#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ১০
#তানিশা সুলতানা
“ও মা মা
আমি যাবো না মা।
প্লিজ আমাকে ওখানে পাঠিও না মা। ওনাদের ফোন করে বলো না আমি ওনার কাছে যেতে চাই না। আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই। প্লিজ মা বলো না।
ছোঁয়া মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে। নাজমা বেগমের চোখেও পানি। সিমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মা আর বোনের দিকে। কোলে এখনো পরি। পরম শান্তিতে ঘুমচ্ছে।
” এমন করে না সোনা। ওটা তোমার শশুড় বাড়ি। তোমাকে তো ওখানেই থাকবে হবে।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন তিনি।
ছোঁয়ার কান্নার গতি বেরে যায়।
“ওই বাড়িতে কেউ আমাকে ভালোবাসে না। শশুড় আর পরি ছাড়া ওখানে কেউ নেই আমার। সাদি তো সুযোগ পেলেই বকে দেয়। ঠাস ঠাস মেরে দেয়। দেখো এখনো গাল লাল হয়ে আছে। আমি কি করে থাকবো? আমাকে কেনো বিয়ে দিলে তোমরা?
আমি কি অতশত বুঝি না কি? একটু ভুল করলে কেউ সুধরে দেয় না। শুধু বকা দেয়।
কান্না করলেও ধমক দেয়।
বুকটা কেঁপে ওঠে সিমির। বোনটা তাহলে ভালো নেই। নাজমা বেগম কি বলে মেয়েকে শান্তনা দেবে বুঝে উঠতে পারছে না।
দরজা কাছে দাঁড়িয়ে শফিক রহমানও চোখের পানি মুছছে। মেয়ে এসেছে শুনে হাত ভর্তি বাজার নিয়ে দোকান বন্ধ করে চলে এসেছে। কিন্তু মেয়ের এমন হৃদয় কাঁপানো কথা শুনে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস হয় না ওনার।
ছোঁয়া বুঝে গেছে মাও আর ওকে রাখতে চায় না। তাচ্ছিল্য হাসে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়।
” শুধু আজকের রাতটা থাকার পারমিশন নিয়ে দাও না। তোমাদের সাথে একটা রাত থাকি। তারপর না হয় কালকে চলে যাবো শাশুড়ীর ছেলের কাছে?
মায়ের হাত ধরে বলে ছোঁয়া। নাজমা বেগম নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহস নেই।
“বোন তোকে আজ আমি কোথাও যেতে দেবো না। আমি কথা বলবো তোর শাশুড়ীর সাথে।
সিমি বলে। ছোঁয়া খুশি হয়ে যায়।
” সত্যি বলবি?
“হুমম বলবো। তাছাড়া তোর শাশুড়ীকে কল করার কি দরকার। তোর ভাসুর আর ননদ তো আসছেই। ওনাদের বুঝিয়ে না হয় রেখে দেবো।
ছোঁয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠে সিটির গলা জড়িয়ে ধরে। ছোঁয়ার চিৎকারে পরির ঘুম ভেঙে যায়।
শফিক রহমান লম্বা শ্বাস টানে।
” আমার ছোঁয়া মনি এসেছে বুঝি?
এক গাল হেসে বলেন উনি। ছোঁয়া এক দৌড়ে গিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে ওড়ে।
পরি কেঁদে দেয়। ঘুম থেকে উঠার পর সিমির মুখ দেখেছে। সিমিকে চিনতে না পেরেই কেঁদে ওঠে।
সিমি হকচকিয়ে যায়। পরিকে সোজা করে কোলে নেয়।
“মা দুধ না আনতে বললাম তোমায়?
বাবাকে ছেড়ে রাগী গলায় বলে ছোঁয়া।
” এখুনি আনছি মা।
নাজমা বেগম হুরমুর করে চলে যায়। সিমি পরিকে কোলে নিয়ে হাঁটতে থাকে। আমি পরি চুপ করে যায়। গলা জড়িয়ে ধরে সিমির। মাথা রাখে সিমির কাঁধে।
“বাবা এসো। তোমার নাতনি ও। কোলে নাও ওকে।আদর করে দাও।
বাবার হাত ধরে টেনে সিমির সামনে দাঁড় করায়। সিমির কোল থেকে পরিকে নিতে গেলে পরি যায় না। মুখ লুকায় সিমির বুকে। কেঁপে ওঠে সিমি।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে পড়ে যায় অতীত। যেখানে নয়টা মাস বাচ্চার অস্তিত্ব অনুভব করেও তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারে নি। সে বেঁচে আছে কি না সেটাও জানা নেই।
আজকে এই বাচ্চাটা সিমির শূন্য বুক টাকে শীতল পরস দিলো। মনে করিয়ে দিলো জঘন্য স্মৃতি। যা এতোদিন কড়া পাওয়ারের ঘুমের ঔষধের সাথে বিলিন করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলো অসহায় সিমি।
” ওকে নিস না ছোঁয়া। থাক না আমার কাছে একটু। আমিও একটু অনুভব করি সুখ টাকে।
অনমনে বলে সিমি। শফিক রহমান মেয়ের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না
“ওকে নিলাম না। থাক তোমার কাছে। খায়িয়ে দিও ওকে। আমি আর বাবা গিয়ে শাশুড়ীর ছেলে মেয়েকে রিসিভ করে আসি।
নাহলে আবার শাশুড়ী ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দেবে।
ছোঁয়া বাবাকে টেনে নিয়ে যায়। অনেক কথা জমে আছে বাবার সাথে।
ওরা যেতেই সিমি হু হু করে কেঁদে। পরির মুখে অজস্র চুমু খায়।
সিমির কান্না দেখে পরি চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে থাকে। পর চোখেও পানি টলমল করছে।
” খাবো
অস্ফুরণ কন্ঠে বলে পরি।
সিমি কান্নার মাঝে হেসে ফেলে। অন্য বাচ্চারা খাওয়া নিয়ে বায়না করে। আর এই বাচ্চাটা নিজেই খেতে চাইছে।
চোখ মুছে পরিকে খাওয়াতে থাকে সিমি।
সাবিনা বেগম স্বয়ং এসেছে। এটা দেখে ছোঁয়ার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই মহিলা এসেছে মানে এখনি চলে যাও।
শফিক রহমান ভীষণ খুশি হয় ওনাদের দেখে।
সালাম দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে। ছোঁয়া গোমড়ামুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
“পরি কোথায়?
সিফাত চেয়ার টেনে বসতে বাসতে বলে।
” আমার বড় মেয়ের কাছে। খাওয়াচ্ছে ওকে।
শফিক রহমান একটু হেসে বলে।
“রান্না বান্না শেষ হয়েছে?
সাবিনা বেগম জিজ্ঞেস করে গম্ভীর মুখে। ওনার কথা শুনে শফিক রহমান একটু ভরকে যায়। তনু মায়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” এতদিন পর মেয়ে এসেছে নিশ্চিয় ভালো ভালো রান্না করছেন। তো তাই জিজ্ঞেস করলাম রান্না শেষ হয়েছে না কি?
হলে তারাতাড়ি খেতে দিন। আমরা এখনি চলে যাবো।
শফিক রহমানের হাসি মুখটা চুপসে যায়। ছোঁয়া আসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায়।
ছোঁয়ার কাকিমার কোনো সন্তান নেই। কাকা বিদেশ থাকে। দাদা বেঁচে নেই। দাদিমা বেঁচে আছে।
তিনজন মিলে অনেক পদ রান্না করেছে। সবাই খাচ্ছে। ছোঁয়া শুধু খাবার নারাচারা করছে।
সিমি স্পষ্ট বলে দিয়েছে ওনাদের সামনে আসবে না। পরি সিমির কাছেই আছে। সিফাতের কাছে নিয়ে এসেছিলো ছোঁয়া কিন্তু থাকে নি।
খাওয়া শেষ হলে শাশুড়ী সবাইর কাছ থেকো বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। ছোঁয়াকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে যায়।
ছোঁয়া বাবা মা কারো সাথে কথা বলে না। সিমির সাথেও কথা বলে না। পরি সিমির কোল থেকে যাবে না। ছোঁয়া টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে যায়। সিমির গাল বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বুকটা আবারও ফাঁকা হয়ে যায়।
তনু ছোঁয়ার বাবা মায়ের কাছে হ্মমা চায় ছোঁয়াকে এভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর কথা দিয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবে ওকে।
ছোঁয়া জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। পরি কেঁদেই যাচ্ছে। সিফাত ওর কান্না থামাতে পারছে না।
সিমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো বড় গাড়িটার দিকে। পরির কান্নার আওয়াজ সিমির কানে বারি খাচ্ছে।
মুহুতেই শো শো করে গাড়িটা চলে যায়। নাজমা বেগম শব্দ করে কেঁদে ওঠে। সিমি ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে।
পরির জন্য কাঁদছে নাকি ছোঁয়ার জন্য কাঁদছে জানা নেই ওর।
চলবে