অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-১২

0
1925

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১২

অর্পণ বললো, দোস্ত এডাই তোর ডাক্তার?

অর্পণের উৎসুক কণ্ঠস্বর। অধিক আগ্রহের সাথে আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আমি নিরুত্তর। সামনের ব্যক্তিটিকে পর্যবেক্ষণ করেই চলেছি। তিনি এখানে কি করছেন? কি দরকার ছিলো এখানে আসার? অর্পণ আর নির্ঝরের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর আমায় দিতে হবে। উফ লোকটা যা পারে! আমার মুখ মলিন হয়ে এলো। ধীর পায়ে সে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো। সব সময়ের মতোই মুখে তার গাম্ভীর্যের ছায়া।অর্পণ বার বার আমাকে একই প্রশ্ন করে চলেছে, তার থামার নাম গন্ধ নেই। আমি বিরক্তি নিয়ে ‘হুম’ শব্দ করতেই নির্ঝর বললো, ‘তোর আশিক দেখি মরার গরমের মধ্যে তোরে নিতে আইসা পড়ছে।’

অর্পণ বললো, ‘ঠিক কইছোস। প্রেম দিওয়ানা।’

ওদের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সবার চোখে মুখে এক রাশ বিস্ময়। হয়তো সে এখন এদিকেই আসবে। সবার উৎসুক দৃষ্টি। তার পদচারণার অপেক্ষায় পাঁচ জোড়া চোখ। এবার সবার বিস্ময়কে আকাশ অব্দি পৌঁছে দিলেন তিনি। ধীরে সুস্থে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেও তিনি উত্তর দক্ষিণ কোন দিকেই তাকালেন না। তিনি রওয়ানা হলেন সম্মুখ পানে। কোথাও দৃষ্টিপাত করলো না। আমাদের পাঁচটি বিস্মিত চেহারাকে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। বিস্তৃত দালানের দিকে এগিয়ে গেলো সে। কিয়ৎক্ষণের জন্য তাজ্জব বনে গেলাম। একে তো তাকে দেখে অবাক দ্বিতীয়ত তার ভাব ভঙ্গি। কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টায় আছে সবাই। রুম্পি ঠোঁট উল্টে বললো,

‘এটা কি হলো? তোর ডাক্তার দেখি হলের দিকে গেলো।’

মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। যেদিকেই গেছে ভালো হয়েছে। আমি তার সম্মুখীন হই নি এটাই অনেক।

‘আমি কি জানি? আমার মনে হয় উনি কোন কাজে এসেছেন। আমাকে নিতে আসবে! ওনার বুঝি বয়েই গেছে।’

অর্পণ বললো, ‘কি কাম থাকবো আর? তোর জন্যই আইছে। বেশি পাট লইছ না‌। দেখবি এদিকে আসবো‌।’

‘এদিকে যেহেতু আসবে তাহলে ওদিক কেন যাবে? ফালতু কথা রাখ তো। উনি ওনার কাজে এসেছেন হয়তো। তাছাড়া উনি কি করে জানবেন আমি এখানে পড়ি?’

আমার কথায় সবাই আমার দিকে তাকালো। রুম্পি বললো, ‘ডাক্তার ফাক্তার জানে না তুই কোথায় পড়িস?’

আমি আগের মতোই বললাম, ‘তাকে বললে না সে জানবে। আমি কখনো বলি নি।’

অর্পণ মাথ চুলকাতে চুলকাতে বললো, ‘দোস্ত আমার কেমন জানি সব হ-য-ব-র-ল লাগতাছে‌।’

নির্ঝর বললো, ‘নিশ্চিত একটা গাবলা আছে।’

আমাদের আলোচনার মাঝেই নির্ঝরের মোবাইল ফোন টা থেকে টুং টাং রিংটোনের এলো। ফোনটা হাতে নিয়েই নির্ঝর বললো, ‘দোস্ত আমি যাই আমার খবর আছে।’

অর্পণ তাকে ফোড়ন কেটে বললো, ‘যাও মামু পীরিত করো। ঠেলা একদিন বুঝবা।’

নির্ঝর কিছু বললো না তার আপাতত বেড়ুতে হবে না হলে তার খবর আছে। সব এলোমেলো। নির্ঝর প্রস্থান করতেই আমি অর্পণকে বললাম, ‘অর্পণ তুই কি বল তো? কখনো ঠিক হবি না?’

‘কেন? তোর মনে হয় আমি ত্যাড়া?’

‘অবশ্যই তুই ত্যাড়া। এভাবে বলার কি দরকার ছিলো?’

‘শোন আমি যা কই সামনাসামনিই কই। পিছনে কিছু কওয়ার স্বভাব আমার নাই। যা কইছি ঠিকই কইছি। মাইয়া জাতি গো আমার সহ্য হয় না।’

রুম্পি মুখ ঘুরিয়ে বললো, ‘হবে হবে যেদিন একজন নিজের কপালে জুটবে ঠিকই সেদিন হবে।’

অর্পণ তেজ গলায় বললো, ‘ওই তোর সমস্যা কি? তোর মনে হয় অর্পণের জীবনে মাইয়া গো জাগা হইবো? দেখ আমি জীবনেও এই আকাম কুকামে নাই।’

‘কেন তুই কি কখনো কাউকে বিয়ে করবি না? কাউকে আপন করে নিবি না?’

‘বাইচা থাকতে তো সম্ভব না।’

‘কেন কি সমস্যা তোর?’

‘কোন সমস্যা নাই। আমার ভালা লাগে না।’

রুম্পি হঠাৎ বললো, ‘তোকে কোন মেয়ে পাত্তা দিলে না!’

অর্পণ হেসে বললো, ‘তাই হয়তো রে। তোরা আছোস আর মানুষ দিয়া কি করমু? বিন্দাস লাইফ। চিল।’

আবারও ছেয়ে গেলো থমথমে পরিবেশ। এতোক্ষণের জমজমাট আড্ডায় মেতে ওঠা বন্ধুমহলে পিন পিন নিরবতা। আমি তনয়ার সাথে নোট গুলো দেখতে লাগলাম। আমাদের বন্ধু মহলের সবচেয়ে চুপচাপ প্রকৃতির মেয়েটি হলো তনয়া। বছরে একটা কথা বলে কিনা সন্দেহ। তারপরও কি করে কি করে যেন আমাদেরই অংশে পরিণত হলো।

ঘড়ির কাঁটা গয়ে থামলো তিনটার ঘরে। ওঠার সময় হয়ে এসেছে‌। এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে হবে। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে সবাই উঠে দাঁড়িয়েছি।

‘আজ অনেক দিন পর সবাই এক হলাম। আমার আজকে খুব ভালো লেগেছে।’ তনয়ার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো।

‘তোর ভালা লাগছে কেন? ভুতুম পেঁচার মতো তো থুম ধইরা বইয়া আছিলি। একটাও কথা কছ নাই।’ (অর্পণ)

‘সবসময় কথা বললেই ভালো লাগবে এমনটা কিন্তু না। আমার তোদের কথা শুনতে বেশি ভালো লাগে। মনে পড়ে শেষ কবে আমরা আড্ডা দিয়েছিলাম?’

সবাই চুপ হয়ে গেলাম। ধীর পায়ে সামনে দিকে এগোচ্ছি। হঠাৎ অর্পণ বললো, ‘আরে মামু ডাক্তার আইয়া পড়ছে। দেখ তোরেই দেখতাছে। আমি কইছিলাম না।’

অর্পণের কথা শুনে সামনের দিকে তাকালাম। ঠিকই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অরিদ্র। যাকে বলে আড়চোখে চাওয়া। তার দৃষ্টি বোঝার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। পা দুটো থমকে গেছে। তিনি এদিকেই আসছেন।

‘বাব্বাহ দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।’ রুম্পি আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো। আমি তার দিকে গরম দৃষ্টিতে তাকাতেই সে চুপসে গেলো। অরিদ্র এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন।

‘ইশারা আপনি এখানে?’

‘আমি তো এখানেই পড়ি তো কোথায় আর থাকবো?’

‘আপনি এই ভার্সিটিতে পড়েন!! আগে তো বলেন নি!’

‘বললে কি হতো?’

‘কিছু না। ক্লাস শেষ?’

তনয়া বললো, ‘তা তো সেই কখনই শেষ।’

তো এতোক্ষণ কি করছিলেন?

অর্পণ এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন?’

এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?

‘জ্বি ভালো। আপনার কথা আমরা ইশার মুখে অনেক শুনেছি ভাইয়া। আপনার গুণগান করতে করতেই ইশার দিন পার হয়।’

অর্পণের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। কি বললো ছেলেটা? সত্যিই তো একটা ফাসাদ ও। রাগে কটমট করতে লাগলাম।

অরিদ্র হেসে বললেন, ‘সিরিয়াসলি? তুমি অনেক স্মার্ট।’

অর্পণ বললো, ‘ভাইয়া বিশ্বাস করলেন না?’

‘বিশ্বাস করার মতো কথা হলে ঠিকই বিশ্বাস করতাম।’

অর্পণ হেসে ফেললো। বললো, ‘তা এখানে কি মনে করে ভাইয়া? আমাদের ইশাকে নিতে এসেছেন?’

‘না আমার পুরোনো এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনাদের ইশা যে এখানে পড়ে তা তো আমি জানতাম না।’

তার কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেলো। বন্ধু! তার বন্ধু কে? আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, আপনার বন্ধু কে?

তিনি স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, রুদ্র মাহমুদ। চিনেন আপনারা?

তার কথায় সবার চোখ কপালে। রুদ্র স্যার ওনার বন্ধু?

অর্পণ বললো, ‘চিনি মানে! স্যার তো আমাগো ক্লাস নেয়। আজকেও তো স্যারের ক্লাস ছিলো।’

‘ওহ্, গুড। সবাই মন দিয়ে লেখাপড়া করো।’

সবাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। হঠাৎ উনি বললেন, ‘আপনি কি এখন বাড়ি ফিরবেন ইশারা? নাকি আরো দেরি হবে?’

আমি শান্ত ভাবেই বললাম, হুম বাড়ি যাবো।

ওহ্ তাহলে একসাথেই যাই চলুন।

না চাইতেও আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। কেন তা অজানা! অর্পণ আমার কানে কানে বললো, আমাকে নিতে আসবে! ওনার বুঝি বয়েই গেছে। এইডা কে জানি কইছিলো মামা?’

আমি শান্ত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে সামনে পা বাড়ালাম। পিছনের মানুষ গুলো যে হাসির জোয়ারে ফেটে পড়েছে তা বুঝতে বাকি থাকলো না।

বাড়ি পৌঁছাতেই দেখতে পেলাম বেশ রমরমা পরিবেশ। বাড়িতে বেশ আয়োজন চলছে। মেজ খালা চলে এসেছে। ড্রইং এ বাবার সাথে বসে আছেন খালুজান। খালা বোধহয় মায়ের কাছে। আমি সালাম জানিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলাম। খালুজান বেশ হাসি খুশি ভাবেই উত্তর দিলেন। খালা যেমনই হোক খালুজানের মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। আমি আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। অরিদ্র বাজারের মোড়েই থেকে গেছেন আমার সাথে বাড়ি ফিরেন নি। কি যেন কাজ আছে বলেছেন। আমি আর কথা বাড়াই নি।

রুমে গিয়েই একটা লম্বা সাওয়ার নিলাম। এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটা ঠাণ্ডা সাওয়ার। সাওয়ার নিয়ে ভুরি ভোজের জন্য নিচের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু নিচে আসতেই চোখ কপালে উঠে গেলো।

অরুনিকে দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। অরুনি আমার মেজ খালার একমাত্র অতি আদরের কন্যা। আদরের দুলারী। অরুনি অরিদ্রের পাশে বসে বেশ হেসে হেসে কথা বলে চলেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ওর কত্ত দিনের পরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলছে। অরিদ্র বসে আছেন কোন ভঙ্গিতা ছাড়াই। অরুনি প্রশ্ন করছে আর সে ছোট করে উত্তর দিচ্ছে। কিছুক্ষণ এই দৃশ্য উপভোগে মগ্ন হয়ে গেলাম। এরপর পা বাড়ালাম সেদিকে।

টেবিলে বসতে বসতে জোরে চেঁচিয়ে মাকে বললাম, মা খাবার দাও খুব খিদে পেয়েছে।

অরিদ্র আমার দিকে শান্ত ভঙ্গিতে তাকালেন। কিন্তু বেশিক্ষণ এই দৃষ্টি দিতে পারলেন না। মা খাবার বেড়ে দিতেই আমি তাকে মুখ ভেংচে আমার ঘরে চলে গেলাম। সেখানে বসে থাকলে এই খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না। মানুষের অতিরিক্ত ঢং আমার কখনোই পছন্দ না।

চলবে…….

(রিচেক হয় নি। অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here