অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৬২

0
4758

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬২ ❤❤❤

রৌদ্রদীপ্ত সকালের মিষ্টি কিরণ এসে নীলার চোখে-মুখে পরতেই তার গভীর ঘুমটা ধীরে ধীরে হালকা হতে শুরু করলো। গতরাতে ঘুমাতে গিয়ে অনেকটাই লেইট হওয়ার দরুন বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। নীলা চোখ পিটপিট করে খোলতেই নিজেকে কারো সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো অনুভব করলো৷ ব্যক্তির দিকে না তাকিয়েই নীলা নিঃশব্দে হাসলো। এই পুরুষের ঘ্রাণ যে নীলার সমস্ত অঙ্গে বহমান। তাকে কিভাবে অনুভব করতে সে ভুল করবে?
এইবার ঢাকায় শীতের মাত্রা বেশ প্রবল। ইংরেজি মাসের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এসে পড়ছে অথচ এখনও আবহাওয়াতে শীতের প্রকোপ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু বেচারা সাদিদ এই শীতেও ঘেমে নেয়ে অস্থির। নীলার জন্য সে এসিও ছাড়তে পারে না। আবার কম্বল না দিয়েও পারে না। নতুবা পাখিটাকে নিজের বুকের সাথে আগলে রাখবে কিভাবে? মেয়েটা যে একেবারে শীতকাতুরে! তাই প্রতিদিন তাকেই খালি গায়ে ঘুমাতে যেতে হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
নীলা একপলক মাথা তুলে সাদিদের মুখশ্রীতে নজর দিলো। দেরিতে ঘুমিয়ে তার ও এখন অবধি ঘুম ভাঙেনি৷ তাই আপনমনে ভেবে নেওয়া নিজের দুষ্টু ইচ্ছেটাকে প্রশয় দেওয়া যেতেই পারে।
নীলা সাদিদের লোমশ বুকটাতে আঙুল দিয়ে অযথাই খানিক আকিঁবুকিঁ করলো। সাদিদের এতেও কোনো নড়াচড়া না দেখে চুপি চুপি তার পুরুষালী বুকটাতে নাক ডুবালো। টেনে টেনে তার শরীরের পাগল করা নেশা ধরানো ঘ্রাণটা তার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে নিতে লাগলো। এ যেন ড্রাগের থেকেও বড় নেশালো দ্রব্য। পুরুষালী এই তীব্র স্মেলে নীলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বারংবার প্রলয়কারী ঝড় উঠে।

— ‘ নটি গার্ল! আমার ঘুমিয়ে থাকার এডভান্টেজ নেওয়া হচ্ছে? ‘

আচমকা সাদিদের ঘুম জড়ানো আওয়াজ পেয়ে নীলা হুড়মুড়িয়ে বুক থেকে মুখ তুলতে গেল। কিন্তু সাদিদ বরাবরের মতোই নিজের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে তাকে আটকে দিলো। খুবই সাবধানে নীলাকে বালিশে শুইয়ে তার উপর আধশোয়া হলো। এমনিতেই শরীরে পানি চলে আসাতে নীলা আগের তুলনায় অনেকটাই গোলুমোলু হয়ে গিয়েছে। তারউপর ঘুমিয়ে উঠার পর নীলার ফোলা গালগুলো আরও যেন ফুলে থাকে। সাদিদের তো ইচ্ছে করে কামড়ে-কুমড়ে একেবারে খেয়ে নিতে। বউটা এতো কিউট কেন?

— ‘ আমি.. মানে.. ছাড়ুন। আমি উঠবো। ‘
— ‘ সেটা বললে কি হয়? চুরি চুরি এসব করে এখন পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে? ‘
— ‘ আ..মি কি করলাম? ‘
— ‘ তুমি কি করলে? ‘

নীলার ভিতু মুখশ্রী দেখে সাদিদের দম ফেটে হাসি পাচ্ছে। কিন্তু কোনোরকমে হাসিটা চেপে রাখলো। আপাতত সকাল সকাল বউটাকে একটু না জ্বালালে কি হয়?

— ‘ তুমি কি করছিলে? এমন নেশাগ্রস্তদের মতো বুকে নাক টানার কি মানে? আমার বুঝি লজ্জা লাগে না? ‘

ইশশ তার আবার লজ্জা! একেবারে নির্লজ্জের একশেষ। কিন্তু এটা কি এখন বলা যায়? নীলা নিজেই তো ধরা পরে গিয়েছে। তাই খানিকটা তোতলানো স্বরেই বলল,

— ‘ একেবারেই না। আমি আর এসব! ছাড়ুন বলছি৷ আজকে শান্তর বিয়ে না? পরে সেন্টারে পৌঁছাতে লেইট হয়ে যাবে। ‘
— ‘ তাই বললে কি হয়? চুপি চুপি নিজের পাওনা নিয়ে গিয়ে আমাকে রিটার্নে কিছুই দিবে না! এটা মানা যায়? একদমই নয়৷ ‘
— ‘ কি রিটার্ন! সকাল সকাল কি আবোলতাবোল বলা শুরু করেছেন বলুন তো? ‘

সাদিদ আর উত্তর দিলো না। শুধু দুষ্টু হেসে ক্রমচ নিচের দিকে নেমে পড়ল। নীলার পরনে রাতের ঢিলেঢালা ক্রপটপটা আরও উপরে উঠিয়ে সাদিদ নগ্ন পেটে মুখ রাখলো। গরম নিঃশ্বাস খালি পেটে পরতেই নীলা দুর্বলভাবে তাকে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু সাদিদ কি এতোটাই ভালো মানুষ?
নীলার বাঁধা না নেমে উঁচু পেটটাতে সময় নিয়ে গাঢ় চুমু খেল। নীলা মৃদু কেঁপে উঠতেই সাদিদ তাতে নিঃশব্দে হেসে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।

— ‘ বিয়ের এতদিন পর, এতোবার কাছে আসার পরও আমার অল্প স্পর্শতেই এতো কাঁপা-কাঁপি! ইজ এন্ট ইট স্টেইঞ্জ? ‘

নীলা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলো না। শুধু তার লাল মুখটা লজ্জায় আরও লালচে বর্ণ ধারণ করলো। প্রিয়তমার লজ্জায় রক্তিম মুখশ্রী দেখে সাদিদের ঠোঁটের কোণেও মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। প্রিয়তমার এই রূপটা যে সাদিদের বরাবরের মতোই ভীষণ প্রিয়। বারবার দেখেও যেন মন ভরে না। আরও দেখতে ইচ্ছে হয় এবং তাতে পাগল হয়ে আরও ভালোবাসায় উন্মাদ হতে ইচ্ছে হয়।
সাদিদ তুলতুলে নরম পেটটাতে হাত বুলিয়ে আরও গুটকয়েক উষ্ণ চুমু খেল। অতঃপর পেটে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ প্রিন্সেস, তুমি পাপার গুড গার্ল না? তাই এখন চুপটি করে চোখ বন্ধ করে রাখবে। বাবা তোমাকে আদর দিয়েছি না? এখন মাকেও তো আদর দিতে হবে৷ তাই লক্ষ্মি মেয়ের মতো ঘুমিয়ে থাকো। ‘

নীলা সাদিদের কান্ডে ফিক করে হেসে ফেলল। তা দেখে সাদিদ তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকালো,

— ‘ সমস্যা কি? হাসার মতন কি হয়েছে? ‘
— ‘ না না। আমার আবার কি সমস্যা? কিন্তু আপনার মেয়েকে যে এতসব বললেন, সে যদি চোখ বন্ধ না করে? আপনি তো তাকে দেখতে পাবেন না। বুঝবেন কি করে? ‘

সাদিদের মুখে এবার চিন্তার ছাপ লক্ষ্য করা গেল। মনে হয় বিষয়টা সে খুবই সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে। মিনিট দুই-এক সে চুপচাপই থাকলো। কিন্তু আচমকাই নীলার উপর আধশোয়া হয়ে তার মুখোমুখি হলো। এবং বেশ ভাব নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলল,

— ‘ একদমই না। আমার প্রিন্সেস গুড গার্ল। সে আমার মতোই হয়েছে। তাই বাবার কথা না শুনে সে থাকতেই পারবে না। কিন্তু তার মায়ের মতন হলে সমস্যা ছিলো। প্রিন্সেসের মা যে বাবার একটা কথাও শুনে না। ‘

সাদিদের মুখে মেকি অসহায়ত্বের ছাপ। তা দেখে নীলা রাগ করলো না বরং আবারও খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। সাদিদ নিজেও মৃদু হাসলো। আর প্রাণোচ্ছল তরুণীর ন্যায় প্রিয়তমার হাসিমুখটা মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো।
অতঃপর শক্ত হাতের আঙুলগুলো তুলতুলে নরম গালগুলোতে স্থান পেল। নীলা এখনও থেকে থেকে হাসছে। আর সাদিদ অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবাধ্য আঙুলগুলোর স্থান পরিবর্তন করতে লাগলো। ঠোঁটের কোণ, গলায়, গালে আঙুলের খেলা চলতেই থাকলো।
নীলার হাসিমুখটাতে এবার লজ্জারা এসে ভিড় জমিয়ে। প্রিয়তমের চোখজোড়া যে নীরবে কথা বলে।
সাদিদ একপলক নীলার চোখের দিকে তাকালো। তাতে নীরব সমর্থনের আশ্বাস পেয়েই আলতো করে নিজের পুরুষালী ঠোঁটজোড়া কোমল নারীর ঠোঁটে মিলিয়ে দিলো। প্রবল আবেগ মিশিয়ে ছোট্ট ছোট্ট আদর দিতে লাগলো। কিন্তু নীলার উপর কোনোরকম শরীরী ভার না দিয়েই।
সাদিদকে এটা কখনই নীলার তরফ থেকে বলতে হয় না। সে যতই নিজের ভালোবাসায় হিংস্রতা প্রকাশ করুক না কেন? কিন্তু নীলার শারিরীক অবস্থার কথা তার মাথা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও যায় না। হাজারো আবেগের ভেলায় চড়েও যেন প্রিয়তমার শারীরিক অবস্থা নিয়ে তার চোখ-কান সর্বদা সচেতন।
সময়ের সাথে সাথে সাদিদের বাহুবন্ধনী আরও গাঢ় হলো। দৃঢ় হলো ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে নেওয়ার প্রবল আকর্ষণ। নীলাও ইতিমধ্যে নিজেকে সামলাতে সাদিদের ঘাড়ের পিছনের ছোট ছোট সিল্কি চুলগুলোতে সজোরে নিজের মুঠিতে টেনে নিয়েছে। যখন বুঝতে পারলো প্রিয়তমা আর সহ্য করতে পারবে না তখন ধীরে ধীর সাদিদ নিজেকে তার ঠোঁট থেকে সরিয়ে আনলো। নীলার হালকা গোলাপি ঠোটযুগল তিরতির করে কেঁপেই চলেছে। আর এতক্ষণের বিরামহীন আদরে সেগুলো এখন টকটকে লাল বর্ণ পরিণত হয়েছে। যেন হালকা একটা টুকা দিলেই গড়গড়িয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসবে।
সাদিদ আবারও মাথা নুইয়ে নীলার ঠোঁটে দীর্ঘ একটা চুমু খেল। অতঃপর আস্তে ধীরে সরে আসলো।
কিন্তু নীলাকে এখনও চোখ বন্ধ করে একরকমে শুইয়ে থাকতে দেখে দুষ্টু হেসে ফিচেল স্বরে বলে উঠল,

— ‘ পাখি, আরও আদর চাই? ‘

নীলার যেন এবার হুঁশ ফিরলো। সে পাশ থেকে একটা কুশন নিয়ে সাদিদের গায়ে ঢিল দিলো। আর যেতে যেতে নিচুস্বরে বলে গেল,

— ‘ অসভ্য একটা। ‘
— ‘ অসভ্য আর কোথায় হতে দিলে জান? রেড এলার্ট যে আগেই জারি করে রেখে দিয়েছো। একবার প্রিন্সেস আসুক, তারপর না বুঝবে অসভ্য কাকে বলে কত প্রকার এবং কি কি? ‘

সাদিদের গলায় এখনও দুষ্টুমিরা খেলা করছে। আর অপরদিকে নীলা দ্রুতপায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। নতুবা এই অসভ্য ছেলের মুখ যে কন্টিনিউসলি চলতেই থাকবে৷

__________________

শুক্রবার বিধায় বরপক্ষ জুম্মার সালাত আদায় করে তারপর কনভেনশন সেন্টারে আসবে। তাই ইতিমধ্যে কনেপক্ষ এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। নীলা, নিধি, শায়লা রহমানকে এখানে ড্রপ করে দিয়ে সাদিদ, শাহেদ আবারও তানবীরদের সাথে জয়েন করেছে। কেননা নামাজ শেষে তারা একসাথেই এখানে আসবে।
নীলার শরীরের কন্ডিশন বিবেচনায় সাদিদ খুবই আরামদায়ক একটা পোশাক তার জন্য চুজ করেছে। কোনোরকম স্টোনের কাজ বিহীন পিচ কালারের সফ্ট কাপড়ের লেসের শর্ট স্লিভের ঢিলেঢালা একটা গ্রাউন। তাতে নীলার কমফোর্ট ফিলের সাথে সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানের সাথেও মিলিয়ে যাচ্ছে।

— ‘ দোস্ত চয়েজ কার? জিজুর নাকি, হুহ? ‘

শান্তর দুষ্টুমি স্বরে নীলার ভাবনা থেকে খেয়াল ফিরলো। সে এতক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে সাদিদের পছন্দটাই দেখে যাচ্ছিল। নীলাকে আগ বাড়িয়ে কখনোই কিছু বলতে হয় না। সে যেন এমনিতেই নীলার অন্তর্যামী। নীলা মৃদু হেসে শুধু মাথা নাড়ালো।

— ‘ বাহ্ বাহ্ তোদের প্রেম দেখি সময়ের সাথে সাথে সমানুপাতিক না সরি দ্বিগানুপাতিক হারে বেড়েই চলেছে। ‘
— ‘ তানবীর ভাইয়া বুঝি আপনাকে কিছু কম করে? আমি শপিংয়ে যাইনি তো কি হয়েছে, আপনার মাথার টিকলি থেকে পায়ের নুপুর পর্যন্ত যে তানবীর ভাইয়ার পছন্দ করা সেগুলো কি আমি জানি না মনে করেছেন? ‘

শান্ত এবার থেমে গেল৷ কেননা প্রসঙ্গ যে নিজের ঘাড়ে এসে পড়েছে। সে আমতাআমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু নীলাই তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলো,

— ‘ হয়েছে এখন আর প্রসঙ্গ পাল্টাতে মিথ্যা বলতে হবে না। খুব সুন্দর লাগছে রে তোকে। আমারই নজর না লেগে যায়। ‘

বলেই নীলা প্রিয় বান্ধবীর গালে ছোট্ট করে একটা ভালোবাসার উষ্ণ পরশ দিলো। হাসিখুশি মুহূর্তটা যেন নিমিষেই পাল্টে গিয়ে থমথমে হয়ে গেল। এতক্ষণ বহুত আজেবাজে জিনিস করে শান্ত নিজের কান্নাটা লুকিয়ে রাখলেও এখন যেন বাঁধ ভেঙে গেল। শান্তর জলে ছলছলে চোখ দেখে নীলারও চোখে জল এসে গেল।

— ‘ শান্ত, তুই কি বোকা? কান্না করছিস কেন? ‘
— ‘ আই উইল মিস ইউ বেব। ‘
— ‘ ইশশ ভাবটা এমন যেন কোন বিলাতে চলে যাচ্ছিস! পাঁচ মিনিটের পথ। ভাইয়াকে বললে রাত হোক দিন হোক নিয়ে চলে আসবে। ‘
— ‘ ঐটাতো একটা উল্লুক। আমার কোনো কথা শুনে বুঝি? ‘
— ‘ আহারে! শুনে না বলেই কি সকলের অগোচরে আপনাকে প্রথম হলুদ লাগিয়ে আসে? ‘

বলেই নীলা ঠোঁট বাঁকিয়ে ভ্রু নাচালো। এতক্ষণের কান্না ভুলে গিয়ে তৎক্ষনাৎ শান্ত আবারও লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। শাড়ি দিয়ে পেট এতো ঘুরে রাখলেও দুষ্টু বান্ধবীটার চোখে ঠিকই সেটা পরে গিয়েছে। ইশশ কি লজ্জা! তখনই দুই বান্ধবীর কথোপকথনে বিঘ্ন ঘটিয়ে শান্তর ছোট্ট চাচাতো বোনটা এসে বলতে শুরু করলো,

— ‘ নীলা আপু বর এসেছে। তাড়াতাড়ি চলো বর এসে গিয়েছে। জলদি আসো। ‘

নীলা কেবল পিচ্চিটার দিকে অসহায় চোখে তাকালো। ছোট্ট মেয়েটাতো আর জানে না নীলা এই রুম থেকে বেড়িয়ে সেন্টারে ঢ্যাং ঢ্যাং করলে তার গালে আরেকজন একটা থাপ্পড়ও মিস করবে না। তাই নিঃশব্দে বিরস মুখে নীলা সেখানেই বসে রইল। আর সবাই হইহট্টগোল করে বরের আগমনে বের হলো।

— ‘ দোস্ত আমার বুকটা দেখ, কেমন করে যেন ধকধক করতাসে। ‘

শান্তর ভয়ার্ত মুখের কথা শুনে নীলা এবার হেসে ফেলল। হাসিমুখেই বলল,

— ‘ আরে ভয় পাস না। বিয়ের সময় সবারই এমন নার্ভাসনেস হয়। ‘
— ‘ না দোস্ত। আমার বুক বোধহয় ফাইট্টা যাইব। কবুল বলার আগেই কি মইরা-টইরা যামু নাকি? ‘
— ‘ চুপ। বাজে কথা কম বল। ভাইয়া শুনলে থাপ্পড় একটাও মিস হবে না। ‘

এবার বোধহয় কাজ হলো। শান্ত আজেবাজে বকা ছেড়ে শান্ত মেয়ের মতোই চুপচাপ বসলো। কিছু সময় পর বড় কয়েকজন এসে শান্তকে স্টেজে নিয়ে যেতে আসলো। কিন্তু ভিতু মেয়েটা কিছুতেই নীলার হাত ছাড়বে না। তাই হাসিমুখে নীলাও তার সাথেই চললো।

________________

— ‘ কিরে এমন ঘামছিস কেন? ‘
— ‘ না ঘাইম্মা উপায় আছে বাল? এতো টাকা কি সেন্টারের মালিকের মাথায় ঢালবার লিইগ্গা দিছিলাম? গরমে শরীর জ্বইলা যাইতাসে। ‘
— ‘ কই! হলের ভিতরে তো বেশ ঠান্ডা। ‘
— ‘ মামা তুমি আমার অবস্থাটা বুঝবা না। হট মামা ভীষণ হট। ‘

তানবীরের নিচুস্বরের আবোলতাবোলের অর্থ সাদিদ বুঝতে পেরেও আর কিছু বললো না। সে বারবার কেবল অস্থির হয়ে ঘড়িতেই সময় দেখে যাচ্ছে।

— ‘ এই সাদি, বিয়ে কি তোর নাকি? তুই এতো টেনশনে কেন? ‘
— ‘ বিয়ে না হলে কি হয়েছে? বাবা তো হচ্ছি। আর বউটা সেই কখন থেকে সাথে নেই। এই টেনশন তুই বুঝবি? ‘

অর্ণব সাদিদের কথার প্রতিউত্তরে কেবল মাথা নুইয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। সাদিদের বিষয়টা স্বাভাবিক লাগলো না। গতকাল থেকেই অর্ণবকে সে বেশ চিন্তিত দেখছিল। কিন্তু কি ভেবে যেন আর জানতে চায়নি। আর আজকে আবার প্রিয়তীকেও সাথে নিয়ে আসেনি৷ তাই সন্দেহের বশে বলেই ফেলল,

— ‘ কি হয়েছে বল তো। তোর হাব-ভাব আমার ঠিক ভালো ঠেকছে না। আর প্রিয়তীকেও যে দেখছি না। বিয়েতে আসেনি নাকি? ‘

অর্ণব মুখে উত্তর না দিয়ে সাদিদকে শক্ত করে ঝাপটে ধরলো। মুখে উপচে পরা হাসি নিয়ে বলে উঠল,

— ‘ চাচ্চু হচ্ছিস দোস্ত। ‘
— ‘ কি? ‘
— ‘ হ্যাঁ রে। প্রিয়তী প্রেগনেন্ট। গত দুইদিন থেকেই বলছিল শরীরটা ভালো লাগছে না। প্রথম প্রথম এতো গুরুত্ব দিতে চায়নি। কিন্তু আমার টেনশন হচ্ছিল। আর আজকে সকালেই তাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম। আর রেজাল্ট পজিটিভ। সে ইচ্ছে করেই আসেনি। এতো লোকজনের মধ্যে নাকি আসতে ভালো লাগছিল না। তাই আমিও আর জোর দিতে পারলাম না। ‘
— ‘ কনগ্রেস ইয়ার। ‘

সাদিদও হাসি মুখে অর্ণবের পিঠ চাপড়ে দিলো। তাদের দুইজনকে কোম্পানি দিতে তানবীরও নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ধরাম করে অর্ণবের পিঠে এক চাপড় বসালো। বেচারার বোধহয় পিঠটাই ভেঙে যাবার উপক্রম ছিলো।

— ‘ হারামি করস কি? লাগে না? ‘
— ‘ অভিনন্দন জানাইতে আইলাম। আর তানবীরের অভিনন্দন জানানোর স্টাইলই এমন। ‘
— ‘ তোর পিঠে এমন কয়েকটা পড়লে স্টাইল চলে যাবে। ‘
— ‘ হাতে গুনে চারমাস। তারপর আমিও তোদেরকে পিঠে চাপড় দেওয়ার চান্স করে দিব বাডি’স। ‘

বলেই তানবীর চোখ টিপলো। আর সাদিদ আর অর্ণব দুইজনই তার দুষ্টুমির টপিকে শব্দ করে হেসে ফেলল।
তানবীরের মুখেও হাসি। কিন্তু আচমকাই যেন তার দুষ্টুমিরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে লুকিয়ে পালালো। সে থম মেরে দাঁড়িয়েই রইল।
সাদিদ আর অর্ণব তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। আর বন্ধুর এহেন আচরণের কারও ঠিক বুঝে উঠতে পারলো। তাই তারা আবারও একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো।
সিঁদুর রাঙা লেহেঙ্গায় গোল্ডেন আর সিলভার স্টোনের ভারি কাজের সাথে শরীরজুড়ে ব্রাইডাল গোল্ডের জুয়েলারিতে শান্তকে যেন আজ চেনা-ই যাচ্ছে না। দুইহাতে অর্গানিক মেহেদীর টকটকে লাল রং। হাত ভরা চুড়ি। ব্রাইডাল সাজে সে যেন এক মানুষরূপী পরী। তানবীর বারকয়েক চোখ বুজে আবার তাকালো। না সহ্য করা যাচ্ছে না। এই ভয়ংকর সৌন্দর্য যে চোখ রীতিমতো পুড়িয়ে দিচ্ছে।
শান্তকে এনে তানবীরের ঠিক পাশে বসানো হলো। সর্বদা দাপটে চলা মেয়েটাও আজ নিজের বিয়ের দিনে এসে চুপসে গিয়েছে। চোখ উপরে তুলে তাকাতেই পারছে না। কেননা সে যে না তাকিয়েও উপলব্ধি করতে পারছে পাশের মানুষটির ঝলসানো দৃষ্টি তার সমস্ত অঙ্গে খেলা করে যাচ্ছে। আর এখানেই যে শান্তর সবচেয়ে বেশি ভয়। লজ্জা-জড়তা সব।

— ‘ হসপিটালের জন্য এডভান্স সিট কাটতে হবে বোধহয়। ‘

শান্ত এতক্ষণে চোখ তুলে তানবীরের দিকে তাকালো। কিসের মধ্যে কি! কিন্তু তার অবাককরা চাহনিতে তানবীর থেমে গেল না। বরং মুখ নিচু করে শান্তর কানে নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ কাইঁজ্জাখুন্নি মাইয়া, তুইতো শেষ। আজকে আমার ধ্বংসকারী হাত থেকে তোকে কে বাঁচাবে? ‘

মুহূর্তেই শান্তর শরীরে যেন কাঁপন ধরেছে। সমগ্র অঙ্গে থরথর করে কাঁপুনি শুরু হয়েছে। তানবীরের কন্ঠস্বর নিচু হলেও তাতে নেশালো আভাস স্পষ্ট। গরম নিঃশ্বাসগুলো যেন এই এয়ারকন্ডিশনেও শান্তর শরীর পুড়িয়ে দিয়ে যাবে।

— ‘ ওহ্ ওহ্। দেবরসাহেব এখনই সব কথা শেষ করে ফেলবেন নাকি? রাতের জন্যও কিছু বাকি রাখুন। ‘
— ‘ রাতে কি আর কথা বলার সময় পাওয়া যাবে ভাবী? অন্য কাজ আছে না? ‘

নিধি এসেছিল তানবীরের কান টানতে। কিন্তু নির্লজ্জ ছেলের এমন কথায় তার নিজের কান দিয়েই যেন ধোয়া বের হবার জোগাড়। তাই নিজের সম্মান বাঁচিয়ে সে জলদি কেটে পড়ল। সকলের টুকিটাকি দুষ্টুমি, হাসি-ঠাট্টার মধ্যে দিয়েই অবশেষে বিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা এসেই গেল। কাজি সাহেব যখন শান্তকে কবুল বলতে বলল এই মেয়ে কাঁদতে কাঁদতেই শেষ।

— ‘ আরে শান্ত কি হচ্ছে এটা? ওনাদের কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে। বলে দাও। ‘
— ‘ হ্যাঁ ছুটকি বলে ফেল। ওনারা বিরক্ত হচ্ছে। ‘

কে শুনবে কার কথা। একটা মেয়েই বোধহয় এই সময়টা উপলব্ধি করতে পারে। তিন অক্ষরের কবুল শব্দটা যে তখন কতটা ভারী, আর সেটা মুখে বলা যে কি কঠিনতম কাজ সেটা কাউকে বুঝিয়ে বলা হয়তো কোনো কালেই সম্ভব নয়। তানবীর নিজেও সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু তাই বলে কি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে এই মেয়ের নাকের জল চোখের জল দেখবে নাকি?

— ‘ চুপ। আর একটা কান্নার আওয়াজ শুনলে তোর খবর আছে৷ চুপচাপ কবুল বল। তোকে কি কিডনাপ করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি নাকি! নাহলে এমন ছিঁচকাঁদুনের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিস কেন? ‘

উপস্থিত সবাই আবারও একবার হতবাক। এই বর-কনে বিয়ের আগেই যেমন করে সকলের সামনে ঝগড়াঝাটি করে যাচ্ছে, আল্লাহ ভালো জানেন ভবিষ্যতে এদের কি অবস্থা হবে। সবাই আর যাই ভাবুক না কেন কিন্তু তানবীরের এই ধমকে বেশ কাজ হলো। শান্ত হুরহুর করে বলে ফেলল,

— ‘ কবুল। ‘

একইভাবে তিনবার কবুল বলার পর তানবীরের পালা আসতে সে একদমই সময় নিলো না। কাজিসাহেব বলার সাথে সাথেই সে কবুল বলে ফেলল। সবাই একদফা হাসাহাসি করলেও সে তাতে নির্বাক। আপাতত তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শান্তর উপরেই বিরাজমান। আপাতদৃষ্টিতে তার দৃষ্টির ভাষা বুঝা ভীষণ কঠিন। সে নিজেই জানে তার মনে মনে কি ফন্দি চলছে।

________________

বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে এবার সময় বিদায়ের পালা। বিদায়বেলা বরাবরই বড্ড করুণের। কিন্তু তানবীরের আগে থেকেই সর্তকবাণীতে শান্ত এবার আর কাঁদার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারল না। শুধু নিচুস্বরে বারবার নাক টেনে গিয়েছে। আর মনে মনে ইচ্ছে মতন তানবীরকে গালাগাল মানে নিজের সদ্য বিবাহিত জামাইকেই মনের দুঃখে বকে যাওয়া।
ঐ বাড়িতে কিছু নিয়মকানুনের জন্য নিধি-নীলার সাথে সাথে আরও কয়েকজন আত্মীয়রা তানবীরের বাড়িতে আজকের রাতটা কাটাবে। তানবীরের এতো সহায়সম্পদের মধ্যেও হাতেগোনা কয়েকজন কাছের আত্মীয়। নতুবা সবাই সুসময়ের অর্থের পাগল। তাই শায়লা রহমান নিজে এসে শান্তকে গৃহ বরণ করে গিয়েছেন৷ তারপর নিধি আর নীলাদের আজকের রাতটা এখানেই কাটানোর জন্য বলে গিয়েছেন। বিয়ে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন না থাকলে কি বিয়ে বাড়ি মনে হয়?
টুকিটাকি কিছু নিয়মনীতি শেষ করে শান্তকে তানবীরের রুমে নিয়ে এসে বসাতেই তার বুকে আবারও হাতুড়িপেটা শুরু হয়েছে।

— ‘ শান্ত এবার তাহলে তুই থাক। আমরা গেলাম। ‘
— ‘ আরে বস না। এতো তাড়া কেন? চল আজকে সারারাত দুইজনে বসে আড্ডা দেই। ‘

অতি উত্তেজনাতে শান্তর বোধহয় মাথাটাই গিয়েছে। নীলা এতজনের সামনে কিছু না বললেও তানবীরের আত্মীয়দের মধ্যে একজন বলেই ফেলল,

— ‘ কিগো নতুন বউ, জামাইরে বাহিরে বসাইয়া বান্ধবীরে নিয়া আড্ডা দিবা? জামাই কি এতসহজেই ছাইরা দিব? ‘
— ‘ আরে ছাড়বো কি, আজকে রাতে তো সুপার গ্লুর মতো চিপকে থাকবো। ‘
— ‘ শুধু কি চিপকেই থাকবো? আর কিছু করবো না? ‘

শান্ত পারে না দৌড়ে এই বেশরম মহিলাদের সামনে থেকে পালাতে। নীলাও এসব কথায় বেশ লজ্জা পাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে এমনিতে যতই দুষ্টুমি করুন না কেন, কিন্তু সবার সামনে তারা বরাবরই ভদ্র বাচ্চা। তাই দুইজনই বেশ লজ্জা পাচ্ছে।
নিধিই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এগিয়ে আসলো,

— ‘ আচ্ছা হয়েছে। তোমরা আর বেচারিকে ভয় পাইয়ে দিও না। এবার আসো তো৷ তানবীর বোধহয় বাহিরে অপেক্ষা করে আছে। ‘

সবাই আরও কিছু হাসি তামাশা করে অবশেষে রুম থেকে বের হলো। নীলাও তাদের সাথে বেড়িয়ে আসলো। একটু দূরেই সাদিদকে দেখা গেল। তারা বন্ধুরা মিলে ক্রমাগত তানবীরের টাং খিঁচে চলেছে। নীলাকে তানবীরের রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে দেখেই সাদিদ এদিকে এগিয়ে আসলো। মুখে তার মৃদু হাসি৷

— ‘ অবশেষে ম্যাডামের আমার জন্য সময় হয়েছে? ‘

নীলা তার এহেন কথায় চোখ ছোট করে তাকাতেই সাদিদ তাকে আলতো করে ধরে কাছে টানলো। ডান গালটা আস্তে করে টিপে দিয়ে বলল,

— ‘ কিছু খাবে? ‘
— ‘ ইশশ না৷ আর কত? একটু আগেই না খেলাম! ‘
— ‘ আচ্ছা খেতে হবে না। কিন্তু এখানে প্রথমবার এসেছো৷ কিছু লাগলে আমাকে কিন্তু অবশ্যই বলবে। ‘

নীলাকে এতটুকু বলে সাদিদ গলা উঁচিয়ে পিছনে তাকিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য বলে উঠল,

— ‘ আমি গেলাম। দায়িত্বটা তোদের উপর বরাদ্দ। হারামি এতদিন আমাদের পকেট খালি করছে। আজকে এর একেবারে কানাকড়িও ছাড়বি না। সবটুকু উশুল চাই৷ ‘

অতঃপর নীলাকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে সাদিদ তাদের জন্য গুছিয়ে রাখা রুমে চলে আসলো। দরজা লক করে দিয়ে পিছন ঘুরতেই পাখিটাকে খোলা জানালার বাহিরে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখল। আর মুহূর্তেই সাদিদ দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসলো।

— ‘ পাখি এসব কি? বলেছি না এমন সময়ে-অসময়ে চুল ছেড়ে বাহিরে আসবে না। ‘

বলতে বলতেই সাদিদ তার লম্বা চুলগুলোকে নিজের একহাতের মুঠিতে নিয়ে নিলো। তাতে নীলার নিচু গলার অভিযোগ,

— ‘ বাহিরে কোথায়? এখন কি জানালার পাশেও দাড়াতে দিবেন না? ‘
— ‘ না দিব না। তুমি বুঝো না কেন? আমার এসবে ভয় হয় পাখি। আমি তোমার ক্ষেত্রে কোনোরকম রিক্স নিতে রাজি নই। এসব কুসংস্কারকেও নই। ‘
— ‘ আমার জন্য আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে, তাই না? ‘

সাদিদ নিজের পাখিটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। মাথায় দীর্ঘ একটা চুমু খেয়ে প্রচন্ড আবেগ মিশানো জড়ানো গলায় বলল,

— ‘ না জান। একবারেই না। বরং তুমি পাশে না থাকলেই আমার যত কষ্ট হয়। সহ্য করার মতো নয়। তাই সবসময় আমার পাশে থেকে অনবরত পাগলামি করে যাবে। আমি কিছু বলব না। লক্ষ্মি পাখি আমার। ‘

নীলার মনটাও নিমিষেই আবার খারাপ হয়ে গেল। আজকাল সাদিদ নীলা দুইজনই খুব ভালো অভিনেতা এবং অভিনেত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বাহির দিয়ে তারা বড্ড সুখি, বড্ড পাগল। কিন্তু একমাত্র ভিতরটাই জানে তারা কত খন্ডে বিভক্ত হয়ে আছে। দিনশেষে আপনজনের মুখেই হাসি ফুটাতে তারা সর্বদা হাস্যমুখের অভিনয়ে মেতে থাকে। কিন্তু দিনশেষে দু’জনেই চোখের দৃষ্টিতে ধরা। আবার পরমুহূর্তেই সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ অজানার ভাণ ধরে। নীলা এবার মুখ তুলে সাদিদের দিকে তাকালো। সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে তার মনটা ভালো করতে বলে উঠল,

— ‘ বাবু আবারও তার বাবার আদর চায়ছে। ‘
— ‘ তাই? ‘
— ‘ হুম তাই। জলদি জলদি। ‘

সাদিদ তার কথায় মৃদু হাসলো। প্রিয়তমার ছোট্ট কপালটাতে আদুরে একটা চুমু খেয়ে তাকে সাবধানে কোলে তুলে নিলো। এগিয়ে গেল নরম বিছানাটার দিকে৷ প্রিয়তমাকে যে এখন আদর দিতে হবে। আদরে আদরে তার সবটুকু কষ্ট শুষে নিয়ে শূন্য কোঠায় স্থান দিতে হবে।

.

ঘরে উপস্থিত লোকের সংখ্যা একে একে কমে যেতেই শান্তর আবারও মৃগী রুগীদের ন্যায় কাঁপাকাঁপি শুরু হলো।
ভয়ার্ত চোখেই সে তানবীরের রুমটাতে নজর বুলালো। এতক্ষণ সবার মধ্যে থেকে কিছু দেখার সুযোগই ছিল না। লাল গোলাপ আর রজনীগন্ধায় রুমটা ডেকোরেশন করা হয়েছে। এতো এতো ফুলে মনে হচ্ছে কোনো রুম নয় সাক্ষাৎ ফুলের বাগান। সাথে জেসমিনের সৌরভের অসংখ্য ক্যান্ডেলে রুমটা আলোকিত। শান্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে নিজের রুমটাকে। হ্যাঁ এটাতো আজ থেকে তারই রুম। বিবাহের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুধু এই রুমটুকুই তার নয়। বরং এই বাড়ি এবং এর প্রতিটি আনাচে-কানাচেতে আজ থেকে শান্তর দায়িত্ব। তার নিজের ছোট্ট সংসার।
হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে শান্ত সেদিকে ফিরে তাকালো। আজ সারাদিকে যেন তানবীরের দিকে তাকানোর তার সাহসই হয়নি। এখনও হচ্ছে না৷ কিন্তু বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে যে বড্ড ইচ্ছে হয়। এই দুষ্টু ছেলেটা যে একান্ত তার নিজের। তার উপর শান্তর অনেক অধিকার, অনেক মুগ্ধতা। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের এই ছেলেটিকে মেরুরের মধ্যে গোল্ডেন শেরওয়ানিতে বর সাজে মারাত্মক লাগছে। চোখ ফিরানো যে দায়। আবার ঐদিকে বড়রা শিখিয়ে দিয়েছে বাসরঘরে তানবীর আসলে তাকে যেন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। তাই শান্ত ধুরু ধুরু বুক নিয়েই ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
তানবীর ডেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়ি খুলে পাঞ্জাবির বোতাম খুলছিল। আচমকাই শান্ত নিজের মতো করে তানবীরে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফেলল। হঠাৎ এমন করাতে তানবীরও বিষয়টা বুঝে উঠতে পারলো না।

— ‘ সালাম করার দরকার ছিল না। এসব আমি মানি না। ‘
— ‘ আস..লে বড়রা বলে দিয়েছে। তাই। ‘
— ‘ আচ্ছা থাক। আর বলতে হবে না। এসব পরে আর কতক্ষণ থাকবে? ভারি জিনিসপত্র ছেড়ে ফ্রেস হয়ে আসো। ‘

শান্ত বিনাবাক্য তানবীরের কথা পালন করলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো এতো এতো অলংকার, সেফটিপিনে। শান্তর এসবের সাথে এমন নীরব যুদ্ধ দেখে তানবীর এগিয়ে গেল। এবং নিঃশব্দে তার কাজে সহায়তা করলো। এদিকে পুরোটা সময় শান্ত যেন দম আটকে বসে ছিল। শরীরে তানবীরের রুক্ষ বলিষ্ঠ হাতগুলোর ছোঁয়া পরতেই যেন শরীর বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছিল।

— ‘ হুম সব খোলা শেষ। এখন যাও। ‘

শান্ত এবারও বিনাবাক্য তার কথা পালন করলো। তার নিজের শব্দ ভান্ডার যেন আজ ফাঁকা। হালকা কমলা রঙের একটা সুতি শাড়ি নিয়ে সে ওয়াসরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সারাদিনের ক্লান্ততায় বেশ সময় নিয়ে একটা শাওয়ার নিলো। অতঃপর ভেজা চুলে তোয়ালে পেচিয়ে সে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। কিন্তু কয়েকদম সামনে এগুতেই শান্ত নিজেকে শূন্য অনুভব করলো৷ আচমকা এমন হওয়াতে ভয় পেলেও ক্যান্ডেলের মৃদু আলোয় তানবীরের কোলে নিজেকে দেখে কোনোভাবে বুকে ফুঁ দিয়ে সামলে নিলো। কিন্তু তানবীরের বলা নেই কওয়া নেই এমন করার কারণটা কি?

— ‘ কি হয়ে..ছে? এমন করে..

বাকিটা বাক্য সমাপ্ত করতে না দিয়েই তানবীর তাকে নরম বিছানায় একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলল। আর সেকেন্ড সময় অতিবাহিত না করেই নিজের সবটুকু ভর তার নরম শরীরের উপর তুলে দিলো।

— ‘ কি কর..ছেন কি? আমি ব্যাথা পা..চ্ছি। উঠুন। ‘

তানবীর উঠলো তো না-ই উল্টো শান্তর নরম গালগুলো শক্ত হাতে চেপে ধরলো,

— ‘ তখন ওভাবে কান্না করার কি মানে? তোকে কি আমি জোর করে বিয়ে করেছিলাম? নাকি মন এখনও বিদেশের বাগদত্তার কাছে পরে আছে? ‘

শান্তর চোখ বোধহয় বেড়িয়ে আসার উপক্রম। এই ছেলেতো আচ্ছা পাগল। কবুল বলার সময় কি কোনো মেয়ে হাসবে নাকি? এটাতো একটা বাচ্চাও বুঝে।

— ‘ এটাতো…
— ‘ চুপ। সবাইকে কি জানাতে চাস? আমি খারাপ? আমার কাছে তুই খারাপ থাকবি? তাই এতো কান্নাকাটি? ‘
— ‘ আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে। আমি কেন এমনটা মনে করাতে যাব? ‘
— ‘ তাহলে বল এতো কান্নাকাটির কি মানে? তুই দেখেছিস? তোর বাপ মানে আমার শ্রদ্ধেয় শশুর আব্বা কেমন বড় বড় চোখ করে তাকাইয়া ছিল! না জানি উনার আদরের দুলালীরে আমি কতই না দুঃখে রাখুম। ‘
— ‘ ইশশ আপনি তো আমাকে কিছু বলতেই দিচ্ছেন না। ‘
— ‘ আর বলতে দিবোও না। ‘

কথাটুকু শেষ করেই তানবীর নিজের মুখ শান্তর গলায় ডুবিয়ে দিলো৷ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ঘষাতে শান্তর অবস্থা বড্ড করুণ। ঐদিকে তানবীর নিজের কাজে মত্ত। এতদিনের পিপাসিত প্রাণের কাছে আজকে যেন জলের সন্ধান। তাই সে সবকিছু ভুলে নিজের পিপাসা নিবারণে ব্যস্ত।

— ‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি। ‘

শান্তর অস্ফুটস্বরের কথাটাতে তানবীরের মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। শুধু শান্তর কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে ঘন শ্বাস ফেলে বলল,

— ‘ মাত্র এতটুকুতেই? এখনও যে অনেক ব্যাথা পাবার বাকি। এখনই কাহিল হলে চলবে? ‘

কি ছিলো বাক্যটাতে শান্ত সেটা জানে না। কিন্তু এমন নেশালো বাণে শান্তর শরীর অসার থেকে অসার হতে চলেছে। শরীরে যেন একবিন্দু পরিমাণ শক্তি নেই। বড্ড অভাব। কিন্তু চরম এক সুখানুভূতি। বোধহয় এমন জ্বালাময়ী সুখ কেবল বিবাহের পবিত্র বন্ধন থেকেই উপলব্ধি করা সম্ভব। আর ঐদিকে রাতের প্রহরের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে যেন ভালোবাসার প্রহরেরও পরিবর্তন হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসার গভীরতাটুকু যেন ক্রমশ বৃদ্ধির পথে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here