অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৬৪

0
4857

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬৪ ❤

আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠার পরেই নীলা আদুরে বাচ্চার মতন মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছে। সাদিদ আড়চোখে তার ভাবভঙ্গি খেয়াল করেছে ঠিকই। লাই দিলে মাথায় চড়ে বসবে বলে এতক্ষণ কিছুটি বলেনি। কিন্তু এখন বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে কখন সেই স্ট্রবেরি মিল্কশেকটা খেতে বলেছে কিন্তু এখন ও সে শেষ করেনি। তাই সাদিদ বাধ্য হয়েই এবার ডাকলো,

— ‘ পাখি? ‘

নীলা গোমড়ামুখে তার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। সাদিদ তার কান্ডে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। অতঃপর আবার ডাকলো,

— ‘ আসো। ‘

অভিমানিনী আড়চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের কাছে ডাকছে। এমন করে বললে কি মন খারাপ করে রাখা যায়?
নীলাও পারলো না। ধীর পায়ে সাদিদের দিকে এগিয়ে গেল। সাদিদ তাকে টেনে এনে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো। থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করলো,

— ‘ কি হয়েছে আমার প্রাণপাখির? মন ভালো না সোনা? ‘
— ‘ নাহ্। ‘
— ‘ তাই? ‘

নীলা আলতো করে সাদিদের বুকে একটা কিল দিলো। বুঝেও নীলার সাথে দুষ্টুমি করা হচ্ছে!
নীলা রেগে উঠতে গেলেই সাদিদ তার কোমড় জড়িয়ে তাকে কাছে টানলো। ফোলা ফোলা গালগুলোতে নিজের শক্তপোক্ত হাতটা বুলিয়ে দিয়ে আবার বলল,

— ‘ এমন মন খারাপ করে থাকলে হবে? তাহলে যে আমাদের প্রিন্সেস ও একা একা মন খারাপ করে বসে থাকবে। ‘
— ‘ থাকবেই তো। প্রিন্সেসের বাবা এমন করলে মন খারাপ না করে উপায় আছে বুঝি? ছাড়ুন আমাকে। এখন আর আদর দেখাতে হবে না। ‘
— ‘ ইশশ বউটা রেগে গিয়েছে মনে হয়? কিন্তু আমি কি করবো জান? তোমাকে নিয়ে যে আমার পক্ষে ওয়ান পারসেন্ট ও রিক্স নেওয়া সম্ভব নয়। ‘
— ‘ তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি? আমি এখনই হসপিটালে এডমিট হতে চাই না। হসপিটালের পরিবেশে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। ‘
— ‘ এমন করে বলে না সোনা। আমি আছিতো তোমার সাথে। আর মা-ভাবীমণি সবাই থাকবে। তোমার একটুও খারাপ লাগবে না। ‘
— ‘ তারপরও…

সাদিদ তাকে আর বাক্যটা সমাপ্ত করতে দিলো না৷ আদুরে মুখটাতে পরপর দুইটা চুমু খেল। তারপর থুতনিতেও ঠোঁটের উষ্ণ পরশ দিয়ে সাদিদ নিজেই তার বাক্যটা সমাপ্ত করলো,

— ‘ তারপরও যেতে হবে। একমাত্র তোমার জন্যই তানবীরের সাথে কথা বলে আমি তাদের বিয়ের ডেইটটা এগিয়ে এনেছি৷ এতদিন তোমাকে ইচ্ছে করেই সেটার কারণ বলিনি। আগে বললে তখন থেকেই মন খারাপ করে বসে থাকতে। ‘
— ‘ এতো যেহেতু বুঝেন তাহলে এটা কেন বুঝতে চাচ্ছেন না যে, আমি এখনই হসপিটালের বন্ধ পরিবেশে যেতে চাই না। বেবি আসতে আরও অনেক সময় বাকি। আমি মাত্র ছয় মাস শেষ হয়ে সাত মাসে পরবো। ‘
— ‘ আমি জানি সোনা। তাইতো এতো তাড়াহুড়ো করছি। গত রাতেও আচমকা তোমার শরীর খারাপ লাগছিলো। এমনটাতো আজকাল অহরহ হচ্ছে। এই অবস্থায় আমি কিভাবে তোমাকে বাড়িতে রেখে শান্তি পাই বলো? ‘
— ‘ ডক্টরতো বলেছে এটা আমার জন্য নরমাল। তাই এতো চিন্তার প্রয়োজন নেই। ‘
— ‘ আছে পাখি। প্লিজ অন্ততপক্ষে আমার জন্য হাসিমুখে রেডি হও। তোমার মুখটা এমন শুকনো দেখলে কি আমার ভালো লাগবে? ‘

নীলা জলে টলমলে চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। অতঃপর সাদিদের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমি বাড়ির সবাইকে অনেক মিস করবো। ‘
— ‘ সবাই যাবে তো। তুমি মিস করার সুযোগই পাবে না। ‘
— ‘ ইশশ আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি আমাদের এই রুমটাকেও মিস করবো। সব মানে সব মিস করবো। ‘

সাদিদ তার এমন কথায় মৃদু হাসলো। তারপর পাখিটার গালে হাত বুলিয়ে মাথা নিচু করে মাথায় গভীর একটা চুমু খেল। নীলার হাতের সরু আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে আদুরেস্বরে বলল,

— ‘ কিন্তু তারপরও যেতে হবে সোনা। আমার জন্য হলেও। যাবে না? ‘

নীলা মুখে আর কিছু বললো না। শুধু নিঃশব্দে মাথা উপরনিচ করলো। সাদিদ নিজেও বুঝতে পারছে নীলা কেবলমাত্র সাদিদের মুখের দিকে তাকিয়েই হ্যাঁ বলছে।
কিন্তু সাদিদ যে নিরুপায়। আজকে নীলার মন ভেঙে হলেও তাকে নিজের জায়গায় স্থির থাকতেই হবে। তাই আলতো করে নীলাকে বুকে টেনে আনলো। মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে ভীষণ আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আমরা শীঘ্রই ফিরে আসবো পাখি। দেখবে এরপর যখন বাড়িতে আসবো, ইনশাআল্লাহ আমাদের প্রিন্সেসকে ও সাথে নিয়ে আসবো। ‘

সাদিদের কন্ঠে চাপা খুশির আমেজ। বাচ্চার কথাটা শুনে নীলার মনটাও নিমিষেই ভালো হয়ে গেল। প্রচন্ড উৎসাহে বলল,

— ‘ সত্যি তাই? ‘
— ‘ হ্যাঁ পাখি। একেবারে সত্যি। ‘

বলেই সাদিদ প্রিয়তমার আদুরে গালগুলো আলতো করে টেনে দিলো। নীলা এবার শত কষ্টের মাঝেও খুশি। ছোট্ট প্রাণটা যে নিজের অবর্তমানেই তাদের জীবনের বৃহৎ একটা অংশজুড়ে নিজের জায়গা পাকাপোক্তভাবে বরাদ্দ করে নিয়েছে।

— ‘ এবার এটা শেষ করো। তারপরই আমরা বেড়িয়ে যাব। তোমাকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার অফিসে আসতে হবে। ‘
— ‘ তাহলে আমি যাবোই না৷ আপনি আমাকে ঐ খারাপ জায়গাটাতে একা রেখে রেখে চলে যাবেন। তাহলে আমি কেন যাব? যাবোই না। ‘

বলেই নীলা আবারও গাল ফুলিয়ে নিলো। সাদিদ এবার শব্দ করেই হেসে ফেলল। সেটা দেখে নীলা কপালে কুঁচকে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। সাদিদ আর মুখে কথা বললো না। মিল্কশেকের গ্লাসটা হাতে নিয়ে নীলার ঠোঁটের সাথে লাগালো। নীলা মুখ ঘুরিয়ে নিতেই আদুরে ছোট্ট বাচ্চার মতো গাল হালকাভাবে চেপে ধরে একটুখানি খাইয়ে দিলো। আর নীলার সাথে সাথেই অভিযোগ শুরু,

— ‘ খারাপ, খারাপ। খুব খারাপ আপনি৷ বাবু শুনছিস তো? তোর বাপ একটা বজ্জাত খারাপ। ‘

বলতে দেরি নেই আর পেটে হাত চেপে নীলার মুখ ফুটে আর্তনাদ বেড়িয়ে আসতে দেরি নেই৷ সাদিদ এতক্ষণ হাসছিলো কিন্তু এখন গ্লাস সাইডে রেখে দ্রুত এগিয়ে আসলো,

— ‘ লক্ষীটি কি হয়েছে? আবারও পেট ব্যাথা করছে? ‘

নীলার ব্যাথা এখন ধীরে ধীরে কমে এসেছে। সে চোরাচোখে একবার সাদিদের দিকে তাকালো। কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না৷ সেটা দেখে সাদিদ দ্বিগুণ অস্থিরতা মিশ্রিত কন্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করলো,

— ‘ বলো আমাকে। খুব বেশি ব্যাথা করছে? ‘
— ‘ না.. ঠিক আছি। ‘
— ‘ কি হয়েছিল তখন? ‘

সাদিদ বারবার জানতে চায়ছে আর অপরদিকে নীলা এটা সেটার অযুহাতে কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাচ্ছে।
সাদিদ এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে নীলার দিকে একদৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলো। আর ক্ষণে ক্ষণে নীলার আড়চোখে তাকানো আর কথা লোকানোর ভাবভঙ্গি দেখে ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হতে শুরু করলো। কেননা ইতিমধ্যে সে বিষয়টা ধরে ফেলেছে৷ সাদিদ বেশিক্ষণ নিজের হাসি চেপে রাখতে পারলো না। একসময় শব্দ করেই হেসে ফেলল। এবং হাসতে হাসতে তার সোফায় গড়াগড়ি খাওয়ার মতন অবস্থা হলো৷ আর নীলা এবার রাগে দুঃখে এলোপাতাড়ি সাদিদের উপর বালিশের আক্রমণ শুরু করলো।

— ‘ খুব খারাপ, খুব৷ সাথে আপনার আদরের দুলালীও। বজ্জাত মেয়ে একটা। এখনই বাপের তরফদারি করে! ‘
— ‘ আরে বউ থামো। অনেক হয়েছে। আচ্ছা মেয়েকে বলবো মায়ের মন রক্ষার্থে যেন মাঝে মধ্যে তারও তরফদারি করে। ‘

নীলা কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়েছিল। কিন্তু সাদিদের মিটিমিটি হেসে এমন কথার পরিবর্তে আবারও শুরু করলো। এভাবে অনেকক্ষণ চললো প্রেমময়ী কাপল যুগলের খুনসুটি। অতঃপর এবার সাদিদকেই উঠে ক্ষেপা বাঘিনীকে থামাতো হলো। সে নীলাকে পিছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে উন্মুক্ত কাঁধে মুখ গোঁজল। খড়খড়ে দাঁড়ির মৃদু ঘষাতে অটোমেটিকলি নীলার হাত থেমে গেল। সাদিদ ঠোঁট টিপে হেসে প্রিয়তমার কানের লতিতে নিজের পুরুষালী ঠোঁট স্পর্শ করলো। সাদিদ নীলার কাঁধে-ঘাড়ে মুখ ঘষতেই নীলা লেগে যাওয়া স্বরে বলে উঠল,

— ‘ কি কর..ছেন? ‘
— ‘ না, এখন আর কিছু করছি না। সময় যে নেই। ‘

বলেই সে উন্মুক্ত কাঁধে ছোট করে একটা চুমু খেল। পিছন থেকেই নীলার উঁচু পেটটাতে আদুরেভাবে হাত বুলিয়ে বলল,

— ‘ লক্ষীটি আমার, আর দুষ্টুমি করে না। ভালো মেয়ের মতো যাওয়ার জন্য তৈরি হও। আই প্রমিস তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমি যেটুকু সময় থাকবো না বাড়ির অন্য কেউ অবশ্যই তোমার সাথে থাকবে৷ এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে একা ছাড়বো না। বিশ্বাস করো না আমাকে? ‘

নীলা ঘাড় ফিরিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। মিষ্টি করে হেসে বলল,

— ‘ নিজের থেকেও বেশি। ‘

সাদিদও মৃদু হাসল। অতঃপর নীলার নাকে নিজের নাক আলতো করে ঘষা দিয়ে বলল,

— ‘ তাহলে এবার চলো। প্রিন্সেসকে নিজেদের কাছে পাওয়ার জন্য একদাপ এগিয়ে যাই? ‘

নীলা আর রাগ বা অভিমান দেখালো না। চুপটি করে সাদিদের সাথে উঠে আসলো।
সাদিদ একেবারে নীলাকে রেডি করিয়ে রুমের বাহিরে এসেছে। তারা লিভিংরুমে আসতেই সবাইকে সেখানে উপস্থিত পেল। কারো মুখে বিন্দুমাত্র হাসির রেখা নেই। কিন্তু তারপরও সাদিদ নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।

— ‘ আচ্ছা সাদি, আমাকে একটু বলবি এসবের মানে কি? যদি এখন থেকেই নীলা মামণিকে হসপিটালে রাখতে চাস তাহলে বাংলাদেশে কেন? দেশের বাহিরে নিয়ে যা। ‘
— ‘ তোমার মা কিন্তু খারাপ বলেনি সাদি। আমরা এই বিষয়ে আগেও কথা বলেছি। কিন্তু তুমিই তখন না করলে। তাহলে এখন এতো তাড়াহুড়ো কেন? ‘

সাদিদ তাদের কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই একপলক নীলার দিকে তাকালো। নীলা চোরাচোখে তাকাতেই সে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

— ‘ আমাকে বলো কেন? তোমাদের আদরের দুলালীকেই বলো। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ মানে হচ্ছে তোমাদের আদরে বাঁদর হওয়া মেয়েটা আমার একটা কথাও শুনে না। তাকে কোনোভাবেই ডেলিভারির জন্য ইউকে তে যাওয়ার জন্য রাজি করতে পারিনি। আমি তার অবস্থা জেনেই ইউকে নিয়ে যাবার জন্য চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু তার এক বাচ্চামো জেদ, সে যাবে না। ‘
— ‘ এসব কি নীলা মামণি? আর সাদি তুই, আমাদের একথা আগে জানাসনি কেন? ‘
— ‘ জানানোর আগেই তো কেঁদে কেটে একশেষ। দেখো, এখনও চোখে জল টলমল করছে। এই মেয়েকে আমি কিভাবে কি বলবো! ‘

সাদিদের কথায় শায়লা রহমান উঠে দাঁড়ালেন। নীলাকে আস্তেধীরে এনে সোফায় বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসলেন। অতঃপর চোখের জল মুছে দিয়ে খুবই আদরের ভঙ্গিতে বললেন,

— ‘ কিরে মা, এসব কি শুনছি? এটা কি ঠিক? এতো টাকাপয়সা থেকেও যদি সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে না পারি তাহলে এসব থেকে কি লাভ? ‘
— ‘ মা টাকার জন্য না। আমি বাবুকে নিয়ে ইউকে যেতে চাই না। ‘

নীলার মাথা নুইয়ে নিচুগলার কথা শুনে উপস্থিত সবকটি চোখ তাকেই পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। শায়লা রহমান ধৈর্য্য ধরতে না পেরে বলেই ফেললেন,

— ‘ কেন? ‘
— ‘ আমি জানি না মা। কিন্তু বাবুকে আমি বিদেশের মাটিতে জন্ম দিতে চাই না। আল্লাহর ইচ্ছে থাকলে সে নিজ দেশের মাটিতেই প্রিয়জনদের দোয়ায় সুস্থভাবে জন্মগ্রহণ করবে। আমার এইটুকু ইচ্ছে মা। প্লিজ আপনারা বাবুকে নিয়ে ইউকে যেতে জোর করবেন না। ‘

লিভিংরুমে কয়েকটি মুহূর্ত ভীষণ নীরবতায় কেটে গেল। থমথমে পরিস্থিতিটাকে সামলে নিতে শায়লা রহমান সযত্নে নীলার কপালে স্নেহের চুম্বন দিয়ে বললেন,

— ‘ বেঁচে থাক মা। আল্লাহ তোকে সবুর করার জন্য উত্তম ফলাফল দান করুক। আমরা আর কেউ তোকে এই নিয়ে জোর করবো না। তোর খুশিতেই আমাদের খুশি। ‘

নীলা ছলছলে চোখে হাসলো। পাশে বসা শাদমানকে একদৃষ্টিতে তার পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদুরেভাবে তাকে কাছে টেনে আনলো।

— ‘ আব্বাটা এমন করে কি দেখে? ‘
— ‘ খালামণি, তোমার এই..এইখানে বাবু আছে? ‘

ছোট্ট মানুষের হঠাৎ এমন পাকা কথায় নীলার ভীষণ হাসি পেল। উপস্থিত সবাইও ঠোঁট টিপে তাদের কথোপকথন শুনে যাচ্ছে।

— ‘ হ্যাঁ। একটা ছোট্ট বাবু আছে তো। ‘
— ‘ বাবুটা কি পঁচা? ‘
— ‘ এমা! পঁচা হতে যাবে কেন? ‘
— ‘ তাহলে তোমাকে ব্যাতা দেয় কেন? তোমাকে ডতক্টর যেতে হবে কেন? বাবুই এতো দুতষ্টু কেন? ‘

নীলা আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। হাসতে হাসতে পেটে এবার মৃদু ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। তাই সে পেটে হাত রেখেই পিচ্চির পাকনামিতে হেসে যাচ্ছে।
সাদিদ এতক্ষণ দাড়িয়ে থেকে মিষ্টি সম্পর্কের সুখানুভূতিটা অনুভব করছিলো। এখন নিঃশব্দে মৃদু হেসে এগিয়ে আসলো। শাদমানকে শক্ত করে নিজের কোলে চেপে ধরে বরাবরের মতোই ফর্সা গালগুলোতে ঠেসে ঠেসে চুমু খেল,

— ‘ বাবা তুমি এতো পাকনামি করো কেন? ‘

শাদমান সাদিদের কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলো না। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে গাল মুছতে মুছতে নাকের পাটা ফুলিয়ে উল্টো বলে উঠল,

— ‘ তুমি বাবুর মতো এতো পঁচা কেন? বারবার আমার গাল খাও কেন? ভাত খাও না কেন? ‘

কেউই আর শাদের এতো কেনোর উত্তর দিতে পারলো না। হাসতে হাসতেই তাদের অবস্থা খারাপ। দুঃখে ভরা বিষন্ন পরিস্থিতিটা যেন মুহূর্তেই আনন্দমহলে পরিণত হলো। সবার এতো আনন্দের মধ্যে কেবলমাত্র একজনের মুখেই রাজ্যের বিরক্তি। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক আপনমনেই বিরক্তিরস্বরে বিড়বিড় করলো,

— ‘ সবাই এতো হাসছে কেন? ‘

_________________

পুরোটা দিন নীলার অতিবাহিত হলো নতুন নতুন ডক্টর আর নার্সদের মুখ দেখে। বোধহয় কেউ তাদের উপর গুরুদায়িত্ব চাপিয়েছে যেন নীলাকে ক্ষণে ক্ষণে এসে বিরক্ত করে যায়। আবারও একজন ডক্টর এসে নীলার রেগুলার ব্লাড প্রেশার চেক করে গেল৷ এবং বরাবরের মতোই টুকিটাকি কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি। ডক্টর কেবিন থেকে বের হতেই নীলা অসহায় ভঙ্গিতে নিজের মা এবং নিধির দিকে তাকালো। তারা মিটিমিটি হাসছে। কেননা তারা ভালোই জানে নীলা এখন কি বলবে।

— ‘ আম্মু আমি পাগল হয়ে যাব। তোমাদের জামাই আমার ট্রিটমেন্টের জন্য নয়, বরং আমাকে পাগলাগারদে পাঠানোর জন্য এখানে এনেছে। ‘
— ‘ ছিঃ ছিঃ দিবো এক থাপ্পড়। এমন কথা কেউ বলে? ‘
— ‘ তাহলে আমি আর কি করবো? সকাল থেকে এসবে পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। ‘
— ‘ রাগ করিস না পিচ্চু। জানিস তো ছেলেটা তোর বিষয়ে পুরোপুরি পাগল। তাই অযথা রাগ না করে একটু সহ্য কর। ‘
— ‘ সহ্য! আমার কাছে এগুলো মারাত্মক অসহ্যকর হয়ে পড়েছে। বারবার..

নীলা আরও কিছু অভিযোগ মাখানো শব্দ বলতে চাইছিল। কিন্তু কেবিনের দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে তাকালো।
সাদিদ এসেছে। তাকে আসতে দেখেই নিধি উঠে দাড়ালো।

— ‘ আম্মু উঠো। সাদিদ চলে এসেছে এখন আমাদের দায়িত্ব শেষ৷ ‘
— ‘ আরে ভাবীমণি বসো তোমরা। সমস্যা নেই। ‘
— ‘ না গো ভাই। শাদকে বাসায় মায়ের কাছে রেখে এসেছি। ছোট মানুষ বিধায় আর হসপিটালে নিয়ে আসিনি। ‘
— ‘ কিন্তু তাই বলে এখনই? ‘
— ‘ আরে এখনতো আশা যাওয়া লেগেই থাকবে। কালকেই তো আবার আসবো। এখন আর আটকিও না ভাই। ‘
— ‘ হ্যাঁ বাবা, তোমরা থাকো বরং। আমরা এবার যাই। ‘

নার্গিস খাতুন আর নিধি বিদায় নিয়ে চলে গেল। সাদিদ বলা স্বত্বেও তারা আর কিছুক্ষণ থাকলো না। আসলে তাদের পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যই অপরজনের প্রাইভেসিতে বাধা হয়ে দাড়াতে চায় না। এই যেমন সারাদিনের ব্যস্ততার পর রাতের এইটুকু সময় যে সাদিদ নীলাকে আলাদা করে চাইবে, এটা তাদেরকে বলে বুঝিয়ে দিতে হয় না৷ নিজ দায়িত্বে তারা এইটুকু বুঝে নেয়। সাদিদ এসবভেবে আপনমনেই নিঃশব্দে হাসলো। অতঃপর কেবিনের দরজাটা লক করে এসে নীলার পাশে বসলো। প্রিয়তমার মুখটা আঁজলাভরে ধরে মাথায় সময় নিয়ে ভালোবাসার দীর্ঘ একটা পরশ এঁকে দিলো।

— ‘ সারাদিন কেমন কেটেছে পাখি? ‘
— ‘ খুববববব ভালো। ‘

খুব শব্দ উচ্চারণে অতিরিক্ত চারটা ‘ব’ যুক্ত করতেই সাদিদ বুঝতে পারলো প্রাণপাখি তার রেগে বুম হয়ে আছে। তাই আর বেশি ঘাটতে গেল না। এমনিতেই প্রেগনেন্সিতে মেয়েটার মুডের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ক্ষণে ক্ষণে রেগে যায়। মিষ্টি পাখিটার মেজাজটা আজকাল বড্ড তিরিক্ষি হয়ে থাকে। তাই সাদিদ কিছুটি বললো না। শুধু আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো৷ সারাদিনের ক্লান্তিতে এবার গোসল না করলেই নয়। তাই সে আজকে আনানো ছোট্ট ওয়ারড্রব থেকে নিজের জন্য পাতলা একটা ট্রি শার্ট আর টাওজার নিয়ে কেবিনের এডজাস্ট ওয়াসরুমে চলে গেল। নীলা ততক্ষণে কম্বলে মুখ ঢেকে নিয়েছে। আজকে আর কথাই বলবে না৷ সকালে তাকে হসপিটালে দিয়ে সাদিদ পুরো হাওয়া। সারাদিন বাহিরে কাটিয়ে রাত দশটা বাজে তার নীলার কথা মনে পরেছে। বলবে না নীলা, কিছুতেই এই নিষ্ঠুর ছেলের সাথে কথা বলবে না৷ অতিরিক্ত পাগলামি করে তাকে হসপিটালের এই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি করে রাখার শাস্তি এই ছেলেকে সে দিয়েই ছাড়বে।
সাদিদ শাওয়ার নিয়ে রুমে আসতেই নীলার কান্ড বুঝতে পারলো। তার ঠোঁটের কোণে মুহূর্তেই খুশির রেখারা এসে ধরা দিলো। সে চুলগুলো কোনোভাবে মুছে নীলার সিঙ্গেল বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।
আর অপরদিকে নীলার মনে মনে লাড্ডু ফুটছে। হসপিটাল হয়ে ভালোই হয়েছে। সাদিদের ইচ্ছে থাকলেও তার কাছে আসতে পারবে না। আর নীলা তাকে দূরে রেখে সাদিদের জন্য ভয়ানক শাস্তির উপহার স্বরূপ তৃপ্তির হাসি হাসবে। এসব ভাবতেই নীলার বুক ফেটে হাসি বের হচ্ছে। শুধু কোনোভাবে নিজের হাসিটা আটকে রাখছে।
কিন্তু সেগুড়ে বালি! নীলার সব আশাতে একটন জল ঢেলে দিয়ে সাদিদের বলিষ্ঠ হাতদুটো তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে। নীলা হুড়মুড়িয়ে কম্বলের নিচ থেকে মুখ তুললো। সাদিদকে নিজের সাথে একি বিছানায় দেখে খানিকটা চমকে গেলেও পরমুহূর্তেই বিষয়টা আঁচ করতে পারলো৷ দুষ্টুটা কেবিনের দুটি বেডকে একত্রে করে নিয়েছে। নীলা আবারও রেগে সাদিদের দিকে তাকালো।

— ‘ এসব কি? এটাকে কি নিজের বেডরুম পেয়েছেন? আপনার প্রাণের প্রিয় ডক্টর-নার্সরা এসে দেখলে কি ভাববে? ‘
— ‘ কি আর ভাববে? ভাববে ছেলেটা তার বউটাকে খুবই আদর করে৷ তাইতো দূরে থাকতেই পারে না। ‘
— ‘ সরুন। দরকার নেই…

নীলাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে সাদিদ তার মুখটাই বন্ধ করে দিলো। প্রিয়তমার কোমল ঠোঁটে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে সরে আসলো৷ নীলা চোখ পাকিয়ে তাকালো। আবারও রাগীস্বরে বলে উঠল,

— ‘ কি হলো? সবসময়…

এবং দুষ্টু সাদিদ আবারও নীলার ঠোঁটযুগল আলতো করে চেপে ধরলো। নীলা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। শুধু রাগ-অভিমান-ক্ষোভের মিশ্র সমন্বয়ের দৃষ্টি নিয়ে সাদিদের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে আর কিছু বললো না। নতুবা দুষ্টুটা আবারও নিজের শয়তানি শুরু করবে।
নীলাকে চোখ পাকিয়ে নীরব থাকতে দেখে সাদিদ ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

— ‘ কি? আর কিছু বলবে না? ‘

তার ঠোঁটের কোণে এখনও চাপা হাসি। নীলা কিছু বললো না। শুধু পাশ ফিরে শুয়ে পরতে গেলেই সাদিদ তাকে আটকে দিলো। ভীষণ আদুরেভাবে নরম গলায় বলে উঠল,

— ‘ সরি জান। আ’ম লেইট। কিন্তু প্রমিস কাল থেকে আর হবে না। আমি আজকেই বাবার সাথে কথা বলেছি। কাল থেকে কেবলমাত্র দুপুর পর্যন্তই আমি অফিসে থাকবো। আর বাদবাকি সব কাজ তোমার সাথে থেকেই শেষ করবো। এখনও রেগে থাকবে সোনা? আ’ম সরি তো। ‘

ইশশ এমন আদুরেভাবে বললে কি রেগে থাকা যায়? যায় না তো। নীলাও পারলো না। সাদিদের ভেজা চুলগুলোতে আলতো হাত বুলিয়ে বলল,

— ‘ এসব করতে হবে না। আপনার যেভাবে কাজ করলে সুবিধা হবে সেভাবেই করেন। আপুনি, মা সবাই আছে তো। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। ‘
— ‘ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি পাখি। আর বাবার সাথেও এই নিয়ে কথা বলে ফেলেছি। তাই এসব নিয়ে তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। তুমি শুধু নিজের আর আমার প্রিন্সেসের খেয়াল রাখো৷ বাকিসব আমি সামলে নিবো। ‘
— ‘ তবুও..
— ‘ আর কিছু না। এখন আসো তো পাখি, সারাদিনে একটুও আদর করতে পারিনি। এখন শুধু আদর হবে। ‘
— ‘ ইশশ না। ‘
— ‘ শুধু আদর। আর কোনো কথা নয়। ‘

নীলা খিলখিলিয়ে হাসছে, আর সাদিদ আস্তে করে তাকে নিজের সাথে আগলিয়ে নিয়ে অনবরত নীলার গলায় আদুরে চুমু খাচ্ছে। যেন আদুরে একটা ছোট্ট বাচ্চা। একটু জোরে ধরলেই ব্যাথা পাবে।

— ‘ আর কতো? ‘
— ‘ মাত্রই তো শুরু করলাম। আরও অনেক। ‘
— ‘ আমার সুড়সুড়ি লাগছে। ‘
— ‘ লাগুক। কিছু করার নেই। আদরে বাকি রাখতে পারবো না। সো বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। ‘

সাদিদের এহেন কথায় নীলা হালকা শব্দ করেই হেসে ফেলল। আর অপরদিকে সাদিদ তার কাজে মহা ব্যস্ত। নীলার পেটের উপর থেকে সাদিদ রাতের জন্য পরিহিত নরম ঢিলা মেক্সিটা সরিয়ে দিলো। উঁচু পেটটাতে দীর্ঘ একটা স্নেহভরা উষ্ণ চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ আম্মা, ঘুমিয়ে পরেছেন? নতুন জায়গা পছন্দ হয়েছে? ‘
— ‘ ওহ্ একদম না। ‘
— ‘ আপনাকে বলিনি। আমার প্রিন্সেসকে বলেছি। বুঝেছেন। ‘
— ‘ কচু বুঝেছি। ‘
— ‘ সেটাই তো বুঝবেন। ভালো কিছু বুঝলে তো আপনার নাম আর নীলাঞ্জনা হতো না। ‘
— ‘ আমাকে অপমান করছেন? ‘

নীলার কুঁচকানো কপাল দেখে সাদিদ হেসে ফেলল। অতঃপর আবারও উন্মুক্ত পেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে কন্ঠে এক সমুদ্র আবেগ ঢেলে বলে উঠল,

— ‘ না লক্ষীটি। ভালোবাসছি। হৃদয়ে সযত্নে সংরক্ষিত অনেক অনেক আদুরে ভালোবাসা। ‘

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here