অন্তহীন💜 পর্ব-৬

0
3405

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৬
#স্নিগ্ধা_আফরিন

অন্তরীক্ষ জুড়ে তেজোনিধি দিনমনির আধিপত্য বিস্তার করছে।ভোর হয়েছে যে।সূর্য যেনো আজ ক্ষেপেছে। তার সে কী তেজ!
জানালার ফাঁক দিয়ে তার ক্ষিপ্ত আলোক রশ্মি এসে লুটোপুটি খাচ্ছে বিছানার এক কোণে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানবির নেত্রের উপর। ঘুমের মাঝেই ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো সে।আনন যেন ঝলসে যাচ্ছে ক্ষিপ্ত রোদে।
দুই হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে শোয়া থেকে উঠে বসলো চৈতি। দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সকাল ১০টা বেজে ৩৪ মিনিট।
পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো।সে ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। নিজের বিছানা ছেড়ে অন্য এক জনের বিছানায় শুয়ে সারা রাত ছটফট করেছে চৈতি। নিদ্রারা ধরা দেয় নি তাকে। ফজরের আযানের আগে শয়তানে এমন ঘুম পারিয়ে দিয়েছিল যে সেই ঘুম কিছুক্ষণ আগেই দিনমনির ঝাঁঝালো আলোতে ভাঙ্গলো।
বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই দাঁত ব্রাশ করার কথা মনে পড়লো চৈতির।ব্রাশটা তো বাড়িতেই রেখে এসেছে।মন খারাপ করে আবারো বিছানার উপর বসে পড়লো।
এমন সময় রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো প্রহন। বিছানায় বসে থাকা চৈতির দিকে তাকিয়ে বললো,
“পিচ্চি ঘুম ভাঙ্গলো?”
চৈতি প্রতি উত্তরে কিছু না বলে অসহায় দৃষ্টিতে প্রহনের বদন পানে চেয়ে রইলো।

পেছনে গুটিয়ে রাখা ডান হাতটা সামনে এনে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা ব্রাশটা এগিয়ে দিল চৈতির দিকে।অবাক হলো চৈতি।”না বলতেই বুঝে গেলেন কী করে?”
প্রতি উত্তরে মুচকি হেসে প্রহন বললো,
“দ্রুত মুখ ধুয়ে আসো পিচ্চি। আম্মু তোমার অপেক্ষায় এখনো নিচে বসে আছেন কিছু না খেয়েই।”

আরেক দফা অবাক হলো চৈতি। মনে মনে ভাবলো,
“আমার আম্মু-আব্বুর মতন এনারাও কত ভালো।”

_______________
“নতুন বউ এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে।আগে কোথাও দেখেছেন কি আপা?”

সোফায় বসে থাকা মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হাসলেন নিজের ভাইয়ের বউয়ের কথায়।অধর জুড়ে হাসির রেখা টেনেই উত্তর দিলেন,
“বউ না তো। চৈতি তো আমার মেয়ে।আর বাড়ির মেয়ে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতেই পারে।এতে অপরাধের কিছু নেই।আর একটা কথা হয়তো ভুলে গেছো, নতুন জায়গায়,নতুন পরিবেশে, নতুন সব মানুষের ভিড়ে মেয়েটার অস্বস্থি হতেই পারে। হয়তো বিছানা বদলানোর জন্য রাতে মেয়েটার ঠিক মতো ঘুম হয়নি।তাই একটু বেলা হয়ে গেছে ঘুম ভাঙ্গতে।হুট করেই তো আর সব কিছু মানিয়ে নেওয়া যায় না।মানিয়ে নিতে হলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।”

মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে মুখ ঝামটা দিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করতে করতে প্রহনের বড় মামি বলে উঠলেন,”বেশি মাথায় তুলিয়েন না।পরে দেখবেন মাথায় উঠেই নাচবে।”

“সে দেখা যাবে। আমাদের পারিবারিক বিষয়ে নাক না গলানোই উত্তম তোমার জন্য। বুঝতেই তো পারছো। আমি ছেড়ে কথা বলবো না।”

অপমানিত হয়ে রেগে গটগট করে চলে গেলে প্রহনের মামি। মিসেস ইয়াসমিন বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। এই দীর্ঘ শ্বাস কোনো আফসোস বা কষ্টের নয়। বরং একটা তৃপ্তির।জোর খাটিয়ে চৈতি কে নিজের মেয়ে বলতে পারার তৃপ্তির।
.
রাতে সোফায় এক পাশ হয়ে শুয়ে থাকার ফলে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে প্রহনের। ঘুম হয়নি ঠিক মতো।ছয় ফুট লম্বা স্বাস্থ্যবান একজন আর্মির ক্যাপ্টেন এর কাম্য নয় সোফায় ঘুমানো। তবু ও ঘুমিয়ে ছিল সে। বাচ্চা মেয়েটা যদি ভয় পেয়ে যায় পাশে ঘুমাতে দেখে। এমনিতেই কেমন চুপসে যায় প্রহনের সামনে।

চৈতি যখন ওয়াস রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছিল প্রহন তখন আঁখি জোড়া বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। প্রহন ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে চৈতি ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় প্রহনের রাশভারী কন্ঠস্বর শুনে ঘুরে দাঁড়ায়।
“পিচ্চি, একটা কাজ করতে পারবে?”

“জী বলুন।”
“আগে নাস্তা করে আসো যাও। তার পর বলবো, বুঝছো পিচ্চি?”

চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিল,
“হুম”

সিঁড়ি বেয়ে চৈতি কে নামতে দেখে মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে এগিয়ে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন। উনাকে দেখেই হাসলো চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“কীরে মা ঘুম হয়েছে?”

“সারা রাত জেগেই ছিলাম। সকালের দিকে ঘুম এসেছিল।তাই এত দেরি হয়ে গেছে উঠতে।”

“কোনো সমস্যা নেই। তোর জন্য অপেক্ষা করে বসে ছিলাম এক সাথে নাস্তা করবো বলে।”

মিসেস ইয়াসমিন চৈতির হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। চৈতির পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে নিজেও তার পাশে বসলেন। চৈতি কে স্বাভাবিক করার যথেষ্ট চেষ্টা করছেন তিনি।নিজ হাতে খাইয়ে দিতেও ভাবছেন না। মেয়ের অভাব যে পূরণ হয়েছে। এই মেয়েকে কী আর অনাদরে রাখা যায়?

নাস্তা করা শেষে চৈতিকে নিয়ে সোফায় বসলেন মিসেস ইয়াসমিন। এমন সময় প্রহনের ডাক পড়লো।
“পিচ্চি, তোমার কী এখনো নাস্তা করা শেষ হয়নি? একটু জলদি আসো তো!”

মিসেস ইয়াসমিন মনে মনে খুব করে হাসলেন। চৈতির সামনে মুখ ফুটে হাসতে পারছেন না। মেয়েটা লজ্জা পাবে দেখে। তবে মনে মনে খুব খুশী হলেন এই ভেবে যে ছেলেটা সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
চৈতি অভিযোগ করলো মিসেস ইয়াসমিন এর কাছে।
“আচ্ছা আমাকে কী পিচ্চি বাবুদের মতো দেখতে?”

মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললেন,
“একদমই না। রুপকথার গল্পে রাজার যেই রাজকন্যা আছে ঠিক তার মতন দেখতে আমার সোনা মাকে।”কথা টা বলেই চৈতির কপালে চুমু খেলেন মিসেস ইয়াসমিন।
“রুমে যা। প্রহন ডেকেছে।”

চৈতি চোখ ছোট ছোট করে বললো,
“প্রহন কে?”

চৈতির এমন প্রশ্ন শুনে মিসেস ইয়াসমিন হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছেন না। পরক্ষনেই মনে হলো, এমন প্রশ্ন করাটা অস্বাভাবিক নয়। বিয়ের আগে তো মেয়েটা প্রহনকেই তো দেখেনি। তাহলে নাম না জানা টা অস্বাভাবিকের ক্ষেত্রে পড়ে না। মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার ছেলের নাম প্রহন চৌধুরী। সম্পর্কে যে তোর স্বামী হয়।আর এখন থেকে মানুষ জন তোকে মিসেস প্রহন চৌধুরী বলে ডাকবে।বুঝলি মেয়ে। এখন যা।উপরের রুমে যা।দেখে আয় কেন ডাকছে।”

চৈতি চুপ করে বসা থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে আনমনে কয়েক বার আওড়াতে লাগলো
“মিসেস প্রহন চৌধুরী।”
নামটা তার বুকের বা পাশের স্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।
রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন। পিচ্চি বউয়ের অপেক্ষা।
এক পা দু’পা করে এগিয়ে এলো চৈতি।তাকে দেখেই প্রহন জিজ্ঞেস করলো,
“এই পিচ্চি,এক ঘন্টা লাগে নাস্তা করতে?”

চৈতি আনমনেই উত্তর দিলো,
“মিসেস প্রহন চৌধুরী।”

চৈতির কথাটা কানে আসতেই চোখ কোঠর থেকে বিরিয়ে আসার উপক্রম প্রহনের।
শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,
“কিহ? পিচ্চি এইটা তুমি কী বললা?”

হুস ফিরলো চৈতির। দাঁত দিয়ে জিহবা কামড়ে ধরে মনে মনে বললো,
“ইশশশশ।কী বলে ফেললাম আমি এটা।”

প্রহন হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। চৈতি গাল ফুলিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে প্রহনের দিকে। হাবভাব এমন যে, প্রহন যদি আরো কিছুক্ষণ এই একই ভাবে হাসতে থাকে তাহলে সে কান্না করে দিবে।

হাসি থামিয়ে বিছানা থেকে নেমে চৈতির কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় প্রহন। চৈতির নাক টেনে দিয়ে বলে,
“পিচ্চি এই সব কথা কে বলছে তোমাকে?”

চৈতি মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
“ভালো মা।”

“আম্মু বলেছে এই কথা?বাহ খুব দ্রুত সব শিখিয়ে দিচ্ছে দেখছি।”
প্রহন আবারো আগের নেয় বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। তার পর চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,
“ড্রেসিং টেবিলের প্রথম ড্রয়ারে একটা মলম রাখা আছে।ওটা নিয়ে আসো তো পিচ্চি।”

বাধ্য মেয়ের মতো প্রহনের কথা অনুযায়ী মলম নিয়ে প্রহনের দিকে এগিয়ে গেল চৈতি।

“ঘাড়ে মালিশ করে দাও।ব্যাথা করছে খুব।”

চৈতি সংকোচ বোধ করলো। আঙ্গুলের ডগায় মলম নিতে গেলেই থরথর করে কেঁপে উঠে হাত খানি। বেশ কিছুক্ষণ পরও চৈতির কোনো সাড়া না পেয়ে চোখ মেলে তাকায় প্রহন। চৈতির হাতের দিকে তাকিয়ে গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
“মেয়েটা আসলেই অনেক ছোট।যতই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি ততই ব্যার্থ হচ্ছি।”

চৈতির হাত থেকে মলমটা নিজের হাতে নিতে গেলে দেয় না চৈতি।মেয়েলী কন্ঠের নরম সুরে প্রহনের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমি মালিশ করে দিচ্ছি। আপনি শুয়ে পড়ুন।”

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here