#অন্তহীন💜
#পর্ব_২০
#স্নিগ্ধা_আফরিন
প্রকৃতি তখন ধীরে ধীরে নিশিথীনির গাঢ় অমায় আচ্ছাদিত হয়ে উঠছে।অন্তরীক্ষে অর্ধ চন্দ্র টা এক পাশে হেলে পড়েছে। শুকতারা টা মিটিমিটি জ্বলছে। নগরীর বড় বড় অট্টালিকার কোথাও আঁধার দূর করতে জ্বলে উঠছে আলো। আবার কোথাও অন্ধকারি রাজত্ব করছে।বিরতিহীন গাড়ির শা শা শব্দ জানান দিচ্ছে নগরীর ব্যস্ততা কমেনি বরং বেড়ে চলেছে। চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছে কেউ। যদিও এটাকে শান্তির চা বলা যায় না।ঠান্ডা শরবত বললেই চলে।না চাইতেও বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির আভাস। দৃষ্টি তার সামনের মেয়েটার দিকে আবদ্ধ।ডান হাত দিয়ে বা হাতের আঙ্গুল মোচড়াচ্ছে চৈতি।ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রহনের দিকে।”চা টা গরম করে দিবো না বলেছি বলেই ঠান্ডা চা খাচ্ছেন?কী অদ্ভুত তো!”
বিড় বিড় করলো চৈতি। প্রহন শেষের চা গুলো এক ঢোকে গিলে চৈতির হাতে চায়ের কাপ টা ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”ঠান্ডা চা খাওয়ালে না আমায়?এর শোধ তুলবো দেইখো।”
শোধ তুলবে মানেই হলো উলটো পাল্টা কাজ।কথাটা মাথায় আসতেই চৈতি চট করে বলে উঠলো,”আমি তো বলিনি চা গরম করে এনে দিবো না। শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”
চৈতির কথা শুনে ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো প্রহন।এক পা চৈতির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,”বলো নি তাই না?”
চৈতি এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,”বলিনি তো!”
প্রহনের অধর জুড়ে শয়তানি হাসি।”মিথ্যুক মেয়ে।” চৈতিকে ধরতে যাবে এমন সময় বসার ঘর থেকে মিসেস ইয়াসমিন এর ডাক ভেসে এলো।”চৈতি একটু এদিক আয় তো।”
ডাক শুনে চৈতি কে আর প্রহন পায় কোথায়,সে প্রহন কে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে প্রহনের বলা কথা স্পষ্ট শুনতে পায়।”চঞ্চলা হরিণী শুনো, হরিণীর ন্যায় তো লাফিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে গেলে।তোমায় শুধু হাতের নাগালে পাই মিথ্যা বলার মজা বুঝাবো।”
চৈতির হাতে চায়ের কাপ টা দেখে মিসেস ইয়াসমিন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,”সেই কখন চা দিয়ে ছিলাম সেই কাপ এখন আনলি?”
চৈতি রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,”তোমার ছেলে যদি ঢং করে ঘন্টা লাগিয়ে ঠান্ডা চা খায় তাহলে আমার কি দোষ?”
“সে কি প্রহন ঠান্ডা চা কেনো খেলো?ও তো ঠান্ডা চা মুখে তুলে ও দেখে না।”
চৈতি মিটিমিটি হাসলো।প্রেম সাগরে ডুবে মরলে ঠান্ডা চা মুখে তুলে কেন গিলেও খাওয়া যায়।তা কী আর মিসেস ইয়াসমিন জানে। চায়ের কাপ টা ধুয়ে রেখে এসে মিসেস ইয়াসমিন এর পাশে বসলো চৈতি। চৈতি কে নিজের পাশে এসে বসতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বললেন,”তোকে একটা দরকারে ডেকে ছিলাম।”
চৈতি হাসি মুখে বললো,”বলে ফেলো।”
মিসেস ইয়াসমিন কিছু একটা বলতে যাবেন তখন প্রহন ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে।কালো রঙের শার্টের বুকের উপরের বোতাম খোলা। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। কালো রঙের শার্ট পরিহিত মানবের দিকে নেত্র পড়লেই দাঁত মুখ খিঁচে ফেললো কিশোরী।ভ্রু যুগল আপনা আপনি কুঁচকে গেলো।আনন জুড়ে রাগান্বিতর আভা ফুটে উঠেছে। উন্মুক্ত বক্ষ দেখেই রাগ হচ্ছে চৈতির। প্রহন মুচকি হেসে বললো”আম্মু আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে একটু রাত হলে ও হতে পারে। বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিবো একটু।”
প্রহনের কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন বিরক্ত হলেন। মুখ থেকে বিরক্ত সূচক শব্দ বের করে বললেন,”তোর আবার বান্ধবী কোথা থেকে আসছে? মেয়েদের থেকেই তো দূরে দূরে থাকতি।”
“এখন আর অনেক মেয়ে ফ্রেন্ড আছে। সোনিয়া,সিফা, সিমরান অনেক জন।”চৈতির দিকে তাকিয়ে বললো প্রহন।
প্রহনের কথা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে চৈতি বলে উঠলো,”আপনার সব মেয়ে ফ্রেন্ডের নাম বুঝি ‘স’ দিয়ে রাখা।তা কে রেখেছে নাম গুলো? আপনি নিজেই?”
চৈতির এহেন কথায় থতমত খেল প্রহন। মনে মনে বললো,”যত ছোট মেয়ে মনে করেছি তত ছোট কিন্তু না।”
মিসেস ইয়াসমিন মুচকি মুচকি হাসছেন। প্রহন চোখ বড় বড় করে চৈতির দিকে তাকিয়ে আছে। চৈতির কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে প্রহনের দিকে।
চৈতি প্রহনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে বললো,”ভালো মা তোমার কথা আমি পরে শুনবো।”
মিসেস ইয়াসমিন কে কথাটা বলতে দেরী দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দেরী হলো না চৈতির। মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”পিচ্চি বউ ক্ষেপেছে।সামলাও গিয়ে।”
প্রহন এক পলক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ও রুমে চলে গেল। মিসেস ইয়াসমিন রিমোট দিয়ে টিভি অফ করে হাসতে হাসতে রুমে চলে গেল।
রুমে এসে চৈতি কে দেখলো না প্রহন।বার কয়েক ডাক দিলো,”চৈতি”
সাড়া পেল না। বেলকনিতে কারো ছায়া স্পষ্ট দেখতে পেয়ে প্রহন বুঝলো চৈতি বেলকনিতে আছে।
মৃদু বাতাসে উড়ছে চৈতির খোলা এলোকেশ। বুকে দুই হাত গুজে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চৈতি। প্রহন এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো তার পাশে।
চৈতি কে চেতিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,”সিমরান নাকি আমায় খুব ভালোবাসে।বুঝছো চৈতি?”
প্রহনের কথা শুনে কোনো এক অজানা বিষাদে ভরে গেল চিত্ত। বুকের বা পাশে খারাপ লাগলো চৈতির। এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় সে।তাই হয়তো প্রহনের বলা কথাটা গাঢ় করে দাগ কাটলো কিশোরীর অবচেতন চিত্তে।
প্রহন আবারো বললো,”সিমরান কিন্তু অনেক সুন্দর একটা,,”কথাটা শেষ করতে পারলো না প্রহন। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই প্রথম চৈতি তাকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরলো। স্তব্ধ হয়ে চৈতির দিকে তাকালো প্রহন।
মেয়েটা কান্না করছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে না নীরবে কাঁদছে। পিঠের অংশের শার্ট খামচে ধরেছে। অভাবনীয় কার্য দেখে কেমন রিয়েকশন করা উচিত বুঝতে পারছে না প্রহন। চৈতির চোখের পানি তে বুকের কাছের শার্টের কিছু অংশ ভিজে শেষ।
প্রহন চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”কী হয়েছে চৈতি? এই ভাবে কান্না করছো কেন?”
চৈতির উত্তর পেলো না প্রহন। মেয়েটা আগের মতই কান্না করে যাচ্ছে।
প্রহন চৈতি কে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে চোখের পানি মুছে দিলো প্রহন।
“রাগ করেছো বউ?রাগ করে না। আমি তো মজা করে বলেছি। সিমরান টিমরান কেউ নেই আমার জীবনে।মেয়ে ফ্রেন্ড তো একটাও নেই।”
চৈতি কান্না আটকিয়ে ধরা গলায় বললো,”আপনার মুখে অন্য মেয়েদের নাম আমার সহ্য হয় না কেন জানি।”
“আর ইউ জেলাস?উমম হুঁ আমি বুঝতে পেরেছি।বউ আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছে।”
প্রহনের কথা শুনে কান্না থেমে গেল চৈতির।এক সাথে কয়েক বার চোখের পলক ফেলে প্রহনের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,”ভালোবাসা আসলে কি?”
প্রহন মুচকি হেসে বললো,”ভালোবাসা হলো হৃদয়ের একটা অনুভুতি। দূর থেকে ও কাছে থাকার অনুভব করা।মন খারাপের সময় আমরা যখন একা বসে থাকি, আবার কেউ গান শুনি, নামাজ পড়ি এই সব করে আমাদের যে শান্তি টা লাগে ঐটাই ভালোবাসা। ভালোবাসার সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম।যেমন আমার কাছে ভালোবাসা মানে, তোমার বাচ্চামো, তোমার রাগান্বিত মুখ, তোমার চোখ, পুরো তুমি টাই যে আমার ভালোবাসা। ভালোবাসা শুধু প্রেমিক প্রেমিকার জন্য নয়। ভালোবাসা আমাদের পরিবারের জন্য ও থাকে।মা বাবার জন্য, বন্ধু বান্ধব এর জন্য। ভালোবাসায় থাকতে হয় বিশ্বাস ও সম্মান। একদিনের জন্য ভালোবাসা নয় বরং বছরের প্রতিটি দিনই প্রিয় মানুষ গুলো কে ভালো বাসতে হয়।”
দম ছাড়লো প্রহন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চৈতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। প্রহনের সব কথা চৈতির মাথার উপর দিয়ে গেছে। প্রহন চৈতি কে এক মিনিট বলে রুমে আসলো। কাভার্ডের ভেতরে রাখা ব্যাগ থেকে একটা জিনিস বের করে চৈতির কাছে নিয়ে গেল। চৈতির হাতের মধ্যে তা ধরিয়ে দিয়ে হাসলো।
চৈতি অবাক হয়ে বললো,”এক বাক্স চকলেট?”
প্রহন উত্তর দিলো”হুম। এই যে এখন তোমাকে এই চকলেট বাক্সটা দিয়েছি এটাও কিন্তু ভালোবাসা।”
“আপনি আমায় ভালোবাসেন?”
চৈতির প্রশ্নের প্রত্যত্তরে প্রহন চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলল,”তোমার ঐ চোখ আমায় খুন করেছে। সহস্র বার,,,,”
চলবে,,,,