অপেক্ষা পর্ব (০৪+০৫)

অপেক্ষা পর্ব (০৪+০৫)
লেখিকা- সামিয়া বিনতে হামিদ

০৪।
রিধি আর দিয়া কলেজ শেষে বাসায় ফিরছে।

রিধি: আজকের সারা দিনটাই মাটি।

দিয়া: আমার কিন্তু আজকের ক্লাসগুলো ভালোই লেগেছে।

রিধি: হুহ আসছে, আমার আতেল।

দিয়া: সামনে টেস্ট এক্সাম। ভালো মতো পড়। এসব মুভি, ঘুম বাদ দে কয়েকমাস।

রিধি: এতো পড়াশুনা করে কি হবে? একদিন তো মরেই যাবো।

দিয়া: ভাই, তুই কবে সিরিয়াস হবি?

রিধি: আরে ভাই, আমি এখন একটাই ব্যাপার নিয়ে সিরিয়াস। সামনে আমার কপালে দুঃখ।

দিয়া: বুঝায় যাচ্ছে।

রিধি: আরে পড়াশুনার ব্যাপার নিয়ে না।

দিয়া: তাহলে?

রিধি: এক সপ্তাহ পর, মা-বাবার ৩০তম বিবাহ বার্ষিকী। এখন বাবা তো আসবেই সাথে ওই রাক্ষসটাকেও আসতে পারে মনে হচ্ছে।

দিয়া: ওমা আসলে কি সমস্যা?

রিধি: জানিস না, কেমন বদমেজাজি ওই রাক্ষসটা! অনেক কাঁদিয়েছে আমাকে। আই হেইট হিম।

দিয়া: বাদ দে না। তোর বড়ো ভাইয়ার মতো।

রিধি: ভাইয়া না কচু। রাক্ষস একটা। আমাকে এইবার কিছু বললে, আমি চলে যাবো, আর থাকবো না ওই রাক্ষসটার বাড়ীতে। আমার অনু ভাইয়া আমাকে কতো ভালোবাসতো, জানিস? অনু ভাইয়া থাকলে হয়তো আমাকে কেউ বকতো না।

রিধির গলা ভারী হয়ে আসে, কথাটি বলতে বলতে।

দিয়া: রিধি, সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব পুরোনো কথা আর মনে করিস না দোস্ত।

রিধি: জানিস দিয়া, অনু ভাইয়া দেখতে কেমন ছিল আর মনে নেই। আম্মি, বাপ্পিকেও ভুলে গিয়েছি। মনে করতেই পারছি না তারা দেখতে কেমন ছিল। একটি ছবিও ছিল না আমার কাছে।
দিয়া চুপ হয়ে গিয়েছে, সে জানে এখন আর রিধিকে শান্ত করা যাবে না।

রক্তিম এর কথা উঠলেই রিধির নিজেকে অনাথ মনে হয়। কারণ রক্তিম তার অনাথ হওয়ার বিষয়টা অনেকবার তাকে খোঁচা দিয়ে বলেছিল। রিধির নিজেকে অসহায় মনে হয়, কারণ তার আসল বাবা-মা, ভাই বেঁচে নেই। মা-বাবা, ভাই ছাড়া তার কোনো আত্মীয়ও ছিল না।

এগারো বছর আগে, সে তার বাপ্পি, আম্মি আর অনু ভাইয়ার সাথে মেলায় গিয়েছিলো। সাত বছর হবে বয়স।
মেলায় আগুন ধরে যায়। অনেকে মারা গিয়েছিল। সে হারিয়ে ফেলে তার বাপ্পি, আম্মি আর অনু ভাইয়াকে। সেখানেই খুঁজে পাই রিধিকে নবনী আর জুনাইয়েত দম্পতি।
জুনাইয়েত হোসেইন ব্যবসার কাজে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা। তারা দুর্ঘটনা স্থলে ছিলেন। তারা রিধিকে অচেতন অবস্থায় পান। তাকে চিকিৎসা করিয়ে, চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। প্রথমে সে খুব ভয় পেলেও নবনী তাকে আপন করে নেয়। তার পরিচয় জানার পর তারা পত্রিকায় ছাপায় ছবিসহ। কিন্তু কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।

রিধির আসল নাম সিদ্দিকা মরিয়ম অরণী। বাবা- কামাল সিদ্দিক, মা- আদিবা সিদ্দিকা, ভাইয়ের নাম সিদ্দিক কবির অনিক। তারা ঢাকায় থাকতো। কোনো ফোন নম্বর মুখস্থ ছিল না রিধির। ঢাকায় কোথায় থাকে সে সেটিও জানতো না। দুর্ঘটনায় অনেকে পুড়ে মারা গিয়েছিল। তাদের লাশ ও চেনা যায়নি। বাচ্চা মেয়েটিকে লাশ দেখিয়ে চিহ্নিত করার ব্যাপারটা জুনাইয়েত সাহেব করতে দেননি। পরে তাকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। এরপর থেকেই অরণী থেকে সে রিধি হয়ে যায়। রক্তিম তাকে খুব পছন্দ করেছিল।
কিন্তু দুই বছর আগেই রিধিকে মনে করিয়ে দেয় রক্তিম যে সে অনাথ। রক্তিম কেন এমন বলেছিল তা রক্তিমই ভালো জানতো। এরপর থেকেই রিধির মাঝে মাঝে অনেক অচেনা মনে হয় নিজেকে। নিজের অস্তিত্বের কোনো ঠিকানা খুঁজে পায় না রিধি।

এদিকে ক্লাস শেষে ইশা আর নিশু বাসে উঠে, বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

নিশু: স্যারের এসাইনমেন্টটা করে থাকলে আমাকে দিস।

ইশা: হুম। আচ্ছা চল না কোথাও ঘুরতে যায়। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না।

নিশু: দেখি মিহিরকে বলে। গেলে ও সহ যাবো।

ইশা: মিহির ভাইয়া ছাড়া আমাদের সাথে কোথাও যাওয়া যায় না?

মুচকি হেসে নিশু বলল,
নিশু: না, যায় না।

ইশা: তোর আর ভাইয়ার ভালোবাসা দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সম্পর্কটা কেন এতো এলোমেলো! এই দেখ আজকেও ঝগড়া করেছে, কারণ শুনলে তুই অবাক হবি।

নিশু: কি হয়েছে?

ইশা: তুই তো জানিস, আমি একটু হালকা পাতলা কবিতা লিখি। কিছু কবিতা রবীন্দ্রনাথ কে উৎসর্গ করে লিখেছিলাম ওটাতে ওর এমন অবস্থা।

নিশু: মানে কি?

ইশা: ওর কথা হলো ও রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করে না, আর তাই আমাকে বই পড়তে দেবে না রবীন্দ্রনাথের।

নিশু: অনেক হাস্যকর তো!

ইশা: আগে তো বলেছিল জব করতে দেবে না। এখন বইও পড়তে দেবে না। গতকাল আরো এক অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিল, প্রশ্নটি হলো ওর মা আর আমার মা একসাথে অসুস্থ, এখন আমি কার সেবা করবো?

নিশু অবাক হয়ে বলল,
নিশু: এ্যা। তুই কি বলেছিস?

ইশা: আমি বলেছি, তোমার মায়ের সেবা তুমি করবে আর আমার মায়ের সেবা আমি করবো। যদি একই সাথে অসুস্থ হয় তখন। আর আমার মায়ের দায়িত্বতো আমাকেই নিতে হবে। আর এটি কেমন পার্থক্য? আমি মেয়ে দেখে কি বাবা মার উপর আমার দায়িত্ব শেষ?

আমাদের সমাজটা মেয়েদের কে এতো অদ্ভুত সব পরীক্ষা কেন দেয়? জব করতে পারবে না, ঘন ঘন বাবার বাড়ি যেতে পারবে না, এমন মন-মানসিকতার মানুষ কেন থাকে?
এখনো আছে, বাবা খালি হাতে এলে শ্বশুর বাড়িতে মেয়েকে কথা শুনতে হয়। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর বাবা মার দায়িত্ব শেষ। তবুও মেয়ের বাড়ি থেকে কি আসলো তা দেখার জন্য পাড়া পড়শির ঘুম নেই। কোরবানে গরুর জায়গায় ছাগল দিলে শুনতে হয় অদ্ভুত সব কথাবার্তা। দুই ইদে জামা কাপড় তো আছেই। এতো কিছু মেয়ের বাবা মা করে, শুধু তাদের মেয়েটি যাতে দুধে ভাতে থাকে। তাও ওইখানে মেয়েটিকে শুনতে হয় নানান কথা। তাকে নিজস্ব স্বকীয়তা ছেড়ে সাজতে হয় স্বামীর বাড়ির আদর্শ বউ। এতেও যদি পাশ না হয়, হাল্কা পাতলা শুনে চুপচাপ সহ্য করে থাকাই যেন প্রকৃতির নিয়ম। বেশি কথা তো বহুদূর, আমি এটি করিনি বললেও শুনতে হয়, ‘বাবারে কি বেয়াদপ মেয়ে আনলাম ছেলের জন্যে, মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছে’। এইসব এর পরিবর্তন কি হতে পারে না?

মুহিবের মতো আশেপাশে এমন অনেক মানুষ আছে। সবারই উচিত নিজেকে পরিবর্তন করা। সমাজের নিয়মগুলো আমরাই সৃষ্টি করি, সভ্য সমাজ বলে আমরা যে সমাজটিকে দেখছি, তা আদৌ কতটুকু সভ্য তা হয়তো অনেকে বুঝে না। বুঝেও হয়তো না বোঝার ভান ধরে।

ইশার মুহিবের প্রতি ভালোবাসা যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। তিন বছর আগেও মানুষটির জন্য সে পাগল ছিল। কিন্তু অবহেলা ভালোবাসা কমিয়ে দেয়। ইশার জন্য এখন মুহিব দিন দিন বড়োই অপরিচিত।
তিন বছর আগের প্রেম আর এখনের প্রেমের মধ্যে বড়োই অমিল।

প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়ার বয়স কলেজ জীবনে হয় না। তখন তো মাত্র জীবনকে চেনার সময়। জীবনকে উপলব্ধি না করে অনেকে হয়ে পড়ে প্রেমিক-প্রেমিকা। কেউ পায় সফলতা, কারো জীবনে আসে ব্যর্থতা। এসব ব্যর্থ প্রেম থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। নতুন করে বাঁচার শিক্ষা।

ইশা মুহিবের প্রেমের গল্প কি ব্যর্থ প্রেমের গল্প হবে নাকি সফল হবে এটি সময়ই বলে দেবে।

০৫।

অনেকক্ষন ধরে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজিয়ে যাচ্ছেন রাজিয়া রহমান। তার চিন্তাও বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দিয়া কি এখনো বাসায় ফিরে নি? সন্ধ্যা হতে চলল। ফোনে তো বলেছিল বাসায় এসেছে। ফোন দিচ্ছে দিব্য, দিয়া দুজনকেই। দিব্যের ফোন অফ। দিয়ার ফোনে রিং যাচ্ছে, কিন্তু ধরছে না।
তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে দেখল, দিয়া এসেছে কিনা।

দারোয়ান বলল,
“আপা মণি তো আইসে খালাম্মা। আমি তারে দেখসিলাম। ঘরেই তো থাকবো বাইরে থেইকাও কেউ তো আইলো না। ঘুম যাইতাসে মনে অয়।”

রাজিয়ার নিজেকে এই মুহূর্তে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। মেয়ের কিছু হয়ে গেলো না তো! আজকাল কি কারো বিশ্বাস আছে?
বাবা ছাড়া দুইটা সন্তান বড়ো করা যে খুব পরিশ্রমের তা তিনি ভালোই বুঝেছেন এই পনেরো বছরের সংসারে। পুরোনো সংসারের মায়া তিনি কাটাতে পেরেছেন। তবুও কখনো কখনো অবেলায়, মধ্যরাতে চাঁদের আগমনে বা বৃষ্টিভেজা বিকেলে মনে পড়ে যায় পুরোনো স্মৃতি। তিনি আর আগের মতো নেই। নিজেকে আর ছন্ন ছাড়া ভাবেন না। প্রথম কয়েকবছর মায়াটা বড্ড ছিল। কিন্তু এখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন।

মানুষ আসলে খুবই বিচিত্র। এক সময় মনে হয় প্রিয় মানুষটিকে ছাড়া চলা তার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু সেই মানুষটিই আবার সব কষ্টকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মুখে প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে রাখতে পারে খুব সহজেই।

মিসেস রাজিয়া রহমান সব গুছিয়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে। স্বাবলম্বী হওয়ায় তার আর কারো অপেক্ষায় থাকতে হয় না।

প্রতিটি মেয়ের শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত। সময় কিন্তু মাঝে মাঝে বেইমানীও করে বসে। কার কপালে কি আছে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।

মিসেস রাজিয়া আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট স্বচ্ছল। ফয়সাল আহমেদও নিজের দায়িত্ব পালন করে আসছেন পনেরো বছর ধরে। তিনি প্রতিমাসে তার দুই সন্তান আর স্ত্রীর নামে টাকা পাঠান। যদিও এই টাকা রাজিয়া রহমান কখনো তুলেননি।
মাসে একবার মেয়েকে দেখতে আসেন ফয়সাল আহমেদ। দূর থেকে দেখেই চলে যান। কিন্তু দিব্যের দেখা পান কম।

দিব্য আর রোহান ভালো বন্ধু এটিও তিনি জানতেন। রোহানের মুখে শুনেন দিব্য সম্পর্কে। এতেই যেন তিনি সন্তুষ্ট।
মনে মনে ভাবেন ভালোই তো আছে তারা। রোহানকে তিনি দিব্যের আসল পরিচয় দেননি। কারণ রোহান কখনো ভাই বোনকে দেখার আগ্রহ দেখায় নি।রোহানের মনের মধ্যে যে চাপা ক্ষোভ আছে তা বোঝা যায় তার চোখগুলো দেখলে। গভীর আর শান্ত চোখ। যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু ভাষা নেই।রোহানের ধারণা তার মা, তার বাবাকে আর তাকে ভালোবাসতো না।
অন্যদিকে দিব্যের ধারণা তার বাবার অবৈধ সম্পর্ক ছিল।

রোহান আর দিব্য পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে তিন বছরের বন্ধুত্বে কোনো কথাই বলে নি। রোহান শুধু জানে দিব্যের মা একজন ডক্টর আর তার বোন দিয়া কলেজে পড়ে। দিয়ার সাথে একবার দেখাও হয়েছিল রোহানের।
রোহান কারো বাসায় যাওয়া পছন্দ করতো না। তাই কখনো দিব্যের বাসায় যায়নি। দিব্য জানতো রোহান এর মা নেই। তাই কখনো কোনো প্রশ্ন করেনি। কারণ তার বাবাও তাদের সাথে নেই।

ভার্সিটির প্রোগ্রামগুলোতে পরিচিত মুখ তারাই। রোহান ভালো গান গাইতে পারতো। আর দিব্য ছবি তুলতে পারতো ভালো। ফোটোগ্রাফিতে অনেক পুরষ্কারও পেয়েছে সে। আর সব ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পিকনিক পরিচালনার দায়িত্ব থাকতো দিব্যের উপর।
আর দুই ভাইয়ের এই দুটো বিশেষ গুণের জন্য তাদের অনেক পরিচিতি।

ভার্সিটির সব অনুষ্ঠানে ছবি তুলার দায়িত্ব পরতো দিব্যের উপর, আর গান গাওয়ার অনুরোধ আসতো রোহানের জন্য। গিটারও ভালো ভাজাতে পারে রোহান।

রোহান দেখতে খুবই সুদর্শন। প্রথম দেখায় ক্রাশ খাওয়া মুখ। দেখতে লম্বা, ঘন কালো চুলগুলো খাড়া, মুখে চাপ দাঁড়ি, চোখে চশমা পড়ে। হাসলে গালে টোল পড়ে। কিন্তু খুব গম্ভীর স্বভাবের সে। খুব কম হাসে, কথাও কম বলে, আর অল্পতেই রেগে যায়। রাগটা খুবই বেশি তার।

অন্যদিকে দিব্যের স্বভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। অনেক মিশুক আর চঞ্চল। রোহানের মতোই সুদর্শন, লম্বা, চুল ঘন কিছুটা বাদামী রঙের। চোখ গুলো বিড়ালের চোখের মতো, সবাই কেটস আই বলে ডাকে। মুখে দাঁড়ি নেই, ক্লিন শেইভ করে রাখে। হাসলে তারও গালে টোল পড়ে। তার মুখে সব সময় হাসি থাকবেই। তাই রোহানের চেয়ে দিব্যকে মেয়েরা একটু বেশিই পছন্দ করে। কিন্তু দিব্য মেয়েদের থেকে যত সম্ভব দূরত্ব রেখেই চলে। প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না কোনো মেয়ের সাথে। আর এই ভদ্র স্বভাবের জন্য দিব্য বেশি পরিচিত মেয়েদের কাছে। আর রোহানের চুপচাপ স্বভাবের কারণে মেয়ে বন্ধুতো বহুদূর, ছেলে বন্ধুও কম। তার একমাত্র ভালো বন্ধু দিব্য।
রোহানকে কেউ আড্ডায় নিয়ে আসেনা। কারণ রোহান থাকলে কথা বলতেও সবাই ইতস্তত করে। কিন্তু পড়াশুনায় রোহান সবচেয়ে ভালো। শুধু ওই ব্যাপারেই সবাই তার সাথে কথা বলতে আসে।

কিন্তু স্বভাবে অমিল থাকলেও দুই ভাইয়ের একদিকে মিল আছে। সেটি হলো দুজনেই ইশাকে পছন্দ করে।
দিব্যের পছন্দের ব্যাপারটা রীতিমত সব বন্ধুরাই জানে। আর রোহানও কখনো বলেনি কাউকে তার পছন্দের কথা। যেহেতু সে জানে দিব্যও ইশাকে পছন্দ করে, তাই এখন কাউকে ‘তার ইশাকে পছন্দ’- এই কথা বলার প্রশ্নই হয় না।

ইশা যখন ভার্সিটিতে নতুন এসেছিল, তখনই প্রথম দেখেছিল রোহান তাকে।

ইশার ভার্সিটির প্রথম দিন-
ইশা খুব বেশি সাজতে পছন্দ করে না।প্রথমদিনেও সে হালকা সেজে এসেছিল, চোখে কাজল দিয়েছিল, কারণ তার কাজল পড়তে ভালো লাগতো। ইশার ঠোঁটগুলো গোলাপী, তাই সে ঠোঁটে কিছুই দিতো না। হালকা গোলাপি সুতার কাজের সাদা রঙের একটি জামা পড়েছিল। একদম মানিয়েছে তাকে। মনে হচ্ছিল প্রকৃতিই যেন তাকে সাজিয়েছে প্রাকৃতিক রুপে। কোনো কৃত্রিমতা, জড়িমা নেই। প্রথমদিনেই যেন মিশে গিয়েছিল অপরিচিতদের মাঝে, অপরিচিত পরিবেশটিকেও বানিয়ে নিয়েছে আপন। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলছিল সবার সাথে। রোহান নিরবে দেখছিল ইশাকে। আর মায়ায় বাঁধছিল ইশা রোহানকে ধীরে ধীরে।

নবীন বরণের প্রধান দায়িত্ব দিব্যের উপরেই ছিল। যেহেতু দিব্য আগে থেকেই ইশাকে চিনতো, সে ইশার সাথে সিনিয়রদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। রোহানের সাথেও পরিচয় হয় ইশার।রোহান প্রথম সেদিন কোনো মেয়ের পরিচয় জানার আগ্রহ দেখিয়েছিল।

ইশা কিন্তু রোহানকে একদমই পছন্দ করে না।
ইশার ভাষ্য, হাসিমুখে থাকলেই মানুষকে মানুষ লাগে।
রোহান হাসে না বললেই চলে, কখনো আদৌ হেসেছে কিনা তাও কেউ দেখেনি। গম্ভীর মানুষ ইশার একদমই পছন্দ না। তবে রোহান যখন স্টেজে গান গায় তখন ইশা খুব মনোযোগ দিয়েই শুনে। মনে হয় যেন খুব কষ্ট জমিয়ে রেখেছে নিজের মধ্যে। কিসের কষ্ট কেউ হয়তো বুঝতে পারে না।
চাপা স্বভাবের মানুষগুলো এমনই হয় হয়তো। কষ্টগুলো তারা জমিয়ে রাখতে পারে। প্রকাশ পায় কবিতায় বা গানের সুরে।

রোহানের গান দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সে আইয়ুব বাচ্চুর গান দিয়ে শুরু করে,

‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো,
অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো
দেখো না কেউ হাসি শেষে নিরবতা।
বুঝে না কেউ তো চিনলো না,
বোঝেনা আমার কি ব্যথা
চেনার মতো কেউ চিনলো না
এই আমাকে—‘

রোহানের গান শুনে ইশার চোখে পানি চলে আসল। কারণ ওই সময় তার সাথে মুহিবের সম্পর্কের দীর্ঘ দিনের দূরত্ব চলছিল।

রোহানের গান গাওয়া শেষে ইশার দিকে চোখ পড়লো। ইশার চোখের মাঝে যেন সে অদ্ভুত যন্ত্রণা দেখেছিল সেদিন। প্রথমদিনেই কি এমন মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে চোখগুলো। তার সারাদিন শুধু ইশাকে ভেবেই কেটেছে।

অনেক পরেই সে জানতে পারলো যে দিব্য ইশাকে পছন্দ করে। তখন যেন তার লুকোনো ক্ষতে আরো কয়েকবার করে কেউ আঘাত করে দিয়েছিল।
তবুও রোহান কাউকে কিছুই বুঝতে দেয়নি। প্রিয় জন হারানো যেন তার ভাগ্যেই লিখে রেখেছে সৃষ্টিকর্তা। তাই সে সুখের অপেক্ষায় থাকে না এখন।অপেক্ষা যে আশায় বাধে মানুষকে, সেটি রোহানের কাছে মিথ্যে আশা।

এদিকে দিয়ার ঘুম ভাঙল রাত আটটায়। রাজিয়া রহমান এসেছিলেন বিকেল পাঁচটায়।
দিব্য ফোন অন করার সাথে সাথে রাজিয়া রহমানের কল পায়। দিব্য ওই সময় লাইব্রেরীতে ছিল, সাথে ছিল অনিক। মায়ের কাছে দিয়ার দরজা না খোলার কথা শুনে সে খুব ভয় পেয়ে যায়।

দিব্য: ভাই, বিপদ হয়েছে।

অনিক: কি বলিস? কি হয়েছে?

দিব্য: দিয়া বাসায় আছে, কিন্তু দরজা খুলছে না।

অনিক: চাবি নেই আন্টির কাছে?

দিব্য: হ্যাঁ, আছে। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

অনিক: চল তাড়াতাড়ি।

অনিকের বাইকে করে দুইজন বেরিয়ে পড়ে।

অনিক মনে মনে অনেক ভয় পায়। কারণ তার দিয়াকে ভালো লাগতো। কিন্তু বন্ধুর বোন তাই বলার সাহস হয় নি কখনো। যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়?
দশ মিনিটের মধ্যেই অনিক দিব্যকে নিয়ে দিব্যদের বাসার সামনে চলে আসে।

তাদের বাসাটি চার তলা বাসা। চতুর্থ তলায় ছাদ, দ্বিতীয় তলায় মিসেস রাজিয়া রহমান থাকেন, দিব্য দিয়াকে নিয়ে। তৃতীয় তলা ভাড়া দিয়েছেন। আর নিচে দারোয়ান থাকে। এই বাসাটি রাজিয়া রহমানের নামে করে দিয়েছিলেন তার বাবা মা। তিনিই একমাত্র মেয়ে ছিলেন তাদের। তাদের মৃত্যুর পর এখন তিনি এই পুরো বাড়ির মালিক।

তাদের বাসাটি অনেক বড়ো, চার বেডের বাসা। পূর্ব দিকে দুইটা বেড, পূর্ব দিকের রুমের সাথে লাগানো বারান্দা একটি। বারন্দাটি খোলা। পূর্ব দিকের রুমে দিয়া থাকে। পাশেরটায় রাজিয়া রহমান। ভিতরের রুমে থাকে দিব্য, আরেকটা রুম তাদের দুই জনের যাবতীয় জিনিস দিয়ে পূর্ণ।

তাদের সামনাসামনি বাড়িটা ইশাদের। তিনতলা বাড়ি। তৃতীয় তলায় ছাদ, দ্বিতীয় তলায় চারটি বেডরুম, একটি ড্রয়িংরুম, নিচে ডায়নিং আর রান্নাঘর। আরো কয়েকটা রুম আছে, মেহমানদের থাকার জন্য।
বাড়ির সামনে বাগান। ইশার বাগান করার খুব শখ। সব তার হাতে লাগানো ফুলের গাছ। বেশিরভাগ গোলাপ গাছ। বাড়ির সাথে লাগানো বেলিফুলের গাছ আছে একটি, বাগানের ঠিক উল্টো দিকে বসার ব্যবস্থা আছে।

ইশার বাবা- মো:কামাল উদ্দিন পেশায় সরকারী চাকুরীজীবী। মা- ইশিতা পারভিন স্কুল শিক্ষিকা আর ইশার ছোট ভাই- ফারহান উদ্দিন ইফতি, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দিয়ার বয়সের কিন্তু আলাদা কলেজের।

এদিকে দিয়া বাসায় থাকলে বারান্দার দরজা খোলা রেখেই ঘুমায়। কিন্তু রাতে ঘুমানোর সময় রাজিয়া রহমান মনে করে তা বন্ধ করে দেন। কখন বিপদ আসে বলা তো যায় না।

দিব্য কোথা থেকে একটা মই নিয়ে আসে, ওইটা বেয়ে উপরে উঠে যায়।বারান্দার দরজা যেহেতু খোলা তাই সে ঘরে ঢুকতে পারে সহজেই। ঢুকে দেখে দিয়া ঘুমুচ্ছে। তার এখন ইচ্ছা করছে থাপ্পড় দিয়ে ঘুমটা ভাঙিয়ে দিতে। কিন্তু ঘুমন্ত মানুষকে এভাবে জাগানো উচিত না। সে ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়। রাজিয়া রহমান মেয়েকে দেখতে পেয়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু কেউ দিয়াকে আর ডাকল না।

ঘুম ভাঙার পর ঘড়ি দেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখল ৫০+ মিসড কল। ভাইয়া আর মায়ের নম্বর থেকে। রুম থেকে বের হয়ে দেখল মা রাতের খাবার রেডি করছে।

দিয়া: মা, তুমি কিভাবে আসলে?

মিসেস রাজিয়া রহমান চুপ করে আছেন। দিব্য পেছন থেকে এসে দিয়ার কান ধরে টান দিলো।

দিয়া: ভাইয়া লাগছে তো!

দিব্য: লাগুক। আজকে তুই একটা কান্ড করলি!

দিয়া: আমি ঘুম ছিলাম। আমার কি দোষ?

দিব্য: না তোর দোষ নেই! দোষতো আমাদের? দরজা ভেতর থেকে বন্ধ না করলে কি হতো না?

দিয়া: সরি। আর হবে না।
মায়ের কাছে এসে বলল, মা!সরি। আর হবে না তো। ভুল মানুষ তো একবারই করে, বার বার হয়? ভুল থেকেই তো শিক্ষা নেয়। এইবারের মতো মাফ করে দাও।

রাজিয়া: রিধি এসেছে কিছুক্ষন আগে। তোর জন্য বসে আছে। যা এখন। আমি কাজ করছি। বিরক্ত করিস না।

দিয়া:আচ্ছা। যাচ্ছি। তুমি আগে বলো রাগ শেষ?

মুচকি হেসে বললেন,
রাজিয়া: হ্যাঁ বাবা, শেষ। যা রিধি একা বসে আছে।

দিয়া রিধির কাছে গেল।

মিসেস রাজিয়া রিধিকে খুব পছন্দ করেন। কারণ রিধি পড়াশুনায় খুব ভালো, খুবই চঞ্চল আর সবার সাথেই মিশে যায়। দেখতেও ভারী মিষ্টি। ব্যাখ্যা দিলে কম হবে, সংক্ষেপে মাত্রাধিক সুন্দর বলা যায়। চিকন ঠোঁট, চোখগুলো গোল গোল, ঘন পাপড়িযুক্ত। চুলগুলো ঘন, কালো, সোজা। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের।
দিয়াও দেখতে সুন্দর। শ্যামলা, চুল ঘন তবে হাল্কা কোঁকড়ানো।

রিধিকে দেখেই দিয়া বলল,
দিয়া: কেমন আছিস?

রিধি: কি কান্ড বাধিয়েছিস আজকে?শুনলাম দরজা বেধে অনশন করছিলি? তবে কার জন্য আপনার অনশনটা হচ্ছিল?

দিয়া: ঘুমিয়ে ছিলাম।খেয়াল করি নি। তুই হঠাৎ?

রিধি: এক্সামের জন্য পড়া গুছিয়ে নিতে এসেছি।

দিয়া: এতোদিন পর হঠাৎ পড়াশুনা নিয়ে ভাবার কারণ?

রিধি: পরশু বাবা আসবেন। সাথে ওই রাক্ষসটাও। বাবা এখন দেশেই থাকবেন, আর যাবেন না। এখন পরীক্ষা যদি খারাপ হয়, রাক্ষসটা আমাকে পঁচানোর সুযোগ পাবে বাবার সামনে। মা তো জানেই আমি অনেক লক্ষী। বাবার কাছেও প্রমাণ করতে হবে তো তাই।

দিয়া: ইশ! কি সৌভাগ্য এলো তোর বইগুলোর। এতোদিনে বুঝতে পারলি তাদের মর্ম।

রিধি: এখন বাইরের জ্ঞান না দিয়ে আমাকে বল কি কি পড়িয়েছে এতোদিন।

দিয়া: আচ্ছা, আচ্ছা। বলছি।

রিধি পড়া উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।তাদের বাসা পরের গলিতেই। রাজিয়া রহমান অনেক বলল খেয়ে যেতে কিন্তু রিধি বলল মা অপেক্ষা করছেন।
দিব্য রিধিকে বাসায় দিয়ে আসতে গেল।

চলবে—

আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/372950074426771/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here