অপেক্ষা পর্ব-৪০:
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
অনেকক্ষণ ধরেই দিয়া মোবাইল নিয়ে গুঁতাগুঁতি করছে। ফয়সাল আহমেদ মেয়েকে নতুন মোবাইল কিনে দিয়েছেন। নতুন মোবাইল পাওয়ার আনন্দে প্লে স্টোর থেকে যত এপ্স আছে নামিয়ে ফেলে দিয়া। নতুন নতুন গেইমস ডাউনলোড করে। কিছুক্ষণ খেলার পর আবার ডিলিট করে দেয়। দিয়া ফেইসবুক একাউন্ট অনেক আগেই খুলেছিলো। কিন্তু সে ফেইসবুকে ঢুকতো জামা-কাপড়, ব্যাগ-জুতো এসবের বিজ্ঞাপন দেখতে। এসব দেখেই বের হয়ে যেতো। মানুষের মোবাইল ভর্তি নিজের ছবি থাকে। আর দিয়ার মোবাইল ভর্তি জামা- শাড়ী এসবের ছবি। সারাদিন বসে বসে মার্ক করা পেইজের লাইভ দেখতো আর রাতে এসবের স্বপ্ন দেখতো।
দিয়ার কোনো ছেলে তো বহুদূর, কোনো মেয়ের সাথেও চ্যাট করা একদম বিরক্তিকর মনে হয়। শুধুমাত্র রিধির সাথে ভয়েস পাঠিয়ে কথা বলে। আজ অনেকদিন পর সে মেসেঞ্জারে ঢুকলো। অনেকগুলো মেসেজ জমে আছে। এভাবে আনরিড মেসেজ চোখের সামনে দেখলে তার চোখ চুলকায়। তাই যে মেসেজগুলো দেখার ইচ্ছে নেই, সবগুলো পাঠিয়ে দেয় ইগ্নোর মেসেজ বক্সে। হঠাৎ চোখ পড়লো মেসেজ রিকোয়েস্টে, ‘তুমি কি আমার গল্পের নায়িকা হবে’ এটি কোনো মেসেজ ছিলো না, এটি ছিলো আইডির নাম। কৌতুহলবশত মেসেজটা দেখলো দিয়া।
অনেকগুলো মেসেজ এসেছিলো ফেইক আইডিটা থেকে। দুইবছর ধরে মেসেজ দিচ্ছে। দিয়া মনে মনে ভাবছে, ‘লোকটা কি মানসিক রোগী?’
-হাই।
-হ্যালো, মিস দিয়া।
-তুমি সারাদিন কি করো? আমার দিকে না হয়, না-ই তাকালে, মেসেজগুলো কি চোখে পড়লো না?
-তুমি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটলে অনেক কিউট লাগে।
দিয়া মেসেজটা পড়েই হাঁ হয়ে যায়।
দিয়া: ইশ, কি ছ্যাঁচড়া!
এই মেসেজগুলো এসেছে যখন সে কলেজের প্রথম বর্ষে। এরপর অনেকদিন কোনো মেসেজ দেয় নি। পরের মেসেজটা এসেছে ছয়মাস পর।
-এই দিয়া, দিয়া,দি…য়া তোমার নামটা, তোমার মতোই সুন্দর।
-চোখে কাজল দিলে তোমাকে মারাত্মক লাগে।
-এই মেয়ে, আজ আমি কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম।
দিয়া ভাবছে, ভয় পেয়েছে মানে কি? আমি কি তাকে ভূত সেজে ভয় দেখাতে গিয়েছিলাম? অদ্ভুত তো লোকটা!
পরের মেসেজটা ছিলো।
-তুমি কি গান শিখতে চাও? আমি কিন্তু ভালোই গান গাইতে পারি।
দিয়া: আজিব, লোকটা আমাকে গান শেখাবে কেন? আমি কি বলেছিলাম তাকে? আর মেসেজ দেখে মনে হচ্ছে লোকটা আমাকে চেনে। কে এই ছ্যাঁচড়া? একবার সামনে আয়। আমার দুই দুইটা হিটলার ভাইয়ের দিয়ে তোকে মেরে আলোর গতিতে পৃথিবী থেকে বের করে দেবো।
এরপর অনেকদিন কোনো মেসেজ দেয় নি। পরের মেসেজটা এসেছিলো যেদিন দিব্য ইশাকে প্রপোজ করেছিলো ঐদিন রাতে। তারিখ দিয়ার মনে আছে এখনো।
– তোমাকে নীল রঙে একটু বেশিই মানায়। তোমার বিয়েতে নীল শাড়ী পড়ো।
দিয়া মেসেজটা দেখে বুঝে যায় ছেলেটা তাকে ভালো করেই চেনে। এখন দিয়ার মাথায় ঘুরছে, ‘যে করেই হোক আমার জানতে হবে এই ছ্যাঁচড়াটা কে?’
যেই ভাবা সেই কাজ। দিয়া মেসেজের রিপ্লাই দেয়।
দিয়া: ওই ছ্যাঁচড়া পোলা, সাহস থাকলে নায়কের মতো মেসেজ দে। আর এসব কি আজাইরা মেসেজ? ইস কি বিশ্রী নামও আবার। আর কি নাম খুঁজে পাস নি? আর কোন সাহসে আমার আইডিতে আমাকে মেসেজ দিয়েছিস? জানিস আমি কার বোন?
দুই-তিনঘন্টা পর মেসেজের রিপ্লাই আসে।
-নায়করা কিভাবে মেসেজ দেয় আমার তো জানা নেই। তুমি কি নায়কদের সাথে চ্যাট করো? আমাকে স্যাম্পল দাও। আমি ওইভাবে মেসেজ দেবো তারপর।
দিয়া: এই তুমি কে, হ্যাঁ?
-আমি তোমার মতোই এক অতিসাধারণ মানুষ।
দিয়া: আমি কি বলেছি তুমি এলিয়েন? মানুষই তো হওয়ার কথা। আর তুমি আমাকে কিভাবে চেনো?
-আমি আর তুমি তো একই জায়গায় বাস করি।
দিয়া: মানে? তুমি কোথায় থাকো?
-পৃথিবী নামক গ্রহে থাকি।
এক আকাশের নিচে তুমি আমি।
একই সাথে অক্সিজেন নেয় আর ছাড়ি।
প্রতিদিন আমি তোমায় খুঁজে মরি।
তুমিই শুধু আমার গল্পের একমাত্র নারী।
দিয়া: ভাই আপনি কে?
-ভাইয়া বললে চটকা দেবো,
আমি তো শুধুই ভালোবাসা নেবো।
দিয়া: ব্লক মেরে তোর চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করবো।
-মিস, দিয়া। ব্লক দিলে আমাকেই হারিয়ে ফেলবে। আমার চৌদ্দপুরুষ সম্পর্কে আর জানা হবে না।
দিয়া: অসহ্য।
দিয়া অফলাইনে চলে যায়। প্রথম কোনো ছেলের সাথে দিয়া কথা বলছে। ভিন্ন ধরণের অনুভূতির জন্ম নিচ্ছে। ব্লক দিতে মন চাইছে না। কারণ দিয়া এখন এই রহস্যময় আইডির মালিককে খুঁজতে চায়। তার জানতেই হবে সে কে, যে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখেছে।
পরের দিন সকালে দিয়া ভার্সিটির জন্য বের হয়। ছোট একটা বাচ্চা এসে তাকে একটি গোলাপ ফুল আর একটি চিরকুট দিয়ে চলে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ দেয় নি বাচ্চাটি।
চিরকুট খুলে দেখলো,
‘ভালোবাসি তোমায় প্রথম দিন থেকে,
যত্নের সাথে চোখের আলোতে রেখে,
হোক বইয়ের পাতায় বা মনের খাতায় তোমার ছবি এঁকে,
দিয়া তুমি জ্বালিয়ে রেখেছো মনের প্রদীপ ঢেকে,
নিজেকে উৎসর্গ করার ইচ্ছে আমার, তোমার হাত দুটি চেয়ে,
ধন্য হবো তোমার মতো কোমল কিরণ পেয়ে।’
দিয়া চিরকুট থেকে চোখ তুলে আশেপাশে দেখলো। কিন্তু চোখে পড়লো না এমন কাউকে, যাকে চিরকুটটির মালিক বলে সন্দেহ করতে পারবে। দিয়ার মাথায় এখন কিছুই ঢুকছে না। আর এসব অনর্থক চিন্তা করে মাথা গুলিয়ে ফেলে মানসিক রোগী হওয়ার ইচ্ছে নেই তার। এমনিতেও পড়াশুনার চাপ কি কম? তার উপর তার হিটলার ভাই দুইটি যদি জানতে পারে কেউ তাকে বিরক্ত করছে, তাহলে চাপের উপর চাপ দিয়ে নতুন মোবাইলটা নিয়ে ফেললে সব শেষ। দিয়া আর যায় হোক যত্তসব ছ্যাঁচড়ার জন্য নিজের ভালোবাসার মোবাইলটা বিসর্জন দিতে পারবে না।
ঘড়িতে রাত বারোটা, আকাশ পরিষ্কার। একটা সুন্দর চাঁদের জায়গা হয়েছে ওই কালো আকাশটায়। রোহান ছাদে বসে গিটারে সুর দেওয়ার চেষ্টা করছে। দিব্য, রোহানকে একা বসে থাকতে দেখে তার পাশে এসে বসলো।
দিব্য: ভালো আছিস?
রোহান হালকা হেসে বলল,
রোহান: আমাদের কি অনেকদিন পর দেখা হয়েছে?
দিব্য: কিছু মানুষ প্রতিদিন আমাদের সামনে থাকে তাই আর জিজ্ঞেস করা হয় না, তারা কেমন আছে। কিন্তু প্রতিদিন তো সবাই ভালো থাকে না। কিছু কষ্টতো থাকেই, যা হয়তো তারা লুকিয়ে রাখে।
রোহান: ভালো আছি। আগে ভালো ছিলাম না। খুশির অভাব ছিলো। আঘাত পেলে শান্ত হয়ে যাওয়ার মতো কোনো আশ্রয় খুঁজে পেতাম না। কিন্তু এখন আর আমি নিঃসঙ্গ নই। একটা সম্পূর্ণ পরিবার আছে। সকালে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙার মতো কৃত্রিমতা আমার জীবনের অভ্যাস ছিলো একসময়। এতো বিরক্তিকর শব্দ ছিলো! প্রতিদিন এক রাশ কষ্ট আর বিরক্ত নিয়ে উঠতাম ঘুম থেকে। আর এখন মা ডেকে দেয়, ‘বাবা অফিসে যাবি না তুই? দেরী হয়ে যাচ্ছে।’ ইচ্ছে করে এই ডাকটা শুনার জন্য আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। একসময় বুয়া এসে নাস্তা বানিয়ে দিতো। কখনো কখনো ক্যান্টিনে নাস্তা সারতাম। আর তাই মাঝে মাঝে এসব বাইরের খাবারের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়তাম। বাসায় এসে ট্যাবলেট খেয়েই নিজেকে সুস্থ করতাম। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতো, কেউ আমার খবর নিতে আসতো না। আর এখন সকাল সকাল মায়ের হাতের একটি রুটিতেই পেট ভরে যায়। অফিস শেষে বাসায় আসলে কেউ দৌঁড়ে আসে আমার জন্য। মিষ্টি একটা হাসিমাখা মুখ জিজ্ঞেস করে, ‘দুপুরে কি খাবি? ক্লান্ত লাগছে?’ বেশিক্ষণ রুম বন্ধ করে বসে থাকলে কেউ একজন দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকে উৎকন্ঠা নিয়ে। ‘রোহান, বাবা, তুই ঠিক আছিস তো?’ আমি আসলেই ভাল আছি, দিব্য। খুব বেশিই ভালো আছি এখন। একটা সময় ছিলো যখন দুপুরে আমি আর বাবা না খেয়েই থাকতাম। কখনো কখনো আপেল বা সালাদ বানাতাম। যেদিন বুয়া আসতো সে দুপুরে রান্না করে দিয়ে যেতো। কিন্তু ওই রান্নায় সেই মায়া-ভালোবাসা নেই, যেটি এখন আমি ফিরে পেয়েছি। সারাদিন বাইরে থেকে এসে নিজের এলোমেলো জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখতে হতো। ক্লান্ত লাগলে ওই ভাবেই ঘুমিয়ে পড়তাম। অসুস্থ পরিবেশে বড়ো হয়েছি আমি। কিন্তু এখন সবকিছুই সুস্থ। আমার আশপাশে এখন খুব শান্তি। কলেজে উঠার পর অনেকটায় শিখে ফেলেছি কিভাবে একা থাকতে হয়। কিন্তু স্কুলে যখন ছিলাম, তখন কেউ টিফিন বানিয়ে দেওয়ার মতো ছিলো না। কেউ নিতে আসতো না স্কুল থেকে। বাবাতো ব্যস্ত থাকতো। মাও তো ছিলো না পাশে। কেউ ছিলো না। কিন্তু আমি এখন বড়ো সুখী। দিব্য, আমি এখন অনেক ভালো আছি। আর কি চাই আমার?
দিব্য রোহানকে জড়িয়ে ধরলো, রোহানের চোখের কোণে পানি জমে নেই, কারণ সব শুকিয়ে গেছে।
দিব্য: আমি চাই তুই ভালো থাক সবসময়। কিন্তু এভাবে ভালো থাকবি না। তোর আর রিধির বিয়ের কথাবার্তা অনেকটাই ফাইনাল। আগামীকাল তোর এংগেইজমেন্ট। কিন্তু তুই জানিস না তুই কতো বড়ো ভুল করছিস।
রোহান: কি ভুল করছি?
দিব্য: রিধিকে বিয়ে করলে কখনো তুই সুখে থাকবি না। আমি জানি রিধি অনেক ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু ও তোকে সুখে রাখতে পারবে না। কারণ রিধি রক্তিম ভাইয়াকে ভালোবাসে।
রোহান: রক্তিম ভাইয়া, মানে.. বুঝলাম না ঠিক?
দিব্য রোহানকে সব খুলে বললো, রক্তিম আর রিধির ভালোবাসার কথা, সাথে রিধিকে মেনে না নেওয়ার যুক্তি।
রোহান: কি বলছিস এসব? ওহ শিট। এইটা খুবই অপমানজনক রিধির জন্য। মেয়েটার অবস্থা ভালো না। ওর চোখে মুখে অদ্ভুত কষ্ট। মানুষগুলোর মাঝে কি দয়া নেই?
দিব্য: আমিও এইটাই ভাবছি। এতোবছর কেন বড়ো করলো মেয়েটিকে? এতোকিছু করলো তারা, কিন্তু শেষটাই একদম বাজে করে দিলো। মেনে নিলে তেমন কোনো সমস্যা হতো না। আমার মনে হয় না বংশজাত এসব ভালোবাসার সম্পর্কগুলোতে টেনে আনা উচিত। তাদের ভালো থাকাটাই বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
রোহান: এখন তো এই বিয়ে অবশ্যই করবো আমি। বাবা-মাকে বলে বিয়ের তারিখটা আরো আগে এনে দিলে ভালো হয়। রিধিকে এভাবে অপমানিত হতে দিতে পারি না।
দিব্য: কিন্তু?
রোহান: তুই আমার কথা ভাবছিস? নাকি তাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবছিস? রিধি নিজেই আমাকে বলেছে সে নিজ ইচ্ছাতেই এই বিয়ে করছে। তার অর্থ হচ্ছে, রিধি কোনো সাপোর্ট পায় নি। সাপোর্ট পেলে বিয়েতে হ্যাঁ বলতো না। রিধি চাপে আছে হয়তো। আর সে সুখেও থাকবে না। কারণ মেনেই নিচ্ছে না রক্তিমের ফ্যামিলি। আর রিধির জায়গা কোথায়? রিধির কে আছে আপনজন, যে তার দায়িত্ব নেবে? আর আমি যদি না করে দেই, তারা কি অন্য ছেলের সাথে রিধির বিয়ে দেবে না? ওকে বসিয়ে তো রাখবে না আর! আর কয়জনই বা বুঝবে মেয়েটার কষ্ট? ভাগ্য হয়েছে আমার। আমি বুঝতে পেরেছি। ওর চোখের যন্ত্রণাগুলো আমার যন্ত্রণাগুলোর মতোই। দুইটা অসম্পূর্ণ অস্তিত্ব বুঝতে পারে তাদের দুর্বলতা।
দিব্য: রক্তিম ভাইয়া এখনো রিধিকে ভালোবাসে।
রোহান: ভালোবাসলে কিভাবে দেখছে এতোকিছু? চুপচাপ সহ্য করছে কেন? দিব্য শোন, এতোই ভালোবাসলে তার কিছু করা উচিত ছিলো। আর এখনো সুযোগ আছে। রিধি যদি কখনো রক্তিম ভাইয়ার কাছে ফিরে যেতে চায় আমি আটকাবো না। আমি শুধু মেয়েটিকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে চাচ্ছি। রিধিকে আমি বাঁচাবো এখন। এতোকিছু জানতাম না এতোদিন। কিন্তু এখন জেনেছি। এসব কথা আর শুনতে হবে না তাকে। মেয়েটার এসব সহ্য করার বয়স হয় নি এখনো। মানুষের ভালো মতো বাঁচার জন্য শুধু আত্মা থাকলে হয় না, মনের দরকার হয়। মনটা একবার ভাঙলে মানুষ খুব শক্ত হয়ে পড়ে। ওই শক্ত জীবনে সবকিছুই বড়োই প্যাঁচালো। ভালো লাগে না কিছু। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
দিব্য: নিজের কথা ভাবলি না একবারো?
রোহান: আমার নিজের কিছুই নেই। অন্যের জন্য কিছু করতে পারলেই ভালো লাগবে। আমাকে কিছু বলিস না আর। আমি অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
দিব্য মুচকি হেসে রোহানের কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিলো।
দিব্য: আমি তোর সাথে আছি। ইনশাল্লাহ ভালো কিছুই হবে।
পরেরদিন ফয়সাল-রাজিয়া, দিব্য আর রোহান রক্তিমদের বাসায় আসে। বেগম আতিকা আর জুনাইয়েত-নবনী তাদের অনেক আদর অভ্যর্থনা করেন। রক্তিম তাদের দেখে বুঝে ফেলেছে কি হতে যাচ্ছে। রক্তিম নবনী হোসেইনকে ডেকে আনে রুমে।
রক্তিম: কি হচ্ছে এসব, মা?
নবনী: আজকে রিধি আর রোহানের এংগেইজমেন্ট। যেহেতু দুই পক্ষের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হবে, তাই বাসায় দাওয়াত করলাম, সাথে এংগেইজমেন্টটাও হয়ে যাবে। আর ভালোমতো জানতেও পারবো আমাদের মেয়ের শ্বশুর-বাড়ির লোকদের।
রক্তিম: রিধি তোমাদের মেয়ে না। আর কখনো বলবে না রিধিকে তোমার মেয়ে। জানো মা, আমি ভাবতাম আমার মা কখনো এসব সমাজের ভ্রান্ত সংস্কার মানবে না। আমার মা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে। রিধিকে যখন তুমি ভালোবাসতে, আদর করতে আমার চেয়ে বেশি, তখন গর্ব হতো আমার। ভাবতাম আমার মায়ের মন কতো বড়ো। রিধি অসুস্থ হলে যখন তুমি চোখের পানি ফেলতে, রাত জাগতে, ভালো লাগতো অনেক। কেন জানো? যে মানুষ অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে তাদেরকেই বলে ‘মা’। সন্তান জন্ম দিলে মা হওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু একজন বন্ধ্যাও মা হতে পারে। কারণ মা হওয়ার জন্য মন দরকার। তুমি আমার মা হতে পেরেছো কারণ তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছো। কিন্তু রিধির মা হতে পারো নি। রিধির কি কোনো অধিকার নেই?
নবনী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন।
রক্তিম: রোহান ভালো ছেলে, আমি স্বীকার করলাম। কিন্তু আমি কি খারাপ? আমার মধ্যে কোনো সমস্যা আছে? তাহলে তুমি কেন আমার আর রিধির সম্পর্ক মানছো না? আমি বলছি কেন মানছো না। কারণ হচ্ছে রিধির কোনো বংশ-পরিচয় নেই, রিধির মা-বাবার কোনো পরিচয় নেই। সমাজের মানুষকে তোমরা কিভাবে বলবে একটা অনাথ মেয়েকে বউ করে আনলাম? বাবার আমাদের এই সম্পর্কে কোনো সমস্যা ছিলো না। শুধু তোমার আর নানুর চাপে তিনি চুপ করে আছেন।
নবনী: আমরা যা করছি তোর ভালোর জন্য। একসময় বুঝবি।
রক্তিম: বুঝতে হবে না আর। যা বোঝার বুঝেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও, মা। অনেক উঁচু গলায় কথা বলেছি আমি তোমার সাথে। কিন্তু রিধিকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষটিকে আমি চাপের উপর রাখতে চাই না। রিধি এখন থেকে স্বাধীন। তোমরা অধিকার হারিয়ে ফেলেছো। যাদের অধিকার আছে, এখন শুধু তারাই সিদ্ধান্ত নেবে রিধি আর রোহানের বিয়ে হবে কি হবে না। তোমরা আর কোনো মত রিধির উপর চাপিয়ে দেবে না।
নবনী: রক্তিম, তুই ওদের সামনে কোনো তামাশা সৃষ্টি করিস না।
রক্তিম: আমি জানি আমার কি করতে হবে। তামাশা এতোদিন হয়েছে, এখন যা উচিত তাই হবে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম। ধরে নিয়েছি বুঝতে পারবে। কিন্তু তোমরা সব সুযোগ শেষ করে দিলে। অপেক্ষার সমাপ্তিটা এতো বাজে হবে, জানা ছিলো না।
রিধি শাড়ী পড়ছে, আর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। মানুষ কষ্টের মধ্যেও নিজেকে সাজাতে পারে সেটি আজ রিধি নিজেকে দেখেই বুঝতে পারছে। শাড়ী পড়ছে, আর টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছছে। লিপস্টিক নিয়ে কাঁপা হাতে লাগাচ্ছে। আর নিজেকে দেখে তার আরো কান্না পাচ্ছে।
হঠাৎ রক্তিম, রিধির রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। রিধির কাছে এসে রিধিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। রাগের মাথায় তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে।
রিধি কাঁপা গলায় বলল,
রিধি: রক্তিম, লাগছে। কি করছো?
রক্তিম: এতোবড়ো কথা কিভাবে লুকিয়েছো আমার কাছ থেকে?
এই মেয়ে, চুপ করে আছো কেন? তোমার সাহস কিভাবে হয়, হ্যাঁ? তুমি এতো বড়ো হয়ে গেছো?
রিধি: আমাকে ভুলে যাও রক্তিম। আমাদের মিল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
রক্তিম: জানি না আছে কিনা। কিন্তু তোমার এভাবে বিয়েতে মত দেওয়া উচিত হয় নি।
রিধি: আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না।
রক্তিম: আমাকে কষ্ট দিচ্ছো কেন তাহলে?
রিধি: আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না আর।
রক্তিম রিধির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
রক্তিম: এতোদিন অপেক্ষা করিয়েছি তোমাকে। এতো সহজে হেরে যাবো না। আগামী দুইদিনের মধ্যে আমি সব ঠিক করে দেবো, ইনশাল্লাহ।
এরপর রিধি আর রোহানের এংগেইজমেন্ট হয়ে যায়। রক্তিম এককোণে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে অনেক কষ্টে। এভাবে সবার সামনে রিধি আর তার পরিবারকে অপমানিত করতে চায় না রক্তিম। তাই চুপ করে ছিলো।
রোহানের ফ্যামিলি বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময়, রক্তিম দিব্যকে আটকায়।
রক্তিম: দিব্য, তোমার একটা সাহায্য লাগবে।
দিব্য: জি। বলুন।
রক্তিম: অনিক, তোমার বন্ধু, আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই আগামীকাল। প্লিজ ওকে আমার সাথে দেখা করতে বলবে?
দিব্য: অনিকের সাথে কেন দেখা করবেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?
রক্তিম: অনিকের বোন, যাকে মেলায় হারিয়ে ফেলেছিলো, আমি চিনি মেয়েটিকে।
দিব্য: কে?
রক্তিম: আগামীকাল অনিককে নিয়ে আসবে। তখন জানতে পারবে।
আগামীকাল নতুন সূর্য উঠবে রিধির জীবনে। হয়তো আবার কিছু অস্তিত্বের অপেক্ষার সমাপ্তি হতে যাচ্ছে।
চলবে—
আগের পর্ব:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/374778317577280/