অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ ০৮

0
7369

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ০৮

গাজীপুরের বরৈপাড়ার মির্জাপুর ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে নির্মিত, সুবিশাল নান্দনিক রিসোর্টটির সামনে এসে বাস থামতেই সবাই এক এক করে নিচে নামতে লাগল।
কিন্তু বিপওি ঘটল সাদিদকে নিয়ে। তার জন্য নীলা নিচে নামতে পারছে না।
নামবে কিভাবে? সাদিদ যে বাসের সিটে হেলান দিয়ে গভীর ঘুম দিয়েছে। সকাল সকাল বেরিয়েও ঢাকার অসহ্যকর জ্যামে তাদেরকে আটকা পরতে হয়েছে। তাই অনেকটা সময় লেগে গিয়েছে। আর টঙ্গীর জ্যামে পরে তো সাদিদ ঘুমিয়েই পরেছে। অবশ্য নীলা মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিল৷ কেননা সাদিদের পাশে থাকতে তার ভীষণ লজ্জা-অস্বস্তি লাগছিল। তাই সাদিদ ঘুমিয়ে পরবার পর নীলা মোটামোটি হাঁফ ছেড়েছে।
কিন্তু এরমধ্যে সে বেহায়ার মতো একটা কাজ করে বসেছে। সে এতক্ষণ সাদিদের ঘুমন্ত মুখটাই একদৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গিয়েছে। সজাগকালে ইচ্ছা থাকলেও নীলার এই চোখের দিকে তাকাতে পারে না। তাই ঘুমের মধ্যে একপ্রকার এডভান্টেজ নিয়েছে। বলতে গেলে লুকিয়ে ভালোবাসার মানুষকে প্রাণভরে দেখার এডভান্টেজ।
কিন্তু এখন যে দেখার স্বাদ মিটে যাচ্ছে। কেননা সবাই ইতিমধ্যে বাস থেকে নেমে গিয়েছে। বাসে কেবলমাত্র সে এবং সাদিদ রয়ে গেছে। পিছনে বসার কারণে তাদেরকে কেউ ভালোভাবে খেয়াল করেনি।
নীলা এবার ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ” বাব্বাহ্ এত ঘুম! সবাই নেমে যাওয়ার এত আওয়াজেও মহারাজের ঘুম ভাঙেনি! ”

সাদিদ এবার নড়েচড়ে একেবারে নীলার পাশে মুখ করে বসল। সাদিদের তপ্ত নিঃশ্বাসগুলো নীলার মুখে এসে লাগতেই, নীলা আবারও শিউরে উঠল।
কি যে আছে এই স্পর্শতে, নীলার সর্বাগ্র পুরো কেঁপে উঠে।
নীলা এবার একটু এগিয়ে আসলো। তার অবুঝ মনটা এইমুহূর্তে ভয়ানক কিছু কাজ করে ফেলতে তার উপর জোর খাটাচ্ছে। সে নিজের মাথায় চাপড় বসাল।

— ” নীলা, শয়তানটা মাথা থেকে দূর কর। সে তোর কেউ না। ”

নিচুস্বরে কথাটা বলেই নীলা একপলক সাদিদের ঘুমন্ত মুখটার দিকে আবারও তাকালো। মুহূর্তেই তার চোখজোড়া ম্লান হলো।
নিজেকে সামলাতে সে এবার উঠে দাঁড়াল।
ইচ্ছা হলো সাদিদকে টপকে সিট থেকে বের হয়ে যাবে। তাই সাদিদের পায়ের সাইড দিয়ে পা রেখে বের হবার সময়ই, সাদিদ আচমকা নড়ে উঠল। এবং সাদিদের পায়ের সাথে লেগে গিয়ে, ব্যালেন্স হারিয়ে নীলা গিয়ে সোজা সাদিদের উপর পড়ল।

নীলা চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। তার একহাত দিয়ে সাদিদের বুকের ট্রি-শার্ট খামচে ধরা।
নীলা চোখ খোলার বিন্দুমাত্র সাহস করতে পারছে না। কেননা সাদিদের গরম নিঃশ্বাসগুলো এসে নীলার চোখে-মুখে উপচে পরছে।
আর অপরদিকে নীলা এতই জোরে পরেছে যে সাদিদ সাথে সাথেই তাকে আগলে নিয়েছে। বিন্দুমাত্র ব্যাথা পেতে দেয়নি।
সাদিদের দৃষ্টি পুরোপুরি স্থির। নীলার কোমড়ে রাখা ডান হাতটা একটু জোরে চেপে ধরতেই, নীলা সাদিদের সাথে আরও মিশে গিয়ে তার ট্রি-শার্ট খামচে ধরল।
ভয়ার্ত চোখে সাদিদের দিকে তাকাতেই দুইজনের দৃষ্টি মিলিত হলো।
কিন্তু বোকার মত এতক্ষণ কি করছিল মাথায় আসতেই নীলা দ্রুত সরে আসতে চায়ল। কিন্তু সাদিদ না ছেড়ে আরেকটু শক্তভাবে আগলে ধরল।

— ” কি করছেন আপনি? ”

— ” একজ্যাক্টলি? আমার সিট, আমার কোল ইনফ্যাক্ট হেড টু টো সবটাই আমার। তাহলে তুমি এখানে কি করছ? ”

নীলা এবার ফেঁসে গেল। পরিস্থিতি সামলাতে চাইছিল সাদিদের দিকে তীরটা ছুঁড়ে দিতে। কিন্তু সাদিদ একেবারে জায়গা মতো প্রশ্ন করেছে।
নীলা দ্রুত সাদিদের থেকে সরে আসতে চায়লে সাদিদ আবারও তাকে আটকে নিলো।

— ” প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। ”

— ” কি হচ্ছে এটা? ছাড়ুন আমাকে। ”

— ” আন্সার মাই কোয়েশ্চেন ফাস্ট, দ্যান গো হুয়াটএবার ইউ উইশ। ”

— ” আ..সলে আ..মি ইচ্ছা করে বসিনি। যাওয়ার সময় আপনার পায়ে লেগে পড়ে গি..য়েছি। ”

সাদিদ এবার নীলাকে আস্তে করে ছেড়ে দিলো। ছাড়া পেতেই নীলা দৌড়ে নিচে নামল। কি একটা পরিস্থিতিতে ফেঁসেছিল ভাবতেই তার বুক ধুকপুক করছে।
অপরদিকে সাদিদের মুখে রহস্যময় হাসি। নীলার পিছু পিছু সেও মাথা চুলকে নিচে নেমে গেল।

রিসোর্ট দেখে সবারই ক্লান্তি দূর হলো। অসাধারণ সুন্দর সুইমিংপুল, ইউরোপিয়ান ডিজাইনের কটেজ, সবুজে ঘেরা পরিবেশ এবং সবরকম আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন এই রিসোর্ট টি সত্যিই মুগ্ধকর। ঢাকার মধ্যে এমন একটা রিসোর্ট ক্লান্ত শহরের জীবনের ব্যস্ততাগুলো ভুলিয়ে দিতে সক্ষম। হাতে আছে অল্প সময়, আর একটু নিরিবিলি পরিবেশে রিলাক্সের জন্য অবশ্যই আসা যায়।

— ” সাদিদ বাবা, সত্যিই রিসোর্টের পরিবেশটা খুব সুন্দর। ”

— ” থ্যাংক ইউ আঙ্কেল। একচুয়ালি এইজন্যই আমরা শেয়ারগুলো কিনতে চেয়েছি। ঢাকার আশেপাশে রিলাক্স এর জন্য ভাউয়াল রিসোর্টটা আমার পছন্দের তালিকায়। তাই যখন অফারটা পেলাম আমরাও এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। ”

— ” সেটা না হয় বুঝতে পারলাম। কিন্তু এইসবের চক্করে যদি তুই আমার অফিসে না বসিস, তাহলে তোর রক্ষা নেই। ”

সাদিদ মাথা নিচু করে হাসল। হাসিমুখেই হাসিবুর রহমানের উদ্দেশ্য বলল,

— ” বাবা আই প্রমিজড ইউ। তাই যতই বিজি থাকি না কেন অবশ্যই অফিসের জন্য সময় বের করব। ”

হাসিবুর রহমান ছেলের কথায় খুশি হলেন কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। সবাই জার্নি করে এসে ফ্রেস হতে চলে গেল।
সাদিদরা তাদের থাকার জন্য তিনটে এক বেড রুমের ভিলা, এবং দুইটি দুই বেডরুমের সুইট নিয়েছে।
নীলা, শান্ত আর প্রিয়তী তিন যুবতী দুই বেডের এক ভিলাতে নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির। শান্ত নরম তুলতুলে বিছানায় গা এলিয়ে বলে উঠল,

— ” দোস্ত বলতেই হচ্ছে সাদিদ জি. না মনে ভাইয়ার জবাব নেই। লা জবাব চুম্বন পুরুষ। ”

— ” চুম্বন পুরুষ! এটা আবার কি নাম সম্বোধন শান্ত? ”

শান্ত কুটিল হাসছে৷ অপরদিকে নীলার চোখ-মুখ গরম। এই বাচাল মেয়েকে তিনবেলা খাবারের মত নিয়ম করে পেদানু দরকার।

— ” প্রিয়তী আপু না দিদিভাই বলব? ”

— ” একটা বললেই হলো। সবকিছুতেই আমি কম্ফোর্টেবল। ”

— ” ওকে দ্যান দিদিভাই। আপুতো অনেককেই ডাকলাম। তোমাকে না হয় দিদিভাই ডাকলাম। ”

প্রিয়তী হাসল। মেয়েটা খুবই মিশুক, আর ভীষণ পাঁজিও।

— ” সো দিদিভাই ঘটনা হচ্ছে সাদিদ ভাইয়াকে দেখলে বা উনার কথা শুনলেই, আমার এক ঐতিহাসিক চুম্বন দৃশ্যর কথা মনে পড়ে। অবশ্য দৃশ্যটা আমি স্বচোখে দেখতে পারিনি। তাই একগাদা আফসোস রয়ে গেল। ”

— ” মানে? সাদিদ আর চুমু! আমিতো হিসাবটা ঠিক মিলাতে পারছি না। ”

— ” আরে আপু তুমিও না। শান্ত একটা পাগল। কোন নায়কের সাথে কোন এঙ্গেল মিলে গেল আর সেও তার অদ্ভুত না রেখে বসল। ”

প্রিয়তী ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। নীলার চোখে-মুখে ভয়, অপরদিকে শান্ত হাসছে। বিষয়টা যতটা নীলা স্বাভাবিক দেখাতে চায়ছে তার কাছে ততটাই গড়মিলে মনে হচ্ছে। নীলা এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে চাই। তাই ঝাপটে গিয়ে প্রিয়তীকে ধরল।

— ” আমিও দিদিভাই ডাকি? ডাকতে খুব ইচ্ছে করছে। ”

প্রিয়তী গলে গেল। তার বোন নেই। তিনভাইয়ের ছোট বোন। তাই এত অল্প সময়ের মধ্যে দুটো বোন পেয়ে তার চোখে-মুখে আকাশের চাঁদ পাওয়ার খুশি।
দরজায় করাঘাত হলো।
নীলা সামনে ছিল বিধায় দরজা খোলে দিলো। সাদিদ দাড়ানো, হাতে নীলার লাল রঙের ছোট্ট হাত ব্যাগটা। কিছু গল্পের বই আর একটা ডাইরি। আর কিছু হয়তো খোঁজে পাওয়া যাবে না।

— ” এইটা তোমার? ”

— ” জ্বি আমার-ই। ধন্যবাদ আপনাকে, গাড়িতে ছিল হয়তো আমি খেয়াল করিনি। ”

— ” ইট’স ওকে। ”

সাদিদ ব্যাগটা নীলার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়েও রুমের দিকে উঁকি দিলো। শান্ত-প্রিয়তী নিজেদের কাজে ব্যস্ত।
নীলা ব্যাগটা নিতে চাইলেও নিতে পারছে না। কেননা সাদিদ শক্ত হাতে ধরে রয়েছে। নীলা কিছুটা অবাক চাহনিতে সাদিদের দিকে তাকাতেই সে নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি? নট ব্যাড। ছবিটা দেখেছিলে নাকি? ”

নীলার হাত কাঁপতে লাগল। সাদিদ এমন প্রশ্ন করছে কেন? নীলা এর কি উত্তর দিবে?
সাদিদ আরেক কদম এগিয়ে আসলো। নীলার কানের কাছে মুখ নিয়ে আরও নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ” বয়সতো খুব বেশি না। তবুও ছবির লিড ক্যারেক্টারের ন্যায় শাড়ি পড়লে মন্দ হয় না। কিন্তু আরেকটু নাদুসনুদুস হলে ভালো ফুটত। কিন্তু তারপরও চোখজোড়া এই শুকনো সৌন্দর্য-ই অবলোকন করতে চায়। তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষামান। ”

সাদিদ চলে গেল। নীলার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। তার চোখের পাতা দ্রুত উঠানামা করছে। মুখ-ঠোঁট কাঁপছে, সমস্ত শরীর মৃদু কাঁপছে।
এসব কি? সাদিদ তাকে কি বুঝিয়ে গেল? নীলাতো কিছুই বুঝতে পারল না! রহস্য রহস্য কেবলমাত্র রহস্য! এই ছেলেটাই আস্ত একটা রহস্যের গোডাউন।

— ” এই কি হয়েছে তোর? এমন গাছের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে তো নাকি? দেখিতো কাছে আয়। ”

— ” দোস্ত শরীর কাঁপছে। ”

— ” তোকে আবার কবে থেকে হাঁপানি রোগে ধরছে? আর কার সাথে কথা বলছিলি? কে আসছিল? ”

— ” উনি। ”

— ” উনিটা আবার কে… ওহ্ তাই বল। দোস্ত শুধু হাঁপানি রোগ দেখে বিস্মিত হলাম। ম্যালেরিয়া, ল্যাভেরিয়া আরও ভয়ানক কিছু-টিছু হলে স্বাভাবিক হতো। ”

নীলা হাতের ব্যাগ নিয়ে শান্তকে মার শুরু করল।

— ” আরে আমাকে মারিস কেন? তোমার উনার সামনে তো ঢাকা মেডিকেলের হাঁপানি রুগী হয়ে যাস। ”

— ” আরে নীলা থাম, কি করছ তোমরা? আর শান্তকে এমন মারার কারণ কি! আরে থাম না। ”

— ” দিদিভাই আটকিও না। এই ফাজিল মেয়েটাকে আজ আকাশের চাঁদ দেখিয়ে ছাড়ব। ”

— ” দোস্ত আজ মেবি আমাবস্যা। ইচ্ছে পূরণে বিগ্ন ঘটল। ”

নীলার অসহায়ত্বের পরিমাণ দ্বিগুণ হলো। তার সাথে পাল্লা দিয়ে রাগও তরতর করে বাড়ল। অবশেষে শান্তর একচুট গুষ্টি উদ্ধার করে সে ক্ষান্ত হলো।

___________________

সবাই হালকা ফ্রেস হয়ে ভিলা থেকে বেরিয়ে আসলো। সকালে ভালোভাবে নাস্তা করা হয়নি, তাই এখন টুকটাক নাস্তা এবং কফি খাওয়ার জন্য সবাই এখানে একত্রিত হয়েছে।
নীলা ফ্রেস হয়ে হলাকা সবুজ আর সাদা মিশেলে একটা কুর্তি তার সাথে লেডিস জিন্স পরেছে। গলায় ফ্লোরাল একটা স্কাফ।
সাদিদ তার আগেই এসেছিল। তাই নীলাকে আসতে দেখে এবার সেদিকে দৃষ্টি স্থির করল। খুবই সাধারণ পোশাক। মুখে নেই কোনো কৃত্রিমতার ছাপ। তারপরও সাদিদের চোখে মুগ্ধতা।
তারা তিনজনে এসে চেয়ার ঠেলে টেবিলে বসল। প্রিয়তীকে অর্ণবের পাশে বসতে দেখেই তানবীরের ভ্রু কুঁচকে এলো। অর্ণবের বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে হালকা রাগের আভাসে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ” অত ঘেঁষাঘেষির কি আছে? হেতিই কি দুনিয়ার একমাত্র গার্লফ্রেন্ড নাকি? আর বাকিসব মাইয়ারা কি পুলা হইয়া গেছে? ”

— ” মুখ সামলা তানবীর। ”

— ” তোমাদের এমন রঙচঙ দেখলে আমার মুখ অটোমেটিক দৌড়াদৌড়ি করে। ”

— ” সেটআপ ইডিয়ট। ”

— ” ইংরেজি কইলে ওষ্ঠা মাইরা সামনের পানিতে ফালাই দিমু। ”

— ” ওহে মোর প্রিয় দোস্ত, ওহ্ শুদ্ধ বাংলাতে আই থিংক বন্ধু। ওহে মোর প্রিয় বন্ধু। আমাকে ক্ষমা করো, ভুলত্রুতি মার্জনা করো। ”

তানবীর নিভল। খাবার খেতে চামচ হাতে নিলো। কিন্তু কপাল কুঁচকে ডিল মেরে দূরে ফেলল। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখে ঈষৎ লালচে ভাব নিয়ে, সে মুখে পরোটা পুরে চিবুতে লাগল।
সাদিদ পাশেই ছিল। তানবীরের পিঠে আলতো করে হাত রাখল। তানবীর ফিরে সাদিদের চোখে চোখ রাখতেই দ্রুত সে দৃষ্টি সরালো। চোখ-টখ কচলে অবস্থা খারাপ। ভাবটা এমন যে চোখে পোকা পরেছে। সাদিদ বুঝেও কিছু বলল না।

— ” পাপা সুইমিং। ”

— ” তুমি পারবে? যদি মুখে-কানে পানি ডুকে? ”

— ” পাপা গোসল। ”

শাহেদ-নিধি হাসল। শাদ যখন কিছু নিয়ে কনভিন্স করতে চায়, তখন বাংলাতে বললে না মানলে রিপিট করে ইংরেজিতে বলে। আবার অনেকসময় ইংরেজি টু বাংলাও বলে।

— ” হ্যাঁ জিজু। আমিও যাব। এত সুন্দর সুইমিংপুল সামনে, অথচ এখনও বসে আছি। ভাবতেই আমার মন খারাপ হচ্ছে। ”

— ” আগে নাস্তাটা শেষ করো। তারপর আমরা সবাই যাব। ”

নীলা খুশি হলো। পানি তার বরাবরই পছন্দ। ছোটবেলায় সময়ে-অসময়ে পানিতে যাওয়ার জন্য সে মায়ের হাতে অগণিত মার খেয়েছে।
সাদিদ কফিতে চুমুক দিয়ে নীলার হাসিমুখটা দেখছে। হঠাৎ নীলার দৃষ্টি সাদিদের দিকে পরতেই তার মুখের হাসিভাবটা মিলিয়ে যেতে লাগল। সাদিদের চোখগুলো নীলাকে ইদানিং খুবই বিরক্ত করছে। চোখের ভাষা বুঝে না। আবার ঐ নেশালো আঁখির অর্থও বুঝে না তাই বিরক্তির পরিমাণটা আরও দ্বিগুণ।

নাস্তার পর সবই রিসোর্টের সুইমিংপুলে এসেছে। কিন্তু কেউ-ই সুইমিং সুট পরেনি। উপস্থিত সবাই ফ্যামিলি মেমবার তারউপর বড়রা আছে। আর বাঙালি হিসেবে সুইমিং সুট মানেই চক্ষু ছানাবড়ার জিনিস। তাই সবাই সামঞ্জস্য মেনেই সুইমিং এর জন্য কাপড় বাছাই করেছে।
নীলার চোখগুলো শুধু এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি করছে। তানবীর-অর্ণব আরও আগেই চলে এসেছে। তাহলে সে এখনও কি করছে এইটাই নীলার মাথায় আসছে না।

— ” গোসল করতে আসলেও কি তার বাবু সেজে আসতে হয় নাকি? ”

পরমুহূর্তেই নীলা নিজেকেই ধমকাল। লোকে বলে প্রেম ভালোবাসায় মানুষ গাধা হয়ে যায়। নীলার মনে হচ্ছে নীলা গাধার চেয়েও নূন্যতমানের বস্তুগত জিনিসে রূপান্তরিত হচ্ছে।
সাদিদকে সে চায় না। অথচ ঘুরেফিরে সে সাদিদকেই সবসময় চায়। কি অদ্ভুত!

সাদিদ আসলো। নীলার চোখগুলো মুহূর্তেই বড় হলো। ইশশ কে বলল মেয়েরা শুধু ক্রাশ খায়?
ডাহা মিথ্যা কথা। এটা বলা মানে মেয়েদের ছোটখাটো অপমান করা।
নীলা বলতে ইচ্ছে করছে এমন কেউ সামনে থাকলে আরও বহুত কিছু অনায়াসেই খাওয়া যায়। পানিছাড়াও গাপুসগুপুস এসব জিনিস মুহূর্তেই খেয়ে ফেলে ঢেকুর তুলা যায়। তাই এইমুহূর্তে ক্রাশ শব্দটা নীলার কাছে নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।

থ্রি-কোয়ার্টার ব্রাউন পেন্ট, চোখে রৌদ চশমা লাগিয়ে, সাদিদ নীলার ভাষ্যমতে বাবু সেজে বেরিয়েছে। নীলার এইমুহূর্তে খুব লজ্জাজনক একটা ব্যাপার অনুভব হচ্ছে।
সাদিদের উন্মুক্ত বুকটা দেখতে নীলার বড্ড ইচ্ছা করছে। কিন্তু সাদিদ আকাশি রঙের একটা হাতা ছাড়া ট্রি-শার্ট পরে রয়েছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভীষণ আনন্দও লাগছে। কেননা আশেপাশে অনেক সুন্দরী রমণীদের মিলনমেলা। এবং নীলা মরে গেলেও চাইবে না সাদিদ তাদের সামনে খালি বুকে আসুক। নীলার মুখের মৃদু হাসি বিস্তৃত হলো। সাদিদ এগিয়ে এসে পানিতে ঝাপ দিলো। শরীরের হাতা ছাড়া জামাটা এবার গায়ে পুরো লেপ্টে গিয়েছে। যার জন্য বলিষ্ঠ শরীর আর বাহুর সুগঠিত মাসলগুলো আরও দৃশ্যমান।
নীলার মনে হচ্ছে কেউ তাকে নেশাজাতীয় কিছু খাইয়ে দিয়েছে। নতুবা নিজেকে এমন নেশাখোরের মত মনে হচ্ছে কেন?

অপরদিকে নীলা যতই লুকিয়ে-চুরিয়ে সাদিদকে দেখুক না কেন, সাদিদ সবটাই বিচক্ষণতার সহিত অবলোকন করে।
এবারও পূর্বের ন্যায় সেটা বাদ যায়নি। সাদিদ ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসল।

— ” আউচ। ”

তানবীর সাতরিয়ে আসতেই শান্তর সাথে ধাক্কা খেল। শান্ত তাল সামলাতে না পেরে ডুব দিয়ে পানি খেল। নাকেমুখে পানি ডুকে তার কাশি আসছে। শান্ত বার কয়েক শুকনো কেশে নিয়ে রাগীস্বরে বলল,

— ” সমস্যা কি? পানি দেখে কি বেহুশ হয়ে গিয়েছেন নাকি? ”

— ” সরি টু সে বাট তুমি এতটাই বেটু, আর পানির নিচে শরীরের অর্ধেকটা থাকায় তোমাকে আমি দেখতেই পাইনি। ”

— ” বেটু? ”

— ” লজ্জা! লজ্জা! তুমি দেখি বাংলাতেও দুর্বল। বেটু মিনস্ শর্ট। ইন গেঁয়ো বাইট্টা। আরও গেঁয়ো চূড়ান্ত বাইট্টা। ”

— ” আপনি.. আপনি একটা বিরক্তিকর মানুষ। ”

— ” আই নো। যারা বিরক্তিকর, তাদের সবকিছুই বিরক্তিকর বলে মনে হয়। ”

— ” সরুন বলছি। এত গায়ে পরা স্বভাব কেন? ”

— ” কই তোমার গায়ে পড়লাম! আমি পরলে তুমি বুঝি আস্ত থাকবে? ”

— ” এতক্ষনে ভালো একটা কথা বলেছেন। ভাল্লুক গায়ে পরলে মানুষ আস্ত থাকে না। পিষে যায়। আর আমিও ভাল্লুকের ধাক্কায় পিষে গিয়েছি। ”

শান্ত ভেজা চুলগুলো একহাতে সরিয়ে দিয়ে নীলাদের পাশে গেল।
তানবীর ডানহাতে চোখ-মুখের পানি মুছল। শান্তর চুলের ছিটা সব এসে তার মুখের মধ্যে পরেছে।

— ” অভদ্র মেয়ে একটা। তুই ভাল্লুক, বেয়াদব মহিলা ভাল্লুক। ”

_________________

আচমকা হাতে টান পরতে নীলার ভয় পেল। ভয় প্রকাশ করবার আগেই সে পানিতে ডুব দিলো। এবং কিছু বুঝবার আগেই কেউ তাকে কোলে তুলল।

— ” আপনি? ”

তখন সবাই পানিতে বেশ মজা করছিল। ছোট-বড় সবাই আনন্দে সামিল। ছোট্ট শাদমানও পিছিয়ে নেই। সুইমিং জ্যাকেট পরে সবার সাথে সামিল। শান্ত-নীলা সুইমিংপুল পেয়ে পানিতেই বাচ্চাদের মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছিল। এতবড় সুইমিংপুলে নীলা কখনও আসেনি। তাই আনন্দ-উচ্ছাস দ্বিগুন। তারা দুষ্টুমি করতে করতে এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছিল। আশেপাশে যে আরও মানুষজনের আনাগোনা আছে সেদিকে তাদের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।
সাতরানোর মধ্যেই হঠাৎ করে এমনটা হয়ে গেল। কিছু বুঝে উঠার আগেই নীলার বাঘের গর্তে পা দেওয়া হলো।
পানিতে ডুবে পানি খেয়েছে, তাই নীলা কাশতে কাশতে আবারও বলল,

— ” আপনি? ”

সাদিদ উত্তর দিলো না। নীলাকে কোলে নিয়েই তাদের রুমে আসলো। আশেপাশে রিসোর্টের স্টাফরা ছিল। বাহিরের কিছু গেস্টরাও উপস্থিত। কিন্তু সাদিদ এসবে পাত্তা দিলো না।
রুমে নিয়ে এসে নীলাকে কোলে নিয়েই দরজা বন্ধ করল। কোল থেকে নামিয়ে রক্তলাল চোখে বলে উঠল,

— ” ড্রেস চেইঞ্জ করো। ”

নীলার এতক্ষণের অবাকের মাত্রা যেন কম ছিল। তাই সাদিদ এই কথা বলে পূর্ণ করছে।

— ” আই সেইড রাইট নাও চেইঞ্জ ইউর ক্লথ। ”

নীলা কেঁপে উঠে কয়েককদম পিছিয়ে গেল। সে এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। না সাদিদের এমন ব্যবহার না বর্তমান পরিস্থিতি।
নীলাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদিদ দ্রুত এসে ডার দুইবাহু চেপে ধরল। পিছনের দেয়ালে নীলাকে ঠেকিয়ে রাগীস্বরে আবারও বলল,

— ” নীলাঅঞ্জনা ইউ হেভ অনলি টু মিনিটস্। ইন টু মিনিস্ চেইঞ্জ ইট কুইকলি। আদারওয়াইজ আই ইউল ডু দ্য প্রিভিয়াস ওয়ার্ক। ”

বলেই সাদিদ নীলাকে মৃদু ধাক্কা দিলো। নীলার বলার আর কোনো ভাষা নেই। সে বিনাবাক্য কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে ট্রলি ব্যাগ খোলল। একটা সাদা-কালো রঙের চুড়িদার জামা নিয়ে দ্রুত পা বাড়িয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল।

সাদিদ অনবরত জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। রাগে তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সবকটাকো এইমুহূর্তেই ধরে পিষে ফেলতে।
কিন্তু এখন মাথা গরম করে কিছু করা মানেই ফ্যামিলির সবার টেনশন। তারউপর নানারকম বাড়তি ঝামেলা।
কিন্তু নিজেকেও যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাইতো নীলাকে এভাবে নিয়ে এসেছে। নতুবা সেখানেই ছেলেগুলো সে আধা মরা করে ফেলত।

— ” বাস্ট… হাউ ডেয়ার দে.. ”

সাদিদ জোরে লাথি দিয়ে সামনের টুলটা দূরে ফেলল। ভিতরকার রাগটা কোনোভাবেই কমাতে পারছে না।
সুইমিংপুলে অনেকেই উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে একটা মাঝবয়সী বয়েস গ্রুপও ছিল। নীলা যথেষ্ট মার্জিত পোশাক পরে থাকলেও, কয়েকটা ছেলে বারবারই খারাপ নজরে তার ভেজা শরীরের দিকে তাকাচ্ছিল। সাদিদতো সবসময় নীলাকেই দেখতে ব্যস্ত। তাই ছেলেগুলোর চোখের বিশ্রি দৃষ্টি সাদিদের চোখের আড়াল হয়নি। তাই নীলাকে এমন হন্তদন্ত হয়ে রুমে নিয়ে আসা।
নীলাকে হয়তো বললেও সমস্যা সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সাদিদের কি এসবে নজর আছে? রাগ যে তার আকাশছোঁয়া।
দরজার আওয়াজে সাদিদ রক্তচক্ষু নিয়েই পিছন ফিরল।
মুহূর্তেই তার রাগ কমে গেল। শরীর শীতল হলো। চোখে-মুখে নেমে আসলো সীমাহীন মুগ্ধতা।
সাদিদ ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
নীলা সাদিদকে এখনও ভীষণ ভয় পাচ্ছে। সে তো তখনকার সাদিদের ওমন রাগের কারণটা-ই ধরতে পারছে না।
নীলা সকালের পর থেকে সাদিদের সাথে একটাও কথা বলেনি। তাহলে এত রাগের কারণটা কি?
সাদিদ একেবারে নীলার সামনে এসে দাঁড়াল। নীলা মাথা নিচু করে আছে। শরীর এখনও তার মৃদু কাঁপছে।

সাদিদ নীলার গালে হাত রাখল। নীলা চমকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই সাদিদ অপর হাতটাও নীলার গালে রাখল।
নীলার মুখটা আঁজলভরে ধরে সে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
অপরদিকে নীলা ভয়ার্ত চোখে শুকনো ঢুক গিলছে। সাদিদ কি করতে চাইছে?
সাদিদ নিজের মুখটা এগিয়ে নিলো। নীলার বড়বড় করে রাখা চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হাসল।
তারপর কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিলো। নীলার চোখজোড়া অটোমেটিকলি বন্ধ হয়ে গেল। শরীরে রক্তের প্রবাহমান গতি বেড়ে গেল। হৃদস্পন্দন দ্রুত হলো।
সাদিদ দীর্ঘ চুম্বন শেষে নীলার কপাল থেকে মুখ সরিয়ে আনল। তার নিঃশ্বাসের ঘন শব্দ স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। নীলার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ” আ’ম সরি, বাট নট ফর দিস কিস। আ’ম সরি ফর মাই এংগ্যর। ”

সাদিদ নীলার কপাল থেকে কপাল সরিয়ে আনলো। নীলা এখনও চোখ বন্ধ করে থরথর করে কাঁপছে।
সাদিদ আবারও নীলার কপালে ছোট্ট করে চুমু খেল। মুখ থেকে হাত সরিয়ে এক কদম পিছিয়ে বলে উঠল,

— ” বাহিরে আসতে হবে না। চুপচাপ রুমে বসো। আমি গিয়ে সবাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”

বাহির থেকে দরজা বন্ধের আওয়াজে নীলা এবার চোখ উঠিয়ে তাকালো। সাদিদ চলে গেছে। কিন্তু রেখে গেছে নিজের হৃদস্পন্দন বন্ধকারী স্পর্শ।
নীলা কাঁপা হাতে নিজের কপাল ছুঁয়ে দিলো। শরীরটা যেন আবারও শিরশির করে উঠল।

#চলবে…

[ পাঠকগণ আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো জানতে আগ্রহী। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here