অপেক্ষা পর্ব-(৪১+৪২)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
৪১।
দিব্য গতকাল রাতেই অনিককে ফোন দিয়ে বলে, রক্তিম তার সাথে দেখা করতে চায়। অনিক অনেকবার জিজ্ঞেস করার পরও কেন দেখা করতে চায় এই ব্যাপারে দিব্য কিছুই জানায় নি। কারণ দিব্য জানে অনিক তার বোনের ব্যাপারে খুব ইমোশনাল। এখন যদি জানিয়ে দেয় অরনী সম্পর্কে কোনো খবর রক্তিম জানে, তবে অনিক আর সকাল হতে দেবে না।
এতোটা বছর অনিক তার বোন অরনীর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে আসছে। কারণ এগারো বছর আগে, বোনকে মেলায় নিয়ে যাওয়ার জেদ অনিকই করেছিলো। অনিক স্কুলের বন্ধুদের কাছে শুনেছিলো মেলায় অনেক কিছুই পাওয়া যায়। বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে সুন্দর সুন্দর সব রাইডারও আছে। তারা যেহেতু দেশের বাইরে ছিলো, বাংলাদেশের মেলা কখনো দেখে নি এবং সেই সম্পর্কে কোনো ধারণাও ছিলো না। বাসায় এসে অনিক এসব মেলার গল্প অরনীকে শুনিয়েছিলো। এরপর থেকেই অরনী মেলায় যাওয়ার বায়না ধরে। অরনীর সাথে অনিকও জোর করে বাবা-মাকে। এই কারণেই অনিক নিজেকে অপরাধী মনে করে। অরনীর মৃত্যুর পর তাদের জীবনের গতিপথ পালটে যায়।
অনিকের বাবা কামাল সিদ্দিক, অনেক বড়ো বিজনেসম্যান। তার সবকিছুই দেশের বাইরে। কামাল সিদ্দিক দেশের বাইরেই পড়াশুনা করেছিলেন। পড়াশুনা শেষ হওয়ার আগেই তার কাজিন আদিবা সিদ্দিকাকে বিয়ে করে সেখানেই নিয়ে যান। পরবর্তীতে বিজনেস দাঁড় করিয়ে বাবা-মা আর শাশুড়িকে নিয়ে যান। এর মধ্যে দেশে এসেছিলেন বাবা-মা আর শাশুড়ীর মৃত্যুর পর। তাদের দেশের বাড়িতে দাফন করা হয়েছিলো তাই। এর মধ্যে আর আসেন নি। শেষবার এসেছিলেন অরনীর বয়স যখন চার বছর। তাদের ইচ্ছে ছিলো বাংলাদেশেই থাকার। কিন্তু আর থাকা হয় নি। যেদিন মেলায় আগুন ধরেছিলো কামাল সিদ্দিক মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছিলেন ভীড়ের মাঝে। স্ত্রী-পুত্রকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আবার খুঁজতে যান মেয়েকে। অতিরিক্ত প্রেশার নিতে না পেরে ঘটনাস্থলেই স্ট্রোক করে ফেলেন। কিছু লোক তাকে বের করে এনেছিলো সেদিন। কামাল সিদ্দিক কয়েকমাস বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন নি। তাকে জানানোও হয় নি অরনীকে না পাওয়ার খবর। পরবর্তীতে জানলে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেই যাত্রায়ও তিনি বেঁচে যান। তার একমাত্র বন্ধু পিটার মেথিউস আর তার স্ত্রী এনি ডিসুজা তাদের অনেক সাহায্য করেছিলো। কিন্তু অরনীকে কেউ খুঁজে পায় নি। কামাল সিদ্দিক এখন মোটামুটি অনেকটাই সুস্থ। তবে অরনীর ছোটবেলার ছবিগুলো দেখলে আবেগ আটকে রাখতে পারেন না। একমাত্র আদরের মেয়ে ছিলো। বড়ো বেশি ভালোবাসতেন অরনীকে। কতো স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু একটা এক্সিডেন্ট তাদের পুরো পরিবারটি এলোমেলো করে দেয়।
আদিবা সিদ্দিকা এখনো মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশায় আছেন। তার ধারণা তাদের মেয়ে একদিন ফিরে আসবে। এতোটা বছর তিনি অপেক্ষায় ছিলেন অরনীর। মায়ের মন বলে কথা। খুবই নরম হয় এই মন। যতোদিন অরণীকে দেখবেন না, ততোদিন অপেক্ষায় থাকবেন। কারণ তিনি তো ছোট্ট মেয়েটির লাশও দেখেন নি। তাহলে কেন বিশ্বাস করবেন তাদের মেয়ে আর নেই? অনিকেরও একই বিশ্বাস ছিলো অরনী বেঁচে আছে। তাই সে বাংলাদেশেই পড়াশুনা করে। হোস্টেলে থেকে স্কুল, কলেজ শেষ করে। আর তখন থেকেই দিব্য তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। দিব্য খুব কাছ থেকে অনিকের কষ্টটা বুঝতে পেরেছে। দিব্যের জন্মদিনে দিয়া ছোট ছোট কার্ড গিফট করতো ভাইয়াকে। অনিক সেই কার্ডগুলো উল্টেপাল্টে দেখতো। অরণীও খুব ভালো আঁকতে পারতো। রাজা-রাণী, হাতি ঘোড়া এসবের ছবি আঁকতো আর অনিকের কাছে নিয়ে আসতো। অনিক খাতায় ভেরি গুড লিখে দিলে অনেক খুশি হতো।
দিব্যের হাতে কার্ডগুলো দেখে বলতো,
অনিক: অরু থাকলে আমাকেও এভাবে গিফট করতো। জানিস, অরু অনেক ভালো আঁকতে পারতো। আমিই শিখিয়েছিলাম।
কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতো। দিব্যের সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না।
সকালে রক্তিম ঘুম থেকে উঠেই রিধির ছোটবেলার ছবি, ড্রয়িং-খাতা যেখানে তার বাবা-মা আর ভাইয়ের ছবি এঁকেছিলো, আর সেই খবরের কাগজ, যেখানে রিধির হারানো বিজ্ঞপ্তি ছাপানো হয়েছিলো সেটি নিয়ে বের হয়। খবরের কাগজটা এতোদিন জুনাইয়েত হোসেইনের কাছে ছিলো। তিনি এসব জিনিসের খুব যত্ন করতেন। অনেক বছর আগের হিসাবের খাতাও তার কাছে আছে। খবরের কাগজটি রক্তিম বাবার কাছ থেকে খুঁজে নিয়েছিলো, যেদিন জানতে পেরেছিলো অনিক রিধির অনু ভাইয়া।
দিব্য আর অনিক অনেকক্ষণ ধরে জিইসির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিকের হাত ঘামছে। ঘামে পুরো শার্ট ভিজে গেছে। মাথার উপর কড়া রোদ। কিন্তু অনিক ছায়ায় না দাঁড়িয়ে পায়চারী করছে এদিকওদিক। বার বার তাকিয়ে আছে সামনের রাস্তায়, রক্তিমের অপেক্ষায়। এক এক টা মিনিট অনেক বেশি সময় মনে হচ্ছে। দিব্য আসার পর পর অনিক জিজ্ঞেস করতে থাকে কেন রক্তিম তাকে ডেকেছে। পরে দিব্য বলেই দেয় রক্তিম অরনীর সম্পর্কে জানে। অরনীর খবর দিতে আসবে শুনে অনিকের মনে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আনন্দ, সংকোচ সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে অনিকের মাঝে।
অরনী বেঁচে আছে, কোথায় আছে? কতোবড়ো হয়েছে? দেখতে কেমন হয়েছে? এখনো কি তার অনু ভাইয়াকে মনে রেখেছে? এসব প্রশ্ন করেই যাচ্ছে একটু পর পর দিব্যকে। রক্তিম এখনো কেন আসছে না, সেই চিন্তায় যেন পাগল প্রায় অনিক।
রক্তিমকে দেখেই ছুটে গেলো অনিক।
অনিক: আমার অরু কোথায়? আপনি অরুকে আনলেন না কেন? অরু ভালো আছে তো? আমার বোনটা আমাকে ভুলে গেছে?
রক্তিম অনিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,
রক্তিম: ঠান্ডা হও অনিক। তোমার বোন ভালো আছে। এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ো না। কোথাও বসলে ভালো হয়। কথা আছে অনেক।
দিব্য, অনিক ও রক্তিম একটা ক্যাফেতে বসলো।
রক্তিম শুরু থেকেই বলল সব ঘটনা। রিধিই তার বোন অরনী। মেয়েটিকে কতোবার দেখেছে অনিক। কিন্তু একটুও বুঝলো না। কতো বড়ো দুর্ভাগ্য তার!
রক্তিম যা যা এনেছিলো সাথে, সব অনিককে দেখালো। খবরের কাগজের বিজ্ঞপ্তিটাও দেখায়। অনিক চোখের পানি আর আটকে রাখতে না পেরে রক্তিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
অনিক: আপনি জানেন না ভাইয়া, আপনি আমাকে কি দিয়েছেন। আপনারা এতো বছর আমার বোনকে আদর-ভালোবাসা দিয়েছেন, পড়াশুনা করিয়ে এতোটুকু এনেছেন, অনেক বড়ো ঋণ চেপে দিয়েছেন। এইটা হয়তো শোধ হবে না কখনো। আপনার বাবা-মা যদি আমার বোনটার পাশে না থাকতো, আজ আমার অরুর কি হতো? কোথায় থাকতো!
রক্তিম: আমার রিধি… মা…মানে তোমার অরু। খুবই লক্ষী একটা মেয়ে। অনেক বড়ো হয়ে গেছে। মেয়েটির জীবনে ভালোবাসার বড়োই অভাব পড়েছে। আমি চাই আমার রিধি ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। আর যা-ই হোক কষ্টের ছিটেফোঁটাও যেন ওর কাছে না আসে। মেয়েটা না কষ্ট সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এই একমাসে মেয়েটি অনেক কষ্ট পেয়েছে। তার একটাই অপরাধ ছিলো, মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার মা আর নানু মানছে না এই সম্পর্ক। অনেক কষ্ট দিয়েছে আমার রিধিকে। কাউকে কষ্টগুলো দেখাতেও পারছে না। বাধ্য করছে তাকে রোহানের সাথে বিয়ে করার জন্য। আমি জানি রোহান ভালো ছেলে। কিন্তু রিধিতো আমাকে ভালোবাসে। আমাকে ক্ষমা করে দাও অনিক। আমি অনেক আগেই জানতে পেরেছিলাম, রিধিই হচ্ছে তোমার অরু। কিন্তু সাহস হয় নি বলার। আমি রিধিকে খুব ভালোবাসি। হারাতে চাই নি ওকে। তুমি, তোমার বাবা-মা যদি ওকে নিয়ে যেতে? আমি কি নিয়ে থাকতাম? আমি চেয়েছিলাম একদম বিয়ে করেই রিধিকে তোমাদের সামনে আনবো। তখন তো চাইলেও আমার রিধিকে কেউ আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু দেখো, কি ছিলো, আর কি হয়ে গেলো।
রক্তিমের গলা ভারী হয়ে আসছে, কি যেন আটকে আছে গলায়। অনেক কষ্ট লাগছে রিধিকে হারাতে। কিন্তু রিধিকে এভাবে চাপ দিতে চায় না রক্তিম। এখন রিধির বাবা-মা তাদের মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনোই যাবেন না। এখন হয়তো রিধির রোহানকে বিয়ে করতে হবে না।
অনিক: আমি নিয়ে যাবো আমার বোনকে। ও আসবে তো আমার সাথে?
রক্তিম: রিধি এখনো তোমার কথা বলে। বাপ্পি, আম্মি আর অনু ভাইয়ার গল্প শুনায়। আর কিসের মায়ায় থাকবে? সব মায়া তো শেষ। নিয়ে যাও ওকে। ওকে একটু ভালোমতো শ্বাস নিতে দাও। ওই বাসায় ওর দম বন্ধ হয়ে যায়। কাউকে বলতে পারে না। আমি বুঝি। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।
অনিক বাবা-মার কাছে গেলো, অরনীকে পাওয়ার সংবাদ দিতে। কামাল সিদ্দিক আর আদিবা সিদ্দিকা অরনীর খবর পেয়ে যেন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন।
এই খুশি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এসব অনুভূতি শব্দকে হার মানিয়ে যায়। আজ বিকেলে যাবেন মেয়েকে আনতে। তাদের অপেক্ষার সমাপ্তি হলো শেষমেশ।
দিব্যও বাসায় গিয়ে সবাইকে জানায় রিধির আসল পরিচয় হলো, সে অনিকের হারিয়ে যাওয়া ছোট বোন অরনী। রাজিয়া-ফয়সাল অনেক খুশি হয়েছেন শুনে। দিয়া তো আরো বেশি খুশি, কারণ রিধি রক্তিমদের বাসায় খুব কষ্ট আর অপমান সহ্য করে আসছিল এতোদিন। রোহানও অনেক খুশি হয়েছে। কারণ এখন সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা ঘটবে। অনিকদের বংশ, রক্তিমদের বংশের চেয়ে ভালো। বংশজাত নিয়ে রেষারেষি করার শাস্তি রক্তিমের পরিবার বুঝতে পারবে হয়তো।
বিকেলে জুনাইয়েত-নবনী আর বেগম আতিকা, রিধি আর রোহানের বিয়েতে কি কি করবেন তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আর রিধি এসব কথাবার্তা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে পায়। বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে করছে মরে গিয়ে তার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ। তাদের কোথাও স্থান হয় না।
চোখের পানি মুছে ওজু করে নেয়। তারপর নামায পড়তে যায়। মনকে শান্ত করার একমাত্র উপায় এখন এটি। কারণ এখন সব সমস্যার সমাধান সৃষ্টিকর্তায় করতে পারেন। কপালে যা আছে হবে, কিন্তু চাইতে তো দোষ নেই।
নামায শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। রিধির আবার বুকটা ভারী লাগছে। নিঃসঙ্গ লাগছে নিজেকে। ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। রিধির হতাশার অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই কলিংবেলের শব্দ হয়। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। চোখের পানিও মুছে নেয়।
হয়তো রক্তিম এসেছে। তাকে দেখলেও মন শান্ত হয়। রক্তিম রিধির চোখের জল সহ্য করতে পারে না। রক্তিমের মন খুব নরম। তবে সবার ব্যাপারে না, শুধু রিধির ব্যাপারে। রিধিকে বিধ্বস্ত দেখলে রক্তিমের মুখটা একদম শুকিয়ে যায়।
এটাই হয়তো ভালোবাসার দহন। এখানে স্পর্শের দরকার হয় না, চোখের ভাষায় এই দহন কমিয়ে দিতে পারে।
তাই রিধি ভালোমতো চোখ মুখ ধুয়ে ফেললো। রিধির ফর্সা নাক আর চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। রিধি হালকা পাউডার লাগিয়ে লালচে ভাবটা ঢেকে দিলো।
নবনী হোসেইন দরজা খুলে রক্তিমের সাথে দিব্য-রোহান আর অপরিচিত তিনজনকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
নবনী: আরে রোহান, দিব্য, বাবা তোমরা! এসো এসো। আর রক্তিম বাকীদের তো চিনলাম না!
রক্তিম: ভেতরে আসতে দাও।
কামাল সিদ্দিক এবং তার স্ত্রী আদিবা সিদ্দিকা সাথে অনিক এসেছিলো। অনিক দিব্য আর রোহানকে নিয়ে আসে। কারণ একা আসতে খুব ইতস্ততবোধ করছিলো অনিক। আর দিব্য রক্তিমের বাবা-মাকে ভালো করেই চেনে। তাদের অনেক আগে থেকেই পরিচয় আছে। তাই দিব্যকে সাথে নিয়ে আসে। আর রোহান যেহেতু রিধির বাগদত্তা, কোনো ঝামেলা হলে সামাল দিতে পারবে।
বেগম আতিকা রোহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
বেগম আতিকা: জামাই বাবা, তোমার আত্মীয়?
রোহান: না, অনিক আমাদের বন্ধু। আর ইনি হচ্ছেন কামাল সিদ্দিক অনিকের বাবা আর ইনি আদিবা সিদ্দিকা অনিকের মা।
নবনী: আচ্ছা, ভালো আছেন?
আদিবা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
আদিবা: জি। আ…আমার মেয়েটা কোথায়?
নবনী অবাক হয়ে বলল,
নবনী: আপনার মেয়ে?
কামাল: জি, আমাদের মেয়ে, সিদ্দিকা মরিয়ম অরনী, আমি ওর বাবা।
আদিবা: আমি অরনীর আম্মি।
জুনাইয়েত-নবনী অনেক বড়ো ধাক্কা খেয়েছেন।
জুনাইয়েত: এতো বছর পর!
অনিক পুরো ঘটনা খুলে বলল।
কামাল: আমার অরু মাকে ডেকে দেবেন? প্লিজ।
রক্তিম রিধির দরজায় কড়া দিলো।
রক্তিম: রিধি, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। দরজা খোলো।
রিধি রক্তিমের কন্ঠ শুনে দরজা খুলে দিলো।
রিধি: কি সারপ্রাইজ? আমাকে আর বিয়ে করতে হবে না? আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে?
রক্তিম: এর চেয়ে বেশি সুন্দর সারপ্রাইজ। চলো।
রিধিকে নিয়ে আসলো তার বাবা-মা আর ভাইয়ের সামনে।
রক্তিম: চিনতে পেরেছো?
রিধি: চেনা চেনা লাগছে।
কামাল: মাই প্রিন্সেস, আমাকে চিনতে পারো নি?
রিধির মনে পড়ল, তার বাপ্পিও তাকে প্রিন্সেস বলে ডাকতো।
রিধি ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দেয়।
রিধি: বাপ্পি! আম্মি।
কামাল: হ্যাঁ। আসো বাপ্পির কাছে।
পরিবেশটা একদম থমেথমে হয়ে যায়।
রিধির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ যেন বলছে,
কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তোমরা? কতো মিস করেছি তোমাদের জানো বাপ্পি-আম্মি? আমার ভালো লাগে না এইখানে। নিয়ে যাবে আমাকে? তোমাদের সাথে চলে যাবো আমি। এইখানে কেউ আমায় ভালোবাসে না। সবাই আমাকে কাঁদায়। প্লিজ নিয়ে যাও। আমি থাকবো না আর এইখানে।
আদিবা সিদ্দিকা মেয়ের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলেন।
আদিবা: এতো দুর্বল কেন লাগছে তোকে? ঠিক মতো খাস না? নাকি এখনো মুখে নিয়ে বসে থাকিস।
রিধি: আম্মি, আমি এখন অনেক বড়ো হয়েছি তো! এখন আর মুখে নিয়ে বসে থাকি না। খেতে মন না চাইলে খাই না, কেউ জোর করে না খাওয়ার জন্য।
নবনীর বুকে কথাটা তীরের মতো বিঁধেছে। এই একমাস রিধির সাথে অনেক বাজে ভাষায় কথা বলেছেন। ছোটখাটো ব্যাপারেই খোঁচা দিয়েছেন। আর মেয়েটি ঠিকমতো খেতো না। বেশি ক্ষিধে পেলে নিজ থেকেই খেয়ে নিতো রান্নাঘরে এসে। কিন্তু তিনি একবারো বলেন নি খেতে। উলটো জুনাইয়েত সাহেব মেয়েকে খাওয়ার সময় ডাকলে তিনি বিরক্তবোধ করতেন। এই একমাসে তারা একসাথে খেতেও বসে নি। রক্তিমও বাইরে থেকে খেয়ে আসতো। কখনো কখনো সারাদিন না খেয়ে থাকতো বা রাতে সবাই ঘুমানোর পর রিধির সাথে ছাদে বসে বসে খাওয়া-দাওয়া করতো চোরের মতো।
একটা মাস যেন এক যুগের সমান ছিলো রিধি আর রক্তিমের কাছে। আজ রিধির জীবনে নতুন সূর্য উঠেছে। রক্তিম জানে না সে তার প্রেয়সীর জীবনসঙ্গী হতে পারবে কিনা। কিন্তু সে তার প্রেয়সীকে খুব দামী উপহারটা দিতে পেরেছে।
দুই ভাই বোনের আজ এক যুগ পর দেখা হয়েছে। আজ প্রথম অনিককে কাঁদতে দেখছে রোহান।
ছেলেরাও কাঁদে। প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাওয়ার পর, ফিরে পাওয়ার আনন্দ এক মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয়। সেই অনুভূতিই প্রকাশ পায় চোখের নোনাজল হয়ে।
কামাল সিদ্দিক আর আদিবা সিদ্দিকা মেয়েকে নিয়ে যাবেন। ‘মেয়েকে নিয়ে যাবেন’ এই কথাটা আর জুনাইয়েত সাহেব মানতে পারছেন না। নবনীর চোখে মুখে অদ্ভুত অনুশোচনা আর অপরাধ বোধ জন্ম নিয়েছে। গলার মাঝে কথা আটকে গেছে।
জুনাইয়েত: এভাবে নিয়ে যাবেন না। মেয়েটাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?
রিধি: আমি চলে যাবো। আমাকে নিয়ে যাবে, বাপ্পি? প্লিজ। আমি এখানে থাকতে চাই না। আমার এখানে ভালো লাগে না।
জুনাইয়েত: রিধি মা, কি বলছিস? বাবাকে ছেড়ে চলে যাবি?
রিধি: তুমি অনেক ভালো বাবা। কিন্তু আমি আর বেশিদিন এখানে থাকলে মরে যাবো। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে একটু বাঁচতে দেবে?
নবনীর চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। তিনি অনেক কষ্ট দিয়েছেন। আর কোনো অধিকার নেই কিছু বলার। তিনি সরে পড়লেন।
জুনাইয়েত সাহেব সোফায় বসে পড়লেন। তার শক্তি সব হারিয়ে ফেলেছেন।
মেয়ে বিয়ে দিলে যখন শ্বশুরবাড়ী চলে যায়, তখন কোনো ভয় থাকে না। বরং দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারার শান্তি মনের মাঝে ফুটে উঠে। মেয়ে তো মাঝে মাঝে বাবা-মাকে দেখতে আসবেই, কিসের ভয়? কিন্তু আজ জুনাইয়েত সাহেবের মনে ভীষণ ভয়। মেয়ে তো আর শ্বশুরবাড়ী যাচ্ছে না? মেয়ে তো যাচ্ছে তার আসল বাবা-মার কাছে। আর ফিরে আসবে না। শ্বশুরবাড়ী থেকে সে দেখতে আসবে তার আসল বাবা-মাকে। তাকে দেখতে আসবে না। তাদের আর কোনো অধিকার নেই।
আজ এতোবছরের ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া সবকিছুই একমাসের চাপে নষ্ট হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বিশ্বাস, ভেঙে গেছে মনের সম্পর্ক, কমে গেছে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। এই দিনটাও আসতে পারে কেউ ভাবতে পারে নি।
রিধি তার প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া আর কিছুই নেয় নি সাথে। তবে রক্তিমের দেওয়া সবকিছুই নিয়ে যাচ্ছে। এই বাসায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্তিম তার পাশে ছিলো।
রিধি যাওয়ার আগে রক্তিম তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
রক্তিম: আমার অপেক্ষায় থাকবে তো?
রিধি মাথা নেড়ে বলল,
রিধি: যতোদিন বেঁচে আছি ততোদিন অপেক্ষায় থাকবো।
রিধি প্রশান্তচিত্তে রক্তিম আর জুনাইয়েত হোসেইন থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো তার আসল গন্তব্যে।
এখন আর তাকে ভালোবাসার ত্যাগ দিয়ে জোর করে অন্যের বউ সাজতে হবে না। সে মুক্ত এই চাপ থেকে।
অনিক রোহানের কাছে এসে বলল,
অনিক: থ্যাংক ইউ। কি বলে তোকে ধন্যবাদ দেবো জানি না। তুই আমার বোনটার হাত ধরেছিস। ওকে বাঁচিয়েছিস।
রোহান: রিধির কষ্টগুলো বুঝতে পেরেছিলাম। আমার যা ভালো মনে হয়েছিল তাই করেছি।
অনিক: তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিলাম একসময়। বলে না, যাকে ভালো লাগে না তার কোনোকিছুই ভালো লাগে না। আমাকে ক্ষমা করে দিস দোস্ত।
রোহান: আমি জানি তুই কেন এমন করেছিস। থ্যাংক ইউ টু, তুই আমার ভাইটার সাথে ছিলি। ওকে অনেক সাপোর্ট করেছিস।
অনিক: আমি জানি তুই ইশাকে পছন্দ করতি। তাই আমি চাই নি তোর জন্য দিব্য কষ্ট পাক। কারণ ছেলেটা অনেক আগে থেকেই ইশাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো।
রোহান: এখন এসব কথা বাদ দে। খেয়াল রাখিস রিধির। অনেক বেশি সহ্য করে ফেলেছে।
অনিক: রিধি হয়তো চাপের উপর এই সম্পর্কে মত দিয়েছিলো। আমি…..
রোহান: ইটস ওকে। রিধি যদি এই সম্পর্কে আর আগাতে না চায়, আমার কোনো সমস্যা নেই। সম্পর্ক মন থেকে সৃষ্টি হয়, কারো জোরের উপর না। আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম রিধিকে বাঁচানোর এই যন্ত্রণা থেকে। হয়তো রিধিকে ওভাবে ভালোবাসতে পারতাম না যেমনটা ওর প্রাপ্য। আর রক্তিমের মতো করে ভালোবাসতে তো কখনোই পারতাম না।
অনিক রোহানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
অনিক: একদিন তোর জীবনেও ভালো কেউ আসবে।
রোহান মনে মনে বলল,
আমি অপেক্ষায় থাকি না। হয়তো আসবে, হয়তো কখনো আসবে না। চার বছর ইশাকে খুব যত্নে রেখেছিলাম দূর থেকে, আর একবছর আগে সে অন্যের বউ হয়ে আমার চোখের সামনেই ছিলো। আমি মন থেকে চেয়েছিলাম এই মায়া কাটাতে। কিন্তু আমার ভাগ্য যে একটা সুযোগ আমায় আর দিচ্ছে না। তাই আর অপেক্ষায় থাকবো না। একাকীত্ব আমার জীবনের কালো ছায়া, যেটি হয়তো হাজার বছর অপেক্ষা করলেও যাবে না।
৪২।
অপেক্ষারত কিছু মানুষের জীবন থেকে কেটে গেলো আরো একটি মাস। এই একটিমাসে বদলেছে পুরোনো স্বভাব-অভ্যাস, পরিবেশ ও আবেগ-অনুভূতি। এসেছে ভালোবাসার নতুন স্রোত।
রিধি তার নতুন পরিবেশে অনেক ভালো আছে। একমাস আগের ব্যথা-যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে তার প্রিয় মানুষগুলো। আর রক্তিম এখন অভ্যস্ত রিধিহীন জীবনে। ইদানীং ঘরের বাইরেই বেশিরভাগ সময় কাটে তার। কারণ ওই ঘরের চার দেয়ালের মাঝে রিধির স্মৃতি আটকে আছে। অনেক রাত করেই ঘরে ফিরে এখন সে। মাঝে মাঝে রিধি যে রুমে থাকতো ওইখানে গিয়ে বসে থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত।
রক্তিম রিধির মায়া কাটাতে পারছে না কোনোভাবে। এই একমাসে রক্তিম রিধির সাথে কোনো যোগাযোগ করে নি। কারণ রক্তিম চায় না রিধির নতুন জীবনে আবার কোনো কষ্ট আসুক। আজ রক্তিমের জন্যই রিধিকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। রক্তিম তাই নিজেকে রিধির জীবনের কালো ছায়া মনে করছে। তবে রক্তিম কয়েকদিন পর পর রিধির খবর নেয় অনিকের কাছ থেকে। এতেই সে অনেক ভালো থাকে।
অন্যদিকে রক্তিমের এমন ছন্নছাড়া চলাফেরা নবনী হোসেইন সহ্য করতে পারছেন না। তিনি নিজের ব্যবহারে খুবই অনুতপ্ত। জুনাইয়েত হোসেইন আর রক্তিম যখন দেশের বাইরে ছিলো, রিধিই ছিল তার কথা বলার সঙ্গী। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতো রিধির বকবকানি। নবনী বিরক্ত হতেন না। বরং ভালোই লাগতো। মাঝে মাঝে নবনী হোসেইন বাইরে গেলে তার পছন্দের খাবার বানিয়ে রাখতো। মানুষের মন জয় করার মতো সব গুন রিধির মাঝে ছিলো। কিন্তু রিধির গুনগুলোর চেয়ে নবনী হোসেইন তার বংশের নামটিকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আজ রিধির কথা খুব মনে পড়ছে তার।
আমাদের সমাজটিতে এমন বংশজাতের পার্থক্য কিন্তু দেখা যায়। আমরা একটি মেয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য খুঁজি না। মেয়েটির ভালো কোনো গুন আছে কিনা তা দেখার সময় আমাদের নেই। মেয়েটির সৃজনশীলতা কেমন? মেয়েটির বর্তমান সমাজ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? মেয়েটির চরিত্র কেমন? ভালোবাসার মতো মন আছে কিনা? এসব হচ্ছে একটি মেয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা গুন। বংশের নাম, বাবার বাবা, দাদার বাবা কোন বংশের, বাবা কি করেন, দাদা কি করতো! এসব দেখে যারা একটি মেয়েকে বিচার করতে যায় তারা সমাজের মাঝে কিছু অন্ধকারের বীজ বুনে দেয়। যা নতুন নতুন অন্ধ সংস্কারের জন্ম দেয়।
জুনাইয়েত-নবনীর সংসারে আর কোনো আমেজ খুঁজে পাওয়া যায় না এখন। ঘর জুড়ে নীরবতা বিরাজ করছে। জুনাইয়েত সাহেব রিধি যাওয়ার পর থেকেই চুপচাপ থাকেন। স্ত্রী নবনীর সাথে তেমন একটা কথাও বলেন না। রক্তিমও প্রয়োজন ব্যতীত কথায় বলে না কারো সাথে। বেগম আতিকা খুলনায় চলে যান ছেলের কাছে। কারণ নবনী তার পরিবারের অশান্তির জন্য তার মাকে দায়ী করছেন। যদিও নবনী হোসেইনের দোষটায় বেশি ছিলো। তিনি যেহেতু রিধির খুব কাছের মানুষ ছিলো, অন্তত তিনি যদি রিধি আর রক্তিমের সম্পর্কটি মেনে নিতেন, রিধিকে মানসিক অত্যাচার না করতেন, এর সমাপ্তি ভিন্নভাবেও হতে পারতো।
আজকাল রোহান আর রিধির মধ্যে খুব ভালোই সম্পর্ক হয়েছে। রিধির গান শেখার খুব ইচ্ছে। পাশাপাশি গিটার বাজানোও শিখতে চায়। তাই অনিক তার বোনকে গিটার কিনে দেয়। আর রোহানকে গান শেখানোর দায়িত্ব দেয়। রোহান প্রতিদিন অনিকদের বাসায় এসে রিধির গানের ক্লাস নেয়। কখনো কখনো রিধি দিয়ার সাথে চলে যায় রোহানদের বাসায়। দুই পরিবারের মধ্যে রোহান আর রিধির সম্পর্ক ভাঙার জন্য কোনো মনোমালিন্য হয় নি। বরং রাজিয়া ও ফয়সালের সাথে আদিবা ও কামাল সাহেবের ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
এই একটি মাস রোহানকে অনেক পরিবর্তন করে দেয়। যে ছেলেটি একটা সময় হাসির কথা শুনলেও হাসতো না, এখন ধীরে ধীরে সে হাসির কারণ খুঁজে পেয়েছে। রিধিই তার হাসির একমাত্র কারণ। প্রতিদিন অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলে সে রোহানকে হাসায়। আর মাঝে মাঝে তো রোহানকেই হোম-ওয়ার্ক দেয় রিধি। হোম ওয়ার্ক হচ্ছে মজার গল্প বানিয়ে আনতে হবে, যেটি শুনে রিধি হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাবে। এসব গল্প বানানোর জন্য রোহানকে গুগলসার্চ করতে হয়। আর রিধিকে হাসাতে পারলে রোহানের অনেক ভালো লাগে।
রোহান রিধিকে ভালোবাসতে শুরু করেছে, বন্ধুর মতো। দিব্য যেমনটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, রিধিও রোহানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দিব্য যেভাবে বুঝতো রোহানকে, রিধিও ঠিক ওভাবেই রোহানকে বুঝতে পারে। রিধি আর ইশার মধ্যে অনেক পার্থক্য। রিধিকে সে বন্ধু হিসেবে ভালোবাসে আর ইশাকে তার জীবনের অংশ হিসেবে। রিধিকে হারিয়ে ফেলার কোনো ভয় কাজ করে না, আর রিধিকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছেও নেই তার মাঝে। কারণ বন্ধুত্ব তো কখনো হারিয়ে যায় না। আর বন্ধুত্ব কখনো ভিন্ন বাসনাও জাগিয়ে দেয় না। কিন্তু ইশাকে হারানোর ভয় সবসময় ছিলো রোহানের মাঝে। আর তাকে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনাও ছিলো। খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু পারে নি।
প্রথম ভালোবাসা ভুলে যাওয়া সহজ না। আর সে ভুলতে চায়ও না ইশাকে। ইদানীং ইশাকে না পাওয়ার কষ্টে রোহান আঘাত পায় না। বরং দিব্য আর ইশাকে একসাথে দেখলে শান্তি লাগে খুব। মাঝে মাঝে তো নিজ থেকেই ইশার সাথে কথা বলতে যায় রোহান। দিব্য বাসায় না থাকলে ইশাকে ভার্সিটির জন্য বাসে তুলে দিতে যায়। কিন্তু কিছু মাস আগেও রোহান নিজেকে ইশার থেকে দূরে রাখতো, কারণ রোহান ভয়ে ছিলো তার ইশার প্রতি মোহ যদি বেড়ে যায়, তখন সবকিছু আরো খারাপ হয়ে যাবে। এতোদিন রোহান ভয়ে ছিলো, দিব্য যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে রোহানের ইশাকে পছন্দ, তখন দিব্যের সাথে তার সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। বাবা-মা, দিয়া, ইশা, দিব্য কারো সামনেই আর দাঁড়াতে পারবে না রোহান। নিজেকে একটা সময় ছ্যাঁচড়া মনে হতো তার, ভাবতেও লজ্জা লাগতো সে তার ভাইয়ের বউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো। তাই গুটিয়ে রাখতো নিজেকে সবসময়। কিন্তু এখন আবেগ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন সারাদিন ইশাকে নিয়ে ভাবে না। তার ভাবনার জগতে অনেক কিছুর জায়গা হয়েছে। ব্যস্ত সময় কাটে তার।
সারাদিন অফিস, বিকেলে রিধিদের বাসায় যাওয়া, আর রাতে মা-বাবা, ভাই বোনের সাথে আড্ডা। সারাদিনের ব্যস্ততার পর রাতে অফিসের কাজও করতে হয়। এরপর ভীষণ ঘুম পায় রোহানের, আর ইশার কথা মাথায়ও থাকে না।
ব্যস্ত মানুষ আবেগের বশে আসে না। উলটো আবেগ তাদের কাছে আসতে ভয় পায়। ব্যস্ততার ভীড়ে ভালোবাসা অনেক সময় চাপা পড়ে যায়, এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। যারা অলস সময় কাটায় তাদের মাঝে আবেগকেন্দ্রিক ভাবনার জন্ম হয়। তারা ভাবনার জগত থেকে বের হতে পারে না। এই ভাবনা তার মনের অনেকাংশ জ্বালিয়ে দেয়। যেমনটা রোহানকে জ্বালিয়েছিলো ইশার ভাবনা। ইশার মায়া ত্যাগ করতে না পেরে সে আঘাত পেয়েছিলো অনেক বেশি। আর এখন ইশার প্রতি ভালোবাসা চাপা পড়ে গেছে বাস্তবতার আড়ালে।
এই একমাসে দিয়ার জীবনে এসেছে নতুন ভালোবাসা। সেই ফেইক আইডির মালিকের মায়ায় পড়ে যায় দিয়া। কিন্তু কে সেই মালিক, দিয়া এখনো বুঝতে পারে নি।
-হাই, মিস দিয়া।
দিয়া: তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে?
-ব্যস্ত সময় কেটেছে।
দিয়া: এতো কিসের ব্যস্ততা? তুমি না বললে, তোমার পড়াশুনার চাপ নেই।
-পড়াশুনার চাপ নেই তো কি হয়েছে, বসের চাপ তো আছে।
দিয়া: বস তোমাকে দিন রাত চাপ দেয়? মিথ্যে কথা কেন বলছ? আমার ভাইয়াদের তো কোনো চাপ নেই। বিকেলে চলে আসে, তারপর বাসায় থাকে।
-হুম।
দিয়া: তোমার নিশ্চয় আরেকটা আইডি আছে। তুমি মেয়েদের সাথে ছ্যাঁচড়ামি করো ফেইক আইডি থেকে মেসেজ দিয়ে?
-আমি তো শুধু তোমার সাথেই ছ্যাঁচড়ামি করি।
তুমি ছাড়া আর কাউকে মনে বসাতে না পারি।
তুমি আমার গল্পের এক মায়াভরা কুমারী।
তোমার জন্য সব ব্যস্ততা ছাড়তে পারি।
দিয়া মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
দিয়া: তুমি এভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেসেজের রিপ্লাই কেন দাও? সোজাসুজি লিখলে কি সমস্যা? অনেক দেরী হয় না!
-তোমার জন্য সময় ব্যয় করতে ভালো লাগে,
তুমি হীনা জীবন বড়োই রসহীন আর বাজে,
তোমায় নিয়ে লেখা কবিতা ঘুরে মনের আশেপাশে,
হৃদয় জুড়ে রঙ তুলিগুলো শুধু তোমার ছবি আঁকে।
দিয়া: ভালো হয়েছে। তুমি এতো দেরী করে রিপ্লাই দেবে না। বিরক্তিকর!
-আমি বিরক্তিকর?
দিয়া: হ্যাঁ।
-আচ্ছা, ঘুমিয়ে পড়ো, আগামীকাল তোমার ক্লাস আছে।
দিয়া: রাগ করেছো?
ফেইক আইডির মালিক অফলাইনে চলে যায়। দিয়ার মেসেজ আর সিন হয় নি। দিয়ার এখন আর ভালো লাগছে না কিছুই। কি দরকার ছিলো তাকে বিরক্তিকর বলার। ভালোই তো লাগছিলো কবিতাগুলো। বেশি ঢং করতে গিয়ে নিজের মনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখন সে যদি আর মেসেজ না দেয়। সারারাত ছটফট করতে থাকে দিয়া। ঘুম আসে দেরীতেই।
পরের দিন দুপুরে ভার্সিটির ক্লাস শেষে দিয়া দাঁড়িয়ে আছে রিধির জন্য। তারা একসাথেই বাসায় যায়।
রিধি: হাই দিয়া, আমার জান।
দিয়া: আমার জান! এতো খুশি কেন আজ?
রিধি: জানিস আজকে কি হয়েছে?
দিয়া: বল না, এতো ঢং করছিস কেন?
রিধি: ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাইয়া আমাকে আজ বলেছিলো আমার হাসিটা খুব সুন্দর! হায়! কি ভালো লাগছে আমার। ইশ, আগে জানলে মোবাইলে রেকর্ড করে রাখতাম। আর ওই রাক্ষসটাকে পাঠিয়ে দিতাম। হুহ, একটা ফোনও দেয় না আমাকে। জেলাস হয়ে, মরে যাক।
দিয়া: রক্তিম ভাইয়ার সাথে কথা হয় না!
রিধি: না। কিন্তু পঁচা-বাসি রাক্ষসটা অনু ভাইয়াকে ফোন দেয়। আমি দেখেছি, ভাইয়ার ফোনে তার অনেকগুলো কল এসেছে। আমাকে কল দেয় না শুধু। আমিও দেবো না। দেবদাস হয়ে যাক। আমার কি!
দিয়া চুপচাপ হাটছে। দিয়ার মন খারাপ দেখে রিধি বলল,
রিধি: মুখটাকে ইদের চাঁদের মতো করে রেখেছিস কেন?
দিয়া: ইদের চাঁদ!
রিধি: হ্যাঁ, সুন্দর মুখটাকে বাঁকা করে রাখায় হচ্ছে ইদের চাঁদের মতো মুখ।
দিয়া: দূর, আমার জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেছে। তোকে বললাম না, ওই যে, ফেইক আইডিতে যে ছেলেটা মেসেজ দিয়েছিলো? আমার মনে হয় সে আমার কথায় রাগ করেছে।
রিধি: তাই! ইশ, আমার জান পাখিটার প্রেমের ঘুড়ি আকাশে উড়ার আগেই ছিঁড়ে গেছে!
দিয়া: রিধি সব সময় ফাজলামো ভালো লাগে না।
রিধি: আরে কোন বুড়ো, টাকওয়ালা, ভুঁড়িযুক্ত, নাক বোঁচা তোর প্রেমে পড়েছে! আর তুই তার জন্য মরে যাচ্ছিস?
দিয়া: তোকে কে বলেছে ছেলেটা বুড়ো?
রিধি: তুই কিভাবে জানতে পারলি ছেলেটা যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়ে? আমার রাক্ষসের চেয়ে বুড়ো হলে তো শেষ। ভুঁড়িযুক্ত চেহারা মাথায় ঘুরছে।
দিয়া: রক্তিম ভাইয়া বুড়ো? উনি তো অনেক স্মার্ট। ক্রাশ খাওয়ার মতো।
রিধি: এই চুপ। একদম ক্রাশ খাবে না কেউ। রক্তিম আমার স্মার্ট বুড়ো। খবরদার আমার বুড়োর দিকে নজর দিবি না। তুই তোর ওই ফেইক আইডির বুড়োটার দিকে নজর দে।
দিয়া: আমি রক্তিম ভাইয়ার দিকে নজর দিচ্ছি না। হুহ। আর আমি জানি, ও বুড়ো না।
রিধি: ও! ওওওও। তাই? ও…! ওরে আমার প্রেমিকা! কতো ভালোবাসা তার ‘ও’ য়ের জন্য।
দিয়া: রিধি! কি ও ও করছিস।
রিধি: ওমা, তুই-ই তো বলছিস, আমার মন বলছে ‘ও’ বুড়ো না। না, আমার ও বুড়ো! এ হতে পারে না। আমি মানবো না। কখনো না।
রিধি হাসতে হাসতে বসে পড়লো। দিয়া মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো। রিধি তাড়াতাড়ি উঠে দিয়ার পেছন পেছন গেলো।
রিধি: দিয়া, দাঁড়া না! মজা করছিলাম। সরি।
দিয়া: হুহ, যা কথা বলিস না।
রিধি পুরো রাস্তা দিয়াকে ক্ষেপিয়েছে। দিয়া রিধির সাথে রাগ করে নি। কারণ রিধির এই ক্ষেপানোর মধ্যেই ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। দিয়া এখন অপেক্ষায় আছে তার ফেইক আইডির প্রেমিকের পরিচয় জানার।
চলবে—
আগের পর্ব:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/375008667554245/