অপেক্ষার প্রহর পর্ব-৮

0
716

অপেক্ষার প্রহর (পর্ব-৮)
কলমটা পরীক্ষা শেষের দুই মিনিট আগেই শেষ হতে হল? বিরক্ত লাগছে অপর্ণার। শেষ প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক মত দিতেই পারল না।
“কিরে? কেমন দিলি পরীক্ষা?” মিলি প্রশ্ন করল।
“ভালই দিচ্ছিলাম। কিন্তু শেষে তো লিখতেই পারলাম না। কলমের কালি শেষ হয়ে গেল শেষ মুহূর্তে।” অপর্ণা জবাব দিল।
“কেন? এক্সট্রা কলম ছিল না?”
“না, নইলে কি আর এভাবে বলি? তোর কেমন হল? স্যার দেখি এবার সহজ প্রশ্নই করল। কঠিন করলে তো একদম মাঠে মারা যেতাম।”
“সেটাই ভাল হত। এত কষ্ট করে এত কিছু পড়লাম আর স্যার কিনা আগের বছরের প্রশ্ন থেকে প্রশ্নও করল। এটা কিছু হইল?” অপর্ণা আর তর্কে গেল না। মিলি ওদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। অপর্ণার রেজাল্ট মোটামুটি। পাস করে কোনমতে একটা চাকরী যোগাড় করতে পারলেই ও খুশি।
“অপর্ণা, নীলক্ষেতে যাবি?” রাসেল জিজ্ঞেস করল। প্রায়ই অপর্ণারা পরীক্ষা শেষে নীলক্ষেতে তেহারি খেতে যায়।
“নারে, তোরা যা।” অপর্ণার আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। বাসায়ও যেতে ইচ্ছে করছে না। দাদাভাইয়ের বাসায় যাবে? বৌমনি কি বাসায় আছে? ইয়াসমিন এসময় মাঝে মাঝে লাইব্রেরীতে যায়। ফোন করে দেখতে হবে। পরীক্ষার জন্য যাওয়া হচ্ছে না। আজ একটু ঘুরে আসা যেতে পারে।
“মিলি তুই যাবি?” রাসেল মিলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
“নারে। হলে যাব। খুব টায়ার্ড লাগছে।” প্রত্যাশিত উত্তর। মিলি কখনই তেমন ওদের সাথে বাইরে বেড়াতে যায় না। সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়েই থাকতে পছন্দ করে।
ইয়াসমিনকে ফোন করার জন্য অপর্ণা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে। ১৬টা মিসকল। প্রত্যয়ের। প্রত্যয় তো এতবার ফোন দেয় না। কি কারনে এতবার ফোন দিয়েছে? কোন অঘটন ঘটল নাকি? অপর্ণা ভয়ে ভয়ে ফোন করল।
“কি খবর? পরীক্ষা কেমন হল?”
“প্রত্যয়, কিছু হয়েছে? এতবার ফোন দিলে যে?”
“Excitement- এ ভুলে গেছি যে তোমার পরীক্ষা চলছে। তাই এত বার ফোন দিয়ে ফেলেছি।”
“এত বেশি Excitement এ ছিলে যে ১৬ বার ফোন করার পর মনে পড়ল যে আমার পরীক্ষা ছিল?”
“বললে না তো পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
“পরীক্ষা ভালই হয়েছে। কিন্তু তুমি এত খুশি কেন বলত?”
“তুমি এখন কোথায়?”
“ইউনিভার্সিটি। আবার কোথায়?”
“তুমি এখনি একটা রিক্সা নিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে আস। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমাকে পিক আপ করছি” এই বলে প্রত্যয় ফোন রেখে দিল। পাঁচ মিনিট পর যখন প্রত্যয় অপর্ণাকে নিজের রিকসায় তুলে নিয়ে গেল অপর্ণার পাশ দিয়ে রাসেল যেতে যেতে বলল, “হুম, এই জন্যই আমাদের সাথে আসতে চাওনি বাছা।” অপর্ণা লজ্জা পেয়ে গেল। তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে। প্রত্যয়ের আজ কি হল? কোথাও যেতে হলে দুইজন আলাদা আলাদা উপায়ে গন্তব্যে যায়। প্রত্যয় ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে জয়েন করার পর থেকে এই ব্যবস্থা। প্রত্যয় বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্রেজুয়েশান কমপ্লিট করে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অপর্ণাকে নিয়ে রিকসায় ঘুরেছে প্রচুর, দুজনকে অনেকবার টিএসসি, ইউনিভার্সিটি, নিউমার্কেটে ঘুরতে দেখা গেছে। কিন্তু প্রত্যয় লেকচারার হিসেবে জয়েন করার পর থেকে প্রত্যয় একসাথে ঘুরা বাদ দিয়ে দেয়। প্রত্যয়ের মতে স্টুডেন্টরা দেখলে তার ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে, তাই আগের মত যখন-তখন, যেখানে-সেখানে দেখা করা যাবে না। প্রথমে একটু গাইগুই করলেও অপর্ণা শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল। সেই প্রত্যয় আজ নিজে থেকে অপর্ণাকে রিকসায় করে ঘুরাতে নিয়ে যাচ্ছে দেখে অপর্ণা সত্যি অবাক হয়ে গেল।
“তোমার কি হয়েছে বলত?” অপর্ণা প্রত্যয়কে জিজ্ঞেস করল।
“অপা, আমার স্কলারশিপটা হয়ে গেছে। প্রফেসর মেইল করেছে। সামনের মাসের মধ্যে ওরা সমস্ত কাগজপত্র পাঠিয়ে দিবে।” প্রত্যয় অপর্ণার হাত ধরে জোরে জোরে বলতে লাগল।
“Congratulations” অপর্ণা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। আনন্দে প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। কিন্তু রিক্সায় কাজটা ঠিক হবে না। “কখন জানলে?”
“আরে সকালে ক্লাসের ব্রেকে মেইল চেক করতে গিয়েই তো দেখলাম। অপা আমার যে কি খুশি লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।”
“আমার না এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এই তুমি আমাকে একটা জোরে করে চিমটি দাও তো।” প্রত্যয় সত্যি সত্যি জোরে চিমটি দিল অপর্ণাকে। “এই এত জোরে দিতে বলেছি নাকি?” অপর্ণা বলে উঠল। দুজনেই হাসতে লাগলো।
“কি খাবেন বলুন ম্যাডাম?” রেস্টুরেন্টে বসে জিজ্ঞেস করল প্রত্যয়।
“আজ আমি সমস্ত খাবার খেয়ে ফেলব, যাতে আগামী দুইদিন কিছু খাওয়া না লাগে।” প্রচণ্ড ভাল লাগছে অপর্ণার। প্রত্যয় অনেকদিন ধরে এই স্কলারশিপটার জন্য অপেক্ষা করছিল।ওয়েটারকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিল।
“তো। শেষ পর্যন্ত তোমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।”
“হুম। ভাল লাগছে আবার খারাপ ও লাগছে।” অপর্ণার হাত ধরে বলল প্রত্যয়।
“খারাপ লাগছে কেন?”
“বারে খারাপ লাগবে না? তোমাদের সবাইকে ছেড়ে এত দূরে থাকতে হবে।” হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
“হ্যাঁ মা বল।” প্রত্যয়ের মা নীলিমা ফোন করেছেন। ভদ্রমহিলা একটা ব্যাংকে চাকরী করেন।
“তুই কোথায়?”
“এইত অপর্ণাকে নিয়ে একটু বাইরে আসলাম।” প্রত্যয়দের বাসার সবাই প্রত্যয় আর অপর্ণার ব্যাপারটা জানে। প্রত্যয়ের ছোট বোন নিরুপমা অপর্ণার ছোটবেলার বান্ধবী। তাই অপর্ণাকে বেশ ভাল করেই চিনে জানে প্রত্যয়ের বাসার সবাই।প্রত্যয়দের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত আছে অপর্ণার।
“তাই নাকি? ওকে একটু ফোন দে তো।” প্রত্যয় অপর্ণাকে ফোন দেয়, “মা কথা বলবে।”
“নমস্কার মাসীমা। ভাল আছেন?”
“এই তো। তুমি ভাল আছ তো মা? প্রত্যয়ের খবরটা শুনেছ নিশ্চয়ই?”
“জি মাসীমা, সেজন্যই তো খাওয়াতে নিয়ে এসেছে।”
“নিরু তো বাসায় কেক নিয়ে যাবে। আমি ও ভাবছি ভাল মন্দ কিছু রান্না করব। প্রত্যয়ের সাথে চলে এসো বাসায়। রাতে না হয় প্রত্যয় পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
“না মাসীমা আজ তো হবে না। পরীক্ষা চলছে তো। পরীক্ষা শেষ হোক। যাব একদিন বাসায়।”
“ঠিক আছে। তাই হবে। মা কিছু মনে কর না, প্রত্যয় তো বাইরে যাবে। তাই ভাবছিলাম ও যাবার আগে তোমাদের আশীর্বাদটা হয়ে যাক। তোমার বাসায় কথা বল। দুই পরিবারের মধ্যে একটু জানাশোনা হোক।”
“না না মাসীমা, এতে মনে করার কি আছে? আমি বাসায় কথা বলব। প্রত্যয়কে জানাব।” অপর্ণা লজ্জা পেয়ে গেল।
“ঠিক আছে মা। সেই অপেক্ষায় রইলাম। পরীক্ষা শেষ হলে বাসায় এসো।” এই বলে নীলিমা ফোন রেখে দিলেন।
“কি ব্যাপার? মা মনে করার মত কি বললেন?” প্রত্যয় জিজ্ঞেস করল।
“বলছিলেন আমাদের ব্যাপারটা বাসায় জানাতে। মাসীমা চাচ্ছেন আশীর্বাদটা সেরে ফেলতে।”
“আশীর্বাদ? আমি তোমায় এখনি বৌ করে নিয়ে যেতে চাই।”
“যাহ, সবসময় উল্টা-পাল্টা কথা।” অপর্ণা লজ্জা পেয়ে গেল।
“কেন? আমার বৌ হওয়া উল্টা-পাল্টা কথা?”
অপর্ণা ভাবছে দাদাভাইয়ের বাসায় যাবে কিনা? একমাত্র সুদীপ্ত প্রত্যয়ের ব্যাপারটা জানে, বাসার আর কেউ জানে না। সুদীপ্ত জানে বলার চাইতে এটা বলা ভাল যে সুদীপ্তর সামনে ধরা পড়ে যায় অপর্ণা। একবার প্রত্যয়ের সাথে সিনেপ্লেক্স থেকে সিনেমা দেখে বেরনের পর হঠাৎ করে সুদীপ্তর সামনে পরে যায় অপর্ণা আর প্রত্যয়। সুদীপ্ত ওর বন্ধুদের সাথে মার্কেটে ঘুরতে গিয়েছিল।
“দাদাভাই তুই এখানে?”
“হুম। ঘুরতে এসেছি। তুই এখানে?” বলে আড়চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকায় সুদীপ্ত।
“দাদাভাই ও হচ্ছে প্রত্যয় আর প্রত্যয় এই যে আমার দাদাভাই।” দুজনে হাত মেলায়।
“দাদাভাই তুই কি এখন বাসায় যাবি?” অপর্ণা ভয় পেয়ে গেছে। সুদীপ্ত বাসায় গেলে ওর সাথে এখনি চলে যাবে আর সুদীপ্তকে রিকোয়েস্ট এই কথা মাকে যাতে না জানায়।
“কেন? এখন গেলে কি হবে?” সুদীপ্ত প্রশ্ন করল।
“না মানে আমি যাব তো। তুই গেলে তোর সাথে ফিরতাম।”
“না আমার দেরী হবে।” সুদীপ্তর খুব মজা লাগছে। তার ছোট বোন প্রেম করে ধরা পড়ে গেছে। আমতা আমতা করছে এখন।
“তাহলে আমরা এখন যাই।” কোনভাবে সেখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে যেন অপর্ণা।
“ঠিক আছে। বাসায় এসো ভাই।” সুদীপ্ত ইচ্ছে করে প্রত্যয়কে বাসায় যেতে বলেছিল। অপর্ণার মুখের অবস্থা কি হয় দেখার জন্য। অপর্ণা অবাক হয়ে গেল, দাদাভাই ওকে বাসায় যেতে বলল কেন? অবশ্য বাসায় ফেরার পর সুদীপ্তর কাছে প্রত্যয়ের ব্যাপারে সবকিছু বিস্তারিত বলতে হয়েছিল অপর্ণাকে। এরপর থেকে প্রত্যয়ের ব্যাপারে আর কোন কথা হয়নি অপর্ণা আর সুদীপ্তর মাঝে। মাকে প্রত্যয়ের ব্যাপারে জানাতে ভয় পাচ্ছে অপর্ণা। সুদীপ্তকে দিয়ে অঞ্জনার কাছে প্রত্যয়ের ব্যাপারটা বলতে হবে। সুদীপ্ত বললে অঞ্জনা না বলতে পারবে না।
খাওয়া দাওয়ার পর প্রত্যয় অপর্ণাকে নিয়ে বেড়িবাঁধে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দূরে হয়ে যাবে দেখে অপর্ণা রাজি হয়নি। হাতিরঝিলে গিয়েছিল দুজন।অনেক কথা হল দুজনের মাঝে, হাত ধরাধরি করে ঘুরলো দুজনে। আলো আঁধারের খেলার মাঝে দুজন বসেছিল পাশাপাশি। প্রত্যয়ের কাঁধে মাথা দিয়ে হাতে হাত রেখে বসেছিল অপর্ণা। মুগ্ধ করা সূর্যাস্ত দুজনার মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিল। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here