অপেক্ষা পর্ব-৫১:
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ইশা। সামনে সেই বাড়িটি দেখা যাচ্ছে যেটিতে দিব্য আর ইশার বাসর হয়েছিলো। খুব ইচ্ছে করছে সেই ঘরে যাওয়ার। ইচ্ছেটা আটকাতে মন চাইছিল না। ধীর পায়ে ছাদ থেকে নেমে রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখে দিহান ঘুম। এরপর চলে আসে বাইরে।
ইশার বাগানে কোনো ফুল ফুটে নি। ইশার জীবনের মতো বাগানটিও নিস্তেজ। মেইন গেইট পার হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, দিব্য ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে ইশার অপেক্ষা করতো। ইশা তাদের পুরোনো বাড়িতে ঢুকলো। ঘরের এক্সট্রা চাবি ছিলো তার কাছে।
আশেপাশে ধুলো জমে আছে। মাসে একবার পরিষ্কার করানো হয়। কিন্তু তিনমাস এই ঘরটিতে আসা হয় নি কারো।
তিনমাস হয়ে গেছে তার দিব্য ওপাড়ে চলে গেছে। তিনমাস খুব যন্ত্রণাদায়ক ছিলো ইশার জন্য। ইশা ধীর পায়ে তাদের পুরোনো রুমে ঢুকলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো কারণ ছাড়া, আর পারছে না দাঁড়িয়ে থাকতে। দিব্যকে এখন খুব মনে পড়ছে। ইশা বারান্দার সামনে এসে বসে পড়লো। মুখ চেপে কান্না করছে ইশা। আর কতো কাঁদবে সে? কাঁদতে কাঁদতে বিরক্ত এসে গেছে এই কান্নার প্রতি।
বেলা বারোটা। দিহান কাঁদছে সেই সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে। বাচ্চাটার খুব ক্ষিধে পেয়েছে হয়তো, মুখ ঠোঁট শুকিয়ে গেছে একদম। ইশিতা পারভীন দিহানকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। আর কামাল সাহেব ও ইফতি ইশাকে আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করছেন। তারা খুব ভয় পেয়ে যায়, কারণ ইশার ইচ্ছের বিরুদ্ধে রোহানের সাথে তার বিয়ে হয়। এখন যদি রাগের বশে কিছু একটা করে বসে।
এদিকে খুব ভোরেই ইশা ঘর থেকে বেরিয়েছিলো তাই কেউ তাকে দেখেনি। ওইসময় দিব্যদের পুরনো বাসার দারোয়ানও ঘুমিয়ে ছিলো। তাই সেও ইশাকে ঢুকতে দেখে নি। কিন্তু ইশাতো সেই ভোরেই এসে বসে আছে দিব্যের পুরনো ঘরে। আর কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ইফতি রোহানকে ফোন দিয়ে ইশাকে না পাওয়ার খবর দেয়। রোহান অফিসে ছিলো সেই সময়। কাজ ফেলে চলে আসে তাড়াতাড়ি।
দিব্যদের পুরনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রোহান বলল,
রোহান: এই বাসায় যায় নি তো?
ইফতি: দারোয়ান বলল যেতে দেখে নি।
রোহান: দারোয়ান বলল আর তোমরা বিশ্বাস করলে? একটু দেখে আসবে না? চাবি আছে?
ইফতি: আপুর কাছে থাকতে পারে। আপু কিছু একটা করে ফেললে?
রোহান: কখনো না। ইশা এমন মেয়ে না।
ইফতি: ভাইয়া, আপু এমনই।
রোহান: চুপ করবে তুমি?
ইফতি চুপ হয়ে গেলো। রোহানের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। দারোয়ানকে ডেকে দরজার তালা ভেঙে পুরনো বাড়ির ভেতরে ঢুকল রোহান। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ইশা এখন এখানেই আছে। ধুলোমাখা ঘরের মেঝেতে ইশার পায়ের ছাপ পড়ে আছে। ইফতিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রোহান দিব্য আর ইশার পুরনো রুমটিতে ঢুকলো। মেঝেতে পড়ে আছে ইশা। ঘুমিয়ে আছে খুব শান্ত ভাবে, মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে।
রোহান ইশার পাশে গিয়ে বসলো। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ায় ধুলো মাখা মেঝেটি আরো ময়লাটে দেখাচ্ছে। ইশার কালো রঙের জামাটি ধুলোয় মাখামাখি হয়ে আছে। রোহান ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মাথাটি মেঝে থেকে তুলে তার বুকে স্থান দিলো। ইশার তবুও ঘুম ভাঙে নি। পকেট থেকে রুমাল বের করে ইশার মুখে লেগে থাকা ময়লাগুলো ঝেড়ে দিলো। তারপর ইশাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। বাসায় এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় ইশাকে।
ইশার ঘুম হয়তো ভাঙবে না, আর দিহানের ক্ষিধেও পেয়েছে, তাই জোর করেই ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় রোহান। চোখ খুলে রোহানকে দেখে আবার দিব্য ভেবে ফেলল ইশা।
ইশা: তুমি চলে এসেছো? আমি কতো কষ্টে ছিলাম, জানো? আমার না তোমাকে ছাড়া একদম ভালো লাগে না। দিব্য প্লিজ আমাকে ফেলে যেও না কোথাও। আর যাবে না বলো! প্রমিজ করো।
রোহান কিছু বলার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরলো ইশা। ইশার ঘুমের ভাবটি এখনো যায় নি। ইশা হয়তো ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে। ইশা রোহানের গালে হালকা ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
আর রোহান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করছে। ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সে। এখন ইশা আবার ঘুমিয়ে পড়লেই ভালো হবে রোহানের জন্য। কেন ডাকতে গিয়েছিলো ইশাকে? ইশার ঘুমের ভাবটা কেটে গেলে তখন দুজনকেই লজ্জায় পড়তে হবে।
এদিকে অল্প কয়েকমিনিটের মধ্যে ইশার ঘুমের ভাব কেটে যায়।
ইশা চোখ খুলে, শক্ত হয়ে রোহানের বুকের সাথে মিশে আছে আর ভাবছে,
ইশা: দিব্য তো নেই? দিব্য কোথা থেকে আসবে? রোহানকে দিব্য ভেবে ফেললো আবার। ছিঃ, কীভাবে চেহারা দেখাবে এখন রোহানকে? কী করলো একটু আগে?
একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে রোহানকে সরিয়ে দেয় আর পালিয়ে আসে রুম থেকে। রোহানও আকস্মিক ধাক্কা সামলাতে পারে নি, কোমরে ব্যথা পায় হালকা।
এরপর ইশা আর রোহানের সামনে আসে নি। দিহানের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রোহান বাসায় চলে আসে।
কয়েকসপ্তাহ পর ইশার অনার্স ফাইনাল শুরু হয়ে যায়। ভার্সিটি থেকে বাসার দূরত্ব অনেক বেশি, ইশার যাওয়া আসায় অনেক কষ্ট হয়ে যায়। এতোটা সময় দিহান মা ছাড়া কীভাবে থাকবে? দিহানকে নিয়ে গেলেও তেমন কোনো জায়গা খুঁজে পায় না রাখার। আর প্রতিদিন নিয়ে যাওয়াও কি সম্ভব? বাইরের ঠান্ডা বাতাস লেগে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে? এতোগুলো সমস্যা নিয়ে ইশা পড়াশুনাও করতে পারছে না ঠিকমতো। আর ইশার পরীক্ষাটাও দেড় মাস ধরে চলবে। শেষমেশ রোহান এই সমস্যার সমাধান করে ফেলে। ভার্সিটির পাশেই একটি বাসা ভাড়া নেয় দেড় মাসের জন্য। ইশা আর দিহানকে নিয়ে উঠে পড়ে সেই বাসায়। ইশা প্রথমে রাজী না হলেও পরিস্থিতির কারণে রাজী হতে বাধ্য হয়। ইশার পরীক্ষা সকাল দশটা থেকে দুপুর এক টা পর্যন্ত। রোহান এই সময় অফিস থেকে ছুটি নেয়। একেবারে দুপুরে খেয়ে অফিসে যায়, আসে রাত আটটায়।
বাসাটি একরুমের হওয়ায় ইশাকে বাধ্য হয়ে রোহানের সাথে থাকতে হয়। কিন্তু মধ্যে বড়ো বড়ো দুইটা বালিশ দিয়ে রোহানকে পৃথক রাখে ইশা।
বিছানাটি ছোট, তার উপর দুইটা বড়ো বড়ো বালিশ জায়গা নিয়ে ফেলেছে অর্ধেক। রোহানের থাকতে খুব কষ্ট হয়। ইশা আর দিহানের ঘুমের সমস্যা যাতে না হয় তাই তেমন একটা নড়াচড়াও করে না রোহান। শেষে দুইটা চেয়ার জোড়া দিয়ে অল্প জায়গা করে নেয় নিজের জন্য। এতোকিছু ইশা বুঝলেও তেমন পাত্তা দেয় না। ইশা তো এমন মেয়ে না, কিন্তু তার রোহানের প্রতি কোনো ভালোলাগাও নেই। ইশার ধারণা রোহানকে একটুও যদি গুরুত্ব দেয় তবে সে আস্কারা পেয়ে যাবে। আর ইশা রোহানকে কখনো দিব্যের জায়গা দেবে না। ইশা জানে অবহেলা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। রোহানও হয়তো তার অবহেলা পেয়ে একদিন দূরে চলে যাবে, তখনই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের জন্য আর ইশার জন্য নাস্তা বানিয়ে ফেললো রোহান। ইশাকে ডাকতে যাবে তখনই ইশা উঠে যায়। রোহানকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনেকটা ভড়কে যায়।
বিরক্তমাখা কন্ঠে বলল,
ইশা: আপনাকে আমি সভ্য ভেবেছিলাম, আর আপনি অসভ্যের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন? কী চান? দেখেন, কোনো বাজে চিন্তা-ভাবনা মাথায় রাখবেন না কিন্তু। ভালো হবে না।
রোহান: দেখো ইশা, আমি তোমাকে ঘুম থেকে ডাকতে এসেছিলাম শুধু। আর তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? আমি তোমার স্বামী এখন। সুন্দর করে কথা বলো এট লিস্ট।
ইশা: আপনাকে আমি দিহানের জন্য বিয়ে করেছি। সো আপনি আমার কেউ না। অনলি, দিহানের বাবা। যদিও কোনো দরকার ছিলো না এতো বড়ো ত্যাগ করার। আর শুনুন, শুধু দিহানের দায়িত্ব পালন করলেই চলবে, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার যখন ইচ্ছে তখন উঠবো, যেমন ইচ্ছে হয় তেমন করবো। আপনি নাক গলাতে আসবেন না।
রোহান: ইশা, কী শুরু করেছো?
ইশা আর কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। রোহানের এসব কথাবার্তা পছন্দ হয় নি। ইশা অবহেলা করছে তাকে, সেটি মেনেও নিয়েছে সে। কিন্তু এভাবে কড়া ভাষায় কথা বলার মতো কোনো অপরাধ তো রোহান করে নি।
ইশা ফ্রেশ হয়ে, ভার্সিটির জন্য তৈরি হয়ে নিলো। রোহান দিহানকে কোলে নিয়ে হাঁটছে।
রোহানের সামনে এসে বলল,
ইশা: দিহানকে রুমে রেখে আসেন। ওর ক্ষিধে পেয়েছে।
রোহান: তুমি নাস্তা করে নাও আগে।
ইশা: আমি নাস্তা করবো কি করবো না, সেটি আপনার ভাবতে হবে না।
রোহান আর কিছুই বলল না ইশাকে। কথা বললে কথা আরো বাড়বে, আর ইশার আজকে পরীক্ষাও। রোহান চায় না তার জন্যে ইশার পড়াশুনার কোনো ক্ষতি হোক।
ইশা দিহানকে ঘুম পাড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, নাস্তা না করে। রোহান ডাইনিং-এ এসে একা একা বসে থাকে। অনেক ভালোবাসা নিয়ে নাস্তা বানিয়েছিলো ইশার জন্য। ভেবেছে ইশার দেরী হয়ে যাবে নাস্তা বানালে, আর বাইরের কিছু খেলে অসুস্থও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইশা তো একটু খেয়েও দেখলো না। অনেক ইচ্ছে ছিলো ইশার সাথে বসে নাস্তা করার। একটু পাশে বসলে কি এমন ক্ষতি হতো?
ইশা চলে যাওয়ার পর ইশার সব কাজ রোহান করে দেয় প্রতিদিন। ইশার জন্য দুপুরের খাবারও বানিয়ে রাখে। ইশার পছন্দের খাবারের লিস্ট বানায় রোহান। ইউটিউব দেখে দেখে সারাদিন শুধু রান্না করে আর দিহানকে সামলায়।
কিন্তু ইশা তবুও রোহানের সাথে কথা বলতে চায় না। রোহানের ছায়াও যেন সহ্য হয় না ইশার। আজ একটু রাত হয় রোহানের বাসায় ফিরতে। এসে দেখলো ইশা আর দিহান ঘুমিয়ে আছে। রাতের খাবার বানিয়ে রেখেছে ইশা। রোহানও ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে শুয়ে পড়লো ইশার পাশে।
হঠাৎ খুব জোরে জোরে শব্দ হলো দরজায়। কেউ কড়া নাড়ছে বাঁধাহীন ভাবে। ইশার ঘুম ভেঙে যায়, মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে দেখলো রোহান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ইশা বিছানা ছেড়ে দরজার সামনে এসে ফটক দিয়ে দেখলো, কোনো ছেলে মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ইশা মনে মনে ভয় পেয়ে যায়।
দৌঁড়ে রোহানের কাছে এসে বলল,
ইশা: শুনছেন, কে এসেছে একটু দেখবেন?
রোহান হালকা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো।
ইশার এখন খুব বিরক্ত লাগছে,
ইশা: যত্তসব ঘুমকাতুরে একটা। হুহ।
ইশা দরজার সামনে এসে এবার সাহস নিয়ে বলল,
ইশা: কে?
কাঁপা কন্ঠে জবাব আসলো, অপ্সরী, দরজাটা খোলো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি আমায় ফেলে কোথায় চলে গেছো?
দিব্যের কন্ঠের স্বর শুনে ইশার পুরো শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়, কাঁপা হাতে দরজা খোলে দেখলো, দিব্য তাকিয়ে আছে অসহায় চোখে।
ইশা: তুমি?
দিব্য: তুমি আমায় কীভাবে ভুলে গেলে অপ্সরী? এতো সহজে তুমি আমার জায়গাটা অন্য কাউকে দিয়ে দিলে? আমার কথা একবারো মনে পড়ে নি। আমার খুব কষ্ট হয় জানো। তুমি শুধু আমার অপ্সরী, শুধুই আমার।
ইশা দিব্যের হাত ধরে বলল,
ইশা: আমি সবসময় তোমার থাকবো। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। বিশ্বাস করো, আমি ওই লোকটাকে বিয়ে করতে চাই নি। সবাই জোর করে বিয়ে দিয়েছে। আমি তো তোমারি।
দিব্য: আমি আমার অপ্সরী আর আমাদের বাবুকে খুব মিস করি।
ইশা: বাবুকে কোলে নেবে না তুমি? আমি দিহানকে নিয়ে আসছি। তুমি এখানে বসো।
ইশা দিব্যের হাত ধরে তাকে সামনের চেয়ারে বসায়। তারপর দৌঁড়ে রুমে গিয়ে দিহানকে কোলে নিয়ে দিব্যের কাছে আসে। কিন্তু দিব্যকে আর কোথাও খুঁজে পায় নি।
ইশা পাগলের মতো কাঁদছে আর চিৎকার করে বলছে, আমি আবার হারিয়ে ফেলেছি, আবার হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে। দিব্য, প্লিজ ফিরে আসো। আমি কাউকে তোমার জায়গা দেবো না, প্রমিস।
রোহানের ঘুম ভেঙে যায় কান্নার শব্দে। ইশা ঘুমের মধ্যে কান্নাকাটি করছে। হয়তো কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছে। ইশার কাছে এসে ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রোহান। তারপর ধীর কন্ঠে ইশাকে ডাকলো।
রোহান: ইশা, কি হয়েছে? ইশা, তুমি ঠিক আছো তো?
ইশা ঘুম ভেঙে রোহানকে দেখে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। চিৎকার করে রোহানকে বলল,
ইশা: এখন বেরিয়ে যান এই রুম থেকে। আমার পাশে থাকবেন না। যান বলছি।
রোহান: কি হয়েছে ইশা? এমন করছো কেন?
ইশা: কানে ঢুকছে না কি বলছি? অসভ্য লোক। যান বের হয়ে।
রোহান: আমার দোষটা কোথায় ইশা?
ইশা: আপনার জন্য আমার দিব্য কষ্ট পাচ্ছে। শুধুমাত্র আপনার জন্য। আই হেইট ইউ।
রোহান: ইশা, ওকে, শান্ত হও। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার সামনে আসবো না আর।
রোহান রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাসাটা একমাসের জন্যই নিয়েছিলো তারা। তেমন ফার্নিচার নিয়ে আসে নি। শুধু একটা বেড, ডাইনিং আর রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস সাথে এনেছে। সোফাও ছিলো না, এখন বাকী রাত কীভাবে কাটাবে রোহান? শেষে একটা জায়নামাজ বিছিয়ে বালিশটা নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। ঘুম আসছে না। মাথায় ঘুরছে, ইশা দিব্যকে স্বপ্ন দেখেছে? দিব্য কি বলেছে ইশাকে? রোহানের সাথে থাকলে দিব্য কষ্ট পায়? রোহানও দিব্যকে অনেক বার স্বপ্নে দেখেছিলো, কিন্তু রোহানকে তো কিছুই বলে নি। বলেছে শুধু ইশা আর দিহানের খেয়াল রাখতে। তবে ইশাকে কেন বলেছে দিব্য? এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে ইশা ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে চলে যায়, দিহানকে নিয়ে। রোহান ঘুম থেকে উঠে ইশাকে পুরো ঘরে খুঁজে কোথাও পায় নি।
ইশার আরো তিনটা পরীক্ষা বাকী ছিলো। আজও পরীক্ষা আছে। সে দিহানকে নিয়েই পরীক্ষা দিতে আসে। রোহান ভার্সিটিতে এসে দেখে ইশা দিহানকে পরিচিত একটি মেয়ের কাছে দিয়ে পরীক্ষা দিতে বসেছে।
রোহান: দিহানকে আমার কাছে দাও। তুমি চলে যাও।
-ইশা আপু, আমাকে দিয়ে গেছে। আপনি কে?
রোহান: আমি ইশার হাসবেন্ড।
-ইশা আপুর হাসবেন্ড তো মারা গিয়েছে।
রোহান: দেখো, আমি দিহানের বাবা।
এমন সময় ভার্সিটির প্রফেসর মান্নান ইসলাম রোহানকে দেখে বলল,
মান্নান স্যার: আরে, রোহান, কেমন আছো?
রোহান: আসসালামু আলাইকুম স্যার। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
মান্নান স্যার: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ইশা কেমন আছে? পরীক্ষা বোধহয় আজ?
রোহান: জি স্যার।
মান্নান স্যার: এইটা কি আমাদের হিরোর ছেলে?
রোহান: জি স্যার।
মান্নান ইসলাম মেয়েটির কাছ থেকে দিহানকে নিলেন।
মান্নান স্যার: দিব্যের খবর শুনে বড়ো কষ্ট পেয়েছি। ইশা খুব কম বয়সে স্বামী হারিয়েছে। শুনলাম, বিয়ে করেছো ইশাকে।
রোহান: জি স্যার।
মান্নান স্যার: তোমার বাবা বলেছিলো। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছো।
মান্নান ইসলাম আর ফয়সাল আহমেদ কলেজ বন্ধু ছিলেন, মাঝে মাঝে তাদের যোগাযোগও হয়।
মেয়েটি তাদের কথা শুনে বুঝলো রোহান সত্যি বলছিলো। স্যার চলে যাওয়ার পর মেয়েটি রোহানকে বলল,
– আপনি ইশা আপুর সেকেন্ড হাসবেন্ড?
রোহান: হুম।
-সরি, ভাইয়া। আমি বুঝতে পারি নি। ইশা আপু বলে নি আপনার কথা। আপুর সাথে আমার ভালোই ফ্রেন্ডশিপ। মাঝে মাঝে কথাও হয়।
রোহান: হুম। ইটস ওকে। এখন কি আমার ছেলেকে দেবে?
মেয়েটি দিহানকে রোহানের কোলে দিয়ে চলে গেলো।
রোহান দিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
রোহান: তোর মা না বড্ড ট্যারা। আমি যে তোর বাবা সেটি কাউকে বলে নি কেন? আচ্ছা মানলাম জানাতে চায় না কাউকে। আজকে কি করলো? আমাকে বলেও তো আসে নি এখানে আসার আগে। এভাবে লটরপটর করে কেন আমার সাথে? তোর দিব্য বাবা, তোর মাকে কিভাবে সহ্য করতো? আমিও কিন্তু দিব্য রহমানের ভাই রোহান আহমেদ। সো এতো সহজে পালাচ্ছি না আমি। আমরা দুজনে মিলে একেবারে সোজা করে দেবো কিন্তু। কি আমার পক্ষে থাকবি তো?
ইশা পরীক্ষা শেষে বের হয়ে রোহানকে দেখে আরো বিরক্ত হয়ে গেলো। জোর করে দিহানকে কোলে নিয়ে চলে আসলো। রোহান ইশার পেছন পেছন বাসায় আসলো।
বাসায় আসার পর রোহান ইশাকে বলল,
রোহান: ইশা, তুমি এমন কেন করছো? আমার কি অপরাধ?
ইশা: কি করছি আমি? অন্যের বউকে বিয়ে করেছেন, আর বলছেন কি অপরাধ করেছেন?
রোহানের মাথা এখন গরম হয়ে যায়। প্রতিটি কথার উলটো প্রশ্ন রোহানের ভালো লাগে না। আর তার উপর সকাল থেকে না খেয়ে আছে।
রোহান: জাস্ট স্টপ ইট ইশা। আমি একটা মানুষ তো! আমার কি কোনো অনুভূতি নেই? যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছো আমার সাথে?
ইশা: কি করবো? আদর করবো? ভালোবাসা দেবো? কি চান আমার কাছ থেকে? আপনার মনের বাসনা আমি কখনো পূর্ণ করতে পারবো না। এতো ইচ্ছে থাকলে একটা মেয়ে ভাড়া করে আনেন।
ইশার কথা শুনে রোহানের পুরো শরীর কাঁপতে থাকে রাগে। এতো বড়ো কথা। শেষ কথাটি শুনে চিৎকার করে উঠে রোহান, আর ইশাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
রোহান: চুপ, একদম চুপ। তুই আমাকে কি ভেবেছিস? আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি তোকে আমার মনের বাসনা পূর্ণ করার জন্য বিয়ে করেছি? তুই কি ভাবছিস, আমি তোর কাছে অন্য কিছুর আশায় আছি? আমার ভালোবাসা কি তোর চোখে পড়ে না? এতো নোংরা মন-মানসিকতা কিভাবে রেখেছিস আমাকে নিয়ে? যা ছেড়ে দিলাম। যেখানে ইচ্ছে চলে যা। জাস্ট গেট লস্ট।
ইশা ভয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। ইশার মুখে যা এসেছে বলে দিয়েছে। এতোটা খারাপ হয়ে যাবে বিষয়টি সে ভাবতে পারে নি।
রোহান ইশাকে দেখে আবার চিৎকার দিয়ে উঠে,
রোহান: কি হলো, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গেট আউট ফ্রম হেয়ার। যা……..ও।
ইশা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ইশার নিজেরই এখন খারাপ লাগছে। খুব খারাপ কথা বলে ফেলেছে সে রোহানকে। রোহান তো শুধু দিহান আর তার দায়িত্ব নিয়েছে, দিহানকে বাবার মতো আগলে রেখেছে। আর তার জন্য কতো কিছু করেছে। ছিঃ এতোটা জঘন্য ভাষায় কথা কীভাবে বলতে পারলো?
রোহান পাঁচ মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো এক জায়গায়। ইশাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে সে। কোথায় যাবে ইশা?
আবার বেরিয়ে পড়লো ইশাকে খুঁজতে। সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইশা। মুখে উড়না পেঁচিয়ে কাঁদছে।
রোহানের আওয়াজ শুনে চোখ মুছে ফেলল,
রোহান: বাসায় চলো। আর তো কয়েকটা দিন। তারপর আমার সাথে আর থাকতে হবে না। আর সহ্য করতে হবে না আমাকে। আমি আসবো না আর তোমার সামনে।
ইশা: আই এম সরি। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
রোহান: ইটস ওকে।
রোহান বাকী দিনগুলোতে ইশার সাথে একটি কথাও বলে নি। রাতে মেঝেতে ঘুমিয়ে ছিলো। ইশাও রোহানের সাথে কথা বলে নি। মনে মনে খারাপ লাগলেও দেখায় নি কিছু। ইশার পরীক্ষা শেষ হলে ইশা বাবার বাড়ী চলে আসে দিহানকে নিয়ে।
রোহান ইশাকে দিয়ে আসার পর, বাসায় এসে খুব কেঁদেছিলো। এতোটা খারাপ কিভাবে ভাবলো ইশা আমাকে? ভালোবাসা মানে কি দৈহিক সম্পর্ক? এসব তো ভালোবাসা না। সে তো ইশার কাছে এমন ভালোবাসা চায় নি। সে শুধু চেয়েছে ইশা যাতে তার সাথে একটু হেসে কথা বলে, একটু ভালো ভাবে তাকায় তার দিকে, তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে যাতে শুনে, এইটুকুই চেয়েছিলো। বেশি কিছু তো চায় নি।
এদিকে ইশা তার মাকে স্বপ্নের কথাটি বলল, যে দিব্য কষ্টে আছে রোহানের সাথে বিয়ে হওয়ায়। তাই এই সম্পর্ক সে আর রাখবে না।
ইশিতা পারভীন মেয়ের কথা শুনে বললেন,
ইশিতা: তুই কি ভেবেছিস, দিব্য এসে তোকে এসব বলেছে? কখনো না। মৃত্যুর পর ওপাড়ে চলে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে এপাড়ের কোনো সংযোগ নেই। দিব্যের তোর কথা মনে করার সময় নেই রে, মা। সে নিজের জগতে আছে। আর এসব স্বপ্ন তুই দেখছিস, কারণ তোর মনে হয় দিব্য এসব ভাবে। তুই সারাদিন এসব নিয়ে পড়ে থাকিস। তাই এসব স্বপ্ন দেখছিস। বরং দিব্য খুশি হবে জানলে। রোহানকে খুব ভালোবাসতো তোর দিব্য। দিব্য যদি জানতে পারে, রোহান তার দিহানের বাবা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না। এসব মাথা থেকে ফেলে দে। পাগল হয়ে যাবি তুই। রোহান অনেক ভালো ছেলে। অবহেলা করিস না, মা। পাপ হবে। যাই হোক, এখন তোর বর তো।
ইশা মায়ের কথা শুনে মনে মনে অনেক কষ্ট পায়। রোহান এখন ইশার বর। ভাবতেও কষ্ট হয়। কিভাবে পারবে মানতে এই সত্যটি? পারছে না ইশা। এতো সহজ না সবকিছু মেনে নেওয়া।
আজ রাতটিও ছিলো দুটি মানুষের জন্য অন্ধকারময়। রোহান আর ইশার জীবনের এক অন্ধকার রাত। একজন প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে আঘাত পেয়েছে, অন্যজন নতুন জীবন কীভাবে মেনে নিবে সেই দ্বিধায় ভুগছে।
চলবে-
আগের পর্ব 👇
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/375252920863153/