অপেক্ষার প্রহর পর্ব-৯

0
666

অপেক্ষার প্রহর (পর্ব-৯)
“আপনি এখানে কি করছেন?” শিলা শফিককে প্রশ্ন করল। শিলা ক্লিনিক থেকে বের হয়ে দেখল শফিক ফুটপাথের উপর বসে একটা পিচ্চি ছেলের সাথে কথা বলছে। শিলার কণ্ঠস্বর শুনে শফিক পিছন ফিরে তাকাল। সেই ফাঁকে ছেলেটা উঠে চলে গেল। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল যাওয়ার জন্য, সুযোগ পাচ্ছিল না। শিলা আসাতে সুযোগ পেয়ে গেল।
“আপনি এখানে?” পাল্টা প্রশ্ন করল শফিক।
“আমি এই ক্লিনিকে ডিউটি করি। কিন্তু বললেন না তো আপনি এখানে কি করছিলেন?”
“আপনাদের কথামত এক পথশিশুর সাথে কথা বলছিলাম।”
“আমাদের কথামত মানে?”
“আপনারা তো এইসব বাচ্চাদের পথশিশু বলেন।”
“কেন? আপনি বলেন না?”
“না,বলিনা। যেসব বাচ্চারা বাসায় থাকে তাদের তো আপনারা বাসাশিশু বলেন না। তাহলে এদেরকে কেন পথশিশু বলেন? পথেই এদের বাড়িঘর বলে?” শিলা চুপ করে রইল।
“আপনি কি কোথাও যাবেন?”শিলা প্রশ্ন করল।
“হুম, বাসায় যাব।”
“ও। তাহলে ত একসাথে যাওয়া যাবে। রাস্তা তো খুব বেশি না। হেঁটে যেতে আপনার আপত্তি নেই তো?”
“অবশ্যই না।” দুজনে একসাথে হাঁটা শুরু করল।
“তো কি কথা বলছিলেন বাচ্চাটার সাথে?”
“তেমন কিছু না। এই জিজ্ঞেস করছিলাম কি করে, কোথায় থাকে।”
“কি জবাব পেলেন?”
“ছেলেটার নাম মিলন। কুমিল্লা বাড়ি। গ্রামের বাড়িতে মা আর ছোট বোন থাকে।বাবা এই ঢাকাতেই থাকে। দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে থাকে। ওদের কোন খবর নেয় না। মিলন একটা লেগুনার হেল্পার। এই কাজ করেই তাকে নিজের খরচ মেটাতে হয় আবার বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। যে বয়সে এই বাচ্চাটার স্কুলে যাবার কথা ছিল, মাঠে খেলতে যাওয়ার কথা ছিল সেই বয়সে তাকে সংসারের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অথচ চারপাশে চেয়ে দেখুন। কত মানুষ অলস ভাবে দিন কাটাচ্ছে।খুব খারাপ লাগে এসব কথা ভাবলে। ওদের সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কেন জানি অপরাধী মনে হয়।” শিলা চুপ করে শুনছে।“সরি,আমার কথা শুনে আপনি আবার বিরক্ত হচ্ছেন নাতো?”
“না না, বিরক্ত হব কেন? আপনি তো ভুল কিছু বলেননি।” হঠাৎ শিলা দাঁড়িয়ে গেল, “চটপটি খাবেন?”
“আপনারা ডাক্তাররা এসব খেতে পছন্দ করেন?”
“কেন? আমরা কি মানুষ না? আমাদের এসব খাবার খেতে ইচ্ছে করতে পারেনা?”
“না না তা হবে কেন? আপনারা অন্যদের খাওয়া দাওয়ায় অনেক নিষেধাজ্ঞা দেন তো তাই ভাবলাম রাস্তার খাবার হয়তো আপনারা পছন্দ করেন না।”
“রাস্তার খাবার পছন্দ করিনা ঠিক, কিন্তু এরা অনেক পরিস্কারভাবে সবকিছু মেইনটেইন করে। আর চটপটিটাও এরা ভালই বানায়। সব জায়গার চটপটি ভাল হয়না খেতে।”
“খেতে পারি এক শর্তে। বিলটা আমি দিব। খাওয়ার পর বিল দেয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে ভাল লাগে না।”
“ঠিক আছে। আপনিই বিল দিবেন।” হেসে জবাব দিল শিলা।
টুলে বসে দুই প্লেট চটপটির অর্ডার দিল শিলা। “আপনি প্রায়ই এসব শিশুদের সাথে কথা বলেন?”
“হুম। ওদের সাথে কথা বলে ওদের কষ্টগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি। সবার কাহিনী প্রায় একই। নদীর ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি ভেসে গেছে, তারপর ছিন্নমূল হিসেবে এই শহরে আগমন। কারো পরিবার ভেঙে গেছে, বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছে। অনেকগুলো মানুষের দায়িত্ব পরে তাদের কাঁধের উপর। জীবনের প্রয়োজনে বাস-লেগুনার হেল্পার কিংবা বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে।কারখানায় কাজ করে। মানবেতর জীবনযাপন করে। আপনি জানেন বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লক্ষ শিশু শ্রমিক রয়েছে। আমাদের দেশে প্রায় ৮০ লক্ষ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এদের মধ্যে ৪৫ লক্ষ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সাথে যুক্ত। শহর এলাকার চাইতে গ্রামেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেশি।”
“আপনি দেখি অনেক কিছুই জানেন।”
“আসলে আমি ছোটবেলা এই শিশুশ্রমের বিপক্ষে। শিশুশ্রমটাই শেষ কথা না, ছোট মানুষ বলে এরা প্রাপ্য মজুরীটুকুও পায় না। এমনকি কাজে ভুল হলে শুরু হয় নানা ধরণের নির্যাতন।” এর মধ্যে চটপটি চলে আসে। দুইজনে নীরবে খাওয়া শেষ করল।
খাওয়া শেষে হাটতে হাটতে শিলা বলল, “কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনার এসব শিশুদের জন্য কখনও কিছু করতে ইচ্ছে করেনা? মানে বলতে চাচ্ছি আপনি তো অনেকের কাছ থেকে তাদের জীবনের অনেক কথা শুনেছেন? কখনও তাদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করেনি?”
“আমার এত সামর্থ্য তো নেই। তবে যখন যতটুকু পারি করার চেষ্টা করি।”
“দেশে তো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা এদের জন্য কাজ করে। আপনি কি সেরকম কোন প্রতিষ্ঠানের সদস্য?”
“কয়েকটা সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এসব সংগঠন আর কতটুকুই আর করতে পারে বলেন? আর একসময় সংগঠনের লোকজনও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে আর সংগঠনও ভেঙে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যাটা কোথায় জানেন? দারিদ্রতা। প্রচণ্ড দরিদ্র হওয়ার কারণেই তো এদেরকে এসব শ্রমে জড়িত হতে হয়। সরকার যদি বড় কোন উদ্যোগ না নেয় তাহলে এই সমস্যার থেকে আমরা মুক্তি পাব না। আর এসব তো আজকে নতুন না।অনেক পুরনো। সুকান্ত তো সেই কবেই বলে গেছেন এই বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব।”
“শফিক সাহেব শুধু শিশুরা কেন? অনেক বৃদ্ধ মানুষও তো নানা ধরণের ভারী কাজ করছে। আর আপনি শিশুশ্রমের কথা বলছেন? শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে না? শারীরিক-মানসিকভাবে। এসবের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?”
“আসলেই সবগুলো সমস্যা এমনভাবে আমাদের সমাজে শিকড় গেঁড়ে বসেছে যে যখনি এসব নিয়ে চিন্তা করি মাথাটা শূন্য হয়ে যায়।” বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে দুজনে।
“একটা কথা বলব?” শিলা বলল।
“জি বলুন।”
“আমার নিজেরও তেমন একটা সামর্থ্য নেই। তবু একটা অনুরোধ ছিল। যদি কখনও কোন প্রয়োজন হয় একটু মনে করবেন প্লিজ। আমিও আমার সাধ্যমত কাজ করতে চাই ওদের জন্য।”
“You are always welcome” দুজনে দুজনার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
“বাসায় আসেন। একটু চা খেয়ে যান।” শিলা বলল।
“না না আপনি বাইরে থেকে এসেছেন। রেস্ট নিন। শুধু শুধু ঝামেলা করার দরকার কি?”
“ঝামেলা হবে কেন? বাবার আর আমার জন্য তো চা বানাবই, আপনিও না হয় যোগ দিলেন আমাদের সাথে।”
“ঠিক আছে। চলুন।”
শিলা চা নিয়ে এসে দেখল শফিক আর শওকত সাহেব জোরে জোরে হাসছেন। শওকত সাহেবের হাতে একটা জোকসের বই। দুজনে মিলে জোকস পড়ছে আর হাসছে। শিলা অনেকদিন পর শওকত সাহেব কে এভাবে হাসতে দেখল।
রাতে ঘুমানোর আগে জানালার কাছে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে সারাদিনের কথা চিন্তা করতে লাগল শিলা। একদিন শফিক সাহেবের সাথে বের হতে হবে। শফিক সাহেব যেমন শিশুদের কষ্টের কথাগুলো শুনেন, শিলাও শুনবে। এই বাচ্চাগুলোর জন্য কিছু করবে। শিলার বৈচিত্র্যহীন জীবনে শফিক কি কোন বৈচিত্র্য এনে দিবে?
সুদীপ্তর অফিস থেকে বের হতে অনেক রাত হয়ে গেছে।কয়েকদিন ধরেই দেরি হচ্ছে। অফিস একটা বড় প্রজেক্টে ইনভেস্ট করতে যাচ্ছে। প্রজেক্ট সফল হলে সুদীপ্তর প্রমোশন হবে, বেতনও বাড়বে। এই মুহূর্তে টাকার খুব দরকার সুদীপ্তর। হাতিরঝিল দিয়ে মগবাজার রেলগেটের দিকে রিক্সা আসছিল। একটু অন্ধকার জায়গা দিয়ে রিক্সা এগুচ্ছিল। অন্যদিনের চাইতে জায়গাটা অনেক বেশি নীরব মনে হচ্ছে। হঠাৎ করে রিক্সা ঘিরে কতগুলো ছেলে এসে দাঁড়াল।“যা আছে সব দিয়ে দে”। মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। অনেকদিন পর শুনলেও গলার স্বর চিনতে এতটুকু ভুল হল না। সুদীপ্তর ছোট ভাই কৌশিক। কৌশিক ছিনতাইকারী? (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here