অপেক্ষা
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
পর্ব-(৩৮+৩৯): (বুড়ো-বুড়ি স্পেশাল)
৩৮।
সকালে রাজিয়া রহমান নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লেন। উদ্দেশ্য সেই পরিচিত পরিবেশ। মেডিকেল ক্যাম্পাসের সামনে নেমে, রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা শুরু করলেন ক্যাম্পাসের পিচ ঢালা রাস্তায়। হালকা হাওয়ায় শাড়ীর আঁচল উড়ছে। খোঁপা করে এসেছেন। চুলে লাগানো মেহেদীর লালচে রঙ সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এর মধ্যেও কয়েকটা আধা-পাকা চুল বোঝা যাচ্ছে। এই রাস্তায় একটা সময় তার বুড়োটার সাথে হেঁটেছিলেন হাতে হাত রেখে। কখনো রংবেরঙের শাড়ি, কখনো বা ভালো জামা পড়ে একটু সেজে আসতেন তার বুড়োকে দেখাবেন বলে।
আর বুড়োটা বলতো, ‘তুমি যেমন দেখতে ওভাবেই ভালোবেসেছি তোমায়। আমি তোমার মনের সৌন্দর্যে আকর্ষিত হয়েছি। তোমার রূপ ওই মনটার সামনে ম্লান। তুমি এভাবে সেজে এসো না রাজিয়া।’
ফয়সাল আহমেদের বলা কথাগুলো মনে করে হাসলেন। আজ কোনো সাজসজ্জা নেই। নতুন প্রেমিকের সাথে তো আর দেখা করতে আসছেন না। বুড়ো প্রেমিকের সাথে দেখা করতে আসছেন। যেই মানুষটার শরীরের ঘ্রাণটাও তার পরিচিত। ফয়সালের অস্তিত্ব দুটি নিয়েই তো বেঁচে ছিলেন এতোটা বছর।
হালকা হলুদ রঙের সুতির শাড়ী পড়েছেন আজ। হাতে ছিলো একটা ব্যাগ। চলে গেলেন লাইব্রেরীতে। খুঁজতে হয় নি বেশিক্ষণ। সেই জায়গায় বসে আছেন ফয়সাল আহমেদ চোখে মোটা চশমা লাগিয়ে, যেখানে তারা দুজন একসাথে বসতেন। রাজিয়া নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন পাশে। সেই পুরোনো লাইব্রেরী রুম, কিন্তু অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন আলমারি, নতুন বইয়ের গন্ধ, নতুন আসবাবপত্র। লাইব্রেরীর হাওয়ায় এখন নতুনত্বের ছোঁয়া। শুধু মানুষ দুটি পুরোনো। আর তাদের পুরোনো ভালোবাসা যেন এখন আবার জাগিয়ে তুলেছে সেই লাইব্রেরীটিকে।
ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে ফয়সাল আহমেদের দিকে ঠেলে দিলেন রাজিয়া রহমান।
ফয়সাল মুখে হাসি টেনে বইটির দিকে তাকালেন। সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ বইটি। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পান তার বুড়ির পত্র। সেই পরিচিত হাতের লেখা। চিঠি কাছে এনে ঘ্রাণ নিলেন, রাজিয়ার ছোঁয়া লেগে আছে এই পত্রে।
রাজিয়া রহমান লিখেছেন,
‘পনেরো বছর তুমি পাশে ছিলে না,
তবুও কাটেনি তোমার বাসনা,
চিঠিগুলো এখনো বহু যত্নে পড়ি,
তোমার প্রেমেতে এখনো মরি।
.
তুমি যদি অনিমেষ হও,
আমি মাধবীলতা,
ভালোবাসা যদি আবার চাও,
আমি দেবো না সহজে ধরা।
.
তবুও ভালোবেসেছি তখনো,
এখনো ভালোবাসি,
যদি এই হাত না ছাড়ো কখনো,
তোমার রাজিয়া রাজি।’
ফয়সাল আহমেদ মুচকি হাসলেন।
তারপর কলম বের করে চিঠির অপর পাতায় লিখলেন,
‘রাজিয়া এখন রাজি,
ডাকবো না আর কাজি,
আমরা তো এখনো আছি,
কাবিন যদিও বাসি।
.
সম্পর্কটি এখনো মুখ্য
অতীত যদিও রুক্ষ,
ছাড়ি নি তখনো হাত,
তুমি আমার দিন-রাত,
আজ হয়েছে পূর্ণ,
অপেক্ষার ফল হয়নি শূন্য।
.
ভালোবাসি তোমায় রাজিয়া,
জড়তা মুছে দাও কাছে আসিয়া।’
একে অপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ হাসি দিলেন। আজ তারা মন থেকে হাসছে। তাদের অপেক্ষার সমাপ্তি হয়েছে। ভালোবাসায় এই সমাপ্তির ঠিকানা ছিলো। আজ তারা ঠিকানা ফিরে পেয়েছে। বুড়োটা তার বুড়ির হাত ধরেছে শক্ত করে। এই হাত আর ছাড়বে না। নিজের বাহুডোরে আটকে রাখলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। এতোবছর পর তার স্ত্রীর উপর যেন অধিকার ফিরে পেয়েছেন আবার। যদিও এতোবছর সেই অধিকার ছিলো। কিন্তু নিজ ইচ্ছায় তারা অধিকারটি থেকে দূরে ছিলেন।
রাজিয়া আর ফয়সাল, রাজিয়া রহমানের বাসায় আসলেন। দিয়া আর ইশা গল্প করছে। রোহান আর দিব্য খেলা দেখছে। ফয়সাল আহমেদকে দেখে রোহানের হাত থেকে রিমোট পড়ে যায়। দিব্য রোহানের চোখ অনুসরণ করে ফয়সালকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায়।
দিব্য: তোমরা একসাথে?
রাজিয়া আর ফয়সাল মুচকি হাসলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে।
রোহান খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
রোহান: আমার খুব ভালো লাগছে। তার মানে আমার পরিবার এখন পূর্ণ?
রাজিয়া রহমান মাথা নেড়ে বললেন,
রাজিয়া: তোর বউ আসলে পূর্ণ হবে।
রাজিয়ার কথা শুনে সুখের মাঝেই যেন আঘাতের ঢেউ এসে ভীড় জমায় রোহানের মনের তীরে। তবুও কথাটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সাথে সাথে। আজ তো তার জন্য বড়োই আনন্দের দিন, আজ ‘কষ্ট’ নামের শব্দটিকে আসতে দেবে না সে।
দিয়া আর ইশা শব্দ শুনে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে। দিয়াকে দেখে ফয়সাল আহমেদ হাত এগিয়ে দিলেন। দিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।
ফয়সাল: আমার ছোট্ট মা টা কি তার বাবার কাছে আসবে না?
দিয়া তখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের পানি টলমল করছে, যেন এখন বৃষ্টি নামবে চোখ বেয়ে।
ফয়সাল আর অপেক্ষা না করে নিজেই মেয়ের কাছে আসলেন। দিয়ার হাতগুলো নিজের হাতে রাখলেন।
ফয়সাল: ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো বড়ো হয়ে গেছে। আমার মেয়েটাও তো অনেক বড়ো হয়েছে! বাবাকেও ভুলে গেছে। আসছেও না আমার কাছে।
দিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ইতস্ততবোধ করছে সে। কারণ আজ বুদ্ধি হওয়ার পর প্রথম বাবাকে সামনা-সামনি দেখেছে। মনের মধ্যে ভয়, জড়তা, আনন্দ সব একসাথেই ভীড় করছে।
ফয়সাল: আমার মেয়েটা কি এখনো রাগ করে আছে?
দিয়া মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলো তার কোনো রাগ নেই, কোনো অভিযোগ নেই।
রোহান: দিয়াকে একটু সময় দেওয়া উচিত। তোমাকে প্রথম দেখছে তো!
দিয়া যেন সুযোগ খুঁজছিলো পালানোর। কারণ তার খুব কান্না পাচ্ছে৷ এভাবে তার বাবার সামনে কাঁদতেও লজ্জা লাগবে। তাই সরে পড়লো দেরী না করে।
রাজিয়া: ও একটু লাজুক স্বভাবের। কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।
দিব্য হেসে বলল,
দিব্য: হ্যাঁ, রোহানের সাথেও এমন একটা ভাব দেখিয়েছিলো।
রোহান: আর এখন মেয়েটার মুখে যেন কেউ ইঞ্জিন লাগিয়ে দিয়েছে। একবার শুরু হলে নিজ থেকে থামবে না, প্যানপ্যান করতেই থাকবে।
ইশা সালাম করলো ফয়সাল আহমেদকে।
ফয়সাল: আমাদের বউমা?
রাজিয়া: হ্যাঁ।
ফয়সাল: ভারী মিষ্টি মেয়ে আনলে তো আমাদের দিব্যের জন্য?
রাজিয়া: তোমার দিব্যের পছন্দ।
ফয়সাল: আমার ছেলের তো দেখছি আমার মতোই রুচি। গুড চয়েজ মাই সান।
রোহান ইশার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। রোহান মনে মনে বলছে,
রোহান: উফ, কি অসহ্য লাগছে এসব। মেয়েটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, চলে যাচ্ছে না কেনো? আমিও কি ভাবছি, ও যাবে কোথায়? ওর বর তো এখানেই। ও আল্লাহ আমাকে এই মায়া থেকে মুক্তি দাও। আর কতো আবেগে জড়াবে মেয়েটা আমায়? এখন তো একসাথেই থাকতে হবে। কিভাবে আটকাবো নিজেকে? আর পারছি না। কিছুতো একটা করতে হবে।
সন্ধ্যায় রাজিয়া আর ফয়সাল গেলেন ইশাদের বাসায়। কামাল উদ্দিন আর ইশিতা পারভিনের সাথে দেখা করতে। তাদের ভালোই গল্প জমলো।
এখন ফয়সাল তার পরিবার নিয়ে চলে যেতে চান নিজ বাসায়। কিন্তু এভাবে সব হঠাৎ ছেড়ে তো চলে যাওয়া যায় না। অনেকটা বছরতো এখানেই ছিলেন রাজিয়া রহমান সন্তানদের নিয়ে।
তাই তারা কিছুদিন সময় নেন। দুইদিন পর রোহান এসে রাজিয়া রহমান আর দিয়াকে নিয়ে যায়।
রোহান বলল, ‘দিব্য আর ইশা কিছুদিন একা সংসার করুক। এতোদিন দিব্য মা-বোনের ভাগ পেয়েছে, এখন আমার পালা।’
দিব্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
রোহান: তুই বরং তোর বউকে নিয়ে একা থাক কিছুদিন। তোর তো বউ আছে। আমি আমার মা-বোনকে নিয়ে থাকতে চাই।
দিব্য: যা যা, তোর জন্য কিছুদিন না হয় মায়া ছাড়লাম।
দিয়া: তুমি টেনশন নিও না ভাইয়া। আমরা তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করছি। খুব শীঘ্রই তুমি শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছো ইশা ভাবী।
রোহান: আচ্ছা, চল চল।
দিয়া: আমি রিধির সাথে একবার দেখা করবো। অনেকদিন কথা হয় নি।
দিয়া রিধির বাসায় গেলো রিধিকে দেখতে। রিধিকে দেখেই দিয়ার বুকটা কেঁপে উঠল।
কি অবস্থা বানিয়ে রেখেছে মেয়েটা। চোখের নিচে কালি জমেছে, মুখ শুকনো, এলোমেলো অবস্থা, মনে হচ্ছে অনেকদিন নিজের যত্ন নেয় নি।
দিয়া রিধির হাত ধরে বলল,
দিয়া: কি হয়েছে রিধি?
রিধি: আমার সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে।
৩৯।
রিধি এতোদিন তার সাথে যা কিছু হয়েছে সব খুলে বলল দিয়াকে। দিয়ার এসব আর সহ্য হচ্ছে না। এতো কষ্ট পেয়েছিলো রিধি!
দিয়া: তুই চল আমার সাথে। আমাদের সাথে থাকবি।
রিধি: দিয়া, তোর বাসায় কতোদিন থাকবো বল? আমার তো কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আমার একাই থাকতে হবে।
দিয়া: রোহান ভাইয়ার সাথে বিয়ের কথা বলছে, বললি না? রিধি, রোহান ভাইয়া অনেক ভালো। তোকে অনেক ভালো রাখবে। আমি জানি রক্তিম ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু কখনো কখনো ভালোবাসাকে ত্যাগ দিতে হয় নিজের সুখের জন্য। এখন রক্তিম ভাইয়া আর তুই যদি পালিয়েও বিয়ে করিস, তোরা সুখে থাকবি না। কারণ রক্তিম ভাইয়ার পরিবার তোকে শান্তিতে বাঁচতে দেবে না।
রিধি: আমিও চাই না বাবা-মাকে কষ্ট দিতে। আমি একটা অনাথ-অসহায় মেয়ে ছিলাম। তারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো, নিজের মেয়ের মতো বড়ো করেছিলো, পড়াশুনাও করিয়েছে। বিশ্বাস কর, আমার কখনো মনে হয় নি আমি অনাথ। আজ তাদের খুশির জন্য আমি কি আমার ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারবো না?
দিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
দিয়া: আমরাও চলে যাচ্ছি বাবার বাসায়। দিব্য ভাইয়া আর ইশা ভাবী কিছুদিন পর যাবে। তুই ভার্সিটিতে গেলে দেখা হতো। কিন্তু তোকে তো ভার্সিটিতে যেতেও দিচ্ছে না।
রিধি: আচ্ছা, তুই মন খারাপ করিস না আমার জন্য। তোর জন্য আমার অনেক খুশি লাগছে। তোর পরিবার পূর্ণ হলো। আমার জন্য দোয়া করিস যাতে আমার ইচ্ছেটাও পূর্ণ হয়।
দিয়া: কি ইচ্ছে তোর?
রিধি: শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত রক্তিমকে পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবো।
দিয়া: আল্লাহ যাকে তোর ভাগ্যে রেখেছেন সেই হবে তোর অপেক্ষার ফল।
রিধি: তাই তো অপেক্ষায় থাকবো। যার সাথেই হবে তাকে মনে প্রাণে মেনে নেবো। কিন্তু ততোদিন পর্যন্ত আমি রক্তিমকেই ভালোবাসবো।
দুই একদিন পর ফয়সাল আহমেদের সাথে জুনাইয়েত হোসেইনের কথা হয় রিধি আর রোহানের বিয়ের ব্যাপারে। ফয়সাল আহমেদের কোনো অমত নেই, কারণ রাজিয়া রহমানের রিধিকে পছন্দ। কিন্তু রোহানের সাথে কথা বলেই তারা আগাতে চান।
রাজিয়া রহমান বিকেলে রোহানের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে আসেন।
রাজিয়া: রোহান, তোর সাথে কিছু কথা আছে।
রোহান: হ্যাঁ মা, বলো।
রাজিয়া: রিধিকে কি তোর পছন্দ?
রোহান: রিধিকে পছন্দ! মানে?
রাজিয়া: রিধির বাবা বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
রোহান: কার জন্য?
রাজিয়া: তোর জন্য। রিধি আর তোর…..
রোহান: মা…মানে?
রাজিয়া: হ্যাঁ। আমার রিধি মেয়েটাকে অনেক ভালো লাগে। আর তোর বউ আসলেই আমাদের পরিবারটা পূর্ণ হবে। দিব্যতো নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। আমি তোর বিয়েটা আমার পছন্দে দিতে চাই।
রোহান: কিন্তু রিধি? ও তো বাচ্চা একটা মেয়ে।
রাজিয়া: বাচ্চা কোথায়? ভার্সিটিতে উঠেছে। দিয়ার সমবয়সী। তোদের বয়সের পার্থক্যও তেমন না। আর তোর ভালো চাকরীও হয়েছে। এখন বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? তোর কি কোনো পছন্দ আছে?
রোহান চুপ হয়ে যায়। তার ভালোবাসার মানুষটিকে তো হারিয়েই ফেলেছে। এখন আর কিসের অপেক্ষায় থাকবে।
রাজিয়া: কি হয়েছে রোহান? তোর পছন্দ থাকলে বল। আমরা তোকে চাপ দেবো না।
রোহান: না। তেমন কিছু নেই।
তোমার পছন্দই আমার পছন্দ। তুমি খুশি থাকলে আমিও খুশি।
রাজিয়া খুশি হয়ে বললেন,
রাজিয়া: তুই তাও ভেবে দেখ। তোকে তো সময় দিচ্ছি। আর না হয় রিধির সাথে কথা বল। দেখা কর দুজন। তারা আমাদের উত্তরের অপেক্ষায় আছে।
রোহান: আচ্ছা মা, আমি তোমাকে রাতে জানাচ্ছি।
রাজিয়া: আচ্ছা।
রাজিয়া রহমান চলে যাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রোহান। দিব্য আর ইশা সুখেই আছে। ইশার এখন সুন্দর সংসার আছে। কিসের মায়ায় থাকবে সে? দুই একদিন পর দিব্য, ইশাকে নিয়ে আসবে বাসায়। তখন তো সারাদিন না চাইতেও চোখের সামনেই থাকবে। এভাবে সে ইশাকে ভুলতে পারবে না। জীবনকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত। জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকে না। আর একদিন বিয়ে তো করতেই হবে। আর যদি এখনই করে, হয়তো ইশাকে ভুলে যাওয়াটা সহজ হবে। হয়তো সৃষ্টিকর্তা তার জন্য এই পথটি খোলা রেখেছেন।
রাতে সে রাজিয়াকে জানিয়ে দেয় তার রিধিকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই।
পরেরদিন রাজিয়া আর ফয়সাল রক্তিমদের বাসায় যান রিধিকে দেখতে। তারা বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেন। নবনী হোসেইন খুব শীঘ্রই এই বিয়ে সেরে ফেলতে চান। আর জুনাইয়েত হোসেইন বুকে পাথর চেপে এসব দেখছেন।
রক্তিম এখনো কিছুই জানে না। রিধি নিজ থেকেও জানায় নি। কারণ রক্তিম জানলে অনেক ঝামেলা করবে। রিধি চায় না তার জন্য আর কোনো ঝামেলা হোক।
আজ দিব্য ইশাকে নিয়ে আসলো ফয়সাল আহমেদের বাসায়। এখন থেকে তারা এখানেই থাকবে। ইশার মন সকালে থেকেই খারাপ। কারণ এতোদিন বাবার বাড়ির কাছেই ছিলো, যখন তখন দেখা করতে চলে যেতো। এখন তো আর সম্ভব না।
ইশার মন খারাপ দেখে, দিব্য ইশাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
দিব্য: আমার অপ্সরী কেনো মন খারাপ করে আছে, জানতে পারি?
ইশা: তুমি জানো না, কেন মন খারাপ? বাবা-মাকে মিস করছি খুব।
দিব্য: এটাই স্বাভাবিক। ঠিক হয়ে যাবে কিছুদিন পর। আমি আছি তো তোমার সাথে।
ইশা হঠাৎ গাল ফুলিয়ে বলল,
ইশা: অপ্সরীর কাব্যটা না খুব পঁচা। অপ্সরীকে শুধু শুধু কষ্ট দেয়।
দিব্য: কাব্যটা তার অপ্সরীকে যে মারাত্মক ভালোবাসে। অপ্সরী কষ্ট পেলে কাব্যটাও যে কষ্ট পায়। এই অপ্সরী, কষ্ট পেও না তুমি। বলো তোমার কাব্যটা এখন কি করবে তোমার জন্য?
ইশা: তুমি শুনবে তো? আমি যা চাইবো দেবে তো?
দিব্য: হ্যাঁ মন দিয়ে শুনবো। আর আমার সব কিছুই দিয়ে দিতে রাজি।
ইশা: তুমি তো আমারি আছো। তোমার সবকিছুই তো আমার। অন্যকিছু চাই।
দিব্য: বলো।
ইশা: একটা বাবু লাগবে আমার।
দিব্য: ওরে বাবা, আমার সামনেই তো একটা বসে আছে।
ইশা: ওইটা তোমার বাবু। আমাদের বাবু না।
দিব্য: আচ্ছা? হঠাৎ বাবু কেন? আমাদের তো মাত্র বিয়ে হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি!
ইশা চুপ করে বসে আছে। তার মাথায় একটা কথায় ঘুরছে। মা বলেছিলো একটা বাচ্চা নিলে দিব্য একটি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকবে। এতোবছর রাজিয়া আর ফয়সাল একে অপরের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো, দিব্য, রোহান আর দিয়ার জন্য। বাচ্চা না হলে সম্পর্কটা আর কখনো জোড়া লাগতো না। দিব্যও যদি হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে যায়? একটা বাবু আসলে দিব্য কখনো ইশাকে ছেড়ে যাবে না। আর ইশা চায় না দিব্যকে হারাতে। ইশার দ্বিতীয় ভালোবাসা দিব্য। আর দিব্য শুধুই তার ভালোবাসা না, এখন তার সবকিছুই দিব্য। দিব্যকে হারিয়ে ফেললে সে পাগল হয়ে যাবে। রাজিয়া রহমানের মতো পনেরো বছর অপেক্ষায় থাকতে পারবে না ইশা। কারণ এতো ধৈর্য ইশার নেই। যেখানে অল্পতেই সে ঘুমের ঔষুধ বা উল্টোপাল্টা অনেক ঔষুধ খেয়ে অচেতন হয়ে যায়। অনেক বারই এমন করেছিলো। বাবা-মার সাথে রাগ করেও এমন পাগলামি করতো। কিন্তু দিব্য, ইশার জীবনে আসার পর তার প্রতিটি দিন বাঁচতে ইচ্ছে হয়। আর প্রতিদিন ইশা নামাজ পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দিব্যের মতো একজনকে পেয়ে।
ইশা দিব্যকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করে, তবুও যদি হঠাৎ দিব্যকে হারিয়ে ফেলে! তার ধারণা দিব্যের অস্তিত্বই দিব্যকে তার সাথে বেঁধে রাখবে।
দিব্য: এই অপ্সরী, কি হয়েছে তোমার?
ইশা: আমাকে এতো প্রশ্ন করো না। তুমি আমাকে বলেছো আমি যা চাইবো তাই দেবে। দিচ্ছো না তো এখন! মিথ্যে আশা দিয়েছো কেন তাহলে?
দিব্য: ইশা। তুমি রাগ করছো কেন? তোমার পড়াশুনাও শেষ হয়নি। আমার তো কোনো সমস্যা নেই। তুমি কি একসাথে দুটি সামলাতে পারবে?
ইশা: তোমার ওইসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আর আমি একা কেন সামলাবো। তুমি কি ঘাস কাটবে?
দিব্য মুচকি হেসে বলল,
দিব্য: আমাকে তো বড়ো বাবুটাকে সামলাতে হবে। যে এখনো ঠিকমতো ভাত খেতে পারে না, মাঝে মাঝে খাইয়ে দিতে হয়। ঠিকমতো চুল বাঁধতে পারে না, বরকে চুল আঁচড়ে দিতে হয়। এখনো শাড়ির কুঁচি ঠিকমতো ধরতে জানে না, সেটিও দিব্য রহমানকে করতে হয়। ভালোমতো ভাত রাঁধতে পারে না, ধোঁয়া উঠিয়ে দেয় রান্নাঘরে। বড়ো বাবুটি, ছোট্ট বাবুর জন্য খিচুড়ি কিভাবে রাঁধবে?
ইশা গাল ফুলিয়ে বসে আছে।
দিব্য: সকালে ঘুম থেকে টেনে ধরে যাকে উঠানো লাগে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য, সে সারারাত কিভাবে জাগবে ছোট্ট বাবুর জন্য?
ইশা: যাও, কথা নেই তোমার সাথে।
দিব্য বিছানায় বসলো পা গুটিয়ে, সাথে ইশাকে টান দিয়ে বসিয়ে দিলো।
ইশা: কি করছো?
দিব্য: রাগ করেছো? আচ্ছা, আমার অপ্সরীর এই ইচ্ছেটাও পূর্ণ হয়ে যাবে। আমি তো তোমার কথা ভেবে বলেছিলাম। তোমার কষ্ট হবে এতোকিছু একসাথে সামলাতে। ছোট্ট বাবুটা তো বিরাট দায়িত্ব তাই না?
ইশা: তুমি পাশে থাকলে আমার কোনো কষ্ট হবে না।
দিব্য: আমি তো তোমার সাথেই থাকবো সবসময়।
তিন-চার দিন কোনো নতুনত্ব ছাড়াই কেটে গেলো রিধি-রক্তিমের দিন। রিধির মধ্যে সেই দুষ্টুমি ভাবটা কেটে গেছে যেটি একমাসে আগেও ছিলো। জুনাইয়েত-নবনী দম্পতীর ঘরে আর পুরোনো দিনের মতো আমেজ নেই। যে প্রতিদিন ঘরটাতে আমেজ ছড়িয়ে রাখতো সে তো কোথায় হারিয়েই গেছে।
আজ রিধি আর রোহান দেখা করবে। দিব্য গতকাল রাতেই জানতে পারে রোহান আর রিধির বিয়ের কথাবার্তা চলছে, আর রোহানের কোনো আপত্তিও নেই। দিব্য এসব জানার পর রোহানকে রিধি আর রক্তিমের সম্পর্কের কথা বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভালো সুযোগ পায় নি।
রিধি কমলা রঙের জামা পড়েছে আজ। রঙটা রিধির পছন্দ না, আর রিধির মনে হয় তাকে এই রঙে ভালো মানায় না। তাই ইচ্ছে করেই নিজেকে এই রঙে রাঙিয়েছে সে। একদমই সাজে নি আজ রিধি। চুলগুলোও বাঁধে নি। ভালোমতো আঁচড়েও আসে নি। মাথায় কাপড় দিয়ে রেখেছিলো। রক্তিম অফিসে ছিলো তাই এসব জানতো না।
রেস্টুরেন্টে বসেই মাথার কাপড় ফেলে দেয়। যাতে পাগলের মতো বানিয়ে রাখা চুলগুলো দেখে রোহান পালিয়ে যায়। রোহান সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে। রোহান দেখতে তো সুদর্শনই, আর আজকে তো পুরাই কিলার লুক। রিধি কাচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে আর রাস্তার গাড়িগুলো গুনছে কারণ ছাড়াই। হয়তো পাগল হয়ে গেছে সে। রিধিকে দেখেই রোহান চেয়ার টেনে বসলো। তখনো রিধির কোনো সাড়া শব্দ নেই। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে একটু গলা খাঁকারি দিলো। তবুও রিধির কোনো হুঁশ নেই। বেখেয়ালে বসে আছে। রোহান টেবিলের উপর হাত রেখে রিধির চোখ অনুসরণ করলো। কিন্তু এমন কিছুই দেখলো না যেটি দেখে এভাবে তাকিয়ে থাকা যায়। চোখ ফিরিয়ে রিধিকে ভালোমতো লক্ষ্য করলো। মেয়েটি একদম শুকিয়ে গেছে। চোখের মাঝে যেন হতাশা ভীড় করে আছে।
রোহান নিজেই শুরু করলো কথা।
রোহান: রিধি, তুমি কি শুনছো?
রিধি বাস্তবে ফিরে এলো। রোহানকে দেখে স্বাভাবিক হাসি দিলো। রোহান এই হাসির পেছনে ভয়ংকর কষ্ট দেখতে পেয়েছে।
রিধি: ভালো আছেন?
রোহান: আমি ঠিক আগের মতোই আছি। কিন্তু তুমি আগের মতো নেই।
রিধি: হ্যাঁ। একটু বড়ো হয়েছি, বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আগের মতো কিভাবে থাকবো?
রোহান মনে মনে ভাবছে, মেয়েটির মধ্যে সেই বাচ্চামো স্বভাবটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। এতো বড়ো হয়ে গেছে সে।
রোহান: তোমার কিছু জানার আছে?
রিধি: না।
রোহান: তুমি কি কারো চাপে পড়ে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেছো?
রিধি: আমি নিজ ইচ্ছাতেই হ্যাঁ বলেছি। ইচ্ছা না থাকলে আমাকে এখানে দেখতেন না।
রোহান: হুম। রিধি, কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারো। তোমার কি কোনো পছন্দ আছে?
রিধি আহত দৃষ্টিতে রোহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
রিধি: সব পছন্দের জায়গা আমাদের জীবনে হয় না। কিছু পছন্দের মানুষকে ভুলে যাওয়ায় শ্রেয়।
রোহান: যারা আমাদের ভাগ্যে থাকে না, তাদের জন্য অপেক্ষায় থাকার দরকার নেই। কিন্তু জীবনকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত। আমি হয়তো তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। সব কথা প্রকাশের জন্য ভাষার দরকার হয় না। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়।
রিধি চুপ করে বসে আছে। আসলেই রোহান হয়তো বুঝে ফেলেছে তার অবস্থা। মানুষতো এতো বোকাও হয় না।
রোহান: রিধি, তোমার অমত না থাকলে, আমার এই বিয়েতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একটা কথা আমি অবশ্যই বলবো, আমি হয়তো তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না। কারণ আমি অন্য একজনকে ভালোবাসার জায়গাটা দিয়ে দিয়েছি। এক মনে দুইজনের জায়গা হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে আমি আমার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করবো। বাকীটা হয়তো সময় পরিবর্তন করেও দিতে পারে।
রিধি: একটা প্রশ্ন করি?
রোহান: অবশ্যই।
রিধি: অন্য একজনকে ভালোবাসলে আমাকে কেন বিয়ে করছেন?
রোহান: বললাম তো, যারা ভাগ্যে নেই, তাদের অপেক্ষা করতে নেই। আমি নিজেকে পুরোনো মায়া থেকে বের করে আনতে চাচ্ছি। কারণ যাকে ভালোবাসতাম সে অন্যের ভালোবাসায় বিভোর।
রিধি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
রোহান: আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাতে চাই নি। তাই সব খুলে বললাম। তোমার আর কিছু জানার আছে?
রিধি: আমার আর কিছুই জানার নেই। আমি হয়তো আপনাকে বুঝতে পেরেছি, আর আপনিও হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমাকে। এভাবেই অসম্পূর্ণ দুটি মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা যদি কোনো সম্পূর্ণতা খুঁজে পান, তাহলে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
রিধির চোখে পানি টলমল করছে। রোহানের বুকে আবার সেই অদ্ভুত যন্ত্রণা। রিধির জায়গায় একসময় সে ছিলো। তাই রিধির কষ্ট সে বুঝতে পেরেছে।
রোহান: প্রমিজ মি রিধি, একটা সুযোগ যদি থাকে, তুমি আরেকটা বার চেষ্টা করবে ভালোবাসাটাকে বাঁচানোর।
রিধি: আপনি কি করেছিলেন?
রোহান: পারিনি। আমার একজনের জন্য আমি অনেকগুলো মানুষের হাসি কেঁড়ে নিতে পারি না। আমার অধিকার নেই। আর যদি মানুষগুলো খুব কাছের হয় তখন তো প্রশ্নই উঠে না।
রিধি: তাহলে আমি কিভাবে পারবো প্রিয় মানুষগুলোকে কষ্ট দিয়ে নিজেকে সুখী রাখতে? ইনশাল্লাহ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
রিধি ম্লান হাসি দিয়ে বিদায় নিলো রোহান থেকে। রোহান রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন একজনকে সে ভালোবাসে যে মানুষটি এখনো জানেই না কতোটা যত্নে রেখেছে তাকে এই হৃদয়ে। ইশার জীবনে ভালোবাসার অভাব নেই। হয়তো রিধির জীবনে সেই ভালোবাসার অভাব আছে। রোহান চায় রিধির জীবনে সেই ভালোবাসা ফিরে আসুক। তা যদি রিধি তার ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেয়ে পায় তাতে আপত্তি নেই। আর রোহানের যদি রিধির সাথে বিয়ে হয়, সে রিধির জন্য রিধিকে ভালোবাসার চেষ্টা করবে। কারণ সে জানে ভালোবাসা ছাড়া জীবন বড়োই জটিল।
চলবে–
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/374654374256341/