অন্তর্লীন_প্রণয় পর্ব-১৩

#অন্তর্লীন_প্রণয় পর্ব-১৩
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

অন্ধকারে আচ্ছাদিত চারিপাশ। মাঝেমধ্যে বিকট আওয়াজে হয়ে আশপাশ ক্ষনের জন্য আলোকিত হয়ে ফের নিজের পূর্ব রূপে ফিরে আসছে। বৃষ্টি হচ্ছে বাহিরে তুমুল বেগে। আয়ন্তিকা গ্রীল হতে হাত বের করে বাহিরে দেয়। বৃষ্টির হীম কণা এসে তৎক্ষনাৎ তার হাত স্পর্শ করে। অন্যান্য সময় হলে আয়ন্তিকা খিলখিল করে হেঁসে দিতো কিন্তু বর্তমানে আয়ন্তি হাসলো না। তার মন বিষন্ন। চিন্তায় একটু খানি হয়ে গেছে।

সকাল হতে অহর্নিশের কোনো খবর নেই। সেই ভোর ছয়টায় বেড়িয়েছে তাকে বলে নিয়ে, কিন্তু এখন রাত ১২ টা বাজে অহর্নিশের ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। আজকাল অহর্নিশ পাশে না থাকলে তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভূত হয়। তাদের সংসার এর বয়স যত বাড়ছে ততই মনে হচ্ছে আয়ন্তিকা অহর্নিশের প্রতি একটু আধটু করে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। হবেই না কেনো? একজন মেয়ে পার্ফেক্ট স্বামী চায় সর্বদা। আর অহর্নিশ কে নিঃসন্দেহে একজন পার্ফেক্ট স্বামী বলা যায়। এই যে আয়ন্তিকার পরিক্ষা গেলো কতটা সুন্দর ভাবে তাকে গাইড করেছে অহর্নিশ। তার ছোট ছোট আবদার পূরন করার চেষ্টা করেছে, মুখে না বললেও অহর্নিশ তা বুঝে গিয়ে তার অপূর্ণ ইচ্ছে পূর্ণ করতো। স্বামী হিসেবে তো সবাই এমনই একজনকে চায় সর্ব ক্ষনে,

কলিংবেলের শব্দ কর্ণগোচর হতেই আয়ন্তিকা দ্রুত পায়ে দরজার নিকটে চলে যায়। দরজা খুলতেই তার সামনে দৃশ্যমান হয় সিক্ত, আহত অহর্নিশ কে। চুল দিয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে। কপালের কার্নিশে ব্যান্ডেজ। বাম হাতেও উঁকি দিচ্ছে শুভ্র রঙের ব্যান্ডেজ। আয়ন্তিকা বিস্মিত হয়! কাঁপাটে সুরে বলল,

-‘ আ..আপনার কি হয়েছে? ‘

অহর্নিশ নিজের সুস্থ হাতটা মাথায় গলিয়ে দেয়। আলত করে ঝাড়া দিয়ে পানিমুক্ত করার প্রয়াস চালায়। অতঃপর গহীন চোখে আয়ন্তিকার পানে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘ তেমন কিছু না। একটু আঘাত পেয়েছি। ‘

-‘ তেমন কিছু না মানে? আপনি কি আমায় বোকা মনে করেন হ্যা? নিশ্চিত মারামারি করেছেন। সত্যি করে বলুন অহর্নিশ, আপনার এই অবস্থা কি করে হলো।’

আয়ন্তিকার তেজী কন্ঠে ভড়কে যায় অহর্নিশ। মুখে সেই ভড়কানো আভাসটা তরতাজা হয়ে ফুটে আছে তবে মনে যেনো একটু প্রশান্তির ছোঁয়া মিললো। আয়ন্তিকা তাকে তার নাম ধরে ডেকেছে। তার ওপর একটু একটু করে অধিকার দেখাতে শুরু করেছে। বুঝে নিচ্ছে আস্তেধীরে নিজের অধিকার অহর্নিশের থেকে। আয়ন্তিকার কঠিন দৃষ্টি দেখে মৃদু হাসে সে। পরিশেষে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-‘ সত্যিটা তুমি হজম করতে পারবেনা। তাই না বলাই শ্রেয় আয়ন্তিকা। কিছু কিছু সত্য গোপণ রাখা ভালো। ‘

আয়ন্তিকা মনোযোগী চাহনি দেয় অহর্নিশের মুখশ্রীর প্রতি। পরবর্তীতে চোখমুখে ফের কাঠিন্যতা টেনে এনে বলল,

-‘ হজম করতে পারবো কিনা ঐটা নিতান্তই আমার ব্যাপার। আপনি বলুন! খুন – টুন করে এসেছেন কাওকে?’

-‘ খুন করিনি কিন্তু করে ফেলতাম আরেকটু হলে।’
মৃদু হেঁসে বলল অহর্নিশ।

আয়ন্তিকা ভ্রুকুটি কুঁচকে নেয়। কৌতূহলি কন্ঠে সে বলল,

-‘ মানে?’

-‘ আমার এই আঘাতের কারণ সায়িদ। গ্রামের নিরিহ মেয়েদের যে ধর্ষণ করে নিজ মন খুশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো টাকার এবং ক্ষমতার জোরে। তোমাকে বাজে ছুঁয়েছিলো। সেই সায়িদ! ওকে মেরেই ফেলতাম আজ। প্রথমত গালাগাল করে পালিয়ে যাওয়ার সময় আঘাত করলো। তার ওপর তোমায় নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, বাজে কথা বলেছে। আমি আসলেই আজ ওকে খুন করে ফেলতাম। কিন্তু পারিনি সেটা করতে। বাবার ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারিনি আমি। ‘

আয়ন্তিকা পাথর রূপ ধারণ করেছিলো। অতি কষ্টে সে অস্ফুটস্বরে বলল,

-‘ আপনি সায়িদকে কিভাবে চিনলেন?এসব কোথা কোথা থেকে জানলেন আপনি?’

-‘ তুমিই বলেছিলে। চার মাস আগে আমি তোমায় জরীয়ে ধরাতে তোমার জ্বর এসেছিলো মনে আছে? সেই দিনই রাতে জ্বরের ঘোরে সব বলেছিলে তুমি। ‘

কথা সমাপ্ত হওয়ার পর অহর্নিশ লম্বা পা ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। আয়ন্তিকা সেদিকে তাকিয়ে একফোঁটা অশ্রু বিষর্জন দেয়। সায়িদের কথা মাথায় আসলে ঠিক থাকেনা সে। তার ওপর আজ অহর্নিশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে সায়িদের জন্য। এতে সে নিজেকেই দায়ী ভাবছে। আয়ন্তি মনে করে সে যদি সেদিন জ্বরের ঘোরে ওসব কথা না বলতো তাহলে আজ অহর্নিশ আঘাতপ্রাপ্ত হতো না। কিন্তু ঐ জা-নো-য়া-র সায়িদেরও তো শাস্তি পাওয়া দরকার ছিলো।

নিজেকে পূর্ণরূপে ধাতস্থ করে আয়ন্তিকা অহর্নিশের রুমের উদ্দেশ্যে পা এগিয়ে নেয়। রুমের সন্নিকটে এসে আলত চাপিয়ে রাখা দরজা হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় সে। অতঃপর আয়ন্তিকা সুনিপুণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে অহর্নিশ কে। অহর্নিশ নিজের শার্ট পাল্টে সবেমাত্র টিশার্ট পড়লো। তবে ছিপছিপ রক্তের দাগ আয়ন্তিকার চক্ষুর আড়াল হয়নি।

অহর্নিশ ঘাড় বাকিয়ে আয়ন্তিকা কে দেখে নিয়ে বলল,

-‘ কিছু বলবে?’

আয়ন্তিকা সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ায়।

-‘ কি বলতে চাও?’
আয়ন্তিকা ইতস্তত বোধ করে বলল,

-‘ আপনার ব্যান্ডেজ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চেঞ্জ করা দরকার। ‘

অহর্নিশ ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলল,

-‘ ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করার মতো শক্তি আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই আয়ন্তিকা। আমি এখন একটু ঘুমাবো, মাথা ব্যাথা করছে। ‘

-‘ ব্যান্ডেজ তবে আমি চেঞ্জ করে দেই?’

অহর্নিশ চমকে হাতের টাওয়াল টা মেঝেতে ফেলে দেয়। শুষ্ক ঢোক গিলে সে বোঝার চেষ্টা করে এই মাত্র সে কি শুনলো? সত্যি শুনলো তো?আয়ন্তিকা তার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করে দিতে চাইছে তা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। নিজেকে আস্বস্ত করে মৃদু হেঁসে অহর্নিশ বলল,

-‘ অবশ্যই। কাবার্ডে ফাষ্ট এইড বক্স আছে নিয়ে আসো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি। ‘

-‘ আচ্ছা। ‘

আয়ন্তিকা ফাষ্ট এইড বক্স নিয়ে বেডে বসার ক্ষন বাদে অহর্নিশ ওয়াশরুম হতে বেড়িয়ে আসে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সে আয়ন্তিকার সামনে গিয়ে বসলো। টিশার্ট আলত করে উঁচু করে অহর্নিশ বলল,

-‘ জলদি করো ঘুম পাচ্ছে। ‘

-‘ আচ্ছা। একটু অপেক্ষা করুন। বেশি সময় লাগবে না আমার। ‘

আয়ন্তিকার কথ্যে অহর্নিশ মনে মনে বলল,

-‘ বছর খানেক সময় নিয়ে তুমি আমার ব্যান্ডেজ করো আয়ন্তিকা। আমার কোনো আপত্তি নেই এতে, তুমি যত সময় নিয়ে আমার ব্যান্ডেজ করবে ততবার তোমার কোমল, তুলতুলে হাত আমায় নতুন অনুভূতির প্রতি পরিচিয় করাবে। ‘প্রেম ‘ নামক অনুভূতির। যেই অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে আমি মনেপ্রাণে চাই। কিন্তু সেই প্রেম অনুভূতি তোমায় ঘিরে না হলে তা আমার চাইনা। একটুও চাই না। ‘
________________

এলার্মের শব্দে তড়িৎ বেগে চোখ খুলে আয়ন্তিকা। পিটপিট করে তাকিয়ে ডান পাশে দৃষ্টি দিতেই সে দেখে অহর্নিশের ফোন। এলার্মের শব্দের উৎপত্তি সেখান হতেই। আয়ন্তিকা চটজলদি মাথা নিচু করতেই দেখে অহর্নিশ তার পা জরীয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। কাল রাতে অহর্নিশের জ্বর আসাতে পরবর্তীতে আর নিজের রুমে যায়নি আয়ন্তিকা। অহর্নিশের রুমে বেডের ওপর বসে ছিলো। ভোরের একটু আগে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। কিন্তু অহর্নিশ আর তার মাঝে বেশ ব্যাবধান ছিলো। কখন এসে তাকে জরীয়ে ধরলে কে জানে?’

অহর্নিশ একটু আধটু নড়েচড়ে উঠে। ঘুমুঘুমু কন্ঠে সে বলল,

-‘ এলার্ম টা অফ করে দাওনা আয়ন্তিকা। ঘুম পাচ্ছে আমার। এখন উঠতে চাচ্ছিনা। ‘

আয়ন্তিকা অস্বস্তি নিয়ে বলল,

-‘ আপনি আগে সরুন তো। ‘

অহর্নিশ চোখ খুললো। নিজের অবস্থান দেখে সে একটুও ভড়কালো না। বরং অহর্নিশ ঠোঁট বাকিয়ে হাসে আয়ন্তিকার অবস্থা দেখে। লাজুকলতা রূপে নতজানু হয়ে তটস্থ হয়ে আছে আয়ন্তিকা। অহর্নিশের আর ইচ্ছে হলোনা আয়ন্তি কে লজ্জা দেয়ার। নয়তো এবার সে ভয়ংকর কিছু করতো। অহর্নিশ তার হাত সরিয়ে নেয়। শীতল কন্ঠে বলল,

-‘ আমার ফোনটা একটু দাও তো আয়ন্তিকা। ‘

আয়ন্তিকা চটজলদি নেমে পড়ে বিছানা থেকে। পালানোর সুযোগই সে খুজছিলো। কিন্তু নিজ হতে দৌড়ে রুম থেকে বের হতেও সংকোচ কাজ করছিলো। টেবিলের ওপর থেকে অহর্নিশের ফোন হাতে তুলে নিয়ে ফোন স্ক্রিনে ভেসেথাকা ম্যাসেজটি দেখে সে থমকায়। ম্যাসেজটা এসেছে ‘Safu ‘ নিক নেম দিয়ে সেভ করা এক নাম্বার হতে।

আয়ন্তিকা আবার চোখ বুলায় ফোনে। স্পষ্টত লিখা
‘ আমাকে এতদিন বন্দী রেখে মানষিক টর্চার করেছো অহর্নিশ। এই শোধ আমি তুলবোই। কালকের মধ্যেই এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবো তুমি তখন বেচে থাকার পথ খুঁজে পাবেনা। ‘

চলবে…

ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। পারসোনাল কিছু সমস্যায় আমি জর্জরিত। রি – চেইক করিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here