অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৭৬

0
4902

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৭৬ ❤(শেষ পর্ব)

প্রথম অংশ__

সিঁদুর লাল জমকালো বেনারসি শাড়িতে সোনালী কারুকার্য। সম্পূর্ণ অংশে যার চোখ ধাঁধানো আভিজাত্যের ছোঁয়া। ভীষণ আদুরে, ভীষণ আবেগ জড়ানো বছর খানেক পূর্বে তৈরিকৃত বিয়ের পোশাকটা গায়ে জড়াতেই নীলার কাজলকালো চোখগুলোতে অশ্রুকণারা এসে উঁকি দিলো। বহুত সময় নিয়ে দেওয়া চোখের কাজলটা হালকা লেপ্টে যেতেই পাশ থেকে নিধির ধমক শুনা গেল।

— ‘ এটা কিছু হলো? এতো কষ্ট করে সাজিয়ে-টাজিয়ে কান্নাকাটি করার কি মানে পিচ্চু? আর কান্না করবিই বা কি জন্য? এটা কি তোদের প্রথম বিয়ে নাকি! ‘

নীলা মুহূর্তেই টিস্যু পেপার দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নিলো। সে কিভাবে বুঝাবে তার এখন কেমন অনুভূতি হচ্ছে? সব অনুভূতি যে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। কিছু অনুভূতি একান্তই নিজস্ব। তাদের কথোপকথনের মধ্যেই সাদিদের কাজিন সিস্টার অনামিকার হঠাৎ আধ খোলা দরজাটার দিকে নজর যেতেই সে একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠলো,

— ‘ তুই এখানে কি করিস? দেখো ভাবী, ভাইয়া এখানে দাড়িয়ে আমাদের কথা শুনছে! ‘

অনামিকার কথা শুনে সবগুলো মেয়েলী চোখ মুহূর্তেই দরজার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।
সাদিদকে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিধি তাকেও একদফা ধমক লাগানো,

— ‘ এসব কি সাদিদ! তুমি এখানে কেন? জানো না এই মুহূর্তে তোমার এখানে আসা নিষেধ? এখনি বের হও। ‘
— ‘ মাই ডিয়ার সুইট ভাবীমণি রুমটা যেহেতু আমার সেহেতু প্রয়োজনে আসতেই তো পারি। আর এটা কিন্তু যেমন তেমন প্রয়োজন নয়, একেবারে শ্বাস আটকে থাকার মতো প্রয়োজন। সুতরাং প্রয়োজন না মিটলে অঘটন ঘটবার পরিপূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সময় থাকতে প্রয়োজনটা মিটিয়ে নেওয়া উচিত নয় কি? ‘

সাদিদ কথা বলছে আর আড়চোখে বারবার নীলার দিকেই তাকাচ্ছে। বিষয়টা নীলাসহ কারোরই নজর এড়ালো না। তাই কাকে ইন্ডিকেট করে কথাগুলো বলা হয়েছে উপস্থিত কারো আর বুঝার বাকি নেই। তাই সাদিদের পিন্চ কাটাটা বাদ গেল না।

— ‘ হ্যাঁ সেটাতো দেখতেই পারছি কি প্রয়োজন। তা দেবর সাহেব আপাতত প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে না। আপনি এখন যেতে পারেন। ‘
— ‘ দেবরের পূর্বে কিন্তু ভাই হয়। ভাইয়ের সাথে এতোবড় নাইনসাফি করতে পারবে? ‘
— ‘ এসব কিছু বুঝতে চাই না। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে কাজ হবে না। জলদি বের হও। ‘

সাদিদ আরও একবার মুখ নিচে নামিয়ে রাখা ব্যক্তিগত লজ্জাবতী লাজুকলতার দিকে তাকালো। অতঃপর হার না মানা স্বরে চরম নির্লজ্জতার পরিচয় দিলো।

— ‘ ওকে। ঠিক আছে তাহলে। তোমরা যেহেতু নিজেদের কথা থেকে সরে আসবে না তাই আমার প্রয়োজন আমাকেই দেখতে হবে। সুতরাং আমি আমার বউকে নিয়ে গেলাম। নিজস্ব মানসম্মান বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে নিজ দায়িত্বে চোখ বন্ধ করতে পারো। পরে আমাকে বলো না যেন, যে আমি সর্তক করিনি। ‘

বলেই সাদিদ এগিয়ে এসে সবার সামনেই নীলাকে কোলে তুলতে গেলে সবাই একপ্রকার চোখে হাত দিয়ে চিল্লিয়ে উঠল।

— ‘ আরে থাম ভাই থাম। তোর না হয় একেবারেই লাজশরম নাই তাই বলে কি আমাদেরও লজ্জা নাই নাকি? ‘
— ‘ ওহ্ তাই নাকি! তাহলে এতোই যখন লজ্জার ভয় তাহলে এসব বিষয়ে নাক গলাতে আসো কেন? ‘

নিধি এগিয়ে এসে আলতো করে সাদিদের কানটা টেনে ধরলো।

— ‘ ইশশ ভাবীমণি লাগে তো। ‘
— ‘ পাঁজি একটা! লাগার জন্যই ধরেছি। মেয়ের বাবা হয়ে গেল অথচ দুষ্টুমি কমে না। ‘
— ‘ এটার সাথে মেয়ের কি সম্পর্ক? তাছাড়া হিসেব মতো তো পদবি বৃদ্ধির সাথে সাথে সবকিছুই বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। আই মিন টু সে সবকিছু। তুমি জ্ঞানী। আর জ্ঞানীরা সব অল্পতেই বুঝতে পারে। সুতরাং বুঝতেই পারছো? ‘

বলেই সাদিদ চোখ টিপলো। আর সবাই আরেকদফা হাসাহাসিতে লাগলো।

— ‘ মাত্র দুইমিনিট। এরথেকে বেশি এই মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ একটু পরেই নিচ থেকে ডাক পরবে৷ তাই জলদি নিজের প্রয়োজন শেষ করো। আমরা ততক্ষণ রুমের সামনেই আছি। ‘

নিধি দরজাটা হালকা চাপা দিয়ে সবাইকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তারা চলে যেতেই সাদিদ নীলার দিকে তাকালো।
একেবারে পাকা লাল টমেটো। শাড়ি লাল, দোপাট্টা লাল, ঠোঁটের লিপস্টিকও টকটকে লাল। সব লালের মধ্যে লাজকলতা যেন ফোটা লাল পদ্মা। সাদিদ অপরপাশে তাকিয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। কেননা পাগলিটা এখনও মুখ নিচু করেই বসে রয়েছে। শুধু পারে না থুতনি এনে বুকের সাথে লাগিয়ে নিতে।
আর অপরদিকে বেচারি নীলার অবস্থা করুণ। এখনও বুকের হৃদযন্ত্রটা ধকধক আওয়াজ করে বেজেই চলেছে। তখনকার সাদিদের কৃতকর্মে নীলার আত্মাটা এসে প্রায় গলায় ঠেকেছিল। এই অসভ্য পুরুষের নির্লজ্জতাকে নীলা বরাবরই ভীষণ ভয় পায়।

— ‘ এখনও এতো লজ্জা! স্থান-কাল বিবেচনায় সেটা একটু বেশি নয় কি? ‘

নীলা এতক্ষণে সাদিদের কথায় মুখ উপরে তুলে তাকালো। লজ্জা পেলে এই ছেলে তাকে আরও বেশি পঁচাবে। তাই সাহসীকতার পরিচয় দিতে লজ্জাকে পরাজিত করে সাদিদের সামনে উঠে দাড়ালো। আলতো করে তার বুকে একটা কিল বসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ এসব কি? লোকজন দেখেন না? আপুনিসহ সবাই কি ভাবলো! ‘

সাদিদের ঠোঁটের কোণ জুড়ে মৃদু হাসির রেখা যেন আবারও ফুটে উঠল। সে নীলার কোমড় পেঁচিয়ে হালকা টান দিয়ে তার বুকে এনে ফেলল। একহাত কোমড়ে আর আরেকহাত গালে বুলিয়ে বলল,

— ‘ আমার কি দোষ? তারাই তো কথা ঘুরিয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করালো। তুমি জানো একটু কাছে আসার জন্য আমি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছি? তার মধ্যে তারা এসে বাধা দিতে চাইলে কিভাবে সহ্য করা যায়? ‘
— ‘ আপনি..আপনি একটা বেশরম। ‘

প্রেমিক পুরুষটি আবারও মৃদু হাসলো। আলতো করে নীলার মুখটা আঁজলাভরে ধরে একদৃষ্টিতে প্রিয়তমার মুখশ্রীতে তাকাতেই নীলা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

— ‘ কি দেখেন? ‘

সাদিদ প্রিয়তমার শরীরটাকে নিজের আরও কাছে টানলো৷ সময় নিয়ে পুরুষালী ঠোঁটজোড়া নীলার কপালের মধ্যখানে চেপে ধরল। নীরবে কিছু উষ্ণ ভালোবাসাঘন মুহূর্ত পার হলো।

— ‘ আমার কল্পনার থেকেও বেশি সুন্দর। বর্ণনার উর্ধ্বে। এতোটা বেশি সৌন্দর্যের চিত্রকর্ম কল্পনাতেও আঁকা সম্ভব নয়। সত্যিই পূর্ণতাটা হৃদয়ে তৃপ্তি এনে দিলো। এই তৃপ্তিটা দেওয়ার জন্য সাদিদ তার প্রাণপাখির কাছে কৃতজ্ঞ। ‘

সৌন্দর্যের প্রশংসাতে সব মেয়েরাই লজ্জা পায়। নীলাও তো সেটার বাহিরে নয়। তাই সাদিদের মুখের এমন বাক্য যারপরনাই সে ভীষণ লজ্জা পেল। চোখ খুলে রাখা রীতিমতো দায় হচ্ছে। নীলা চোখ পিটপিট করে সাদিদের দিকে তাকালো।
সাদিদের পরনেও বিয়ের শেরওয়ানি। কেবলমাত্র মাথায় বরদের পাগড়িটা ব্যতিত। হয়তো বা বাসা বিধায় খুলে রেখেছে। আর বলাবাহুল্য সাদিদও সেই বছর পূর্বেকার শেরওয়ানিটাই পরেছে। নীলার অবশ্য সেদিন তাকে স্বচোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কেবলমাত্র শপিংয়ের সময় যা দেখার দেখেছিল অতোটুকুই। সাদিদ নিজেও যে বিয়ের জন্য এটাই পরবে সেটা নীলা আশা করেনি। সেদিনতো লকার থেকে সাদিদ শুধু নীলার জন্য কেনা বিয়ের সকল জিনিসপত্রগুলো বিছানায় রেখেছিল। সেখানে সাদিদের কিছু ছিল না। তাই এতোবড় সারপ্রাইজটা সে একদমই আশা করেনি। তাইতো সামনাসামনি এভাবে দেখে পুরোনো কিছু তিক্ততা চোখের পর্দায় ভেসে উঠল। আর প্রত্যাশিতভাবেই নীলার চোখে আবারও নোনাজলেরা এসে ভিড় জমালো।
সাদিদ খুব যত্নে নীলার চোখের কোণটা মুছিয়ে দিলো। জলে ভেজা লেপ্টানো কাজল চোখজোড়া হালকা ছুঁয়ে দিয়ে নরমস্বরে বলল,

— ‘ অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে এই আয়োজন। আর পূর্ণতা সবসময় খুশিতে মানায়। তাই চোখে জল আসা বারণ। সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা থাকলেও এই চোখে জল সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই জান। তাই কোনো পরিস্থিতিতেই জল গ্রহণযোগ্য নয়। ‘

নীলা পরম আদরে সাদিদের বলিষ্ঠ পুরুষালী বুকের সাথে মিশে গেল।
একজনম কি? হাজার জনম ভালোবেসে গেলেও যেন এই কাপলযুগলের ভালোবাসার কমতি অনুভব হবে না। সুখে-দুঃখে, ভালো-মন্দে জীবনের সবকয়টি পরিস্থিতিতে কেবল এই হাতটাই যেন পাশে পাবার একান্ত আকাঙ্খা।
দুটি প্রেমিক মন এবং শরীর যখন একে-অপরের সাথে মিশে গিয়ে ভালোবাসার উষ্ণতায় হাবুডুবু খেতে ব্যস্ত তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে দরজায় নক পরলো,

— ‘ আরে ভাই হলো? প্রয়োজন ছিল বুঝলাম। কিন্তু এখন দেখছি সীমাহীন প্রয়োজন চলছে! বর সাহেব, নিচে আপনাকে চিরুনী খোঁজার ন্যায় খোঁজ চলছে৷ আমরা কি বলবো আপনাদের বর এখন তার বউয়ের সাথে প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত? ‘

দরজার ওপাশ থেকে আবারও হাসির ধুম পরতে সাদিদ ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।

— ‘ ইশ কি ঝামেলা! শান্তি মতে একটু নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথেও সময় কাটানো যায় না৷ ভাগ্যিস বিয়েটা হয়েছিল। নতুবা এই অশান্তিগুলো হয়তো ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিতে না। যতসব! ‘

নীলা সাদিদের ব্যঙ্গাত্বক স্বরে ফিক করে হেসে ফেলল। প্রিয়তমার হাসিমুখটা দেখে সাদিদের ঠোঁটেরও কোণেও ঈষৎ মিষ্টিরঙা রেখার সাদৃশ্য মিললো।

_________________

একই মুহূর্তের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু বুকের ছটফটানিগুলো যেন এখনো সেই প্রথম মুহূর্তটাতেই আটকে রয়েছে। নীলা বরাবরের মতো আবারও একবার সাদিদের মুখের দিকেই তাকালো। আগেরবার যেখানে ছিল অপরাধবোধ, অসহায়ত্ব আজ সেখানে উৎফুল্লতা। মেয়েকে কোলে নিয়ে সে দিব্যি নীলার উত্তর শুনার জন্য অপেক্ষা করে বসে রয়েছে। নীলার এমন সিচুয়েশনেও বেশ হাসি পেল। তাদের পাকনা মেয়েটা বড়দের মতো একবার বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার মায়ের দিকে। আবার হঠাৎ হঠাৎ করে চোখ ঘুরিয়ে উপস্থিত সবার মুখের উপর নজর বুলিয়ে পরিস্থিতির অগ্রগতি লক্ষ্য করছে। আশেপাশের লোকজনকে মাথায় রেখে নীলা কোনোভাবে নিজের হাসি আটকালো। মেয়েটা সত্যিই না জানি কোনদিন তার নাক কেটে বসে!
কাজি সাহেব কবুল বলতে বললে নীলা হাসিমুখেই আবারও একবার কবুল বলল। নীলার পালা শেষ হতেই সাদিদ বলল।
আর আবারও তাদের পুনরায় বিবাহের কার্য সম্পূর্ণ হওয়াতে পরিবার বর্গ সাক্ষী হলো সেই বিশেষ আনন্দের মুহূর্তটাতে। সবার মুখেই উপচে পরা হাসি। শাহেদ এসেতো ভাইয়ের সাথে কোলাকুলিই করে নিলো। এই লিস্ট থেকে তার দুই প্রাণপ্রিয় বন্ধু সমতূল্য ভাইও কিন্তু বাদ পরেনি। সবাই তাদের বাচ্চামি কান্ডে ঠোঁট টিপে হাসছে। ভাবটা এমন যেন এটা তাদের বন্ধুর প্রথম বিয়ে। কিন্তু বন্ধুর যে একটা পাকনা মেয়েও আছে সেটা কেন তারা বারবার ভুলে যায়?
অতঃপর তাদের হাসিমুখের সাথে আরও দুইটি নতুন হাসি মুখও যুক্ত হলো। স্বয়ং কনে এবং তার গুণধর কন্যা। পিচ্চি নীয়ানার খুশি দেখে কে! নিষ্পাপ বাচ্চার দন্তহীন সেই খুশির হাসি এককথায় বর্ণনার উর্ধ্বে।

.

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই অতঃপর ফটোসেশনের পালা এলো। সাদিদ-নীলার সাথে সবার সিঙ্গেল ছবি আগেই তোলা হয়েছিল। কিন্তু এবার হবে ফ্যামিলি ফটো। তাইতো আয়োজনের কোনো কমতি নেই।
সাদিদ নীলাকে মাঝখানে বসিয়ে তাদের দুইপাশে পরিবারের বড়রা অর্থাৎ আরিফ মাহমুদ, হাসিবুর রহমান, শায়লা রহমান, নার্গিস খাতুনসহ সাদিদের দাদা বাড়ির বেশ কয়েকজন রয়েছে।
আসলে ফ্যামিলি বলতে কেবল আমরা পরিবারে যে গুটিকয়েক সদস্য থাকি তাদেরকেই হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সাদিদই চাই তাদের ফ্যামিলি ফটোটা সবাইকে নিয়েই হবে। যেখানে বন্ধু বান্ধব, কাছের কোনো মানুষই বাদ যাবে না। তাইতো প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারকে এখন এতো বড় ছবি ক্যাপচার করার জন্য চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে। কেননা তাদের সংখ্যা যে খুব একটা কম নয়!

— ‘ এই মেয়ে তুই ওখানে কি করস? এখানে আস। ‘

শান্ত হাসিমুখে নীলার কাঁধে হাত রেখে ভাব নিয়ে পিছনে গিয়ে দাড়িয়েছিল। তাই হঠাৎ তানবীরের ধমকে চোখ বাঁকিয়ে তাকালো।
এই ছেলের ফেভারিট লিস্টে চিকেনের নাম না হয়ে করল্লা হওয়া উচিত ছিল। সর্বদা মুখ থেকে তিতকুটে বাক্য বের হয়।

— ‘ কেন! এখানে কি সমস্যা? ‘
— ‘ তুইতো সমস্যার গোডাউন তাই সমস্যা তোকে ছাড়তেই চায় না।
— ‘ কি! ‘

শান্তর চোখযুগল প্রায় বেড়িয়ে আসার জোগাড়। এই ছেলেটা এমন একটা সময়ে এসেও সবার সামনে তার সাথে ঝগড়া করছে! এসব মানা যায়?
তানবীর মুহূর্তেই চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। হনহনিয়ে শান্তর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার বাহু টেনে সামনের সোফায় বসিয়ে দিলো।

— ‘ আহা, মেয়েটার সাথে সবসময় এমন করিস কেন? ওখানে সমস্যা কি? ‘
— ‘ হ্যাঁ সেটাই। আঙ্কেল বলেন তো উনাকে। তার মাথায়ই নিশ্চয়ই সমস্যা আছে। ‘

তানবীর চোখ বাঁকিয়ে তাকাতেই শান্ত ভদ্র মেয়ের মতো মুখে ট্যাপ লাগালো।

— ‘ আমার কোনো সমস্যা নাই৷ কিন্তু আমার বাপের অবশ্যই সমস্যা হবার কথা। এই ভদ্র মহিলা নিজের আনন্দে আমার বাপকে ভুল্লাই গেছে। তুই সেখানে থাকলে তোর মুন্ডি না হয় দেখা যাইতো কিন্তু আমার বাপের? আমার বাপ কই যাইতো? গর্দভ ছেরি। তাই বাপ হিসেবে এসব দিকে নজর রাখা আমার কর্তব্য। ‘

তানবীরের মুখের বুলি শুনে শান্তর মুখটা একে-অপরের থেকে এতোটাই দূরে চলে গেল যে অনায়াসেই তার মধ্যে দিয়ে কয়েকশো মশা তাদের বংশধর নিয়ে ঢুকে যেতে পারবে।
তাকে ছাড়া বাদবাকি সবারও প্রায় একই হাল। কি বলে এই ছেলে!

— ‘ একদম নড়াচড়া করবি না। ‘

তানবীর নিজের ধমকা-ধমকির পালা শেষ করে এবার হাসিমুখে শাড়ির উপর দিয়ে শান্তর একেবারেই মসৃণ পেটটাতে আলতো করে হাত রেখে ফটোগ্রাফারের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ এবার ঠিক আছে দাদা। এখন তুলতে পারেন। আমার বাপকে মিস দেওয়া চলবে না। নতুবা বাপ আইবার পর আমারে জিগাইলে আমি কি উত্তর দিমু? সো ক্যামেরাওয়ালা দাদা, ঠিকঠাক ক্লিক করবেন। ‘

সবাই এতক্ষণে আধা পাগলের সম্পূর্ণ কথাটা বুঝতে পারলো। আর তাদের সাথে শান্তও পারলো। আর সবার সামনে এমন পরিস্থিতিতে পরে লজ্জায় তার মুখটা মুহূর্তেই একটুখানি হয়ে গেল। রাগ আর লজ্জার সংমিশ্রণে নিঃশব্দে তানবীরকে উদ্দেশ্য করে শ’খানেক গালির বর্ষণ আওড়ালো। কিন্তু সেগুলো সবকটাই একান্ত নীরবে। নতুবা ঘুণাক্ষরেও পাশের জনের কানে পৌঁছাতে পারলে তাকে আর অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খোঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না।
ফটোগ্রাফার ক্যামেরাতে ক্লিক করার আগে আরও একবার ভালোভাবে সবাইকে দেখে নিলো।
সাদিদের কোলে পিচ্চি নীয়ানা এবং তার কাছ ঘেঁষে নীলা। তাদের সাথে মানে পিচ্চি নীয়ানার পাশেই নিজের জায়গাটা বেশ পাকাপোক্তভাবে করে নিয়ে শাদ বসা। আর তাদেরকে ঘিরে পুরো পরিবার।
কাছের মানুষগুলোর হাসি মুখখানা নিয়ে খুব সুন্দর একটা স্মৃতিছবি ক্যামেরার পর্দায় উঠে এলো। হয়তো বা বছরঘুরে এই সুুখ স্মৃতিগুলোই মুহূর্তটাকে পূনরুজ্জীবিত করবে। চায়ের কাপে বসবে ফিরে দেখা দিনগুলোর জ্বলমলে স্মৃতিপট নিয়ে লম্বা আলাপ। প্রহর পেড়িয়ে গোধূলি লগ্ন আসবে কিন্তু তারপরও থেমে থাকবে না সেই স্মৃতিকখন। সুখ-দুঃখ, ঝগড়া, মান অভিমান, দূরত্ব, আত্মীয়ের বিশ্বাস ঘাতকতা সবকিছুকে ছাপিয়ে যেই ভালোবাসা আপন রঙে খেলে গিয়েছে। ভালোবাসার রক্তিম আবিরে যারা রঙিন হয়েছে এবং নিজেদের রঙে পাশের মানুষজনগুলোকেও রাঙাতে বাধ্য করেছে। এ যেন এক অকুতোভয়, সীমাহীন, অবোধগম্য, ব্যক্তহীন, কবু না থেমে থাকা ভালোবাসার গল্প। এক অন্তরালের প্রেমিক মনের গল্প। যার শুরু এবং শেষটা পুরোটাই অনুরাগ নির্ভর। এ যেন এক হৃদয়ে ছুঁয়ে যাওয়া অন্তরালের অনুরাগের প্রেমময়ী স্মৃতিকাহন!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here