অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১৪
ইভান ফোন করে দেয়ার পরেই ইলহাম দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। বাড়ি থেকে সেখানে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু প্রকৃতির বর্ষণের যেনো বড্ড তাড়া। সময় নষ্ট না করেই ঝমঝম করে নেমে এলো বৃষ্টি। মুহূর্তেই আকাশ কাপিয়ে শুরু হলো বজ্রপাত। চারিদিকে ভিজে থৈথৈ হয়ে গেলো। ঈশা গাছের নীচে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। বৃষ্টির ছাঁট এসে অর্ধ ভিজিয়ে দিয়ে গেলো তাকে। অস্থির চিত্তে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। অল্প কয়েক মিনিটেই ইলহাম রিক্সা নিয়ে এলো। মাথাটা বের করে বলল
— উঠে এসো আপু। বৃষ্টি বাড়ছে।
ঈশা দ্রুত রিক্সায় উঠে বসলো। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
— এতো দেরি করলি কেনো? কখন থেকে অপেক্ষা করছি।
ইলহাম ভ্রু কুচকে হাতের ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল
— ১৫ মিনিট হয়েছে মাত্র। বাড়ি থেকে এখানে আসতে তো ১৫ মিনিট সময় লাগেই। দেরি হয়নি তো।
ঈশা একটু ভাবলো। আসলেই বাড়ি থেকে তার ভার্সিটির সামনে আসতে ১৫ মিনিট লাগে। এতেই ঈশার মনে হচ্ছে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এই বাক্যটার মর্মার্থ বুঝে গেছে ঈশা। এতটুকু সময়ে অপেক্ষা করতে গিয়ে হাপিয়ে উঠেই ইলহাম কে প্রশ্ন করে বসলো। অথচ তার আগে একবারও ভাবলো না আসলেই সে দেরি করে ফেলেছে কিনা। নিজের কাজে নিজের উপরে বিরক্ত হলো। একদিকে অদ্ভুত রকমের একটা অপরাধ বোধ চেপে বসলো। ইভান ও তো তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। কই একবারও তো অভিযোগ করেনি। একবারও তো বলেনি সে কতোদিন আর অপেক্ষা করতে হবে। বরং বলেছে ঈশার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারবে সে। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠতেই ইলহাম বলল
— এতো গভির ভাবে কি ভাবছো তুমি? কখন থেকে একটা প্রশ্ন করছি উত্তর দিচ্ছ না।
ঈশা লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
— কিছু না। তুই কি বলছিস?
— তোমার এক্সাম কেমন হলো?
— হয়েছে।
মলিন কণ্ঠে বলল ঈশা। ইলহাম কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ঈশার মন খারাপ কিনা বোঝার চেষ্টা করলো। নরম কণ্ঠে বলল
— কি হয়েছে আপু? তোমার মন খারাপ?
ঈশা নিজেকে সাভাবিক করে নিলো। মুচকি হেসে বললো
— মন খারাপ না। আবহাওয়া দেখে কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম।
ইলহাম হেসে ফেললো। কারণ সেও জানে ঈশার এই আবহাওয়া ভীতির কথা। ঈশাও তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। দুজন গল্প করতে করতেই বাসায় পৌঁছে গেলো। ঈশা বাসায় ফিরেই ভেজা কাপড় ছাড়িয়ে একবারে গোসল সেরে ফেললো। দুপুরের খাবার শেষ করে সবাই ঘরে ঘরে চলে গেল। ঈশাও নিজের ঘরে গেলো রেস্ট নিতে। কিছু সময় পরেই বেজে উঠলো কলিং বেল। সদ্য লেগে আসা চোখটা মেলে তাকাল ঈশা। বিছানা ছাড়তে একদম ইচ্ছা করছে না। কেউ এসে যদি দরজা খুলে দেয় তাহলে সে আর উঠবেই না। কিন্তু কেউ দরজা খুললো না। পুনরায় কলিং বেল বেজে উঠতেই এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছাড়লো। যেতে যেতে এই অসময়ের অতিথিকে মনে মনে গালিও দিয়ে ফেললো। কিন্তু দরজা খুলেই সব কথা হারিয়ে গেলো। ক্লান্ত ইভানের মায়াভরা চেহারাটা দেখেই নিমেষেই সব বিরক্তি উধাও হয়ে গেলো। ইভান এক পলকেই পুরো ঈশা কে অতি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। আধ ভেজা চুলগুলো ঘাড় অব্দি পড়ে আছে। চেহারাটা সতেজ। কি অদ্ভুত স্নিগ্ধ এক দৃশ্য। ইভান এর মনে হলো তার ক্লান্ত চোখ জোড়া যেনো জুড়িয়ে গেলো। সতেজ হয়ে উঠলো মন মস্তিষ্ক। মন ভরে দেখা শেষ করেই ঈশা কে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। এই সময় ইভান কে বাসায় দেখে ঈশা অবাক হলো। অফিস শেষ করে বন্ধুদের সাথে বাইরে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত ৯ টা বেজে যায়। কিন্তু আজ বিকেলের আগেই চলে আসায় ঈশা নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলো না। তাই জিজ্ঞেস করেই বসলো
— এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলে যে? সব ব্যস্ততা শেষ হয়ে গেলো বুঝি?
ঈশার খোচামারা কথাটা খুব সহজেই ধরে ফেললো ইভান। থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে সরু চোখে ঈশার দিকে তাকাল। সে ইভানের সেই চাহুনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে টেবিলে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো খাওয়ার জন্য। ইভান অত্যন্ত সাভাবিক ভাবেই বলল
— বাসায় বউ রেখে বাইরে গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে রোম্যান্স টা ঠিক জমে উঠছিলো না। তাই তাড়াতাড়ি চলে আসলাম।
ইভান এর কথা শুনে ঈশা বিষম খেলো। অস্থির হয়ে উঠতেই ইভান তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। সাভাবিক করার চেষ্টা করলো। ঈশা সাভাবিক হতেই একটা লম্বা শ্বাস টেনে তাকাল ইভানের দিকে। কিন্তু ঠোঁটে লেগে থাকা সেই দুষ্ট হাসিটা ভীষণভাবে অপ্রস্তুত করে দিলো তাকে। চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই ইভান দুষ্টুমি করে বলল
— বাকি কথাটা কি শেষ করবো নাকি এখানেই থেমে যাবে?
ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। ইভান এর গভীর দৃষ্টির ফলে অস্থির হয়ে উঠতেই বলল
— তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি খাবার রেডি করছি।
বলেই উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলো। ইভান ঈশার অবস্থা বুঝেই হেসে ফেললো। কারণ ঈশা আজ বেশ জব্দ হয়েছে। এরপর থেকে এরকম খোঁচা মেরে কথা বলার আগে ভাবতে বাধ্য হবে। ঈশা খাবার রেডি করে দিলো টেবিলে। ইভান গোসল সেরে এসে খেতে বসলো। চুপচাপ বসে খাবার খাচ্ছে। ঈশা পাশের চেয়ার টেনে বসে বলল
— তখন কি করছিলে?
ইভান প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলল
— মিটিং এ ছিলাম।
— ডিস্টার্ব করেছি ফোন করে?
ইভান খেতে খেতেই খুব সাভাবিক ভাবে বলল
— সেরকম কিছু তো বলিনি। এতো বেশি বোঝা উচিত নয়। সহজ বিষয় সহজ ভাবে নেয়াই ভালো।
ঈশার মুখটা চাপা কোন কষ্টে কালো হয়ে গেলো। আহত কণ্ঠে বললো
— করিনি সেটাও তো বললে না। আর সব কথা তো মুখে উচ্চারণ করে বলতে হয়না। কথা বলার ধরন বুঝেই অনেক কিছু আন্দাজ করা যায়।
ইভান খাওয়া থামিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই এভাবে মন খারাপ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তার ভালো লাগলো না। জিজ্ঞেস করেই বসলো
— কি হয়েছে? মন খারাপ কেনো?
ঈশা চমকে গেলো। অচেনা এক অনুভূতি নিয়ে তাকাল ইভানের চোখে। তার মন খারাপটা ইভান বুঝতে পেরেছে। তার মানে ইভানের অভিমান কমে যাচ্ছে। ঈশা কে চুপ থাকতে দেখে নরম কণ্ঠে বলল
— আমি একটুও বিরক্ত হইনি। হলে সেটা আগেই বলে দিতাম। আমি স্পষ্ট কথা বলতেই বেশি পছন্দ করি। সব সময় সবকিছু মুখে বলা সম্ভব হয়না। পরিবেশ পরিস্থিতি কোনটাই সঙ্গ দেয়না। সেক্ষেত্রে একটু কষ্ট হলেও বুঝে নিতে হয়।
ঈশা মনে মনে ভীষন খুশি হলো। এতটাই যে তার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেশ ফুটে উঠলো। ইভান তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো বলে বিষয়টা সহজেই ধরতে পারলো। কিন্তু ঈশা সেটাকে পাত্তা না দিয়েই অভিমানটা গাঢ় করে ফেললো। অভিমানে সিক্ত কণ্ঠে বলল
— তোমাকে এক্সপেক্ট করেছিলাম। কিন্তু তুমি আসলে না।
ইভান উত্তর দিলো না। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাবারে মনোযোগ দিলো। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ভারী আওয়াজে বলল
— এক্সপেকটেশন কম থাকা ভালো। নাহলে কষ্টের শেষ থাকে না। আর পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে পরে সেই এক্সপেকটেশন কমিয়ে নিতেও অনেক কষ্ট হয়ে যায়। সেই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না।
ঈশা কোন কথা খুঁজে পেলো না। ইভান এর কষ্টটা সে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। কারণ সেও এখন সেই কষ্টের স্বীকার। ইভান এর গাঢ় অভিমানটা হালকা হলেও এখনো পুরোপুরি নিঃশেষ হয়নি। তার প্রভাবেই ইভান নিজের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ঈশার কাছে যেতে পারছে না। সবকিছু ঠিক থাকলেও কোথায় যেনো একটা বাধা কাজ করছে। এই বাধা পেরিয়ে ঈশার কাছে যাওয়া সম্ভব হলেও ইভান নিজে থেকে সেটা কখনোই করতে চাইবে না। কারণ সে এর আগে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর কষ্ট পেয়েছে বলেই নিজে নিজেই দুজনের মাঝে একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন হয়তো ঈশার পালা। ইভান এর নির্ধারণ করা সীমা অতিক্রম করে তাকে তার কাছে যেতে হবে। ইভান এর অভিমান ভাঙ্গানোর পালা এবার। এর জন্য যা কিছু করতে হয় সে করবে।
চলবে….