অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৬৮

0
4787

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬৮ ❤

হসপিটালের তীব্র ফিনাইলের গন্ধটা যেন উপচে পরা হাসি মুখগুলোর কাছে ফিকে পরছে। খরার পর আকষ্মিক বৃষ্টিতে যেমন মাঠে খেটে খাওয়া কৃষকের মুখে ব্যাখাহীন হাসি মুখখানা দেখা যায়, তেমনিভাবে আল্লাহর অশেষ কৃপায় নীলার সুস্থতায় যেন প্রিয়জনগুলোর মধ্যে একই ছাপ। তাই আদরের মেয়েটাকে তারা নিজেদের সর্বোচ্চ আদর-স্নেহ লুটিয়ে দিতে ব্যস্ত।

— ‘ মা, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। ‘
— ‘ সেটা আর বলতে? আন্টি আমার কলিজা তো গলায় এসে আটকে গিয়েছিল। ‘
— ‘ এটা তোর কলিজা? না-কি গুরা কৃমি? এমন লাফালাফি করে ক্যান? ‘

শান্ত চোখ পাকিয়ে তানবীরের দিকে তাকালো। তাতে তানবীরের মধ্যে সেরকম কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে একধ্যানে উত্তরের অপেক্ষায় শান্তর দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু শান্ত তাকে পুরোপুরি নিরাশ করে দিয়ে বিনা প্রতিউত্তরে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল। তাকে রেগে চলে যেতে দেখে শায়লা রহমান তানবীরের কান টেনে ধরলেন,

— ‘ পাঁজি ছেলে, সবসময় মেয়েটার পিছনে না লেগে থাকলে তোর ভালো লাগে না বুঝি? ‘
— ‘ আরে কি করো? ব্যাথা পাই তো। কান ছাড়ো। ‘

শায়লা রহমান কান ছাড়ার আগে আরেকটা কানমলা দিয়ে তবে হাত সরালেন। আর মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন,

— ‘ যা গিয়ে দেখ মেয়েটা কোথায় গেল। হাসিখুশি পরিবেশটাতে ঝগড়া না বাঁধালে শান্তি লাগে না! যতসব দুষ্টু ছেলেপেলে হয়েছে। ‘

শায়লা রহমান তানবীরের আরও কিছু গালমন্দ করলো। সবাই তানবীরের চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে। তানবীর পাংশুটে মুখ নিয়েই কেবিন থেকে বের হলো।
তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে হাসিবুর রহমান বলে উঠলেন,

— ‘ অনেক তো হলো হাসিঠাট্টা। এবার যে মিষ্টিমুখের পালা৷ ‘
— ‘ সেটা আর বলতে বাবা? আমাদের বাড়ির প্রথম মেয়ে। রাজকন্যার আগমনে যে মিষ্টির বৃষ্টি হবে। ‘
— ‘ তাহলে আর দেরি কেন? ওর্ডার দাও ঢাকার সব মিষ্টি দোকানে। একদিনের জন্য শহরের সব মিষ্টি যেন আমাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ‘

আবারও আরেকদফা হাসাহাসি হলো। তারা যেন আজকে নিজেদের অতি আনন্দগুলো প্রকাশ করার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না। তাইতো বাচ্চাদের মতন এমন কারণে-অকারণে হেসে যাচ্ছে। কথা শেষ হতেই শাহেদ আর অর্ণব চললো মিষ্টির জন্য।
সাদিদ একপলক নীলার দিকে তাকালো। সে মেয়ের ছোট্ট আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করছে। সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। নীলার আচমকা সাদিদের দিকে চোখ পরতেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। সাদিদকে সবার সামনেই এমন নির্লজ্জের মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জাবতী নীলা বেশ লজ্জা পেল। আর সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করলো।

.

শান্ত নিজস্ব শরীরের রাগ মেটাতে হসপিটালের নির্দোষ গাছগুলোর উপর অত্যাচার চালাতে শুরু করলো। বোধহয় দেহের সমস্ত শক্তি খরচ করে সে অনবরত গাছের পাতাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে।

— ‘ এখন এতো শক্তি! যখন থাকার দরকার তখন তো দেখি না। ‘

আগুনে যেন তানবীরের কথাটা পেট্রোল হিসেবে কাজ করলো। শান্ত কটমট দৃষ্টি নিয়ে পিছনে ফিরলো।

— ‘ আরেবাস, জলসার কটকটি দেখি বাংলাদেশের মাটিতে! ‘
— ‘ আপনি.. আপনি একটা অসহ্য। ‘

শান্ত চলে যেতে নিতেই তানবীর পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো। আর চারপাশে একবার দেখে নিয়ে শান্তকে পিছন থেকে হালকাভাবে জড়িয়ে ধরল। কাঁধে থুতনি রেখে তিক্ষতা ভুলে নরমস্বরে বলে উঠল,

— ‘ কি হয়েছে? এতো রাগ কেন? ‘
— ‘ কি আর হবে? কিছুই হয়নি। ‘

কন্ঠে প্রখর অভিমানিনীর টান দেখে তানবীর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো। অতঃপর রাগে ফোলা নাকটা আরেকটু ফুলিয়ে দিতে বলল,

— ‘ তাহলে তো ভালো। কিন্তু মুখ এমন পেঁচার মতো কেন? এমনিতেই বান্দ..

তানবীরকে সম্পূর্ণ কথা সমাপ্ত করতে না দিয়েই শান্ত তার পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো। অতঃপর ভাঙা অভিমানী স্বরে বলল,

— ‘ তাহলে কোনো রূপসী ললনাকেই বিয়ে করতেন। আমাকে করার কি দরকার ছিলো? তখন কি চোখ ছিলো না? না-কি বিয়ে হতেই বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছে? ‘

এবার তানবীর আর দুষ্টুমির মুডে নেই৷ এই কথার পর দুষ্টুমি মানায় না। তাই ধরে রাখা হাতের বাঁধন আরেকটু জোরালো করে পুরুষালী ঘন স্বরে বলে উঠল,

— ‘ আজকেই শেষ। আর কখনও যেন তোমার মুখ থেকে এমনটা না শুনি৷ রাগ-অভিমান ঠিক আছে। তাই বলে এসব মেনে নেব না। মাইন্ড ইট। ‘

তানবীরের গলায় রাগের আভাস পেয়ে শান্ত যেন এবার নিভে এলো। কেননা তানবীরের রাগ সম্পর্কে ইতিমধ্যেই তার ধারণা জন্মে গিয়েছে।
শান্তকে চুপচাপ দেখে তানবীর এবার জোরে একটা শ্বাস টানলো। মাথায় জ্বলে উঠা রাগটা কমানোর সর্বোচ্চ প্রয়াস। অতঃপর মিনিট কয়েক নীরবতার পর তানবীরই বলল,

— ‘ তখন এভাবে রাগের কারণ কি? ‘

নিভে যাওয়া অভিমানের টুকরোগুলো যেন আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। নিজেকে তানবীরের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে শান্ত বলে উঠল,

— ‘ ছাড়ুন আমাকে। একদম কথা বলবেন না। কত বার আপনাকে বলেছি সবার সামনে তুইতোকারি করবেন না। বিয়ের আগে ঠিক ছিল। কিন্তু এখন লোকে কি বলবে? ছাড়ুন বলছি। ‘

তানবীর তার রাগের কারণটুকু জেনে শব্দ করেই হেসে ফেলল। যা দেখে শান্ত যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।

— ‘ আবার হাসি হচ্ছে! খারাপ লোক কোথাকার। ‘
— ‘ না হেসে উপায় আছে? বউ যে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন গাল ফুলিয়ে বসবে সেটা কে জানে? আমি আমার বউকে আদর করে তুই ডাকবো, প্রয়োজন হলে আপনি ডাকবো তাতে কার কি? ‘
— ‘ তুই ডাকা আদর? ছিঃ কি বিচ্ছিরি লাগে শুনতে। ‘

তানবীর তার কথায় পাত্তা দিলো না। ঠেসে শান্তর কানের পিছনে চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ বিচ্ছিরি লাগে না গো। আদর আদর লাগে। বরং একটু বেশিই লাগে। ‘

তানবীরের কর্মকান্ডে শান্ত আশেপাশে তাকিয়ে একটু যেন দমে গেল। মেকি রাগ ভুলে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল,

— ‘ পাবলিক প্লেসে এসব কেমন নির্লজ্জতা? ‘
— ‘ তাইলে বলছিস প্রাইভেট প্লেসে নির্লজ্জ হতাম? চল তাহলে, বাসায় যাই। আজ একেবারে নির্লজ্জতার ডেফিনেশন চেইঞ্জ করে ফেলব। ‘
— ‘ ধ্যাত। যতসব আজগুবি কথাবার্তা। ‘
— ‘ আরে কই আজগুবি! শুন না, সাদির মেয়ে উপলক্ষে ঐদিকে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। আমিও মিষ্টি খাব। ‘
— ‘ তো আপনাকে খেতে কে বারণ করেছে? যান গিয়ে পেটভরে মিষ্টি খান৷ ‘
— ‘ ঐ মিষ্টিতে তো পেট ভরবে না। আমার স্পেশাল মিষ্টি চাই৷ ‘
— ‘ মানে? ‘

তানবীর নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে ডানহাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে শান্তর ঠোঁটের কোণ স্পর্শ করলো। ঠোঁটে হালকা স্লাইড করতেই শান্ত চোখ বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালো।

— ‘ এই মিষ্টি চাই৷ ‘

শান্ত এবার লজ্জা পেয়ে আস্তে করে তানবীরের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরালো। লজ্জায় ইতিমধ্যে তার গাল লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।

— ‘ কি হলো? দিবি না? ‘
— ‘ সরুন তো। সব জায়গায় দুষ্টুমি। ‘
— ‘ দুষ্টুমির কি দেখলি? মাত্র একটা কিসই তো চাইলাম। এখানেও তোর অনীহা! ‘
— ‘ নতুবা কি করবো? আপনার বেশরমগিরিতে সঙ্গ দিব? ‘
— ‘ তুই মুডটাই খারাপ করে দিস। শুন, আমার ডিসিশন না চেইঞ্জ। শুধু মিষ্টি না, আমার এর থেকেও বড় জিনিস চাই। ‘
— ‘ মানে? ‘

তানবীর যেন এবার বেশ লজ্জা পেল। লজ্জাবতী মেয়েদের মতো মুখ লটকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

— ‘ একটা গোলুমোলু দে। ‘
— ‘ মা..নে? ‘

শান্ত যেন ছোটখাটো একটা বিষম খেল। তার চোখজোড়া প্রায় বেড়িয়ে আসার উপক্রম।
কিন্তু তানবীর খানিকটা রেগে গেল। তাইতো শান্তর মাথায় হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে বিরক্তিমাখা স্বরে বলল,

— ‘ গাধা মাইয়া কোথাকার। খালি মানে মানে করে। ‘

তারপর আবারও সে নিজের খোলস পাল্টে নিলো। মুহূর্তেই মুখে মেয়েদের ন্যায় খানিকটা লাজুকতা মিশিয়ে বলে উঠল,

— ‘ কিছু বুঝে না। একটা গোলুমোলু বাবু চাই। প্লিজ দে। ‘

শান্ত হাত দিয়ে মাথায় ঘষতে ঘষতেই তানবীরের দিকে কটমট চাহনিতে তাকালো। এই ছেলেটা কোনদিন না জানে তার মাথার সব নাট বল্টু নড়িয়ে ফেলে! অতঃপর কন্ঠে লজ্জা নয় বরং রাগ মিশিয়েই বলল,

— ‘ বাচ্চা কি হাটবাজারে বিক্রি করে? যে আপনি চায়লেই আমি কিনে এনে দিতে পারবো? ‘
— ‘ আরে সেটা তো বলিনি। আমরাই বাচ্চা তৈরির কাজে লেগে যাব। শুধু তুই মেন্টালি এন্ড ফিজিক্যালি প্রিপেয়ার হলেই চলবে। ‘

এবার তাকে আর পায় কে? বেচারা লজ্জায় প্রায় মরিমরি। শান্ত এতক্ষণ চমকিত পর্যায়ে থাকলেও এখন যেন তার দমফেটে হাসি পাচ্ছে। এই ছেলে তাকে আর কতরূপ দেখাবে! এই নরম তো এই গরম। আবার এই বেশরম তো এই লজ্জায় কাদাকাদা।

— ‘ আমি যাই। ‘

বলেই শান্ত এই আপত্তিকর পরিস্থিতি থেকে কেটে পরতে চাইলো। কিন্তু তানবীর আবারও শুরু করলো,

— ‘ প্লিজ একটা বাবু দে না। সাদির মেয়েটা দেখ, কতো নরম-তুলতুলে। আমারও চাই। প্লিজ লক্ষ্মি বউ আমার একটা বাবু দে। ‘
— ‘ আরে কি পাগলামি এসব? বাচ্চা বললেই কি পাওয়া যাবে নাকি? এটা কি হাতের মোয়া? কমপক্ষে একবছর লাগবে। ‘
— ‘ হুম তাও ঠিক। তাহলে চল আজকে থেকেই কাজে লেগে যাই। এমনিতেই একবছর, আবার লেইট মানে প্রডাকশনে আরও লেইট। ‘
— ‘ ইশশ আপনিও না! ‘

শান্ত আর এক সেকেন্ডও দাড়ালো না। প্রায় দৌড়েই হসপিটালের করিডোর পেরিয়ে কেবিনের দিকে চললো। আর তানবীর বেচারাতো নিজের নির্লজ্জতা বজায় রাখার অনশন চালিয়েই যাচ্ছে,

— ‘ আরে লক্ষ্মি বউ, সোনা বউ যাও কই? শুনো না, আমার কিন্তু লাগবেই। চাই মানে চাই। যত দ্রুত সম্ভব। ‘

___________

শাদমানকে গুটিগুটি পায়ে নীলার বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে দেখেই নিধি সর্তক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তাকে বিছানায় উঠার চেষ্টা করতে দেখে নিধি আহতস্বরে বলে উঠল,

— ‘ বাবা উঠে না। খালামণির শরীরে ব্যাথা। ‘
— ‘ খালামণি কষ্ট পাবে না। তাই না? ‘

বলেই সে নীলার মুখের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকালো। নীলা পিচ্চির পাকনামিতে হাসলো। অতঃপর নিধির দিকে তাকিয়ে বলল,

— ‘ কিছু হবে না আপুনি। ওকে আসতে দাও। ‘
— ‘ তুই চুপ থাক। কতটুকু চিনিস এই দুষ্টুকে? এখনই বিছানায় উঠে লাফালাফি শুরু করবে। ‘
— ‘ মা! যারা পঁচা কথা বলে তারা পঁচা। ‘

নিধি চোখ গরম করে তাকালো। অপরদিকে মা-ছেলের দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটিতে সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে। নিধি কন্ঠে খানিকটা রাগ নিয়েই বলল,

— ‘ আর যারা পঁচা কাজ করে তারাও পঁচা। এজ লাইক ইউ। দুষ্টু ছেলে একটা। ‘
— ‘ ওহ্। শাদমান গুড বয়। মাম্মা ব্যাড গার্ল। ‘

পিচ্চির কন্ঠে চূড়ান্ত ভাবের আভাস। আর কথার সুরে ভীষণ ঠেলা। আবারও নিধি চোখ পাকালো। আর নিচুস্বরে বিড়বিড় করল,

— ‘ এই যুগের বাচ্চাগুলো মারাত্মক চালু। ‘

অতঃপর সবার আরেকদফা হাসাহাসির মধ্যে সাদিদ এগিয়ে আসলো৷ আর নিজেই শাদমানকে ধরে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দিলো।

— ‘ বাবা, বেশি নড়াচড়া করে না। চাচি মণি ব্যাথা পাবে। সাথে ছোট্ট বাবুও ব্যাথা পাবে। বুঝেছ? ‘

শাদমান বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়ালো। যেন সে খুব বুঝতে পেরেছে। অতঃপর একদৃষ্টিতে সাদা তোয়ালে দিয়ে মুড়ানো ছোট্ট শরীরটার দিকে তাকালো। অনেকক্ষণ।

— ‘ কি যে দেখতাসে আল্লাহ জানে! এই পোলা এমন কইরা কি দেখস? বাচ্চা মাইয়া নজর লাগবো। চোখ সরা। ‘

শাদমানের এখন তানবীরের সেসব কথার দিকে নজর নেই। সে এখনও একধ্যানে ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। অতঃপর সবার হৃদপিণ্ডের উপর ছোটখাটো একটা টর্নেডো চালিয়ে দিয়ে ছোট্ট পিচ্চিটার গালে আরেকজন পিচ্চি ঠোঁট চেপে ধরল। আর টান দিয়ে নরমস্বরে ডাকলো,

— ‘ বউউউ। ‘

তানবীরের বোধহয় ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যাবার অবস্থা। সে বুকে হাত চেপে ধরেছে। চক্ষুযুগল তার অক্ষিকোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চায়। তার সুঠামদেহী বলিষ্ঠ শরীরটাকে শান্ত কোনোভাবে ধরে আছে। তাদের ন্যায় বাকি সবারও একি অবস্থা। কিন্তু যে সবার উপর দিয়ে এমন একটা ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব চালালো সে পুরোপুরি ভাবলেশহীন। ঠোঁটের কোণে এখনও তার মিষ্টি হাসি ঝুলসে।
কিন্তু আর বাকি সবার মতো আরেকজনের দৃষ্টিও ভিন্ন। তাতে যেন সবার ন্যায় চমকের আভাস নেই। ছোট্ট মুখমণ্ডলে হালকা রাগের আভাস যেন স্পষ্ট ভেসে উঠছে। শাদমান পিচ্চিটার রাগে ফুলে উঠা লাল গালটা হালকা করে টেনে দিতেই এবার যেন সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। নিমিষেই ঠোঁট উল্টে এক পাহাড় সমান অভিযোগ জমিয়ে সে বাবার দিকে তাকালো। যেন নিঃশব্দে বাবার কাছে এই দুষ্টু ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছে। আর জানতে চাচ্ছে এই ছেলেটা এতো পাঁজি কেন? বাবা যেন পাঁজিটাকে বকে দেয়।
সাদিদ মেয়ের মুখপানে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। এমন ফাঁসা বোধহয় সে ইহজীবনে ফাঁসেনি।
পরিস্থিতির এমন দফারফা অবস্থা দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে শাহেদই এগিয়ে আসলো। শাদমানকে কোলে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,

— ‘ ছিঃ বাবা এসব বলে না। বউ না, বনু হয়। ‘
— ‘ না পাপা। বউ বউ। ‘
— ‘ শাদ? ‘

শাহেদের কন্ঠে ঈষৎ ধমকের আভাস। বাবার থেকে ধমক পেয়ে সে অভ্যস্ত নয়। তাই মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে গেল। শাহেদও ছেলের এই চেহারা দেখে ধমে গেল। বুঝানোর জন্য নরমস্বরে আবারও বলল,

— ‘ বাবা, এটা তোমার বনু হয়। তুমি না বলেছিলে একটা বনু চায়। তাইতো তোমার চাচ্চু আর চাচি মণি বনু এনেছে৷ ‘
— ‘ না পাপা এই বনু চাই না। এটা বউ, আমার লক্ষ্মি বউ। ‘

বলেই শাদমান ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে পিচ্চির গালে আবারও ছোট্ট করে চুমু দিলো। অতঃপর ঝড়ের আগাম সংকেত জানিয়ে মেয়ে এতক্ষণের শান্ত-শিষ্টতা ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করলো।
নীলার অবস্থা প্রায় মেয়ের মতোনই কেঁদে দেওয়ার মতন। সে পারছে না দৌড়ে এই বিশ্রী জায়গা ত্যাগ করতে।
শাদমান ছোট্ট পিচ্চির কান্নারত মুখশ্রীতে তাকিয়ে চোখ-মুখ মুহূর্তেই কুঁচকে নিলো। আর বিরক্তিরস্বরে বলল,

— ‘ লক্ষ্মি না, এটা পঁচা বউ৷ ‘

নিধির এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। ছেলেকে জোর পূর্বক বিছানা থেকে নামিয়ে বলল,

— ‘ চুপ আর একটা কথা নয়। সবসময় পাকনামি। ‘
— ‘ নতুবা কি? পাপা যখন কিসি দেয় তুমি বুঝি কান্না করো? আমার পঁচা বউ কান্না করে! ‘

নিধি যেই দম নিয়ে এসেছিল মুহূর্তেই এবার ভেজা বিড়ালে পরিণত হলো। আর সবাইকে না হয় বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু বাবা-মা, শশুর-শাশুড়ির সামনে এসব বললে কেমন লাগে? নিধির কান দিয়ে যেন গরম ধোয়া বের হচ্ছে। শাহেদ কোনোভাবে হাসি চেপে ছেলেকে আরও বোম ফাটানোর পূর্বেই কেবিন রুম থেকে বাহির করতে আসলো,

— ‘ চলো তো বাবা৷ আমরা আইসক্রিম খেয়ে আসি। এসব পঁচা কথা তোমাকে কে বলেছে? ভালো ছেলেরা এসব বলে না। ‘
— ‘ তার মানে তামমবীর চাচ্চু পঁচা? ‘
— ‘ মানে? ‘

এতক্ষণের বাকি সবার ক্লাস নেওয়া দেখে তানবীর আর শান্ত মনে মনে হেসে খুন হচ্ছিল। কিন্তু এবার যেন তাদের আত্মাটা গলায় এসে ঠেকেছে। তারা একে অপরের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো।

— ‘ তামমবীর চাচ্ছুই তো চাচি মাকে বলেছে লক্ষ্মি বউ, সোনা বউ। তারপর কিসি দিয়েছে তারপর বাবু…

তানবীর বোধহয় ঝড়েরবেগে এগিয়ে এসে শাদমানের মুখ চেপে ধরল।

— ‘ আরে শালার ভাতিজা চুপ যা এবার। নামটারই তো জগাখিচুরি কইরা দেস। তাইলে এইগলা কেমনে কস? তুই চল আমার সাথে৷ আজকে তোর একদিন আর আমার সবদিন। ঠোঁটের মধ্যে গ্লু না লাগাইলে একবারেই হইবো না। ‘

শাদমান ছুটবার জন্য অনবরত মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের করছে। কিন্তু তানবীর আর নিজের বেঁচে যাওয়া সামান্য ইজ্জতের দফারফা করতে ইচ্ছুক নয়। তাই বগলদাবা করে পাকনা ছেলেটাকে টেনে রুম থেকে বের করলো।
ছোট্ট মেয়েটার খাবার সময় হয়েছে বিধায় তানবীরদের পিছু পিছু বাকি সবাইও কেবিন থেকে বেড়িয়ে পড়ল। নীলা আর ছোট পিচ্চিটার সাথে থেকে গেল কেবলমাত্র সাদিদ। মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে নীলা সাদিদের মুখপানে তাকালো। অতঃপর এতক্ষণের জমে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেলল,

— ‘ ব্যাপার কি বলুন তো। আপনার এতো চুপচাপ আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। ‘

সাদিদ নীলার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। যেন এই হাসিতে কতো শত রহস্যেরা দানা বাঁধছে। কিন্তু সে মুখ ফুটে উত্তর দিলো না। কেবল মাথা নিচু করে মেয়ের কপালে ছোট্ট করে আদুরে স্পর্শ ছুঁইয়ে দিলো।
বাবার আদর পাওয়া মাত্রই মেয়ে খাওয়া ভুলে সাদিদের দিকে তাকালো। অতঃপর ধীরে ধীরে কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। ইশশ কি যে প্রশান্তি এই হাসিতে! সাদিদের বুকটা খুশিতে যেন নিমিষেই ফুলে উঠল। সে নিচু হয়ে মেয়ের ছোট্ট শরীরটা আলতো করে নিজের বাহুবন্ধনে আগলে নিয়ে বলল,

— ‘ পাপা তার প্রিন্সেসকে ভীষণ ভালোবাসে। ‘

মেয়ে বাবার কথাটার অর্থ ঠিক কতোটা বুঝলো কে জানে? কিন্তু ছোট্ট হাতগুলো নেড়ে বাবার ধূসর বর্ণের শার্টটা আঁকড়ে ধরতে চাইল।
নীলার চোখ বেয়ে অজান্তেই কয়েক ফোঁটা সুখের অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। এই দৃশ্য যেন হাজার বছর ধরে দেখলেও তৃপ্তি মিটবে না।
সাদিদ আচমকা নীলার দিকে তাকাতেই প্রিয়তমার চোখের কার্ণিশে জমা নোনা জলগুলো নজরে পড়ল। কয়েক মিনিট থমকালেও পরবর্তীতে এর কারণটুকু সাদিদ উদঘাটন করতে পারলো। কিন্তু তাকে হাসানোর জন্য দুষ্টুমির স্বরে মেয়ের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ দেখলে প্রিন্সেস, মা কেমন হিংসুটে? তোমাকে আদর দিচ্ছি দেখে মা কান্না করছে। দিবো নাকি, তোমার হিংসুটে মাম্মামকে একটু আদর? ‘
— ‘ ইশশ আমার বয়েই গিয়েছে। আপনারা বাপ বেটি আদর করেন আর গলায় ধরে ঝুলে পড়েন তাতে আমার কি? ‘
— ‘ কিছু না বলছো? ‘
— ‘ অবশ্যই। কোনো সন্দেহ আছে? ‘

নীলা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই সাদিদ নিচুস্বরে হেসে ফেলল। অতঃপর নীলার কাছে এসে আলতো করে অধরে অধরে মিলনরেখা তৈরি করলো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে সরে আসলো। নীলা চমকিত দৃষ্টিতে একবার সাদিদের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকটার বুকের সাথে আগলে থাকা ক্ষুদার্ত মেয়েটার দিকে। সাদিদ তার চাহনির অর্থ বুঝতে পেরে প্রিয়তমার কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিচেল কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ বাকিটা মেয়ে রাতে ঘুমালে পূরণ করে দিব। এখন অবস্থা বুঝে রিক্স নিলাম না। ‘

অতঃপর নরম কানের লতিতে আলতো করে ধারালো দাঁতের কামড় পড়ল। আর নীলা বরাবরের মতোই মুখে একথালা রক্তিম আবির মেখে মাথা নুইয়ে নিলো।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here