অপেক্ষার প্রহর পর্ব-৭

0
651

অপেক্ষার প্রহর (পর্ব-৭)
তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?এই রচনাটা প্রত্যেক মানুষকেই ছোট বেলায় পড়তে হয়েছিল, পরীক্ষার খাতায় লিখতে হয়েছিল। বেশির ভাগের জীবনের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া।বাবা- মারা এই রচনা না লিখলেও ছেলে-মেয়ের চাইতে তাদের আগ্রহ বেশি থাকে ছেলে-মেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। ছোটবেলায় পড়াশুনায় ভাল রেজাল্ট করলে আগ্রহটা আরও পাকাপোক্ত হয়ে উঠে।অমনি শুরু হয়ে যায় তোকে অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে অথবা ডাক্তার হতে হবে। এগুলো হতে না পারলেও অনেক বড় সরকারী অফিসার হতে হবে। তাহলে আমাদের আর বড় বড় অফিসারদের ঘুষ দেয়া লাগবে না, ডাক্তারের পিছনে এত এত টাকা খরচ করতে হবে না।বড় হতে হতে জীবন, জীবনের লক্ষ্য সব পালটে যেতে থাকে। এমনকি যে ছেলে বা মেয়েটা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শিক্ষাজীবনের শেষের দিকে তারও মনে হয় কোনভাবে একটা চাকরী যোগাড় করে সংসার ধর্ম পালন করে জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই হয়।
ছোটবেলার রচনার খাতায় অন্য সবার মত ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও শিলা জানত না ডাক্তার হওয়ার জন্য কতগুলো ধাপ পেরোতে হবে। ক্লাসে কোনদিন প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি এমন টাইপের স্টুডেন্ট না হলেও পরীক্ষায় বরাবর ভাল ফলাফল করে এসেছে শিলা।সেটা কখনই কোন খুশির ব্যাপার হয়নি শিলার বা শিলার পরিবারের কাছে। বড় সন্তান মেয়ে হওয়ার পর শিলার মা রাহেলার ইচ্ছে ছিল একটা ছেলে হওয়ার। কিন্তু পরবর্তীতে আবার মেয়ে হওয়ায় আর বড় মেয়ের চাইতে ছোট মেয়ের গায়ের রঙটা একটু ময়লা হওয়ায় রাহেলার শিলার প্রতি মনোযোগটা কমই ছিল। মেয়েদের পড়াশুনা নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা ছিল না তার।যে মেয়ে বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, পর হয়ে যাবে- তার জন্য, তার পড়াশুনার জন্য এত চিন্তা করে কি লাভ?তার উপর আবার মিলা মিডিয়াম টাইপের স্টুডেন্ট হওয়ায় শিলাকেও তেমন গোনায় ধরা হয়নি। শিলাও ছোটবেলা থেকে এই ধারণা নিয়ে ছিল জন্মেছি, পড়াশুনা করব, মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিব, বিয়ে হবে-সংসার হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেকে নিয়ে বাড়তি কোন চাওয়া ছিল না। তাই ময়মনসিং মেডিকেল কলেজে যখন টিকল তখন শিলা বাদে পরিবার- আত্মীয়স্বজন সবার টনক নড়ল। রাহেলা সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন, “মেয়েটা তেমন পড়াশুনাই করতে চায় না, আরেকটু ভাল মত পড়লে তো ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেত।” ব্যাপারটা একদমই সত্যি না। শিলা বরাবরই ভালভাবে পড়াশুনা করে এসেছে। শিলার জীবনটা ছিল পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা টাইপের।
বর্তমানে একটা সরকারী হাসপাতালে অনারারী করে শিলা। সকালে এসে পুরনো রোগীদের ফলো আপ করা, ট্রিটমেন্ট এডজাস্ট করা, নতুন রোগীর হিস্ট্রি রিভিউ, ট্রিটমেন্ট রিভিউ করা, রাউন্ড, ক্লাস, সেমিনার ইত্যাদি হাজারটা কাজ থাকে। দম ফেলার সময় থাকে না। এমনিতেই সিজন চেঞ্জের কারণে হাসপাতালে আজ রুগির সংখ্যা বেশি ছিল। তার উপর আবার একটা এক্সিডেন্টের কেস ছিল।পেছন থেকে বাস এসে মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। দুইজন যাত্রীর মধ্যে একজন স্পট ডেড। বাকি জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আইসিইউতে আছে। মৃত ব্যাক্তির পরিবারের লোকজন হাসপাতালে কান্নাকাটি করছিল।পাঁচ বছর মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করেও রোগীর মৃত্যু ব্যাপারটা এখনও শিলার মনকে বেশ নাড়া দেয়। হয়তো নব্য ডাক্তার বলে এই ধরণের আবেগ বেশি কাজ করে। আজ সারাদিন এই বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ থাকবে শিলার। যদিও মন খারাপ করার মত সময়ও তার নেই। নব্য ডাক্তারদের তিন জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে হয়-সরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক আর বাসা। এর মাঝে আবার থাকে পড়াশুনা।সরকারী হাসপাতালে অনারারী করে বিদ্যা অর্জন করা হলেও অর্থ উপার্জন করা যায় না। বরং হাসপাতালে যাতায়াতের খরচ যোগাড় করার জন্য কোন ক্লিনিকে কাজ করতে হয়। শিলাকেও হাসপাতালের পর ক্লিনিকে ডিউটি করতে হয়।শওকত সাহেব সরকারী চাকরী থেকে রিটায়ার্ড করার পর পেনশনের একটা বড় এমাউন্ট দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেন। ভবিষ্যতে স্বামী-স্ত্রী দুইজনে থাকার জন্য। কিছু টাকা জমা করে রাখেন শিলার বিয়ের জন্য। বাকি টাকাটা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা।তাই দিয়ে বাবা-মেয়ের সংসার চলছে। কিন্তু বসে খেলে রাজার ধনও ফুরায়। সংসারের টাকাটা শিলাই ব্যাংক থেকে উঠায়। তাই সঞ্চিত টাকার পরিমাণটা শওকত সাহেবের চাইতে শিলাই ভাল জানে আর এটাও জানে পরিমাণটা সন্তোষজনক নয়। ক্লিনিকে ডিউটি করে অল্প অল্প করে জমাতে হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও চলে অর্থের কারচুপি। সিনিয়র ডাক্তারকে এসিস্ট করেও অনেক সময় পাওয়া যায় না এসিস্ট ফি। এমনকি ইমারজেন্সি ফি পাওয়া যাবে কিনা তাও অনেকটা অনিশ্চয়তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অথচ মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে একের পর এক খরচের চিন্তা- পার্ট ওয়ানের ফি, দিলিপ স্যারের ফি ইত্যাদি ইত্যাদি। সংসারের চিন্তা তো মাথায়ই আনা যায় না।
হাসপাতালের ডিউটি শেষে সোজা ক্লিনিকেই আসল শিলা। অন্যদিন আগে বাসায় আগে যায়। ক্লিনিকটা বাসার কাছেই। মূলত শওকত সাহেবকে দেখার জন্যই শিলার বাসায় ফেরা।আজকে এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে হাসপাতাল থেকে ফিরতে আর বাসায় মিলা আছে। তাই বাসায় না গিয়ে সরাসরি ক্লিনিকে চলে আসল। ত্রিশ বেডের এই ক্লিনিকটা খারাপ চলে না।ক্লিনিকের মালিক ডাঃ আশরাফ আলী ঢাকা মেডিকেলের প্রোফেসর। এছাড়া আরও কয়েকজন বড় বড় ডাক্তার বসেন এই ক্লিনিকে। তারা ৫ টার পর আসেন। তারপর থেকে তারা রুগি দেখা শুরু করেন। সেই অনুযায়ী রুগিদের সিরিয়াল দেয়া। রক্ত পরীক্ষা, আলট্রাসোনোগ্রাম সহ কিছু ছোট খাট টেস্ট করার সুযোগ আছে এই ক্লিনিকে। বড় এবং জটিল টেস্ট হলে রুগিদের পাঠিয়ে দেয়া হয় কাছের একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
অনেকগুলো কাজ করতে হল ক্লিনিকে। ক্লিনিকেও সেই এক ডিউটি। রোগীর ফলোআপ করা, ট্রিটমেন্ট রিভিউ করা, নতুন ট্রিটমেন্ট দেয়া। এক সিজারিয়ান রুগির ড্রেসিং করতে হল।সিজারের পর Severe Wound Infection হয়ে গেছে। অনেক সময় নিয়ে ড্রেসিং করতে হল। এরপর দুটো সার্জারি ছিল। দুটোই ডেলিভারি ছিল।
সারাদিনের পরিশ্রম শেষে প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিল শিলা। সামনে নীরার বিয়ে। নীরা শিলার বান্ধবী। ক্লিনিক থেকে বেরোতেই প্রায় আটটা বেজে গেল। কিছু কেনাকাটা ছিল। এত রাতে আর মার্কেটে যেতে ইচ্ছে করল না। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে সুপার শপ থেকে কিছু দরকারি বাজার শেষে বাসা ফিরে দেখল মিলা ওর বাসায় ফিরে গেছে। মিলার শাশুড়ির প্রেশারটা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।পিয়াসকে রেখে গেছে বাসায় শওকত সাহেবের সাথে। মিলার বাসা দুটো রোড পরেই। তাই যখন খুশি বাবার বাসায় আসতে পারে মিলা। পরে মিলাদের বাসা থেকে কেউ এসে পিয়াসকে নিয়ে যাবে। শিলার ধারণা মিলা রাশেদকে পাঠাবে। শিলার ধারনা মিথ্যে প্রমাণ করে মিলার স্বামী কবির এসে পিয়াসকে নিয়ে যায়।

পরিশ্রমের কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক শোয়ামাত্র শিলা ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটায় শিলার ঘুম ভেঙে যায়। জানালাটা খোলা ছিল। জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল শিলা। এত সুন্দর লাগছে বৃষ্টির দৃশ্যটা দেখতে। কতদিন এত আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টি দেখেনি শিলা। হাসপাতাল-ক্লিনিক-বাসা করতে করতে নিজেকে একটা যন্ত্র করে ফেলেছিল নিজেকে। রোগী আর শওকত সাহেব ছাড়া শিলার যেন আর কিছু নেই এই জীবনে। তবু কখনও কখনও মনে হয় কেউ কি থাকতে পারতো না তার জীবনে? কারো ফোনের অপেক্ষায় থাকতে পারতো না সে?মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ থাকলে খুব ভাল হত। তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করত। তার জন্য কোন পার্কে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করত।দেরি করে আসলে কিছুটা মান অভিমান হত।এমন বৃষ্টির রাতে ফোন করে তার ঘুম ভাঙ্গাত। ঘুম ঘুম চোখে ফোন ধরে বলত, “কি হয়েছে? এত রাতে ফোন দিলে যে?”
“তুমি ঘুমুচ্ছ? দেখ বাইরে কি চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে।”
“শিলা, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি হবে। এতে অবাক হবার কি আছে?”
“আমি অবাক হচ্ছিনা বুদ্ধু। আমি মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছি। তুমি আর ঘুমিয়ে থেক নাতো। ওঠ। উঠে বৃষ্টি দেখ।”
“আমি বৃষ্টি দেখলে কাল সকালে আমার কাজগুলো কে করবে শুনি? তুমি নাকি তোমার এই বৃষ্টি?”
“আচ্ছা, তুমি এত আন-রোমান্টিক কেন?”
“কারন তুমি অনেক রোমান্টিক। দুজনের এত এত রোমানটিসিজম থাকলে সংসার যে ভেসে যাবে মহারানী।”
আচ্ছা, শিলা এই ফোনালাপ কল্পনা করছে কেন? মানুষটা তো তার পাশেই থাকতে পারে। আচ্ছা বৃষ্টির দিনে তাদের মধ্যে কি কিছু হবে? শিলা মাঝে মাঝে মানুষটাকে কল্পনা করে। কেমন হবে মানুষটা? তার গায়ের রঙ একটু কাল। মানুষটা কি ফর্সা হবে? লম্বা হবে? চশমা পড়বে? শিলাকে কি অন্য কোন নামে ডাকবে? শিলা কি মানুষটাকে বিশেষ কোন নামে ডাকবে?
মিলা যতই চেষ্টা করুক না কেন শিলা মোটেই রাশেদকে বিয়ে করবে না। যদিও রাশেদ দেখতে যথেষ্ট ভাল। যে কোন মেয়ে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করবে এমন টাইপের। মানুষটা কি শফিকের মত হবে? শফিক সাহেব মানুষটা হয়তো ভালই।শিলাই বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে লোকটার সাথে। প্রয়োজনেই তো মানুষ একজন আরেকজনের কাছে যাবে। এতে অস্বাভাবিকের কিছু নেই। একদিন ওনাকে চায়ের দাওয়াত দিতে হবে বাসায়। বাসার ভেতর না গেলেও এক ঝলকে বাসাটায় একটু চোখ বুলিয়েছিল। একটা বইয়ের তাক আছে। একদিন যেতে হবে কি কি বই আছে দেখার জন্য। চা খেতে খেতে বই নিয়ে গল্প করা যাবে। আচ্ছা লোকটা কি তার সাথে কোন অভদ্রতা করবে? গল্প করতে করতে হঠাৎ করে মুখের সামনে চুল এসে গেলে তাকে ছোঁয়ার অজুহাতে চুলগুলো সরিয়ে দিবে? শিলার কি উচিত হবে তাকে সেই সুযোগ করে দেয়ার?
শিলা অবাক হয়ে গেল। রাত বাজে দুটো বেজে আটত্রিশ মিনিট। এখন সে শফিকের কথা ভাবছে কেন? নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত লাগছে। বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। শিলা বিরক্তি দূর করার জন্য গান শুনতে লাগলো মোবাইলে, “কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে।” শিলার খুব পছন্দের একটা গান। শিলার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে প্রচণ্ড। এত রাতে বৃষ্টিতে ভেজা সম্ভব না হলেও দুইদিন পর শিলার ইচ্ছে পূরণ হল। ছুটির দিন দুপুরবেলা শিলা ছাদে উঠে দুইহাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজল। শিলা টেরও পেল না আড়াল থেকে এক জোড়া চোখ প্রচণ্ড মুগ্ধ হয়ে শিলার বৃষ্টিতে ভেজা দৃশ্য দেখছে।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here