অন্তহীন💜 পর্ব-৪ ৫

0
3624

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৪+৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

“নতুন বউ কালো রঙের শাড়ি পরে শ্বশুর বাড়িতে যাবে?”চৈতি কে দেখে কথাটা বলে উঠলেন প্রহনের বড় মামি।লাল পেড় কালো শাড়ি পরিহিত কিশোরী চৈতি কে দেখে কিছুক্ষনের জন্য হৃদয়ের স্পন্দন থমকে গিয়েছিল প্রহনের।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চৈতির দিক থেকে চোখ ফেরালো ।বা হাত দিয়ে মাথার চুল এলোমেলো করতে করতে সোফায় বসে পড়লো।

জুনাইদা চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,”রুমে চল। বিয়ের শাড়ি টা পড়িয়ে দিই।”
মায়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো চৈতি।
জুনাইদা চৈতির হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে চলে গেলেন।রুপা সাথে যেতে চাইলে বারন করে দেন তিনি। মেয়ের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে।যা সবার সামনে বলা যাবে না। আসলে মা মেয়ের অনেক কথাই সকলের সামনে বলা যায় না। থাক না মা মেয়ের মাঝে কিছু ব্যাক্তি গত কথা বার্তা। সবার সব কিছু জানতে হবে কেন?

চৈতির রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ের শাড়িটা খুঁজতে শুরু করলেন জুনাইদা। আলমারি খুলতেই পেয়ে গেলেন শাড়িটা।রুপা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে।

শাড়িটা নিয়ে এসে বিছানার উপর রাখলেন জুনাইদা। চৈতি বিছানার এক কোণে মন খারাপ করে বসে আছে।মা কিছু বলার আগেই চৈতি মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে যেতেই কি হবে আম্মু?”

জুনাইদা মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“এটা তো নিয়ম মা।”বিয়ের পর মেয়েদের বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে চলে যেতে হয়।”

“এমন নিয়ম শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই কেন?”

“তোকে আমি কী করে এইসব বুঝাই বল তো? আচ্ছা বাদ দে এই সব। আমি কী বলি শোন,
একটা মেয়ের যখন বিয়ে হয়ে যায় তখন তার দুটো পরিবার হয়।একটা তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে নিয়ে আরেক টা বাবার বাড়ির লোকজন কে নিয়ে।”

জুনাইদার এই সব কথায় কিছু টা বিরক্ত হলো চৈতি।কথা গুলো শুনতে ভালো লাগছে না তার।
মেয়ের মুখের ভাব ভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন জুনাইদা।কথা ঘুরানোর জন্য বলে উঠলেন,
“আমার চঞ্চল হরিণীর নেয় কন্যা আপনি আজ এত শান্ত হয়ে গেছেন কেন বলুন তো?”

মায়ের কথা বলার ধরন দেখে হেসে ফেললো চৈতি। গতকাল থেকে মেয়েকে হাসতে দেখেননি জুনাইদা। মেয়ের মুখের হাসি দেখে প্রানটা যেনো জুড়িয়ে গেল এক নিমেষে। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললেন,
“এই ভাবেই হাসি খুশি থাকবি সব সময়। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি বলে এই নয় যে পর করে ফেলেছি। তোর জন্য ভালোবাসা টা আমাদের কখনো কমবে না মা।”

মায়ের কথা শুনে মলিন হেসে চৈতি বললো,
“তাহলে এত জলদি বিয়ে দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলে কেন?”

জুনাইদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা অনেক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন করে ফেলছে তাকে। মেয়ের এত প্রশ্নের উত্তর কী করে দিবেন তিনি?
“তোর জীবনটা সুন্দর করতে হবে মা। এখান থেকে রিফাতের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে হবে তোকে। ছেলেটা যে অনেক খারাপ।একটা পরিচয় লাগতো তোর।”

“কিসের পরিচয়? আমি তোমাদের মেয়ে। সরদার পরিবারের একমাত্র ছোট মেয়ে চৈতি সরদার।এটা কী আমার পরিচয় না?”

“চুপ কর চৈতি।আর একটা ও কথা না।আমরা যা করেছি সব তোর ভালোর জন্য করেছি। এখন না হলেও এক দিন না এক দিন ঠিক বুঝবি। মিলিয়ে নিস তখন।”

চৈতি চুপ হয়ে গেল।আর একটাও কথা বাড়ালো না।যা হচ্ছে হোক। আটকানোর ক্ষমতা নেই তার।
জুনাইদা চৈতিকে লাল শাড়িতে সাজিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
.
“কী রে ভাই, ফার্স্ট নাইট কেমন কাটলো বল।”
ইফতির কথা শুনে মাথা তুলে ইফতির দিকে তাকালো প্রহন।
“দেখ ভাই,মন মেজাজ এখন কোনোটাই ভালো নেই।উল্টা পাল্টা কথা বলে রাগাবি না আমাকে।”

“তবে যাই বলিস না কেন, তোর কিশোরী বউটা কিন্তু অনেক জোস। আমি যদি তোর জায়গায় থাকতাম বিয়ে করতে পেরেও এত জেদ করে বসে থাকতাম না।”

ইফতির বলা কথাটা কর্ণ কুহরে যেতেই রাগে শরীর গিজগিজ করে উঠলো প্রহনের।ইফতিকে ঠাঁটিয়ে কয়েক টা চড় মারতে পারলে শান্তি লাগতো।
নিজেকে সামলিয়ে বসা থেকে উঠে বেরিয়ে গেল প্রহন।
.
মেয়ের বিদায়ের সময় সরদার সাহেব চৈতির হাত প্রহনের হাতে তুলে দিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলেছিলেন,
“ছোট থেকে খুব বেশি আদরেই বড় করেছি আমার কলিজার টুকরা মেয়েকে। আমার সেই যত্ন করে বড় করা সোনার টুকরা কে তোমার হাতে তুলে দিলাম সারা জীবনের জন্য। আমার মেয়েকে সুখে রেখো।”

প্রতি উত্তরে কী বলা উচিত?তা মাথায় আসছে না প্রহনের। শুধু মনের ভেতর প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,
“এতই যদি আদরের মেয়ে হয় তাহলে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিলো কেন?”
মনের কথা মনেই থেকে গেল। মুখ ফুটে আর বেড়িয়ে আসতে দেয়নি প্রহন। কিছু প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে।তখনই হঠাৎ মনে পড়লো,
“বেশি সুন্দরী দেখে কী এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলো?”
আবার মনে হলো,”না।এর চেয়ে ও কত সুন্দরী আছে।হয় তো অন্য কোনো কারণ।”
ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি ঘাটা ঘাটি করলো না প্রহন।

সরদার বাড়ির সবাই যখন চৈতি কে বিদায় দিতে ব্যস্ত তখন চৈতি অবাক হয়ে শুধু দেখছে সবাইকে। খারাপ লাগছে খুব।এই প্রথম নিজের চোখে বাবাকে কান্না করতে দেখলো চৈতি।
সবার চোখেই আজ শ্রাবণের ধারা।অথচ জৈষ্ঠ্যের রোদের মতো ঝলমল করা মেয়েটার চোখেও যে আজ শ্রাবণের ধারা নামার জন্য বেকুল হয়ে ছটফট করছে, সে খবর কে রাখে?কেউ না।
প্রিয় জন কে ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্ত গুলো ভীষণ বিষাদে ঘেরা থাকে। ছোট থেকে যাদের সাথে পথ চলা শুরু হঠাৎ করেই মাঝ পথে নতুন অতিথির সাথে জীবনের পথ চলতে হয়।কী অদ্ভুত নিয়ম।

প্রচন্ড কান্না পাওয়ার পর ও চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে দেয়নি চৈতি। বুকের ভেতর ঝড়ের সাথে নিজেই মোকাবেলা করে গেছে। তীব্র ভালোবাসা যেমন কাছে টানে, ঠিক তেমনি তীব্র অভিমান অনেক দূরে নিয়ে যায়।বাবা মায়ের প্রতি সেই অভিমান টাই জন্মে গেছে চৈতির মনে। মেয়েটা যে বড্ড অভিমানী।
.
সন্ধ্যা হলো।ঘরে ঘরে সাজঁক বাতি জ্বলে উঠলো।।একটু পরেই মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসবে নামাজের আহবানের সুর। মিনিট বিশেক আগেই বাড়ি এসে পৌঁছায় প্রহনরা।
প্রহনের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো চৈতি কে। মেয়েটা ক্লান্ত। নতুন জায়গা নতুন পরিবেশে কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছে চৈতির।সব অপরিচিত মুখ। পরিচিত বলতে শুধু রেদোয়ান চৌধুরী আর মিসেস ইয়াসমিন।এনাদের কে আরো কয়েক বার দেখেছে চৈতি।
প্রহনের বড় মামি আর কাজিনরা মিলে চৈতি কে যে ভাবে বসিয়ে দিয়ে গেছে সেই একই অবস্থায় থ মেরে বসে আছে সে। বাড়িতে হলে এতক্ষণে তিন চার বার সারা বাড়ি চক্কর দেওয়া হয়ে যেতো। চৈতির বেশ জল তেষ্টা পেয়েছে।প্রহনের রুমের কোথাও পানির জগ দেখলো না সে।
“এত বড় রুমে একটা পানির জগ বা বোতল নেই ধুর।”

রুমে কারো প্রবেশের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকালো চৈতি। প্রহন এসেছে। বিছানার উপর বসে থাকা চৈতির দিকে এক পলক তাকিয়ে কাভার্ড থেকে ট্রাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেল।
এখন পর্যন্ত চৈতির গলার স্বর শুনতে পায়নি প্রহন।শুনতে পাবেই বা কী করে? চৈতি যে তার সামনে এখনো টু শব্দটি ও করেনি।

গোসল করে গা মোছার জন্য তোয়ালে নিতে ভুলে গেছে প্রহন।ওয়াস রুমের দরজা কিছুটা ফাঁক করে বিছানায় বসে থাকা চৈতির উদ্দেশ্য তার প্রথম কথা ছিলো,
“বেলকনিতে আমার তোয়াললেটা আছে।একটু এনে দিবা পিচ্চি?”

প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। অর্ধেক মাথা বের করে আছে। চুল থেকে টুপ টুপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। চৈতি বিছানা থেকে নেমে বেলকনি থেকে তোয়ালে টা এনে প্রহনের হাতে দিতেই তার হাতের সাথে স্পর্শ করে। মৃদু কেঁপে উঠলো চৈতি।
প্রহন ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজার কাছ থেকে সরে আসতে আসতে চৈতি ভাবলো,
এত ভীষণ অপরিচিত পুরুষ মানুষটির সাথে কী করে কাটাবে সে?ভাবতেই অস্থির অস্থির লাগছে মনে।
“উনি যে আমার ভীষণ অপরিচিত কেউ একজন।”

চলবে,,,

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াস রুম থেকে বেরিয়ে আসলো প্রহন। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো,
বিছানার উপরে বসে চৈতি উশখুশ করছে। চৈতি কে এমন করতে দেখে প্রহন জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু প্রয়োজন তোমার?”
প্রহনের স্বায় পেয়ে চৈতি মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
“আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে।”
এই প্রথম বার প্রহন নিজের নবনী কিশোরী বউয়ের কন্ঠস্বর শুনলো।কী মিষ্টি শুনালো কথা টা!”মেয়েটার কন্ঠস্বর সত্যিই কি এত সুন্দর?নাকি আমার কানেই শুধু সুন্দর লাগলো?”
প্রহন দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
“আম্মু আমার রুমে এক জগ পানি পাঠিয়ে দাও।”

মিসেস ইয়াসমিন তখন মাগরিবের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার সামনে থাকা কাজল কে দেখেই বললেন,
“কাজল প্রহনের রুমে এক জগ পানি দিয়ে আয় তো মা।ফুপ্পি নামাজ পড়েনি।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো কাজল। অনেকক্ষণ যাবৎ প্রহনের রুমে যাওয়ার সুযোগ খুচ্ছিলো সে।যাই হোক। শেষ পর্যন্ত সুযোগ টা পেয়েই গেলো।
ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা পানি ভর্তি জগ আর গ্লাস হাতে প্রহনের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল কাজল।

“পিচ্চি,এত গর্জিয়াস একটা শাড়ি পড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না তোমার?”

“আমি তো বসে আছি।তাই তেমন কষ্ট হচ্ছে না।”

প্রহন হাতের তোয়ালেটা চৈতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“বেলকনিতে এটা মেলে দিয়ে আসো যাও।”
প্রহনের কথা শুনে চৈতি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল প্রহনের অদর পানে।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চৈতি।পা বাড়াতে যাবে তখনই শাড়ির কুঁচি সাথে পা আটকে পড়ে যেতে যেতে পড়লো না। প্রহন আগলে ধরেছিল।
চৈতির কোমর ধরে উঁচু করে তুলে বসিয়ে দিল বিছানায়।সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো চৈতির।দ্রিম দ্রিম করে হাতুড়ি পেটা শুরু করলো বুকের বা পাশে। হৃদয় স্পন্দন বেড়ে গেল কয়েক গুণ।
চোখ মুখ খিঁচে ফেললো চৈতি।
চৈতির কান্ড দেখে মিটি মিটি হাসছে প্রহন।
“বাচ্চা একটা মেয়ে,ও নাকি প্রহন চৌধুরীর বউ।”
চৈতির হাত থেকে তোয়ালে টা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো প্রহণ। রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ঘড়ি বের করে হাতে পড়তে পড়তে চৈতির উদ্দেশ্য বললো,
“নিজেকেই এখনো সামলাতে পারো না পিচ্চি।আর এই শাড়ি কী করে সামলে রাখবে?”

চৈতি মিন মিনে গলায় উত্তর দিলো,
“শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই আমার।আগে কখনো শাড়ি পড়িনি।”

প্রহন এগিয়ে আসলো চৈতির দিকে। চৈতির সামনাসামনি বসে মুখটা চৈতির মুখের কাছাকাছি এনে বললো,
“শাড়ি সামলাতে শিখে নিও। না হলে আমাকে কী করে সামলাবে? আমি যে শাড়ির চেয়ে ও বেশি বেসামাল।”

প্রহনের কথা শুনে কাশি উঠে গেল চৈতির। গলায় কেমন ঝাল ঝাল লাগছে।এত কাছ থেকে এত আবেগীয় ভয়ংকর কথা এই প্রথম শুনেছে। লজ্জাবতী গাছের মতো লজ্জায় নুয়ে পড়লো। নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।নবনী কিশোরীর লাজুক অদর দেখে ভীষণ ভালোলাগা কাজ করলো পুরুষের সেই কঠিন হৃদয় জুড়ে।

দরজায় টোকা পড়লো। প্রহন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দরকার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো।
“আম্মু কোথায়?”

রুমের ভেতর প্রবেশ করতে করতে কাজল উত্তর দিলো,
“ফুপ্পি নামাজ পড়ছে।তাই আমাকে বললো পানি দিয়ে যেতে।”

কাজলের হাত থেকে পানির জগ নিয়ে প্রহন বলে উঠলো,
“দেওয়া হয়ে গেছে? এই বার যাও এখান থেকে।”

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে প্রহন ভাইয়া।”

“দেখো কাজল, আমার মন মেজাজ একদম ভালো নেই।তাই উল্টা পাল্টা কিছু বলে নিজের খারাপ ডেকে এনো না।”

“সেই তো আমার চেয়ে ছোট একটা মেয়েকেই বিয়ে করেছ। তার পর ও এত মেজাজ আমার উপর দেখাতে এসো না।”চৈতির দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলে রেগে প্রহনের রুম ত্যাগ করলো কাজল।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো প্রহন।

বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর পানির জগ টা রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পেছনে তাকিয়ে চৈতির উদ্দেশ্য বললো,
“নির্ঘাত বিয়ে নামক বাঁধনে জড়িয়ে তোমার দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হচ্ছি।তাই বলে যাচ্ছি, মায়ের কাছ থেকে তোমার জামা কাপড় নিয়ে এই শাড়ি টা বদলে নাও বাচ্চা।”
কথা গুলো বলেই গট গট করে চলে গেল প্রহন।কী থেকে কী হলো? কিছুই বুঝতে পারলো না চৈতি।সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। কিন্তু প্রহনের বাচ্চা, পিচ্চি বলে ডাকা ডাক গুলোর প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো চৈতি।”কী আজব! আমি কী এখনো ছোট বাবুদের মতো?যে আমাকে বাচ্চা ডাকতে হবে?”
.
ধরিত্রী তখন নিশিথীনির গাঢ় অমায় ছেয়ে গেছে। তবু ও শহরের কোলাহল কমলো না। গাড়ির হর্নের শব্দে বারংবার কেঁপে উঠছে চৈতি।পড়নে তার সেলোয়ার কামিজ।মা বাবার জন্য মনটা কেমন ছটফট করছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় রাত ১০টা। প্রহন যে সেই বেরিয়েছে আর ফিরেনি। কিছুক্ষণ আগেই মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে গেছেন। একটা মেয়ের ভীষণ ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু আল্লাহ তার ইচ্ছে টা পূরন করেছেন চৈতির মধ্যে দিয়ে। চৈতি কে নিজের মেয়ের চোখেই দেখেন মিসেস ইয়াসমিন।
সরদার সাহেব এর মুখে যখন চৈতির জীবন সংসয় নিয়ে শুনলেন, তখনই প্রস্তাব দিয়ে বসে ছিলেন,
“আপনার আদরের মেয়ে কে আমাকে দিবেন ভাই? কথা দিচ্ছি কখনো অনাদরে অবহেলায় রাখবো না।”

সরদার সাহেব প্রতি উত্তরে বলেছিলেন,
“কোন অধিকারে?”

রেদোয়ান চৌধুরী উঁচু গলায় বলেছিলেন,
“আমার এক মাত্র ছেলের বউয়ের অধিকারে।”
.
“এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কী করছো পিচ্চি?”
পুরুষালীর ভারি কন্ঠস্বর কর্ণ কুহরে পৌঁছাতেই মৃদু চমকে উঠলো চৈতি। চৈতির এমন অবস্থা দেখে প্রহনের বুঝতে বাকি রইলো না যে, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বাইরে সে কখনো অন্য পুরুষের কথা শুনে অভ্যস্ত না।

প্রহন এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো চৈতির দিকে।বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে লাল নীল আলো দেখতে ব্যস্ত চৈতি। মুখের ভাব ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মন খারাপি কালো মেঘেরা এসে ভীড় জমিয়েছে।
মেয়েটা কে দেখে মায়া হলো প্রহনের।
নরম সুরে প্রহন চৈতিকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাচ্চা, তোমার কী মন খারাপ?”

প্রহনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো চৈতি।রেগে গেলে সজীব আর সাদিকের দিকে যে ভাবে চোখ বড় বড় করে তাকাতো, ঠিক তেমনি প্রহনের দিকে ও তাকালো। এমন চোখ বড় বড় করে তাকানোর অর্থ হলো,
সে রেগে গেছে।প্রহনের জায়গায় সজীব কিংবা সাদিক থাকলে পিঠে কিল ঘুষি মেরে হাত ব্যাথা করে ফেলতো। কিন্তু এখানে যে এক অতি অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।এত সাহস নেয় তার।
“আপনি আমাকে বাচ্চা, বাচ্চা বলে ডাকছেন কেন?”

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে প্রহন উত্তর দিলো,
“তুমি তো একটা বাচ্চা মেয়ে।তাই তোমায় বাচ্চা বলে ডাকছি।”

“এই সব আমার ভালো লাগে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চা তোমার নাম কী?”

হাল ছাড়লো চৈতি।অযথা তর্ক করে লাভ নেই।
“চৈতি”

“চৈত্র মাসে জন্ম গ্রহণ করে ছিলে নাকি পিচ্চি?”

ছোট থেকেই যখন কাউকে নিজের নাম বলতো তখন সবাই মুচকি একটা হেঁসে বলতো বাহ বেশ সুন্দর নাম তো।কে রেখেছে?
চৈতি বেশ খুশি হয়ে উত্তর দিতো,
“আমার আব্বু।”
কিন্তু এই প্রথম প্রহনের মুখে এমন কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল চৈতি।
“কারো নাম শুনে কেউ এমন আজব প্রশ্ন করে?”
তা জানা নেই চৈতির।

চৈতির উত্তর না পেয়ে প্রহন আবারো বলে উঠলো,
“পিচ্চি, উত্তর দিচ্ছো না যে?”

“মা বলে ছিল, সেদিন রোদ্দুর ছিল।খা খা রোদে পুড়ে গিয়েছিল বসুন্ধরা।”

“গ্রীষ্মের উত্তপ্ত কোনো এক দিনে?”
“হুম।”
“তাহলে তো তোমার অনেক তেজ থাকার কথা। তুমি এত শান্ত কেন?”
উত্তর দিলো না চৈতি।সময় এবং পরিস্থিতি চঞ্চল চৈতি কে ও শান্ত করে দিয়েছে।সে খবর কী প্রহন জানে?
নাহ!জানে না।

হাত ঘড়িতে সময় দেখলো প্রহন। ঘড়ির কাঁটা ১০টার ঘর পেরিয়ে ১১ এর ঘর পৌঁছানোর জন্য আর অল্প কিছুক্ষণ সময় বাকি আছে।
ঘড়ির দিক থেকে চোখ সরিয়ে চৈতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রহন। তারপর রাশ ভারি গলায় বললো,
“খেয়েছো বাচ্চা?”
চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“হুম। ভালো মা খাইয়ে দিয়ে গেছে।”
“ভালো মা,সে আবার কে?”
“আপনার আম্মু।”
“সুন্দর তো ব্যাপারটা। ভালো মা বানিয়ে নিয়েছো?ভেরি গুড।”
প্রহন বেলকনি থেকে রুমের ভেতর যেতে যেতে বলে উঠলো,
“অনেক রাত হয়ে গেছে। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো পিচ্চি।”

প্রহনের পেছন পেছন চৈতি ও এলো। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একটা কথা বলবে বলবে করেও বলার সাহস হয়ে উঠছে না চৈতির।ডান হাত দিয়ে বা হাতের আঙ্গুল মোচড়াতে মোচড়াতে আমতা আমতা করে বললো,
“আব্বু আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে।”

চৈতির দিকে তাকালো প্রহন। নতুন জায়গায় যে মেয়েটার মন কেন খারাপ ছিল তা এই মাত্র বুঝতে পারলো সে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বললো,
“তোমার আব্বুর নাম্বার তো আমার কাছে নেই পিচ্চি।”

“আমার মুখস্থ আছে।”

“ওয়েল। আমি লক খুলে দিচ্ছি। তুমি কল করে কথা বলে নাও।”

বাবাকে কল করেছে ঠিকই কিন্তু টু শব্দটি ও করেনি চৈতি। সরদার সাহেব ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো কে,বলে গেছেন টানা ১ মিনিট ধরে। বাবার কন্ঠস্বর শুনে কল কেটে দেয় চৈতি। প্রহন অবাক হয়ে চৈতির দিকে চেয়ে আছে।
কল কেটে দিয়ে প্রহনের দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দেয়।
চৈতির হাত থেকে মোবাইল টা হাতে নিয়ে প্রহন কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসে,
“এমন করলে কেন পিচ্চি?”

চৈতির সোজা সাপ্টা উত্তর,
“জানি না।”

প্রহন আর কিছু বললো না এই ব্যাপারে। সোফায় গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।আর চৈতি কে ও লাইট অফ করে শুয়ে পড়তে বললো।
চৈতি বিছানার দিকে তাকালো।”এত বড় বিছানা ছেড়ে এমন একটা সোফায় কেন ঘুমাচ্ছে?”মনে মনে ভাবলো চৈতি।
মনের মধ্যে ভেসে উঠা প্রশ্ন টা করেই ফেললো চৈতি।
প্রহন শোয়া থেকে উঠে চৈতির কাছে আসতেই ঘাবড়ে গেল চৈতি।
হাসলো প্রহন। নিজের মুখটাকে চৈতির মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“তুমি এখনো অনেক ছোট পিচ্চি। বুঝবে না।”

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here