অপেক্ষা পর্ব-৫২(শেষ পর্ব):

অপেক্ষা পর্ব-৫২(শেষ পর্ব):
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ

দুইমাস পর-
ইশা আজ শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসে দিহানকে নিয়ে। এই দুইটি মাস রোহানের সাথে দেখা করে নি ইশা। কিন্তু রোহান প্রতিদিন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতো। মাঝে মাঝে ইশার ছায়া দেখে বা কন্ঠের স্বর শুনেই রোহানের সন্তুষ্টি হতো। অনেক ইচ্ছে ছিলো ইশাকে বাসায় নিয়ে আসার। কিন্তু বলার সাহস হয় নি। যদি ইশা উলটো বুঝে বসে থাকে?
ইশার বানানো এক কাপ চায়ের মধ্যেও রোহান ভালোবাসা খুঁজে পেতো। এ দুমাসে ইশার এই একটি ছোঁয়া রোহান পেয়েছিলো শ্বশুরবাড়ি গিয়ে। প্রথম প্রথম ইশা বিরক্তিপ্রকাশ করতো। রোহান আসলে অকারণেই রাগ ঝাড়তো ঘরের জিনিসপত্রের উপর। রোহানের খারাপ লাগতো খুব। পরে আবার রোহানের জন্য চাও বানাতো নিজ হাতে। রোহানের তখন অনেক ভালো লাগতো। কিন্তু ইশা সামনে আসতো না চা নিয়ে। শাশুড়ি, ইশিতা পারভীন নিয়ে আসতো, আর বলতো, ‘তোমার বউ বানিয়েছে। কেমন হয়েছে দেখো!’ এই দুইমাসে তিনি বিশেষভাবে রোহানের মনে জায়গা পেয়েছেন। রোহানের তার আন্তরিকতা খুব ভালো লাগে। আর তিনিই একমাত্র রোহানের পক্ষে বলতেন, ইশার বাবা কামাল উদ্দিন মেয়েকে কিছুই বলতেন না।

ইশা রোহান আসলেই বলতো,
ইশা: ওই লোকটা আবার কেন এসেছে? যত্তসব।

ইশিতা: তোর সমস্যা কোথায়? তার ছেলেকে দেখতে এসেছে। তোর ইচ্ছে না থাকলে চলে যা সামনে থেকে।

রোহান দমে গেলে ইশিতা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতো,
ইশিতা: কিছু মনে করো না বাবা, একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।

রোহান: জি, আমি সেই সময়ের অপেক্ষায় থাকবো।

বর্তমান-
ইশা দিহানকে নিয়ে দিব্যের রুমে চলে যায়।
রাজিয়া রহমান ইশাকে বলল,
রাজিয়া: ইশা, তুমি এখন থেকে রোহানের সাথে থাকবে দিহানকে নিয়ে। আমি তোমাদের জন্য রুমটা গুছিয়ে রেখেছি।

ইশা: না মা, আমি এখানেই থাকবো।

রাজিয়া: দেখো মা, রোহান এখন তোমার স্বামী। আমি একটা ছেলে হারিয়েছি। রোহানকে হারাতে চাই না। ইশা রোহানের ভবিষ্যৎ এখন তোমার সাথে। তুমি মেনে নাও এই সম্পর্ক। কিসের জেদ ধরে আছো? দিব্যের হায়াত ওতোটুকুই ছিলো। তোমার ভাগ্যে তোমার স্বামী দুজন লেখা ছিলো, তাই আজ রোহানের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে। এখানে রোহানের তো কোনো অপরাধ নেই। তোমার আর দিহানের জন্য ও সব করতে পারবে। ছেলেটা সব কথা নিজের মাঝে চেপে রাখে, দিব্যের মতো কারো সাথে ভাগ করে না। তাই হয়তো বোঝা যায় না ও কতোটা কষ্টে আছে।
ইশা আর কিছু বলতে পারলো না। তার ইচ্ছের উপর তো সব চলবে না। তাই না চাইতেও তাকে রোহানের রুমে শিফট হতে হয়।
আর এদিকে রোহানের আজ খুব ভালো লাগছে কারণ ইশা আসবে বাসায় দিহানকে নিয়ে। দুইমাস পর ইশাকে দেখবে, এখন আর পালাবে কোথায়? সারাদিন তো আর নিজেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না!
বাসায় আসার সময় ইশার জন্য ফুচকা কিনে আনলো রোহান। ভার্সিটিতে ইশাকে ফুচকায় খেতে বেশি দেখেছিলো সে। সাথে অনেকগুলো কিটকাট চকোলেট কিনলো। ইশার কিটকাট চকোলেট অনেক পছন্দের। দিব্যও প্রতিদিন নিয়ে আসতো বাসায় আসার সময়। সাথে একটা গোলাপ ফুলও আনতো মাঝে মাঝে। ইশার গোলাপ ফুলও অনেক পছন্দ, অনেক ইচ্ছে হচ্ছে, ইশাকে গোলাপ ফুল দেওয়ার কিন্তু যদি অন্য কিছু মনে করে? তাই আর নিলো না।
বাসায় এসে সোজা দিব্যের রুমে যায়, কিন্তু ইশা আর দিহানকে না দেখে দমে যায়। রাজিয়া রহমানকে জিজ্ঞেস করলো,
রোহান: মা, ইশা আর দিহান আসে নি?

রাজিয়া মনে মনে হাসলেন, মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
রাজিয়া: না।

না শুনেই মুহূর্তে রোহানের মুখের আমেজ বিলীন হয়ে গেলো। মন খারাপ করে টেবিলের উপর ফুচকার প্যাকেট আর চকোলেটগুলো রেখে রুমে চলে আসার সময় রাজিয়া বললেন,
রাজিয়া: এগুলো কার জন্য?

রোহান: ইশার জন্য এনেছিলাম। ওর পছন্দের।

রাজিয়া মুচকি হাসলেন। রোহান রুমে এসে দেখলো, নীল জামা পড়া একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে শান্ত ভাবে। ইশাকে তার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো রোহান। আবার যেন আমেজ ফিরে পেয়েছে। ইশার পাশে এসে বসলো, ফ্যানের বাতাসে চুলগুলো উড়ে এসে মুখের উপর পড়েছে। এতো মায়া মেয়েটির মাঝে, কি নিষ্পাপ লাগছে দেখতে। দেখে মনেই হচ্ছে না এই মেয়েটিই আবার ঝগড়াও করতে পারে।
রোহান ইশার চুলগুলো আস্তে করে সরিয়ে দিলো। ঘুমিয়ে থাকুক আজ ইশা। এতো কাছ থেকে, গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার সুযোগটা সে হাত ছাড়া করবে না। অনেকক্ষণ এভাবেই তাকিয়ে ছিলো রোহান। এক শান্ত আর মিষ্টি ভালোবাসার নজরে দেখছিলো রোহান তার প্রিয়তমাকে। যে চাহনিতে কোনো লালসা নেই, কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো অভিমান আর অভিযোগের স্থান নেই, এই চাহনিতে শুধুই আছে প্রকৃত ভালোবাসা, অসীম মায়া, তীব্র অনুভূতি আর মিষ্টি সন্তুষ্টি।
ইশার নড়েচড়ে উঠাতে, রোহান তাড়াতাড়ি সরে পড়ল। ইশা রোহানকে দেখে খানিকটা লজ্জা পায়।

মনে মনে ভাবছে,
ইশা: উনি কি ভাববে? আমি এসেই উনার রুমে অভদ্রের মতো ঘুমিয়ে পড়েছি! নির্লজ্জ বলবে।

ইশা নিজের কাপড় ঠিক করে রোহানকে বলল,
ইশা: মা বলেছিল তাই এই রুমে এসেছি। আমার ইচ্ছে ছিলো না। আপনার সমস্যা হলে আমি দিহানকে নিয়ে চলে যাবো। আপনি একটু মাকে বোঝাবেন শুধু।

রোহান মনে মনে ভাবছে,
রোহান: এই মেয়েটা এতো অদ্ভুত কেন? এতোদিন পর আমাকে দেখে জিজ্ঞেসও করলো না কেমন ছিলাম এতোদিন! শুরুতেই তার অদ্ভুত সব কথাবার্তা।

রোহান: সমস্যা হবে না আমার।

ইশা: কেন সমস্যা হবে না? আপনি কোথায় থাকবেন?

রোহান: দিহানের পাশে।

ইশা: আমি কোথায় থাকবো তাহলে?

রোহান: দুইটা বালিশ দিয়ে রাখতে পারো মধ্যে। বিছানা যথেষ্ট বড়ো আছে। এখন কোনো সমস্যা হবে না।

রোহানের উত্তর শুনে ইশা মনে মনে খুশি হলো। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। রাজিয়া ইশাকে দেখে বলল,
রাজিয়া: ঘুম ভেঙেছে?

ইশা: জি, মা।

রাজিয়া: তোমার বর এনেছে এগুলো তোমার জন্যে।

ইশা প্যাকেট খুলে দেখলো ফুচকা আর সাথে অনেকগুলো কিটকাট। ইশা মনে মনে খুব খুশি হলো। দিব্যও নিয়ে আসতো তার জন্য কিটকাট চকোলেট। আর অনেকদিন ধরেই ইশার ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু কাকে বলবে? বাবাকে বলেছিলো, কিন্তু বাবার ভাষ্যে, ‘এসব বাইরের জিনিস খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে, আর সে অসুস্থ হলে তার বাচ্চাও অসুস্থ হয়ে যাবে।’ ইশার এসব আবদার কেউ পূরণ করে না। একমাত্র দিব্যই সব বুঝতো। আর আজ রোহানও বুঝলো। ইশাকে অনেকদিন পর মুচকি হাসতে দেখলো রাজিয়া রহমান। ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
রাজিয়া: তোমার মুখে হাসিই মানায়। আর মন খারাপ করে থেকো না।

ইশা মুচকি হেসে বলল,
ইশা: জি।
রাতের খাবার শেষে সব গুছিয়ে ইশা রুমে এসে দেখলো, রোহান দিহানের সাথে হাসছে।

ইশা মনে মনে ভাবছে, দিব্য থাকলে হয়তো এভাবেই দিহানের সাথে খেলতো। রোহানের হাসি অনেকটা দিব্যের মতোই। রোহান হাসলেও গালে টোল পড়ে। রোহান ইশাকে দেখে বলল,
রোহান: আমার ছেলে আমাকে কাছে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে। আমাকে বলছে, এতোদিন আমাকে ছাড়া তার ভালো লাগে নি।

ইশা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
ইশা: আমার ছেলে প্রতিদিন আমার সাথে হাসতো, খেলতো। যদি কেউ মনে করে আমার ছেলে এতোদিন ভালো ছিলো না এইটা তার মনের ভুল।

রোহান: ছেলেটা একদম তার বাবার মতো হয়েছে। ভালো না লাগলেও হাসতে পারে, কাউকে বুঝতে দেয় না।

ইশা: আপনি কি বুঝাতে চান? আমার ছেলে, আমার সাথে ভালো থাকে না?

রোহান: ভালো থাকে না তো বলিনি। বলেছি, আমাকে ছাড়াও তার ভালো লাগে না। আমার ছেলের তো মা-বাবা দুজনকেই চাই। তাই না বাবা?

দিহান আবার হেসে দেয়। দিহানকে খিলখিলিয়ে হাসতে দেখে ইশা রোহানকে আর কিছু বলে নি। অদ্ভুত লোকটার জন্য সে তার ছেলের মন খারাপ করতে চাই না। আর যায় হোক, এই অদ্ভুত লোকটা তার ছেলের বাবা।

এদিকে রিধির জন্য আজকের দিনটা বড়োই আনন্দের। কারণ রক্তিম আর রিধির বিয়ের ব্যাপারে রিধির আম্মি-বাপ্পি রাজি হয় শেষমেশ। আর এই রাজি করানোর ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে রিধির দুই কলিজার বান্ধবী বর্ণ আর দিয়া সাথে তার অনু ভাইয়া।
দুইসপ্তাহ সময় নেয় তারা। দুই সপ্তাহ পর রিধি আর রক্তিমের বিয়ে। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ছাড়াও আশেপাশের অনেককে দাওয়াত করা হয়। অদিতিও দেশে এসেছে রিধির মন রক্ষা করার জন্য। রিধি অনেক অনুরোধ করেছিলো। অদিতির মনেও কোনো অভিযোগ নেই আর, পাকিস্তানি একটি ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে তিনমাস হলো। ছেলেটির নাম আহাদ রোস্তম। অদিতির সাথে কাজ করতো কোম্পানিতে। ভালো বন্ধুত্বও ছিলো তাদের। অদিতিকে পছন্দ করতো অনেক আগে থেকেই। কিন্তু অদিতি রক্তিমকে ভালোবাসতো তাই কখনো আহাদ তার ভালোলাগার কথাটি জানায় নি। কিন্তু যখন জানতে পারলো রক্তিম অন্য একজনকে পছন্দ করে, আহাদ আর এই সুযোগ হাত ছাড়া করলো না। অদিতির মনে জায়গা করেই নিলো।
রিধি আর রক্তিম এয়ারপোর্টে এসেছে অদিতি ও তার হাসবেন্ডকে রিসিভ করতে। অদিতি রক্তিমের সাথে আহাদের পরিচয় করিয়ে দিলো।
আহাদ রক্তিমের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
আহাদ: নাইস টু মিট ইউ। এন্ড থ্যাংকু ইউ সো মাচ। ইউ হ্যাল্পড মি টু গেট দিস লাভলী ল্যাডি।

রক্তিম মুচকি হাসলো। অদিতি রক্তিমের কানের কাছে এসে বলল,
অদিতি: দেখেছো, তোমার চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম। তুমি কি ভেবেছিলে, তুমিই একমাত্র সুদর্শন? হুহ।

রিধি অদিতিকে বলল,
রিধি: আপু তোমার বরটা না খুব…..

রক্তিম বাঁকা চোখে তাকাতেই রিধি চুপ হয়ে যায়, আর মনে মনে বলে,
রিধি: বুইড়া ব্যাটা, রাক্ষস, এতো জ্বলছে কেন এখন? আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে যখন আমার ভার্সিটির মেয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলো তখন কি আমার জ্বলে না? খুব তো হেসে হেসে দাওয়াত দিচ্ছিলো ওইদিন। আর আমি কারো দিকে তাকালে, একটু প্রশংসা করলেই দোষ। হুহ।

রিধি রক্তিমকে ভেংচি দিয়ে আহাদের কাছে গিয়ে বলল,
রিধি: ইউ আর টু ইয়াং এন্ড সো হ্যান্ডসাম।
অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল,
রিধি: আপু, আমি কি তোমার বরকে আমার ক্রাশ লিস্টে স্থান দিতে পারবো?

অদিতি রক্তিমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
অদিতি: অবশ্যই।

রক্তিম রিধির হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনলো, আর বলল,
রক্তিম: বাসায় যাওয়া যাক। কাম আহাদ। গেট ইন।

আহাদ: ইয়াহ ম্যান।

আহাদ আর অদিতি সামনে চলে গেলে রক্তিম রিধির হাত ধরে বলল,
রক্তিম: কি বলছিলে তুমি? ক্রাশ লিস্ট মানে কি? তুমি কয়জনের উপর ক্রাশ খাও সারাদিন? রাস্তাঘাটে, যাকে দেখো তাকে তোমার ভালো লেগে যায়। আমাকে কি চোখে পড়ে না?

রিধি: হুম, পড়বে না কেন? তুমি তো হচ্ছো আমার ওল্ড এন্ড এক্স ক্রাশ।

রক্তিম: মানে?

রিধি: মানে হচ্ছে, বুড়োদের মধ্যে একমাত্র তুমিই আমার ক্রাশ, আর এক্স হয়ে গেছো, এখন তো রিসেন্ট ওই যে আপুর বরটা। যা ইয়াং!

রক্তিম: আমি তোমার এক্স? তাকাবে না ওইটার দিকে। আমার দিকে তাকাও।

রিধি: আরেহ, এক্স ক্রাশ বলতে, পুরনো ক্রাশ বলছি। ভালো তো শুধু তোমাকেই বাসি। তুমিই তো আমার ওয়ান এন্ড অনলি ভালোবাসা। আমার একমাত্র বুড়ো রাক্ষস। এই জায়গা কি আমি আর কাউকে দিতে পারি বলো?

রক্তিম মুচকি হেসে বলল,
রক্তিম: অদিতির বরের দিকে চোখ দেবে না।

রিধি: কেন?
রিধি তারপর রক্তিমের বুকের কাছে নাক লাগিয়ে বলল,
রিধি: পোড়া গন্ধ আসছে।

রক্তিম: ভালো হয়েছে। এবার তোমার এসব ঢং বন্ধ করো। চলো এখন।

দুইসপ্তাহ পর রিধি আর রক্তিমের মেহেদী রাত। মেহেদী অনুষ্ঠান একসাথেই হয়। রোহান, ইশা আর দিহানকে নিয়ে এসেছে রিধি-রক্তিমের মেহেদী অনুষ্ঠানে। ইশা আজ হলুদ শাড়ি পড়েছে। রোহান ইশার সাথে মিলিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে।

রিধি রোহানকে বলল,
রিধি: আজকে কিন্তু একটা গান অবশ্যই গাওয়া লাগবে।

রোহান: আজকের গানটা আমার ছেলের মায়ের জন্য গাইবো। হবে তো?

রিধি: একদম ফাটাফাটি হবে।

রিধি আর রক্তিম একে অপরের হাত ধরে আছে। তাদের দেখে অনিক দিয়ার হাত ধরলো শক্ত করে।

দিয়া: কি করছো?

অনিক: আমার বউয়ের হাত ধরেছি।

দিয়া: সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু লোকে কি বলবে?

অনিক: আমার বউ, আমি ধরবো হাত,
আজ যে আমাদের ভালোবাসার রাত।

দিয়া: বিয়ে তোমার বোনের হচ্ছে, আমাদের না।

অনিক: আমার জন্য তো প্রতিদিন বিয়ের রাত।

দিয়া: মানে?

অনিক: দূর, কি হাত ধরলাম, কতো কথা তার! যাও।

অনিক হাত ছেড়ে দিলে, দিয়া আবার শক্ত করে ধরে ফেললো, আর বলল,
দিয়া: ছাড়বে না একদম।

অনিক মুচকি হাসলো।

রোহান গিটার হাতে নিলো। ইশার দিকে তাকাতেই ইশা চোখ নামিয়ে ফেলল। আজ অনেক মাস পর রোহান গিটারে হাত দিয়েছে। আজ তার প্রেয়সীর জন্য সে গান গাইবে, যে এখন শুধুই তার প্রেয়সী। যার উপর এখন শুধুমাত্র রোহানের অধিকার। আর কারো কোনো অধিকার নেই।

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
অন্ধ করে রাখে, তোমারে দেখিতে দেয় না।
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই হারাই’ সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
আশ না মিটিতে হারাইয়া– পলক না পড়িতে হারাইয়া–
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে।
ওহে, কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে–
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
আমার সাধ্য কিবা তোমারে– দয়া না করিলে কে পারে– তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে।
আর-কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ–
ওহে তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয় -বাসনা বিসর্জন।
দিব শ্রীচরণে বিষয়– দিব অকাতরে বিষয়–
দিব তোমার লাগি বিষয় -বাসনা বিসর্জন।”

রোহান ইশার দিকে তাকিয়ে পুরো গানটি শেষ করলো। ইশা একটিবারের জন্যও রোহানের দিকে তাকায় নি। লজ্জা লাগছিল ইশার খুব।

পরের দিন রিধি আর রক্তিমের বিয়ে হয়ে যায়। রক্তিম আর রিধির অপেক্ষার সমাপ্তি হয় অবশেষে।

বাসর ঘরে বসে আছে রিধি। রক্তিম ঘরে ঢুকার সাথে সাথেই রিধি বিছানা ছেড়ে নেমে হাত এগিয়ে দেয়।

রক্তিম রিধির হাত ধরে বলল,
রক্তিম: আমার বউটাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।

রিধি: জানি, সবাই বলেছে।

রক্তিম: কে কে বলেছে?

রিধি: ইফতি, আদি, শাহেদ, ইমতিয়াজ, নাফিজ, আরমান….

রক্তিম: ওকে, ওকে, শেষ করো। আজকে আমাদের বাসর, রিধি। আর তুমি অন্য ছেলেদের কথা বলছো?

রিধি: ওমা, তুমি জিজ্ঞেস করেছো কে কে বলেছে সুন্দর লাগছে?

রক্তিম: ওকে বাদ। এখন শুধু তুমি আর আমি।

রিধি: হুম, আগে আমার গিফট।

রক্তিম: মানে? কিসের গিফট?

রিধি: আজ বর বউকে গিফট দেয়। আমারটা কোথায়?

রক্তিম: কি গিফট লাগবে আবার বউটার?

রিধি: ওয়েট, ওয়েট লিস্ট করতে হবে।

রক্তিম: লিস্ট করতে হবে না। তোমার যদি সম্মতি থাকে, তবে সবচেয়ে বড়ো গিফটটা তোমায় দেবো।

রিধি: সত্যি? দাও দাও।

রক্তিম: এতো তাড়াতাড়ি তো হয় না। বাবু আসতে তো সময় লাগবে। এখন থেকে প্রস্তুতি নিলাম না হয়।

রিধি: বাবু? এই, আজ মাত্র বিয়ে হয়েছে আমাদের, কোথায় আমাকে হানিমুনে নিয়ে যাবে, তা না। বাবু নেওয়ার প্ল্যান করছো? হুহ। আসলেই বুড়ো হয়ে গেছো তুমি। এখনই বাবা হওয়ার ইচ্ছে জাগছে, কিছুদিন পর শ্বশুর হতে চাইবা, তারপর দাদা-নানা।

রক্তিম: আচ্ছা, সরি। বলো কি লাগবে গিফট?

রিধি: লাগবে না কিছু, বুড়ো রাক্ষস তুমি।

রক্তিম: আমাকে তোমার বুড়ো লাগে? তুমি জানো, কতো মেয়ে আমার পেছনে ঘুরে।

রিধি: কি? ছিঃ রক্তিম ছিঃ। তুমি অন্য মেয়েদের নাচাও?

রক্তিম: রিধি, আজকে আমাদের বাসর। তুমি এসব ঝগড়া কি আজ বাদ দিতে পারো না?

রক্তিম বারান্দায় চলে যায় রাগ করে। রিধি এসে রক্তিমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

রিধি: আমায় ফেলে চলে এসেছো কেন?

রক্তিম: আমি হয়তো তোমার যোগ্য না। আমাদের বয়সের পার্থক্য অনেক। কিন্তু আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি রিধি।

রিধি: কি বলছো রক্তিম তুমি? কে বলেছে তুমি আমার যোগ্য না? তুমি আমার সবকিছু। আমি তোমাকে ছাড়া কখনো ভালো থাকবো না। ভালোবাসার মানুষকে পছন্দের নামে ডাকতে সবার ভালো লাগে। আমার বুড়ো নামটি ভালো লেগেছে।

রিধি রক্তিমের মুখে হাত দিয়ে বলল,
রিধি: তুমি কি রাগ করো? আমি তো আদর করে বলি। রক্তিম, তুমিই হচ্ছো আমার মিস্টার পারফেক্ট। আমার ভালোবাসা। সরি, আর কখনো ডাকবো না বুড়ো।

রক্তিম হেসে রিধিকে জড়িয়ে ধরলো,
রক্তিম: আমার বউটার যেমন ইচ্ছে হয়, তেমন নামে ডাকবে।
রক্তিম রিধির দিকে তাকিয়ে আছে বাঁধাহীন ভাবে।

রিধি বলল,
রিধি: কি দেখছো?

রক্তিম: ছোট্ট একটা মেয়ে এসেছিলো একদিন, মেয়েটিকে কখন ভালোবেসে ফেলি আমার জানা হয় নি। আর আজ মেয়েটি আমার বউ।

রিধি: হুম। ইয়া লম্বা একটা ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল একদিন। যে রোজ আমায় বকতো, আবার চকোলেটও কিনে আনতো রাগ ভাঙানোর জন্য। একটা পঁচা রাক্ষস ছিলো সে। তারপর সেই রাক্ষসটায় আমার মনে জায়গা করে ফেলে। আজ রাক্ষসটি আমার বাচ্চার দাদীর একমাত্র পুত্রবধূর বর।

রক্তিম রিধিকে আরো কাছে টেনে নেয়। আজ থেকে শুরু হবে রিধি আর রক্তিমের নতুন সংসার, যেখানে থাকবে ছোটখাটো অপেক্ষা।

রক্তিম অফিসে গেলে তার ফোনের অপেক্ষায় থাকবে রিধি। রক্তিম কবে বাসায় ফিরবে সেই অপেক্ষায় থাকবে রিধি। সাপ্তাহিক ছুটির অপেক্ষায় থাকবে তারা, যেদিন একটু বেশি সময় ভালোবাসার মানুষটির সাথে কাটাতে পারবে। এই অপেক্ষা মিষ্টি অপেক্ষা। এখানে কোনো কষ্ট নেই, যন্ত্রণার স্পর্শ নেই, শুধুই ভালোবাসা আর ভালোলাগার স্থান।

সকালে রিধির ঘুম ভাঙার পর সে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিলো। রক্তিমের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য শাড়ি পড়ে নিলো। মাথায় খোঁপা করলো আলগাভাবে। সুন্দর করে কাজল লাগালো চোখে। তারপর রান্নাঘরে চলে গেলো রক্তিমের জন্য নাস্তা বানাতে।

এদিকে রক্তিমের এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো। রিধিই এলার্ম সেট করে রেখেছিলো। রক্তিম আশেপাশে রিধিকে না দেখে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে আসলো রিধিকে খুঁজতে। রিধিকে দেখে রক্তিম হাঁ করে তাকিয়ে আছে। রিধির কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো।

রক্তিম: সুন্দর লাগছে।

রিধি: চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।

রিধি টেবিল ফ্যান চালু করে দিলো। রক্তিম ক্যাবিনেটে উপর বসে পড়লো। ফ্যানের বাতাসে রিধির চুলগুলো ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে।

রক্তিম মনে মনে হাসছে আর ভাবছে মেয়েটির এখনো মনে আছে আমার ইচ্ছের কথা!

রক্তিম রিধির কাছে এসে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে কপালে চুমু এঁকে দিলো। এমন সময় নবনী এসে পড়লো। রক্তিম আর রিধি নবনীকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।

নবনী হেসে বলল,
নবনী: এতো বড়ো রুম কেন দিয়েছি তোদের?

রক্তিম: আচ্ছা, আমি আসছি।

রিধি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
রিধি: বদ একটা। আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়ে এসেছে।

রিধি রুমে এসে রক্তিমকে ইচ্ছেমত শুনিয়ে দিলো, আর রক্তিম রিধির মাথা ঠান্ডা করায় ব্যস্ত। এখন হয়তো রোজ চলবে তাদের দুষ্টু-মিষ্টি ভালোবাসা।

এদিকে রাত দশটায় রোহান ইশাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে ছাদে এসে দেখলো ইশা দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে।

ইশা রোহানের উপস্থিতি টের পেয়ে রোহানকে বলল,
ইশা: আপনাকে একটা অনুরোধ করবো রাখবেন?

রোহান: হ্যাঁ, অবশ্যই।

ইশা: আমার থেকে আপনি তেমন কোনো আশা রাখবেন না কখনো। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। আমি দিব্যের জায়গা দিতে পারবো না আপনাকে। ভালো হবে আপনি কোনো অপেক্ষায় থাকবেন না আর।

কথাটি বলে ইশা ছাদ থেকে নেমে পড়ল। রোহানের বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

এক অন্ধকার রাতকে সাক্ষী রেখে রোহান মনে মনে বলছে ,
তোমায় কাছে পেয়েও পেলাম না ইশা। কিন্তু যতোটুকু পেয়েছি, এর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি হয় না। আমি এখন অনেক সুখে আছি। অনেকটা সম্পূর্ণ। তুমি নাই বা আমার হলে, কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো হারাবে না। আমি অপেক্ষা করাও ছাড়বো না। অপেক্ষায় থাকবো। তোমায় কাছে পাওয়ার অপেক্ষা।

সমাপ্তি—-

(বি:দ্র- অপেক্ষা দ্বিতীয় অধ্যায় আসবে।)

আগের পর্ব 👇
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/375295847525527/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here