পাখি, তাই কোনো কিছুর-ই ভালো অবস্থা ছিলো না। এখন তুমি এসে গিয়েছো, দেখবে সবকিছু আবার আগের মতো ঝলমলে হয়ে যাবে৷ ‘
সাদিদ কথাটুকু বলেই দীর্ঘ ভালোবাসায় প্রিয়তমার চুলের ভাঁজে চুমু দিলো। নীলার একদিকে কষ্টরা হানা দিলো আর অপরদিকে এতোটা ভালোবাসা ভাগ্যে লিখা ছিলো বিধায় মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট হাজারো শুকরিয়া আদায় করলো। আর প্রিয়তমের এতোটা ভালোবাসার যোগ্য ফেরত উপহারস্বরূপ সাদিদের বুকে মুখ গোঁজল। কোমল ঠোঁটগুলো খুবই সন্তপর্ণে স্বামীর বুকে লেপ্টে দিলো৷ কিন্তু অবুঝ পাখি কি জানে না? এই সাদিদ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে? তার নিঃশব্দের নিঃশ্বাসও সাদিদের নিকট একেবারে পরিস্কার।
#চলবে…
[ প্রিয়পাঠক, পাঠকমহলের গ্রুপে আপনাদেরকে পূর্বেই আমার পরীক্ষার বিষয়ে জানিয়েছিলাম। তাই আজকের পর অনিদিষ্ট একটা সময়ের জন্য অন্তরালের অনুরাগের পরবর্তী অংশ দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু ইনশাআল্লাহ সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা সম্পূর্ণ করে জীবিত থাকলে আপনাদের মাঝে আবারও হাজির হবো৷ ততদিন সবাই ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন আমার জন্য। ]