অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব-৪৫

0
776

অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-পয়তাল্লিশ
নাফিসা নীলয়া!

-তিশা একবার গিয়েই দেখ না। আমি মানছি তোর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একবার যেতে তো ক্ষতি নেই।

জায়মা তিশাকে বারবার অনুরোধ করছেন। কিন্তু তিশা ওনার কথা আমলেই নিচ্ছে না। সে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার এপার্টমেন্টের পেছনে একটা বড় গাছ আছে সেখানে একজোড়া পাখি বাসা বাঁধছে। সে পাখির বাসা বাঁধা খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে। এই মুহূর্তে তার আর দিন দুনিয়ার কোথাও খেয়াল নেই। উদাস হয়ে সে সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো। জায়মা তিশাকে এমন নির্লিপ্ত দেখে এবার বিরক্ত বোধ করলেন। বললেন।

-তোর বাসায় এসে কি ভুল করেছি? খাওয়ার সময়ও তেমন কথা বলিসনি। এখনো কোনো কথা বলছিস না। তোকে এতোবার করে অনুরোধ করছি। আমার অনুরোধও রাখছিস না। এই তুই আমাকে তোর মায়ের থেকে বেশি ভালোবাসিস?

জায়মার কথা শুনে এবার তিশা জায়মার দিকে তাকালো। উদাস কন্ঠে বললো।

-আমি জীবনে যা চেয়েছি ঠিক তাই পেয়েছি খালামনি। বাবা-মা আমাকে সব দিয়েছে। আদর দিয়েছে,টাকা পয়সা দিয়েছে ভালো দামি স্কুলেও পড়িয়েছে। যখন যা চেয়েছি বলার সাথে সাথে হাজির করেছে। আমি পেয়ে অভ্যস্ত৷ না পাওয়াটা মানতে পারি না। সেটা মানুষ হোক কিংবা অন্যকিছু। এখনো পারছি না।

জায়মা তিশার কথা শুনে ওর কাছে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।

-কিছু জিনিস আমাদের মানতে হয় তিশা। বুঝতে হবে একতরফা কোনোকিছুই কখনো স্থায়ী হয় না। নীরাকে আমরা যেভাবে অপমান করেছি সেটা কি ঠিক ছিলো? বিবেককে প্রশ্ন কর। এখনো তুই যা করতে চাইছিস সেটাও কি ঠিক হচ্ছে?

তিশা কিছুই বললো না। চুপ করে রইলো। জায়মা বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। তিনি বললেন।

-এসব থেকে বেড়িয়ে আয় তিশা। নইলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। কখনোই না। এমনিতেই আমি সবার চোখে ঘৃণ্য একজন। এখন তোর জীবনটা বরবাদের পেছনেও আমি দায়ী হবো। সেটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না। নিজের কথাটা ভাব। এরকম করে দিনশেষে কি পাবি? কিচ্ছু না।

এবারও তিশা জায়মার কথার কোনো প্রতিউত্তর করলো না। তার একবার আসাদের সাথে দেখা করতে হবে। দুইদিন যাবত আসাদটা ফোনও ধরছে না৷ কি সমস্যা হয়েছে সেটা তো জানতে হবে। তিশা মনে মনে এসবই ভাবছে।

জায়মা অশ্রুসিক্ত চোখে তিশার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনের সব কথা, মুখের সব কথা ব্যয় করেও তিশাকে কিছু বোঝাতে পারছেন না। এই দুঃখই তাকে শান্তি দিচ্ছে না।

তিতলির ইদানিং নির্বানের কথা খুব মনে পরে। তবে সে নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নেয়। তিতলি জানে এখনই এসব ভাবার উপযুক্ত সময় না। তবুও আনমনেই নির্বানের খেয়াল এসেই যাচ্ছে। আজ মিলা আর রেহানের সাথে ঘুরতে গিয়েও তার মনে হচ্ছিলো নির্বান হয়তো আশেপাশেই আছে। তবে সে এদিক ওদিক তাকিয়েও নির্বানকে পায়নি। তারপর থেকেই সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো। ঘুরাঘুরি শেষে বাড়িতে আসার পর সে তার বারান্দায় একাই চুপচাপ বসে ছিলো। মিলা এসে দেখলো তিতলি অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। সে পেছন থেকে এসে ধাক্কা দিলো। হুট করে ধাক্কা দেওয়াতে তিতলি ভয়ে লাফিয়ে উঠলো। মিলা তিতলির অবস্থা দেখে হেসে ফেললো। তিতলি বুকে থুথু দিয়ে বললো।

-মিলা আপু। ভয় পাইয়ে দিয়েছো তুমি একদম। আল্লাহ্ আরেকটু হলেই তো মরে যেতাম।

তিতলির কথা শুনে মিলা হাসতে হাসতে বললো।

-এতো ভীতু কেন মেয়েটা? দিনে দুপুরে এমন আনমনা হয়ে কি ভাবছো? কারো প্রেমে টেমে পরে গেলে নাকি?

মিলার কথা শুনে তিতলি চমকে গেল। তারপর দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো।

-আরে নাহ্! কি যে বলো প্রেম আর আমি। আমার দুই দুইটা ডেঞ্জারাস ভাই থাকতে আমি করবো প্রেম। ও মাই গড!

-যাই ই বলো এসব প্রেমেরই লক্ষন। এমন অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া। একা একাই হাসা। এসবই প্রেমের লক্ষন। আর আমার মনে হচ্ছে তুমি প্রেমে পরেছো!

ভ্রু নাঁচিয়ে দুষ্টুমি করে বললো মিলা। রেহান তিতলির ঘরে মোবাইলের চার্জার খুঁজতে এসেছিলো। তখনই তার কানে মিলার কথাটা গেল। সে দ্রুতগতিতে বারান্দায় গেল। জোরে চেঁচিয়ে বললো।

-কে প্রেম করে তিতলি? কার সাথে প্রেম করে? কোন ছেলে? কার এতো বড় সাহস দেখি একবার।

রেহান এতো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো যে মিলা আর তিতলির কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। রেহানের কান্ড দেখে মিলা আর তিতলি বিরক্ত হলো। মিলা রেহানের হাতে চিমটি কেটে বললো।

-চুপ করো। কেউ কারো সাথে প্রেম করছে না। আর করলেও এরকম চেঁচানোর মানে কি?

মিলার চিমটি খেয়ে আর মিলার কথা শুনে রেহান রেগে গেল।

-মানে? প্রেম করবে কেন? ওর এখন লেখাপড়ার বয়স। ও কেন প্রেম করবে?

রেহানের ক্রমাগত কথায় মিলার ইচ্ছে করলো রেহানের মাথা ফাটিয়ে দিতে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বললো।

-ইয়া আল্লাহ্! এরকম চেঁচানোর কি আছে? আশ্চর্য তো। তিতলি কোনো প্রেম টেম কিছুই করছে না। আমি দুষ্টুমি করে বলেছি।

মিলার কথা শুনে রেহান শান্ত হলো। তিতলি রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো।

-ছোট ভাই তুই একটা যা তা। আমি প্রেম করলে তো সবার আগে তোকেই বলতাম। আর আমার কি এসব ইউজলেস কাজের জন্য সময় আছে? আমি কতো ব্যস্ত থাকি। হাঁদারাম একটা।

বলেই রেহানের বাহুতে একটা চাপড় মেরে দৌড়ে পালালো তিতলি। তিতলির মার খেয়ে রেহান চেঁচিয়ে বললো।

-কত্তবড় সাহস আমাকে মারা? আজ আসুক ভাই আর ভাবিমনি।রোজ রোজ আমার নামে বিচার দেওয়া? আজ তোর নামেই আমি বিচার দিবো।

রেহানের কথা শুনে মিলা খিলখিল করে হেসে ফেললো। রেহান মিলার হাসির আওয়াজ শুনে মিলার দিকে তাকালো। আর তার দৃষ্টি মিলার হাসির দিকে আটকে গেল। বদমেজাজী মিলার হাসি যে এতো সুন্দর সে এটা দ্বিতীয়বারের মতো উপলব্ধি করলো। প্রথমবার মিলার এই সুন্দর হাসি দেখেছিলো যেদিন নীরা আর শিহাবের বিয়ে ঠিক হলো সেদিন। রেহান মিলার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে মিলার হাত ধরলো। মিলা হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

-কি হয়েছে?

রেহান হালকা হেসে বললো।

-বদমেজাজী জোয়ালামুখী টিলার হাসি যে এতো সুন্দর তা তো আগে জানতাম না। রাগী মুখের আড়ালে এই সুন্দর রূপ আড়াল না করলেই নয়?

রেহানের প্রশংসা শুনে মিলার খুব ভালো লাগলো। তবে প্রশংসার আগে বদমেজাজী আর রাগী বলাতে তেমন মেজাজও খারাপ হলো। সেজন্য সে বললো।

-তোমার মতো ছেলের জন্য এরকম বদমেজাজী রাগী হতেই হয়। নইলে তুমি সোজা হবে কি করে?

তিতলির কথা শুনে রেহান হাসতে হাসতে বললো।

-এরকম হাসিখুশি রূপ দেখার জন্য আমি হাজারবার সোজা হতে রাজি আছি।

রেহানের কথা শুনে এবার মিলাও হেসে ফেললো। রেহানের হাতে তখনো মিলার হাতটা ধরা। রেহান মিলার দিকে তাকিয়ে রইলো।

তখনই জহুরা এসে পরলেন। দুজনকে হাত ধরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে প্রচন্ড অবাক হলেন। যেনো বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য দেখছেন তিনি। তার মুখভঙ্গি সেরকমই হয়ে গেল। তিনি বহু কষ্টে গলা খাঁকারি দিলেন। রেহান আর মিলার তখন হুস ফিরলো। জহুরাকে দেখে মিলার ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন না হলেও রেহান প্রচন্ড লজ্জা পেলো। মিলা হাসিমুখে ওভাবেই জহুরাকে জিজ্ঞেস করলো।

-আমাকে খুঁজছিলে খালা?

জহুরা মাথা নাড়লেন। মিলা জিজ্ঞেস করলো।

-কেন খুঁজছিলে?

জহুরার হতভম্ব ভাব তখনো কাটেনি। তিনি সেভাবেই বললেন।

-পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিস চোখের সামনে ঘটতে দেখে সব ভুলে গেছি।

জহুরার কথা শুনে মিলা জোরে হেসে ফেললো। আর রেহান লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারলো না। সে শুধু একটা কথাই ভাবছে মিলা যেখানে এমন সহজ হয়ে আছে। সেখানে সে কেন এতো লজ্জা পাচ্ছে! কি আশ্চর্য কথাবার্তা! মিলা লজ্জা পাচ্ছে না কেন। এদিকে মিলা জহুরার সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেল। রেহান লজ্জা পেয়ে ওভাবেই দাড়িয়ে রইলো। তিতলি এসে রেহানকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো।

-ও হ্যালো কি হয়েছে তোর? এমন স্ট্যাটু হয়ে আছিস কেন?,

রেহান তিতলিকে বাহুডোরে নিয়ে বললো।

-তোর ভাইয়ের কপাল পুড়লো।

তিতলি অবাক হয়ে বললো।

-মানে?

রেহান বিড়বিড় করে বললো।

-কতে শখ ছিলো একটা নরম স্বভাবের লজ্জাবতী বউয়ের অথচ!

তিতলি রেহানের বিড়বিড়ানো দেখে বললো।

-কি বলিস শুনতে পাইনি। আবার বল।

রেহান তিতলিকে নিয়ে হাটতে হাটতে বললো।

-কিছু না। তুই শুধু পড়ালেখা করবি অন্য কোনো দিকে নজর দিবি না ওকে?

তিতলি বিজ্ঞের মতো বললো।

-একই শর্ত আপনার জন্যও প্রযোজ্য।

রেহান তিতলির কথা শুনে হেসে ফেললো।

তিশা আসাদের জন্য অনেকক্ষন যাবত অপেক্ষা করছে। কিন্তু আসাদের আসার কোনো নাম নেই। দুইদিন যাবত ফোন তো ধরেইনি। আজ যাও ধরেছে। দেখা করতে আসার কথা বলে উধাও হয়ে আছে। এখনো আসার নাম নেই। তিশা কখনোই কারো জন্য এতো অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত না। সে ই সবাইকে অপেক্ষা করিয়েছে। আসাদের ওপর সে প্রচন্ড রেগে আছে। তিশা বসে থাকতে থাকতেই আসাদ এসে গেল। তিশার সামনে বসে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললো।

-স্যরি লেট হয়ে গেল। এক্সট্রেমলি স্যরি!

তিশা আসাদের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো।

-তোমার স্যরি দিয়ে আমি কি করবো? আধা ঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছো তুমি আমাকে। সময়জ্ঞান নেই না?,

তিশার কথা শুনে আসাদ হাসতে হাসতে বললো।

-সে তো তুমিও সবসময় আমাকে অপেক্ষা করাতে মনে সেই? এক ঘন্টা দুই ঘন্টা এমনও আছে চার ঘন্টাও অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। এখন অবশ্য তুমি সময়মতোই আসো।

আসাদের কথা শুনে তিশা এই ব্যপারে আর কিছু বললো না। সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল।

-দুই দিন ফোন ধরোনি কেন? কোথায় ছিলে?

-মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো৷ সেজন্যই বিজি ছিলাম।

আসাদের কথা শুনে তিশা চিন্তিত স্বরে বললো।

-কি বলো! কিভাবে হয়েছে? আন্টি ঠিক আছেন এখন?

আসাদ তিশার প্রশ্নের উত্তরে বললো।

-ঠিক আছেন আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি খুশি হয়েছি তুমি আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছো বলে!

আসাদের কথা শুনে তিশার বিরক্ত হয়ে বললো।

-একজন মানুষ এক্সিডেন্ট করেছেন। আর আমি ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করবো না?

আসাদ হাসতে হাসতে বললো।

-না তুমি তো এরকম না তাই আরকি।

আসাদের কথা শুনে তিশা রেগে গেল। সেটা দেখে আসাদ বললো।

-ওকে ওকে রেগে যেও না। জাস্ট মজা করেছি।

আসাদের কথা শুনে তিশা শান্ত হলো। তারপর বললো।

-নীরার সাথে কতোদূর?

আসাদ হতাশ কন্ঠে বললো।

-নীরার খোঁজ আগে দিলে কি হতো আমি ওকেই বিয়ে করে নিতাম। মায়েরও বেশ পছন্দ ওকে।

তিশা আসাদের দিকে সরু চোখে তাকালো তারপর বললো।

-তোমাকে তো বলেছিই সেটা এখনো সম্ভব। মিসআন্ডার্সট্যান্ডিং ক্রিয়েট করছি। সম্ভব হতে কতোক্ষন?

-কই ওদের দেখে মনে তো হয় না। ওদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবোঝি চলছে।

তিশা বিরক্ত হয়ে বললো। যা বলার স্পষ্ট করে বলো।

আসাদ হাসিমুখে বললো।

-আমার মনে হয় না তোমার এসব সিলি ট্রিক্স ওদের সম্পর্কের ওপর বিন্দু মাত্র প্রভাব ফেলবে। সেদিন হসপিটালে শিহাবের চোখে আমি নীরার জন্য যেই ভালোবাসাটা দেখেছি। তাতে অন্তত সম্ভব না। মাকে নীরাই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো। শিহাব ভেবেছিলো নীরার কিছু হয়েছে। ও তো একদম পাগলের মতো হসপিটালে হাজির হয়েছে সেদিন। সবার সামনেই নীরাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। নীরাকে হারানোর ভয় ছিলো ওর চোখে আর ছিলো অফুরন্ত ভালোবাসা।

আসাদের কথা শুনে তিশার চোখে জল ভীড় করলো। অনেককিছু বলতে চাইলেও বলতে পারছে না। সব কথা গলায় আটকে রইলো। আসাদ হেসে তিশার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে কটাক্ষ করে বললো।

-ভীষষ ইমোশনাল তুমি। সামান্য কথায় চোখে পানি এসে পরলো?

তিশার আসাদের কথা শুনে রেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে রাগলো না। নিজেকে সামলে বললো।

-তোমারও কি নীরাকে খুব পছন্দ?

আসাদ মাথা নেড়ে বললো।

-অনেস্টলি ওকে আমার খুব পছন্দ। ওর সাথে থাকলে ওকে পছন্দ না করে থাকা দায়। ও এমনই একজন। শুধু ওই একটা সমস্যা ছাড়া ওর মধ্যে তো আর কোনো সমস্যাই নেই। ইভেন খুব সুন্দরীও।

আসাদের কথা শুনে তিশা হেসে বললো।

-ক্যারেক্টারলেস!

আসাদও হাসলো। বললো।

-এদিকটাতে তো অন্তত আমাদের মিল আছে। তুমিও অন্যের হাজবেন্ডের দিকে নজর দিচ্ছো। আর আমিও অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিচ্ছি৷ একদম মিলে গেছে।

অন্যান্য দিন হলে তিশা আসাদকে খুব কটু কথা শুনিয়ে দিতো। স্ল্যাং ইউজ করে যা নয় তাই বলতো। তবে আজ বললো না। উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকালো। আসাদও তিশার আচরণ দেখে খুব অবাক হলো। কিন্তু সে ও কিছু বললো না। চুপচাপ তিশাকে পর্যবেক্ষন করলো। বোঝার চেষ্টা করলো তিশার মনের ভেতর কি চলছে!

নীরা বাড়ি ফিরে সবার সাথে গল্প করলো। সবাইকে রাতের খাবার খাওয়ালো। শিহাবের ফিরতে দেরি হবে বলে নিজে শিহাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সবাই ঘুমাতে চলে গেলেও সে বসে রইলো। তারপর কিছুক্ষন হাটাহাটি করতে শুরু করলো। রেজা সাহেব নিচে পানি খেতে এসে দেখলেন নীরা হাটাহাটি করছেন। তিনি এগিয়ে গেলেন। বললেন।

-এতো রাতে এখানে হাটাহাটি করছিস কেন?

নীরা রেজা সাহেবকে দেখে হঠাত একটু চমকে গিয়েছিলো। তারপর নিজেকে সামলে বললো।

-এমনিই বাবা। তোমার কিছু লাগবে?

রেজা সাহেব হেসে বললেন।

-শিহাবের জন্য অপেক্ষা করছিস বললেই তো হয়। না কিছু লাগবো না। পানি নিতে এসেছিলাম।

রেজা সাহেবের কথা শুনে নীরা একটু লজ্জা পেলো। রেজা সাহেব বললেন।

-ঘরে গিয়ে শুয়ে পর। এতো রাত জাগতে হবে না। আমি শিহাবকে বলে দিবো যেনো রাতে তাড়াতাড়ি ফেরে।

নীরা মাথা নাড়লো শুধু। রেজা সাহেব হেসে চলে গেলেন। নীরা ঘরে যাবে বলেও গেল না। উল্টো বাইরে গেল। লনে একা একা হাটাচলা করার ইচ্ছে হলো হঠাত। মাঝেমাঝে মানুষের বোধহয় একা থাকতে ভালো লাগে। একা হাটতে ভালো লাগে,একা সময় কাটাতে ভালো লাগে। নীরারও আজ একা একা হাটতে ইচ্ছে করছে। সে একাকী হাটা শুরু করলো৷ বাইরের শীতল বাতাস বইছে। শীতল বাতাস নীরার চোখমুখ ছুঁয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে সে সেই বাতাস অনুভব করলো।

শিহাব আজ গাড়ির হর্ণ না বাজিয়েই বাড়িতে ঢুকলো। গাড়ি পার্ক করে হেটে যেতে লাগলো। হঠাত লনের আলোতে সে নীরাকে দেখতে পেলো। তার কাছে মনে হলো কোনো অচিনপুরের রাজকন্যা পথ হারিয়ে ভুল করে তার বাড়ির লনে হাটছে। অচিনপুরের রাজকন্যার রূপের আলোতে চারদিক যেনো ঝলমল করছে। শিহাব এই দৃশ্য দেখে হাটা থামিয়ে দিলো। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আবার তাকালো। সে চোখে ঝাপসা দেখছে! নীরাকে সে অত্যাধিক ভালোবাসে। নিজে যতোটা দেখায় তারচেয়ে বহুগুন বেশি ভালোবাসে। তবে প্রকাশ করে না। যা প্রকাশ করা হয় তার চেয়ে অনেকাংশে বেশি সে ভালোবাসে যার কোনো পরিমাপ হয় না। প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত পরিমাপ শুধু বাড়ছে। ভবিষ্যতেও বাড়বে। কখনোই কমবে না এটা শিহাব জানে। একসময় তার মনে হতো সে বোধ হয় এই কঠিন মনের অসম্ভব রূপবতী মেয়েটিকে তার নিজের করে পাবে না। যখনই সে এসব ভাবতো তার দমবন্ধ লাগতো। মনে হতো এই মানুষ তার না হলে সে জীবনে চলতেই পারবে না। অবশেষে যখন সে নীরাকে নিজের করতে পারলো। এতোদিন পরেও নীরা যখন তার পাশে ঘুমিয়ে পরে সে চুপিচুপি বিস্ময় নিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বিশ্বাস হয় না যার জন্য এতোকিছু সে আজ তারই পাশে। মনে চাপা আনন্দ কাজ করে। দু চোখ ভরে সে তার সহধর্মিণী কে দেখে। দেখতেই থাকে। দেখতে তো বারন নেই। মাঝেমাঝে চোখে পানিও এসে যায় হয়তো অত্যাধিক খুশি আর প্রাপ্তিতে।

নীরা হাটতে হাটতে চোখ খুলে আবার বন্ধ করলো। এতো সুন্দর বাতাস যে শুধু চোখ বন্ধ করে অনুভব করতেই ইচ্ছে করে। এরমধ্যে হঠাত তার পেছনে তবে খুব কাছে একজনের ঘ্রাণ পেলো। নির্দিষ্ট পারফিউম না। নির্দিষ্ট ব্যক্তির ঘ্রাণ। যেই ঘ্রাণ এখন তার অনেক প্রিয়। অনেক অনেক ভীড়ের মাঝেও সে এই ঘ্রাণ পেয়েই মানুষটাকে চোখ বন্ধ করে আলাদা করতে পারবে। নীরা চোখ খুলে হালকা হেসে দ্রুত পেছন ফিরলো। আর শিহাবের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। শিহাবও থতমত খেয়ে নীরাকে দ্রুত ধরে ফেললো। নীরা নাকে ব্যথা পেয়ে বললো।

-দ্বিতীয় বারের মতো আমার নাকে ব্যথা দিয়েছো।

নীরার ব্যথাতুর কন্ঠ শুনে শিহাবের চোখে বেদনা ফুটে উঠলো। সে নীরার নাক ছুঁয়ে অনুতাপের সুরে বললো।

-স্যরি। খুব ব্যথা পেয়েছো? চলো ঘরে চলো কিছু লাগিয়ে দেই।

নীরা শিহাবের হাত সরিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো।

-থাক,তেমন বেশিও লাগেনি। কিছু লাগাতে হবে না।

শিহাব সন্দেহের সুরে বললো।

-শিওর?

নীরা হেসে বললো।

-হান্ড্রেট পার্সেন্ট! কতো সুন্দর শীতল বাতাস আজকে তাই না?

শিহাব নীরাকে দেখতে দেখতে বললো।

-হু একদম তোমার মতো শীতল আর সুন্দর।

নীরা আবারও হেসে বললো।

-শেষমেষ বাতাসের সাথে?

শিহাব একধ্যানে তাকিয়ে বললো।

-হু!

তারপর হঠাত পেছন থেকে সামনে হাত বাড়িয়ে বকুল ফুল আর শিউলি ফুলের মালা ধরলো। নীরা মালা দেখে খুশি হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে দিলো নিজ থেকে। শিহাব নীরাকে হাত বাড়াতে দেখে খুশি হলো। খুব যত্ন নিয়ে দুটো মালাই হাতে বেঁধে দিলো। নীরা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো।

-অনেকদিন পর। থ্যাংক ইউ!

শিহাব একটুখানি হাসলো। নীরা সেই সুন্দর হাসির দিকে তাকিয়ে বললো।

-তোমাকে তো কিছুই দিলাম না কখনো।

শিহাব নীরার কথা শুনে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো।

-তোমাকে মনভরে দেখতে দিলেই চলবে। আর কিছুই লাগবে না। যদিও তোমাকে দেখতে আমার তোমার অনুমতির প্রয়োজন নেই। আর না তোমার কোনো বারণ শোনার প্রয়োজন আছে। আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি দেখতেই থাকবো!

নীরা হুট করে একটা অভাবনীয় কাজ করে বসলো একটু উচু হয়ে শিহাবের জ লাইনে স্পর্শ করলো। শিহাব বিস্ময় নিয়ে নীরার দিকে তাকালো। নীরা দ্রুত সরে দাড়াতে চাইলো। কিন্তু শিহাব তাড়াতাড়ি ধরে ফেললো। অবাক হয়ে বললো।

-ইট্স ইউ? ও মাই গড! আনবিলিভেবল!

নীরা শিহাবের রিয়্যাক্সন দেখে হাসলো। শিহাব নীরার কপালে দীর্ঘ স্পর্শ করে জড়িয়ে ধরে বললো।

-থ্যাংক ইউ।

নীরাও শিহাবকে আলতো করে ধরে বললো।

-ফর হোয়াট?

শিহাব হালকা হেসে বললো।

-চুপ করে থাকো। এভাবেই থাকো। কথা বলবে না।

নীরা আর কিছু বললো না। চারদিকে সুন্দর শীতল বাতাস বইছে। সেই বাতাস দুজনকেই মহাআনন্দ নিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে।

-চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here