গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬০ 💛❤💛
একসপ্তাহের ব্যবধানে সাদিদ নীলার জীবনে যেন বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। যেমন বেড়েছে সাদিদের অতিরিক্ত ভালোবাসার পাগলামি। তেমনিভাবে নীলা তাতে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে সাদিদের সাথে রাগারাগি। কিন্তু সাদিদের তাতে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং সে নিজের কার্যসিদ্ধিতে সমানতালে ব্যস্ত। এমনকি মহা ব্যস্ত। খুনসুটিতে মেতে থাকা এই দম্পতির সাথে সাথে অপর দুইটি মানুষের জীবনেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগার মাত্র অপেক্ষা। যেই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে আরও মাস দুইয়েক সময়ের অপেক্ষা ছিল, সাদিদের পাগলামিতে এখন এটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
কেননা আজকে তানবীর আর শান্তর হলুদ ছোঁয়া। আর
আজকে গায়েহলুদের কার্যক্রম শেষ হতেই কাল তারা বিয়ের মতো পবিত্র একটা বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
শান্তদের পরিবারের কিছু কারণবশত সমস্যায় তারা বিয়ের ডেইটটা আরও মাস তিনেক পরে ঠিক করেছিল। কিন্তু সেইদিন ডক্টরের কাছ থেকে আসার পর সাদিদ নিজ দায়িত্বে এটাকে এগিয়ে এনেছে।
বলা যায় সাদিদ এককথায় ডক্টরের কথাকে উল্টে সেটা নিজের মনমতন সাজিয়ে নিয়েছে। কেননা ডক্টর নীলার শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তাকে ডেলিভারির একমাস আগে থেকে হসপিটালে এডমিট হতে বলেছিল। কিন্তু সাদিদের কথামতো সে নীলাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র রিক্স নিতে রাজি নয়। তাই সে ডেলিভারির একমাস আগে নয় বরং বাড়িতে আর বড়জোর নীলাকে একমাস রাখবে। তারপর বেবির আগমনের আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় নীলাকে হসপিটালে রেখে সার্বক্ষনিক ডক্টরদের চেকআপের আন্ডারে রাখবে।
তাই তিনমাসের সময় কমিয়ে তাদের বিয়েটা এখনই সমাপ্ত করে নেওয়া। নতুবা তাদের বিয়ের টাইমে নীলা উপস্থিত থাকতে পারবে না৷
এটা বললে অবশ্য ভুল হবে। সে আসতে পারবে। কিন্তু কথা হচ্ছে সাদিদ তখন নীলাকে নিয়ে একপাসেন্টও রিক্স নিবে না। এমনকি এখনও নীলার উপর তার ভয়ানক ভয়ানক সব নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ৷ এইরকম ঘাড়ত্যাড়া জামাইয়ের জন্য নিজের বেস্টুর বিয়েটা নীলার জন্য এমন পানসেভাবে শেষ হচ্ছে। সবার এতো এতো আনন্দের মধ্যে কেবলমাত্র নীলার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। কেননা সর্বক্ষণ রুমে বসে তাকে একপ্রকার বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে। বিয়ের মতো এমন একটা আনন্দ উৎসবে সে কেবলমাত্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
— ‘ কোথায় হারালে? হা করো। ‘
সাদিদের মৃদু ধমকে নীলা ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসলো। পুনরায় নিজের অবস্থান চিন্তা করেই সে তেতে উঠল,
— ‘ সমস্যা কি আপনার? এভাবে খাইয়ে খাইয়ে আমাকে পেটুক বানাতে চান? আর খাব না আমি। ‘
বলেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো৷ রাগে ফুলো গালগুলো আরও খানিকটা ফুলে উঠে লাল হয়ে গিয়েছে। সাদিদ তার কান্ডে ঠোঁট চেপে হাসলো। কিন্তু সেটা নীলাকে বুঝতে দিলো না। নতুবা এই মেয়ে একটু আদর পেয়ে শেষে মাথায় উঠে বসবে৷ তাই সে গম্ভীর স্বরেই বলল,
— ‘ এতোসব বুঝতে চাই না। চুপচাপ হা করো। নতুবা কিন্তু ফাংশনে নিয়ে যাব না৷ ‘
নীলা এবার অসহায় মুখ করে সাদিদের দিকে তাকালো। অপরদিকে সাদিদ ভাবলেশহীনভাবে ভুনাখিচুড়ি চামচে তুলতে ব্যস্ত।
— ‘ এতগুলো খাবার আমি শেষ করতে পারবো! ঘণ্টা দুইয়েক আগেই না ঠেসেঠুসে চাউমিন খাওয়ালেন। ‘
— ‘ ঠিক তাই। দুই ঘণ্টা আগে। এতক্ষণে সেটা পেটে থাকার কথা নয়। তাই ঝটপট হা করে পটাপট শেষ করো। ‘
— ‘ এমন করেন কেন? পেটে একটুও জায়গা নেই। ‘
— ‘ তোমার পেটে নাই থাকুক কিন্তু আমার প্রিন্সেসের পেট খালি। তার এই মুহূর্তে অনেক খিদে পেয়েছে। তাই চুপচাপ তাকে খেতে দাও। ‘
বলেই সাদিদ মুরগির মাংসের সাথে ভুনাখিচুড়ি চামচে তুলে সেটা নীলার মুখে তুলে দিলো। নীলাকেও অসহায়ের মতো শেষমেশ খেতে হয়েছে। নতুবা এই ছেলে বহুত ত্যাড়া। কথার জালে নীলাকে ফাসিয়ে নিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নেবে এটা তার খুব ভালো করেই জানা আছে।
সাদিদ প্লেটের খাবার শেষ করে নীলার মুখ যত্নে টিস্যু পেপার দিয়ে মুছিয়ে দিলো। অতঃপর কাভার্ড থেকে নীলার জন্য গায়ে হলুদের জন্য বরাদ্দকৃত ড্রেস বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলো।
— ‘ এখন রেডি হতে পারো। ‘
নীলার মুখে তৎক্ষনাৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে সময় নষ্ট না করে দ্রুত পায়ে ওয়াসরুমের দিকে ছুটতে গেলেই সাদিদ তার কব্জি টেনে ধরল। হালকা শাসানোর স্বরে বলে উঠল,
— ‘ এমন দৌড়াদৌড়ি কেন? পরে যাও যদি? তোমাকে নিয়ে আমি আর পারি না। ওয়াসরুমে যেতে হবে না। চুপচাপ দরজা লক করে রুমে চেইঞ্জ করে নাও। শুধু সারাক্ষণ লাফালাফির ধান্দায় থাকে। ‘
সাদিদ নিচুস্বরে আরও কিছু বলে কয়ে নিজে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো। নীলা আর কোনো দিকে খেয়াল না করে দরজা লক করে রেডি হতে থাকলো। এতক্ষণে সাদিদের এসব অতিরিক্ত জ্বালাময়ি টর্চার থেকে রক্ষা পেয়ে খুশি যেন তার আর ধরছে না।
সাদিদ ওয়াসরুম থেকে একেবারে শাওয়ার নিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে এসেছে। ভেজা চুলগুলো শুকনো টাওয়েল দিতে মুছতে মুছতেই সে ওয়াসরুম থেকে বের হলো।
কিন্তু সম্মুখে দৃষ্টি পরতেই তার ভ্রজোড়া তৎক্ষনাৎ কুঁচকে এলো।
নীলাকে এমন আয়নার সামনে পেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে হাতের তোয়ালেটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে দ্রুত পায়ে নীলার দিকে এগিয়ে গেল। অস্থিরতাভরা কন্ঠে বলল,
— ‘ কি হয়েছে পাখি? পেটে আবারও ব্যাথা হচ্ছে? ঠোঁট এমন উল্টিয়ে রেখেছো কেন? ‘
নীলা নিজের অবস্থান থেকেই ঘাড় ফিরিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। ভীষণ মনঃক্ষুণ্ন স্বরে বলল,
— ‘ আমি দেখতে অনেক পঁচা হয়ে গিয়েছি তাই না? ‘
সাদিদের কুঞ্চিত ভ্রুযুগল আরও খানিকটা কুঁচকে এলো৷ সে না বুঝতে পেরে কন্ঠে উৎকন্ঠা ভাব নিয়েই বলল,
— ‘ মানে? ‘
— ‘ নিজেকে কেমন মোটা-মোটা লাগছে। মুখ-টুখও ফুলে-ফেঁপে একাকার। ভীষণ বিশ্রী লাগে দেখতে। আমাকে আপনার আর ভালো লাগে না, তাই না? ‘
সাদিদ নীলার এমন কথার পরিবর্তে খানিকটা সময় স্তব্ধ হয়ে রইল। কিন্তু ধীরে ধীরে তার ভাবভঙ্গির পরিবর্তন হতে
লাগল। তার এই মুহূর্তে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। যে মেয়েটাকে সে প্রতি মুহূর্তে চোখে হারায় তাকে না-কি সাদিদের কাছে আর ভালো লাগবে না! এমনটাও কি সম্ভব?
কিন্তু সাদিদ নীলার বর্তমান অবস্থাটা বেশ ভালোই বুঝতে পারে। যেমন এই রাগ তো একটু পরেই আবার কান্না। নীলার মুডের এই ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনের সাথে সাদিদ বেশ ভালোই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে৷ আর পারবে নাই বা কেন?
ভালোবাসে যে। তার পাখিটাকে সাদিদ সীমাহীন ভালোাবাসে।
সাদিদ এবার নিচু হয়ে নীলার উল্টানো ঠোটজোড়াতে ছোট্ট করে চুমু দিলো। অতঃপর তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে পিছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে হাত রাখলো। নীলার কাঁধে নিজের থুতনি রেখে আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,
— ‘ তুমি মোটা না বরং গোলুমোলু হয়ে গিয়েছো। ‘
নীলা ঘাড় কাত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। ভাবটা এমন যে মোটা আর গোলুমোলুর মধ্যেকার তফাট টা-কি সেটার বুঝার সর্বোচ্চ প্রয়াস।
তার এমন মুখভঙ্গি দেখে সাদিদ আর নিজের এতক্ষণের হাসিটা চেপে রাখতে পারলো না। শব্দ করেই হেসে উঠল।
নীলা যেন নিজের উত্তর পেয়ে গিয়েছে। মন কুঠরে জমা হয়েছে ভীষণ কষ্ট। সে দেখতে বিশ্রী হয়ে গিয়েছে। সাদিদের সাথে এখন তাকে বেমানান লাগে। এসব হাজারো অর্থহীন ভাবনায় সে মনঃক্ষুণ্ন হলো। মনে ভীষণ কষ্ট নিয়েই সে সাদিদের থেকে সরে আসতে চায়ল। কিন্তু সাদিদ এত সহজে তাকে ছাড়লে তো?
সাদিদ তাকে নিজের সাথে আরেকটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে পরপর নিজের উষ্ণছোঁয়া দিলো। নীলা তাতে কেঁপে উঠে পেটের উপর সাদিদের হাতটা খামচে ধরলো। সাদিদ প্রিয়তমার কানের লতিতে হালকা করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে মোহনীয় স্বরে আবারও বলল,
— ‘ সে কি জানে না, আমি তাকে ভালোবাসি? একটু নয় বরং অনেকটা বেশি? তারপরও এতো সংকোচ কেন? মনে এতো হীনম্মন্যতা কেন? সে মোটা হোক বা বিশ্রী, আমার নিকট সে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা রূপসী রমনী। তার প্রেমেতে আমি বারংবার মাতোয়ারা। তার পাগল করা রূপে আমি ক্ষণে ক্ষণে দিশেহারা। ‘
নীলা এবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। অতঃপর সম্পূর্ণ ভাবনাহীনতা থেকে একটা ভুল বাক্য উচ্চারণ করে বসলো।
— ‘ শুধু আপনার চোখে হলে কি হবে? বাকি সবার কাছে তো নই। ‘
নীলার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেলেও
সাদিদের মুখশ্রীতে হালকা রাগের আভাস প্রতিফলিত হলো। সে নীলার কাঁধ থেকে মাথা তুলে তাকে নিজের দিকে ফিরালো। খানিকটা ঝাঁঝ মিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
— ‘ মানে কি? তোমার কয়জনের চোখে সুন্দর হওয়া লাগবে? ‘
এতো সোজা কথার বিপরীতে সাদিদের এমন বাঁকা-ত্যাড়া প্রতিউত্তর শুনে নীলা দ্রুত তার মুখপানে তাকালো। সাদিদের এহেন দৃষ্টি দেখে কিছুটা ভরকে গেলেও পরমুহূর্তেই মাথায় দুষ্টু শয়তানি বুদ্ধি চেপে বসলো। সে সাদিদের গলায় ঝুলে ফিচেল কন্ঠে বলল,
— ‘ আর ইউ জেলাস মিস্টার শাহরিয়ার? ‘
— ‘ অবভিয়াসলি আই এম। নতুবা কি? ‘
সাদিদের থেকে এমন স্পষ্ট উত্তর নীলা আশা করেনি। তাই খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
— ‘ তাহলে সেটা আপনার প্রবলেম। এখানে আমি কি করতে পারি? ‘
— ‘ তুমি কি করতে পারো? আদর করতে পারো। খুব আদর। আসো, আদর খাব। ‘
— ‘ একদম না। দূরে যান বলছি। ‘
— ‘ কিছুতেই না৷ আদর তো আমি খেয়েই ছাড়বো। হয় আঙুল বাঁকিয়ে নতুবা ঘি’য়ের ডিব্বা উল্টিয়ে। ‘
বলেই সাদিদ খপ করে নীলার হাত ধরে তাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। কয়েককদম এগিয়ে গিয়ে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিতেই নীলা মিনুতির স্বরে বলল,
— ‘ কি করছেন? সেন্টারে কখন যাব? ‘
— ‘ আদর খেয়ে। ‘
— ‘ কি কখন থেকে আদর আদর শুরু করেছেন? আপনার জন্য এমনিতেই অনেক লেইট হয়ে গেল। বাসার সবাই আমাদের রেখেই সেখানে চলে গিয়েছে। ‘
— ‘ তাতে আমি কি করতে পারি? রাইট নাও আই ওয়ান্ট এ কিস। নট এ ফাঁকিবাজি মার্কা চুমু। দৃঢ়তার সহিত শক্ত পোক্ত একটা দীর্ঘ চুমু। ‘
নীলা নিজের রাগী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সাদিদের উপর ফেলতেই সে টুপ করে প্রিয়তমার রাগে ফুলে উঠা নাকে চুমু খেয়ে বসল। কয়েক মুহূর্ত নীলা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকলেও পরমুহূর্তেই মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো। আলতো হাতে সাদিদের কপালের ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে শব্দ করে কপালে চুমু দিলো।
সাদিদ মৃদু হেসে বাচ্চাদের মতো নিজের ডান গালও এগিয়ে দিলো। নীলা সেখানেও চুমু দিলো। অতঃপর একইভাবে বামগালেও। কিন্তু দুষ্টু সাদিদ ঠোঁট এগিয়ে দিতেই নীলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে, সাদিদের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসলো। সময় বিলম্ব না করে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেতেই পিছন থেকে সাদিদের রাসভারি কন্ঠস্বর কানে আসলো,
— ‘ এখনের মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু পরে কিন্তু ছাড়ছি না মিসেস। জরিমানা হিসেবে ডাবল দিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে। ‘
নীলা সাদিদের দিকে আর ফিরে তাকালো না। চুপচাপ মাথায় ওড়না টেনে ঠিক করতে লাগলো। কিন্তু ঠোঁটের কোণে তার ঈষৎ চাপা হাসি।
_______________
গায়ে হলুদের জমজমাট আয়োজনে গুলশানের এই বিলাসবহুল কনভেনশন সেন্টারটা মুখরিত। নরমালি গায়ে হলুদের আয়োজন ছেলে-মেয়ের নিজ নিজ বাসভবনে হলেও শান্ত আর তানবীরেরটা হচ্ছে কনভেনশন সেন্টারে। কারণ হিসেবে শান্তর পরিবারের থেকে অনেকজন থাকলেও তানবীরের সেক্ষেত্রে হাতেগোনা মানুষ। হাজার সাদিদের পরিবার তাকে ছেলের মতো আদর করুক কিন্তু সত্যটা তো কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। তাই তানবীরকে এতো বুঝানোর পরও পদ্মলয়ায় সে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য রাজি হয়নি। তাই সাদিদকে বাধ্য হয়ে কনভেনশন সেন্টারেই তাদের দুইজনের একসাথে হলুদের আয়োজন করতে হয়েছে। এতে তানবীরের মনেও কোনোরকম আক্ষেপ বা কষ্ট থাকবে না। আর না অপরদিকে হলুদের অনুষ্ঠানে কোনোরকম সমস্যা হবে৷
তাই সাদিদরা সবাই এখন সেখানেই উপস্থিত। ইতিমধ্যে সবাই এখানে চলে এসেছে৷ শুধু সাদিদ আর নীলাই সবার পরে এসেছে। এই নিয়ে শান্ত-তানবীরও তাদের উপর ক্ষেপে রয়েছে। আর অপরদিকে নীলা এক্সাট্রাভাবে সাদিদের উপরে ক্ষেপে আছে। কেননা যত নষ্টের গোঁড়া হলো এই বজ্জাত মার্কা সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার। নীলার ভাষ্যমতে খাঁটি বজ্জাতের কারখানা।
— ‘ শালার বিয়া করতে এমন বাল-ছাল পরন লাগে? গরমে কলিজা পর্যন্ত জ্বইল্লা যাইতাসে। ‘
শান্ত ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে বসা তানবীরের দিকে তাকালো। হলদে-সাদা পাঞ্জাবিতে সে একপ্রকার বর বাবু সেজে বসে রয়েছে। এখনও তাদেরকে হলুদ লাগানো হয়নি। কেবলমাত্র স্টেজে বসিয়ে হলুদের আগের ফটোসেশন হয়েছে। তাই খুব একটা সময় তারা বসেও থাকেনি। তারউপর পুরো কনভেনশন সেন্টারটা এসিযুক্ত। তাই গরম লাগার বিন্দুমাত্র কোনো ফাঁকফোকর নেই। তাহলে এই ছেলের এতো গরম কই থেকে আসে?
শান্তর তাই বিরক্ত লাগলো। বিরক্তিমাখা কন্ঠেই সে বলল,
— ‘ মুখের কি শ্রী! এতগুলো মানুষের সামনে এসব ভাষায় কথা বলতে লজ্জা লাগে না? ‘
— ‘ আইছে আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা। রাখ তোর লজ্জা-ফজ্জা। আমি এই মুহূর্তে পাঞ্জাবি প্যান্ট খুলতাসি। ‘
— ‘ ছিঃ ছিঃ। আপনি তো দেখছি মহা নির্লজ্জ। সবার সামনে এভাবে উইথ আউট ক্লোথে থাকবেন? ‘
তানবীর বেশ জোরেই শান্তর মাথায় ঠাউয়া দিলো। শান্ত বিস্ফোরিত চোখে তানবীরের দিকে একপলক তাকিয়ে আড়চোখে বাকি সবার দিকে তাকালো। তারা স্টেজে বিধায় খুব সহজেই সবার দৃষ্টির মধ্যমণি। তাই শান্তর মতো সকলেই চোখ বড় বড় করে তাদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এটা দেখে শান্ত যেন দ্বিগুণ তেতে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে সে চিবিয়ে বলল,
— ‘ পাগল হয়ে গিয়েছেন? সবার সামনে এসব কি আচরণ? ‘
তানবীর তার কথার পরোয়া তো করলোই না বরং আগের থেকে দ্বিগুণ জোরে আরেকটা ঠাউয়া দিলো। শান্ত এবারের ধাক্কাটা সময় থাকতে সামলে উঠতে পারলো না। তাই চেয়ার থেকে মেঝেতে বিছানো কার্পেটের উপরই পড়ে গেল।
এতক্ষণ অবাক হলেও এবার শান্ত রাগে দুঃখে পরনের শাড়ি ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। এবং ঝড়ের বেগে গিয়ে তানবীরের বুকে সজোরে নিজেও একটা ধাক্কা দিলো। রাগের বশে এতোটাই জোরে দিয়েছে যে তানবীর বেচারা চেয়ারসহ-ই উল্টে গিয়ে পড়ল।
উপস্থিত এতগুলো মানুষ বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। চোখজোড়া তাদের প্রায় জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।
সারাজীবন দেখে এসেছে হবু দম্পতি গায়ে গা ঘেঁষে প্রেমআলাপ করে। অথচ এখানে তারা দেখছে দুইজনে একেবারে হাতাহাতিতে লেগে গিয়েছে!
কেউ চুল টেনে ধরছে তো কেউ পাঞ্জাবির বোতাম টেনে ছিড়ে ফেলছে। দুই পরিবারের লোকজন এসেও হবু বর-কনের ঝগড়াঝাটি থামাতে পারছে না।
— ‘ ভাই ছাড়ো। এই মাইয়ারে তুইল্লা আইজ্জকা আছাড় দিয়া ভূতের আছর ছাড়ামো। ‘
— ‘ ভাই চুপ থাক। এই মাইয়া, এই মাইয়া কি কস! তোর হবু বউ হয়। ‘
— ‘ একদম না। এই হনুমানকে বিয়ে করা জাস্ট ইম্পসিবল। লাইফ হেল করে ছাড়বে। ‘
— ‘ তুই কোন জান্নাতের হুরপরী? ‘
— ‘ সেটা না হই। কিন্তু কোনো পটলতোলা ঘাটের দারোয়ান নই। ‘
— ‘ এই কি কস? কি কস! কারে কি কস? ‘
— ‘ পাগল কি অবশেষে আমিই হয়ে গেলাম? এক কথা তিন তিনবার শুনি ক্যান? ‘
— ‘ থাপড়াইয়া দাঁতের কপাটিসুদ্ধ খোলে ফেলব শান্তর বাচ্চা। ‘
— ‘ আমি তোর মুখই খোলে ফেলব হনুমানের চামচা। ‘
#চলবে…