অপেক্ষা পর্ব-(৪৭+৪৮): ( বিদায়কাল)

অপেক্ষা পর্ব-(৪৭+৪৮): ( বিদায়কাল)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ

৪৭।
রোহান কয়েক মিনিটের জন্য নির্বাক হয়ে পড়েছে। তার চোখ আটকে আছে টিভিতে আসা ব্রেকিং নিউজে। কিছুক্ষণ আগে জাপান থেকে আসা ফ্লাইটটি ল্যান্ড করার আগ মুহূর্তে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

রোহান কাঁপা হাতে ড্রাইভারকে ফোন লাগায়। ড্রাইভারটিও একই খবর দেয়। এয়ারপোর্টে নাকি প্রচুর ভীড়। এই অবস্থায় দিব্যকে কোথায় খুঁজে পাবে!

রোহানের মাথা আর কাজ করছে না। ইশাকে হাসপাতালে ফেলে যেতেও পারছে না। রোহান আর কিছু না ভেবে অনিককে ফোন দেয়।

কয়েক মিনিটের মধ্যে নিউজটি সবার চোখে পড়ে। নতুন অতিথি আসার খুশিতে থাকা মানুষগুলোর মাঝে মুহূর্তেই ভীড় করে আতঙ্কের ছায়া। দিব্য কি ঠিক আছে? সবার মনে একটাই প্রশ্ন এখন।
দিয়া আর রিধিকে হাসপাতালে রেখে অনিক আর রোহান বেরিয়ে পরে দিব্যের খোঁজে।
এদিকে রাজিয়া রহমান নিউজ দেখার পর থেকে পাগলের মতো করছেন। ফয়সাল আহমেদও আর ঘরে বসে থাকতে পারেন নি, তিনিও ছুটে যান ছেলেকে খুঁজতে।

আর ইশা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যাবিনের দরজার দিকে, দিব্যের অপেক্ষায়। ইশার কাব্য কবে আসবে, কবে বলবে, “অপ্সরী আমি এসেছি, বলেছিলাম না আসবো। ইশ, দেখো বাবুটা না একদম বাবার মতো হয়েছে, কি বলো?”

দিয়া ক্যাবিনের বাইরে বসে বসে আল্লাহকে ডাকছে, তার ভাইটা যাতে সুস্থ ভাবে ফিরে আসে। এই মুহূর্তে ইশার সামনে গেলে ইশা তার চোখ-মুখ দেখে বুঝতে পারবে তাই আর ভেতরে ঢুকে নি।

রোহান আর অনিক এখনো গাড়ীতে।
অনিক রোহানকে শান্ত করতে পারছে না। রোহানকে এই প্রথম কাঁদতে দেখছে সে। কাঁদতে কাঁদতে চোখগুলো ফুলিয়ে ফেলেছে একদম। কাল সারারাত রোহান ইশার পাশে নির্ঘুম বসে ছিলো। দিব্যের বাচ্চাটা কোলে নিয়ে মনে মনে দিব্যের হাসিমুখ কল্পনা করেছিলো রোহান।

অনিক: রোহান, প্লিজ এভাবে কাঁদিস না। ইনশাল্লাহ কিছু হবে না দিব্যের।

রোহান: কিছু হবে না, দিব্যের কিছু হবে না। ওর কিছু হলে ইশার কী হবে? মেয়েটা দিব্যকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমার পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে। সবকিছুতো আমি ফিরে পেয়েছিলাম মাত্র। আমার ভাইটাকে আমি হারাতে চাই না।

রোহান আর অনিক এয়ারপোর্টে যায়। এম্বুলেন্সের হর্ণ, মানুষের চেঁচামেচি আর ভীড় যেন রোহানের মগজ খুবলে খাচ্ছে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে খুব।

রোহান পাগলের মতো দিব্যকে খুঁজছে, আর মানুষের ভীড় ঠেলে সামনে যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষের কথাগুলো কানে আসছে। যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগই মারা গিয়েছে, যারা বেঁচে আছে তাদের মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে।

কয়েকঘন্টা পার হয়ে যায়। উদ্ধার কর্মীরা এসে আহত আর নিহত যাত্রীদের বের করে আনে বিধ্বস্ত বিমানটির ভেতর থেকে। এখন শুধু চিহ্নিত করার পালা।
রাজিয়া রহমানকে আর আটকে রাখা যায় নি। মেডিকেলে আহত রোগীদের মাঝে তিনি তার দিব্যকে খুঁজছেন।
৭০ জন যাত্রীর মধ্যে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। বাকী অনেকে মেডিকেলে আসার পর মারা যায়। আহতদের লিস্টে কোথাও দিব্য ছিলো না। নিহতদের শনাক্ত করার জন্য যাত্রীদের পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়।

আর সেখানেই রোহান তার ভাইকে খুঁজে পায়। দিব্যের নিথর দেহ পড়ে আছে বেডের উপর। রোহানের আর্তনাদ পুরো পরিবেশটা গুমোট করে তুলছে।

দিব্যের লাশ বাসায় আনা হয় রাত আটটায়। আর ইশা এখনো দিব্যের অপেক্ষায় আছে।

ফয়সাল আহমেদের ঘরে এখন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
দিব্যকে গোসল করানো হয়। আগামীকাল সকাল দশটায় দিব্যের জানাজা।

ইশার বান্ধবীরা ইশাকে দেখতে আসে। সে সবার কাছে শুধু একটাই কথা বলছে, ‘দিব্যকে আসতে বল কেউ, ও কি আমার সাথে রাগ করেছে? আমার বাবুটাকেও এখনো কোলে নেয় নি। আমি কি কোনো অপরাধ করেছি? কতোক্ষণ ধরে আমি অপেক্ষা করছি। ও এখনো আসছে না কেন?’

রোহান শুষ্কমুখে ইশার সামনে এসে বসলো।
ইশার আজকে মাত্র অপারেশন হয়েছে। মেয়েটা ঠিকমতো বসতেও পারছে না। রোহানকে দেখে ইশা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে যতোটুকু সম্ভব। প্রচুর ব্যথা এখনো। একটুখানি নড়তেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

ইশা ধীর কন্ঠে রোহানকে জিজ্ঞেস করলো,
ইশা: দিব্য এখনো আসে নি কেন আমাকে দেখতে? আমার সাথে কি রাগ করে আছে? আমার ভালো লাগছে না কিছু। ও কে একটু আসতে বলবেন? প্লিজ।

রোহান নিজেকে শক্ত করে বলল,
রোহান: দিব্য বাসায়। তোমাকে নিতে এসেছি।

ইশা: আপনি কেন এসেছেন? দিব্য কেন আসে নি?

রোহান আর কিছু না বলে উঠে চলে গেলো। ইশা এমনিতেও জানবে বাসায় যাওয়ার পর।
কিন্তু ইশার কান্নাকাটি সহ্য করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা রোহানের এখন, এই মুহূর্তে নেই। অন্তত রাস্তাটা শান্ত পরিবেশে পার করতে চায় রোহান। তাই ইশাকে কিছু বলল না সে।

ইশাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিতে চায় নি, কিন্তু তবুও রোহান তাকে নিয়ে আসে বাসায়। বাসার সামনে এসে, মানুষের ভীড় দেখে ইশার মনের ভয় বেড়ে যায় ধীরে ধীরে। বাবুকে দেখতে এতো মানুষ কেন আসবে? আর বাসার সামনে লাশবাহী গাড়ী দেখে ইশার মাথা ঘুরছে এখন। রোহান ইশাকে শক্ত করে ধরে উঠায়। বাবুটি ইশার বান্ধবী মারিয়ার কোলে ছিলো। বাসায় ঢুকে দেখলো সবার কান্নাকাটির শব্দ।

রোহান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ধীর পায়ে সাদা কাপড়ে ঢাকা মানুষটির কাছে এগিয়ে গেলো ইশা।

ইশার মা ইশিতা পারভীন মেয়েকে ধরে কান্না করে বলছেন,
ইশিতা: ছেলের মুখটা আর দেখলো না। প্রথম সন্তানকেও কোলে নিতে পারে নি। এই ইশা, তোর বর আর নেই মা। চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে।

ইশার আর সিজারের ব্যথার খবর নেই। কিছুক্ষণ আগেও মেয়েটি ব্যথায় কেঁদেছিলো। কিন্তু এখন সব ব্যথা দিব্যকে হারানোর ব্যথার চেয়ে কম।

দিব্যের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর ধীর কন্ঠে বলছে,
ইশা: তোমার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। তুমি আমাকে বলেছিলে এসেই বাবুকে প্রথম কোলে নেবে। বলেছিলে না? মিথ্যে বলেছো কেন? দিব্য, আমার তোমাকে ছাড়া চলবে না। আমি পারবো না। আমি কীভাবে থাকবো? আমি তো তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আমাকে ছেড়ে যাবে না প্লিজ। আমাদের বাবুর কী হবে? এই দিব্য, যেও না প্লিজ। আমাকে অপ্সরী বলে কে ডাকবে? বলো?

ইশার বলা কথাগুলো, সবার কষ্টগুলো যেন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রাজিয়া রহমান নিজেকে খুব শক্ত ভাবতেন। আজ তার সব শক্তি হারিয়ে গেছে। দিব্যের বাচ্চাটি কোলে নিয়ে তিনি কেঁদেই যাচ্ছেন। ক্ষিধে পেয়েছে বাবুটার তাই সেও কাঁদছে। কিন্তু ইশাতো নিজের মাঝে নেই।

লাশ বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে ফুলে যাবে তাই দিব্যকে আবার ফ্রিজিং গাড়ীতে উঠানো হয়। ইশাকে আর আটকানো যাচ্ছে না। দিব্যের সাথে সাথে সেও নিচে নেমে যায়।

রোহান এতোক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইশার পাগলামো দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি। ইফতি একা সামলাতে পারছে না। মাত্র তো কয়েকটা বছরের সংসার ছিলো। এতো বড়ো ধাক্কা নিতে পারছে না ইশা। রোহান ইশাকে আটকানোর জন্য যায়। হাত ধরেও পারছে না আর, ইশা পাগলের মতো ছুটাছুটি করছে। আর কিছু না ভেবে সে ইশাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। এই প্রথম ইশাকে এতো কাছে পেয়েছে রোহান। ইশাকে নিজের সাথে বেঁধে রেখেছে একেবারে, আশেপাশের মানুষ দেখার সময় নেই তার। ইশাকে জড়িয়ে ধরার পর বুঝতে পেরেছে, ইশা কাঁপছে। ইশা কোথায় আছে সে জানে না, তার মুখে শুধু একটায় কথা, ‘আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, দিব্য’।

রোহান ইশাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে নিয়ে যায় সবার সামনে। সামিরা আর তার বাবা-মার চোখেও পড়েছে এসব। রোহান ইশাকে নিজের বিছানায় বসিয়ে, দিয়া আর রিধিকে ডেকে আনে। দিয়া বাবুকে নিয়ে ইশার পাশে বসলো। ইশার বান্ধবী মারিয়া আর রাইসাও ছিলো পাশে। এভাবে ইশাকে ফেলে তাদের যেতে মন চাইছে না।

ফয়সাল আহমেদ ফোন করে একটা নার্স ডাকলেন বাসায়, ইশা আর বাবুর খেয়াল রাখার জন্য। কারণ বাসায় কারো অবস্থায় এখন ইশাকে সামলানোর মতো না।

রোহান রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যায় ইশার জন্য স্যুপ বানাতে। এরপর দুধ গরম করতে দেয়। সামিরা রোহানকে রান্নাঘরে যেতে দেখে, নিজেও গেলো।

সামিরা: রোহান, কী করছো তুমি?

রোহান: ইশার জন্য স্যুপ বানাচ্ছি।

সামিরা: তুমি কেন বানাবে? দিয়াকে বলো!

রোহান: ইশার পাশে কাউকে থাকতে হবে তো!

সামিরা: আচ্ছা, আমি বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি কী এখন ইশার চাকরী করবে নাকি?

রোহান: কী বলছো এসব? ইশার চাকরী করবো মানে কি?

সামিরা: দেখো রোহান, আমি তোমার বাগদত্তা। তুমি আমার সামনে, আমার বাবা-মার সামনে ইশাকে কোলে নিয়েছো। আর তাকে নিয়ে গিয়েছো তো গিয়েছো তাও তোমার নিজের রুমে। আমি তখন কিছু বলি নি। বুঝেছো? আর এখন তুমি ওর জন্য এসব করছো? অদ্ভুত!

রোহানের মাথায় তখনো ব্যথা ছিলো, সামিরার কথায় মাথাটা আরো গরম হয়ে যায় তার।

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
রোহান: আমার দায়িত্ব মনে হয়েছে, তাই করছি। তোমার ভালো না লাগলে চুপ থাকো! আদারওয়াইজ, আমার সামনে থেকে যাও। ফর গড সেইক কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান করবে না। মাথা ব্যথা করছে খুব।

সামিরা: স্ট্রেঞ্জ রোহান! তুমি ইশার জন্য আমার সাথে এভাবে কথা বলছো? তুমি ইশাকে কোথায় নিয়ে রেখেছো জানো? আর কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে। তখন ওইটা শুধু তোমার না আমাদের পারসোনাল রুম হবে। হ্যাভ ইউ আন্ডারস্টুড?

রোহান: ইশাকে তার রুমে নিয়ে গেলে, সে আরো ভেঙে পড়বে। ওই রুমের সব জায়গা জুড়ে দিব্যের স্মৃতি।

সামিরা: দিয়ার রুম তো খালি ছিলো!

রোহান: অনিক এসেছে দেখছো না তুমি?

সামিরা: তাহলে তুমি কোথায় থাকবে?

রোহান: আমি এখনো অবিবাহিত, সামিরা। বোকার মতো কথা বলছো কেন? আমি যেকোনো জায়গায় থাকতে পারবো। সামনের সোফায় থাকলেও আমার কোনো সমস্যা হবে না। আর তুমি এসব কী বলছো? তোমার কি আক্কেল নেই?

সামিরা: আমি আক্কেল ছাড়া কথা বলছি? আর তুমি কি দেখতে পারছো তুমি ওই মেয়েটার জন্য আমার সাথে কড়া ভাষায় কথা বলছো?

রোহান এবার না পেরে সামিরার সামনে হাত জোর করে বলল,
রোহান: আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ কর প্লিজ। আমার ভাইটা চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। নেই দিব্য আমাদের সাথে! তুই কি বুঝতে পারছিস না, এখন এসব কথা বলার সময় না?

সামিরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রোহান তার সাথে এভাবে কথা বলবে সে কখনো ভাবতেও পারে নি।

রোহান স্যুপ আর একগ্লাস দুধ নিয়ে যায় ইশার জন্য। তারপর দিয়াকে ডেকে দিয়ে দেয়, ভেতরে যায় নি আর। এরপর বের হয়ে যায় বাসা থেকে।

লাশবাহী গাড়িটা খোলা ছিলো তখন। ভেতরে ফ্রিজিং মেশিন। সেখানে ছোট একটা গ্লাস আছে। ওইটা দিয়ে শুধু দিব্যের মুখটা দেখা যাচ্ছে।

রোহান গাড়িটির পাশে বসে কাঁদছে। আর মনে করছে সেই দিনগুলো যেদিনগুলোতে দিব্য তার পাশে ছিলো।
দিব্য বলেছিলো তাকে, “আমি যেদিন থাকবো না তোর পাশে, কিভাবে থাকবি একা? এখন থেকে বন্ধু বানিয়ে ফেল। জীবনে বন্ধুর খুব প্রয়োজন। ”

রোহান দিব্যের চেয়ে ভালো বন্ধু বানাতে পারে নি আর। বানানোর চেষ্টাও করে নি। দিব্য আছে তো! আর কী লাগবে তার?

আকাশের দিকে তাকিয়ে রোহান বলল,
রোহান: আল্লাহ তুমি দিব্যকে ভালো রেখো। ওপাড়ে চলে গেছে আমার ভাইটা। আমার কথা তো আর শুনবে না। সে কেমন আছে, এখন তাও জানি না। কিন্তু জীবনে ভালো কাজ করেছে অনেক। তবুও যদি কোনো অপরাধ করে থাকে ক্ষমা করে দিও। একটাবার সুযোগ থাকলে বলতাম তাকে, ভাই তুই আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলি। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। বাকী সবাই তোর পরে। তুই বুঝতি আমাকে সবচেয়ে বেশি। আই প্রমিজ ইউ ভাই, তোর ভালোবাসার মানুষ আর তোর ভালোবাসার অংশ দুইজনেরই খেয়াল রাখবো। তোর ছেলে এখন থেকে আমার ছেলে। দিব্য আর রোহানের ছেলে দিহান। দুই বাবার সন্তান।

৪৮: (কাব্যহীন জীবন)

এক ভয়ংকর রাত কাটিয়েছে ইশা। নির্বাক বসে আছে। কেউ ইশাকে ডাকলে বিড়বিড় করে বলছে, আমি অপেক্ষায় ছিলাম দিব্যের। দিব্য আমায় বলেছে আসবে। আমার বাবুকে এখনো কোলে নিয়ে দেখে নি।

দিয়া: ভাবী, এমন করো না প্লিজ। ভাইয়া শান্তিতে থাকবে না।

ইশা: আমাদের দুজনকে ফেলে কে যেতে বলেছিলো তোমার ভাইয়াকে? আমি কতোবার বলেছি, আমাকে ফেলে যাবে না। আমাকে নিয়ে যায় নি কেন? আমাকে নিয়ে গেলে আজকে আমরা একসাথে থাকতাম। দিয়া, জানো, দিব্য আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। ও এখন কীভাবে থাকবে? আমি পারবো না, আমি পারবো না বাঁচতে। আমার নিশ্বাস আটকে আসছে। আমার দিব্যকে ছাড়া হবে না।

ইশার চিৎকারে সবাই ভয় পেয়ে যায়। রাজিয়া রহমান নিজেকে শক্ত করে ইশার কাছে এসে বসলেন।

রাজিয়া: দিব্যের ছেলেটাকে ফেলে চলে যাবে তুমি? তুমি আমার দিব্যের সাথে থাকতে চাও, ইশা?

ইশা: আমি দিব্যকে ছাড়া পারবো না। ভাবতে পারবো না কিছু। আমি দিব্যের সাথে থাকবো।

রাজিয়া: এই বাচ্চাটায় আমার দিব্যের অস্তিত্ব। আমাদের ছোট্ট দিব্য। ইশা মা, ছেলেটা বাবাকে হারিয়েছে। মা ছাড়া পারবে না। তোমাকে বাঁচতে হবে। দিব্যের জন্য। দিব্য তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে তার সন্তানের। এভাবে ভেঙে পড়লে আমার ছেলেটা ভালো থাকবে না। আল্লাহ আমার ছেলেটাকে ভালো রাখুক এইটাই একমাত্র চাওয়া। এ ছাড়া কিছুই নেই আমাদের হাতে মা। কিছু করতে পারবো না আমরা।

ইশা কীভাবে পারবে দিব্যকে কষ্ট দিতে? না, সে কাঁদবে না। কিন্তু চোখের পানি যে বাঁধায় মানছে না।

দেখতে দেখতে সময় হয়ে গেলো দিব্যের বিদায়ের। যার আত্মা চলে গেছে হয়তো বহুদূর। আর এখন নিথর দেহখানির বিদায়বেলা।
দিব্যকে সকাল দশটায় দাফন করা হয়। জানাজা শেষে যে যার বাসায় চলে যায়।

সময় একদিন হয়তো পার হয়ে যাবে। মুছে যাবে দিব্য নামের ছেলেটির স্মৃতি সবার জীবন থেকে।

এতোকিছুর পরও, কেউ চকলেটের বক্স হাতে তুলে দিলে দিয়ার মনে পড়বে, দিব্য ভাইয়ার সাথে রাগ করে থাকলে সেও বোনের রাগ ভাঙানোর জন্য চকলেট নিয়ে আসতো।
যখন ঘুম দেরীতে ভাঙবে, আর রাজিয়া রহমান শাড়ি ঠিক করতে করতে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে আসবেন নাস্তা বানানোর জন্য, আর দেখবেন রান্নাঘর ফাঁকা। তখন তার চোখের কোণে পানি জমবে। কারণ দেরী হয়ে গেলে তার দিব্য তার জন্য নাস্তা বানাতো আর বলতো, ‘আজ না হয় তোমার ছেলেকে সুযোগ দিলে সেবা করার। প্রতিদিন তো তুমিই করো।’ আর রাজিয়া মুচকি হেসে ছেলের হাতে বানানো রুটি খেয়ে বলতেন, ‘দেখতে হবে না কার ছেলে?’ আর আজ বুক ভরা কষ্টে, সেই মাও মেনে নিয়েছে তার ছেলে আর কখনো আসবে না ফিরে।
কখনো হয়তো শূন্য লাইব্রেরিতে এসে দিব্যকে খুঁজবে অনিক। ছেলেটির ভ্রমণকাহিনী পড়ার খুব নেশা ছিলো। এক কোণে বসে পড়তো বই নিয়ে। পড়া শেষ হলে অনিককে শুনাতো। আর আজ কোথাও দিব্য নেই। দিব্যের প্রিয় বইগুলোতে ধুলো জমবে হয়তো আর কিছুমাস পর।
মন খারাপ করে বসে থাকলে এখন হয়তো রোহানের কাঁধে হাত রেখে কেউ বলবে না, “কী হয়েছে বল? আমি আছি না, সলিউশন বের হয়ে যাবে।” রাত জেগে বসে গল্প করার কেউ নেই, খেলা দেখার সঙ্গী নেই। রোহান হয়তো আবার একা হয়ে গেছে।
দিব্যের পুরোনো ক্যামেরাটা ইশাকে দিয়ে গিয়েছিলো, নতুন ক্যামেরা নিয়ে জাপান পাড়ি জমিয়েছিলো। ক্যামেরাটায় দিব্যের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে। খুব যত্নে তুলে রেখেছে ইশা। দিব্যের ছবিগুলো দেখে কেটে যাচ্ছে মেয়েটির দিন।
কিছু ভিডিওতে জীবন্ত দিব্যকে দেখে শুকনো হাসির রেখা টেনে, আবার বিলীন করে দেয় ইশার মলিন ঠোঁট। দেরীতে ঘুম ভাঙলে, ‘অপ্সরী অফিসে চলে যাবো, না খেয়ে?’ এই কথা বললেই ইশা তাড়াতাড়ি উঠে পড়তো। কারণ অপ্সরী তার কাব্যকে কিভাবে না খেয়ে যেতে দেবে?

কাব্যহীন জীবন এখন আর তার অপ্সরীর ভালো লাগে না। এখন রোজ রাতে কাব্যের অস্তিত্ব ইশাকে ঘুমোতে দেয় না। ইশার চোখেও ঘুম আসে না। কারণ পাশে যে তার কাব্য নেই। ইশার কবিতা শুনার কেউ নেই আর। ইশার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে অনেকদিন। নিজের খেয়াল রাখে না সে। দিব্য দেখলে বলতো, ‘এই পাগলী, আসো আমি চুল বেঁধে দেয়’।

ভাত রাঁধতে গিয়ে দুইবার হাত পুড়ে ফেলেছে ইশা। হাতটি ধরে সে হাতে বরফ লাগানোর জন্য কেউ এলো না শুধু।
মাঝে মাঝে ভোরের আকাশটা ইশা দেখতো তার কাব্যের কাঁধে মাথা রেখে। এখন জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়ে বসে থাকে। জীবনের সব আলো নিভিয়ে দিয়েছে ইশা।
ইশা হাতে চুড়ি পড়লে দিব্যের খুব ভালো লাগতো। ইশার চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখতো। তাই দিব্য মাঝে মাঝে বিভিন্নধরনের চুড়ি কিনে আনতো। এখন কে তাকে চুড়ি কিনে দেবে? এখন কে তার হাতে চুড়ি পড়িয়ে দেবে আর হাতদুটি নাড়িয়ে দেখবে আর বলবে, ‘আমার অপ্সরীর হাতে মানিয়েছে কিন্তু’।

ইশার জীবন আজ বড়োই শূন্য। বড়োই যন্ত্রণাদায়ক।

আজ সামিরা আর রোহানের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। কার্ড ছাপানো হয়েছে, কিন্তু কাউকে দেওয়া হলো না আর। সামিরার বাবা-মার সাথে কথা বলে বিয়ের তারিখ আরো দুইমাস পেছাতে চান ফয়সাল আহমেদ। শোকের ঘরে বিয়ে কীসের? ছেলে হারানোর বেদনা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি এখনো।

তবে তার পরিবর্তে বাবুর আকীকা হয়েছে, কোনো আড়ম্বরহীন ভাবে। বাবুর নাম দেওয়া হয় মো. দিহান আহমেদ। নামটি রোহানের পছন্দে রাখা হয়েছে।
জন্মের পর দিব্যের নাম দিব্য আহমেদ ছিলো। কিন্তু রাজিয়া রহমান সেটি পরিবর্তন করে দিব্য রহমান করেছিলেন যখন তিনি আলাদা হয়েছিলেন সংসার থেকে। কিন্তু যেহেতু দিব্যের আসল নাম দিব্য আহমেদ ছিলো, তাই বাবার নামের সাথে মিল রেখে নামটি দেওয়া হয়েছে।

রাত দুইটা। পুরো বাড়ি নিরবতায় আচ্ছন্ন। সবাই ঘুমিয়ে গেছে, শুধু দুজন এখনো জেগে আছে। একজন স্বামীর পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে চোখের জল ফেলছে, অন্যজন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে জীবনের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছে।

ছাদ থেকে নেমে শুনতে পেলো দিহানের কান্নার আওয়াজ। রোহান দিব্যের রুমের সামনে গিয়ে দেখলো দরজা খোলা। হয়তো ইশা বেরিয়েছে রুম থেকে। তবুও কয়েকবার দরজায় ঠুকা দেয় রোহান। সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকলো। দিহান হাত পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি করছে। ক্ষিধে পেয়েছে হয়তো খুব। কিন্তু ইশাতো আশেপাশে নেই। তাই দিহানকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে রোহান।

ইশা রান্নাঘরে গিয়েছিলো গরম পানি আনার জন্যে। যখন হাঁড়ি চুলায় বসিয়ে দিয়েছিলো তখন পানি ঠান্ডা ছিলো, কিন্তু এখন এতো ভারী আর গরম হাঁড়ি নিয়ে আসা খুব কষ্ট ইশার জন্য। রোহান ইশাকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে গেলো।

রোহান: ইশা কী করছো? তোমাকে ডক্টর মানা করেছিলো, ভারী কাজ না করার জন্য। আর তুমি?

ইশা: আমার কাজ আমাকেই তো করতে হবে। আমার বরতো নেই আর।

রোহান: তুমি দিহানকে রাখো। আমি দিয়ে আসছি পানি।

ইশা: না, আপনি কেন করবেন? প্লিজ। করবেন না এসব।

রোহান: সমস্যা কোথায়?

ইশা: ভালো দেখায় না এসব।

রোহান: চুপ করো ইশা। ভালো দেখায় কি দেখায় না এসবে মাথা ঘামাতে হবে না তোমার। দিহানকে নিয়ে চুপচাপ চলে এসো।

ইশা রোহানকে খুব ভয় পায়। আর রোহানের রাগ সম্পর্কে ধারণা আছে ইশার। তাই আর কিছু বলল না সে।

ইশার খুব কষ্ট হয় চলাফেরা করতে। অপারেশন হয়েছে যেহেতু, ক্ষত শুকাতেও সময় লাগবে। কিন্তু মেয়েটি সবকিছুই কাউকে না জানিয়ে একা একা করে যায়।

ইশা ফ্রেশ হয়ে দিহানের কাপড় পাল্টে দিচ্ছিলো খুব মনোযোগের সাথে। রোহান ইশার পাশে এসে বসলো। এই কয়েকদিনে ইশার দিকে ফিরেও তাকায় নি রোহান। সারাদিন নিজের মাঝেই থাকতো। আর একা একা ঘর বন্দি হয়ে থাকতো ইশা। রোহান অফিস থেকে আসলে আর রুম থেকে বের হতো না সে। কিন্তু আগে তো এমন করতো না।

রোহান ভাবছে, ‘ইশা কি আমাকে ভয় পাচ্ছে? কেন ভয় পাচ্ছে? আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না?’

রোহান ইশাকে আজ অনেক মাস পর ভালো ভাবে দেখছে।
ইশার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। তবুও মেয়েটাকে এতো মায়াবী লাগছে দেখতে। রোহান অনেকবার লক্ষ্য করেছিলো দিব্যকে ইশার চুল বেঁধে দিতে। তাহলে কি ইশা নিজের চুল বাঁধতে জানে না? নাকি ইচ্ছে করে বাঁধছে না? মেয়েটির কি খুব দরকার কাউকে কাছে পাওয়ার? ইশা পারবে তো একা থাকতে? কিভাবে সম্ভব এতোটা পথ নিঃসঙ্গ পাড়ি দেওয়া?
রোহান ইশার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো আকাঙ্ক্ষা ছাড়া পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে রোহান শুধুমাত্র ইশার দিকে তাকিয়ে।

ইশা দিহানের কাপড় পালটে রোহানের দিকে ফিরে দেখলো, রোহান অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ইশা একটু শক্ত কন্ঠে বলল,
ইশা: আপনি এখনো বসে আছেন? আপনার কি উচিত এতো রাতে আমার রুমে এসে বসে থাকা?

রোহান ইশার কথা শুনে খুব অপমানিত হলো। ঠিকই তো বলছে ইশা। এভাবে মধ্যরাতে রোহানের এখানে বসে থাকাটা শোভা পায় না। কিন্তু ইশার পাশে থাকতে ভালো লাগছিলো তার। মায়ায় পড়ে গিয়েছিলো আবার। ভুলেই গিয়েছে ইশা এখন তার ভাইয়ের বিধবা। এখন তো আরো বেশি দৃষ্টিকটু রোহান আর ইশার একসাথে একাকী বসে থাকা।

রোহান আর কিছু না বলে উঠে যায়। কিন্তু দরজার কাছে আসার পর আবার দাঁড়িয়ে গেলো কি ভেবে।

ইশার দিকে ফিরে বলল,
রোহান: প্রয়োজন হলে আমায় ডাকবে। এসব শোভা পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপার নিয়ে বসে থাকলে জীবন চলবে না। তোমাদের দায়িত্ব এখন আমার উপর।

ইশা: আপনাকে কে বলেছে দায়িত্ব নিতে? আপনি কি ভেবেছেন? আমরা অসহায়?

রোহান: দেখো, ইশা। আমার তর্ক পছন্দ না। কিছু লাগলে আমাকে জানাবে। জানাতে বলেছি তাই জানাবে। আর আমি দিহানের কথা ভেবে বলছি। তোমার কিছু হলে ছেলেটার কি হবে? দিহানের এখন মা প্রয়োজন। আর দিহানের যা যা প্রয়োজন সবকিছুই এখন আমার দায়িত্বের মধ্যে আসে।

ইশা কিছু বলতে পারে নি আর। কারণ ইশা জানে রোহান দিহানকে খুব ভালোবাসে, একদম বাবার মতো। আর রোহানের ভালোবাসায় কোনো কৃত্রিমতা নেই, যা রোহানের চোখ-মুখ দেখলেই বুঝা যায়।
কিন্তু রোহানের তো একটা জীবন আছে। সামিরার সাথে বিয়ে হবে তার। একটা সময় তাদের সন্তান হবে। তখন কি দিহানকে ভালোবাসতে পারবে? ইশার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

দিহানকে কোলে নিয়ে বলল,
ইশা: বড়োই অভাগা তুই! যেদিন হয়েছিস, সেদিনই বাবাকে হারিয়েছিস। আমাদের কেউ নেই আর। তুই আর আমি একা হয়ে গেলাম। তোর বাবা আমাদের ফেলে চলে গেলো। আর সাথে বড্ড আঘাত দিয়ে গেলো। তোর কপালে বাবা ছিলো না, আর আমার কপালে ছিলো না আমার স্বামী। তোর বাবা আমায় অপেক্ষায় রেখে চলে গেলো। এই অপেক্ষার শেষ কখনো হবে না। কখনো না।

চলবে–

আগের পর্ব:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/375140470874398/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here